Loading AI tools
উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
ফাতেমা জিন্নাহ (উর্দু: فاطمہ جناح; ৩০ জুলাই ১৮৯৩ – ৯ জুলাই ১৯৬৭)[1] ছিলেন একজন পাকিস্তানি দন্তচিকিৎসক, জীবনীলেখক, রাজনীতিবিদ ও পাকিস্তানের নেতৃত্বস্থানীয় প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম একজন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দন্ত চিকিৎসায় ডিগ্রি লাভ করার পর তিনি তার বড় ভাই মুহাম্মদ আলি জিন্নাহর সহকর্মী ও উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করা শুরু করেন। ভারতে ব্রিটিশ শাসনের তিনি একজন কঠোর সমালোচক ছিলেন। দ্বিজাতি তত্ত্বের পক্ষে তিনি কথা বলেছিলেন এবং নিখিল ভারত মুসলিম লীগের একজন নেতৃস্থানীয় সদস্য হয়ে উঠেন। পাকিস্তানের স্বাধীনতার পর ফাতেমা জিন্নাহ পাকিস্তান ওমেনস এসোসিয়েশন গঠন করেন। নবগঠিত রাষ্ট্রে অভিবাসীদের পুনর্বাসনের জন্য এই সংগঠন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। মুহাম্মদ আলি জিন্নাহর মৃত্যুর পর তিনি তার নিজস্ব কাজ চালিয়ে যান তবে ১৯৬৫ সালের আগ পর্যন্ত রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন না। এসময় তিনি সামরিক শাসন আইয়ুব খানের বিপক্ষে নির্বাচনে অংশ নেন।[2]
মাদারে মিল্লাত ফাতেমা জিন্নাহ | |
---|---|
فاطمہ جناح | |
বিরোধীদলের নেতা | |
কাজের মেয়াদ ১ জানুয়ারি ১৯৬০ – ৯ জুলাই ১৯৬৭ | |
পূর্বসূরী | পদ স্থাপিত |
উত্তরসূরী | নুরুল আমিন |
ব্যক্তিগত বিবরণ | |
জন্ম | ফাতেমা আলি জিন্নাহ ৩০ জুলাই ১৮৯৩ কাথিয়াবাড়, বোম্বে প্রেসিডেন্সি, ব্রিটিশ ভারত (বর্তমান গুজরাত, ভারত) |
মৃত্যু | ৯ জুলাই ১৯৬৭ ৭৩) করাচি, পাকিস্তান | (বয়স
সমাধিস্থল | মাজারে কায়েদ |
নাগরিকত্ব | পাকিস্তানি |
জাতীয়তা | পাকিস্তানি |
রাজনৈতিক দল | নিখিল ভারত মুসলিম লীগ (১৯৪৭ সালের পূর্বে) মুসলিম লীগ (১৯৪৭-১৯৫৮) স্বতন্ত্র (১৯৬০-১৯৬৭) |
সম্পর্ক | জিন্নাহ পরিবার দেখুন |
প্রাক্তন শিক্ষার্থী | কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় |
পেশা | দন্ত চিকিৎসক |
ধর্ম | ইসলাম |
দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকার পর ফাতেমা জিন্নাহ ১৯৬৭ সালের ৯ জুলাই করাচিতে মৃত্যুবরণ করেন। পাকিস্তানে সর্বাধিক সম্মানিত নেতাদের মধ্যে তিনি অন্যতম। নাগরিক অধিকার, পাকিস্তান আন্দোলন ও তার ভাইয়ের সহকর্মী হিসেবে তাকে সম্মান করা হয়। এছাড়া তাকে মাদারে মিল্লাত (জাতির মা) ও খাতুনে পাকিস্তান (পাকিস্তানের নারী) বলেও সম্বোধন করা হয়। অনেক প্রতিষ্ঠান ও স্থান তার নামে নামকরণ করা হয়েছে।[3]
ফাতেমা জিন্নাহ ১৮৯৩ সালের ৩০ জুলাই করাচিতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন তার পিতা জিন্নাহভাই পুনজা ও তার মা মিঠাবাইয়ের সাত সন্তানের মধ্যে কনিষ্ঠ।[1] ভাইবোনদের মধ্যে মুহাম্মদ আলি জিন্নাহ তার বেশি ঘনিষ্ঠ ছিলেন। ১৯০১ সালে পিতার মৃত্যুর পর জিন্নাহ তার অভিভাবক হন।[3] ১৯০২ সালে তিনি বোম্বের বান্দ্রা কনভেন্টে যোগ দেন। ১৯১৯ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। তিনি সেখানকার ড. আর আহমেদ ডেন্টাল কলেজে পড়াশোনা করেন। স্নাতক হওয়ার পর ফাতেমা জিন্নাহ ১৯২৩ সালে বোম্বেতে একটি ডেন্টাল ক্লিনিক চালু করেন।[4]
ফাতেমা জিন্নাহ তার ভাই মুহাম্মদ আলি জিন্নাহর সাথে ১৯১৮ সাল পর্যন্ত অবস্থান করেছিলেন। এসময় মুহাম্মদ আলি জিন্নাহ রতনবাই পেটিটকে বিয়ে করেন। ১৯২৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে রতনবাইয়ের মৃত্যুর পর ফাতেমা জিন্নাহ তার ক্লিনিক বন্ধ করে ভাইয়ের কাছে চলে যান। এরপর থেকে তিনি তার ভাইয়ের সাথে অবস্থান করেছেন।[3]
মুহাম্মদ আলি জিন্নাহর বিভিন্ন জনসভায় ফাতেমা জিন্নাহ অংশ নিতেন।[5] ১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের সময় তিনি ওমেনস রিলিফ কমিটি গঠন করেন। পরে রানা লিয়াকত আলি খান কর্তৃক তা অল পাকিস্তান ওমেনস এসোসিয়েশনের নিউক্লিয়াস গঠন করে। এছাড়া ফাতেমা জিন্নাহ ভারত থেকে আসা মুহাজিরদের পুনর্বাসনের জন্য কাজ করেছেন।[6]
১৯৬০ এর দশকে ফাতেমা জিন্নাহ রাজনীতিতে ফিরে আসেন। এসময় পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি পদের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খানের বিপক্ষে দাঁড়ান।[7] তার প্রথমদিকের মিছিলের সময় ঢাকায় প্রায় ২,৫০,০০০ মানুষ জড়ো হয়েছিল। সেখান থেকে চট্টগ্রামের পথে ২৯৩ মাইলের মত পথে প্রায় দশ লক্ষ লোক জড়ো হয়। ফ্রিডম স্পেশাল নামক তার ট্রেন ২২ ঘণ্টা দেরিতে ছাড়ে কারণ প্রতি স্টেশনে মানুষ তার বক্তৃতার জন্য আহ্বান জানাচ্ছিল। এসময় তাকে মাদার ই মিল্লাত (জাতির মা) বলে সম্বোধন করা হয়।[3]
তার কর্মসূচিতে ফাতেমা জিন্নাহ বলেন যে ভারতের সাথে সিন্ধু পানি চুক্তি করে আইয়ুব খান নদীর নিয়ন্ত্রণ ভারতের হাতে তুলে দিয়েছেন। নির্বাচনে তিনি পরাজিত হন। তবে কিছু প্রদেশে তার সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল।
১৯৬৫ সালে নির্বাচনের সময় তার বয়স ছিল ৭১ বছর। ১৯৫৪ সালে পূর্ব পাকিস্তানে তার সংক্ষিপ্ত সফর ছাড়া স্বাধীনতার পর থেকে রাজনীতিতে তিনি অংশ নেননি। তার ভাইয়ের কারণে তিনিও সম্মানিত ছিলেন এবং গণতান্ত্রিক ক্ষেত্রে তাকে প্রতীক হিসেবে দেখা হতে থাকে। ১৯৬৫ সালে নির্বাচনে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়ার পর নির্বাচনের দৃশ্যপট পরিবর্তন হয়। নির্বাচনে তিনি নির্বাচনের আয়োজক আইয়ুব খানের প্রতিপক্ষ হন।
মৌলিক গণতন্ত্র নির্বাচন শুরুর পূর্বে ১৯৬৫ সালের রাষ্ট্রপতি প্রার্থীদের ঘোষণা হয়। নির্বাচনে প্রধান দুটি দল ছিল। একটি কনভেনশন মুসলিম লীগ ও অন্যটি সম্মিলিত বিরোধী দল। সম্মিলিত বিরোধী দলে পাঁচটি প্রধান বিরোধী দল ছিল। তাদের নয় দফা কর্মসূচি ছিল যাতে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের পুনপ্রবর্তন, প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকার ও ১৯৬২ সালের সংবিধানের গণতন্ত্রীকরণের কথা ছিল। এই বিরোধীদলগুলো ঐক্যবদ্ধ ছিল না এবং চিন্তা ও কর্মের দিক থেকে একতা ছিল না। নিজেদের মধ্য থেকে রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী মনোনীত করতে তারা ব্যর্থ হয় ফলে তারা ফাতেমা জিন্নাহকে প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]
১৯৬৫ সালের ২ জানুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এতে মোট চারজন প্রার্থী ছিলেন। তারা হলেন আইয়ুব খান, ফাতেমা জিন্নাহ ও দুজন স্বতন্ত্র প্রার্থী।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] সংক্ষিপ্ত প্রচারণার সময় ছিল একমাস এবং এতে নয়টি বৈঠকের সীমাবদ্ধতাও আরোপ করা হয়। এতে শুধু ইলেক্টোরাল কলেজের সদস্য ও সংবাদকর্মীরা অংশ নিতে পারত। সাধারণ জনতা এতে অংশ নেয়ার সুযোগ পেত না।
অন্যান্য প্রার্থীদের তুলনায় আইয়ুব খানের সুযোগ বেশি ছিল। তার উত্তরসুরি নির্বাচিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তিনি রাষ্ট্রপতি থাকবেন সংবিধানের দ্বিতীয় সংশোধনীতে এমন নিয়ম করা হয়েছিল। রাষ্ট্রপতি হিসেবে সাংবিধানিক ক্ষমতার কারণে সরকারের সকল অংশে তিনি তার ক্ষমতা কার্যকর করতে সক্ষম হন। রাষ্ট্রপতি হিসেবে তিনি রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধা গ্রহণ করেন। আমলাতন্ত্র ও বাণিজ্য দুই দিক থেকে তিনি নির্বাচন প্রচারণায় সহায়তা পান। এছাড়াও ইসলামে নারীদের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রশাসনের অনুমতি নেই বলে উলামাদের সমর্থনও তিনি লাভ করতে সক্ষম হন।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]
ফাতেমা জিন্নাহর প্রধান সুবিধা ছিল তিনি পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতার বোন। মুহাম্মদ আলি জিন্নাহর মৃত্যুর পর তিনি নিজেকে রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছিলেন। এসময় তিনি আইয়ুব খানকে একনায়ক হিসেবে অবিহিত করেন। ভারতের সাথে সিন্ধু নদীর পানি বিষয়ক চুক্তিতে ভারতের হাতে নদীর নিয়ন্ত্রণ তুলে দেয়া হয়েছে বলে তিনি অভিযোগ করেন। তার প্রচারণা জনসমর্থন লাভে সক্ষম হয়েছিল। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে তিনি অনেক লোক জড়ো করতে সক্ষম হন। তবে তার কাজে কিছু সমস্যা দেখা দেয়। অস্বচ্ছ ও অসম নির্বাচনী প্রচারণা, অর্থাভাব ও মৌলিক গণতন্ত্র পদ্ধতির আওতায় পরোক্ষ নির্বাচনের কারণে তাকে সমস্যায় পড়তে হয়।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]
নির্বাচনে ফাতেমা জিন্নাহ বেশ কিছু ভোট পেলেও নির্বাচনের চূড়ান্ত ফলাফলে তিনি পরাজিত হন এবং আইয়ুব খান পুনরায় রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। ধারণা করা হয় যদি প্রত্যক্ষ ব্যালটের মাধ্যমে নির্বাচন হত তবে তিনি জয়ী হতেন। ইলেক্টোরাল কলেজ ৮০,০০০ মৌলিক গণতন্ত্রীদের নিয়ে গঠিত হয় এবং তারা অনেকাংশে নির্দিষ্ট পক্ষের অনুগত ছিল। তবে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদের জন্য একজন নারী লড়েছেন বলে এই নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ ছিল। মাওলানা মওদুদির নেতৃত্বাধীন জামায়াতে ইসলামিসহ অন্যান্য ধর্মীয় রাজনৈতিক দলগুলো তার বিরোধিতা করলেও পরে তার প্রার্থিতায় সমর্থন দেয়। নির্বাচনের ফলে বোঝা যায় যে জনগণ রাষ্ট্রপতির পদের জন্য কোনো নারীকে দেখতে অখুশি হয়।
ফাতেমা জিন্নাহ তার ভাই মুহাম্মদ আলি জিন্নাহর উপর একটি অসমাপ্ত জীবনী লিখেছেন। এটি ১৯৮৭ সালে কায়েদে আজম একাডেমি থেকে প্রকাশিত হয়।[8][9]
১৯৬৭ সালের ৯ জুলাই করাচিতে ফাতেমা জিন্নাহ মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর কারণ হিসেবে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হওয়ার কথা বলা হলেও তাকে তার বাড়িতে হত্যা করা হয়েছে বলে গুজব ছড়িয়ে পড়ে। ২০০৩ সালে মুহাম্মদ আলি জিন্নাহর ভাইপো আকবর পিরভাই দাবি করেন যে ফাতেমা জিন্নাহর মৃত্যু আইয়ুব খানের সরকার কর্তৃক সংঘটিত হয়েছিল।