Loading AI tools
স্কটিশ পদার্থবিদ উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল এফআরএসই এফআরএস (১৩ জুন ১৮৩১ - ৫ নভেম্বর ১৮৭৯) ছিলেন একজন স্কটিশ গণিতবিদ[1][2] এবং বিজ্ঞানী। তিনি তাড়িতচৌম্বক তরঙ্গের সর্বোত্তম তত্ত্বটি বর্ণণা করেছিলেন, যার সাহায্যে তড়িৎ, চুম্বকত্ব এবং আলো কে একই শক্তির বিভিন্ন রূপ হিসেবে বর্ণনা করা সম্ভব হয়েছিল। ম্যাক্সওয়েলের তড়িৎ চৌম্বকীয় বলের সমীকরণকে পদার্থবিজ্ঞানে "দ্বিতীয় বৃহত্তম একীকরণ"[3] বলা হয়, যেখানে প্রথম বৃহত্তম একীকরণ করেছিলেন আইজাক নিউটন।
জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল | |
---|---|
জন্ম | এডিনবরা, স্কটল্যান্ড | ১৩ জুন ১৮৩১
মৃত্যু | ৫ নভেম্বর ১৮৭৯ ৪৮) কেমব্রিজ, ইংল্যান্ড | (বয়স
মাতৃশিক্ষায়তন | |
পরিচিতির কারণ |
|
পুরস্কার |
|
বৈজ্ঞানিক কর্মজীবন | |
কর্মক্ষেত্র | পদার্থবিজ্ঞান এবং গণিত |
প্রতিষ্ঠানসমূহ |
|
উচ্চশিক্ষায়তনিক উপদেষ্টা | উইলিয়াম হপকিন্স |
উল্লেখযোগ্য শিক্ষার্থী |
|
যাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন | স্যার আইজ্যাক নিউটন, মাইকেল ফ্যারাডে,থমাস ইয়ং |
যাদেরকে প্রভাবিত করেছেন | কার্যত সকল আধুনিক পদার্থবিদ্যা |
স্বাক্ষর | |
১৮৬৫ সালে "এ ডাইনামিক্যাল থিওরি অফ দ্য ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ফিল্ড" প্রকাশের মাধ্যমে, ম্যাক্সওয়েল দেখিয়েছিলেন যে তড়িৎ এবং চৌম্বক ক্ষেত্রগুলো তরঙ্গ হিসেবে আলোর গতিতে মহাকাশের মধ্য দিয়ে ভ্রমণ করে। তিনি প্রস্তাব করেছিলেন যে, একই মাধ্যমে বৈদ্যুতিক এবং চৌম্বকীয় তরঙ্গের পরিভ্রমণের ফলেই আলোক তরঙ্গের উৎপত্তি হয়।[4] আলো এবং বৈদ্যুতিক তরঙ্গের একীকরণ তার রেডিও তরঙ্গের অস্তিত্বের ভবিষ্যদ্বাণী করে। ম্যাক্সওয়েলকে আধুনিক বৈদ্যুতিক প্রকৌশল ক্ষেত্রের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবেও গণ্য করা হয়।[5]
ম্যাক্সওয়েল ম্যাক্সওয়েল-বোল্টজম্যান ডিস্ট্রিবিউশনের বিকাশে সাহায্য করেছিলেন, যা গ্যাসের গতি তত্ত্বের দিকগুলো বর্ণনা করার একটি পরিসংখ্যানগত উপায় ছিল। এছাড়াও তিনি ১৮৬১ সালে প্রথম স্থায়ী রঙিন ছবি উপস্থাপন ও সেতুর রড এবং যৌথ কাঠামোর (ভাররক্ষার্থ কাঠামো) দৃঢ়তা বিশ্লেষণে ভিত্তিমূলক কাজ করেছিলেন।
তার আবিষ্কারগুলো আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের যুগে, বিশেষ আপেক্ষিকতা এবং কোয়ান্টাম বলবিদ্যার মতো ক্ষেত্রের ভিত্তি স্থাপনের সূচনা করতে সাহায্য করেছিল। অনেক পদার্থবিজ্ঞানী ম্যাক্সওয়েলকে ১৯ শতকের এমন বিজ্ঞানী হিসাবে বিবেচনা করেন যিনি ২০ শতকের পদার্থবিজ্ঞানের উপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেন। অনেকে বিজ্ঞানে তার অবদানকে আইজাক নিউটন এবং অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের মতো একই মাত্রার বলে মনে করেন।[6] ১০০০ বছর ধরে চলা একটি জরিপে ১০০ জন বিশিষ্ট পদার্থবিজ্ঞানীদের একটি সমীক্ষায় নিউটন এবং আইনস্টাইনের পরে ম্যাক্সওয়েলকে সর্বকালের তৃতীয় সর্বশ্রেষ্ঠ পদার্থবিজ্ঞানী নির্বাচিত করা হয়েছিল।[7] ম্যাক্সওয়েলের শতবর্ষতম জন্মদিনে, আইনস্টাইন ম্যাক্সওয়েলের কাজকে তার অভিজ্ঞতায় "নিউটনের সময় থেকে পদার্থবিজ্ঞানের সবচেয়ে গভীর এবং সবচেয়ে ফলপ্রসূ" বলে বর্ণনা করেছেন।[8] ১৯২২ সালে আইনস্টাইন যখন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শন করেন, তখন তার অতিথিসেবক তাকে বলেছিলেন যে তিনি দুর্দান্ত কাজ করেছেন কারণ তিনি নিউটনের ঘাড়ে দাঁড়িয়ে বিশ্ব দেখেছেন; আইনস্টাইন উত্তর দিয়েছিলেন: "না আমি নিউটন নয়, ম্যাক্সওয়েলের ঘাড়ে দাঁড়িয়ে বিশ্ব দেখেছি।"[9]
জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল ১৩ জুন ১৮৩১ সালে[10] ১৪ ইন্ডিয়া সড়ক,এডিনবার্গের জন ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল, (যিনি একজন আইনজীবী) এবং ফ্রান্সেস কে[11][12]( রবার্ট হডসন কে এর কন্যা এবং জন কে-এর বোন) এর বিত্তশালী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। (তার জন্মস্থানে এখন জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল ফাউন্ডেশন দ্বারা পরিচালিত একটি জাদুঘর রয়েছে।) তার পিতা পেনিকুইকের ক্লার্ক পরিবারের একজন স্বাচ্ছন্দ্যবাদী ব্যক্তি[13] এবং পেনিকুইকের ক্লার্কের ব্যারোনেটের অধিকারী ছিলেন। তার কাকা ছিলেন ৬ষ্ঠ ব্যারোনেট।[14] তার পরিবারের মূল নাম ছিল "জন ক্লার্ক"।পরে উত্তরাধিকারসূত্রে পূর্বপুরুষদের ডামফ্রিসশায়ারের মিডলবি এস্টেটের একটি সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়ে (১৭৯৩ সালে একটি শিশু হিসাবে) নিজের নামের সাথে "ম্যাক্সওয়েল" যোগ করেন।[11] জেমস ছিলেন শিল্পী জেমিমা ব্ল্যাকবার্ন[15] (তার ফুফুর মেয়ে) এবং নির্মাণ প্রকৌশলী উইলিয়াম ডাইস কে (তার মামার ছেলে) উভয়ের প্রথম চাচাতো ভাই। কে এবং ম্যাক্সওয়েল ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন এবং যখন ম্যাক্সওয়েল বিয়ে করেছিলেন তখন কে তার মিতবরের ভূমিকা পালন করেছিলেন।[16]
ম্যাক্সওয়েলের বাবা-মার দেখা ও বিয়ে হয়েছিল যখন তাদের বয়স ছিল ত্রিশ।[17] যখন তিনি জন্মগ্রহণ করেন তখন তার মায়ের বয়স প্রায় ৪০। ম্যাক্সওয়েল জন্মগ্রহণের পূর্বে তাদের এলিজাবেথ নামে একটি কন্যা সন্তান ছিল, যে শৈশবেই মারা যায়।[18]
ম্যাক্সওয়েল যখন ছোট ছিলেন তখন তার পরিবার কির্ককুডব্রাইটশায়ারের গ্লেনলেয়ারে চলে যায়, যে বাড়ি তার পিতামাতা ১,৫০০ একর (৬১০ হেক্টর) জমির উপর তৈরি করেছিলেন।[19] ম্যাক্সওয়েলের সমস্ত লক্ষণ ইঙ্গিত দেয় যে তিনি ছোটবেলা থেকেই অদম্য কৌতূহলী ছিলেন।[20] তিন বছর বয়সে যা নড়াচড়া করে, চকচক করে বা আঘাত দিলে আওয়াজ করে এমন বস্তু তার মনে এই প্রশ্নটি জাগিয়েছিল: "সেটা কী?"[21] ১৮৩৪ সালে তার খালু জেন কে-এর কাছে তার পিতার একটি চিঠিতে যোগ করা একটি অনুচ্ছেদে, তার মা অনুসন্ধিৎসুতার এই সহজাত অনুভূতি এভাবে বর্ণনা করেছিলেন:
সে খুব সুখী মানুষ, এবং আবহাওয়া সহনীয় হওয়ার পর থেকে তার অনেক উন্নতি হয়েছে; দরজা, তালা, চাবি ইত্যাদি নিয়ে তার দুর্দান্ত কাজ রয়েছে এবং "এটি কীভাবে কাজ করে তা আমাকে দেখান" তার মুখ থেকে কখনোই বের হয় না। সে স্রোত এবং বেল-তারের লুকানো গতিপথ, পুকুর থেকে প্রাচীরের মধ্য দিয়ে কিভাবে জল যায় তাও তদন্ত করে।[22]
ছেলের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাকে বুঝতে পেরে ম্যাক্সওয়েলের মা ফ্রান্সিস তার প্রাথমিক শিক্ষার দায়িত্ব নেন, যা ভিক্টোরিয়ান যুগে মূলত বাড়ির মহিলাদেরই কাজ ছিল।[23]। আট বছর বয়সে তিনি জন মিল্টনের দীর্ঘ কবিতা এবং ১১৯তম গীতসংগীত (১৭৬ শ্লোক) আবৃত্তি করতে পারতেন। প্রকৃতপক্ষে, আগে থেকেেই তার শাস্ত্র সম্পর্কে বিস্তারিত জ্ঞান ছিল; তিনি গীতসংগীত থেকে প্রায় যেকোনো উদ্ধৃতির জন্য অধ্যায় এবং শ্লোক বলে দিতে পারতেন। তার বয়স যখন আট তখন তার মা পাকস্থলীর ক্যান্সারে অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং একটি ব্যর্থ অস্ত্রোপচারের পর, ১৮৩৯ সালের ডিসেম্বরে মারা যান। তখন তার বাবা এবং তার বাবার ভগ্নিপতি জেন তার শিক্ষার তত্ত্বাবধান করেছেন,যারা উভয়েই তার জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।[23] ১৬ বছর বয়সের একজন গৃহশিক্ষকের নির্দেশনায় আনুষ্ঠানিক স্কুলে তার পড়া শুরু হয়েছিল। ম্যাক্সওয়েলকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য যে যুবককে নিয়োগ করা হয়েছিল তার সম্পর্কে খুব কমই জানা যায়, তবে তিনি ছোট ছেলেদের সাথে কঠোর আচরণ করতেন, তাকে ধীরগতির এবং বিপথগামী হওয়ার জন্য তিরস্কার করেছিলেন। ১৮৪১ সালের নভেম্বরে ম্যাক্সওয়েলের গৃহশিক্ষককে বাদ দেওয়া হয়। ১৮৪২ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি জেমসের বাবা তাকে রবার্ট ডেভিডসনের বৈদ্যুতিক চালনা এবং চৌম্বকীয় শক্তি প্রদর্শনের জন্য নিয়ে যান, যা তার জন্য গভীর প্রভাবের অভিজ্ঞতা ছিল।[24]
ম্যাক্সওয়েলকে মর্যাদাপূর্ণ এডিনবার্গ একাডেমিতে পাঠানো হয়।[25] তিনি ছুটিকালীন সময়ে তার খালা ইসাবেলার বাড়িতে থাকতেন। এই সময়ে তিনি তার বড় চাচাতো বোন জেমিমার কারণে ছবি আঁকার প্রতি আগ্রহী হয়েছিলেন।[26] ১০ বছর বয়সী ম্যাক্সওয়েল, তার পিতার গ্রামাঞ্চলের ভূসম্পত্তিতে বিচ্ছিন্নভাবে বেড়ে ওঠেন, যার কারণে তিনি স্কুলে ভালোভাবে শিক্ষা লাভ করতে পারেননি।[27] প্রথম বছর শেষ হওয়ার কারণে তাকে বাধ্য হয়ে তার চেয়ে এক বছর বড় সহপাঠীদের সাথে দ্বিতীয় বর্ষে যোগ দিতে হয়েছিল।[27] তার আচরণ এবং গ্যালোওয়ের উচ্চারণের কারণে অন্যান্য ছেলেদের কাছে তিনি গ্রাম্য হিসাবে অভিহিত হয়েছিলেন। তিনি তার স্কুলের প্রথম দিনে বাড়িতে তৈরি জুতা এবং একটি নিমা পরে গিয়েছিলেন, এর জন্য সকলে তাকে "ড্রাফটি" এর মত নির্দয় নামে ডেকেছিল।[28] বহু বছর ধরে তাকে সবাই "ড্রাফটি" নামে ডাকলেও তিনি কখনো বিরক্ত হননি বলে মনে হয়েছে এবং এর জন্য তিনি কখনো অভিযোগও করেননি।[29] যখন বিদ্যালয়ে তার সাথে লুইস ক্যাম্পবেল এবং পিটার গুথরি টেইটের দেখা হয় তখন তার জীবনে সামাজিক বিচ্ছিন্নতার অবসান ঘটে। তারা দু'জনেই ছিল তার বয়সের। তারা পরবর্তী জীবনে উল্লেখযোগ্য পণ্ডিত হয়েছিলো। তারা দুজনেই ম্যাক্সওয়েলের আজীবনের বন্ধু ছিল।[11]
অল্প বয়সেই জ্যামিতি ম্যাক্সওয়েলের কাছে প্রিয় হয়ে উঠেছিল, তিনি কোনো আনুষ্ঠানিক নির্দেশনা পাওয়ার আগেই নিয়মিত পলিহেড্রাকে পুনরায় আবিষ্কার করেছিলেন।[26] তার স্কুলের দ্বিতীয় বছরে ধর্মগ্রন্থ জীবনী পুরস্কার লাভ তার শিক্ষাজীবনে প্রভাব ফেলেনি। তিনি ১৩ বছর বয়সে ইংরেজি ও কবিতা উভয়ের জন্য স্কুলের গাণিতিক পদক এবং প্রথম পুরস্কার জিতেছিলেন।[30][26]
ম্যাক্সওয়েলের স্কুলের পাঠ্যবইয়ের বাইরের বিষয়েই আগ্রহ বেশি ছিল এবং তিনি পরীক্ষার ফলাফলকে তেমন গুরুত্ব দিতেন না।[30] তিনি ১৪ বছর বয়সে তার প্রথম বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্র লেখেন। এতে তিনি সুতার টুকরো দিয়ে গাণিতিক বক্ররেখা আঁকার একটি যান্ত্রিক উপায় এবং উপবৃত্ত, কার্টেসিয়ান উপবৃত্ত এবং দুইটির বেশি নির্দিষ্ট বিন্দু সহ সংশ্লিষ্ট বক্ররেখার বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করেন। ১৮৪৬ সালে[11][31] তিনি "ওভাল বক্ররেখা, যার অনেকগুলো[32]নির্দিষ্ট বিন্দু আছে তার বর্ণনা" গবেষণাপত্রটি এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাকৃতিক দর্শনের অধ্যাপক জেমস ফোর্বস রয়্যাল সোসাইটি অফ এডিনবার্গে কাছে উপস্থাপন করেছিলেন।[11][31] এইসময় ম্যাক্সওয়েলকে নিজের কাজটি উপস্থাপন করার জন্য খুব কম বয়সী বলে মনে করা হয়েছিল।[33] যেহেতু রেনে দেকার্ত ১৭ শতকে এই ধরনের বহুমুখী উপবৃত্তের বৈশিষ্ট্য গুলো পরীক্ষা করেছিলেন তাই কাজটি সম্পূর্ণ মৌলিক ছিল না, কিন্তু ম্যাক্সওয়েল তাদের কাজকে তুলনামূলক সরলীকৃত করেছিলেন।[33]
ম্যাক্সওয়েল ১৮৪৭ সালে ১৬ বছর বয়সে এডিনবার্গ একাডেমি ত্যাগ করেন এবং এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে শুরু করেন।[34] তিনি ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন, কিন্তু তার প্রথম বছর সমাপ্ত হওয়ার পরে তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তিনি এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে তার স্নাতক পাশ করার সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণ করবেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে কিছু উচ্চ সম্মানিত নাম ও অন্তর্ভুক্ত ছিল; তার প্রথম বছরের শিক্ষকদের মধ্যে স্যার উইলিয়াম হ্যামিল্টন , যিনি যুক্তিবিদ্যা এবং অধিবিদ্যার উপর, ফিলিপ কেল্যান্ড গণিতের উপর, এবং জেমস ফোর্বস প্রাকৃতিক দর্শনের উপর শিক্ষা দিতেন।[11] তিনি তার চাহিদা মতো শিক্ষা পাননি,[35] তাই বিশ্ববিদ্যালয়ে অবসর সময়ে ও বিশেষ করে যখন তিনি গ্লেনলেয়ারে বাড়িতে ফিরে আসতেন সেই সময় ব্যক্তিগত অধ্যয়নে নিজেকে নিমজ্জিত করতেন।[36] সেখানে তিনি উন্নত রাসায়নিক, বৈদ্যুতিক এবং চৌম্বকীয় যন্ত্রপাতি নিয়ে পরীক্ষা করতেন; যাইহোক তিনি প্রধানত চিন্তিত হয়েছিলেন আলোর সমবর্তন বৈশিষ্ট্য বিবেচনা করে।[37] তিনি জেলাটিন আকৃতির ব্লকগুলো তৈরি করেছিলেন, সেগুলোকে বিভিন্ন চাপের মধ্যে দিয়েছিলেন। উইলিয়াম নিকোল তাকে যে এক জোড়া পোলারাইজিং প্রিজম দিয়েছিলেন, তিনি সেটি দিয়ে জেলির মধ্যে বিকশিত হওয়া রঙিন প্রান্তগুলি দেখেছিলেন।[38] তিনি এই অনুশীলনের মাধ্যমে আলোক স্থিতিস্থাপকতা আবিষ্কার করেন, যা শারীরিক কাঠামোর মধ্যে চাপের বন্টন নির্ধারণকারী একটি মাধ্যম।[39]
১৮ বছর বয়সে, ম্যাক্সওয়েল এডিনবার্গের রয়্যাল সোসাইটির সম্পাদিত কর্মের জন্য দুটি প্রবন্ধে অবদান রেখেছিলেন। তন্মধ্যে একটি হলো, "অন দা ইকুইলিব্রিয়াম অফ ইলাস্টিক সলিডস", যা তার জীবনের পরবর্তী সময়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারের ভিত্তি স্থাপন করেছিল, যা ছিল শিয়ার স্ট্রেস দ্বারা সান্দ্র তরলে উৎপাদিত অস্থায়ী দ্বি-প্রতিসরণ।[40] অন্যটি ছিল "রোলিং কার্ভস " এবং এডিনবার্গ একাডেমিতে তার লেখা "ওভাল কার্ভস"। প্রবন্ধটি মঞ্চে দাঁড়িয়ে উপস্থাপন করার জন্য তাকে আবারও জন্য খুব কম বয়সী বলে মনে করা হয়েছিল। প্রবন্ধটি তার পরিবর্তে, তার গৃহশিক্ষক কেল্যান্ডের মাধ্যমে রয়্যাল সোসাইটির কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল।[41]
ইতিমধ্যে একজন দক্ষ গণিতবিদ হয়ে ১৮৫০ সালের অক্টোবরে ম্যাক্সওয়েল কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য স্কটল্যান্ড ত্যাগ করেন। তিনি প্রাথমিকভাবে পিটারহাউসে যোগদান করেছিলেন, কিন্তু তার প্রথম বছর অতিক্রান্ত হওয়ার আগে তিনি ট্রিনিটিতে স্থানান্তরিত হন। তিনি বিশ্বাস করেছিলেন যে এখানে ফেলোশিপ পাওয়া সহজ হবে।[42] ট্রিনিটিতে তিনি কেমব্রিজ অ্যাপোস্টলস নামে পরিচিত একটি অভিজাত গোপন সমাজে নির্বাচিত হন।[43] ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে কাটানো বছরগুলিতে ম্যাক্সওয়েলের খ্রিস্টান বিশ্বাস এবং বিজ্ঞান সম্পর্কে বুদ্ধিবৃত্তিক বোঝার দ্রুত বৃদ্ধি ঘটে। তিনি বুদ্ধিজীবী অভিজাতদের স্বতন্ত্র বিতর্ক সমাজ "অ্যাপোস্টলস"-এ যোগদান করেন, যেখানে তিনি তার প্রবন্ধগুলোর মাধ্যমে এই বোঝার ব্যাপারটি কার্যকর করার চেষ্টা করেছিলেন।কেমব্রিজে ফিরে আসার পর, ম্যাক্সওয়েল তার সাম্প্রতিক অতিথিসেবককে নিম্নলিখিত সাক্ষ্য সহ একটি আলাপী এবং স্নেহপূর্ণ চিঠি লিখেছিলেন।[44]১৮৫১ সালের নভেম্বরে, ম্যাক্সওয়েল উইলিয়াম হপকিন্সের অধীনে অধ্যয়ন করেন, যিনি তার গাণিতিক প্রতিভা লালন করার সাফল্যের জন্য "সিনিয়র র্যাংলার মেকার" ডাকনাম অর্জন করেছিলেন।[45]
১৮৫৪ সালে, ম্যাক্সওয়েল ট্রিনিটি থেকে গণিতে একটি ডিগ্রি নিয়ে স্নাতক উত্তীর্ণ হন। তিনি চূড়ান্ত পরীক্ষায় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ স্থান অধিকার করেন যেখানে এডওয়ার্ড রাউথ প্রথম স্থান অধিকার করেন এতে ম্যাক্সওয়েল দ্বিতীয় র্যাংলারের খেতাব অর্জন করেন। পরবর্তীতে স্মিথস প্রাইজ পরীক্ষার আরও কঠোর অগ্নিপরীক্ষায় তাকে রাউথের সমান ঘোষণা করা হয়।[46] ম্যাক্সওয়েল তার ডিগ্রী অর্জনের পরপরই কেমব্রিজ ফিলোসফিক্যাল সোসাইটিতে তার গবেষণাপত্র "অন দ্য ট্রান্সফর্মেশন অফ সারফেসেস বাই বেন্ডিং" পাঠ করেন।[47] এটি ছিল তার লেখা কয়েকটি বিশুদ্ধভাবে গাণিতিক গবেষণাপত্রের মধ্যে একটি, যা একজন গণিতবিদ হিসাবে তার ক্রমবর্ধমান উচ্চতাকে প্রদর্শন করে।[48] ম্যাক্সওয়েল স্নাতকে উত্তীর্ণ হওয়ার পরে ট্রিনিটিতে থাকার সিদ্ধান্ত নেন এবং একটি ফেলোশিপের জন্য আবেদন করেন, তিনি আশা করেছিলেন যে এটি কয়েক বছর সময় নেবে।[49] একজন গবেষক ছাত্র হিসাবে তিনি তার সাফল্যের দ্বারা আনন্দিত ছিলেন, তিনি কিছু টিউটরিং এবং পরীক্ষার দায়িত্ব ছাড়াও নিজের অবসর সময়ে বৈজ্ঞানিক আগ্রহগুলোকে অন্বেষণ করার জন্য মুক্ত থাকতেন।[49]
এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোর্বসের ছাত্র থাকাকালীন সময়ে রঙের প্রকৃতি উপলব্ধি করার ব্যাপারে তার আগ্রহ জাগে।[50] ফোর্বসের উদ্ভাবিত রঙিন স্পিনিং টপস দিয়ে, ম্যাক্সওয়েল প্রমাণ করতে সক্ষম হন যে লাল, সবুজ এবং নীল আলোর মিশ্রণ থেকে সাদা আলো আসে।[50] ১৮৫৫ সালের মার্চ মাসে তিনি তার গবেষণাপত্র "এক্সপেরিমেন্টস অন কালার" যা রঙের সংমিশ্রণের নীতিগুলি তৈরি করে তা এডিনবার্গের রয়্যাল সোসাইটির কাছে উপস্থাপন করেন।[51] ম্যাক্সওয়েল এই সময় নিজেই এটি প্রদান করতে সক্ষম হয়েছিলেন।[51]
ম্যাক্সওয়েলকে ১৮৫৫ সালের ১০ অক্টোবর ট্রিনিটির একজন সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয় যা ছিল সাধারণ নিয়মের চেয়ে দ্রুততর[51] এবং সেই সুবাদে তাকে জলস্থিতিবিদ্দা ও আলোকবিজ্ঞানের উপর গবেষণাপত্র প্রস্তুত এবং পরীক্ষার প্রশ্নপত্র তৈরি করতে বলা হয়েছিল।[52] পরের বছরের ফেব্রুয়ারিতে ফোর্বস তাকে অ্যাবারডিন বিশ্ববিদ্যালয়ের মারিশাল কলেজের চেয়ার অফ ন্যাচারাল ফিলোসফির সদ্য শূন্য আসনের জন্য আবেদন করার জন্য আহ্বান জানায়।[53][54] তার পিতা তাকে প্রয়োজনীয় তথ্যসূত্র প্রস্তুত করার কাজে সহায়তা করেছিলেন কিন্তু ম্যাক্সওয়েলের প্রার্থীতার ফলাফল জানার আগেই তার পিতা ২ রা এপ্রিল গ্লেনলেয়ারে মারা যান।[54] ১৮৫৬ সালের নভেম্বরে তিনি কেমব্রিজ ছেড়ে অ্যাবারডিনে অধ্যাপকের পদ গ্রহণ করেন।[52]
ম্যাক্সওয়েল যখন মারি সালে যোগদান করেন তখন তার বয়স ২৫ বছর। এ কারণে ম্যাক্স ওয়েল অন্যান্য অধ্যাপক এর চেয়ে ১৫ বছরের ছোট ছিলেন। তিনি একটি বিভাগের প্রধান হিসাবে নিযুক্ত হন। তার নতুন দায়িত্ব ছিল পাঠ্যক্রম প্রণয়ন ও বক্তৃতা প্রস্তুত করা।[55] তিনি সপ্তাহে ১৫ ঘন্টা বক্তৃতা দেওয়ার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ করেন, যার মধ্যে তিনি স্থানীয় কর্মজীবী পুরুষদের কলেজে একটি সাপ্তাহিক জনকল্যাণমূলক বক্তৃতা দিতেন।[55] শিক্ষাবর্ষের ছয় মাস তিনি তার চাচাতো ভাই উইলিয়াম ডাইস কের সাথে অ্যাবারডিনে থাকতেন যিনি ছিলেন একজন স্কটিশ সিভিল প্রকৌশলী এবং গ্রীষ্মকালীন সময় ম্যাক্স ওয়েল তার গ্লেনলেয়ারের বাড়িতে কাটান, যে বাড়ি তিনি তার বাবার কাছ থেকে পেয়েছিলেন।[14]
তিনি তার মনোযোগকে একটি সমস্যায় কেন্দ্রীভূত করেছিলেন যা ২০০ বছর ধরে বিজ্ঞানীদের নজরে আসেনি। এটি ছিল শনির বলয়ের প্রকৃতি। এটা অজানা ছিল যে কিভাবে শনির বলয়গুলো বিচ্ছিন্ন না হয়ে, দূরে সরে না গিয়ে বা শনি গ্রহে ধাক্কা লেগে বিধ্বস্ত না হয় স্থিতিশীল থাকতে পারে।[56] এই সমস্যাটি সেই সময়ে একটি বিশেষ অনুরণন ফেলেছিল কারণ, কেমব্রিজের সেন্ট জনস কলেজ এটিকে ১৮৫৭ অ্যাডামস পুরস্কারের জন্য বিষয় হিসাবে নির্ধারণ করেছিল।[57] ম্যাক্সওয়েল সমস্যাটি অধ্যয়নের জন্য দুই বছর সময় ব্যয় করেছিলেন এবং প্রমাণ করেছিলেন যে একটি নিয়মিত কঠিন বলয় কখনো স্থিতিশীল হতে পারে না, যখন একটি তরল বলয়কে ব্লবে ভেঙে যেতে তরঙ্গ ক্রিয়া দ্বারা বাধ্য করা হয়। যেহেতু কোনটিই পরিলক্ষিত হয়নি, তাই তিনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে বলয়গুলো অবশ্যই অসংখ্য ছোট কণার সমন্বয়ে গঠিত হবে যাকে তিনি "বৃক-ব্যাট" নাম দিয়েছিলেন, যেগুলো প্রতিটি স্বাধীনভাবে শনিকে প্রদক্ষিণ করে।[57] ম্যাক্সওয়েল ১৮৫৯ সালে তার "শনির বলয়ের গতির স্থিতিশীলতার উপর" প্রবন্ধের জন্য £১৩০ অ্যাডামস পুরস্কারে ভূষিত হন[58]; তিনিই একমাত্র প্রবেশকারী ছিলেন যিনি একটি এন্ট্রি জমা দেওয়ার জন্য যথেষ্ট অগ্রগতি করেছিলেন।[59] তাঁর কাজটি এতই বিশদ এবং বিশ্বাসযোগ্য ছিল যে জর্জ বিডেল এয়ারি যখন এটি পড়েছিলেন তখন তিনি মন্তব্য করেছিলেন, "এটি আমার দেখা পদার্থবিদ্যার জন্য গণিতের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য প্রয়োগগুলোর মধ্যে একটি।"[1] এটি ছিল এই সমস্যার চূড়ান্ত সমাধান। ১৯৮০ এর দশকের ভয়েজার ফ্লাইবাইসের সরাসরি পর্যবেক্ষণ ম্যাক্সওয়েলের ভবিষ্যদ্বাণী নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত এটিকে এই বিষয়ে চূড়ান্ত সমাধান হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছিল যে বলয়গুলো কণা দ্বারা গঠিত।[60] তবে এখন বোঝা যাচ্ছে যে বলয়গুলোর কণাগুলো মোটেও স্থিতিশীল নয়, বরং সেগুলোকে মাধ্যাকর্ষণ শক্তির দ্বারা শনি তার নিজের দিকে টানছে। আগামী ৩০০ মিলিয়ন বছরের মধ্যে বলয়গুলো সম্পূর্ণরূপে অদৃশ্য হয়ে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।[61]
১৮৫৭ সালে ম্যাক্সওয়েল মারিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ রেভারেন্ড ড্যানিয়েল দেওয়ারের সাথে বন্ধুত্ব করেন।[62] তার মাধ্যমেেই ম্যাক্সওয়েল দেওয়ারের মেয়ে ক্যাথরিন মেরি দেওয়ারের সাথে দেখা করেন। তারা ১৮৫৮ সালের ২ রা জুন অ্যাবারডিনে বিয়ে করেন। বিয়ের রেকর্ডে, ম্যাক্সওয়েলকে অ্যাবারডিনের মারিশাল কলেজে প্রাকৃতিক দর্শনের অধ্যাপক হিসাবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছিল।[63] ক্যাথরিন ম্যাক্সওয়েলের চেয়ে সাত বছরের বড় ছিলেন। তার সম্পর্কে তুলনামূলকভাবে খুব কমই জানা যায়, তবে এটি জানা যায় যে তিনি ম্যাক্সওয়েলের ল্যাবের কাজে সাহায্য করেছিলেন এবং সান্দ্রতার পরীক্ষায় কাজ করেছিলেন।[64] ম্যাক্সওয়েলের জীবনীকার এবং বন্ধু, লুইস ক্যাম্পবেল, ক্যাথরিনের বিষয়ে একটি অচৈতন্যহীন অযৌক্তিকতা অবলম্বন করেছিলেন, তাদের বিবাহিত জীবনকে "একটি উদাহরণহীন ভক্তি" হিসাবে বর্ণনা করার মাধ্যমে।[65]
১৮৬০ সালে মারিশাল কলেজ প্রতিবেশী কিংস কলেজের সাথে একীভূত হয়ে অ্যাবারডিন বিশ্ববিদ্যালয় গঠন করে। প্রাকৃতিক দর্শনের দুই অধ্যাপকের জন্য কোন জায়গা ছিল না, তাই ম্যাক্সওয়েলের বৈজ্ঞানিক খ্যাতি থাকা সত্ত্বেও, তাকে ছাঁটাই করে দেয়া হয়েছিল। তিনি এডিনবার্গে ফোর্বসের সম্প্রতি খালি হওয়া আসনের জন্য আবেদন করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন, পদটি পরবর্তীতে টেইটের কাছে চলে যায়। এর পরিবর্তে ম্যাক্সওয়েলকে লন্ডনের কিংস কলেজে প্রাকৃতিক দর্শনের আসন দেওয়া হয়েছিল।[66] ১৮৬০ সালে গুটিবসন্তের মারাত্মক আক্রমণ থেকে সেরে ওঠার পর, তিনি তার স্ত্রীর সাথে লন্ডনে চলে যান।[67]
ম্যাক্সওয়েলের কিংস কলেজে কাটানো সময়টা সম্ভবত তার কর্মজীবন সবচেয়ে ফলপ্রসূ ছিল। তিনি ১৮৬০ সালে রঙের উপর কাজের জন্য রয়্যাল সোসাইটির রামফোর্ড পদক লাভ করেন এবং পরে ১৮৬১ সালে রয়্যাল সোসাইটিতে নির্বাচিত হন।[69] তিনি তার জীবনের এই সময়কালে বিশ্বের প্রথম আলোক-দ্রুত রঙিন আলোকচিত্র প্রদর্শন করেন, গ্যাসের সান্দ্রতা সম্পর্কে তাঁর ধারণাগুলো আরও বিকাশ করেন এবং ভৌত পরিমাণ সংজ্ঞায়িত করার একটি পদ্ধতির প্রস্তাব করবেন- যা এখন মাত্রিক বিশ্লেষণ নামে পরিচিত। ম্যাক্সওয়েল প্রায়ই রয়্যাল ইনস্টিটিউশনে বক্তৃতা দিতেন এবং তার সাথে সেখানে মাইকেল ফ্যারাডের নিয়মিত যোগাযোগ হত। দুই ব্যক্তির মধ্যকার সম্পর্ককে বন্ধুত্বের সম্পর্ক বলে বর্ণনা করা যায় না, কারণ ফ্যারাডে ম্যাক্সওয়েলের চেয়ে ৪০ বছরের বড় ছিলেন এবং তিনি বার্ধক্যের দিকে উপনীত হচ্ছিলেন। তবুও তারা একে অপরের প্রতিভার প্রতি দৃঢ় শ্রদ্ধা বজায় রেখেছিল।[70]
এই সময়টিতে ম্যাক্সওয়েল তড়িৎ এবং চুম্বকত্ব ক্ষেত্রে বিশেষ অগ্রগতি সাধন করেছিলেন। তিনি ১৮৬১ সালে প্রকাশিত তার দুই-খণ্ডের গবেষণাপত্র "অন ফিজিক্যাল লাইনস অফ ফোর্স"-এ বৈদ্যুতিক এবং চৌম্বক ক্ষেত্র উভয়ের প্রকৃতি পরীক্ষা করেন। এতে তিনি ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ইন্ডাকশনের জন্য একটি ধারণাগত মডেল প্রদান করেন, যার মধ্যে চৌম্বকীয় প্রবাহের ক্ষুদ্র স্পিনিং কোষ রয়েছে। ১৮৬২ সালের প্রথম দিকে একই গবেষণাপত্রে আরও দুটি অংশ যুক্ত করা হয় এবং প্রকাশিত হয়। প্রথম অতিরিক্ত অংশে তিনি ইলেক্ট্রোস্ট্যাটিক্স এবং সরণ প্রবাহের প্রকৃতি নিয়ে আলোচনা করেন। দ্বিতীয় অতিরিক্ত অংশে তিনি চৌম্বক ক্ষেত্রে আলোর সমবর্তনের সমতলের ঘূর্ণন নিয়ে কাজ করেছিলেন, যা ফ্যারাডে আবিষ্কার করেছিলেন এবং বর্তমানে এটি ফ্যারাডে প্রভাব নামে পরিচিত।[71]
১৮৬৫ সালে ম্যাক্সওয়েল লন্ডনের কিংস কলেজের আসন থেকে পদত্যাগ করেন এবং ক্যাথরিনের সাথে গ্লেনলেয়ারে ফিরে আসেন। তিনি তাঁর গবেষণাপত্র "অন গভর্নরস" (১৯৬৮)-এ গাণিতিকভাবে গভর্নর ডিভাইসের ব্যবহার বর্ণনা করেছেন-যে ডিভাইসগুলো বাষ্প ইঞ্জিনের গতি নিয়ন্ত্রণ করে-যার মাধমে তিনি নিয়ন্ত্রণ প্রকৌশলের তাত্ত্বিক ভিত্তি স্থাপন করেন।[72] তার গবেষণাপত্র "অন রেসিপ্রোকাল ফিগারস, ফ্রেম অ্যান্ড ডায়াগ্রামস অফ ফোরসেস" (১৮৭০) এ তিনি জালির বিভিন্ন ডিজাইনের অনমনীয়তা নিয়ে আলোচনা করেছেন।[73][74] তিনি থিওরি অফ হিট (১৮৭১) এবং ত্রিটাইজ ম্যাটার অ্যান্ড মোশন (১৮৭৬) গ্রন্থ রচনা করেন। ১৮৭১ সালে ম্যাক্সওয়েলই প্রথম মাত্রিক বিশ্লেষণের সুস্পষ্ট ব্যবহার করেছিলেন।[75]
১৮৭১ সালে তিনি পদার্থবিদ্যার প্রথম ক্যাভেন্ডিশ অধ্যাপক হতে কেমব্রিজে ফিরে আসেন।[76] ম্যাক্সওয়েলকে ভবনের অগ্রগতির প্রতিটি পদক্ষেপের তত্ত্বাবধান এবং যন্ত্রপাতি সংগ্রহের জন্য ক্যাভেন্ডিশ ল্যাবরেটরির উন্নয়নের দায়িত্বে নিযুক্ত করা হয়েছিল।[77] বিজ্ঞানে ম্যাক্সওয়েলের শেষ মহান অবদানগুলোর মধ্যে একটি ছিল হেনরি ক্যাভেন্ডিশের গবেষণার সম্পাদনা করা (প্রচুর মূল নোট সহ), যেখান থেকে দেখা যায় যে ক্যাভেন্ডিশ পৃথিবীর ঘনত্ব এবং জলের গঠনের মতো অন্যান্য বিষয়গুলো নিয়ে গবেষণা করেছে।[78] তিনি ১৮৭৬ সালে আমেরিকান ফিলোসফিক্যাল সোসাইটির সদস্য হিসাবে নির্বাচিত হন।[79]
১৮৭৯ সালের এপ্রিলে ম্যাক্সওয়েলের খাবার গলধঃকরণ করতে সমস্যা হয়েছিল । আর এটি ছিল তার গুরুতর অসুস্থতার প্রথম লক্ষণ।[80]
ম্যাক্সওয়েল ১৮৭৯ সালের ৫ নভেম্বর ৪৮ বছর বয়সে পেটের ক্যান্সারে কেমব্রিজে মারা যান।[34] তার মা একই বয়সে একই ধরনের ক্যান্সারে মারা গিয়েছিলেন।[81] যে সেবক তার জীবনের শেষ সময়গুলোতে নিয়মিত তার সাথে দেখা করতেন তিনি তার স্পষ্টতা এবং তার স্মৃতির অপার শক্তি এবং সুযোগে বিস্মিত হয়েছিলেন, এবং বিশেষভাবে আরও মন্তব্য করেছিলেন,
... তার অসুস্থতা মানুষের সমস্ত হৃদয় এবং আত্মাকে আকৃষ্ট করেছিল: অবতার এবং এর সমস্ত ফলাফলের প্রতি তার দৃঢ় এবং সন্দেহাতীত বিশ্বাস ছিল ; প্রায়শ্চিত্তের সম্পূর্ণ চেষ্টায়; পবিত্র আত্মার কাজে। তিনি দর্শনের সমস্ত স্কিম এবং সিস্টেমগুলিকে পরিমাপ করেছিলেন এবং বুঝতে পেরেছিলেন এবং সেগুলোকে একেবারে খালি এবং অতৃপ্তিদায়ক হিসেবে খুঁজে পেয়েছিলেন - এগুলো সম্পর্কে তিনি "অকার্যকর" শব্দ ব্যবহার করেছেন - এবং তিনি সরল বিশ্বাস নিয়ে ত্রাণকর্তার গসপেলের প্রতি সরল ফিরেছিলেন।
মৃত্যুর কাছাকাছি সময়ে ম্যাক্সওয়েল কেমব্রিজের একজন সহকর্মীকে বলেছিলেন,[44]
আমি ভাবছিলাম যে কতটা ভদ্রভাবে আমার সাথে সবসময় আচরণ করা হয়েছে। আমি আমার সারাজীবনে কখনও হিংসাত্মক ধাক্কা খাইনি। আমার একমাত্র ইচ্ছা হচ্ছে ডেভিডের মতো ঈশ্বরের ইচ্ছায় আমার নিজের প্রজন্মের সেবা করা এবং তারপর ঘুমিয়ে পড়া।
ম্যাক্সওয়েলকে গ্যালোওয়ের ক্যাসেল ডগলাসের কাছে পার্টন কার্কে দাফন করা হয় যেখানে তিনি বেড়ে উঠেছিলেন।[82] তার প্রাক্তন সতীর্থ এবং প্রানের বন্ধু অধ্যাপক লুইস ক্যাম্পবেলের বর্ধিত জীবনী দ্য লাইফ অফ জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল, ১৮৮২ সালে প্রকাশিত হয়েছিল।[83][84] ১৮৯০ সালে তার সংগৃহীত কাজ কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস দ্বারা দুটি খণ্ডে প্রকাশ করা হয়।[85]
ম্যাক্সওয়েলের এস্টেটের নির্বাহক ছিলেন তার চিকিৎসক জর্জ এডওয়ার্ড পেগেট, জি জি স্টোকস এবং কলিন ম্যাকেঞ্জি( যিনি ম্যাক্সওয়েলের চাচাতো ভাই ছিলেন)। কাজের চাপে স্টোকস ম্যাক্সওয়েলের কাগজপত্র উইলিয়াম গারনেটের কাছে দিয়েছিলেন, যিনি ১৮৮৪ সাল পর্যন্ত কাগজপত্রগুলোর কার্যকর হেফাজত করেছিলেন।[86]
ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবেতে গায়কদলের পর্দার কাছে তাঁর একটি স্মারক শিলালিপি রয়েছে।[87]
স্কটিশ কবিতার একজন মহান প্রেমিক হিসেবে ম্যাক্সওয়েল কবিতা মুখস্থ করতেন এবং নিজেও কবিতা লিখতেন। তার লেখা [88] সবচেয়ে পরিচিত কবিতা হল রিজিড বডি সিংস, যা সম্ভবত রবার্ট বার্নসের "কমিন থ্রু দ্য রাই" এর উপর ভিত্তি করে লেখা,যেটি তিনি সম্ভবত গিটার বাজানো সময় গাইতেন। কবিতার শুরুর লাইনগুলো হল,[89]
জিন এ বডি মিট এ বডি
ফ্লায়িং থ্র দা এয়ার.
জিন এ বডি হিট এ বডি,উইল ইট ফ্লাই? অ্যান্ড হয়ার?
তার কবিতার একটি সংকলন তার বন্ধু লুইস ক্যাম্পবেল ১৮৮২ সালে প্রকাশ করেছিলেন।[90]
ম্যাক্সওয়েলের বর্ণনায় তার উল্লেখযোগ্য বুদ্ধিবৃত্তিক গুণাবলী সামাজিক বিশ্রীতার সাথে মিলে যাওয়ার বিষয় উঠে এসেছে।[91]
ম্যাক্সওয়েল একজন ধর্মপ্রচারক প্রেসবিটেরিয়ান ছিলেন এমনকি তিনি তার জীবনের শেষ বছরগুলোতে স্কটল্যান্ডের গির্জার একজন প্রবীণ হন।[92] ম্যাক্সওয়েলের ধর্মীয় বিশ্বাস এবং এর সাথে সম্পর্কিত ক্রিয়াকলাপগুলি বেশ কয়েকটি গবেষণাপত্রের কেন্দ্রবিন্দু হয়েছে।[93][94][95][96] ছোটবেলায় চার্চ অফ স্কটল্যান্ড (তাঁর পিতার সম্প্রদায়) এবং এপিস্কোপ্যালিয়ান (তার মাতার সম্প্রদায়) উভয় পরিষেবায়ই তিনি যোগদান করে,১৮৫৩ সালের এপ্রিল মাসে ম্যাক্সওয়েল একটি ইভাঞ্জেলিক্যাল ধর্মের অধীন হন। এই রূপান্তরের একটি দিক তাকে একটি অ্যান্টিপজিটিভিস্ট অবস্থানের সাথে সংযুক্ত করে।[95]
১৮৫৫ সালের প্রথম দিকে যখন ম্যাক্সওয়েল তার গবেষণাপত্র "অন ফ্যারাডে'স লাইন্স অফ ফোর্স" কেমব্রিজ ফিলোসফিক্যাল সোসাইটিতে পাঠ করেন তখন তিনি তড়িৎ এবং চুম্বকত্বের উপর অধ্যয়ন এবং মন্তব্য করেছিলেন।[97] গবেষণাপত্রটি ছিল ফ্যারাডের কাজের একটি সরলীকৃত মডেল এবং এই গবেষণাপত্রে কীভাবে তড়িৎ ও চুম্বকত্ব সম্পর্কিত তা উপস্থাপন করা হয়। তিনি ২০ ধরণের পরিবর্তনশীল ২০টি সমীকরণের সাথে ডিফারেনশিয়াল সমীকরণের একটি সম্পর্কযুক্ত সেটে বর্তমান জ্ঞানের সমস্ত অংশকে হ্রাস করেছেন। এই কাজটি পরে ১৮৬১ সালের মার্চ মাসে "অন ফিজিক্যাল লাইনস অফ ফোর্স" হিসাবে প্রকাশিত হয়েছিল।[98]
১৮৬২ সালের দিকে, কিংস কলেজে বক্তৃতা দেওয়ার সময়, ম্যাক্সওয়েল হিসাব করেছিলেন যে একটি তাড়িত চৌম্বক ক্ষেত্রের চলার গতি প্রায় আলোর গতির সমান। তিনি এটিকে শুধুমাত্র একটি কাকতালীয় ঘটনা বলে মনে করেন এবং মন্তব্য করেন, "সর্বশেষে আমরা খুব কমই এটি এড়াতে পারি যে আলোক তরঙ্গ একই মাধ্যমে বৈদ্যুতিক এবং চৌম্বকীয় ঘটনার কারণ।[1]
সমস্যাটি নিয়ে আরও কাজ করে ম্যাক্সওয়েল দেখিয়েছিলেন যে সমীকরণগুলো লম্বিত বৈদ্যুতিক এবং চৌম্বক ক্ষেত্রের তরঙ্গগুলোর অস্তিত্বের ভবিষ্যদ্বাণী করে, যা খালি স্থানের মধ্য দিয়ে যে গতিতে ভ্রমণ করে তা সাধারণ বৈদ্যুতিক পরীক্ষাগুলো থেকে অনুমান করা যেতে পারে; সেই সময়ে উপলব্ধিকৃত তথ্য ব্যবহার করে, ম্যাক্সওয়েল প্রতি সেকেন্ডে এর বেগ ৩১০,৭৪০,০০০মিটার পেয়েছিলেন (১.০১৯৫×১০৯ ফুট/সেকেন্ড)।[99] তার ১৮৬৫ সালের গবেষণাপত্র "এ ডাইনামিক্যাল থিওরি অফ দ্য ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ফিল্ড"-এ ম্যাক্সওয়েল লিখেছেন, "ফলাফল থেকে মনে হয় যে আলো একটি তাড়িত চৌম্বক ব্যাঘাত যা তাড়িত চৌম্বকীয় আইন অনুসারে ক্ষেত্রের মাধ্যমে প্রবাহিত হয়।[4]
তার বিখ্যাত বিশটি সমীকরণ আংশিক ডিফারেনশিয়াল সমীকরণের আধুনিক আকারে ১৮৭৩ সালে তার বই এ ত্রিটাইজ অন ইলেকট্রিসিটি-এ প্রথম সম্পূর্ণরূপে বিকশিত আকারে আবির্ভূত হয়।[100] এই কাজের বেশিরভাগই ম্যাক্সওয়েল তার লন্ডনের এবং ক্যাভেন্ডিশ পদ গ্রহণের মধ্যবর্তী সময়ে গ্লেনলেয়ারে করেছিলেন।[1] অলিভার হেভিসাইড ম্যাক্সওয়েলের তত্ত্বের জটিলতাকে চারটি আংশিক ডিফারেনশিয়াল সমীকরণে নামিয়ে এনেছেন,[101] যা এখন সম্মিলিতভাবে ম্যাক্সওয়েলের তত্ত বা ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণ নামে পরিচিত। যদিও ঊনবিংশ শতাব্দীতে সম্ভাব্যতা অনেক কম জনপ্রিয় হয়ে ওঠে,[102] তবে বর্তমানে ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণের সমাধানে স্কেলার এবং ভেক্টর পটেনশিয়ালের ব্যবহার মানসম্মত।[103]
যেমনটি ব্যারেট এবং গ্রিমস (১৯৯৫) বর্ণনা করেছেনঃ[104]
ম্যাক্সওয়েল কোয়াটারনিয়নের বীজগণিতে তড়িৎচুম্বকত্ব প্রকাশ করেন এবং তড়িৎ চৌম্বকীয় সম্ভাবনাকে তার তত্ত্বের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেন। ১৮৮১ সালে হেভিসাইড ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক তত্ত্বের কেন্দ্রবিন্দু হিসাবে বল ক্ষেত্র দ্বারা ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিকের সম্ভাব্য ক্ষেত্রকে প্রতিস্থাপন করে। হেভিসাইডের মতে, ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক সম্ভাব্য ক্ষেত্রটি বিধিবহির্ভূত ছিল এবং "পরিবর্তন" করার প্রয়োজন ছিল। কয়েক বছর পর হেভিসাইড এবং পিটার গুথরি টেটের মধ্যে ভেক্টর বিশ্লেষণ এবং কোয়াটারনিয়নের আপেক্ষিক যোগ্যতা নিয়ে বিতর্ক হয়। ফলাফল ছিল উপলব্ধি যে তত্ত্বটি সম্পূর্ণরূপে স্থানীয় হলে কোয়াটার্নিয়ন দ্বারা প্রদত্ত বৃহত্তর বাস্তব অন্তর্দৃষ্টির কোন প্রয়োজন নেই এবং ভেক্টর বিশ্লেষণ সাধারণ বিষয় হয়ে উঠেছে।
ম্যাক্সওয়েল সঠিক প্রমাণিত হয়েছিলেন এবং আলো ও তড়িৎচুম্বকত্বের মধ্যে তার পরিমাণগত সম্পর্ককে ১৯ শতকের গাণিতিক পদার্থবিজ্ঞানের একটি মহান কৃতিত্ব হিসাবে বিবেচনা করা হয়।[105]
হেনরিখ হার্টজ ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণ সম্পর্কে বলেছিলেন, "এই বিস্ময়কর তত্ত্বটি অনুভব না করে অধ্যয়ন করা অসম্ভব, মনে হয় যেন গাণিতিক সমীকরণগুলোর নিজস্ব একটি স্বাধীন জীবন এবং বুদ্ধিমত্তা রয়েছে, যেন তারা আমাদের চেয়ে জ্ঞানী, প্রকৃতপক্ষে তারা তাদের আবিষ্কারকের চেয়ে জ্ঞানী, যেন তিনি তাদের মধ্যে যা দিয়েছেন তার চেয়ে বেশি তারা দিয়েছেন।" হার্টজ রেডিও তরঙ্গ তৈরি করতে ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণ ব্যবহার করেছিলেন, যার ফলে রাডার এবং আরও অনেক কিছু আবিষ্কার হয়েছিল।[106]
তাছাড়াও ম্যাক্সওয়েল, ফ্যারাডে বর্ণিত বল রেখার তুলনায় তড়িৎ চৌম্বক ক্ষেত্রের ধারণা প্রবর্তন করেছিলেন।[107] সক্রিয় কণা দ্বারা নির্গত একটি ক্ষেত্র হিসাবে তড়িৎচুম্বকত্বের বিস্তার বোঝার মাধ্যমে, ম্যাক্সওয়েল আলোর উপর তার কাজকে এগিয়ে নিয়েছিলেন। সেই সময়ে, ম্যাক্সওয়েল বিশ্বাস করতেন যে আলোক তরঙ্গের প্রবাহের জন্য একটি মাধ্যমের প্রয়োজন, যাকে বলা হয় আলোকময় ইথার।[107] সময়ের সাথে সাথে, এই ধরনের একটি মাধ্যমের অস্তিত্ব, যা সমস্ত স্থানের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয় কিন্তু তা আপাতদৃষ্টিতে যান্ত্রিক উপায়ে সনাক্ত করা যায় না, এমনকি মাইকেলসন-মর্লে পরীক্ষার মতো পরীক্ষাগুলোর সাথে সামঞ্জস্য করাও অসম্ভব।.[108] তদুপরি, এটির জন্য একটি নিশ্চিত রেফারেন্সের ফ্রেমের প্রয়োজন ছিল যেখানে সমীকরণগুলো যুক্তিসিদ্ধ ছিল, বিরক্তিকর ফলাফলের সাথে যে সমীকরণগুলি একটি চলমান পর্যবেক্ষকের জন্য রূপ পরিবর্তন করেছিল। এই অসুবিধাগুলি আলবার্ট আইনস্টাইনকে বিশেষ আপেক্ষিকতার তত্ত্ব প্রণয়নে অনুপ্রাণিত করেছিল; এই প্রক্রিয়ায় আইনস্টাইন একটি স্থির আলোকিত ইথারের প্রয়োগ করেছিলেন।[109]
তৎকালীন অধিকাংশ পদার্থবিদদের পাশাপাশি ম্যাক্সওয়েলের মনোবিজ্ঞানের প্রতি প্রবল আগ্রহ ছিল। আইজ্যাক নিউটন এবং থমাস ইয়ং এর পদক্ষেপ অনুসরণ করে, তিনি দৃশ্যমান রং অধ্যয়নে বিশেষভাবে আগ্রহী ছিলেন। ১৮৫৫ থেকে ১৮৭২ সাল পর্যন্ত ম্যাক্সওয়েল রঙ, বর্ণ-অন্ধত্ব, এবং রঙ তত্ত্বের উপলব্ধি সম্পর্কিত তদন্তের একটি সিরিজ প্রকাশ করেন এবং "অন দ্য থিওরি অফ কালার ভিশন" এর জন্য রামফোর্ড পদক লাভ করেন।[110]
আইজ্যাক নিউটন প্রিজম ব্যবহার করে দেখিয়েছিলেন যে সাদা আলো, যেমন সূর্যালোক, অনেকগুলো একরঙা উপাদানের সমন্বয়ে গঠিত যা আবার পরে সাদা আলোতে মিলিত হতে পারে।[111] নিউটন আরও দেখিয়েছিলেন যে হলুদ এবং লাল রং দিয়ে তৈরি একটি কমলা রঙ হুবহু একরঙা কমলা আলোর মতো দেখতে পারে , যদিও তা দুটি একরঙা হলুদ এবং লাল আলোর সমন্বয়ে গঠিত। তাই প্যারাডক্স, যা তৎকালীন পদার্থবিজ্ঞানীদের বিভ্রান্ত করেছিল যে: দুটি জটিল আলো (একাধিক একরঙা আলোর সমন্বয়ে গঠিত) দেখতে একই রকম হতে পারে কিন্তু গঠনগতভাবে এগুলো ভিন্ন, যাকে বলা হয় মেটামার। থমাস ইয়ং পরে প্রস্তাব করেন যে এই প্যারাডক্সটি চোখে অনুভূত রঙের দ্বারা সীমিত সংখ্যক নালীর মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে,যা তিনি তিনগুণ হওয়ার প্রস্তাব করেছিলেন[112], ট্রাইক্রোম্যাটিক রঙ তত্ত্বে। ম্যাক্সওয়েল ইয়ং এর তত্ত্ব প্রমাণ করার জন্য সম্প্রতি উন্নয়নকৃত রৈখিক বীজগণিত ব্যবহার করেছিলেন। যে কোনো একরঙা আলো উদ্দীপক, তিনটি রিসেপ্টর তিনটি ভিন্ন একরঙা আলোর সেট দ্বারা সমানভাবে উদ্দীপিত হতে সক্ষম হওয়া উচিত (এমনকি, তিনটি ভিন্ন আলোর যে কোনো সেট দ্বারা)। তিনি রঙ মেলানো পরীক্ষা এবং বর্ণমিতির উদ্ভাবন করেছেন।[113]
ম্যাক্সওয়েল রঙিন ফটোগ্রাফিতে তার রঙ উপলব্ধির তত্ত্ব প্রয়োগ করতে আগ্রহী ছিলেন,। রঙের উপলব্ধি তার মনস্তাত্ত্বিক কাজ থেকে সরাসরি উদ্ভূত ছিল: যদি যেকোন তিনটি আলোর যোগফল কোন বোধগম্য রঙের পুনরুৎপাদন করতে পারে, তাহলে তিনটি রঙিন ফিল্টারের একটি সেট দিয়ে রঙিন ফটোগ্রাফ তৈরি করা যেতে পারে। তার ১৮৫৫ সালের গবেষণাপত্রে, ম্যাক্সওয়েল প্রস্তাব করেছিলেন যে, যদি একটি দৃশ্যের তিনটি সাদা-কালো ফটোগ্রাফ লাল, সবুজ এবং নীল ফিল্টারের মাধ্যমে তোলা হয় এবং তিনটি প্রজেক্টর দিয়ে সজ্জিত চিত্রগুলির স্বচ্ছ প্রিন্টগুলি একটি স্ক্রিনে অনুরূপ ফিল্টার দিয়ে প্রজেক্ট করা হয় এবং যখন পর্দায় সুপারইম্পোজ করা হয় তখন ফলাফলটি দৃশ্যের সমস্ত রঙের সম্পূর্ণ পুনরুৎপাদন হিসাবে মানুষের চোখ দ্বারা অনুভূত হয়।[114]
১৮৬১ সালে রয়্যাল ইনস্টিটিউশনে রঙ তত্ত্বের একটি বক্তৃতা দেওয়ার সময়, ম্যাক্সওয়েল তিন রঙের বিশ্লেষণ এবং সংশ্লেষণের এই নীতির মাধ্যমে বিশ্বের প্রথম রঙিন ফটোগ্রাফির প্রদর্শনী উপস্থাপন করেন। সিঙ্গেল-লেন্স রিফ্লেক্স ক্যামেরার উদ্ভাবক টমাস সাটন ছবিটি তুলেছিলেন। তিনি লাল, সবুজ এবং নীল ফিল্টারের মাধ্যমে তিনবার একটি টার্টান ফিতার ছবি তোলেন, এছাড়াও একটি হলুদ ফিল্টারের মাধ্যমে চতুর্থ ছবি তোলেন, যা ম্যাক্সওয়েলের বর্ণনা অনুসারে, প্রদর্শনীতে ব্যবহার করা হয়নি। যেহেতু সাটনের ফটোগ্রাফিক প্লেটগুলি লালের প্রতি সংবেদনশীল ছিল এবং সবুজের প্রতি সংবেদনশীল ছিল না, তাই এই অগ্রগামী পরীক্ষার ফলাফলগুলোও নিখুঁত ছিল না। বক্তৃতার প্রকাশিত বিবরণে এটি মন্তব্য করা হয়েছিল যে "লাল এবং সবুজ ছবিগুলি যদি নীলের মতো সম্পূর্ণরূপে ছবি তোলা হত", তবে এটি "রিব্যান্ডের সত্যিকারের রঙিন চিত্র হত ৷ কম অপসারণযোগ্য রশ্মির মাধ্যমে ফটোগ্রাফিক সামগ্রীগুলিকে আরও সংবেদনশীল খুঁজে বের করলে বস্তুর রঙের উপস্থাপনা আরও অনেক উন্নত হতে পারতো।[69][115][116] ১৯৬১ সালে গবেষকরা এই পরিণতিতে পৌঁছেছিলেন যে লাল-ফিল্টারযুক্ত এক্সপোজারের অতিবেগুনী আলোর কারণে আপাতদৃষ্টিতে আংশিক অসম্ভব সাফল্য হয়েছিল ,যা কিছু লাল রঞ্জক দ্বারা দৃঢ়ভাবে প্রতিফলিত হয়, আর এই ব্যবহৃত লাল ফিল্টার দ্বারা সম্পূর্ণরূপে অবরুদ্ধ নয় এবং ভিজা কোলোডিয়ন প্রক্রিয়ার সংবেদনশীলতার সেই সীমার মধ্যে সাটন নিযুক্ত।[117]
ম্যাক্সওয়েল গ্যাসের গতিতত্ত্বও পরীক্ষা করেছিলেন। ড্যানিয়েল বার্নোলির সাথে উদ্ভূত, এই তত্ত্বটি জন হেরাপথ, জন জেমস ওয়াটারস্টন, জেমস জুল এবং বিশেষ করে রুডলফ ক্লসিয়াসের ধারাবাহিক শ্রম দ্বারা এমনভাবে উন্নত হয়েছিল যে এর সাধারণ নির্ভুলতা সন্দেহের বাইরে ছিল; কিন্তু এটি ম্যাক্সওয়েলের কাছ থেকে ব্যাপক বিকাশ লাভ করেছে, যিনি এই ক্ষেত্রে একজন পরীক্ষার্থীর (বায়বীয় ঘর্ষণ আইনের উপর) পাশাপাশি একজন গণিতবিদ হিসাবে আবির্ভূত হয়েছিলেন।[118]
১৮৫৯ এবং ১৮৬৬ সালের মধ্যে, তিনি একটি গ্যাসের কণার মধ্যে বেগের বণ্টনের তত্ত্ব তৈরি করেছিলেন, কাজটি পরে লুডভিগ বোল্টজম্যান দ্বারা সরলীকরণ করা হয়েছিল।[119][120] ম্যাক্সওয়েল-বোল্টজম্যান ডিস্ট্রিবিউশন নামক সূত্রটি যে কোনো তাপমাত্রায় একটি নির্দিষ্ট বেগে চলমান গ্যাসের অণুর ভগ্নাংশ প্রকাশ করে। গতিতত্ত্বে, তাপমাত্রা এবং তাপ শুধুমাত্র আণবিক গতির সাথে জড়িত। এই পদ্ধতিটি থার্মোডাইনামিক্সের পূর্বে প্রতিষ্ঠিত আইনগুলিকে সরলীকরণ করেছে এবং বিদ্যমান পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষাগুলোকে পূর্বের অর্জনের চেয়ে আরও ভাল উপায়ে ব্যাখ্যা করেছে। তাপগতিবিদ্যার উপর তার কাজ তাকে ম্যাক্সওয়েলের ডেমন নামে পরিচিত একটি পরীক্ষা তৈরি করতে পরিচালিত করেছিল, যেখানে শক্তি দ্বারা যেকোনো কণা বাছাই করতে সক্ষম একটি কাল্পনিক সত্তা দ্বারা তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় আইনকে লঙ্ঘন করা হয়।[121]
১৮৭১ সালে ম্যাক্সওয়েল, ম্যাক্সওয়েলের থার্মোডাইনামিক সম্পর্ক স্থাপন করেন, যা বিভিন্ন থার্মোডাইনামিক ভেরিয়েবলের সাপেক্ষে থার্মোডাইনামিক সম্ভাব্যতার দ্বিতীয় ডেরিভেটিভের মধ্যে সমতার বিবৃতি প্রদান করে। ১৮৭৪ সালে, তিনি আমেরিকান বিজ্ঞানী জোসিয়াহ উইলার্ড গিবসের গ্রাফিকাল থার্মোডাইনামিক কাগজপত্রের উপর ভিত্তি করে ফেজ ট্রানজিশন অন্বেষণ করার উপায় হিসাবে একটি প্লাস্টার থার্মোডাইনামিক ভিজ্যুয়ালাইজেশন তৈরি করেছিলেন।[122][123]
ম্যাক্সওয়েল, প্রসিডিংস অফ দ্য রয়্যাল সোসাইটিতে "অন গভর্নরস" গবেষণাপত্রটি প্রকাশ করেছেন, খণ্ড ১৬ (১৮৬৭-১৮৬৮)।[124] এই গবেষণাপত্রটিকে নিয়ন্ত্রণ তত্ত্বের প্রাথমিক দিনগুলির একটি কেন্দ্রীয় গবেষণাপত্র হিসাবে বিবেচনা করা হয়।[125] এখানে "গভর্নর" বলতে গভর্নর বা কেন্দ্রাতিগ গভর্নরকে বোঝায় যা বাষ্প ইঞ্জিনগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যবহৃত হয়।
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.