Loading AI tools
পশ্চিমবঙ্গের একটি জেলা উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
পুরুলিয়া জেলা ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মেদিনীপুর বিভাগে অবস্থিত একটি জেলা। জেলাসদর পুরুলিয়া। এই জেলার পূর্ব সীমান্তে পশ্চিম বর্ধমান জেলা, বাঁকুড়া ও ঝাড়গ্রাম জেলা; এবং অপর তিন দিক ঝাড়খণ্ড রাজ্য দ্বারা বেষ্টিত। বাংলা ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ১৯৫৬ সালে পূর্বতন বিহার রাজ্যের মানভূম জেলার সদর মহকুমাটি পুরুলিয়া জেলা নামে পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্ভুক্ত হয়। সেই থেকে এই জেলা পশ্চিমবঙ্গের অঙ্গ।
পুরুলিয়া | |
---|---|
জেলা | |
উপরের বাঁ দিক থেকে ঘড়ির কাঁটার দিকে: জয়চণ্ডী পাহাড়, বাণ্ডা দেওল মন্দির, অযোধ্যা পাহাড়, আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তা, ছৌ নাচ | |
পশ্চিমবঙ্গে পুরুলিয়া জেলার অবস্থান | |
স্থানাঙ্ক: ২৩.১৯° উত্তর ৮৬.২২° পূর্ব | |
দেশ | ভারত |
রাজ্য | পশ্চিমবঙ্গ |
বিভাগ | মেদিনীপুর |
জেলা সদর | পুরুলিয়া |
সরকার | |
• মহকুমা | ঝালদা, মানবাজার, পুরুলিয়া সদর, রঘুনাথপুর |
• ব্লক | আরশা, বাঘমুন্ডি, বলারামপুর, বরাবাজার, বান্দোয়ান , হুড়া, জয়পুর, ঝালদা ১, ঝালদা ২, কাশীপুর, মানবাজার ১, মানবাজার ২, নিতুড়িয়া, পাড়া, পুঞ্চা, পুরুলিয়া ১, পুরুলিয়া ২ রঘুনাথপুর ১, রঘুনাথপুর ২, সাঁতুড়ি |
• লোকসভা কেন্দ্র | পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, ঝাড়গ্রাম |
• বিধানসভা কেন্দ্র | বান্দোয়ান, বলারামপুর, বাঘমুন্ডি, জয়পুর, পুরুলিয়া, মানবাজার, কাশীপুর, পাড়া, রঘুনাথপুর |
• জেলা শাসক | ডাঃ রজত নান্দা |
আয়তন | |
• মোট | ২,৪১৭ বর্গমাইল (৬,২৫৯ বর্গকিমি) |
জনসংখ্যা (২০১১) | |
• মোট | ২৯,৩০,১১৫ |
• জনঘনত্ব | ১,২০০/বর্গমাইল (৪৭০/বর্গকিমি) |
সময় অঞ্চল | ভারতীয় সময় (ইউটিসি+৫:৩০) |
ওয়েবসাইট | পুরুলিয়া জেলার প্রাতিষ্ঠানিক ওয়েবসাইট |
পুরুলিয়া জেলার প্রাচীন ইতিহাস সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না। কিছু প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন থেকে প্রাচীন ইতিহাসের একটি অনুমান করা যায়। মধ্যযুগেও এই অঞ্চল দুর্গম অরণ্যে আকীর্ণ ছিল। জেলার আধুনিক ইতিহাসের সূত্রপাত ব্রিটিশ যুগে। এই সময় বাংলার আদিবাসী বিদ্রোহে এই জেলা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে। সাঁওতাল, কোল, ভীল, চুয়াড় ও গঙ্গানারায়নের নেতৃত্বে কৃষক বিদ্রোহ পুরুলিয়ায় ইংরেজ শাসনকে বারংবার ব্যতিব্যস্ত করে তোলে। প্রাক-স্বাধীনতা ও স্বাধীনোত্তরকালে বাংলা ভাষা ও বঙ্গভূক্তির দাবিতে এই অঞ্চলে যে গৌরবময় বিদ্রোহ সংগঠিত হয়েছিল তা আজও জেলার মানুষ সশ্রদ্ধ চিত্তে স্মরণ করে থাকেন।
১৭৬৫ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলা-বিহার-ওড়িশার দেওয়ানি লাভ করলেও অরণ্যসংকুল পুরুলিয়া অঞ্চলটি জয় করতে ইংরেজদেরও যথেষ্ট বেগ পেতে হয়। এরপরেও এই অঞ্চলে একাধিক আদিবাসী বিদ্রোহ ও অনেক বড়মাপের সংঘর্ষ ঘটতে থাকে। প্রশাসনিক কাজের সুবিধার্থে ১৮০৫ সালে মানভূম সহ ২৩টি পরগণা ও মহল নিয়ে গঠিত হয় জঙ্গলমহল জেলা। কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিরতায় অতিষ্ঠ হয়ে ইংরেজ কর্তৃপক্ষ ১৮৩৩ সালে এই জেলা ভেঙে মানভূম জেলা গঠন করেন। মানভূম জেলার সদর হয় মানবাজার। বর্তমান বর্ধমান ও বাঁকুড়া জেলাদ্বয়ের একটি বৃহৎ অংশ সেই সময় মানভূম জেলার অন্তর্গত ছিল। এই সময়েই পুরুলিয়া গ্রামটি ধীরে ধীরে শহরে পরিণত হতে থাকে এবং ১৮৩৮ সালে এই শহরে মানভূম জেলার সদর দপ্তর স্থানান্তরিত হয়। ১৯১১ সালে মানভূম বাংলা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বিহার প্রদেশের সঙ্গে যুক্ত হয় এবং স্বাধীনতা পর্যন্ত বিহারেরই অন্তর্গত থাকে।
মানভূমে বাংলা ভাষা আন্দোলন ১৯১২ সালে শুরু হয়। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫৬ সালের মধ্যে ভাষা আন্দোলন তীব্র ভাবে ছড়িয়ে পড়ে মানভূমের বাঙালিদের মধ্যে। মানভূমের এই ভাষা আন্দোলন পৃথিবীতে ঘটা দীর্ঘতম ভাষা আন্দোলন।[১] ১৯৫৬ সালের আগে অধুনা পুরুলিয়া জেলার ভূখণ্ডটি বিহারের অন্তর্ভুক্ত ছিল। সেই সময় রাজনৈতিক ভাবে বিহারের স্কুল-কলেজ-সরকারি দপ্তরে হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়।[২] সেই সময় জাতীয় কংগ্রেসের মাধ্যমে বাংলাভাষী জনগণ হিন্দি ভাষার বিরুদ্ধে আন্দোলন করার চেষ্টা করা হয়; কিন্তু, বাংলা ভাষার দাবি প্রতিষ্ঠিত না হওয়ায় পুরুলিয়া কোর্টের আইনজীবী রজনীকান্ত সরকার, শরৎচন্দ্র সেন এবং গুণেন্দ্রনাথ রায় জাতীয় কংগ্রেস ত্যাগ করে জাতীয়তাবাদী আঞ্চলিক দল লোকসেবক সঙ্ঘ গড়ে তোলেন।[২] বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার লড়াইয়ে তাদের সুদৃঢ় আন্দোলন করেন। এরপর ১৯৫৬ সালে ভারত সরকার মানভূম জেলা ভেঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে সঙ্গে একটি নতুন জেলা (বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের পুরুলিয়া জেলা) সংযুক্ত করতে বাধ্য করেন।[২]
মেদিনীপুর বিভাগের পাঁচটি জেলার অন্যতম পুরুলিয়া জেলা। এই জেলা শুধু সমগ্র বিভাগেরই নয়, বরং সারা পশ্চিমবঙ্গের সর্বপশ্চিমে অবস্থিত জেলা। দক্ষিণে ২২º৪৩′ উত্তর অক্ষাংশ থেকে উত্তরে ২৩º৪২′ উত্তর অক্ষাংশ এবং পশ্চিমে ৮৫º৪৯′ পূর্ব দ্রাঘিমাংশ থেকে পূর্বে ৮৬º৫৪′ পূর্ব দ্রাঘিমাংশের মধ্যে এই জেলা অবস্থিত। জেলার মোট ভৌগোলিক আয়তন ৬২৫৯ বর্গ কিলোমিটার (পশ্চিমবঙ্গের চতুর্থ বৃহত্তম জেলা)। জেলার সদর পুরুলিয়া ২৩º২০′ উত্তর অক্ষাংশ ও ৮৭º৫১′ পূর্ব দ্রাঘিমাংশে অবস্থিত। জেলার রাজনৈতিক সীমানা উত্তরে, পশ্চিমে ও দক্ষিণে ঝাড়খণ্ড রাজ্য, উত্তর-পূর্বে বর্ধমান জেলা, পূর্বে বাঁকুড়া জেলা ও দক্ষিণ-পূর্বে ঝাড়গ্রাম জেলার সঙ্গে সংযুক্ত।
গঠনগতভাবে দামোদর অববাহিকা ও ছোটনাগপুর মালভূমির পূর্ব সীমানায় অবস্থিত পুরুলিয়া জেলা রাঁচি সমপ্রায়ভূমির অন্তর্গত। এই জেলার ভূপ্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য হল বন্ধুর ভূমিভাগ, খাড়া পাহাড়চূড়া ও নিচু উপত্যকা। উচ্চ শৈলশিরা ও নিচু উপত্যকার মধ্যকার ব্যবধান ৩০ মিটার। সাধারণ ভূভাগের উচ্চতা ও ঢাল ১৫০-৩০০ মিটার। ৩০০ মিটার সমোন্নতিরেখাটি ঝালদা, বাঘমুন্ডি, বরাবাজার, আড়সা, বলরামপুর ও বান্দোয়ানের উচ্চ সমপ্রায়ভূমিকে জেলার অবশিষ্টাংশের ক্ষয়িত সমভূমি থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। জেলার অধিকাংশ অঞ্চলই সমভূমি। পশ্চিমের মালভূমির সর্বোচ্চ অংশ অযোধ্যা পাহাড় (৬৭০ মিটার)। এছাড়া বেলামু পাহাড় (প্রায় ৫০০ মিটার), দক্ষিণে দলমা পাহাড় (৩৫৬ মিটার) ও উত্তর-পূর্বের পাঞ্চেত পাহাড়ও উল্লেখযোগ্য পাহাড়। অযোধ্যা পাহাড়ের গোর্গাবুরু এই জেলার এবং পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিমাঞ্চলের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ। ভূপ্রাকৃতিক বিভাগ অনুসারে জেলাকে তিন ভাগে ভাগ করা যেতে পারে – (১) পশ্চিম ও দক্ষিণের বন্ধুর পাহাড়ি অঞ্চল, (২) ল্যাটেরাইট উচ্চভূমি ও বিচ্ছিন্ন শিলাস্তুপ এবং (৩) পাললিক সমভূমি।
পুরুলিয়া জেলার উল্লেখযোগ্য নদীগুলি হল – কংসাবতী, দামোদর, সুবর্ণরেখা, কুমারী ইত্যাদি। ভূমির স্বাভাবিক ঢাল অনুযায়ী এই জেলার অধিকাংশ নদীই পূর্ব বা দক্ষিণ-পূর্বগামী। তাই এই অঞ্চলের ঢাল সম্ভবত পূর্ব থেকে পশ্চিমে দেখা যায়।কেবলমাত্র কংসাবতী নদী দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমগামী। মালভূমি অঞ্চলে উৎপন্ন বলে এই নদীগুলি অনিত্যবহা এবং মাঝেমধ্যে এই সকল নদীতে ফ্ল্যাশ বা ঝলক বান দেখা যায়।
কংসাবতী বা কাঁসাই পুরুলিয়া জেলার প্রধান নদী। এই নদী জেলার কোটশীলা থানার অন্তর্গত জাবর পাহাড় থেকে উৎপন্ন হয়ে দক্ষিণপূর্ব অভিমুখে প্রবাহিত হয়েছে। কুমারী নদী কংসাবতীর সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ উপনদী। এই নদী বাঘমুন্ডি পাহাড়ের নিকট উৎপন্ন হয়ে দক্ষিণ-পূর্ব অভিমুখে প্রবাহিত হয়েছে। এই জেলায় কংসাবতীর অপরাপর উপনদীগুলি হল সাহারা জোড়, বান্ধু নদী, হোবরি জোরি, হনুমন্ত নদী, চাকনা নদী, তেরে নদী ইত্যাদি। সুবর্ণরেখা জেলার পশ্চিম সীমান্ত ঘেঁষে প্রবাহিত হয়েছে। পুরুলিয়ায় এর প্রধান শাখানদীগুলি হল রূপাই, রাড়ডু, সাভা ও শঙ্খ নদী। দামোদর নদ জেলার উত্তর সীমান্ত বরাবর এবং দ্বারকেশ্বর নদ উত্তর-পূর্ব সীমান্ত ঘেঁষে প্রবাহিত। মালভূমিতে উৎপন্ন বলে শীত ও গ্রীষ্মকালে এই জেলার নদনদীগুলিতে জল খুবই কম থাকে; কিন্তু বর্ষায় জলের পরিমাণ প্রভূত বৃদ্ধি পায়; এমনকি মাঝে মাঝে দুই কূল ছাপিয়ে বন্যাও দেখা দেয়।
পুরুলিয়া জেলার জলবায়ু চরমভাবাপন্ন। এখানে গ্রীষ্মকালীন সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রা যথাক্রমে ৪৫º সেন্টিগ্রেড ও ২৬º সেন্টিগ্রেড; এবং শীতকালীন সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রা যথাক্রমে ২৮º সেন্টিগ্রেড ও ১১
º সেন্টিগ্রেড। গ্রীষ্মে অত্যধিক উষ্ণতা ও কম আপেক্ষিক আর্দ্রতার সহাবস্থান দেখা যায়। বর্ষায় আপেক্ষিক আর্দ্রতা কিছু পরিমাণে বৃদ্ধি পেলেও শীতকালে আবার তা অনেকখানি হ্রাস পায়।
জেলার বার্ষিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ১০৫০-১৪২০ মিলিমিটার। তবে গ্রীষ্মকালের বৃষ্টিপাতের স্বল্পতার কারণে অনেক সময়ই খরা দেখা দেয়। জুন থেকে অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে জেলার অধিকাংশ বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে। বছরের অন্যান্য সময় আবহাওয়া মোটামুটি শুষ্কই থাকে।
পুরুলিয়া জেলার অধিকাংশ মৃত্তিকাই পরবর্তী মৃত্তিকা। উপত্যকার উপরিভাগে দেখা যায় অ্যালুভিয়াল মৃত্তিকা। মালভূমির উপরের অংশের মৃত্তিকা অনুর্বর, অগভীর, কাঁকরযুক্ত, দ্রুত ধৌত ও কম জলধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন। এই মাটিতে লোহা, কোয়ার্টজ ও ফেল্ডসপারের সঞ্চয় দেখা যায়।
উপত্যকার মৃত্তিকা গভীর, মধ্যম গঠনযুক্ত, কম জলধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন ও অল্প কাদাযুক্ত। ধানচাষের অনুকূল এই মৃত্তিকা তৈরি হয় মালভূমি থেকে ধৌত প্রক্রিয়ায় আগত পদার্থ দিয়ে।
পুরুলিয়া জেলার অরণ্য মূলত ক্রান্তীয় অরণ্য। অর্থাৎ যেসব গাছপালা এখানে বেশি চোখে পড়ে সেগুলি হল শাল, আসান, কুসুম, বহেরা, আমলকি, মহুয়া, পলাশ, জাম, শিমূল, শিরিষ, অর্জুন, হরিতকি, নিম, হলুদ, টিক ও বাঁশ ইত্যাদি। এই অরণ্য দেখা যায় মূলত পাহাড় ও পাহাড়ের পাদদেশীয় অঞ্চলেই।
পুরুলিয়া জেলার ৭৫.০৫ হাজার হেক্টর জমিতে অরণ্য বর্তমান। এই অরণ্যগুলি কয়েকটি ভাগে বিভক্ত। যথা – ঘন শাল অরণ্য, মিশ্র ঘন অরণ্য, মুক্ত শাল অরণ্য, মিশ্র মুক্ত অরণ্য। এছাড়াও পুরুলিয়ায় সামাজিক বনসৃজনের অঙ্গ হিসাবে অর্জুন, শিরিষ, মহুয়া, নিম, আমলকি, বাঁশ, সেগুন, বাবলা, কুসুম, হরিতকি, ইউক্যালিপটাস, আকাশমণি প্রভৃতি বৃক্ষ রোপণ করা হয়ে থাকে। জেলার দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তে সাবাই ঘাসের জঙ্গল দেখা যায়।
পুরুলিয়া জেলা চারটি মহকুমাতে বিভক্ত। এগুলি হল - পুরুলিয়া সদর, ঝালদা,মানবাজার এবং রঘুনাথপুর। পুরুলিয়া সদর মহকুমাতে রয়েছে পুরুলিয়াপৌরসভা এবং সাতটি সমষ্টি উন্নয়ন ব্লক - মানবাজার-১, মানবাজার-২, বান্দোয়ান, পুরুলিয়া-১, পুরুলিয়া-২, হুড়া এবং পুঞ্চা। ঝালদা মহকুমাতে রয়েছে ঝালদাপৌরসভা এবং সাতটি সমষ্টি উন্নয়ন ব্লক - ঝালদা-১, ঝালদা-২, জয়পুর, আড়ষা, বাঘমুন্ডি, বলরামপুর এবং বরাবাজার। রঘুনাথপুর মহকুমাতে রয়েছে রঘুনাথপুরপৌরসভা এবং ছয়টি সমষ্টি উন্নয়ন ব্লক - পাড়া, রঘুনাথপুর-১, রঘুনাথপুর-২, নিতুড়িয়া, সাঁতুড়ি এবং কাশীপুর। পুরুলিয়া শহর হল পুরুলিয়া জেলার জেলাসদর। এই জেলাতে ২৬ টি থানা, ২০ টি সমষ্টি উন্নয়ন ব্লক, ৩ টি পুরসভা, ১৭০ টি গ্রাম পঞ্চায়েত এবং ২৪৫৯ টি গ্রাম রয়েছে।
২০১১ জনগণনা অনুসারে পুরুলিয়া জেলার জনসংখ্যা ২৯,২৭,৯৬৫ জন, যা মোটামুটিভাবে জামাইকা বা আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের আরকানসাস রাজ্যের সমতুল্য। জনসংখ্যা অনুসারে পুরুলিয়া জেলা ভারতের ১২৯তম জেলা (মোট ৭৩৯ টি জেলার মধ্যে)। পুরুলিয়া জেলার জনঘনত্ব ৪৬৮ জন/বর্গকিমি। ২০০১-১১ দশকে এই জেলার জনবৃদ্ধির হার ১৫.৪৩%। পুরুলিয়া জেলার নারী-পুরুষ অনুপাত ৯৪০ জন নারী প্রতি ১০০০ পুরুষ পিছু এবং স্বাক্ষরতা হার ৬৫.৩৮%।
২০১৩-১৪ সালের হিসাব অনুসারে, পুরুলিয়া জেলার মোট স্বীকৃত বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৩৩১৬। এরমধ্যে প্রাথমিক বিদ্যালয় ২৯৭৫টি, জুনিয়র বিদ্যালয় ৯৭টি, মাধ্যমিক বিদ্যালয় ১৩৯টি এবং উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৮৮টি। এছাড়া জেলায় মোট ২৬১টি শিশুশিক্ষা কেন্দ্র এবং আই সি ডি এস-এর অন্তর্গত ২৪১৫টি অঙ্গনওয়াড়ি শিক্ষা কেন্দ্র আছে। ২০০৩-০৪ সালের হিসাব অনুসারে, জেলার বিদ্যালয়গুলির মোট ছাত্রসংখ্যা ২,৯৯,০৫২ ও মোট ছাত্রীসংখ্যা ২,২৬,৬৮৩ এবং মোট শিক্ষক-শিক্ষিকার সংখ্যা ১০,৯১৮। শিশুশিক্ষা কেন্দ্রে পাঠরত ছাত্র ও ছাত্রীর সংখ্যা যথাক্রমে ৭,৩৯৪ ও ৫,৩৩২ এবং সহায়ক-সহায়িকার সংখ্যা ৩৩৮। অঙ্গনওয়াড়ি শিক্ষা কেন্দ্রের ছাত্র ও ছাত্রীসংখ্যা যথাক্রমে ৬৩,১৩৭ ও ৬০,৪৪১ এবং শিক্ষক-শিক্ষিকার সংখ্যা ২,৩৫৭। এই জেলার গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি বিদ্যালয় হল পুরুলিয়া রামকৃষ্ণ মিশন আবাসিক বিদ্যালয়, পুরুলিয়া সৈনিক স্কুল, পুরুলিয়া জিলা স্কুল, বিদ্যাসাগর বিদ্যালয় ইত্যাদি। জেলার একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় সিধো-কানহো-বিরসা বিশ্ববিদ্যালয়http://www.skbu.ac.in/।%5B%5D
2013-14 সালের হিসাব অনুযায়ী, পুরুলিয়া জেলার ডিগ্রি কলেজের সংখ্যা ১১ এবং পলিটেকনিকের সংখ্যা ৩। জেলায় কোনও বিশ্ববিদ্যালয় না থাকলেও ২টি মুক্তবিশ্ববিদ্যালয় পঠনপাঠনকেন্দ্র আছে। এই জেলার কলেজগুলি সিধো-কানহো-বিরসা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক অনুমোদিত। জেলার কয়েকটি উল্লেখযোগ্য কলেজ হল জগন্নাথকিশোর কলেজ, নিস্তারিণী কলেজ, রঘুনাথপুর কলেজ, আনন্দমার্গ কলেজ, রামানন্দ শতবার্ষিকী কলেজ, অচ্ছ্রুরাম মেমোরিয়াল কলেজ, মহাত্মা গান্ধী কলেজ, নেতাজি সুভাষ আশ্রম মহাবিদ্যালয়, বলরামপুর কলেজ, মানভূম মহাবিদ্যালয়, মাইকেল মধুসূদন মহাবিদ্যালয়, কাশীপুর, পঞ্চকোট মহাবিদ্যালয়,সীতারাম মাহাত মেমোরিয়াল কলেজ কুরুপতুপা ইত্যাদি। ২০০৩-০৪ সালের হিসাব অনুসারে, জেলার সাধারণ ডিগ্রি কলেজে পাঠরত ছাত্র ও ছাত্রীসংখ্যা যথাক্রমে ৮,০৬৫ ও ৩,৩১৯ এবং অধ্যাপক-অধ্যাপিকার সংখ্যা ৩২১।
সাধারণ ডিগ্রি কলেজ ছাড়াও আরও কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জেলার শিক্ষামানচিত্রে সগৌরবে অবস্থান করছে। যেমন – স্পনসর্ড টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, বেঙ্গল ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, পুরুলিয়া হোমিওপ্যাথি মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল, পুরুলিয়া পলিটেকনিক ইত্যাদি।
২০১৬ সালে পুরুলিয়ার জয়পুর ব্লকে পুরুলিয়া গভর্নমেন্ট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়, যার বর্তমান নাম রামকৃষ্ণ মাহাতো গভর্নমেন্ট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ। এটি একটি বি. টেক ডিগ্রি কলেজ।
২০০৩-০৪ সালের হিসাব অনুসারে পুরুলিয়া জেলায় ১২৭টি সাধারণ পাঠাগার ও ৪০টি ফ্রি রিডিং রুম আছে।
পুরুলিয়া জেলাতে দক্ষিণ-পূর্ব রেলপথ বিভাগের তিনটি প্রধান রেলপথ যোগাযোগ রয়েছে। একটি রেলপথ দক্ষিণে ঝাড়খণ্ড থেকে পুরুলিয়া জেলার মধ্য দিয়ে আদ্রা বিভাগ হয়ে পশ্চিম বর্ধমান জেলার আসানসোল পর্যন্ত বিস্তৃত। অন্য একটি রেলপথ বাঁকুড়া থেকে আদ্রা বিভাগ হয়ে ঝাড়খণ্ডের ধানবাদ পর্যন্ত বিস্তৃত। আরও একটি রেলপথ পুরুলিয়া ও ঝাড়খণ্ডকে যুক্ত করেছে। রাঁচি, টাটানগর, পাটনা, হাওড়া, ধানবাদ, লখনউ, আসানসোল, পুরী, ভুবনেশ্বর, দুর্গাপুর, মুম্বাই, চেন্নাই, দিল্লি প্রভৃতি শহরগুলি বর্তমানে পুরুলিয়া জেলার সাথে সুসংযুক্ত রয়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব রেলপথ বিভাগের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপবিভাগ আদ্রা রেলপথ বিভাগের সদরদপ্তর পুরুলিয়া জেলার উত্তর-পূর্ব অংশে আদ্রাতে অবস্থিত।
সড়কপথ পরিবহন পুরুলিয়া জেলার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পরিবহন মাধ্যম। ন্যাশনাল হাইওয়ে ১৮ (ন্যাশনাল হাইওয়ে ৩২) এই জেলাকে জামশেদপুর, বোকারো, চাস, ধানবাদের সাথে যুক্ত করেছে। স্টেট হাইওয়ে ৫ এই জেলার রঘুনাথপুর, আদ্রা, সাঁওতালডিহি ও নিতুড়িয়াকে যুক্ত করেছে।
পুরুলিয়া কৃষ্গিত দিক বেশি উন্নত না হলেও যথেষ্ট উন্নত| এখানকার প্রধান ফসল ধান।
পুরুলিয়া পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম খনিজ সমৃদ্ধ জেলা। এই জেলায় প্রাপ্ত খনিজপদার্থগুলির মধ্যে কয়লা, ফসফেট, চিনামাটি, ডলোমাইট, বালি, কোয়ার্টজ, কায়ানাইট, গ্রাফাইট ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। মূলত জেলার উত্তর-পশ্চিমাংশে অবস্থিত দামোদর উপত্যকা ও পাঞ্চেৎ পাহাড়ের মধ্যবর্তী অঞ্চলে কয়লা পাওয়া যায়। রানিপুর, হিরাখুন, ভামুরিয়া প্রভৃতি অঞ্চলে কয়লা উত্তোলিত হয়। চিনামাটি পাওয়া যায় রঘুনাথপুর, ধুতারে, ঝালদা, কালাঝোড় ইত্যাদি অঞ্চলে। মালতিতে ফায়ার ক্লে এবং ঝালদাতে চুনাপাথর উত্তোলিত হয়। এছাড়া বলরামপুরে কোয়ার্টজ, রঘুদিহ্ ও পালকায় ফেলসপার এবং পুরুলিয়া থানা এলাকায় গ্রাফাইট পাওয়া যায়।
লাক্ষা শিল্প
ছৌ নাচে ব্যবহৃত মুখোশ ও বাদ্যযন্ত্র পুরুলিয়া জেলার বাঘমুন্ডি থানার চড়িদা গ্রামের চল্লিশটি সূত্রধর পরিবার এবং জয়পুর থানার ডুমুরডি গ্রামের পাঁচটি পরিবার ছৌ নাচের মুখোশ তৈরী করেন। এছাড়া পুরুলিয়া মফস্বল থানার গেঙ্গাড়া, ডিমডিহা ও কালীদাসডিহি গ্রামে, পুঞ্চা থানার জামবাদ গ্রামে এবং কেন্দা থানার কোনাপাড়া গ্রামেও এই মুখোশ তৈরী হয়ে থাকে।
মানভূমে বাংলা ভাষা আন্দোলন ১৯১২ সালে শুরু হয়। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫৬ সালের মধ্যে ভাষা আন্দোলন তীব্র ভাবে ছড়িয়ে পড়ে মানভূমের বাঙালিদের মধ্যে। ১৯৫৬ সালের আগে পুরুলিয়া জেলা বিহারের অন্তর্ভুক্ত ছিল। সেই সময় রাজনৈতিক ভাবে বিহারের স্কুল-কলেজ-সরকারি দপ্তরে হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়।[১] সেই সময় জাতীয় কংগ্রেসের মাধ্যমে বাংলাভাষী জনগণ হিন্দি ভাষার বিরুদ্ধে আন্দোলন করার চেষ্টা করা হয়; কিন্তু, বাংলা ভাষার দাবি প্রতিষ্ঠিত না হওয়ায় পুরুলিয়া কোর্টের আইনজীবী রজনীকান্ত সরকার, শরৎচন্দ্র সেন এবং গুণেন্দ্রনাথ রায় জাতীয় কংগ্রেস ত্যাগ করে জাতীয়তাবাদী আঞ্চলিক দল লোকসেবক সঙ্ঘ গড়ে তোলেন।[১] বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার লড়াইয়ে তাদের সুদৃঢ় আন্দোলন করেন। এরপর ১৯৫৬ সালে ভারত সরকার মানভূম জেলা ভেঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে সঙ্গে একটি নতুন জেলা (বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের পুরুলিয়া জেলা) সংযুক্ত করতে বাধ্য করেন।
পুরুলিয়া জেলার বিভিন্ন স্থানে পর্যটন শিল্পের সম্ভাবনা আছে। বাংলার অন্যতম ঐতিহাসিক ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যময় স্থানগুলি পুরুলিয়াতে অবস্থিত। অনুন্নয়ন, অপ্রতুল যোগাযোগ, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সরকারি উদাসীনতার কারণ উপেক্ষা করেও পুরুলিয়ায় সারা ভারত থেকে পর্যটক আসেন বিভিন্ন সময়। এই জেলার অযোধ্যা পাহাড়, জয়চণ্ডী পাহাড়, গড় পঞ্চকোট, বড়ন্তি, ঝালদা ইত্যাদি স্থানে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে উঠেছে।[৫][৬]
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.