Loading AI tools
উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
ভূসমলয় কক্ষপথ বা জিওসিনক্রোনাস কক্ষপথ, (ইংরেজি: geosynchronous orbit) সংক্ষেপে জিএসও, একধরনের পৃথিবীকেন্দ্রিক কক্ষপথ যার কক্ষীয় পর্যায়কাল, পৃথিবীর আহ্নিক গতির সঙ্গে সমান, ২৩ ঘণ্টা ৫৬ মিনিট ৪ সেকেন্ড (এক নাক্ষত্র দিন)। পৃথিবীর আহ্নিক গতির সঙ্গে ভূসমলয় কক্ষপথের পর্যায়কাল সমান হওয়ার ফলে ঐ কক্ষপথে কোনো বস্তু ভূপৃষ্ঠ থেকে কোনো দর্শকের দৃষ্টিতে এক নাক্ষত্র দিন পরে আকাশের ঠিক একই বিন্দুতে ফিরে আসে। এক দিনের সময়ে আকাশে বস্তুটি স্থির থাকে বা একটি পথ বরাবর গমন করে, সাধারণত বাংলা সংখ্যা ৪-এর আকারে, যার নিখুঁত বৈশিষ্ট্য কক্ষপথটির নতি ও উৎকেন্দ্রের উপর নির্ভরশীল। এক বৃত্তাকার ভূসমলয় কক্ষপথের নির্দিষ্ট উচ্চতা ৩৫৭৮৬ কিলোমিটার।[1]
ভূসমলয় কক্ষপথের এক বিশেষ প্রকরণ হলো ভূস্থির কক্ষপথ বা জিইও, যা পৃথিবীর নিরক্ষীয় তলে অবস্থিত এক বৃত্তাকার ভূসমলয় কক্ষপথ এবং এর নতি ও উৎকেন্দ্রিকতা ০-এর সমান হয়। ভূস্থির কক্ষপথে কোনো উপগ্রহ ভূপৃষ্ঠের কোনো দর্শকের দৃষ্টিতে আকাশে একই অবস্থানে থাকে।[1]
যোগাযোগ উপগ্রহদের অনেকসময় ভূস্থির বা প্রায়-ভূস্থির কক্ষপথে পাঠানো হয় যাতে করে কৃত্রিম উপগ্রহদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষাকারী অ্যান্টেনাদের স্থানান্তরিত করতে না হয়, বরং আকাশে কৃত্রিম উপগ্রহটির স্থায়ী অবস্থানে দিকে অভিমুখ করে স্থায়ী ভাবে বসিয়ে দেওয়া যায়।[1]
১৯২৯ সালে হারমান পোতোচনিক বা হারমান নোরডুং জন্য ভূসমলয় কক্ষপথ ও ভূস্থির কক্ষপথদের মহাকাশ স্টেশনের জন্য উপযুক্ত বলে বর্ণনা করেছেন।[2] অক্টোবর ১৯৪২-এ জর্জ ও. স্মিথের প্রথম ভেনাস ইকুইল্যাটেরাল গল্পের মাধ্যমে জনপ্রিয় সাহিত্যে ভূসমলয় কক্ষপথের আবির্ভাব ঘটেছে,[3] তবে স্মিথ এর সম্পর্কে বিবরণ দেননি। ব্রিটিশ কল্পবিজ্ঞান লেখক আর্থার সি. ক্লার্ক ১৯৪৫-এ ওয়াইয়ারলেস ওয়ার্ল্ড পত্রিকায় প্রকাশিত এক্সট্রা-টেরেস্ট্রিয়াল রিলেজ পত্রে ভূসমলয় কক্ষপথের ধারণাকে জনপ্রিয় করেছিলেন।[4][5] ক্লার্ক প্রথম এই কক্ষপথকে সম্প্রচার ও রিলে যোগাযোগ উপগ্রহের জন্য উপযুক্ত বলে বিবরণ করেছেন,[5] এবং এটি অনেকসময় "ক্লার্ক কক্ষপথ" নামেও পরিচিত।[6] একইভাবে, এই কক্ষপথে কৃত্রিম উপগ্রহসমূহকে একত্রে "ক্লার্ক বলয়" বলা হয়।[7]
কারিগরি পরিভাষায় ভূসমলয় কক্ষপথকে অনেকসময় ভূস্থির কক্ষপথও বলা হয় যদি এটি প্রায় নিরক্ষরেখার উপর অবস্থিত হয়, তবে এই পরিভাষা দুটি অনেকসময় একের অপরের জন্য ব্যবহৃত হয়।[8] বিশেষ করে "ভূসমলয় ভূ-কক্ষপথ" (জিইও) শব্দটি "ভূসমলয় নিরক্ষীয় কক্ষপথ"[9] বা "ভূস্থির ভূ-কক্ষপথ" শব্দের সমর্থক হতে পারে।[10]
১৯৫৯ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হিউজ এয়ারক্রাফট কোম্পানিতে কাজ করার সময় হ্যারল্ড রোজেন প্রথম ভূসমলয় উপগ্রহের নকশা তৈরি করেছিলেন। সোভিয়েত ইউনিয়নের স্পুটনিক ১ উপগ্রহ দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি যোগাযোগের বিশ্বায়নের জন্য একটি ভূস্থির (ভূসমলয় নিরক্ষীয়) উপগ্রহ চেয়েছিলেন। তখন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের মধ্যে একসঙ্গে কেবল ১৩৬ জন ব্যক্তিদের মধ্যে টেলিযোগাযোগ সম্ভব ছিল, এবং এটি উচ্চ কম্পাঙ্কের বেতার যন্ত্র ও অন্তঃসামুদ্রিক কেবলের উপর নির্ভরশীল ছিল।[11]
তৎকালীন প্রচলিত মত অনুযায়ী ভূসমলয় কক্ষপথে কোনো কৃত্রিম উপগ্রহকে পাঠাতে অতিরিক্ত রকেট ক্ষমতার প্রয়োজন এবং এর ব্যয় ন্যায্য করার জন্য এটি বেশিক্ষণ বেঁচে থাকতে পারবে না।[12] সুতরাং প্রাথমিক প্রচেষ্টাগুলি নিম্ন ও মধ্য ভূ-কক্ষপথে উপগ্রহের কনস্টিলেশন তৈরির লক্ষ্যে সম্পন্ন করা হয়েছিল।[13] এর মধ্যে প্রথম প্রচেষ্টাটি হলো ১৯৬০-এর প্যাসিভ ইকো বেলুন উপগ্রহ। এর পরে ১৯৬২-এ টেলস্টার ১ উপগ্রহের প্রচেষ্টা করা হয়েছিল।[14] যদিও এইসব প্রকল্পে সিগনাল স্ট্রেংথ ও ট্র্যাকিঙের সমস্যা ছিল, ভূসমলয় উপগ্রহের ধারণাটি তখনও অকর্যকর বলে মনে হয়েছিল, সুতরাং হিউজ অনেকসময় এর জন্য তহবিল ও সমর্থনকে আটকে রাখত।[13][11]
ভূস্থির কক্ষপথ (ইংরেজি: geostationary orbit) বা ভূস্থির ক্রান্তিয় কক্ষপথ[15] বা জিইও পৃথিবীর ক্রান্তিয় অঞ্চলের ৩৫,৭৮৬ কিলোমিটার ওপরে পৃথিবীকে কেন্দ্র করে একটি ঘুর্ণায়মান গোলাকৃতি কক্ষপথ। এই কক্ষপথে কোন বস্তুর ঘূর্নন গতি পৃথিবীর আহ্নিক গতির সমান অর্থাৎ পৃথিবী যে সময়ে একবার নিজ অক্ষে আবর্তন করে ঠিক একই সময়ে কৃত্রিম উপগ্রহটি পৃথিবীকে একবার আবর্তন করে।[16] ভূস্থির কক্ষপথে অবস্থিত কৃত্রিম উপগ্রহগুলিকে পৃথিবী থেকে পর্যবেক্ষণ করা হলে তা একই জায়গায় অবস্থান করে বলে মনে হয়। আবহাওয়া ও যোগাযোগ উপগ্রহগুলো সাধারণত ভূস্থির কক্ষপথে স্থাপন করা হয়।
ভূস্থির উপগ্রহগুলো যেহেতু পৃথিবীর একটি নির্দিষ্ট স্থানের উপর স্থির থাকে তাই এর সংকেত গ্রহণ করার অ্যান্টেনাগুলোকে সংকেত গ্রহণের জন্য তাদের অবস্থার পরিবর্তন করতে হয় না। অ্যান্টেনাগুলো আকাশের একটি নির্দিষ্ট দিকে তাক করে স্থায়ী ভাবে বসিয়ে দেওয়া যায়। ভূস্থির কক্ষপথ ভূসমলয় কক্ষপথের একটি প্রকরণ।
১৯২৮ ভূসমলয় কক্ষপথের সর্বপ্রথম ধারণা দেন হারমান নোরডুং।[17] তবে তিনি ব্যপকভাবে এই ধারনাটি ব্যাখ্যা দেন নি। পরবর্তিতে বিখ্যাত ব্রিটিশ বিজ্ঞান কল্পকাহিনী লেখক আর্থার সি ক্লার্ক এই ধারনাটির উপর সামগ্রিক আলোকপাত করেন। ১৯৪৫ সালে তিনি এই বিষয়ে একটি লেখা প্রকাশ করেন যার নাম ছিল "এক্সট্রা টেরিস্ট্রিয়াল রিলে" । এই প্রকাশনাতে তিনি কৃত্রিম উপগ্রহের মাধ্যমে সারা বিশ্বে যুগপৎ ভাবে বেতার সম্প্রচার করার একটি ধারণা প্রদান করেন।[18] এজন্য এই কক্ষপথকে "ক্লার্ক অরবিট" ও বলা হয়।[19]ভূসমলয় কক্ষপথে বিভিন্ন বস্তুদের কক্ষপথ উৎকেন্দ্রিক বা আনত বা উভয় হয়। উৎকেন্দ্রিকতার ফলে কক্ষপথটি উপবৃত্তাকার হয় এবং ভূ-উপগ্ৰহ কেন্দ্র থেকে এটি আকাশে পূর্ব থেকে পশ্চিমে দুলতে থাকে বলে মনে হয়। আবার, নতির ফলে কক্ষপথটি নিরক্ষরেখার সাপেক্ষে কাত করে এবং এটি ভূ-উপগ্ৰহ কেন্দ্র থেকে আকাশে উত্তর থেকে দক্ষিণে দুলতে থাকে বলে মনে হয়। এই প্রভাবদুটিকে একত্রিত করলে এক অ্যানালেমা গঠিত হয়,[20]:১২২ যা দেখতে বাংলা সংখ্যা ৪-এর মতো।
উপবৃত্তাকার বা উৎকেন্দ্রিক কক্ষপথে উপত্রহগুলিকে পরিচালনাযোগ্য ভূ-উপগ্ৰহ কেন্দ্রের মাধ্যমে অনুসরণ করা উচিত।[20]:১২২
ভূসমলয় উপগ্রহদের এক সম্মুখী কক্ষপথে পাঠানোর জন্য পূর্বদিকে মুখ করে উৎক্ষেপণ করা হয় যাতে করে নিরক্ষরেখার আহ্নিক গতির সঙ্গে সমতা বজায় রাখে। কোনো কৃত্রিম উপগ্রহকে উৎক্ষেপণ করার জন্য ন্যূনতম কক্ষীয় নতি হলো উৎক্ষেপণ স্থানটির অক্ষাংশ, সুতরাং নিরক্ষরেখার কাছ থেকে উপগ্রহটিকে উৎক্ষেপণ করা হলে পরবর্তীকালে কক্ষীয় নতি পরিবর্তন কম করতে হয়।[21] এছাড়া, নিরক্ষরেখার কাছ থেকে উৎক্ষেপণ করার ফলে পৃথিবীর আহ্নিক গতিবেগ উপগ্রহটির বেগ বৃদ্ধি করে। কোনো উৎক্ষেপণ স্থানের পূর্বদিকে যেন পানি বা মরুভূমি থাকে, যার ফলে কোনো ব্যর্থ হওয়া রকেট কোনো জনবসতির উপর আছড়ে পড়ে না।[22]
বেশিরভাগ উৎক্ষেপক যান ভূসমলয় উপগ্রহদের এক ভূসমলয় স্থানান্তর কক্ষপথে (জিটিও) সরাসরি পাঠানো হয়। এটি একটি উপবৃত্তীয় কক্ষপথ যার অপভূ ভূসমলয় উচ্চতায় এবং অনুভূ তুলনায় নিম্ন উচ্চতায় থাকে। এরপর, কৃত্রিম উপগ্রহের ভিতরকার প্রপালসন ব্যবস্থার মাধ্যমে অনুভূর উচ্চতা বৃদ্ধি করে কক্ষপথটিকে এক বৃত্তে পরিণত করে ভূসমলয় কক্ষপথে পৌঁছয়।[21][23]
এক উপযুক্ত ভূস্থির কক্ষপথে পৌঁছনোর পর মহাকাশযানটি তার অর্ধ-পরাক্ষকে পরিবর্তন করার মাধ্যমে তার দ্রাঘিমাংশীয় অবস্থানকে পরিবর্তন করতে পারে যাতে করে নতুন পর্যায়কালটি এক নাক্ষত্র দিনের থেকে কম বা বেশি হয়। এর ফলে পূর্ব বা পশ্চিমদিকে এক আপাত "বিচ্যুতি" উৎপন্ন করা যায়। লক্ষ্য দ্রাঘিমাংশে পৌঁছনোর পর মহাকাশযানটির পর্যায়কালকে পুনরায় ভূসমলয়ে পরিবর্তন করা হয়।[24]
ভূসমলয় কক্ষপথের এক বিস্তৃত রূপ হলো তাত্ত্বিক মহাকাশ উত্তোলক। এর একপ্রান্ত ভূপৃষ্ঠের সঙ্গে যুক্ত করা হলে ভূস্থির বলয়ের থেকে কম উচ্চতায় উত্তোলকটির কক্ষীয় পর্যায়কাল অভিকর্ষজ বলের তুলনায় কম হবে।[25]
নিজ অবস্থান বজায় রাখার জন্য ভূসমলয় উপগ্রহদের কিছু স্টেশন-কিপিঙের প্রয়োজন হয়। থ্রাস্টার জ্বালানি শেষ হয়ে গেলে এবং এটি আর ব্যবহারযোগ্য না হলে উপগ্রহটিকে উচ্চতর সমাধি কক্ষপথে স্থানান্তরিত করা হয়। ভূসমলয় উপগ্রহদের কক্ষপথচ্যুত করা সম্ভব নয়, কারণ কক্ষপথটিকে সামান্য উন্নীত করার তুলনায় এটি অনেক বেশি জ্বালানি ব্যয় করবে। এছাড়া বায়ুমণ্ডলীয় ড্র্যাগ নগণ্য, যার ফলে ভূসমলয় উপগ্রহদের হাজার বছরের মেয়াদ থাকে।[26]
অবসরপ্রাপ্তির এই প্রক্রিয়াটিকে ক্রমশ নিয়ন্ত্রিত করা হয়েছে এবং জীবনের শেষে কৃত্রিম উপগ্রহদের ২০০ কিমির বেশি উচ্চতার কক্ষপথে স্থানান্তর করার ৯০% সম্ভাবনা থাকতে হবে।[27]
যেকোনো ভূসমলয় কক্ষপথের দুটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য আছে:
সমস্ত ভূসমলয় কক্ষপথের পর্যায়কাল ঠিক এক নাক্ষত্র দিনের সমান।[28] অর্থাৎ, প্রতি (নাক্ষত্র) দিন ভূপৃষ্ঠের উপর একই বিন্দুতে ভূসমলয় উপগ্রহটি ফিরে আসে।[29][20]:১২১ এই পর্যায়কালটি (T) নিম্নলিখিত সমীকরণের দ্বারা কক্ষপথটির অর্ধ-পরাক্ষের সঙ্গে জড়িত:
যেখানে:
যেকোনো ভূসমলয় কক্ষপথের যেকোনো নতি থাকতে পারে।
ভূসমলয় উপগ্রহের কক্ষীয় নতি সাধারণত শূন্য রাখা হয়, যার ফলে কক্ষপথটি সর্বদা নিরক্ষরেখার উপর থাকে এবং এটি ভূপৃষ্ঠের কোনো দর্শকের দৃষ্টিভঙ্গিতে এটি অক্ষাংশের সাপেক্ষে স্থির থাকে।[20]:১২২
ভূসমলয় কক্ষপথের আরেক জনপ্রিয় নতি হলো তুন্দ্রা কক্ষপথের ৬৩.৪° নতি, যার ফলে কক্ষপথটির অনুভূর আর্গুমেন্ট সময়ের সঙ্গে পরিবর্তিত হয় না।[30]
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.