Loading AI tools
ধর্মীয় ও জাতিগত নিধন উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
রোহিঙ্গা গণহত্যা বা ২০১৬-১৭ সালে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নির্যাতন বা নিপীড়ন বলতে মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনী এবং পুলিশের দ্বারা দেশটির উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা মুসলমানদের উপর চলমান সামরিক অভিযানকে বুঝানো হয়। এটি ২০১২ সালের অক্টোবরে অজ্ঞাত বিদ্রোহীর দ্বারা বার্মা সীমান্তে হামলার একটি প্রতিক্রিয়া ছিল। বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গণধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ ও শিশুহত্যাসহ অত্যধিক মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ অভিযুক্ত হয়েছে।
তারিখ | ৯ অক্টোবর ২০১৬ – ২০১৭ |
---|---|
অবস্থান | রাখাইন রাজ্য, মিয়ানমার |
ধরন | |
বিষয়বস্তু | Military crackdown by Myanmar's armed forces and police on Rohingya Muslims |
কারণ |
|
অংশগ্রহণকারী |
|
নিহত | ২,০০০+[7][8] |
প্রকাশনা নিষেধাজ্ঞা | Media access in northern Rakhine State heavily restricted by the Burmese government. |
রোহিঙ্গা জনগণের ওপর সামরিক অভিযান জাতিসংঘ (যা "মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ" হিসেবে চিহ্নিত), মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, মার্কিন ডিপার্টমেন্ট অফ স্টেট, প্রতিবেশী বাংলাদেশ সরকার এবং মালয়েশিয়ার সরকার থেকে সমালোচনার জন্ম দিয়েছে (যেখানে অনেক রোহিঙ্গা শরণার্থী পালিয়ে গেছে)। মিয়ানমারের সাবেক সরকার প্রধান, অং সান সু চি, বিশেষ করে তার নিষ্ক্রিয়তা ও নীরবতার জন্য এবং এই সামরিক অপব্যবহার প্রতিরোধে বলতে গেলে কোন কাজ না করার জন্য সমালোচিত হয়েছেন।
রোহিঙ্গা জনগণদেরকে "পৃথিবীতে সবচেয়ে কম প্রয়োজন বোধ করা"[9] এবং "সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত সংখ্যালঘুদের মধ্যে অন্যতম" বর্ণনা করা হয়েছে।[10] রোহিঙ্গাদের মুক্তভাবে চলাফেরা এবং উচ্চশিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে।[11] বার্মিজ জাতীয়তা আইন প্রণীত হওয়ার পর থেকে তাদের বার্মিজ নাগরিকত্ব প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। [12] তারা কোনও সরকারি অনুমতি ছাড়া ভ্রমণ করতে পারবে না এবং পূর্বে তাদের দুই সন্তানের বেশি না নেয়ার প্রতিশ্রুতিতে স্বাক্ষর করতে হত, যদিও এই আইনটি কঠোরভাবে প্রয়োগ করা হয়নি। তারা রুটিনমাফিক জবরদস্তিমূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে নিগৃহীত; সাধারণত রোহিঙ্গা পুরুষদের সপ্তাহে এক দিন সামরিক ও সরকারি প্রকল্পে কাজ করতে হবে এবং এক রাতের জন্য প্রহরীর দায়িত্ব পালন করতে হবে। রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের অন্যত্র থেকে বৌদ্ধ বাসিন্দাদেরকে দেয়ার জন্য প্রচুর পরিমাণে আবাদি জমি হারিয়েছে।[13][12]
মিয়ানমার, বার্মা নামেও পরিচিত, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি দেশ, যার পশ্চিমে বঙ্গোপসাগর, বাংলাদেশ ও ভারত এবং পূর্বদিকে চীন, লাওস ও থাইল্যান্ডের সীমানা দ্বারা পরিবেষ্টিত। সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সম্প্রতি মিয়ানমারে উত্থাপিত গণতন্ত্র, ২০১৫ সালের ৮ নভেম্বর, স্বাধীন নির্বাচন করার অনুমতি দেয়, যা নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী অং সান সু চিকে গৃহবন্দী থাকার পর ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করেছে ।[14]
মিয়ানমার মূলত বৌদ্ধধর্মাবলম্বী (জনসংখ্যার ৮৮% -৯০%), ভিন্ন বিশ্বাসী কিছু সংখ্যালঘুসহ, সংখ্যালঘুদের মধ্যে মুসলমান ৪%, যাদের বেশিরভাগকেই ভোট দিতে নিষিদ্ধ করে রাখা হয়েছে এবং নাগরিকত্ব প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে (কামান জাতি ব্যতীত)। মিয়ানমার তার সংখ্যাগরিষ্ঠ বমা জাতি (বা বর্মণ) (৬৮%) দ্বারা প্রভাবিত, যাদের অধিকাংশই বৌদ্ধ। [14][15]
বেশ কয়েকটি জাতিগত গোষ্ঠী সরকার কর্তৃক বৈষম্য, অপব্যবহার এবং অবহেলার শিকার; পশ্চিমাঞ্চলীয় রাখাইন রাজ্যের উপকূল, এটি মূলত বৌদ্ধ রাখাইন (৪%, প্রায় ২ মিলিয়ন মানুষ) এবং মুসলিম রোহিঙ্গা (২%, প্রায় ১০ মিলিয়ন মানুষ) অধ্যুষিত, যারা সরকারের হাতে নিপীড়নের শিকার। জাতীয়তাবাদী বৌদ্ধরা প্রায়ই রোহিঙ্গাদের উদ্দেশ্য করে, বৌদ্ধ ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে উত্তেজনা ও সহিংসতা সৃষ্টি করেছে।[16] রোহিঙ্গারা তাদের নিজস্ব ভাষা এবং সংস্কৃতি সহকারে একটি স্বতন্ত্র জাতি, তবে তারা রাখাইন রাজ্যের সাথে দীর্ঘ ঐতিহাসিক সম্পর্কের দাবিদার।[14][15]
রোহিঙ্গারা নিজেদেরকে আরব ব্যবসায়ীদের বংশধর হিসেবে বর্ণনা করে, যারা বহু প্রজন্ম আগে এই অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেছিল।[17] পণ্ডিতরা বলেন যে তারা ১৫ শতাব্দী থেকে এই অঞ্চলে অবস্থান করছে।[18] তবে, মিয়ানমার সরকার তাদের নাগরিকত্ব অস্বীকার করেছে, যা তাদেরকে বাংলাদেশের অবৈধ অভিবাসী হিসেবে বর্ণনা করেছে।[17]
বর্তমান সময়কার, মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমানদের উপর অত্যাচার ১৯৭০-এর দশক থেকে চলে আসছে।[19] তখন থেকে রোহিঙ্গাদের নিয়মিতভাবে সরকার ও জাতীয়তাবাদী বৌদ্ধদের দ্বারা নিপীড়নের লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে।[16] মিয়ানমারের অতীতের সামরিক শাসকদের দ্বারা প্রায়ই বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠী শোষিত হয়েছে যা তাদের মাঝে চাপা উত্তেজনার সৃষ্টি করেছে।[17]
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতে, ১৯৭৮ সাল থেকে রোহিঙ্গারা তৎকালীন সামরিক একনায়কতন্ত্রের অধীনে মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়ে আসছে। এর ফলে অনেকে প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশে পালিয়ে গেছে।[20] ২০০৫ সালে, জাতিসংঘের শরণার্থীদের জন্য হাই কমিশনার বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের সহায়তা দিয়েছিলেন, কিন্তু শরণার্থী শিবিরে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ এই প্রচেষ্টাকে হুমকিতে ফেলেছে।[21] ২০১৫-তে, ২০১২ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পর ১,৪০,০০০ রোহিঙ্গা আইডিপি ক্যাম্পে অবস্থান করে।[22]
অতি সাম্প্রতিক সহিংসতার আগে, ১৭ মার্চ ২০১৬-তে “এট্রোসিটিজ প্রিভেনশন রিপোর্টে”,[23] মার্কিন পররাষ্ট্র বিভাগের সারসংক্ষেপ:
“ |
রাখাইন ও রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদী ঐতিহাসিক উত্তেজনা সংমিশ্রন, সামাজিক-রাজনৈতিক সংঘাত, আর্থ-সামাজিক অবনয়ন এবং বার্মার সরকার দ্বারা রাখাইন ও রোহিঙ্গা উভয়েই দীর্ঘস্থায়ী প্রান্তিককরণ, রাখাইন রাজ্যের অবস্থা গুরুতর করে তুলেছে। বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে দারিদ্র্যতার হার সর্বোচ্চ (৭৮ শতাংশ) এবং দেশটির সবথেকে দরিদ্র রাজ্য। একদিকে যেমন কেন্দ্রীয় সরকারের দ্বারা বিনিয়োগের অভাবের ফলে জীর্ণশীর্ণ অবকাঠামো এবং নিকৃষ্ট সামাজিক সেবায় পরিণত করেছে, অপরদিকে আইনশৃঙ্খলার অযোগ্যতাগুলি নিরাপত্তাহীনতার দিকে ধাবিত করছে।[23] রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের সদস্যরা বিশেষ করে বার্মার সরকারের নির্যাতন, বেআইনি গ্রেপ্তার ও আটক, চলাফেরায় সীমাবদ্ধতা, ধর্মীয় অনুশীলনের ওপর ততা ধর্ম পালনে নিষেধাজ্ঞা, কর্মসংস্থান এবং বৈষম্যমূলক সামাজিক সেবা সহ সহিংসতার মুখোমুখি হয়। ২০১২ সালে, অন্তর্বর্তীকালীন দ্বন্দ্বের ফলে প্রায় ২০০ রোহিঙ্গা মারা যায় এবং ১,৪০,০০০ জন লোক বাস্তুচ্যুত হয়। ২০১৩-২০১৫ জুড়ে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সহিংসতার বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটতে থাকে।[23] |
” |
মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় রিপোর্ট অনুযায়ী, ৯ই অক্টোবর, ২০১২ সালে রাখাইন রাজ্যে সশস্ত্র ব্যক্তি কতিপয় সীমান্ত পুলিশ পোস্টে হামলা করে, নয়জন পুলিশ কর্মকর্তাকে মৃত অবস্থায় ফেলে রাখে।[24] অস্ত্র এবং গোলাবারুদও লুট করা হয়। মূলত মংডু শহরে এই হামলাটি ঘটে।[25] নব্য গঠিত একটি বিদ্রোহী দল, হারাকাহ আল-ইয়াকিন, এক সপ্তাহ পর দায় স্বীকার করে।[26] [27][28]
বিদ্রোহী এবং সামরিক বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষ ২০১৭ পর্যন্ত চলতে থাকে।[27][28]
পুলিশ-ক্যাম্পের ঘটনার পর, মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী উত্তর রাখাইন রাজ্যের গ্রামগুলিতে একটি বড় ধরনের অভিযান শুরু করে। প্রাথমিক অপারেশনে, ডজন ডজন মানুষ নিহত হয় এবং অনেককে গ্রেফতার করা হয়।[29] অভিযান অব্যাহত থাকার ফলে, হতাহতের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। নির্বিচারে গ্রেফতার, বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গণধর্ষণ, বেসামরিক লোকদের বিরুদ্ধে নৃশংসতা এবং লুটপাট চালানো হয়।[30][31][32] সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, শত শত রোহিঙ্গা ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে নিহত হয়েছে এবং বাংলাদেশের আশপাশের এলাকায় শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নেওয়ার জন্য মিয়ানমার থেকে অনেকে পালিয়ে গেছে।[16][29][33][34][35]
নভেম্বরের শেষের দিকে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মুক্তি পাওয়া স্যাটেলাইট ইমেজগুলি দেখিয়েছে যে নিরাপত্তা বাহিনীর দ্বারা প্রায় ১,২৫০টি রোহিঙ্গা ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে।[31][35] গণমাধ্যম ও মানবাধিকার সংগঠনগুলি মিয়ানমারের সামরিক সৈন্যদের দ্বারা প্রায়ই গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ দায়ের করে আসছে।[29][31] নভেম্বরে একটি ঘটনার সময়ে, মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী গ্রামবাসীদের গুলি করে হত্যা করার জন্য “অ্যাটাক হেলিকপ্টার” ব্যবহার করে।[16][30][34] নভেম্বর ২০১৬-তেও, মিয়ানমার তখনও মিডিয়া ও মানবাধিকার সংগঠনকে নিপীড়িত এলাকায় প্রবেশ করতে অনুমতি দেয়নি।[16] ফলস্বরূপ, বেসামরিক হতাহতের সঠিক পরিচয় অজানা ছিল। এজন্য রাখাইন রাজ্যকে "তথ্যের কালো-গর্ত বা কৃষ্ণগহ্বর" নামে উল্লেখ করা হয়।[31]
যারা মিয়ানমার থেকে পালিয়ে গেছে তাদের ভাষ্যমতে- নারীরা গণধর্ষণের শিকার হয়েছে, পুরুষদেরকে হত্যা করেছে, ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে এবং শিশুদের জ্বলন্ত বাড়িঘরে নিক্ষেপ করা হয়েছে।[36][37][38] মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী প্রায়ই নাফ নদীতে রোহিঙ্গা শরণার্থী বহনকারী নৌযানকে গুলি করে হত্যা করে।[39]
৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ সালে, জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনার (ওএইচসিএইচআর) এর কার্যালয় ২০০-এর অধিক রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যার মধ্যে উল্লেখ করা হয় যে গণধর্ষণ, গণহত্যা, এবং শিশু-হত্যা সহ নৃশংসতা চালানো হয়েছে।[40][41][42] সাক্ষাৎকারীদের প্রায় অর্ধেকেই বলেছে তাদের পরিবারের সদস্যদের হত্যা করা হয়েছে।[40] নারীদের অর্ধেকই সাক্ষাৎকার দিয়েছে যে তারা ধর্ষিত হয়েছে বা তাদের যৌন হয়রানি করেছে: প্রতিবেদনটি যৌন সহিংসতাকে "বিশাল ও নিয়মানুগ" হিসেবে বর্ণনা করেছে।[41] রোহিঙ্গাদের অধিকারে থাকা বা তাদের দ্বারা ব্যবহৃত "আশ্রম, বিদ্যালয়, বাজার, দোকান এবং মসজিদ" সেনাবাহিনী ও পুলিশের দ্বারা পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে।[40][43][44]
২০১৭ সালের মার্চ মাসে, রয়টার্স একটি “পুলিশ নথিপত্র” খুঁজে পায়। যেখানে উল্লেখ ছিল ৯ অক্টোবর ২০১৬ থেকে ৪২৩জন রোহিঙ্গাকে আটক করার তালিকা, যার মধ্যে ১৩জনই শিশু ছিল, যাদের সর্বকনিষ্ঠের বয়স ছিল দশ বছর। মংডুতে দুই পুলিশ ক্যাপ্টেন নথিপত্রের সত্যতা যাচাই করে গ্রেফতারকৃতদের সত্যতা যাচাই করে, যাদের একজন বলে, "আক্রমণকারীদের যারা সহযোগিতা করেছে, আমরা পুলিশদেরকে তাদের গ্রেপ্তার করতে হয়, ছেলেমেয়েদের না, তবে তারা দোষী হবে কিনা আদালত তা নির্ধারণ করবে; আমরা সিদ্ধান্ত নেয়ার কেউ না।" মিয়ানমার পুলিশ দাবি করেছে যে শিশুদের জিজ্ঞাসাবাদে তাদের অভিযুক্ত অপরাধ স্বীকার করেছে এবং জিজ্ঞাসাবাদে তাদের পিটুনি বা চাপ দেওয়া হয়নি। আটককৃতদের গড় বয়স ৩৪ বছর, সর্বকনিষ্ঠের ১০ বছর এবং বয়োজ্যেষ্ঠের ৭৫ বছর।[45][46] ২৫শে আগস্ট ২০১৭ সালে, রোহিঙ্গা বিদ্রোহীরা সরকারি বাহিনীর উপর আক্রমণ চালায়, এর প্রতিক্রিয়ায় সরকার সাধারণ জনগণের উপর আক্রমণ করে হাজার হাজার রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে পালিয়ে যেতে বাধ্য করে।[47]
জানুয়ারী ২০১৭ সালের সহিংসতার কারণে আনুমানিক ৯২,০০০ রোহিঙ্গা বাস্তুচ্যুত হয়েছে;[48] অক্টোবর ২০১৬ থেকে জানুয়ারি ২০১৭ সালের মধ্যে মিয়ানমার থেকে প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশে প্রায় ৬৫,০০০ রোহিঙ্গা পালিয়ে যায়,[49][50] অপরদিকে আরো ২৩,০০০ লোক অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হয়।[48]
দশ হাজার মুসলিম রোহিঙ্গা, অনেকে স্থলপথে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে চলে আসে, এবং অনেকে সমুদ্রপথে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া এবং থাইল্যান্ডে, মিয়ানমার থেকে পালিয়ে যায়।[51]
২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে, বাংলাদেশ সরকার ঘোষণা দেয় যে, টেঙ্গার চর বঙ্গোপসাগরে একটি পাললিক দ্বীপে, নতুন শরণার্থীদের সাথে পূর্বথেকে অবস্থানরত ২২,০০০ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের স্থানান্তর করার পরিকল্পনা নিয়েছে।[49][52] মেঘনা নদীর ধূলাবৃত পলল থেকে তৈরি দ্বীপটি ২০০৭ সালে প্রথম আবির্ভূত হয়েছিল।[49][52] নিকটতম বাসভূমি, হাতিয়া দ্বীপ প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে।[49] সংবাদ সংস্থাগুলি একটি আঞ্চলিক আধিকারিক উদ্ধৃতিতে এই পরিকল্পনাকে "ভয়ানক" হিসেবে বর্ণনা করেছে।[52] এই পদক্ষেপটি এক চতুর্থাংশের মতো যথেষ্ট বিরোধিতার সম্মুখীন হয়েছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলি এটাকে পরিকল্পিতভাবে জোরপূর্বক স্থানান্তর হিসাবে বর্ণনা করেছে।[49][52] উপরন্তু, দ্বীপে বসবাসের অবস্থার উপর উদ্বেগ দেখা দিয়েছে, যা নিম্নভূমি এবং বন্যাপ্রবণ।[49][52] দ্বীপটিকে "কেবলমাত্র শীতকালে প্রবেশযোগ্য এবং জলদস্যুদের একটি স্বর্গরাজ্য" হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।[40][52] বর্তমানে বসবাসরত রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্প থেকে এটি নয় ঘণ্টা দূরে অবস্থিত।[49][52]
রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নেওয়ার কারণে এখন পর্যন্ত ৬০০০ একর বন ধ্বংস হয়ে গেছে, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৫৪৯.৬০ কোটি টাকা। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রায় ১২ জন রোহিঙ্গা হাতির পদতলে পিষ্ট হয়ে মৃত্যুবরণ করেছে।[53]
২০১৬ সালের নভেম্বরে রোহিঙ্গা মুসলমানদের উপর নিরাপত্তা বাহিনী কর্তৃক পিটুনির একটি ভিডিও অনলাইনে প্রকাশের পর, ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে, সরকারি কর্মকর্তারা অন্ততপক্ষে চারজন পুলিশ কর্মকর্তাকে আটক করে। এই ভিডিওতে, রোহিঙ্গা পুরুষও শিশুদের তাদের মাথার পিছনে হাত দিয়ে সারিবদ্ধভাবে বসতে বাধ্য করা হয়েছিল, যখন তাদের রুল দিয়ে আঘাত এবং লাথি দেয়া হচ্ছিল। দমন অভিযানের শুরু থেকেই এই অঞ্চলে নিজস্ব নিরাপত্তা বাহিনীকে সরকারের শাস্তি দেয়ার এটিই প্রথম ঘটনা।[54][55]
২১ শে জানুয়ারী ২০১৭-তে, মংডুতে একটি অগভীর কবরস্থানে তিনজন রোহিঙ্গার লাশ পাওয়া যায়। তারা স্থানীয় লোক ছিল যারা স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছিল এবং সরকারের ধারণা যে তারা একটি প্রতিহিংসামূলক হামলায় রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের দ্বারা মারা যায়।[56]
২০১৭সালের ৪ জুলাই, সিত্বেয় অন্তত একশ জনের একটি রাখাইন বৌদ্ধ উচ্ছৃঙ্খল জনতা দপাইং ক্যাম্প থেকে অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত করার জন্য সাত জন রোহিঙ্গাকে ইট দিয়ে আক্রমণ করতে থাকে,[57] এভাবে এক জনকে হত্যা করে এবং কয়েকজনকে গুরুতরভাবে আহত করা হয়। রোহিঙ্গা বাসিন্দাদের নৌকা ক্রয় করার জন্য সিত্বের ডকগুলিতে পুলিশ প্রহরীস্বরূপ নিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু সশস্ত্র বাহিনীর রক্ষীরা পাশে থাকা সত্ত্বেও তাদের উপর হামলা করা হয়।[58][59][60] বার্মার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্রের মতে, হামলার সময় রোহিঙ্গাদের সাথে একজন নিরস্ত্র জুনিয়র পুলিশ ছিল, তবে আক্রমণকারীদের থামাতে সক্ষম ছিল না।[57] হামলার সাথে সম্পর্কিত এক ব্যক্তিকে ২৬ জুলাই ২০১৭-তে গ্রেফতার করা হয়।[61]
২০১৬ সালের নভেম্বরের শেষেরদিকে এশিয়ার বিভিন্ন দেশের রাজধানীতে মুসলিমদের প্রতিরোধের জন্য প্রতিরোধ সমাবেশ ডাকা হয়।[62] ৮ই সেপ্টেম্বর ২০১৭-তে, বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া এবং পাকিস্তান সহ এশিয়ার দেশগুলোতে রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীদের সংহতি জানিয়ে প্রতিরোধ মিছিল করা হয়।[63] সেপ্টেম্বর ২০১৭-র প্রথম দিকে, অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নের রোহিঙ্গারাও প্রতিবাদ মিছিল করে।[64] তাছাড়া যুক্তরাজ্যের ওয়াশিংটন ডিসী, দক্ষিণ আফ্রিকার কেপ টাউন[65] এবং ভারতের জম্মু এবং কাশ্মীরেও প্রতিবাদ মিছিল করা হয়। হংকংয়েও প্রতিবাদ সমাবেশের পরিকল্পনা করা হয়।[66][67][68]
রোহিঙ্গাদের শুরু থেকেই আন্তর্জাতিক অনেক সহায়তা দেওয়া হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র রোহিঙ্গাদের ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকা সহায়তা দেওয়ার ঘোষণা দেয়।[69]
রোহিঙ্গা জনগণের ওপর সামরিক অভিযান বিভিন্ন দফতর থেকে সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এবং জাতিসংঘের মতো সংস্থা রোহিঙ্গা সংখ্যালঘুদের ওপর মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে এই সামরিক অভিযানকে আখ্যা দিয়েছে এবং তারা বলেছে যে এটি বেসামরিক লোকদের "সহিংসতার একটি নিয়মানুগ সামরিক অভিযানের" লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছে।[17][34][70][71]
মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরও রাখাইন রাজ্যে সহিংসতা এবং রোহিঙ্গাদের স্থানচ্যুতি সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।[16]
নভেম্বর ২০১৬ সালে, বাংলাদেশ "ভীষণ উদ্বেগ" প্রকাশ করে মিয়ানমারের কূটনীতিক সদস্যদের তাদের দেশে রোহিঙ্গাদের নির্যাতনের জন্য তলব করে।[72]
দেশটির চলমান বিক্ষোভের কারণে মালয়েশিয়া সরকার রাখাইন রাজ্যে দাঙ্গার নিন্দা করেছে। ডিসেম্বরের প্রথমদিকে একটি বিক্ষোভ সমাবেশে, মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাক রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর সামরিক অভিযানের জন্য মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের সমালোচনা করেন এবং চলমান নিপীড়নকে "গণহত্যা" হিসাবে বর্ণনা করেন।[73][74] এর আগে, রোহিঙ্গা মুসলিম সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে "জাতিগত নির্মূল" হিসেবে সহিংসতার কথা উল্লেখ করে মালয়েশিয়া বলে যে 'এই সমস্যাটি আন্তর্জাতিক উদ্বেগের বিষয়'।[75] সহিংসতার প্রতিবাদ হিসেবে মালয়েশিয়া, মিয়ানমারের বিরুদ্ধে দুটি ফুটবল ম্যাচও বাতিল করে দেয়।[33][76]
জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান, রাখাইন রাজ্যের এক সপ্তাহের দীর্ঘ সফর শেষে, ঐ এলাকার মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রতিবেদন সম্পর্কে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন।[77] তিনি ৯ সদস্যের কমিশন পরিচালনা করেন যা ২০১২ সালের আগস্ট মাসে গঠিত হয়। যাতে ঐ রাজ্যের পরিস্থিতিতে দৃষ্টিপাত করা এবং সেখানকার পরিস্থিতি উন্নত করার সুপারিশ করা যায়।[17][77]
নভেম্বর ২০১৬ সালে জাতিসংঘের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, জন ম্যাককিসিক মিয়ানমারকে রাখাইন রাজ্য থেকে মুসলিম সংখ্যালঘু মুক্ত করার জন্য জাতিগত নির্মূল পরিচালনার অভিযোগ করে।[16][75] ম্যাককিসিক, বাংলাদেশের শহর কক্সবাজারে অবস্থিত জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থাটির প্রধান। পরবর্তী মাসে, বাংলাদেশ মিয়ানমারের দূতকে তার দেশে রোহিঙ্গাদের নির্যাতনের উপর "ভীষণ উদ্বেগ" প্রকাশ করে আহ্বান জানায়।[72]
২০১৬ সালের ডিসেম্বরে, জাতিসংঘ মিয়ানমার সরকারের রোহিঙ্গাদের কার্পণ্যপূর্ণ আচরণের জন্য তীব্রভাবে সমালোচনা করে এবং তার অভিগমনকে "নিন্দা" বলে অভিহিত করে।[38][78] জাতিসংঘ রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সহিংসতা বন্ধ করার জন্য পদক্ষেপ নিতে মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় কাউন্সিলর (বস্তুত সরকার প্রধান) এবং নোবেল বিজয়ী অং সান সু চি কে তলব করে।[32][37] ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত প্রতিবেদনে জাতিসংঘের বিবৃতিতে বলা হয়েছে যে রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতন গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অন্তর্ভুক্ত ছিল। জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনার জেইদ রাদ আল হুসাইন বলেন, "এই রোহিঙ্গা শিশুদের বিরুদ্ধে যেসব নিষ্ঠুরতা চলছিল তা অসহনীয়- কোন ধরনের ঘৃণা, শিশুদের মায়ের দুধের জন্য কান্নারত অবস্থায় একজন মানুষকে ছুরিকাঘাত করাতে পারে?"[40][41] সরকারের একজন মুখপাত্র বলেন যে অভিযোগ খুব গুরুতর ছিল, এবং তদন্ত করা হবে।[40]
অং সান সু চি বিশেষ করে তার নীরবতার জন্য এবং এই সমস্যা সমাধানে পদক্ষেপ গ্রহণের অভাবের জন্য সমালোচিত হয়েছেন এবং সামরিক বাহিনীর মানবাধিকার লঙ্ঘন প্রতিরোধে ব্যর্থ হয়েছেন।[16][17][29] তিনি প্রতিক্রিয়ায় বলেন: "আমাকে মানবাধিকার বিষয় ছাড়া একটি দেশ দেখান।"[32]
আগস্ট ২০১৭-তে, অং সান সু চি সরকারের কর্মকাণ্ডকে সমর্থন দিয়ে বলে "...রাখাইন রাজ্যের সকল লোকেদের সর্বোচ্চ সম্ভাব্য উপায়ে প্রতিরোধ করা শুরু হয়েছে এবং যা দুটি দেশের মধ্যে সমস্যা তৈরি করতে পারে সেরকম কোন ভুল তথ্য না থাকে তা প্রকাশ করা হয়েছে।"[79] সংঘবদ্ধ এবং সহিংস রাখাইন যোদ্ধাদের স্বাভাবিকভাবে ধরার চেষ্টা করা হচ্ছে বলে সে নিরাপত্তা বাহিনীর দ্বারা রোহিঙ্গাদেরকে পর্যায়ক্রমিক নির্যাতনের কথা অস্বীকার করে।[80] ডেসমন্ড টুটুর মতো নেতাদের দ্বারা তার প্রতিক্রিয়া সমালোচিত হয়।[81] দি ইকোনমিস্ট সু চির অবস্থানের সমালোচনা করে বিতর্ক করে: "রাখাইন রাজ্যের সহিংসতা এমন এক বিবেকবর্জিত পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে যে নিষ্ক্রিয়তা চালিয়ে ন্যায্যতা প্রমাণের কিছু বাকি নেই।"[80]
২৩শে মে, ২০১৭ সালে, ওএইচসিআর-এর ফেব্রুয়ারি মাসে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের অভিযোগগুলি সামরিক বাহিনী প্রত্যাখ্যান করে বলা হয় যে, "ওএইচসিআর রিপোর্টে অন্তর্ভুক্ত ১৮ টি অভিযোগের মধ্যে ১২ টি ভুল প্রমাণিত হয়েছে, বাকি ছয়টি অভিযোগ পাওয়া গেছে মিথ্যা এবং মিথ্যার উপর ভিত্তি করে অতিরঞ্জিত অভিযোগ এবং উদ্ভাবিত বিবৃতি।"[82]
এই সহিংসতার তীব্র প্রতিক্রিয়া হিসেবে, মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে সরাসরি নিষেধাজ্ঞা, এবং আমেরিকা ও অন্যান্য দেশগুলোর দ্বারা পূর্বে প্রতিষ্ঠিত যেসব কোম্পানিসমূহ এদের সাথে ব্যবসা করত তাদের জরিমানার প্রস্তাব করে।[80] দি ইকোনমিস্টের মতে, "বার্মিজ সেনাবাহিনীদের প্রভাবিত করা এতোটা সহজ না, বরং তাদের অর্থনৈতিক এবং কূটনৈতিক বিচ্ছিন্নতার মাধ্যমে প্রথমে ক্ষমতা আত্মসমর্পণের অংশ হিসেবে চেষ্টা করা যেতে পারে।"[80]
এনজিও ফরটিফাই রাইটসের মেথিও স্মিথের মতে, “আমরা এখন সর্বোচ্চ প্রত্যয় নিয়ে বলতে পারি যে রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত নিরাপত্তা বাহিনী এবং স্থানীয় সশস্ত্র বাসিন্দারা গনহত্যা করে যাচ্ছে।” স্মিথ অভিযোগ করে বলন যে বার্মিজ সামরিক বাহিনী দেশ থেকে সকল রোহিঙ্গাদের উৎখাত করার প্রচেষ্টায় নিয়োজিত।[83]
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.