পাল সাম্রাজ্য
ভারতীয় উপমহাদেশের একটি সাম্রাজ্য / From Wikipedia, the free encyclopedia
পাল সাম্রাজ্য (৭৫০-১১৬১ খ্রি)[1][2] ভারতীয় উপমহাদেশের ধ্রুপদি পরবর্তী যুগের একটি সাম্রাজ্য ছিল। এই সাম্রাজ্যের উৎসস্থল ছিল বাংলা অঞ্চল। পাল সাম্রাজ্যের নামকরণ করা হয় এই সাম্রাজ্যের শাসক পাল রাজবংশের নামানুসারে। পাল সম্রাটদের নামের শেষে ‘পাল’ অনুসর্গটি যুক্ত ছিল। প্রাচীন প্রাকৃত ভাষায় এই শব্দটির অর্থ ‘রক্ষাকর্তা’। পাল সম্রাটেরা বৌদ্ধধর্মের মহাযান ও তান্ত্রিক সম্প্রদায়ের অনুগামী ছিলেন। এই সাম্রাজ্যের পত্তন ৭৫০ খ্রিষ্টাব্দে গৌড়ের সম্রাট পদে গোপালের নির্বাচনের সঙ্গে সঙ্গে ঘটেছিল।[1] অধুনা বাংলা ও পূর্ব বিহারের ভূখণ্ড পাল সাম্রাজ্যের প্রধান কেন্দ্র ছিল। এই সাম্রাজ্যের প্রধান শহরগুলি ছিল - পাটলীপুত্র, বিক্রমপুর, রামাবতী (বরেন্দ্র), মুঙ্গের, তাম্রলিপ্ত ও জগদ্দল।
পাল সাম্রাজ্য | |||||||||
---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|
৭৫০ খ্রিস্টাব্দ[1]–১১৬১ খ্রিস্টাব্দ[2] | |||||||||
পতাকা | |||||||||
খ্রিস্টীয় ৯তম শতাব্দী নাগাদ পাল সাম্রাজ্যের অবস্থান[3] | |||||||||
অবস্থা | সাম্রাজ্য | ||||||||
রাজধানী | একাধিক
| ||||||||
প্রচলিত ভাষা | সংস্কৃত, প্রাচীন বাংলা ভাষা মৈথিলী | ||||||||
ধর্ম | বজ্রযান বৌদ্ধধর্ম মহাযান বৌদ্ধধর্ম শৈবধর্ম শাক্তধর্ম বৈষ্ণবধর্ম | ||||||||
সরকার | রাজতন্ত্র | ||||||||
• প্রতিষ্ঠাতা | গোপাল | ||||||||
• দ্বিতীয় সম্রাট | ধর্মপাল | ||||||||
সম্রাট | |||||||||
• ৭৫০ - ৭৭৭ | গোপাল | ||||||||
• ১১৮১ - ১১৯৮ | মদনপাল (সর্বশেষ স্বীকৃত পাল সম্রাট) | ||||||||
ঐতিহাসিক যুগ | ধ্রুপদি ভারত | ||||||||
• প্রতিষ্ঠা | ৭৫০ খ্রিস্টাব্দ[1] | ||||||||
• বিলুপ্ত | ১১৬১ খ্রিস্টাব্দ[2] | ||||||||
| |||||||||
বর্তমানে যার অংশ | ভারত বাংলাদেশ নেপাল |
পাল সম্রাটরা প্রাজ্ঞ কূটনীতিবিদ ও সামরিক বিজেতা ছিলেন। তাদের সেনাবাহিনীর বৈশিষ্ট্য ছিল একটি বৃহৎ যুদ্ধহস্তী বাহিনী। তাদের নৌবাহিনী বঙ্গোপসাগরে বাণিজ্যিক ও প্রতিরক্ষামূলক ভূমিকা পালন করত। পাল সম্রাটরা ছিলেন ধ্রুপদি ভারতীয় দর্শন, সাহিত্য, চিত্রকলা ও ভাস্কর্যশিল্পের বিশিষ্ট পৃষ্ঠপোষক। তারা একাধিক বৃহদায়তন মন্দির ও মঠ নির্মাণ করিয়েছিলেন। এগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল সোমপুর মহাবিহার। তারা নালন্দা ও বিক্রমশিলা মহাবিহারের পৃষ্ঠপোষকতাও করতেন। শ্রীবিজয় সাম্রাজ্য, তিব্বতি সাম্রাজ্য ও আরবের আব্বাসীয় খিলাফতের সঙ্গে পাল সাম্রাজ্যের সুসম্পর্ক বজায় ছিল।[6] বাগদাদের বাইতুল হিকমাহ এই যুগেই ভারতীয় সভ্যতার গাণিতিক ও জ্যোতির্বিজ্ঞান-সংক্রান্ত কীর্তিগুলির সঙ্গে পরিচিত হয়েছিল।[7]
খ্রিস্টীয় ৯ম শতাব্দীর প্রথম ভাগে পাল সাম্রাজ্য সর্বাধিক সমৃদ্ধি লাভ করেছিল। এই সময় পাল সাম্রাজ্যই ছিল ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তরাঞ্চলের প্রধান রাজনৈতিক শক্তি। সেই যুগে এই সাম্রাজ্য বৃহত্তর পূর্ব-ভারতবর্ষ, উত্তর ও উত্তরপূর্ব ভারত, নেপাল ও বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ভূখণ্ডে প্রসারিত হয়।[1][8] পাল সাম্রাজ্য সর্বাধিক সমৃদ্ধি ঘটেছিল সম্রাট ধর্মপাল ও দেবপালের রাজত্বকালে। তিব্বতে অতীশ দীপঙ্করের মাধ্যমে পাল সাম্রাজ্য প্রভূত সাংস্কৃতিক প্রভাব বিস্তার করেছিল। পাল সাম্রাজ্যের সাংস্কৃতিক প্রভাব পড়েছিল দক্ষিণপূর্ব এশিয়াতেও। উত্তর ভারতে পাল শাসন ছিল ক্ষণস্থায়ী। কারণ কনৌজের আধিপত্য অর্জনের জন্য গুর্জর-প্রতিহার ও রাষ্ট্রকূটদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়ে পাল সম্রাটরা পরাজিত হন। কিছুকালের জন্য পাল সাম্রাজ্যের পতন ঘটেছিল। তারপর সম্রাট প্রথম মহীপাল বাংলা ও বিহার অঞ্চলে দক্ষিণ ভারতীয় চোল অনুপ্রবেশ প্রতিহত করেন। সম্রাট রামপাল ছিলেন সর্বশেষ শক্তিশালী পাল সম্রাট। তিনি কামরূপ ও কলিঙ্গে আধিপত্য বিস্তার করেছিলেন। খ্রিস্টীয় ১১শ শতাব্দীতে পাল সাম্রাজ্যের নানা অঞ্চলে বিদ্রোহ মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। এর ফলে সাম্রাজ্যের শক্তি অনেকটাই হ্রাস প্রাপ্ত হয়।
খ্রিস্টীয় একাদশ শতাব্দীতে বরেন্দ্রতে দিব্যকের বিদ্রোহ এবং দ্বাদশ শতাব্দীতে হিন্দু সেন রাজবংশের পুনরুত্থানের ফলে পাল সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। সেই সঙ্গে ভারতীয় উপমহাদেশের সর্বশেষ প্রধান বৌদ্ধ সাম্রাজ্যের অবসান ঘটে। বাংলার ইতিহাসে পাল যুগকে অন্যতম সুবর্ণযুগ মনে করা হয়।[9][10] বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে কয়েক শতাব্দীব্যাপী গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে পাল সম্রাটরা বাংলায় স্থিতাবস্থা ও সমৃদ্ধি আনয়ন করেছিলেন। পূর্বতন বঙ্গীয় সভ্যতাকে তারা উন্নত করে তোলেন। সেই সঙ্গে শিল্পকলা ও স্থাপত্যের ক্ষেত্রে অসামান্য কীর্তি রেখে যান। তাদের রাজত্বকালেই প্রাচীন বাংলা ভাষার বিকাশ ঘটে। বাংলার প্রথম সাহিত্যকীর্তি চর্যাপদ পাল যুগেই রচিত হয়েছিল। আজও তিব্বতি বৌদ্ধধর্মে পাল উত্তরাধিকার প্রতিফলিত হয়।