Loading AI tools
ভারতবর্ষের এক কৃষক জাতি। উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
কুড়মি বাংলাদেশ, নেপাল, মরিশাস এবং ভারতে বসবাসকারী একটি জনগোষ্ঠী। অন্যান্য জনগোষ্ঠীর মত, কুড়মিদেরও নিজস্ব ভাষা, নিজস্ব পরিচয়, সামাজিক রীতিনীতি, আচার-অনুষ্ঠান, সংস্কৃতি, বর্ণ পরিচয় এবং সামাজিক বৈচিত্র্য রয়েছে; যা তাদের একটি স্বতন্ত্র জনগোষ্ঠী হিসেবে পরিচয় দিয়েছে। কুড়মি জনগোষ্ঠীর অধিকাংশের নিবাস হলো ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের পুরুলিয়া জেলা, ঝাড়গ্রাম জেলা, পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা, বাঁকুড়া জেলা সহ ঝাড়খণ্ড রাজ্য , ওড়িশা রাজ্য এবং আসাম রাজ্যের এর বিভিন্ন অঞ্চলে।
উল্লেখযোগ্য জনসংখ্যার অঞ্চল | |
---|---|
ঝাড়খণ্ড, উড়িষ্যা, পশ্চিমবঙ্গ,আসাম | |
ভাষা | |
কুড়মালি |
বাংলাদেশের বেশ কিছু জেলাতে এদের বসবাস লক্ষ্য করা যায়, তবে সিরাজগঞ্জ জেলার রায়গঞ্জ, তাড়াশ ও সলংগা থানায় এবং বগুড়া জেলার শেরপুর থানায় এরা বেশির ভাগ বসবাস করে। তাছাড়াও জয়পুরহাট জেলার কাশপুর, মহিপুর, দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট থানায়, নওগাঁ জেলার ধামইরহাট থানায়, রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ী ও তানোরে, চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার নাচোলে, পাবনা জেলার চাটমোহরে, ফরিদপুর জেলার বালিয়াকান্দি ও বোয়ালমারী থানায়, নাটোর ও খুলনা জেলার কয়রা থানায়, সিলেট ও মৌলভীবাজার জেলায় বেশ কিছু কুড়মি মাহাতো পরিবার বসবাস করে আসছে। [1]
অধিকাংশ জনগোষ্ঠীর আদি নিবাস হলো ভারতের বর্তমান ঝাড়খণ্ড প্রদেশের নানা প্রত্যন্ত অঞ্চলে। সেখান থেকে কতদিন আগে তাঁরা বাংলাদেশে আসে তার সঠিক ইতিহাস জানা যায়নি, তবে শোনা যায়, মাহাতোরা খুবই কর্মঠ, নিরীহ ও শান্ত স্বভাবের মানুষ। ঝগড়া, গন্ডগোল, অশান্তিমুলক কার্যকলাপকে তাঁরা প্রশ্রয় দেয় না, কিংবা তাতে কখনই অংশগ্রহণ করে না। তারা সব সময় নিজেদের মধ্যে এবং অপরদের মধ্যে সর্বদা মিলে মিশে থাকতে বেশি পছন্দ করে। তাদের প্রধান আদর্শ হচ্ছে যে, “যদি প্রত্যেকের মধ্যে পারস্পরিক সহানুভূতি না থাকে তাহলে কীভাবে একটি শান্তিময় সমাজ তারা পাবে”।
মাহাতোরা অর্থাৎ বেশির ভাগ মাহাতো যারা বাংলাদেশে আছে তারা কুর্মী বা কুড়মি জনগোষ্ঠীর। কুড়মিরা নামের শেষে মাহাতো কথাটি ব্যবহার করে বলে এরা মাহাতো নামে অধিক পরিচিত।[2] আসলে এরা সবাই কুড়মি জনগোষ্ঠীর অর্ন্তগত; কারণ এদের ভাষা কুড়মালি; যা ভারতের ঝাড়খণ্ড, বিহার, উড়িষ্যা, পশ্চিম বঙ্গ, আসামে এখনো প্রচলিত আছে এবং মাহাতোরা নিজেদের মধ্যে কুড়মালি ভাষায় কথা বলে। কুড়মি মাহাতোদের কিছু অংশ প্রথমে ঢাকার কুর্মীটোলায় হয়তো বসবাস শুরু করেছিল তাই হয়তো স্থানীয় লোকজন এই জায়গার নাম দিয়েছেন কুর্মীদের নাম অনুসারে কুর্মীটোলা। মুলত গোষ্ঠীগত দিক থেকে এরা সবাই কুড়মি হলেও এদের সম্প্রদায়ের পদবি হলো মাহাতো। এরা সবাই এদের নামের শেষে মাহাতো কথাটি ব্যবহার করে। অনেকে মনে করেন মহৎ থেকে মাহাতো কথাটি এসেছে, এটি আসলে ঠিক নয়, তবে কেউ কেউ নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে মাহাতো কথাটি মহৎ হতে এসেছে বলে বিশ্লেষন করেন। কিন্তু এটি আসলে আদৌও যৌক্তিক নয়। মাহাতো কথাটি পূর্ব থেকে আজো অবিকৃত অবস্থায় আছে।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]
কুড়মি মাহাতো জনগোষ্ঠী ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিভিন্ন বিভিন্ন বিদ্রোহে ভূমিকা রয়েছে। ভারতের ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্ৰামে চুয়াড় বিদ্রোহের উল্লেখযোগ্য নেতা ছিলেন রঘুনাথ মাহাতো।[3][4][5] তিনি ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহ করেছিলেন তা চুয়াড় বিদ্রোহ নামে পরিচিত। তিনি "আপনা গাঁও, আপনা রাজ; দূর ভাগাও বিদেশী রাজ" এই শ্লোগান দিয়েছিলেন।[6][7]
কোল বিদ্রোহের বীর শহীদ বুলি মাহাতো ছিলেন।[8][9][10][11] এছাড়াও ঝগড়ু মাহাতো সহ আরোও অনেকে শহীদ হন। এরপর আসি নীল বিদ্রোহের ১৮৪৩-১৮৪৮ গোপাল মাহাতো নেতৃত্ব দেন। এরপর হুল বিদ্রোহ এর সময় গড্ডা জেলায় চানকু মাহাতো নেতৃত্ব দেন।[12][13][14] এছাড়াও সিপাহী বিদ্রোহে সুকদেব মাহাত সহ এগারোজনের একসাথে ফাঁসি হয়। এছাড়াও উড়িষ্যার মেড়ি আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন কঁকা মাহাত, রজনী মাহাত, সুচাঁদ মাহাত, কালিচরণ মাহাত, গোপিনাথ মাহাত, কালিয়া মাহাত প্রমুখ অংশগ্ৰহণ করেন।[15][16][17] এরপর কুড়মিরা অহিংস অসহযোগ আন্দোলনেও সক্রিয়ভাবে অংশগ্ৰহণ করেন। এই আন্দোলনে পাঁচজন তরতাজা কুড়মি মাহাতো যুবক শহীদ হন। এরা হলেন গোকুল মাহাতো, মোহন মাহাতো, শীতল মাহাতো, সহদেব মাহাতো, গণেশ মাহাতো।[18][19][20] এছাড়াও অনেকের জেলও হয়। মহাত্মা গান্ধীর আইন অমান্য আন্দোলনের সময় হাজারিবাগ জেলে বন্দি হয়েছিলেন গিরীস মাহাতো, নানকু চন্দ্র মাহাতো, গোবিন্দ মাহাতো, দশরথ মাহাতো, চুনারাম মাহাতো, মথন মাহাতো প্রমুখেরা।[21][22][23] এছাড়াও ভাগলপুর জেলে বন্দি হয়েছিলেন পদক মাহাতো।[24][25][26] ১৯৪১ সালে সত্যাগ্ৰহ করার জন্য সাগর মাহাত, ভজহরি মাহাত, ভীম মাহাত, সত্যকিঙ্কর মাহাতো, মোহিনী মাহাতো কারাবরণ করেন।[27] এরপর 1942 সালে সত্যকিঙ্কর মাহাতোকে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় মানবাজার থেকে কারাবরণ করতে হয়। ১৯৪২ সালে মানবাজার থানা ঘেরাও করার সময় চুনারাম মাহাতো এবং গোবিন্দ মাহাত শহীদ হন। মহিলাদের মধ্যে ভাবিনী মাহাতো উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন।[28] এছাড়াও ভারত ছাড়ো আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্ৰহণ করেছিলেন(ধানবাদ-পারবাসনিয়া)এর জগদীশ মাহাত। এছাড়াও আরো অনেকের অংশগ্ৰহণ আছে।[29][27]
কুড়মি মাহাতোদের সমাজ ব্যবস্থা ব্রাহ্মণ্য ব্যবস্থার মধ্যে কোন দিন ছিল না।[30] কুড়মি মাহাতোদের সমাজ ব্যবস্থা সাম্যবাদী গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা।[31] মাহাতোদের সমাজ ব্যবস্থা দুটি শ্রেণীতে বিভক্ত এক “গ্রাম ভিত্তিক” ও “সমাজ ভিত্তিক”। গ্রাম ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থায় একজনকে “গ্রাম্যপ্রধান” নির্বাচন করা হয়। গ্রামে যিনি সবচেয়ে জ্ঞানী, বুদ্ধিমান ও বিচক্ষনশীল তিনি নির্বাচিত প্রতিনিধি হন এবং তার পর খেকে তিনি “মাহাতোয়া” নামে সমাজে পরিচিত লাভ করেন। গ্রামের যেকোন ধরনের সমস্যা ও সমাধানে সর্বদা তার সহযোগিতা নেওয়া হয়। গ্রাম ভিত্তিক যে কোন পূজায় কর্মী তৈরী করা এবং দায়িত্ব বণ্টন করা, বিবাহ, মৃত ব্যক্তির সৎকার ও শ্রাদ্ধ কিংবা গ্রাম ভিত্তিক যে কোন কাজ তার প্রত্যক্ষ পরিচালনায় সম্পাদিত হয়। সর্বোপরি বলা যায় মাহাতোরা গ্রামের হর্তাকর্তা। কিন্তু তিনি যদি কোন অন্যায় করেন, তাহলে গ্রামের মুরুব্বীগণ তাহা মনিটরিং করেন এবং সতর্ক করেন। তিনি যদি মুরব্বীদের সতর্ক না মানেন বা তাদের কথা না শোনেন, তাহলে সবাই মিলে তার মাহাতোয়া পদটি কেড়ে নেন। তাই তিনি স্বেচ্ছাচারিতা হতে পারেন না। আর সমাজ ভিত্তিক সমাজব্যবস্থায় যে কয়টি গ্রাম নিয়ে সমাজ গঠিত হয়, সে কয়টি গ্রামের মাহাতোয়াদের মধ্যে একজনকে সমাজের প্রধান নির্বাচন করেন যাকে “সমাজপতি” বলা হয়। সমাজের যেকোন কাজে গ্রাম্যপ্রধান বা মাহাতোয়ারা “সমাজপতিকে” সহযোগিতা করেন। এখানে আমি নির্বাচন কথাটি ব্যবহার করেছি বলে মনে করবেন না যে তারা ভোটাভুটি করে নিবাচিত হন। আসলে সমাজে তাদের সবচেয়ে জ্ঞানী মানুষটাকে মেনে চলেন আর সবাই তাকে মান্য করেন বলে তিনি সমাজপতি নির্বাচিত হন। কোন কারণে কোন গ্রামে যদি ঝগড়া কিংবা কোন আপত্তিকর ঘটনা ঘটে তাহলে তারা গ্রামের মাহাতোয়া অর্থাৎ গ্রাম্যপ্রধানের কাছে বিচার চান, গ্রাম্য প্রধান যদি কোন কারণে সিদ্ধান্ত দিতে না পারে তবে সমাজের সকল গ্রাম্যপ্রধান এবং যিনি সমাজপতি হন তিনি সহ সবাই মিলে বিষয়টি মীমাংসা করেন।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]
কুড়মি মাহাতোদের ভাষা মূলত কুড়মালি। তবে বাংলাদেশের যে অঞ্চলে তারা বসবাস করে, সেই অঞ্চলের মুসলিমেরা এদের ভাষাকে মাহাতোদের নামানুসারে মাহাতো ভাষা বলে। কিন্তু আসলে তাদের ভাষার নাম কুড়মালি ভাষা। কুড়মি জনগোষ্ঠীর নাম অনুসারে এদের ভাষার নাম কুড়মালি ভাষা। নিজেদের মধ্যে এই মাহাতোরা কুড়মালি ভাষায় কথা বলে যা বিহারী ভাষাদলের অধীনস্থ একটি ইন্দো-আর্য শ্রেণীভুক্ত ভাষা। যদিও আধুুনিক গবেষকদের একাংশ গবেষক মনে করেন, মুল কুড়মালি ভাষার উৎস আর্য, দ্রাবিড়, এমনকি মুন্ডা অস্ট্রিক কোনো ভাষা পরিবারের মধ্যেই খুঁজে পাওয়া যায় না।[32] [33] পূর্ব ভারতে ব্যবহৃত এই ভাষাটি ঝাড়খণ্ড, উড়িষ্যা, বিহার এবং পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের কুড়মি মাহাতো সম্প্রদায়ের সাথে সম্পর্কিত। কুড়মালি ভাষাটি চর্যাপদে ব্যবহৃত ভাষার নিকটতম রূপ হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা দাবি করেন।[34] কুড়মালি ভাষার নিজস্ব কোন বর্ণমালা এখনো পাঠোদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। মাহাতোরা নিজ ভাষায় কথা বলতে খুবই গর্ববোধ করে তাছাড়াও তারা বাংলা এবং স্থানীয় আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতে শিখলেও সবাই বাংলায় কথা বলতে পারে না। যারা অন্য সমাজের সাথে মেশে না এরকম কিছু বয়স্ক লোকদের ক্ষেত্রে তা বেশি দেখা যায়। জন্মের পর এরা সাধারণত শিশুদের মাতৃভাষা হিসেবে কুড়মালি ভাষা শেখায় কারণ তারা পরিবারে সবাই এই ভাষায় কথা বলে। কেবল মাত্র অন্য সমাজের লোকদের সাথে কথা বলার সময় বাংলাভাষা ব্যবহার করে। এ সমাজের শিশুরা প্রথমে কুড়মালি মাহাতো ভাষায় কথা বলে পরে এরা স্কুল ও বড়দের কাছে বাংলা ভাষা শেখে। বাংলাদেশে কুড়মালি ভাষায় পূর্বে তেমন কোন লেখালেখি না থাকলেও এখন লেখালেখি হচ্ছে। এই ভাষায় প্রথম উপন্যাস রচনার প্রয়াস করেন কুড়মালি ভাষার লেখক ও গবেষক উজ্জল মাহাতো। বাংলাদেশে কুড়মালি ভাষার প্রথম উপন্যাস ‘কারাম’।[35] যা কুড়মালি ভাষা প্রচার ও প্রসারে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পরে তিনিই এই ভাষার ডিকশনারি রচনা করেন। তার প্রকাশিত 'কঁআথুয়েঁনঃ মাহাতো ডিকশনারি' নামের কুড়মালি ভাষায় রচিত একটি গ্রন্থে সংযুক্ত করা হয় ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ। এটি ভিন্ন ভাষায় ১৩ তম এবং ক্ষুদ্র নৃ তাত্ত্বিক ভাষায় প্রথম অনুবাদ।[36][35]
কুড়মি মাহাতো সম্প্রদায় প্রকৃতির পূজা করেন।[37][38][39]
"সূর্যপূজা" অর্থাৎ মাহাতোরা একে “সুরজাহি ধরম” পূজা বলে। পরিবারে পুত্র সন্তান জন্ম নিলে পুত্রের বয়স যখন এক বছর হয় তখন “সুরজাহি ধরম পুজা" করে সন্তানের মাথা মুন্ডন করানো হয়, আবার মাহাতোদের অনেক গোত্রের মধ্যে বিবাহের সময়ও সুরজাহি ধরম পুজা করার প্রচলন আছে। এসময় তারা দুই দিন উপবাস করে কেবল মাত্র গুড় দিয়ে রান্না করা ভাত খেয়ে।[40]
কুড়মি মাহাতো দের রয়েছে বারো মাসে তেরো পার্বণ।[41] কুড়মি মাহাতোদের প্রধান উৎসব হলো করম পরব, জিতিআ পরব, টুসু পরব, বাঁদনা পরব, রহিন পরব, চইত পরব/ভোগতা ঘুুরা, গরাম পূজা, বুঢ়াবাবার পুজার ইত্যাদি।
কার্তিক মাসের প্রতিপদ তিথিতে "গহাইল পূজা" পালিত হয়ে থাকে। গৃহকর্তা সকাল থেকে উপোস করে দুপুরবেলায় স্নান করে ভেজা কাপড়ে গোয়ালে বসে পূজা করেন। কিছু নীলাভ শালুক ফুল চিটে মাটির দ্বারা সদ্যনির্মিত গোলাকার পিঁড়িতে গুঁজে ও খুঁটিতে পুঁতে রাখা হয়। পূজার উপকরণ হিসেবে ধূপ, সিঁদুর, আতপ চাল, গাওয়া ঘি এবং পিঠে ব্যবহৃত হয়। গরুর গোয়ালে লাল মোরগ এবং মোষের গোয়ালে কালো মুরগি বলি দেওয়া হয়। প্রতিটি গরু ও মোষের শিঙে তেল ও সিঁদুর মাখিয়ে মাথায় ধান শিষের তৈরী মোড় পরানো হয়। এরপর গৃহকর্ত্রী নববস্ত্র পরে উলুধ্বনি দিয়ে গাভি পূজা করেন, যাকে গরু চুমা বলা হয়ে থাকে। সন্ধ্যার সময় চালের গুঁড়ো পানিয়া নামক লতার রসের সাথে মিশিয়ে উঠোনে ছিটিয়ে দেওয়া হয়। উৎসবের এই অংশকে চোখ পুরা বলা হয়ে থাকে।
মাহাতো অবিবাহিত মেয়েদের জন্য আছে আলাদা পূজা যাতে কেবল মেয়েরা অংশগ্রহণ করতে পারে। এই পূজাটির নাম হলো “করমপূজা”। করম গাছের ডাল আঙ্গিনার মাঝখানে পুঁতে পাড়ার সকল মেয়েরা নতুন নতুন পোশাক পরে কাঁসার থালায় পূজার উপকরণ নিয়ে আসে এবং আঙ্গিনায় পোতা করম গাছের ডালের চারপাশে ঘিরে বসে। তবে এই পূজা করার আগে মেয়েরা নিদিষ্ট তিথিতে বাঁশে তৈরী ছোট ছোট দুটি থালা আকৃতি ডালায় মাটি দিয়ে নানা রকম ডালের বীজ বোপন করে এবং ডালাগুলো খুব যত্ন করে রাখে। প্রতিদিন রাত্রিতে খাওয়া-দাওয়ার পর পাড়ার সব মেয়েরা একত্রিত হয়ে ডালা দুটিকে বাড়ির আঙ্গিনায় রেখে দল বেধে ডালার চারপাশে ঘুরে ঘুরে নানা রকম গীত গায় এভাবে চলে পাঁচদিন। পঞ্চম দিনে হয় পূজা। পূজা শেষ হলে মেয়েরা গীত গেয়ে ঢোলের তালে তালে ঝুমুর নাচে।
আবার বিবাহিত মহিলাদের জন্য আছে আবার ভিন্ন পূজা। এই পূজার নাম “জিতিআ পরব”। জিতাষ্টমী তিথিতে এই পূজা করা হয় বলে এই পূজার নাম মাহাতোরা দিয়েছে “জিতিআ পরব”। এই পূজায় বিবাহিত মহিলারা উপবাস থেকে সাত পাড়া ঘুরে একে অপরের বাড়ি থেকে নানা রকম ডাল জাতীয় দ্রবাদি এবং শাক চেয়ে আনে। চেয়ে আনা দ্রব্য গুলো দিয়ে তরকারি রান্না করে এবং আতব চাউল দিয়ে ভাত রান্না করে একে অপরের বাড়ি বিতরন করে। এই রান্না করা ভাত-তরকারিকে তারা পবিত্র মনে করে। এই পূজাটি ঠিক “করমপূজার” মত হয়, পার্থক্য হলো করমপূজায় অবিবাহিত মেয়েরা অংশগ্রহণ করে আর জিতিয়াপূজায় বিবাহিত মহিলারা অংশগ্রহণ করে। আরেকটি পার্থক্য হলো করমপূজায় করমগাছের ডাল ব্যবহার করা হয় এবং ভাইয়ের মঙ্গল প্রার্থনা করা হয় আর জিতিয়া পূজায় পাকৈড় গাছের ডাল ও আঁখেরগাছ (মাহাতোরা যাকে কুশাল বলে) ব্যবহার করা হয় এবং স্বামীর মঙ্গল প্রার্থনা করা হয়।
টুসু উৎসব বাংলার ঐতিহ্যবাহী এক উৎসব। টুসু উৎসব পালনের সময় পৌষ মাসের শেষ পাঁচ দিন আঁউড়ি, চাঁউড়ি, বাঁউড়ি, মকর এবং আখাইন জাতরা নামে পরিচিত। অগ্রহায়ণ মাসের সংক্রান্তির দিন থেকে সূচনা হয় এই উৎসবের। পৌষ মাসের প্রতি সন্ধ্যাবেলায় গ্রামের কুমারী মেয়েরা একটি পাত্রে চালের গুঁড়ো লাগিয়ে তাতে তুষ রাখেন। তারপর তুষের ওপর ধান, কাড়ুলি বাছুরের গোবরের মন্ড, দূর্বা ঘাস, আল চাল, আকন্দ, বাসক ফুল, কাচ ফুল, গাঁদা ফুলের মালা প্রভৃতি রেখে পাত্রটির গায়ে হলুদ রঙের টিপ লাগিয়ে পাত্রটিকে পিড়ি বা কুলুঙ্গীর ওপর স্থাপন করা হয়। এই ব্যবস্থাতেই প্রতিদিন সন্ধ্যার পরে টুসুর আরাধনা করা হয়। পৌষ মাসের প্রতি সন্ধ্যাবেলায় কুমারী মেয়েরা দলবদ্ধ হয়ে টুসুর উদ্দেশ্যে চিঁড়ে, গুড়, বাতাসা, মুড়ি, ছোলা ইত্যাদি ভোগ নিবেদন করেন। চাঁউড়ির দিনে গৃহস্থ বাড়ির মেয়েরা উঠোন গোবরমাটি দিয়ে নিকিয়ে পরিষ্কার করে চালের গুঁড়ো তৈরী করা হয়। বাঁউড়ির দিন অর্ধচন্দ্রাকৃতি, ত্রিকোণাকৃতি ও চতুষ্কোণাকৃতির পিঠে তৈরী করে তাতে চাঁছি, তিল, নারকেল বা মিষ্টি পুর দিয়ে ভর্তি করা হয়। এই পিঠে বাঁকা পিঠে বা উঁধি পিঠে ও পুর পিঠা নামে পরিচিত। বাঁউড়ির রাত দশটা থেকে টুসুর জাগরণ অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। মেয়েরা জাগরণের ঘর পরিষ্কার করে ফুল, মালা ও আলো দিয়ে সাজায়। এই রাতে কিশোরী কুমারী মেয়েরা ছাড়াও গৃহবধূ ও বয়স্কা মহিলারাও টুসু গানে অংশগ্রহণ করেন। এই রাতে টুসুর ভোগ হিসেবে নানারকম মিষ্টান্ন, ছোলাভাজা, মটরভাজা, মুড়ি, জিলিপি ইত্যাদি নিবেদন করা হয়। পৌষ সংক্রান্তি বা মকরের ভোরবেলায় মেয়েরা দলবদ্ধভাবে গান গাইতে গাইতে টুসুকে বাঁশ বা কাঠের তৈরী রঙিন কাগজে সজ্জিত চৌডল বা চতুর্দোলায় বসিয়ে নদী বা পুকুরে নিয়ে যান। সেখানে প্রত্যেক টুসু দল গান গাইতে টুসুর চৌড়ল বিসর্জন করে থাকেন। টুসু বিসর্জনের পরে মেয়েরা নদী বা পুকুরে স্নান করে নতুন বস্ত্র পরেন। ছেলেরা খড়, কাঠ, পাটকাঠি দিয়ে ম্যাড়াঘর বানিয়ে তাতে আগুন লাগান। এইভাবেই ঐতিহ্য বজায় রেখে ঝাড়খণ্ড ও পুরুলিয়ার অধিকাংশ গ্রামে পুরাতন প্রথা অনুযায়ী টুসু উৎসবে পালিত হয়। ঝাড়খণ্ডের অধিকাংশ গ্রাম ও পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, বর্ধমান , হুগলি জেলার গ্রামাঞ্চলে টুসু পরব প্রচলিত। বাংলাদেশেও মাহাতো অধুষ্যিত অনেক গ্রামে টুসু উৎসব হয়ে থাকে। বাংলার লোকসঙ্গীত ও সংস্কৃতিতে টুসু গান ও টুসু পরবের বিশেষ স্থান রয়েছে।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]
কুড়মি মাহাতো সম্প্রদায় আর্য এবং দ্রাবিড় এই দুই জনগোষ্ঠীর মিলিত অংশ।[42][43]
“কুড়মি মাহাতো” দের মধ্যে মোট ৮১টি গোত্র আছে এবং বেশিরভাগ গোত্রের দু-চারটি শাখা-প্রশাখাও আছে। যেমন: কাটিআর, বাঘবানুয়ার, নাগ, গুলিআর, সাঁখুআর, ডুমরিআর, ছঁচ মুতরুআর, পুনরিয়ার, হিঁদইআর, বংশআর, নাগটুআর, বানুয়ার, কানবিঁধা, সিংহআর, সিংঘুআর, জাল বানুয়ার, বঁসরিআর ইত্যাদি। [40][44]
মাহাতো পুরুষরা ধুতির সাথে গাভিন শার্ট পরতে বেশি পছন্দ করে,তবে এখন তারা লুঙ্গিও পরে। মেয়েরা সাধারণত শাড়ি পরে তবে তাদের শাড়ি পেচিয়ে পরার ধরন আলাদা ধরনের, এটাকে মাহাতোরা 'চিচিং চিংগঘা' বলে থাকে। অলংকার হিসেবে পুরুষরা কানে সোনার এক ধরনের গোলাকৃতির কানাসি পড়ে আর মেয়েরা হাতে পড়ে কাটাবাজু, পায়ে গড়মল, গলায় ধানবিছা, কোমরে ফিতা ও তারাহারা বা তারার মত অলংকার পড়ে। আগের দিনে সব মেয়েরা বিভিন্ন ধরনের সুদৃশ্য স্থায়ী ট্যাঁটু আকঁতো শরীরের বিভিন্ন অংগে।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]
"কুড়মি মাহাতো" জাতির মানুষদের প্রধান খাদ্য হলো ভাত, রুটি, খাসির মাংস, মুরগি মাংস, মাছ। তাছাড়া তারা পাঠার মাংস, ভেড়ার মাংস, শামুকের মাংস প্রভৃতি খায়।
কুড়মি মাহাতোরা নিজ সম্প্রদায় ছাড়া অন্য কোন সম্প্রদায়ের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয় না, তবে যদি কেউ এই নিয়মের ব্যতিক্রম করে তাহলে সমাজ থেকে তাকে একঘরে করে রাখে অর্থাৎ সমাজ তার সাথে সহযোগিতার সব সম্পর্ক ছিন্ন করে। মাহাতোরা বিয়ের ক্ষেত্রে পরিবারের মুরব্বীদের মতামতের প্রাধান্য দেয়। মাহাতো সম্প্রদায় মনে করে যদি বিবাহের ক্ষেত্রে সন্তানদের মতামতের প্রাধান্য দেওয়া হয় তাহলে সমাজে অবক্ষয় শুরু হবে, যার পরিণতি খুবই খারাপ। বিয়ের পাঁচ কিংবা তিন দিন আগে লগ্ন বাধা [যাকে কুড়মালি ভাষায় 'লগন বাঁধা' বলে] হয়, এর পর থেকে তারা নিমন্ত্রণ দিতে শুরু করে। নিমন্ত্রণের সাক্ষী হিসেবে তারা পান খাওয়ার 'সুপারি' ব্যবহার করে। সাধারণ আত্মীয়দের দুটি করে সুপারি দেয় এবং জামাই শ্রেণীর আত্মীয় স্বজনকে তারা তিনটি করে সুপারি দেয়। লগ্ন বান্ধার দিন থেকে বিয়ের দিন পর্যন্ত প্রত্যেক দিন রাত্রে পাড়ার সকল মেয়েরা বর ও কন্যার গায়ে হলুদ দিয়ে দেয়। এসময় তারা নানা রকম বিয়ের গীত গায় এবং আনন্দ করে। যেদিন বিয়ে, সেদিন তারা বরের বাড়ি থেকে দুপুর বেলা কন্যার বাড়ির উদ্দেশে রওনা হয়, তবে যাওয়ার আগে মহিলারা বরকে সাথে নিয়ে 'অমলো' খাওয়ার উদ্দেশে আমগাছের নিচে নিয়ে যায়। আম গাছের গোড়ায় দাঁড়িয়ে বরকে দেওয়া হয় কচি আমের পাতা চিবানোর জন্য। কোন রকম চিবানো হলে পাতা চিবানো অবস্থায় মুখে পানি নেয়, বরের মুখের এই পানি মহিলারা বরকে কোলে নিয়ে তার মুখ থেকে অল্প অল্প করে মুখে দেয় এবং আর্শিবাদ করে, একে 'অমলো খাওয়া' বলে। এরপর গরুর গাড়ি অথবা পাল্কিতে করে বিয়ে করার উদ্দেশে কনে বাড়ি যায়। কনে বাড়ি পৌছার সাথে সাথে পাড়ার সকল কৌতুহলি মানুষ গুলো বরকে দেখতে বরের গাড়ির কাছে ভিড় জমায়। মহিলারা কাঁসার থালার মধ্যে আতপ চাউল, দুর্বাঘাস, দিয়ালী জ্বালিয়ে বরকে আহব্বান জানায়। এসময় বরপক্ষের সাথে কন্যা পক্ষের 'নটুয়া' খেলা হয়। এই খেলায় বাঁশের তৈরী করা ঢাল ও তলোওয়ার ব্যবহার করা হয়। যারা খেলায় জেতে তাদের 'মেড়লা' উপহার দেওয়া হয়, মেড়লা হলো পিঠা ভর্তি বড় কলস। বিবাহ বাসর হিসেবে বাড়ির আঙিনায় বর্গাকৃতির একটি ঘের তৈরী করা হয় যা কে মাহাতোরা 'মাড়োয়া' বলে। এই মাড়োয়ার উপরে কাপড়ের সামিয়ানা টানানো হয় এবং মাড়োয়ার মাঝ খানে চারটি ছোট কলা গাছ রোপণ করে বিবাহ মন্ডব তৈরী করে, যার মাঝখানে চারটি কলস রাখার মত স্থান তৈরী করে। বিবাহ মন্ডবটি খুব সুন্দর করে সাজানো হয়। চারটি ছোট কলস মন্ডবের মাঝ খানে রেখে মখে চারটি দিয়ালী রেখে বাতি জ্বালানো হয়। তারপর কন্যাকে মাড়োয়ার মাঝখানে পিঁড়িতে বসিয়ে কন্যার গায়ে সোনা পিতল স্পর্শ করানো হয় একে কুড়মালি ভাষায় 'সনা পিতর' বলে। তারপর মহুয়া গাছের পাতা দিয়ে অমলো খায়। এরপর কন্যাকে বাড়ির ভিতরে নিয়ে গিয়ে সাজানো হয়। কন্যাকে সাজিয়ে বাঁশের ডালিতে বসিয়ে শুন্যি করে মাড়োয়ার মাঝখানে বরের সামনে নিয়ে আসে এসময় কন্যা তার মুখ পানপাতা দিয়ে ঢেকে রাখে। বর মন্ডপের এক পাশে দাঁড়িয়ে আর যারা কন্যাকে ডালিতে ধরে নিয়ে আসে তারা মন্ডপের চারপাশে একবার ঘুরে বরের সামনা সামনি কনেকে নিয়ে আসে, তখন বর কন্যার পানপাতা সহ হাত সরিয়ে মুখ দর্শন করে তখন এক মনোমুগ্ধকর পরিবেশ সৃষ্টি হয়, একে শুভ দৃষ্টি বলে। এভাবে শুভ দৃষ্টির সময় বর কন্যার মাথায় আড়াই পাকে আড়াই বার সিঁদুর দিয়ে দেয় শুভ দৃষ্টি সম্পন্ন করে। তারপর গ্রামের কাকি, জেঠি, দিদি, বোন সকলে মিলে বিহা গিত গেয়ে বিবাহ সমাপ্ত করে। তবে কোন কোন পরিবার বিয়ের পরের দিন সকালে আবার বাসি বিয়ে দেয়, বাসি বিয়ে এজন্য বলা হয় কারণ সকাল বেলা টিউবওয়েল বা পুকুর পাড়ে বিয়েটি অনুষ্ঠিত হয়। যেখানে কন্যা বরকে গোসল করিয়ে দেয়। প্রয়োজনীয় কাজ শেষে বিবাহ সম্পন্ন করেন। মাহাতো বিয়েতে পণ প্রথা আছে। তবে সেটা ছেলে পক্ষ মেয়ে পক্ষকে দেয়। আর পণ হিসাবে আগে কাপড় দেওয়ার চল থাকলেও পরে ২৫০-৭০০ টাকা দেওয়ার চল হয়। কাপড় দিতে হতো মেয়ের সব কাকি, মামি, নানি, দাদী ইত্যাদি সম্পর্কীয়ও লোকদের, যাতে অনেক গরিব পরিবার দিতে পারতো না।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]
হটাৎ করে কোন ব্যক্তি মারা গেলে সমাজের সবাইকে মৃত্যা সৎকারের জন্য নিমন্ত্রন করে। সবাই একত্রিত হলে মৃত ব্যক্তিকে ঠাকুর পিড়ার কাছে এনে হাঁড়ে হলুদ দেওয়া হয়। শেষ বিদায় জানানোর জন্য সবাই তার মুখ দর্শন করে এবং সবাই মিলে মৃত দেহকে শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হয়। শ্মশানে লাশকে চিতার উপর কাঠ সহ সাজানোর পর মৃত ব্যক্তির পুত্র বা উত্তরাধীকারী মুখাগ্নি করে এবং দাহ কাজ সম্পন্ন হয়। আবার কেউ কেউ মৃতা কে মাটি দিয়ে সৎকার কার্য সম্পন্ন করে। মৃতদেহ সৎকারের পর শ্মশান বন্ধুগণ সহ সবাই পুকুরে গোসল করে, যে যার ঘরে ফেরে 'আগুন কেটে' অর্থাৎ মাটি বাটখোরার মধ্যে আগুন ও সরিষা রেখে বাটখারাটি শরীরের চার পাশে ঘুরিয়ে শরীরকে পবিত্র করে, তারপর সেই বাটখারাটি মাটিতে রেখে তার উপর দিয়ে পার হয় বলে একে 'আগুনকাটা' বলে। মৃত ব্যক্তির পুত্রগণ সাদা সেলাই বিহীন কাপড় পরিধান করে। পিতার বা মাতার মৃত্যুর পর পিতার মঙ্গল কমনায় পুত্ররা বার দিন হবিস পালন করে, এই বার দিন তারা পিতা বা মাতার আত্মার মুক্তির জন্য ঐ এক কাপড় পরিধান করে থাকে অর্থাৎ তারা প্রতিদিন গোসল করার পর রোদে দাড়িয়ে গাঁয়ের কাপড় শুকায়। পবিারের অন্য সকল লোকজন এই বারদিন/দশদিন তেল, হলুদ ছাড়া তরকারি দিয়ে ভাত খায়। মৃত্যুর দিন থেকে তৃতীয় দিনের দিন মৃত ব্যক্তির উদ্দেশে করা হয় 'তিনাকামান/তৈলখইল' অর্থাৎ তিন দিনের নির্ধারিত শ্রাদ্ধ্য। মৃত ব্যক্তিকে যারা শ্মশানে নিয়ে গিয়েছিল বা যারা সাথে শ্মশানে গিয়েছিল তারা সবাই সেদিন আবার পবিত্র হওয়ার উদ্দেশ্যে হাতের নখ, মাথার চুলকাটা, গোফ-দাড়ি পরিষ্কার করে। দশ দিনের দিন করা হয় দশশ্রাদ্ধ, সমাজের সকল মানুষকে ভোজ খাওয়ানো ইত্যাদি কাজ দিনে সম্পন্ন করা হয়। এরপরের দিন থেকে সেলাই বিহীন কাপড় ছেড়ে নতুন কাপড় পরিধান করে এবং স্বাভাবিক জীবন যাপন শুরু করে পিণ্ড দানকারীগণ।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]
মাহাতোরা একত্রে মিলেমিশে থাকতে বেশি ভালোবাসে আর সে জন্যই পূর্ব থেকেই একত্রে বসবাস করে আসছে, গোষ্ঠী ভিত্তিক জীবন যাপন করে আসছে। মাহাতোরা একই গোষ্ঠী ভিত্তিক যে তাদের একজনের কোন অনুষ্ঠান হলে সবাই আমন্ত্রন পাই, পুরা সমাজ একসাথে অনুষ্ঠান পালন করে থাকে, সেটা বিয়ে হোক বা মৃত্যুর অনুষ্ঠান হোক। তারা প্রথমে বিভিন্ন পরিত্যক্ত অঞ্চলে বসবাস শুরু করেছিল, আর তাই যে সকল জমি তারা জঙ্গল সাফ করে তৈরী করে নিজেরা আবাদ করত সেগুলোর কোন দলিল ছিল না বলে স্থানীয় প্রভাবশালী মুসলমানরা তাদের জমি জবর দখল করেছে। মাহাতোদের বেশির ভাগ ঘর বাড়ি মাটির তৈরী এবং পাশাপাশি। ধারণা করা হয় বা এদের মুরব্বীদের কাছে তথ্য পাওয়া যায়, এরা যেখানে বসবাস করছে তা পূর্বে জঙ্গলে পরিপূর্ণ ছিল। তারা যখন এখানে অর্থাৎ সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ, তাড়াশে বসবাস শুরু করেছিল তখন এদের বাড়ির চারপাশের জঙ্গলে বাঘের মত হিংস্র প্রাণী রাত্রিতে দাপিয়ে বেড়াতো। এদের অনেকে বন্য প্রাণী দ্বারা আক্রান্ত ও আহত হত। তাই তারা যে আদিম অধীবাসীদের মত জীবন ধারণ করেছে তার প্রমাণ মেলে এদের অতীত কথায়। তারা কথা বলত মাহাতো কুড়মালি ভাষায় বলে স্থানীয় মুসলমানরা তাদের সাথে মিশতে চাইতো না। একদিকে ভাষাগত অসুবিধা, অন্যদিকে বন্যপ্রাণীর সাথে যুদ্ধ করে কীভাবে এরা সমাজে নিজেদেরকে খাপ খাইয়ে নিয়েছে তা মনে করলে মন আৎকে উঠতে চায়। এদের বাড়ি মুলত মাটির দেওয়াল দিয়ে তৈরী, উপরে চালা হিসেবে শন, পাট, খড়পাতা দিয়ে তৈরী করা হয়। যারা গরিব তারা বাঁশের কুনচি দিয়ে তৈরী ঘরে বাস করে। ইদানীং ধনী মাহাতোরা চালা হিসেবে টিন ব্যবহার করছে, মাঝে মাঝে ইটের তৈরী বাড়িও নজরে পড়ে। আপনি যদি কোন মাহাতো বাড়িতে বেড়াতে যান। তাহলে তারা আপনাকে সমাদর করে বসার জন্য কাঠের তৈরী পিঁড়ি দিবে অথবা বাঁশ দড়ির তৈরী খাট নতুবা খেজুর পাতার তৈরী শীতলপাটিতে বসতে দিবে, আর পা ধোঁয়ার জন্য এক লটা পানি দিবে।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]
কুড়মি মাহাতোদের প্রধান জীবিকা হলো কৃষিকাজ।[45] পুরুষ ও মহিলা উভয়েই একসাথে মাঠে কাজ করে থাকে। এছাড়াও শ্রমিক হিসাবেও অন্যের জমিতে মজুর খাটে। এটা সত্য যে মাহাতোরাই প্রথম এদেশের ভূমি বাসযোগ্য করেছে, বন জঙ্গল পরিষ্কার করে আবাদি করেছে। অথচ তাঁরাই এখন ভূমিহীন।
মাহাতোরা আগে সবাই নিরক্ষর ছিলো। কিন্তু এখন অনেক ছেলে মেয়ে পড়াশোনা করছে। তাদের ছেলেমেয়েরা বেশ মেধাবী কিন্তু অর্থনৈতিক, সামাজিক কারনে পড়াশুনার সুযোগ কম পায়। তাদের মাতৃভাষায় (কুড়মালি) প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার কোন ব্যবস্থা না থাকায় বাংলা ভাষায় শিখতে প্রথমদিকে বেশ বেগ পেতে হয় মাহাতো ছেলেমেয়েদের। অবশ্য কুড়মালি ভাষায় কোন বর্ণমালা এখনো আবিস্কৃত হয়েছে বলে জানা নাই।
মাহাতো ভাষায় প্রথম উপন্যাস 'কারাম'। মাহাতোদের ভাষা সংস্কৃতি নিয়ে উপন্যাসটি লিখেছেন কুড়মালি ভাষার লেখক ও গবেষক উজ্জল মাহাতো। তিনিই প্রথম কুড়মালি ভাষা ও সাহিত্যকে তার লেখনির মাধ্যমে তুলে ধরার প্রয়াস করেন। মাহাতো জাতিগোষ্ঠির ভাষা ও সংস্কৃতিতে উপন্যাস ‘কারাম’ সুদূরপ্রসারি প্রভাব ফেলে। সেইসাথে কুড়মালি ভাষা ও সংস্কৃতিকে পরিচিতি তথা এক ধাপ এগিয়ে দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সম্প্রতি লেখক ও গবেষক উজ্জল মাহাতো’র প্রকাশিত হয় 'কঁআথুয়েঁনঃ মাহাতো ডিকশনারি' নামের কুড়মালি ভাষায় রচিত আরো একটি গ্রন্থ। এই গ্রন্থটি ‘কুড়মালি ভাষার দলিল’ হিসাবে আক্ষা পায়। এই গ্রন্থে সংযুক্ত করা হয় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ। এটি ভিন্ন ভাষায় ১৩ তম এবং ক্ষুদ্র নৃ তাত্ত্বিক ভাষায় প্রথম অনুবাদ সহ বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতের কুড়মালি ভাষার অনুবাদ । [36]
মাহাতো ভাষায় প্রথম নাটক হটংটয়া [46]। নাটকটি রচনা ও পরিচালনা করেন দেবা মাহাতো ও রবীন্দ্র নাথ মাহাতো।[47]
কুড়মালি ভাষায় অনেক ঝুমুর, গান, বিবাহ গীত, বিভিন্ন পরব এর অনেক গীত গেয়েছেন পরেশ মাহাতো। বাংলাদেশে একমাত্র পরেশ মাহাতোই বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এই সব পারফর্ম করে থাকেন।[48]
এপ্রিল ২০২৩ থেকে জঙ্গলমহলের কুড়মি সম্প্রদায়কে তফসিলি উপজাতিভুক্ত করার দাবিতে এক আন্দোলন সংঘটিত হয়েছে। সেই উপলক্ষে ৫ এপ্রিল থেকে ৯ এপ্রিল পর্যন্ত কুড়মিরা পুরুলিয়া জেলায় এবং পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় রেল অবরোধ করেছিল[49] [50]
পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময়ে কুড়মিরা দেওয়ালে কোনোরকম রাজনৈতিক প্রচার নিষেধ করেছে।[51]
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.