Loading AI tools
মুসলিম রাশিদুন খিলাফতের সামরিক বাহিনী উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
খিলাফতে রাশিদার সেনাবাহিনী বা প্রথমযুগের মুসলিম সেনাবাহিনী ছিল সপ্তম শতকে মুসলিম বিজয় অভিযানের সময়কার খিলাফতে রাশিদার সামরিক বাহিনী। রাশিদুন নৌবাহিনীর পাশাপাশি এটি বিভিন্ন কাজে অংশ নেয়। রাশিদুন সেনাবাহিনীতে উচ্চ শ্রেণীর নিয়মানুবর্তিতা, কৌশলগত দক্ষতা ও সংগঠন রক্ষা করা হত।
খিলাফতে রাশিদার সেনাবাহিনী | |
---|---|
সক্রিয় | ৬৩১ – ৭৫০ |
দেশ | আরব উপদ্বীপ |
শাখা | সেনাবাহিনী |
সদরদপ্তর | মদীনা, কুফা |
নীতিবাক্য | "Allah, al-Watan, at-Thawra, al-Wehda |
যুদ্ধসমূহ | আরব-বাইজেন্টাইন যুদ্ধ মুসলিমদের মিশর বিজয় মুসলিমদের পারস্য বিজয় উত্তর আফ্রিকার যুদ্ধ আরব-সাসানীয় যুদ্ধ আরব-খাজার যুদ্ধ মুসলিমদের মাওয়ারাননহর বিজয় সিন্ধুতে আরব অভিযান |
কমান্ডার | |
সর্বোচ্চ কমান্ডার | খলিফা |
উল্লেখযোগ্য কমান্ডার | খালিদ বিন ওয়ালিদ আমর ইবনুল আস আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ |
তৎকালীন সময়ে খিলাফতের সেনাবাহিনী বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী ও কার্যকরী সেনাবাহিনীগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল। ৬৩২ সালে এই বাহিনীতে ১৩,০০০ সৈনিক ছিল। তবে খিলাফতের সীমানা বৃদ্ধির সাথে সাথে বাহিনীর সদস্যসংখ্যা ৬৫৭ সাল নাগাদ ১,০০,০০০ সৈনিকে উন্নীত হয়। রাশিদুন সেনাবাহিনীর সবচেয়ে সফল দুজন সেনাপতি হলেন খালিদ বিন ওয়ালিদ ও আমর ইবনুল আস। তারা যথাক্রমে পার্সিয়ান মেসোপটেমিয়া ও রোমান সিরিয়া জয় করেন।
রাশিদুন সেনাবাহিনীতে শুধুমাত্র মুসলিমরাই যোগ দিতে পারত। রিদ্দার যুদ্ধের সময় বাহিনীটি মূলত মদিনা, মক্কা ও তাইফের লোকদের নিয়ে গঠিত ছিল। পরবর্তীতে ৬৩৩ সালে ইরাক বিজয়ের সময় অনেক বেদুইন এতে নিয়মিত সৈনিক হিসেবে ভর্তি হয়। সাসানীয় সাম্রাজ্য জয়ের সময় (৬৩৩ - ৬৫৬) প্রায় ১২,০০০ উচ্চশ্রেণীর পার্সিয়ান সৈনিক ইসলাম গ্রহণ করে এবং সাম্রাজ্য আক্রমণে অংশ নেয়। রোমান সিরিয়ায় মুসলিম বিজয় অভিযানের সময় (৬৩৩ - ৬৩৮) কমান্ডার জোয়াকিমের (পরবর্তীতে আবদুল্লাহ জোয়াকিম) অধীন প্রায় ৪,০০০ গ্রিক বাইজেন্টাইন সৈনিক ইসলাম গ্রহণ করে এবং আনাতোলিয়া ও মিশর জয়ে অংশ নেয়। মিশর বিজয়ের সময় (৬৪১ - ৬৪৪) কপ্টিক থেকে ইসলাম গ্রহণ করা ব্যক্তিরা মুসলিম বাহিনীতে যোগ দেয় ও বিজয় সহজ করে দেয়। উত্তর আফ্রিকা জয়ের সময় বার্বার ধর্মান্তরিতরা নিয়মিত বাহিনীতে যোগ দেয়। পরবর্তীতে এদেরকে আফ্রিকায় রাশিদুন সেনাবাহিনী ও তদপরবর্তী উমাইয়া সেনাবাহিনীতে বড় আকারে দেখা যায়।
রাশিদুন সেনাবাহিনীতে বিরাট অংশ পদাতিক ছিল। মুসলিম বাহিনীতে একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল মুবারিজুন। এটি দ্বন্দ্বযোদ্ধাদের নিয়ে গঠিত হয়। এদের কাজ ছিল শত্রুদের দ্বন্দ্বযোদ্ধাদের হত্যা করে তাদের মনোবল ভেঙ্গে দেয়া। এরপর পদাতিক বাহিনী কার ওয়া ফার নামক কৌশলের আশ্রয় নিত। এতে তলোয়ার ও বর্শা ব্যবহার হত সেসাথে শত্রুদের দুর্বল করে তোলার জন্য তীর নিক্ষেপ করা হয়। তবে অশ্বারোহী বাহিনীর আক্রমণ রিজার্ভ রাখা হত যাতে এরপর পাল্টা আক্রমণ করা যায়। প্রতিরক্ষামূলকভাবে মুসলিম বর্শাধারীরা দেয়ালের মত হয়ে তীরন্দাজদেরকে তাদের আড়াই মিটার দীর্ঘ বর্শা দিয়ে রক্ষা করত। ইয়ারমুকের যুদ্ধে এই রক্ষাব্যুহ চারদিক ধরে প্রতিরক্ষার কাজ করেছিল।[1]
রাশিদুন অশ্বারোহীরা অন্যতম সফল হালকা অশ্বারোহী বাহিনী ছিল। এর সদস্যরা সাড়ে পাঁচ মিটার দীর্ঘ বর্শা ও তলোয়ার সজ্জিত থাকত। অশ্বারোহী বাহিনীকে রিজার্ভ হিসেবে রাখা হত। পদাতিক বাহিনীর মুহুর্মুহু আক্রমণে পর্যুদস্ত শত্রুদের উপর আক্রমণে এটি ব্যবহৃত হত। অশ্বারোহীরা পাশ থেকে বা বৃত্তাকারভাবে অবস্থান নিত। সাসানীয়দের বিরুদ্ধে ওয়ালাজার যুদ্ধ ও বাইজেন্টাইনদের বিরুদ্ধে ইয়ারমুকের যুদ্ধে অশ্বারোহী বাহিনীর ব্যবহার কিছু উত্তম দৃষ্টান্ত। দুই ক্ষেত্রেই অশ্বারোহীরা সেনাবাহিনীর পার্শ্ব ও মধ্যভাগের পিছনে অবস্থান নেয়। আরব উপদ্বীপের আবহাওয়া ও দুর্বল অর্থনৈতিক অবস্থার কারণে বিপুল সংখ্যক যুদ্ধের ঘোড়া রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়বহুল হওয়ায় মূল বাহিনীর সাথে অশ্বারোহীদের অনুপাত ২০% এর কম রাখা হত। নিকট প্রাচ্যের সম্পদশালী অঞ্চল করায়ত্ত হওয়ার পর আরব সৈনিকরা বহুসংখ্যক ঘোড়া লাভ করে। ফলে রাশিদুন খিলাফতের শেষের দিকে বাহিনীর অর্ধেক অশ্বারোহী ছিল। বাইজেন্টাইন ও সাসানীয়দের মধ্যে অশ্বারোহী তীরন্দাজ থাকলেও ঐতিহ্যগত আরব যুদ্ধকৌশলে এমন কিছু না থাকায় প্রথমদিকে রাশিদুন অশ্বারোহীদের মধ্যে এমন কিছু ছিল না। পারস্য বিজয়ে অগ্রগতি লাভ করলে বেশ কিছু সাসানীয় ইসলাম গ্রহণ করে এবং রাশিদুন বাহিনীতে যোগ দেয়। তারা তাদের অশ্বারোহী দক্ষতা ও অশ্বারোহী তীরন্দাজির জন্য দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
তৎকালীন মুসলিম সামরিক উপকরণের পুনর্নির্মাণ কষ্টসাধ্য। রোমান সেনাবাহিনী বা পরবর্তীকালীন মুসলিম সেনাবাহিনীর সাথে তুলনা করলেও তৎকালীন অস্ত্রের দৃষ্টিগ্রাহ্য নমুনা তৈরী করা কঠিন। বাস্তবিকপক্ষে খুব অল্প পরিমাণ উপকরণ প্রমাণ হিসেবে টিকে আছে। এর অধিকাংশের সময়কাল নির্ণয় করা কঠিন।[2] ইসলামপূর্ব আরবে অধিকাংশ সামরিক উপকরণ সিরিয়া, ইরাক, আর্মেনিয়া ও ইয়েমেন থেকে আসত। প্রথমদিককার অভিযানে জয় করার মাধ্যমে আরো অনেক বেশি সংগৃহিত হয়।
মুসলিম সৈনিকরা মাথার নিরাপত্তার জন্য হেলমেট পরত। এগুলো গোলাকার ও সুচালো দুইরকমই হত। গোলাকারগুলোকে “বাইদাহ” (“ডিম”) বলা হত। এগুলো বাইজেন্টাইন ধাচের ছিল ও দুইটি অংশ নিয়ে তৈরী হত। সুচালো হেলমেটগুলো মধ্য এশীয় ধাচের ছিল ও এগুলোকে “তারিকাহ” বলা হত। মুখ ও ঘাড়ের সুরক্ষার জন্য ধাতব আচ্ছাদন ব্যবহৃত হত। প্রায়শ মুখমন্ডল অর্ধেক আবৃত থাকত এবং পাগড়ির বর্ধিতাংশ মরুভূমির প্রবল বায়ুপ্রবাহ থেকে রক্ষার জন্য ব্যবহৃত হত।
শক্ত চামড়ার তৈরী বর্ম ইয়েমেন, ইরাক ও পারস্য উপসাগরীয় এলাকায় তৈরী হত। পরবর্তীতে পার্শ্ববর্তী সাম্রাজ্য জয়ের ধাতব বর্ম ব্যবহার ব্যাপকভাবে শুরু হয়। এগুলো দির নামে পরিচিত ছিল। মরিচা থেকে রক্ষার জন্য এগুলোকে পালিশ করা হত এবং ধুলা ও তেলের মিশ্রণে রাখা হত।[3] পদাতিক সৈনিকরা অশ্বারোহীদের তুলনায় বেশি ভারী অস্ত্র সজ্জিত ছিল। দুটি বর্ম পড়ার তথ্যও পাওয়া যায়, এগুলোর মধ্যে দ্বিতীয়টি ছোট ও প্রায়ই চামড়ার তৈরী ছিল।
কাঠ বা বেতের তৈরী ঢাল ব্যবহার করা হত তবে অধিকাংশ ঢাল চামড়ার তৈরী ছিল। এজন্য উট বা গরুর চামড়া ব্যবহৃত হত ও এগুলো তৈলাক্ত করা হত। প্রাচীন হিব্রুদের সময় থেকেই এই চর্চা চলে আসছে।[4] লেভান্ট অভিযানের সময় বাইজেন্টাইন হাতির চামড়ার তৈরী ঢাল ব্যবহৃত হয়েছিল। সম্ভবত এগুলো বাইজেন্টানদের সাথে যুদ্ধের সময় করায়ত্ত হয়।
পারস্য উপসাগরীয় উপকূলের নলখাগড়া দিয়ে দীর্ঘদন্ডযুক্ত বর্শা তৈরী হত। পদাতিকদের বর্শা আড়াই মিটার ও অশ্বারোহীদের বর্শা সাড়ে পাঁচ মিটার দীর্ঘ হত।
তলোয়ার ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র। উচ্চ মানসম্পন্ন তলোয়ার ইয়েমেনে তৈরী হত।[5] অন্যান্য ধরনের তলোয়ার সমগ্র আরবেই তৈরী হত। ছোট আরব তলোয়ার ও সাসানীয় দীর্ঘ তলোয়ারই ব্যবহার করা হত এবং অশ্বারোহী ও পদাতিক বাহিনী দুই ধরনের তলোয়ার একই সময় বহন কর। তলোয়ারগুলো কাঁধ থেকে বেল্টের সাহায্যে ঝুলানো তলোয়ারের খাপে রাখা হত। অন্যতম একটি অস্ত্র ছিল ড্যাগার। এটি সর্বশেষ অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের জন্য রাখা হত।
আরবের বিভিন্ন অঞ্চলে স্থানীয়ভাবে ধনুক তৈরী হত। হিজাজি ধনুকের চল সাধারণ ছিল। এটি একটি কাঠের টুকরো বা দুটি কাঠের টুকরো একটির পিছনে অন্যটি লাগিয়ে তৈরী হত। প্রথাগত আরব ধনুকগুলোর সর্বোচ্চ পাল্লা ছিল ১৫০ মিটার। তৎকালীন পদাতিক তীরন্দাজরা অশ্বারোহীদের বিপক্ষে কার্যকরী প্রমাণিত হয়।
পারস্য বিজয়ের পর আরব তীরন্দাজরা ভারী তীরের ব্যবহারের কারণে পরিচিতি পান। স্বল্প দূরত্বে এগুলো বর্মভেদ করতে পারত। একজন পারসিক লেখক লিখেছেন যে পারসিক তীরন্দাজরা আরবদের প্যাডযুক্ত কাপড়ের কারণে অসফল হন। তবে আরবদের ব্যবহৃত তীর বিপক্ষের ধাতব পোশাক ভেদ করতে সক্ষম হয়।
অবরোধের জন্য ক্যাটাপাল্ট ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। খলিফা উমরের সময় দাবাবাহ নামক অবরোধ টাওয়ার বাহিনীতে যুক্ত করা হয়। বহুতল বিশিষ্ট কাঠের তৈরী এই টাওয়ারগুলো চাকার সাহায্যে সরানো যেত। এগুলোকে পায়ের হেটে সরানো হত। এরপর ব্যাটারিং র্যাম দিয়ে দেয়াল ভেঙ্গে দেয়া হত। তীরন্দাজরা রেম ও এটিকে চালানো সৈনিকদের নিরাপত্তা রক্ষা করত।[6]
খলিফা উমর মুসলিম শাসকদের মধ্যে সর্বপ্রথম সেনাবাহিনীকে একটি রাষ্ট্রীয় সংগঠন হিসেবে গড়ে তোলেন। ৬৩৭ সালে এই সংস্কার সাধিত হয়। কুরাইশ ও আনসারদের সহযোগে প্রথমে এটির সূচনা হয়। এরপর ধীরে ধীরে সমগ্র আরব ও মুসলিম অধিকৃত অঞ্চলে তা ছড়িয়ে পরে। যুদ্ধে যেতে সক্ষম এমন সব প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির নাম লিপিবদ্ধ করা থাকত ও বেতন কাঠামো নির্দিষ্ট করা ছিল। নিবন্ধনকৃত সকলে সামরিক ক্ষেত্রে অংশগ্রহণে বাধ্য ছিল। তারা দুইভাগে বিভক্ত ছিল। এগুলো হল:
মুহররম মাসের শুরুতে তাদের বেতন দেয়া হত। ফসল কাটার মৌসুমে অতিরিক্ত অর্থ দেয়া হত। অধিকাংশ সময় নগদ অর্থে তাদের বেতন দেয়া হত। ইউরোপে রোমান পরবর্তী যুগের বিপরীতে জমি লাভ করা বা প্রজাদের কাছ থেকে সরাসরি কর সংগ্রহের দায়িত্ব তারা পেত না। সেনাবাহিনী অনেকাংশ রাষ্ট্রের উপর নির্ভরশীল ছিল তাই তাদেরকে রাষ্ট্রের কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করতে হত।[7] কর্মদক্ষতা ও মেধার কারণে পদন্নোতি দেয়ার ব্যবস্থা ছিল। কর্মকর্তার পদ ছিল নিয়োগ ভিত্তিক। এটি নির্দিষ্ট র্যাঙ্ক ছিল না। কোনো যুদ্ধ বা অভিযান পরিচালনের জন্য কমান্ডার নিয়োগ দেয়া হত এবং অভিযান সমাপ্ত হলে তারা পূর্ব পদে ফিরে আসত।
সৈনিকদের নিয়মিত বিরতিতে ছুটি দেয়া হত। দূরবর্তী স্থানে অবস্থানরতদের চার মাস অন্তর ছুটি দেয়া হত। প্রত্যেক সেনাদলে একজন কোষাধ্যক্ষ, একজন হিসাবরক্ষক, একজন কাজি, বেশ কয়েকজন দোভাষী এবং চিকিৎসক ও শল্যবিদ থাকতেন। অভিযান চালানো হত ঋতুর উপর ভিত্তি করে। শীতপ্রধান অঞ্চলে গ্রীষ্মকালে ও গ্রীষ্মপ্রধান অঞ্চলে শীতকালে অভিযান চালানো হত। বসন্তে সৈনিকদের স্বাস্থ্যকর আবহাওয়া সম্পন্ন এলাকায় পাঠানো হত। নিয়ম অনুযায়ী প্রত্যেক সৈনিককে ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য কিছু জিনিস রাখতে হত। এর মধ্যে সুই, তুলা, দড়ি,কাচি ও পশুখাদ্যের ব্যাগ থাকত। খলিফা উমরের বিশেষ নির্দেশ অনুযায়ী প্রত্যেক সৈনিককে অশ্বারোহণ, তীরনিক্ষেপ ও সাঁতার শিক্ষার উপর জোর দিতে হত।
সন | সৈনিক |
---|---|
৬৩২ | ১৩,০০০ |
৬৩৩ | ১৮,০০০ |
৬৩৪ | ৪১,০০০ |
৬৩৫ | ৩৭,০০০ |
৬৩৬ | ৭০,০০০ |
৬৪০ | ৭৪,০০০ |
৬৪৮ | ৮০,০০০ |
৬৫২ | ১,২০,০০০ |
৬৫৭ | ১,০০,০০০ |
৬৬১ | ৮০,০০০ |
এক স্থান থেকে অন্যস্থানে যাত্রার সময় সেনারা শুক্রবার বিরতি দিত। যাত্রার দিনগুলোতে দিনের বেলা সৈনিকরা ক্লান্ত হয়ে পড়ে এমন দূরত্ব অতিক্রম করা হত না। কীভাবে যাত্রা করা হবে তা নির্ভর করত পানি ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় উপকরণের প্রাপ্যতার উপর। যোগাযোগ লাইনের ব্যাপারে স্বাধীনতা তাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ছিল। সেসাথে তাদের পশ্চাতে কোন সরবরাহ লাইন থাকত না। সরবরাহ ভান্ডার না থাকায় বাহিনীকে কখনো সরবরাহ থেকে বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব হত না। এজন্য সেনা দপ্তরের অধীনে আলাদা বিভাগ ছিল। খাদ্যসামগ্রী একসাথে জড়ো করে বাহিনীর সাথে পাঠিয়ে দেয়া হত। এজন্য কোনো সড়ক বা মালগাড়ির দরকার হত না। বরং উটের পিঠে করে এসব পাঠানো হত। ফলে মানুষ ও পশুর পক্ষে যাওয়া সক্ষম এমন সব স্থানেই সৈনিকরা যেতে সক্ষম ছিল। এই সহজসাধ্যতার কারণে মুসলিমরা বাইজেন্টাইন ও পার্সিয়ানদের চেয়ে চলাচল ও গতিতে সফলতা লাভ করে। যাত্রার সময় তারা ক্যারাভেনের মত এগিয়ে চলত। সামরিক নিরাপত্তার দিক থেকে দেখলে এটিকে অভেদ্য বলা যায়। অগ্রবর্তী একটি বাহিনী দ্বারা যাত্রার নেতৃত্ব দেয়া হত। এরপর সেনাবাহিনীর মূল বাহিনী থাকত। এর পেছনে থাকত নারী ও শিশু এবং বোঝা বহন করা উট। একেবারে শেষে পিছনের দিকে রক্ষীরা অবস্থান করত। দীর্ঘ যাত্রায় ঘোড়া সামনের দিকে থাকত। তবে শত্রু কর্তৃক আক্রমণের আশঙ্কা থাকলে সৈনিকরা ঘোড়ায় আরোহণ করত। এর ফলে অশ্বারোহীরা অগ্রবর্তী রক্ষী বা পশ্চাতবর্তী রক্ষী হিসেবে কাজ করতে পারত বা পার্শ্ববর্তী অবস্থা গ্রহণ করতে পারত। এটি নির্ভর করত কোন দিক থেকে আক্রমণ আসতে পারে তার উপর। প্রয়োজন হলে সমগ্র সেনাবাহিনী এক ঘণ্টার মধ্যেই সুরক্ষিত স্থানে আত্মগোপন করতে পারত যাতে অন্য কোনো বাহিনী তাদের ধরতে না পারে।
মার্চের সময় বাহিনী নিমোক্ত ভাগে বিভক্ত করা হত:
যাত্রার সময় অধিকাংশ সৈনিক উটে আরোহণ করত। বাকিরা ঘোড়ায় চড়ত। এর ফলে প্রতিদ্বন্দ্বী পার্সিয়ান ও রোমানদের তুলনায় তাদের চলাচলে দ্রুততা আসে।
দশমিক পদ্ধতিতে সেনা বিন্যাস করা হত।[8]
যুদ্ধক্ষেত্রে সেনাদেরকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হত। এগুলো হল:
প্রত্যেক ভাগের একজন কমান্ডার থাকত এবং এগুলোর মধ্যে ১৫০ মিটারের দূরত্ব রাখা হত। প্রত্যেক গোত্রীয় দলের নেতাদেরকে বলা হত আরিফ। এধরনের সেনাদলে ১০, ১০০ ও ১০০০ জনের কমান্ডার থাকত। বড় সেনাদল গঠনের জন্য এই রেজিমেন্টগুলোর গঠন সহজসাধ্য ছিল সেসাথে পরিস্থিতির উপর নির্ভর করত। আরিফদের দল থাকত এবং প্রত্যেক দল আমিরুল আশার নামক কমান্ডারের অধীনে কাজ করত। আমিরুল আশার থাকতেন সেকশন কমান্ডারের অধীন এবং সেকশন কমান্ডার কমান্ডার-ইন-চীফ আমিরুল জাইশের অধীনে থাকতেন।
সেনাবাহিনীর অন্যান্য অংশগুলো হল:
এটি ছিল সেনাবাহিনীর সবচেয়ে উন্নত বিভাগ। অধিকাংশ অভিযানে এর সফলতা প্রতীয়মান হয়। গুপ্তচর ও গোয়ান্দা বিভাগ ইরাক অভিযানের সময় সর্বপ্রথম খালিদ বিন ওয়ালিদ কর্তৃক সংগঠিত হয়।[9] পরে তিনি সিরিয়ান ফ্রন্টে বদলি হলে সেখানেও তিনি গুপ্তচর বিভাগ সংগঠিত করেন।[10] পরবর্তীতে এটি সেনাবাহিনীর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে পরিগণিত হয় এবং এজন্য আলাদা দপ্তর খোলা হয়। এর কাজ ছিল শত্রুর গতিবিধি ও কাজকর্মের উপর নজর রাখা। এতে বিজিত অঞ্চলের স্থানীয় জনগণকে কাজে লাগানো হত। গোয়েন্দাদের কাজ ছিল সুসংগঠিত ও এজন্য তাদেরকে মানসম্পন্ন বেতন দেয়ার ব্যবস্থা ছিল। প্রত্যেকে সেনা ইউনিটের সাথেই সংবাদবাহক থাকত ও তারা খলিফাকে সেনাবাহিনীর অবস্থা সম্পর্কে সর্বশেষ তথ্য সরবরাহ করত।
সামরিক কেন্দ্রগুলো জুন্দ নামে পরিচিত ছিল। এটি সর্বপ্রথম খলিফা উমর কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হয়। সেনা প্রশাসনের উদ্দেশ্য এটি তৈরী করা হয়। এই কেন্দ্রগুলো মদীনা, কুফা, বসরা, মসুল, ফুসতাত, দামেস্ক, জর্ডান ও ফিলিস্তিনে অবস্থিত ছিল। এই কেন্দ্রগুলোতে সৈনিকদের অবস্থানের জন্য ব্যারাক তৈরি করা হয়। স্বল্প সময়ের নোটিশে উপস্থিত করার জন্য উপযোগী চার ঘোড়া রাখার উপযুক্ত আস্তাবল এগুলোতে তৈরী করা হয়। এসকল জুন্দ থেকে প্রয়োজনমাফিক অতিরিক্ত সৈন্য পাঠানো হত। সেনাবাহিনী সম্পর্কিত দলিলপত্র এখানে রক্ষিত থাকত। এসব স্থানে খাদ্য মজুদ থাকত ও এখান থেকেই অন্য স্থানে পাঠানো হত। সেনা কেন্দ্রগুলোর পাশাপাশি বড় শহর ও কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে সেনানিবাস স্থাপন করা হয়। নির্মিত সেনানিবাস ও ব্যারাকগুলোতে আবহাওয়া ও পরিচ্ছন্নতার দিকেও লক্ষ রাখা হত। সেনানিবাসে রাস্তা নির্মাণের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করা হয়। খলিফা উমর রাস্তা নির্মাণের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিতেন।
শত্রুসেনাদের দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে সুযোগের সদ্ব্যবহার করা ও সর্বনিম্ন ক্ষয়ক্ষতি সহকারে বিজয় অর্জন মুসলিম সেনাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল ছিল। খালিদ বিন ওয়ালিদ সাসানীয় (ইরাক ৬৩৩ – ৬৩৪) বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের (সিরিয়া ৬৩৪ - ৬৩৮) বিরুদ্ধে অভিযানের সময় বেশ কিছু দুর্দান্ত কৌশলের আশ্রয় নেন। এগুলো পার্সিয়ান ও বাইজেন্টাইনদের বিরুদ্ধে সফল প্রমাণিত হয়। সহজে চলাচলে সক্ষম না হওয়া সাসানীয় ও বাইজেন্টাইনদের প্রধান দুর্বলতা ছিল।[11] খালিদ বিন ওয়ালিদ তাই শত্রুদের বিরুদ্ধে দ্রুত চলাচলের কৌশল ব্যবহার করেন। পরবর্তী সকল মুসলিম বিজয় অভিযানের সময় সেনাপতিরা খালিদের এই কৌশল ব্যবহার করেন। রাশিদুন সেনাবাহিনীর একটি অংশ শুধু অশ্বারোহী ছিল। তবে বাকিরা উটে আরোহণ করত। খালিদ বিন ওয়ালিদ ও পরবর্তী সেনাপতিরা মুসলিম সৈনিকদের লড়াইয়ের দক্ষতাকে কাজে লাগান। এদের মধ্যে অনেকে ছিলেন বেদুইন এবং তলোয়ার চালনায় সুদক্ষ।
সিরিয়া বিজয়ের সময় মুসলিমদের হালকা অশ্বারোহী বাহিনী সেনাবাহিনীর সবচেয়ে শক্তিশালী অংশে পরিণত হয়। ইয়ারমুকের যুদ্ধে এদের শক্তিমত্তা ব্যাপকভাবে প্রকাশিত হয়। যুদ্ধের বিভিন্ন প্রতিকূল পর্যায়ে খালিদ অশ্বারোহীদেরকে বিভিন্ন দিকে চালনা করে যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দেন। খালিদের মাধ্যমে শক্তিশালী অশ্বারোহী দল গঠিত হয়। প্রথমদিককার মুসলিম ইতিহাসবিদরা এদেরকে মুতাহাররিক তুলাইহা ( متحرك طليعة ) বা মোবাইল গার্ড নাম দেন। এদেরকে অগ্রবর্তী দল হিসেবে ব্যবহার করা হত। শত্রুদের সমূলে উৎপাটনের ব্যাপারে দক্ষ ছিল। বাইজেন্টাইনদের বিরুদ্ধে এদের কৌশল যথেষ্ট কাজ দেয়। হামলার কার্যকারিতার কারণে মুসলিমদের পক্ষে সিরিয়া বিজয় সহজ হয়।[12]
আল-মুসান্না আরেকটি কার্যকর কৌশল উদ্ভাবন করেন। এটিকেও পরবর্তী সেনাপতিরা যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহার করতেন। এই কৌশলটি ছিল যতক্ষণ বিরোধীপক্ষে হামলা করার মত দূরত্বে আছে ততক্ষণ মরুভূমি থেকে বেশি দূরে অবস্থান না করা। এটি মূলত মরুভূমির কাছাকাছি থেকে যুদ্ধ করার রীতি। কোনো কারণে পরাজয় হলে পিছিয়ে যাওয়ার রাস্তা খোলা রাখা হত।[13] মরুভূমি ছিল নিরাপত্তার জন্য স্বর্গভূমি। সাসানীয় ও বাইজেন্টাইন বাহিনী এখানে সুবিধা করতে পারত না। অন্যদিকে উষ্ট্রারোহী সৈনিকদের জন্য এটি চলাচলের জন্য এটি ছিল আদর্শ স্থান। একই কৌশল অবলম্বন করে খালিদ ইরাক ও সিরিয়া বিজয়ের সময় তারা সেনাদেরকে ইরাক ও সিরিয়ার বেশি ভেতরে পাঠাননি যতক্ষণ না শত্রুসেনাদের লড়াইয়ের ক্ষমতা হ্রাস পায়। পিছনের দিকে সবসময় মরুভূমি থাকায় সহজ যোগাযোগ ও পুনএকত্রীকরণের সুবিধা প্রাপ্তি ঘটে।
বাইজেন্টাইন ও সাসানীয়রা দুর্বল ও বিধ্বস্ত হলে সেনাপতিরা যেকোন কৌশল বেছে নিতেন। তবে তারা মূলত তাদের সৈনিকদের দ্রুত স্থানান্তরের ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে শত্রুদেরকে ব্যাপকভাবে একত্রিত হওয়ার পথে বাধা সৃষ্টি করেন।[11]
খলিফা আবু বকর তার সেনাপতিদেরকে তাদের মিশন, মিশন পরিচালনার জন্য ভৌগোলিক এলাকা, ও প্রয়োজনীয় রসদ বরাদ্দ করতে। এরপর মিশন সফল করার দায়িত্ব সম্পূর্ণরূপে সেনাপতিদের উপর ন্যস্ত থাকত। তারা তাদের নিজস্ব কৌশল ব্যবহারের ব্যাপারে স্বাধীন ছিলেন। খলিফা উমর তার খিলাফতের শেষের ভাগে সেনাপতিরা কোথায় অবস্থান নেবে, কোথায় পরবর্তী গন্তব্য হবে ও সেনাদলের ডানপ্রান্ত ও বামপ্রান্ত কে নিয়ন্ত্রণ করবে তা ঠিক করে দিতেন। এর ফলে বিজয় তুলনামূলকভাবে ধীরগতির হয়ে পড়ে কিন্তু অভিযানকে আরও সুসংগঠিত রূপ দেয়। খলিফা উসমান আবু বকরের মত একই প্রক্রিয়া অনুসরণ করতেন। তিনি তার সেনাপতিদেরকে মিশনের দায়িত্ব ন্যস্ত করতেন এবং সফল করার দায়িত্ব তাদের নিজস্ব কৌশলের উপর ছেড়ে দিতেন। খলিফা আলীও একই কাজ করতেন।
কুরআনের নির্দেশিত যুদ্ধনীতি অনুসরণ করা হত। যুদ্ধ শুধু আত্মরক্ষা, অন্য মুসলিমদের সাহায্য ও চুক্তিভঙ্গের কারণে অনুমোদিত ছিল। সে সাথে এই প্রয়োজন পূরণ হওয়ার সাথে সাথে যুদ্ধ বন্ধ করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।[14][15][16][17] জীবদ্দশায় নবী মুহাম্মদ বিভিন্ন নির্দেশনা দিয়েছেন ও যুদ্ধের নীতির দেখিয়ে দিয়ে গেছেন। তার সাহাবী আবু বকর রাশিদুন সেনাবাহিনীকে দেয়া দশটি নীতিতে এই নিয়মগুলো সংক্ষিপ্ত আকারে বলা হয়েছে:[18]
থামো, হে লোকেরা, যুদ্ধক্ষেত্রে তোমাদের নির্দেশনার জন্য আমি দশটি নিয়ম দিচ্ছি। কখনো বিশ্বাসঘাতকতা করবে না বা সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত হবে না। তোমরা কখনো মৃতদেহকে বিকৃত করবে না। শিশু, নারী, বৃদ্ধ ব্যক্তিকে কখনো হত্যা করবে না। গাছ কেটে ফেলবে না বা আগুনে পুড়িয়ে ফেলবে না বিশেষত যদি তা ফলবান হয়। খাদ্য ছাড়া অন্য কোনো কারণে শত্রুদের পশুপালের কিছুকে হত্যা করো না। তোমরা যাত্রাপথে অনেক সংসারত্যাগী সন্নাসীদের পাশ দিয়ে অতিক্রম করবে; তাদেরকে কিছু করো না।
এই নির্দেশগুলো দ্বিতীয় খলিফা উমর কর্তৃক অনুসৃত হয়। তার শাসনামলে (৬৩৪ - ৬৪৪) অনেক গুরুত্ব বিজয় অর্জিত হয়।[19] অধিকন্তু সিফফিনের যুদ্ধে খলিফা আলী ঘোষণা করেন যে মুসলিমরা তাদের শত্রুদের পানি সরবরাহ বন্ধ করতে পারে না।[20] হাদীস অনুযায়ী নবী মুহাম্মদ মিসর বিজয়ের ব্যাপারে বলেছেন:[21]
"যেখানে কিরাত (মূল্যের একক) ব্যবহার করা হয় সেই মিশরে তোমরা প্রবেশ করতে যাচ্ছ। তাদের সাথে উত্তম ব্যবহার কর কারণ আমাদের সাথে তাদের নিকট বন্ধন ও বৈবাহিক সম্পর্ক রয়েছে।"
"কপ্টিকদের ব্যাপারে আল্লাহর প্রতি দায়িত্বশীল হও।"
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.