Loading AI tools
শিব ও পার্বতীর একটি সম্মিলিত রূপ উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
অর্ধনারীশ্বর (সংস্কৃত: अर्धनारीश्वर, Ardhanārīśwara) হলেন হিন্দু দেবতা শিব ও তার পত্নী দেবী পার্বতীর একটি সম্মিলিত রূপ। অর্ধনারীশ্বর মূর্তিটি দেহের ঠিক মাঝখান থেকে সমানভাবে বিভাজিত অর্ধেক পুরুষ ও অর্ধেক নারীর মূর্তি রূপে বর্ণিত হন। সচরাচর এই ক্ষেত্রে ডান অংশটিই শিব রূপে চিত্রিত হন এবং এই অংশেই শিবের শাস্ত্রবর্ণিত বৈশিষ্ট্যগুলি সংযুক্ত থাকে।
প্রাচীনতম যে সব অর্ধনারীশ্বর পাওয়া গিয়েছে, সেগুলি খ্রিস্টীয় ১ম শতাব্দীতে কুষাণ যুগে নির্মিত। গুপ্ত যুগে অর্ধনারীশ্বর মূর্তিকল্পের বিবর্তন ঘটে এবং পূর্ণতা লাভ করে। পুরাণ ও মূর্তিনির্মাণ-সংক্রান্ত একাধিক শাস্ত্রে অর্ধনারীশ্বরের সঙ্গে সম্পর্কিত পৌরাণিক কাহিনি ও মূর্তিকল্পের কথা লিপিবদ্ধ হয়েছে। অর্ধনারীশ্বর মূর্তিটি শিব-পার্বতীর একটি জনপ্রিয় রূপ। সমগ্র ভারতের অধিকাংশ শিব মন্দিরের অলংকরণে এই রূপটিকে দেখা যায়। তবে নির্দিষ্টভাবে অর্ধনারীশ্বরই প্রধান দেবতা রূপে পূজিত হন, এমন মন্দিরের সংখ্যা খুবই কম।
অর্ধনারীশ্বর হলেন ব্রহ্মাণ্ডের পুরুষ ও নারী শক্তির (পুরুষ ও প্রকৃতি) সংশ্লেষণের প্রতীক। ঈশ্বরের নারীসত্তা শক্তি যে তার পুরুষসত্তা শিবের থেকে অবিচ্ছেদ্য, তাও এই প্রতীকটির মাধ্যমেই বর্ণিত হয়েছে। এই দুই সত্তার মিলনেই সকল সৃষ্টির মূল নিহিত রয়েছে। অপর একটি মতে, অর্ধনারীশ্বর রূপটি শিবের সর্বব্যাপী প্রকৃতির প্রতীক।
অর্ধনারীশ্বর নামটির অর্থ "অর্ধেক নারী যে ঈশ্বর"। তিনি অর্ধনরনারী ("অর্ধেক পুরুষ-নারী"), অর্ধনারীশ ("অর্ধেক নারী যে ঈশ্বর"), অর্ধনারীনটেশ্বর ("নৃত্যের ঈশ্বর যিনি অর্ধেক নারী"),[1][2] পরাঙ্গদ,[3] নরনারী ("পুরুষ-নারী"), আম্মিয়াপ্পান (একটি তামিল নাম যার অর্থ "মাতা-পিতা"),[4] ও অর্ধযুবতীশ্বর (অসম রাজ্যে, "অর্ধেক যুবতী যে ঈশ্বর") নামেও পরিচিত। গুপ্ত-যুগীয় কবি পুষ্পদন্ত তার শিবমহিম্নস্তোত্রে এই রূপটিকে "দেহার্ধঘটনা" বলে উল্লেখ করেছিলেন। উক্ত শব্দবন্ধটির অর্থ "আপনি ও তিনি (দেবী পার্বতী) একই দেহের দুই অর্ধাংশ"। বৃহৎ সংহিতা গ্রন্থের টীকায় উৎপল এই রূপটিকে অর্ধগৌরীশ্বর ("অর্ধেক গৌরী যে ঈশ্বর"; এখানে গৌরী শব্দটি দেবী পার্বতীরই বৈশিষ্ট্যবাচক একটি নাম) নামে উল্লেখ করা হয়েছে।[5] বিষ্ণুধর্মোত্তর পুরাণে এই রূপটি শুধুমাত্র গৌরীশ্বর ("গৌরীর অধিপতি বা স্বামী") নামে উল্লিখিত হয়েছে।
অর্ধনারীশ্বর ধারণাটি সম্ভবত বৈদিক সাহিত্যের যুগ্মমূর্তি যম-যমী,[6][7] আদি সৃষ্টিকর্তা বিশ্বরূপ বা প্রজাপতি ও অগ্নির বৈদিক বর্ণনা “যিনি একাধারে বৃষ ও গাভী”, বৃহদারণ্যক উপনিষদ্ গ্রন্থে উভলিঙ্গ বিশ্বমানব পুরুষ রূপী আত্মা[6] এবং প্রাচীন গ্রিসের হার্মাফ্রোডিটাস ও ফ্রিজিয়ান আগডিস্টিস অঙ্ক্রান্ত পুরাণকথা থেকে অণুপ্রাণিত। বৃহদারণ্যক উপনিষদ্ গ্রন্থে বলা হয়েছে, পুরুষ নিজেকে দুই ভাগে ভাগ করেছেন। একটি ভাগ পুরুষ ও অপর ভাগ নারী। এই দুই ভাগ মিলিত হয়ে সকল প্রাণ সৃষ্টি করেছেন। অর্ধনারীশ্বর কাহিনির মূল বিষয়বস্তু।[8] শ্বেতাশ্বেতর উপনিষদ্ পৌরাণিক অর্ধনারীশ্বর ধারণার বীজ বপন করেছে। এই গ্রন্থ মতে, পৌরাণিক শিবের আদি সত্ত্বা রুদ্র সব কিছুর সৃষ্টিকর্তা। তিনিই সাংখ্য দর্শনের পুরুষ (পুরুষ তত্ত্ব) ও প্রকৃতির মূল। এই ধারণা অনুসারে, রুদ্র একাধারে পুরুষ ও নারী। এই ধারণা থেকে রুদ্রের উভলিঙ্গ সত্ত্বার একটি আভাস পাওয়া যায়।[9]
অর্ধনারীশ্বর ধারণাটির উদ্ভব ঘটেছিল যুগপৎ কুষাণ ও গ্রিক সংস্কৃতিতে। কুষাণ যুগে (৩০-৩৭৫ খ্রিষ্টাব্দ) অর্ধনারীশ্বরের মূর্তিতত্ত্বটি বিবর্তিত হয়। কিন্তু গুপ্ত যুগেই (৩২০-৬০০ খ্রিষ্টাব্দ) এই মূর্তিতত্ত্ব পূর্ণাঙ্গ রূপ পরিগ্রহ করে।[10][11] কুষাণ যুগের (খ্রিস্টীয় ১ম শতাব্দীর মধ্যভাগের) একটি কেন্দ্রস্তম্ভ এখন মথুরা সংগ্রহালয়ে রক্ষিত আছে। এই স্তম্ভে একটি অর্ধনারী-অর্ধপুরুষ মূর্তি খোদিত রয়েছে। সেই সঙ্গে আরও তিনটি মূর্তিও খোদিত আছে। এই তিনটি মূর্তি বিষ্ণু, গজলক্ষ্মী ও কুবেরের মূর্তি হিসেবে চিহ্নিত করা গিয়েছে।[7][12] অর্ধনারী-অর্ধপুরুষ মূর্তিটির পুরুষার্ধটি ‘উর্ধলিঙ্গ’ এবং এই অংশে অভয় মুদ্রা প্রদর্শিত হয়েছে। অন্যদিকে নারী-অর্ধটির স্তনটি সুডৌল এবং এই অংশে মূর্তির হাতে একটি দর্পণ দেখা যায়। এটিই অর্ধনারীশ্বর মূর্তির সর্বজনস্বীকৃত প্রাচীনতম নিদর্শন।[7] মথুরা সংগ্রহালয়ে রাজঘাট থেকে প্রাপ্ত একটি প্রাচীন অর্ধনারীশ্বর মূর্তির মস্তকভাগও রক্ষিত আছে। এই মস্তকের পুরুষার্ধটির মাথায় নরকরোটি সংবলিত জটা অর্ধচন্দ্র এবং বাঁদিকের নারী-অর্ধে সুবিন্যস্ত ও পুষ্পশোভিত কেশ এবং কানে পত্রকুণ্ডল বা দুল দেখা যায়। এই মুখে একটিই তৃতীয় নয়ন রয়েছে। অধুনা বিহার রাজ্যের বৈশালী থেকে প্রাপ্ত একটি টেরাকোটার সিলমোহরে অর্ধনারী-অর্ধপুরুষ মূর্তির চিত্র খোদিত রয়েছে।[7] কুষাণ যুগের অর্ধনারীশ্বর মূর্তিগুলি সাধারণ দ্বিভূজ মূর্তি। তবে পরবর্তীকালে রচিত ধর্মগ্রন্থ ও নির্মিত ভাস্কর্যগুলিতে অর্ধনারীশ্বরের মূর্তিতত্ত্বটি আরও জটিল আকার নেয়।
গ্রিক লেখক স্টোবিয়াস(৫০০ খ্রিষ্টাব্দ) বার্ডাসেনেসের (১৫৪-২২২ খ্রিষ্টাব্দ) রচনা থেকে অর্ধনারীশ্বরের কথা উদ্ধৃত করেছেন। বার্ডাসেনেস এলাগাবালাসের (এমেসার অ্যান্টোনিয়াস) (২১৮-২২ খ্রিষ্টাব্দ) রাজত্বকালে সিরিয়ায় একটি ভারতীয় দূতাবাসে সফরে এসে অর্ধনারীশ্বরের কথা জানতে পারেন।[6][10] তক্ষশীলায় খননকার্য চালিয়ে শক-পার্থিয়ান যুগের টেরাকোটার একটি উভলিঙ্গ আবক্ষ মূর্তি পাওয়া গিয়েছে। এই মূর্তিতে নারীর স্তনবিশিষ্ট এক দাড়িওয়ালা পুরুষকে দেখা যায়।[10][11]
অর্ধনারীশ্বর মূর্তিটি হিন্দুধর্মের দুটি প্রধান শাখা শৈবধর্ম ও শাক্তধর্মকে সংযুক্ত করার একটি প্রয়াস রূপে ব্যাখ্যা করা হয়। উল্লেখ্য, শৈবধর্ম শিব-উপাসনা কেন্দ্রিক এবং শাক্তধর্ম শক্তি-উপাসনা কেন্দ্রিক সম্প্রদায়। একইভাবে হরিহর মূর্তির দ্বারা শিব এবং বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের সর্বোচ্চ দেবতা বিষ্ণুকে একীভূত করা হয়েছে।[3][13][14][15]
১৬শ শতাব্দীর মূর্তিতত্ত্ব সংক্রান্ত গ্রন্থ শিল্পরত্ন, মৎস্যপুরাণ এবং অংশুমাদভেদাগম, কামিকাগম, সুপ্রেদাগম ও কারণাগম প্রভৃতি আগম শাস্ত্রে অর্ধনারীশ্বরের মূর্তিতত্ত্বটি বর্ণিত হয়েছে। উল্লেখ্য, উপরিউক্ত আগমগুলি প্রধানত দক্ষিণ ভারতে রচিত হয়।[16] শরীরের ডানদিকের ভাগটি প্রধান। এই ভাগটি সাধারণত শিবের। বাঁদিকের ভাগটি পার্বতীর। কোনো কোনো দুর্লভ বিবরণ অনুসারে, ডানদিকের প্রধান অংশটি পার্বতীর। এই বিবরণগুলি শাক্ত সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত।[17] অর্ধনারীশ্বর মূর্তি সাধারণত চতুর্ভূজ, ত্রিভুজ বা দ্বিভূজ। কোনো কোনো দোষ্প্রাপ্য অষ্টভূজ মূর্তিও পাওয়া গিয়েছে। ত্রিভুজ মূর্তিগুলির ক্ষেত্রে পার্বতীর অংশে একটি মাত্র হাত রয়েছে। এর মাধ্যমে এই মূর্তিতে পার্বতীর ভূমিকা হ্রাসের আভাস দেওয়া হয়েছে।
অর্ধনারীশ্বর মূর্তির পুরুষার্ধটির মস্তকে ‘জটামুকুট’ (মুকুটের আকারে জটা) দেখা যায়। এই জটামুকুটে শোভা পায় একটি অর্ধচন্দ্র। কোনো কোনো মূর্তিতে জটামুকুটে থাকে সর্প এবং সেই জটা থেকে দেবী গঙ্গাকে নির্গত হতে দেখা যায়। ডান কানে থাকে একটি ‘নক্রকুণ্ডল’, ‘সর্পকুণ্ডল’ (সাপের দুল) বা সাধারণ কুণ্ডল বা কানের দুল। কোনো কোনো মূর্তিতে নারী-অর্ধের তৃতীয় চক্ষুটির চেয়ে পুরুষার্ধের তৃতীয় চক্ষুটি ছোটো এবং পুরুষার্ধে দেখা যায় একটি অর্ধেক গোঁফ।[18][19] শাস্ত্রে পুরুষার্ধে একটি অর্ধ তৃতীয় নেত্রের উল্লেখ পাওয়া যায়। কোনো কোনো বর্ণনা অনুসারে, অর্ধনারীশ্বরের কপালের মধ্যস্থলে একটি পূর্ণাঙ্গ তৃতীয় নেত্রটি মাঝখান থেকে দুই ভাগে বিভক্ত। পার্বতীর সিন্দূর-বিন্দুর উপরে বা নিচে একটি অর্ধ নেত্রের উল্লেখও রয়েছে।[18][20] মাথার পিছনে একটি একক ডিম্বাকার জ্যোতিশ্চক্রও (‘প্রভামণ্ডল’ বা ‘প্রভাবলি’) দেখা যায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এই জ্যোতিশ্চক্রটি দিক অনুসারে ভিন্ন প্রকার।[20]
চতুর্ভূজ মূর্তিগুলিতে ডান হাতে থাকে একটি ‘পরশু’ (কুঠার) এবং অন্য হাতটি ‘অভয় মুদ্রা’র ভঙ্গিতে থাকে। কোনো কোনো মূর্তিতে দেখা যায়, ডান হাতদুটির একটি সামান্য বেঁকে শিবের বাহন নন্দীর উপর স্থাপিত এবং অন্য হাতে দেখা যায় ‘অভয় মুদ্রা’। অন্য একটি ধরনে দেখা যায়, ডান হাতে একটি ত্রিশূল ও অপর হাতটিতে ‘বরমুদ্রা’। অপর একটি শাস্ত্রের বর্ণনা অনুসারে, ডান হাত দুটিতে থাকে ত্রিশূল ও অক্ষমালা। দ্বিভূজ মূর্তিতে ডান হাতে থাকে ‘কপাল’ বা নরকরোটির পাত্র অথবা বরমুদ্রা।[18][19] কোনো কোনো মূর্তিতে শুধুমাত্র নরকরোটিও দেখা যায়। বাদামী ভাস্কর্যে চতুর্ভূজ মূর্তিতে দেখা যায়, অর্ধনারীশ্বর বাঁ হাত ও ডান হাতের সাহায্যে বীণা বাজাচ্ছেন। তার অপর ডান হাতে একটি পরশু এবং নারী-অর্ধের হাতে একটি পদ্ম রয়েছে।[21]
অর্ধনারীশ্বর মূর্তির শিব-অর্ধে দেখা যায় চ্যাপ্টা পুরুষালি বক্ষস্থল, ঋজু আনুভূমিক বক্ষস্থল, প্রসারিত কাঁধ, প্রসারিত কোমর ও পুরুষোচিত উরুদেশ।[19] তার বুকে ঝোলে একটি যজ্ঞোপবীত। কোথাও কোথাও এই যজ্ঞোপবীতটি হল ‘নাগযজ্ঞোপবীত’ (সর্পনির্মিত যজ্ঞোপবীত) বা মুক্তো বা মণির মালা। কোথাও কোথাও যজ্ঞোপবীতটি দেহের মধ্যভাগটিকে পুরুষ ও নারী-অর্ধে বিভক্ত করেছে। পুরুষার্ধে শিবের মূর্তিতত্ত্ব অনুসারে, সর্পভূষণ সহ নানা অলংকার দেখা যায়।[18][20]
কোনো কোনো উত্তর ভারতীয় মূর্তিতে[20] পুরুষার্ধটির পুরুষাঙ্গটি উন্নত। এটিকে বলা হয় ‘উর্ধলিঙ্গ’ বা ‘উর্ধরেতা’। কোনো কোনো মূর্তিতে পুরুষাঙ্গটি অর্ধেক এবং ডিম্বাশয়ও একটি। যদিও দক্ষিণ ভারতে এমন কোনো মূর্তি পাওয়া যায়নি।[20] মূর্তির কটিদেশে সাধারণত কাপড় (কোনো কোনো ক্ষেত্রে রেশম বা সূতির ধুতি অথবা বাঘ বা হরিণের চামড়া) থাকে। কাপড়টি হাঁটু অবধি ঝোলে। কোমরে থাকে ‘সর্পমেখলা’ বা সাপের তৈরি কোমরবন্ধনী বা অন্য অলংকার। ডান পাটি সামান্য বাঁকা। এটি অনেক ক্ষেত্রে ‘পদ্মপীঠ’ বা পদ্মের বেদীর উপর স্থাপিত অবস্থায় দেখা যায়। সমগ্র ডান-ভাগটি ভষ্মমাখা ও ভয়ংকর। এটি লাল বা সোনালি বা প্রবালের রঙের। যদিও এই ধরনের মূর্তিগুলির বিবরণ দুর্লভ।[18][20]
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.