১৮২৪ থেকে ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বার্মায় ব্রিটিশ শাসন কায়েম ছিল৷ ইঙ্গ-বর্মা যুদ্ধের পর থেকে প্রাথমিকভাবে বর্মার কিছু অংশ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হলেও ধীরে ধীরে বর্মার দেশীয় রাজ্যগুলি ব্রিটিশ ভারতের প্রদেশগুলির একটি হয়ে ওঠে৷ পরে ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে সম্পূর্ণ বর্মা ব্রিটিশ উপনিবেশভুক্ত হয় এবং ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে তা পূর্ণ স্বাধীনতা পায়। ব্রিটিশ শাসনকালে এই অঞ্চলটি "ব্রিটিশ বর্মা" নামে পরিচিত ছিলো। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৮২৬ খ্রিস্টাব্দে প্রথম ইঙ্গ-বর্মা যুদ্ধে জয়লাভ করে বর্মা রাজ্যক্ষেত্রের একাধিক অঞ্চল যেমন, আরাকান রাজ্য (রাখাইন প্রদেশ) এবং টেনাসেরিম বিভাগ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত করে নেয়৷ ১৮৫২ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় ইঙ্গ-বর্মা যুদ্ধে ব্রিটিশ বাহিনী দক্ষিণ বর্মার পেগু বা পেগুইয়োমা এবং তৎসংলগ্ন অঞ্চল দখল করে এবং সেখানে একটি মুখ্য কমিশনার নিয়োগ করেন৷ ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে " ব্রিটিশ বর্মা"কে "ব্রিটিশ ভারত"-এর অন্তর্ভুক্ত করে একটি অভিন্ন একক হিসাবে শাসন পরিচালনা শুরু হয়৷[1]

দ্রুত তথ্য ব্রহ্মদেশ বর্মা, অবস্থা ...
ব্রহ্মদেশ

বর্মা
১৮২৪-১৯৪৮
১৯৪২-১৯৪৫: নির্বাসিত সরকার
Thumb
জাতীয় মর্যাদাবাহী নকশা
জাতীয় সঙ্গীত: গড সেইভ দ্য কিং (১৮২৪-১৮৩৭; ১৯০১-১৯৪৮)
গড সেইভ দ্য কুইন (১৮৩৭-১৯০১)
Thumb
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ
অবস্থাব্রিটিশ ভারতের প্রদেশ এবং
যুক্তরাষ্ট্রের উপনিবেশ
রাজধানীমৌলমেইন
(১৮২৬-১৮৫২)
ইয়াঙ্গুন
(১৮৫৩-১৯৪২)
শিমলা
(১৯৪২-১৯৪৫)
রেঙ্গুন
(১৯৪৫-১৯৪৮)
নির্বাসনে রাজধানীশিমলা, ব্রিটিশ ভারত
(১৯৪২-১৯৪৫)
প্রচলিত ভাষাইংরাজী (সরকারী)
বর্মী (আঞ্চলিক)
ধর্ম
বৌদ্ধধর্ম, খ্রিস্টধর্ম, হিন্দুধর্ম, ইসলাম
ব্রিটিশ রাজা/রাণী 
 ১৮৬২-১৯০১
ভিক্টোরিয়া
 ১৯০১-১৯১০
সপ্তম এডওয়ার্ড
 ১৯১০-১৯৩৬
পঞ্চম জর্জ
 ১৯৩৬
অষ্টম এডওয়ার্ড
 ১৯৩৬-১৯৪৮
ষষ্ঠ জর্জ
গভর্নর 
 ১৯২৩-১৯২৭
স্পেন্সর হারকোর্ট বাটলার (প্রথম)
 ১৯৪৬-১৯৪৮
হুবার্ট এলভিন রেন্স (অন্তিম)
মুখ্য কমিশনার 
 ১৮৬২-১৮৬৭
আর্থার পারভেজ ফেয়ার (প্রথম)
 ১৮৯৫-১৮৯৭
ফ্রেডারিক উইলিয়াম রিচার্ড ফ্রায়ের (অন্তিম)
আইন-সভাব্রিটিশ বর্মা বিধানসভা পরিষদ (লেজিসলেটিভ কাউন্সিল অব বর্মা) (১৮৯৭-১৯৩৬)
বর্মা আইন-পরিষদ (লেজিসলেচার অব বর্মা) (১৯৩৬-১৯৪৭)
 উচ্চকক্ষ
সেনেট
 নিম্নকক্ষ
দূত নিবাস
ঐতিহাসিক যুগঔপনিবেশিক ভারত
 প্রথম ইঙ্গ-বর্মা যুদ্ধ
৫ই মার্চ ১৮২৪
১৮২৪-১৮২৬, ১৮৫২, ১৮৮৫
১৯১৮-১৯৪২
 ব্রিটিশ সাম্রাজ্য থেকে পৃৃথকীকরণ
১৯৩৭
 জাপানের অধিগ্রহণ and থাই অধিগ্রহণ
১৯৪২-১৯৪৫
 যুক্তরাষ্ট্র থেকে স্বাধীনতালাভ
৪ঠা জানুয়ারী ১৯৪৮
মুদ্রাবর্মী রুপি, ভারতীয় টাকা, পাউন্ড স্টার্লিং
পূর্বসূরী
উত্তরসূরী
ব্রিটিশ সাম্রাজ্য
কোনবাউং রাজবংশ
বর্মা রাজ্য
বর্মা রাজ্য
বার্মায় থাই শাসন
স্বাধীনতা পরবর্তী সংযুক্ত বর্মা (১৯৪৮-১৯৬২)
বর্তমানে যার অংশ মিয়ানমার
বন্ধ

১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে তৃতীয় ইঙ্গ-বর্মা যুদ্ধ|তৃতীয় ইঙ্গ-বর্মা যুদ্ধে জয়লাভ করে ব্রিটিশ বাহিনী উত্তর বর্মার বিস্তীর্ণ অঞ্চলের দখল নিলে সমগ্র বর্মাই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ে৷ উত্তর বর্মাকেও "ব্রিটিশ ভারতের" অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং "বর্মা প্রদেশ" নামে একটি বৃৃহৎ প্রদেশ গঠন করা হয়৷ ব্রিটিশ শাসনকালে প্রদেশটির গুরুত্ব বৃৃদ্ধি পেলে এবং সুশাসনের লক্ষ্যে প্রদেশটিতে ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে একজন প্রশাসনিক লেফ্টেন্যান্ট নিয়োগ করা হয়৷[1] বর্মা অফিস গঠন করে বর্মাকে "সেক্রেটারি অব স্টেট ফর ইন্ডিয়া অ্যান্ড বর্মা"র অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে বর্মাকে ব্রিটিশ ভারত থেকে পৃৃথক ঘোষণা করা অবধি এই প্রশাসনিক নিয়ম লাগু থাকে৷ পরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন একাধিক ব্রিটিশ ঔপনিবেশের সাথে বর্মাতে জাপানের অধিগ্রহণ হলে সেখানে ব্রিটিশ শাসন বিপর্যস্ত হয়৷ পরে তা আবার আবার যুক্তরাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হলে ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের ৪ঠা জানুয়ারী বর্মা পূর্ণ স্বাধীনতা পায়৷

বর্মা যেহেতু অধিকাংশ সময়ে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বদলে স্কটিশবাসী তথা স্যার জেমস স্কটের তত্ত্বাবধানে এবং ইরাবতী ফ্লোটিলা কোম্পানির অধীনে শাসিত হতো এবং অন্যান্য স্কটিশ প্রশাসনের প্রভাবই বেশি থাকতো তাই ঐতিহাসিকরা বর্মাকে "স্কটিশ উপনিবেশ" বলতেই অধিক স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন৷

ব্রিটিশ আধিপত্যের পূর্বে বর্মা

ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বর্মা ছিলো ভারত এবং চিনের মধ্যবর্তী কম কষ্টসাধ্য ও সহজে অতিক্রম্য বাণিজ্য পথ সরাসরি বর্মার ওপর দিয়ে যেতো, যা বর্মাকে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ঐশ্বর্যশালী করে তোলে৷ এছাড়াও স্বয়ং সম্পূর্ণ চাষাবাদের প্রাচুর্য অঞ্চলটিকে অর্থনৈতিকভাবে উন্নত করেছিলো৷ পূর্বে ভারতীয় পণ্যব্যবসায়ীরা সমুদ্র উপকূল বরাবর বা নদীপথ (বিশেষত ইরাবতী নদী) ধরে বাণিজ্য করতেন৷ এই অঞ্চলগুলিতে প্রচুর সংখ্যাক জাতিতে বর্মীরা বাস করতেন ফলে সেখানে ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির গভীর ছাপ পড়ে, যা আজও স্পষ্ট৷ বর্মা বা ব্রহ্মদেশই ছিলো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রথম দেশ যারা ভারতে প্রবর্তিত বৌদ্ধধর্মকে আপন করে নেয়, যা পরবর্তীতে ব্রহ্মদেশের দাপ্তরিক ও সংখ্যাগুরু পৃৃষ্ঠপোষিত ধর্মে পরিণত হয়৷

ব্রিটিশদের বর্মা বিজয় এবং উপনিবেশ স্থাপনের পূর্বে শাসনরত কোনবাউং রাজবংশ সেখানে দৃৃঢ়সংলগ্ন কেন্দ্রীভূত শাসনব্যবস্থা স্থাপন করতে সক্ষম হয়৷ রাজা মূখ্য কার্যনির্বাহকের ভূমিকা পালন করতেন যার সিদ্ধান্তই সকলক্ষেত্রে অন্তিম ও সর্বজনগ্রাহ্য বলে ধরা হতো৷ তবে তিনি প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক বিষয়ে আদেশ দিতে পারলেও নতুন আইন বলবৎ করতে অপারক ছিলেন৷ দেশটিতে তিন ধরনের আইন কোড চলতো, সেগুলি হলো, "রাজথট", "দম্মাথট" এবং "হ্লুত্তউ"৷ কেন্দ্রীয় সরকার তিনটি শাখায় বিভক্ত ছিলো যথা; রাজকোষসম্বন্ধীয়, সম্পাদন-শাস্তিমূলক এবং বিচারবিভাগীয়৷ তথ্যপ্রমাণ অনুসারে হ্লুত্তউ আইনের ভারপ্রাপ্ত সর্বেসর্বা ছিলেন রাজা নিজেই এবং রাজার একাধিপত্য দমন করার জন্য যতক্ষণ না কোনো স্থানে বা কোনো বিষয়ে হ্লুত্তউ আইন বলবৎ হচ্ছে ততক্ষণ সেই স্থানের অধিবাসীবৃৃন্দ রাজার হুকুম মানতে বাধ্য নয়৷ দেশটি একাধিক ক্ষুদ্র প্রদেশে বিভক্ত ছিলো যা রাজার হ্লুত্তউ আইনের অধীনে প্রশাসনিক ব্যক্তিত্ব দ্বারা নিয়োগ করা হতো৷ আবার আলাদা আলাদাভাবে গ্রামাঞ্চলগুলিতে রাজা বা ঐ প্রদেশের ভারপ্রাপ্ত ব্যক্তির নির্বাচিত শিরোমণি পরিবারের যোগ্য সদস্য দ্বারা শাসিত হতো৷[2]

বর্মায় ব্রিটিশের আগমন

Thumb
১৮২৪ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে রেঙ্গুন নৌবন্দরে ব্রিটিশ নৌবাহিনীর প্রবেশ

কোনবাউং রাজবংশের শাসকরা ব্রিটিশ ভারতের অধীনস্থ চট্টগ্রাম নৌবন্দর বেষ্টন করে আসাম রাজ্য পর্যন্ত আরাকান রাজ্যের সীমানা প্রসারিত করতে চাইলে বর্মার রাজবংশ ও ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মধ্যে সংঘর্ষ বাঁধে৷ ১৭৮৪ থেকে ১৭৮৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্রে বর্মী সেন্যবাহিনীর হাত থেকে আরাকান সাম্রাজ্য বেদখল হওয়ার পর ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দে তারা আবার তা পুণর্দখল করার চেষ্টা করে ও সীমান্ত অতিক্রম করে৷ এটিই ছিলো ১৮২৪ থেকে ১৮২৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ঘটে যাওয়া প্রথম ইঙ্গ-বর্মা যুদ্ধর অন্যতম প্রধান কারণ৷ ব্রিটিশরা এসময় রেঙ্গুন পর্যন্ত একটি বৃৃহৎ সমুদ্রচালিত অভিযান চালালে ১৮২৪ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বিনাযুদ্ধে তারা রেঙ্গুন দখল করে৷ মান্দালয়ের নিকট আভা(ইনোয়া)-এর দক্ষিণে অবস্থিত দনুব্যু অঞ্চলে বর্মী সেনাধ্যক্ষ মহা বন্ধুল নিহত হন ও তার সেনাবাহিনী নিকেষ করা হয়৷ বর্মা আসাম সহ উত্তর দিকের প্রদেশগুলি ব্রিটিশদের হাতে তুলে দিতে বাধ্য হয়৷[3] ১৮২৬ খ্রিস্টাব্দে ইয়াণ্ডাবু সন্ধির মাধ্যমে ব্রিটিশ ভারতে দীর্ঘতর, বিপুল অর্থক্ষয়ী এবং অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রথম ইঙ্গ-বর্মা যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে৷ সরকারী হিসাবে পনেরো হাজার ইউরোপীয় এবং ভারতীয় সৈন্য সহ অগণিত বর্মী সৈন্য ও সাধারণের মৃৃত্যু হয় এবং উভয়পক্ষেরই বহু মানুষ আহত হয়৷[4] হিসাব মতো ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনীর সেনাছাউনি বাবদ খরচ হয় ৫ মলিয়ন পাউন্ড এবং সর্বমোট খরচ ১৩ মিলিয়ন পাউন্ড, যার বর্তমান মূল্য ২০০৬ খ্রিস্টাব্দের বাজারদরে প্রায় ১৮.৫ এবং ৪৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার৷[5] এই বিপুল পরিমান অর্থক্ষয় ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দ অবধি ব্রিটিশ ভারতে অর্থনীতিকে চরম সঙ্কটাপন্ন করে৷[6]

১৮৫২ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশরা সিঙ্গাপুর এবং কলকাতার নোবন্দরের মধ্যবর্তী দক্ষিণ বর্মার সেগুন বন দাবী করে৷ বর্মীরা তৎক্ষণাৎ ব্রিটিশ গুপ্তচরকে বর্মা থেকে সরিয়ে নেওয়া পাল্টা দাবী তোলেন৷ ফলে দীর্ঘ ২৫ বছর শান্তিচুক্তির পরে ১৮৫২ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় ইঙ্গ-বর্মা যুদ্ধ শুরু হয়৷ ব্রিটিশরা যুদ্ধশেষে জয়লাভ করে এবং দক্ষিণ বর্মার একটি বিস্তীর্ণ অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তার করে এবং দাবীকৃত সেগুনবন, তেল এবং উত্তর বর্মার অমূল্যসম্পদ লাভ করে৷

রাজা মিন্দন মিন এই আধিপত্য এবং ঔপনিবেশিকতা আটকানোর ও প্রশাসনিক পুণর্বিন্যাসের যথাসাধ্য চেষ্টা করেন৷ তিনি প্রশাসনিক সংস্কার করে বর্মাকে বিদেশী আকর্ষনের জন্য আরো সুগ্রাহী করে তোলেন৷ কিন্তু ব্রিটিশরা সুকৌশলে তৃতীয় ইঙ্গ-বর্মা যুদ্ধের সূচনা করে, যা ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে ঘটে এবং দুসপ্তাহ পর্যন্ত স্থায়ী হয়৷ ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তাদের আক্রমনের পিছনে যুক্তি দেখান যে, বর্মার শেষ স্বাধীন রাজা থিবৌ মিন একজন অত্যাচারী রাজা ছিলেন এবং ষড়যন্ত্র করে তার দেশে ফ্রান্সের প্রভাব বৃৃদ্ধি করতে চাইছেন৷ ব্রিটিশ সৈন্যদল ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দের ২৮ শে নভেম্বর মান্দালয়ে প্রবেশ করে৷ এভাবে তিনটি যুদ্ধের পর এক এক করে ব্রিটিশ বাহিনী সমগ্র বর্মার ওপর নিজ অধিপত্য কায়েম করতে সফল হয়৷ এরপরে ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দের ১লা জানুয়ারী বর্মা ব্রিটিশ ভারতের একটি প্রদেশ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে৷[2]

ব্রিটিশরা উত্তর বর্মার বিস্তীর্ণ অঞ্চল নিজের উপনিবেশের অন্তর্ভুক্ত করে এবং পুরো বর্মাকে "ব্রিটিশ বর্মা" নামে একটি প্রদেশ হিসাবে "ব্রিটিশ ভারত"-এর আওতায় আনে৷ ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দের ২৬শে ফেব্রুয়ারি মাসে উত্তর ও দক্ষিণ বর্মাকে একত্রিত করে একটি বৃৃহত্তর প্রদেশে পরিণত করা হয়৷[7]

Thumb
চিত্রগ্রাহক উইলগবাই ওয়ালেসের তোলা তৃতীয় ইঙ্গ-বর্মা যুদ্ধের শেষে ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দের ২৮শে নভেম্বরে ব্রিটিশ বাহিনির মান্দালয়ে আগমন

প্রাক ব্রিটিশ শাসন

দ্রুত তথ্য ওলন্দাজ ভারত, দিনেমার ভারত ...
ঔপনিবেশিক ভারত
Thumb
ঔপনিবেশিক ভারত
ওলন্দাজ ভারত১৬০৫–১৮২৫
দিনেমার ভারত১৬২০–১৮৬৯
ফরাসি ভারত১৭৬৯-১৯৫৪
পর্তুগিজ ভারত
(১৫০৫–১৯৬১)
কাসা দা ইন্দিয়া১৪৩৪–১৮৩৩
পর্তুগিজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি১৬২৮–১৬৩৩
ব্রিটিশ ভারত
(১৬১২–১৯৪৭)
ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি১৬১২–১৭৫৭
কোম্পানি রাজ১৭৫৭–১৮৫৮
ব্রিটিশ রাজ১৮৫৮–১৯৪৭
বার্মায় ব্রিটিশ শাসন১৮২৪–১৯৪৮
দেশীয় রাজ্য১৭২১–১৯৪৯
ভারত বিভাজন
১৯৪৭
বন্ধ
Thumb
১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দে জে. জ্যাকসনের তোলা রেঙ্গুন স্ট্র্যান্ড রোডের জেলা আদালত ও অফিস
Thumb
ব্রিটিশ অফিসার থিবৌ মিনকে জাহাজে করে ভারতে নির্বাসিত করছেন৷ তাঁকে এরপর বর্মায় আর দেখা যায়নি৷

১৮৮৫ থেকে ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে একাধিকবার বিক্ষাপ্তভাবে বর্মী সেনাবাহিনী ব্রিটিশদের প্রতিরোধ করার চেষ্টা করলে ব্রিটিশ সেনাধিনায়ক উচ্চ আদালতকে দমননীতি চালিয়ে যাওয়ার জন্য বাধ্য করে৷ সরকারীভাবে দু'সপ্তাহের মধ্যে তৃৃতীয় ইঙ্গ-বর্মা যুদ্ধ নিষ্পত্তি পেলেও ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত একাধিক বার উত্তর বর্মা থেকে বিদ্রোহ ঘোষিত হয়৷ ব্রিটিশ বাহিনী গ্রামগুলির নিয়মানুগ ক্ষয়ক্ষতি করে নতুন অফিসার নিয়োগ করে শেষ পর্যন্ত এই গেরিলা কার্যকলাপ আপাতভাবে বন্ধ করতে সক্ষম হয়৷

ঐতিহ্যশালী বর্মী সমাজ রাজবংশ এবং স্বধর্মীয় শাসনতন্ত্র এবং স্বশাসন বিনষ্ট হওয়ার পরে বহুলাংশে রদবদল করে৷ স্থানীয় বর্মী এবং বহিরাগত ইউরোপীয়দের আন্তর্বিবাহে ইউরেশীয় (মিশ্র পরিচয়)|ইউরেশীয় সম্প্রদায়ের উৎপত্তি ঘটে, যারা ইঙ্গ-বর্মী নামে পরিচিত৷ এরাই পরবর্তীকালে বর্মার বৃৃহত্তর জাতিতে পরিণত হয়, তারা ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যে ব্রিটিশ ও স্থানীয় বর্মী মধ্যবর্তী স্থান পায়৷

ব্রিটিশ বাহিনী সমগ্র বর্মার ওপর আধিপত্য বিস্তার করলেও তারা চিনের প্রতি আনুগত্য দেখিয়ে চিনকে রাজত্ব দেওয়া চালিয়ে যায় কিন্তু বিশেষ কারণে তারা চিনের সম্মুখে তাদের পুরানো পদমর্যাদা হারায়৷[8] ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দের বর্মা সম্মেলনে চিন এবং ব্রিটিশ উভয়পক্ষ এটা স্থির করে যে উত্তর বর্মায় চিন ব্রিটিশ আধিপত্য মেনে নেবে এবং এর পরিবর্তে ব্রিটিশ আগামী দশ বছরের জন্য সমগ্র বর্মা থেকে সা যাবতীয় রাজস্ব বেজিংকে দান করবে৷[9]

প্রশাসন

ব্রিটিশ কোম্পানি তাদের সদ্যপ্রাপ্ত নতুন প্রদেশটিতে প্রত্যক্ষ শাসনপ্রক্রিয়া কায়েম করে এবং পুরাতন প্রশাসনিক স্তরে একাধিক পরিবর্তন সাধন করে৷ রাজতন্ত্র বিলুপ্ত করে দেওয়া হয়৷ রাজা থিবৌকে ভারতে নির্বাসনে পাঠানো হয় এবং সাধারণ মানুষের ধর্মাচারণের সাথে শাসকতন্ত্রের মধ্যে মতবিভেদ সৃষ্টি হয়৷ এটা বিশেষ করে বৌদ্ধ সমাজর জন্য খুব ক্ষতিকর ছিলো কারণ বৌদ্ধভিক্ষুরা এতদিন অবধি রাজার দানের ওপর নির্ভর ছিলেন৷ একই সময়ে বৌদ্ধ সংস্থাগুলির রাজতন্ত্রের কার্যকলাপের বৈধতা চর্চা করতো আবার চার্চগুলি জনসাধারণকে জাতীয় রাজনীতি সম্পর্কে সচেতন করতো৷[2]

ব্রিটিশদের তাদের নতুন এই উপনিবেশ সরাসরিভাবে নিয়ন্ত্রণ করার আরেকটি পন্থা ছিলো একটি ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষাক্ষেত্র ও শাসনতন্ত্রের নির্মান৷ ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসিত ভারত সরকার তাদের নতুন উপনিবেশে ধর্মনিরপেক্ষ বিদ্যালয় স্থাপন করার সাথে সাথে ছাত্রদের স্থানীয় বর্মী ভাষা এবং কোম্পানির ইংরাজী ভাষায় বিদ্যাদানের প্রচলন করে৷ এসময়ে তারা খ্রিস্টান মিশনারীদের সাথে বিদ্যমান বিদ্যালয় পরিদর্শন ও নতুন বিদ্যালয় স্থাপনের পরিকল্পনায় রত হয়৷ পুরানো এবং নতুন উভয় প্রকার বিদ্যালয়ে বৌদ্ধধর্মের চর্চা এবং বর্মী সংস্কৃৃতি উপেক্ষিত হয়৷ বর্মীরা এই সময় ব্রিটিশ সংস্কৃৃতির আগ্রাসন নীতির বিরুদ্ধে একত্রিত হতে থাকে৷[2]

উত্তর বর্মাকে গ্রামস্তর থেকে নিপুনভাবে শাসন পরিচালনা করার জন্য গ্রামাঞ্চলে তার নতুন দমন নীতির প্রচলন করে৷ এই নীতি অনুসারে যে সমস্ত পরিবারের মুখ্য লোক উক্ত গ্রামের সর্বেসর্বা হিসাবে নিযুক্ত থাকতেন সেই পরিবারগুলির বাড়িতে অগ্নি সংযোগ করে তাদের সেখান থেকে তাড়ানো হয় এবং দক্ষিণ বর্মায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়৷ এই পরিস্থিতিতে ব্রিটিশরা স্থানীয় বর্মী প্রধানদের সেখান থেকে তাড়িয়ে তার পরিবর্তে তাদের পছন্দমতো নতুনদের নিয়োগ করতন৷[2]

ব্রিটিশ বর্মার বিভাগসমূহ

১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দের পরে ব্রিটিশ বর্মার প্রদেশগুলি ছিলো নিম্নরূপ -

  1. সরকারী বর্মা (মূল বর্মা)
  2. টেনাসেরিম বিভাগ (তাউঙ্গো জেলা, থাটোন জেলা, আমহার্স্ট জেলা, সালউইন জেলা, তাভয় জেলা এবং মেরগুই জেলা)
  3. আরাকান রাজ্য (সিত্বে বা আকিয়ব জেলা, উত্তর আরাকান বা আরাকানইয়োমা জেলা, কিওউকপু জেলা, থান্ডবে জেলা)
  4. পেগু বিভাগ (রেঙ্গুন শহর, পেগু জেলা, থেরাবতী জেলা, প্রোম জেলা)
  5. ইরাবতী বিভাগ (বেসেইন জেলা, হাঞ্জাদা জেলা, থায়েৎমো জেলা, মাউবিন জেলা, মংমা জেলা, প্যাপোন জেলা)
  6. সীমান্তবর্তী তফশিলী অঞ্চলসমূহ
  7. শান রাজ্য
  8. চিন পার্বত্য অঞ্চল
  9. পার্বত্য কাছিন

সীমান্তবর্তী রাজ্যটি একাধিক তফশিলি জাতি অধ্যুষাত থাকায় এটিকে তফশিলি অঞ্চল বা বহির্ভূত এলাকা বলেও উল্লেখ করা হতো৷ বর্তমানে মিয়ানমারের সর্বাধিক সংখ্যক জেলা এই অঞ্চলগুলিতেই রয়েছে৷ এই অঞ্চলগুলি প্রাথমিকভাবে ব্রিটিশরা নিজেদের উপনিবেশ থেকে পৃৃথক করে রাখলেও পরে তা মূল বর্মার সাথে যুক্ত করা হয়, যা আজও মিয়ানমারের ভৌগোলিক সীমারেখা নির্দেশ করে৷ সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলি মূলত চিন, শান, কাছিন ও ইয়াং জনগোষ্ঠীর সংখ্যালঘু লোকেরা বসবাস করতেন৷

১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে বর্ম আটটি প্রশাসনিক বিভাগে এবং প্রতিটি বিভাগ একাধিক জেলায় বিভক্ত ছিলো৷[10]

  1. আরাকান রাজ্য - (আকিয়ব জেলা, পার্বত্য আরাকান বা আরাকানইয়োমা, কিওউকপু জেলা, থান্ডবে জেলা)
  2. মাগওয়ে বিভাগ (পার্বত্য চিন, মাগওয়ে জেলা, মিনবু জেলা, পাকোকু জেলা, থায়েৎমো জেলা)
  3. মান্দালয় বিভাগ (কউকসে জেলা, মান্দালয় জেলা, মেইকটিলা জেলা, মিঙ্গান জেলা)
  4. টেনাসেরিম বিভাগ (তাউঙ্গো জেলা, থাটোন জেলা, আমহার্স্ট জেলা, সালউইন জেলা, তাভয় জেলা, মেরগুই জেলা)
  5. পেগু বিভাগ (রেঙ্গুন শহর, হান্থাবতী জেলা, পেগু জেলা, থেরাবতী জেলা, প্রোম জেলা)
  6. ইরাবতী বিভাগ (বাসেইন জেলা, হেঞ্জাদা জেলা, মাউবিন জেলা, মংমা জেলা, প্যাপোন জেলা)
  7. সাগাইং বিভাগ (ভামো জেলা, নিম্ন চিনদ্বিন জেলা, উচ্চ চিনদ্বিন জেলা, কাঠা জেলা, মিৎক্যিনা জেলা, সাগাইং জেলা, হুকং উপত্যকা এবং জিংপো অঞ্চলসমূহ)
  8. শান যুক্তরাজ্য (উত্তর শান জেলা, পূর্ব শান জেলা, মধ্য শান জেলা, মিয়েলাত শান জেলা, করেন্নি জেলা, কেংতুং এবং যংঘে জেলা)
Thumb
১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে "বর্মা প্রদেশ"-এর প্রশাসনিক বিভাগসমূহ

ঔপনিবেশিক অর্থনীতি

Thumb
১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে তোলা রেঙ্গুনের মাদ্রাজ লেন্সর রোডের ধারে শাকসব্জির দোকান

বর্মার পরম্পরাগত অর্থনীতি ছিলো বর্মীদের তৈরী মূল্যবান পণ্যদ্রব্যাদির, যা অন্যান্য দেশগুলিতে বাণিজ্য করে তারা দেশের অর্থনীতিকে মজবুত করেছিলো৷ দেশটির অর্থনীতি কৃৃষিকাজে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার ফলে তাদের কাছে বাণিজ্যপ্রথার প্রচলন তেমন ছিলো না৷ ভারত ও চীনের মধ্যবর্তী বাণিজ্যপথটিও এই দেশের মধ্য দিয়ে বিস্তৃৃত ছিলো, যা দেশটিকে বৈদেশিক মুদ্রালাভে সহায়ক হয়৷ ব্রিটিশ আগমনের সাথে বর্মার অর্থনীতি বিশ্বজনীন নিবন্ধিত হওয়া শুরু হয়, যা দেশটিকে ঔপনিবেশিক রপ্তানি বাণিজ্যের অংশীদার করতে বাধ্য করে৷[2]

বর্মার যোগদান ব্রিটিশ অর্থনীতিতে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে৷ নাটকীয়ভাবে সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রকৃৃতি পরিবর্তিত হয়৷ ব্রিটিশরা বর্মার মহামূল্যবান জমি ব্যবহার করার জন্য ইরাবতী নদী (মিয়ানমার)। ইরাবতী নদীর দুধারের ঘন ম্যানগ্রোভ অরণ্য কেটে ফেলার ব্যবস্থা করে৷ মিয়ানমারে প্রধান এবং পর্যাপ্ত পরিমান উৎপাদিত ফসল ছিলো ধান, আবার ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে সুয়েজ খাল তৈরীর পর থেকে ইউরোপে চাউলের চাহিদা বৃৃদ্ধি পেতে থাকে৷ ধানের উৎপাদন বৃৃদ্ধি করার জন্য অনেক বর্মী বর্মার উত্তরভাগ থেকে দক্ষিণে নদীদ্বীপ অঞ্চলগুলিতে বসতি স্থাপন করা শুরু করে। এভাবে জনঘনত্বের বিন্যাস বদল হতে থাকে এবং সম্পত্তি ও ক্ষমতার ভিত্তি পরিবর্তন হওয়া শুরু হয়।[2]

যেহেতু ব্রিটিশ ব্যাঙ্কগুলিতে কিছু বন্ধক রেখে টাকা পাওয়ার ব্যবস্থা ছিলো না তাই বর্মার দেশীয় কৃৃষক সম্প্রদায়ের লোকেরা ভারতের মহাজনদের কাছ থেকে চড়া সুদে টাকা ধার করা শুরু করে৷ ভারতীয় মুনাফাদাররা কৃষকদেরকে চড়া সুদে কৃৃষিঋণ দিতো এবং বন্ধকের ব্যবস্থা থাকলেও ঋণগ্রহীতার অবস্থা ভালো না থাকলে তা পাওয়া যেত না।

একই সময় ব্যাপক সংখ্যক ভারতীয় শ্রমিকরা বর্মাতে গমন করে৷ তাদের অধিক কর্মদক্ষতা এবং কম চাহাদার কারণে দ্রুত তারা বর্মী শ্রমিক ও চাষীদের প্রতিস্থাপিত করতে থাকে৷ ফলে স্থানীয়রা বাধ্য হয়ে বর্মী-ভারতীয়দের ওপর দুষ্কর্ম করা শুরু করে[2] এবং চুরি ডাকাতি করে একেরপর এক গ্রাম নষ্ট করতে থাকে যা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিপক্ষে তাদের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলেছিল।

কর্মদক্ষতা বাড়ার সাথে সাথে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত অর্থনীতি দ্রুত কৃৃষিভিত্তিক শিল্পের আকার নেয়৷ ইরাবতী নদী উপত্যকা অঞ্চলে পরিবহনের সুবিধায় রেলপথ বসে এবং বহু জাহাজ ও নৌকা ভিড়বার জন্য নদীবন্দরটির হালনাগাদ করা হয়৷ পরিবহনের এই সমস্ত যানবাহন পরিষেবা পুরোপুরিভাবে ব্রিটিশদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতো৷ বর্মার অর্থনীতি যদিও বৃদ্ধি পাচ্ছিলো তৎসত্ত্বেও স্থানীয় সমাজের ওপর এঅ উত্তরোত্তর বৃদ্ধিপ্রাপ্ত অর্থনীতির বিশেষ কোনো প্রভাব পড়েনি৷[2]

বর্মার অর্থনীতি উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকলে সেখানে প্রায় সবকিছুই ব্রিটিশদের ক্ষমতায় চলে আসে এবং ব্রিটিশ খামারগুলি এবং ভারত থেকে যাওয়া অভিবাসীদেরই প্রতিপত্তি বাড়তে থাকে৷ ইঙ্গ-বর্মী এবং অভিবাসী ভারতীয়রা অধিকাংশ শিল্পক্ষেত্রগুলিতে চাকরি দখল করা শুরু করে এবং ভূমিজ বর্মীরা সবকিছু থেকে বঞ্চিত হয়৷ সৈন্যবাহিনীতেও ভূমিজদের জায়গা না দিয়ে ভারতীয় ও কারেন (জনগোষ্ঠী)কারেন সহ বর্মার অন্যান্য ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীদের স্থান রাখা হতো৷ ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দের শুরুর দিকে রেঙ্গুনে প্যাট্রিক ও'সুলিভান-এর পরিকল্পনায় প্রথম সুব্যবস্থাপন্ন একটি ব্রিটিশ জেনারেল হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা হয়৷ দেশ উন্নতি করলেও ভূমিজ বর্মীরা তার লাভ তুলতে অক্ষম ছিলো৷ (ব্রিটিশ বর্মার কল্পিত চিত্রণ করতে জর্জ অরওয়েলের "বর্মীজ ডেইস" উপন্যাসটি পড়ুন)।

১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশদের কার্যালয়ে নিযুক্ত একজন প্রত্যক্ষদর্শী করনিকের বৃৃষ্টিতে বর্মী লোকেদের জীবনশৈলী এবং তাদের কঠোর শ্রম ও বৈদেশিক বিপননের সাথে খাপ খাইয়ের নেওয়ার বিবরণ নিম্নরূপ -

“Foreign landlordism and the operations of foreign moneylenders had led to increasing exportation of a considerable proportion of the country’s resources and to the progressive impoverishment of the agriculturist and of the country as a whole…. The peasant had grown factually poorer and unemployment had increased….The collapse of the Burmese social system led to a decay of the social conscience which, in the circumstances of poverty and unemployment caused a great increase in crime.”[11]

(অনুবাদ - বিদেশী ভূস্বামী নিয়োগ এবং কুসীদজীবিদের কার্যকলাপে দেশীয় উৎসগুলির ব্যপকহারে রপ্তানিকরণ চলে যা সামগ্রিকভাবে প্রগতিশীল দেশটি কৃৃষক সম্প্রদায়ের দারিদ্রতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়৷ কৃৃষকরা দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর হতে থাকে এবং বেকারত্ব বাড়তে থাকে৷ বর্মী সমাজের তাচ্ছিল্যতায় সামাজিক নীতিগুলির অধঃপতন হয়৷ এমতাবস্থিয় দারিদ্র ও বেকারত্ব দেশের অপরাধ হার বাড়িয়ে দেয়।)

জাতীয়তাবাদী আন্দোলন

Thumb
১৯১১ খ্রিস্টাব্দে রেঙ্গুন ও তৎসংলগ্ন মানচিত্র

শতাব্দী ঘোরার সাথে সাথে ইয়ং ম্যান খ্রিস্টান অ্যাসোসিয়েশনের আদলে বৌদ্ধদের মধ্যেও ইয়ং ম্যান বৌদ্ধ অ্যাসোসিয়েশন তৈরী হয়, যাদের ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে নতুন আন্দোলন গঠন করতে দেখা যায়৷ তারা পরবর্তীকালে জেনারেল কাউন্সিল অব বর্মী অ্যাসোসিয়েশন-এর সাথে সংযোজিত হয়৷ সংগঠন দুটি "উন্থানু আথিন"-এর সাথে যুক্ত হয়ে মুল বর্মার গ্রামে-গঞ্জে ছড়িয়ে পড়ে৷[12] ১৯০০ থেকে ১৯১০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে উ ধম্মলোকা নামে এক আইরিশ বৌদ্ধ ব্যক্তি সরাসরি জনসমক্ষে খ্রিস্টধর্ম এবং সাম্রাজ্যবাদী ক্ষমতার ওপর প্রশ্ন করে এবং সমর্থকদের সাথে দুবার রাজদ্রোহ ঘোষণা করে৷

বিংশ শতাব্দীর শরুর দিকে বর্মী নেতাদের একটি নতুন প্রজন্মের উত্থান হয়৷ তাদের মধ্যে যারা শিক্ষিত পরিবার থেকে আসতো তারা লন্ডনে আইনবিষয়ক উচ্চশিক্ষা লাভ করতে যেত কারণ তারা মনে করেছিলো তাদের এই অভাজ্ঞতা তাদের স্বজাতীয় বর্মীদের বর্তমান অবস্থান উন্নতি ও পুণর্গঠনে সাহায্য করবে৷ সাংবিধানিক উন্নয়ন এবং ১৯২০ এর শুরুর দিকে তার পুণর্গঠনের ফলে আইনসভাতে ব্রিটিশ একাধিপত্য কমে আসে এবং ভারতে যুক্ত থেকেও বর্মাতে আংশিক স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠা পায়৷ বেসামরিক চাকুরীতে জাতিতে বর্মী নিয়োগ বৃদ্ধি করার জন্য বিভিন্ন প্রচেষ্টায় চাপ সৃষ্টি করা হয়৷ অনেকে মনে করেন পরিবর্তনের হার প্রয়োজনীয়তার তুলনায় কম হলেও এই চাপ সৃষ্টি ও সামান্য কর্মসংস্থান বৃদ্ধিও বেশ কার্যকর ছিলো৷

১৯২০ খ্রিস্টাব্দে বর্মার ইতিহাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা প্রথম ছাত্র ধর্মঘট করে৷ তারা নতুন বিশ্ববিদ্যালয় আইনের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানায় কিরণ তারা মনে করেছিলো যে সেই আইনে একশ্রেণীর বিত্তবান এবং ঔপনিবেশাকদেরই লাভ হবে৷ দেশজুড়ে জাতীয় বিদ্যালয়গুলিতে বিদ্রোহর আগুন ছড়িয়ে পড়ে এবং তারা এই ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থা থেকে নিস্তার দাবী করে৷ ধর্মঘটের দিনটি দেশজুড়ে জাতীয় দিবস হিসাবে পালিত হয়৷[12] "উন্থানু আথিন"-এর নেতৃৃত্বে ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের শেষের দিকে আবার আয়কর বিরোধী সর্বজনীন প্রতিবাদ সংগঠিত হয়৷ প্রকৃষ্টভাবে বৌদ্ধভিক্ষু ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা এই আন্দোলনে যোগ দেন, তাদের মধ্যে উ ওত্তামা ও আরাকান থেকে "উ শেইন্দা" স্বাধীনতার দাবী তুলে ব্রিটিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র জাতীয়তাবাদী আন্দোলন গড়ে তোলেন৷ দীর্ঘকালীন অনশন ধর্মঘটের ফলে উ উইসারা আন্দোলনের প্রথম মরণোত্তর শহিদ হন এবং ব্রিটিশ হেফাজতে কারাগারে মৃৃত্যুবরণ করেন৷[12]

১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ডিযেম্বর মাসে সায়া সান-এর নেতৃৃত্বে থেরাবতী অঞ্চলে স্থানীয় কৃষিকর সংক্রান্ত বিদ্রোহ শুরী হয় যা আঞ্চলিক বিদ্রোহ থেকে ক্রমশ সরকারবিরোধী দেশব্যপী বিদ্রোহের রূপ নেয়৷ আন্দোলন দুবছর ধরে চলে৷ আন্দোলনকারীরা ব্রিটিশ বাহিনীকে নাগ অর্থাৎ সাপের সাথে তুলনা করে নিজেদের সংগঠনের চিহ্ন হিসাবে নাগনাশী গরুড়কে (স্থানীয় উচ্চারণ গলোন) চয়ন করে৷ বাদ্রোহ দমনের জন্য হাজার হাজার ব্রিটিশ সৈন্য নিয়োগ করা হয়, বহু স্থানীয় নেতা গ্রেপ্তার ও কৃৃষক লুন্ঠনের পর রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতিদানের মাধ্যমে আন্দোলন সফল হয়৷ সায়া সানের এই নেতৃত্ব তাকে ভবিষ্যতে বর্মী জাতীয়তাবাদী মুখ করে তুলেছিলো৷ অন্যান্য যারা এই বিদ্রোহে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন তারা হলেন মাউবিন থেকে "বা মউ" এবং ওকফো থেকে "উ সও"৷[12]

১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে ডোবামা এশিয়ায়োয়ান (আমরা বর্মী সংগঠন) প্রতিষ্টা করা হয়, যাদের সদস্যরা নিজেদের "থাকিন" বলে উল্লেখ করতো ("থাকিন" শব্দটি একটি বর্মী শব্দ যার ইংরাজী অর্থ "মাষ্টার" বা ভারতীয় শব্দ "সাহেব"-এর সাথে অধিক সামঞ্জস্যপূর্ণ)৷ তারা নিজেদেরকে দেশের রক্ষাকর্তা মনে করতো এবং উপনিবেশবিরোধী কার্যকলাপে নিযুক্ত থাকতো৷[12] দ্বিতীয়বারের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র আন্দোলনটি হয় ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে৷ একই সময়ে রেঙ্গুন বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি দেওয়াল পত্রিকার লেখার ওপর ভিত্তি করে বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চপদস্থ আধিকারিক আক্রমনের সম্মুখীন হয়৷ এইসময়ে ছাত্রনেতা হিসাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে "আউং সান" এবং "কো নু" নাম দুটি উঠে আসে যাদের নেতৃত্বে ছাত্র আন্দোলন ফলপ্রসূ এবং অগ্নগর্ভ হয়ে উঠেছিলো৷ এই আন্দোলন মান্দালয় অবধি ছড়িয়ে পড়ে এবং "অল বর্মা স্টুডেন্ট ইউনিয়ন" (আবসু) বা নিখিল বর্মা ছাত্র সংগঠন প্রতিষ্ঠা পায়৷ "আউং সান" এবং "কো নু" উভয়েই ছাত্র আন্দোলনের মুখ থেকে দেশব্যাপী থাকিন আন্দোলনে যোগ দেয়৷[12]

ভারত ভেঙে বর্মার সৃষ্টি

ব্রিটিশরা ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ ভারত ভেঙে বর্মা প্রদেশটিকে পৃৃথক রাষ্ট্র ঘোষণা করে[13] এবং তাদের এই উপনিবেশকে পূর্ণ নির্বাচন সমাবেশের অন্তর্ভুক্ত করে নতুন সংবিধান রচনা করে৷ এর সাথে তারা প্রশাসনিকসহ বিভিন্ন পদে স্থানীয় বর্মীদের নিয়োগ করা শুরু করে৷ কিন্তু কিছু বর্মীর মতে এই বিভাজন নীতির ফলে ভারতীয় কোনো উন্নয়ন বা পুণর্গঠনে বর্মা চিরকালের জন্য বঞ্চিত হবে কারণ ভারতের লোকবল ছিলো বর্মার চেয়ে অনেক বেশি৷ বা মাও বর্মার প্রথম প্রধানমন্ত্রী পদে নিযুক্ত হন কিন্তু ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে উ সও তাকে এই পদ থেকে অব্যহতি দিতে বাধ্য করে৷ ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দ থেকে তিনি স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন হলেও জাপানের সাথে মিত্রতার কথা আঁচ করতে পেরে ব্রিটিশ সরকার ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে ১৯ শে জানুয়ারী তাকে গ্রেপ্তার করলে তিনি প্রধানমন্ত্রীত্ব হারান৷

কেন্দ্রীয় বর্মার তৈলক্ষেত্রগুলি থেকে একাধিকবার ধর্মঘট-আন্দোলন ও প্রতিবাদ কর্মসূচী চলতে থাকে, এরকমই ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে ঘটে যাওয়া একটি আন্দোলন বর্মা জুড়ে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে৷ রেঙ্গুনে জনসাধারণের সমর্থনে ছাত্র সংগঠনের পিকেটিন এবং বয়কট কর্মসূচী চলতে থাকে৷ ব্রিটিশ শাসনদণ্ড এই আন্দোলনের জন্য ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদী সরকারকে দোষী সাব্যস্ত করলে তাদের সেনাবাহিনী রেঙ্গুন বিশ্ববিদ্যালয়ে ধরপাকড় শুরু করে ও "আং কিয়ৌ" নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রের মৃত্যু হয়৷ মান্দালয়ে পুলিশবাহিনীবিদ্রোহীদের জনসমাবেশে এলোপাথারি গুলি ছুঁড়লে ১৭ জন বৌদ্ধসন্যাসীর ঘটনস্থলেই মৃত্যু হয়৷ এর পর থেকে এই রক্তক্ষয়ী আন্দোলন মিয়ানমারের বর্মীপঞ্জিতে "১৩০০র বিপ্লব" বা স্থানীয় ভাষায় হ্তাউং থৌন ইয়াব্যেই আয়ৈদবোন" নামে পরাচিত৷[12] এবং ২০ শে ডিসেম্বর দিনটিতে এই আন্দোলনের প্রথম শহিদকে স্মরণ করে বো আং কিয়ৌ দিবস[14]

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন

Thumb
১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে বর্মায় ব্রিটিশবাহিনীর অবস্থান

জাপান ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে বর্মা আক্রমণ করে এবং ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে রাজধানী রেঙ্গুনে সরাসরি এই ঘোষণা করা হয়৷ জাপান কখনোই সম্পূর্ণ ব্রিটিশ বর্মার ওপর নিজের আধিপত্য কায়েম করতে পারেনি, যদিও জাপানের কার্যকলাপ সন্দেহজনক ও বেশ অনুপ্রবেশপ্রবণ ছিলো৷ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্যান্য উপনিবেশগুলির ক্ষেত্রে জাপানের এই নীতির লক্ষ্য করা যায় না৷ ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশরা বর্মায় ব্রিটিশ ভারতীয় সেনা নামালে তারা জাপানি অনুপ্রবেশ সরিয়ে বর্মায় আবার নিজেদের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়৷

জাপানের আত্মসমর্পণ ও আং সানের গুপ্তহত্যা

জাপানের আত্মসমর্পণ বর্মায় সামরিক প্রশাসনের জন্ম দেয়৷ জাপানকে সাহায্য করা এবং ব্রিটিশ বিরোধীতার জন্য ব্রিটিশ প্রশাসন আং সান এবং বি.আই.এ. এর অন্যান্য সদস্যদের খুঁজতে তৎপর হয়৷[15] লর্ড লুই মাউন্টব্যাটেন আং সানের জনপ্রিয়তার কথা স্বীকার করে বুঝতে পারেন যে তাকে ধরতে ব্রিটিশদের বেশ বেগ পতে হতে পারে৷ [12] যুদ্ধ সমাপ্তি ঘটলে কর্নেল রেজিনাল্ড ডোরম্যান-স্মিথ বর্মা থেকে ফেরৎ যান৷ পুণঃপ্রতিষ্ঠিত সরকার একটি রাজনৈতিক অনুষ্ঠান সম্পাদন করে, যা রাষ্ট্রের বাস্তবিক পুণর্বিন্যাসকে তুলে ধরে এবং তাদের পরিকল্পিত স্বাধীনতা দেওয়ার আলোচনা কিছুটা পিছিয়ে দেয়৷ এ.এফ.পি.অফ.এল রাজনৈতিক অস্থিরতার কথা উল্লেখ করে রাষ্ট্রব্যাপী সরকার বিরোধীতা শুরু করে৷ সংগঠনটিতে বর্মা কমিউনিস্ট পার্টি এবং আং সানের মধ্যে সামাজিক পরিকল্পনাগত মতবিরোধ দেখা যায়৷ ফলস্বরূপ ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে "থান টুন" সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে অব্যহতি দেন এবং ঐ বছর অক্টোবর মাসর মধ্যে সংগঠনটি থেকে বর্মার কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যরা বেরিয়ে আসে৷[12]

ডোরম্যান-স্মিথ কে বদলি করে মেজর জেনারেল স্যার হুবার্ট রান্সকে নতুন গভর্নর হিসাবে বর্মায় আনা হয়৷ তার বর্মায় আসার কিছু দিনের মধ্যেই রেঙ্গুনে সৈন্যবাহিনী কর্মবিরতি ঘোষণা করে৷ ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে এই ধর্মঘট শুরু হয় এবং পুলিশবাহিনী থেকে সরকারী কর্মচারীরাও এই ধর্মঘট সমর্থন করলে এটি সাধারণ ধর্মঘটের রূপ নেয়৷ রান্স আং সানের সাথে দেখা করেন এবং পরিস্থিতি পূর্বাবস্থিয় ফিরিয়ে আনতে সচেষ্ট হন৷ তিনি আং সানকে তার সংগঠনের সদস্যসহ সরকারী কার্যনির্বাহী পরিষদে যোগ দেওয়া জন্য মানিয়ে নেন৷[12] বিশ্বাসযোগ্য পরিচালনায় নতুন কার্যনিরাবাহী পরিষদের সুনাম পায় দেশজুড়ে জনচর্চিত হতে থাকে৷ এই পরিচালনার ফলে বর্মার স্বাধীনতা বিষয়টি আলোচ্য হিসাবে ব্রিটিশ কাউন্সিলে উঠে আসে এবং ২৭শে জানুয়ারী ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে উভয়ের মধ্যে ক্লিমেন্ট এট্‌লি চুক্তি সফলভাবে সাক্ষর হয়৷[12]

বর্মার কম্যিউনিস্ট দলের বামপন্থী সদস্যরা এবং এ.এফ.পি.এফ.এল এর রক্ষণশিল সদস্যরা এই চুক্তির কিছু দাবী মেনে নিতে পারেনি ফলে সদস্য কর্তৃৃত্ব দ্বারা বামপন্থীরা সদস্যরা দুর্ব্যবহার পায় ও রক্ষণশীলরা সদস্যরা এর বিপক্ষে কথা বলে৷ আং সান ভাষাগত সংখ্যালঘুদের সমর্থন জোগাড় করে একটি একত্রিত অখণ্ড বর্মা গঠনের লক্ষ্যে ১২ই ফেব্রুয়ারি পাংলং সম্মেলন|পাংলং সম্মেলনে একটি চুক্তিপত্র পেশ করতে সক্ষম হন এবং দিনটি বর্মায় "ঐক্যের দিবস" নামে পরিচিতি পায়৷[12][16] চুক্তি সাক্ষরের অল্প সময়ের মধ্যেই আরাকান প্রদেশে এক অভিজ্ঞ সন্যাসী উ শেইন্দার নেতৃৃত্বে বিদ্রোহ ঘোষিত হয়, যা সমগ্র জেলাটিতে ছড়িয়ে পড়ে৷[12] এইসময়ে এ.এফ.পি.এফ.এল - এতে আং সান এবং সমাজবাদীদের জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে৷ এর প্রভাবে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে এপ্রিল মাসে বিধানসর্ভা নির্বাচনের ফল ঘোষণা হলে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার সাথে নিরঙ্কুশভাবে আং সানের দল বিজয়ী ঘোষত হয়৷[12]

১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৯শে জুলাই বর্মাতে ঘটে যাওয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা দেশজুড়ে স্তব্ধতা সৃষ্টি করে৷ এক রক্ষণশীল প্রাকযুদ্ধকালীন প্রধানমন্ত্রী "উ সাও" নেতা আং সানের গুপ্তহত্যার পরিকল্পনা করে৷ আলোচনা সভায় একত্রিত হয়ে "উ সাও", তার মন্ত্রিসভার বিশ্বস্ত সদস্যগণ এবং বর্তমান গণতন্ত্রের জন্য জাতীয় লীগের জনক এবং তার জ্যেষ্ঠভ্রাতা "শেইন উইন" এবং তার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা "বা উইন" এই গুপ্তহত্যার ছক কষেন৷[12][17] এরপর থেকে বর্মাতে ১৯ শে জুলাই দিনটিকে জাতীয় বর্মী শহিদ দিবস হিসাবে পালন করা হয়৷ সমাজবাদী দলের দলনেতা "থাকিন নু" এরপরে নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করে এবং ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের ৪ঠা জুলাই মন্ত্রীত্ব পদে আসিন হয়ে বর্মা স্বাধীনতা অধিনিয়ম, ১৯৪৭-এর বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দিতে থাকেন৷ বর্মা একটি পূর্ণ স্বাধীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের পক্ষে সায় দেয় এবং স্বাধীনতার পরে ব্রিটিশ অধিরাজ্য হয়ে থাকতে নাকচ করে৷ এটি ছিলো ভারত এবং পাকিস্তানের যুগ্ম স্বাধীনতা সিদ্ধান্তের পারভাব কারণ তারা উভয়ই স্বশাসিত অধিরাজ্য এবং পূর্ণ স্বাধীনতাকে বেছে নিয়েছিলো৷ শুধু তাই নয় উভয় দেশের স্বাধীনতার প্রভাবে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ থেকেই বর্মাতে ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতাকামী মনোভাব বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছিলো৷[12]

তথ্যসূত্র

Wikiwand in your browser!

Seamless Wikipedia browsing. On steroids.

Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.

Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.