ইসলামে হাদিস, (আরবি: حديث: হাদীছ) যার আক্ষরিক অর্থে "কথা" অথবা "বক্তৃতা" [1] বা আসার/আছার (আরবি: أثر আথ়ার) যার আক্ষরিক অর্থে "ঐতিহ্য"[2] বলতে ইসলামের নবি মুহাম্মাদ (সা.) এর কথা, কাজ ও নীরব অনুমোদন বুঝানো হয়, যা নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারীদের শৃঙ্খলের মাধ্যমে সংরক্ষণ করা হয়েছে। অন্য ভাষায়, মুহাম্মাদ সা. যা বলেছিলেন; যা করেছিলেন এবং যে কাজ দেখার পর নীরবতা অবলম্বন করেছিলেন, তাই হাদিস। হাদিস হলো পবিত্র কুরআনের ব্যাখ্যা সরূপ। যেমন কুরআনে বলা হয়েছে:
"তাড়াতাড়ি শিখে নেয়ার জন্য আপনি দ্রুত ওহী আবৃত্তি করবেন না; কারণ এর সংরক্ষণ এবং পাঠ আমাদের দায়িত্বে। অতঃপর আমি যখন তা পাঠ করি, তখন আপনি সেই পাঠ অনুসরণ করুন। এরপর তা ব্যাখ্যা করা আমাদের দায়িত্ব।"[3]
[4] কুরআনে এই তাফসির বা ব্যাখ্যা, কুরআনের ভিতর অন্তর্ভুক্ত হাদিস হিসেবে বিবেচিত।
وَمَا کَانَ ہٰذَا الۡقُرۡاٰنُ اَنۡ یُّفۡتَرٰی مِنۡ دُوۡنِ اللّٰہِ وَلٰکِنۡ تَصۡدِیۡقَ الَّذِیۡ بَیۡنَ یَدَیۡہِ وَتَفۡصِیۡلَ الۡکِتٰبِ لَا رَیۡبَ فِیۡہِ مِنۡ رَّبِّ الۡعٰلَمِیۡنَ ۟
অর্থঃ আর কোরআন সে জিনিস নয় যে, আল্লাহ ব্যতীত কেউ তা বানিয়ে নেবে। অবশ্য এটি পূর্ববর্তী কালামের সত্যায়ন করে এবং সে সমস্ত বিষয়ের বিশ্লেষণ দান করে যা তোমার প্রতি দেয়া হয়েছে, যাতে কোন সন্দেহ নেই-তোমার বিশ্বপালনকর্তার পক্ষ থেকে।
[সূরা ইউনুস (يونس), আয়াত: ৩৭]
[5]যেসব আয়াতে "বলুন" এর আরবি قُلۡ আছে, এসব আয়াত আল্লাহ কর্তৃক অনুমোদিত হাদিস হিসেবে বিবেচিত।
قُلۡ اِنِّیۡۤ اَخَافُ اِنۡ عَصَیۡتُ رَبِّیۡ عَذَابَ یَوۡمٍ عَظِیۡمٍ
অর্থঃ আপনি বলুন, আমি আমার প্রতিপালকের অবাধ্য হতে ভয় পাই কেননা, আমি একটি মহাদিবসের শাস্তিকে ভয় করি।
[সূরা আল আনআম (الانعام), আয়াত: ১৫][6]
আল-কুরআন ও হাদিস হিসেবে বিবেচিত এই আয়াত দিয়ে। কারণ, হাদিস অর্থ: বর্ননা
وَاَمَّا بِنِعۡمَۃِ رَبِّکَ فَحَدِّثۡ ٪
অর্থঃ এবং আপনার পালনকর্তার অনুগ্রহের প্রকাশ করুন।
[সূরা আদ-দুহা (الضحى), আয়াত: ১১][7]
হাদিসকে ইসলামি সভ্যতার 'মেরুদন্ড' বলা হয়[8] এবং ইসলামে ধর্মীয় আইন ও নৈতিক দিকনির্দেশনার উৎস হিসাবে হাদিসের কর্তৃত্ব কুরআনের পরেই দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে।[9] মুসলিমরা বিশ্বাস করে যে, হাদিসের শাস্ত্রীয় কর্তৃত্ব এসেছে মূলত কুরআন থেকে। কারণ কুরআনে মুসলিমদের মুহাম্মদ সা.–কে অনুকরণ করতে ও তার রায় মেনে চলতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে (যেমন ২৪:৫৪, ৩৩:২১ নং আয়াতে )। এ জন্যই মুসলমানরা হাদিসকে ইসলামি আইনশাস্ত্রের চারটি উৎসের একটি মনে করে ( অপর তিনটি হল: কুরআন, ইজমা ও কিয়াস)।[10]
কুরআনে ইসলামি আইন সম্পর্কিত আয়াতের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম। হাদিসে ধর্মীয় বাধ্যবাধকতার বিবরণ (যেমন: গোসল বা অজু )[11] থেকে শুরু করে সালাতের সঠিক ধরন ও দাসদের প্রতি দানশীলতার গুরুত্ব পর্যন্ত সব কিছুরই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।[12][13] এভাবে শরীয়তের (ইসলামি আইন) নিয়মের "বৃহৎ অংশ" কুরআনের সাথে সাথে হাদিস থেকে নেওয়া হয়েছে।[14][টীকা 1]
হাদিস মূলত আরবি শব্দ, যার অর্থ বক্তৃতা, প্রতিবেদন, হিসাব, বর্ণনা ইত্যাদি।[16][17]:৪৭১ পবিত্র কুরআনের বিপরীতে সমস্ত মুসলমান বিশ্বাস করেন না যে, হাদিস (বা অন্তত সব হাদিস নয়) ঐশ্বরিক উদ্ঘাটন।[18] বরং কিছু মুসলিম বিশ্বাস করে, ইসলামি নির্দেশনা শুধুমাত্র কুরআনের উপর ভিত্তি করে হওয়া উচিত এবং এভাবে তারা হাদিসের কর্তৃত্ব প্রত্যাখ্যান করেন। অনেকে দাবি করেন যে, বেশিরভাগ হাদিসই বানোয়াট,[19] যা ৮ম ও ৯ম শতাব্দীতে তৈরি করা হয়েছে এবং এগুলোর জন্য মুহাম্মাদ সা.-কে মিথ্যাভাবে দায়ী করা হয়েছে।[20][21][19] তবে তাদের এই ধারণা ও বিশ্বাস বৃহত্তর ইসলামি সমাজে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে এবং হাদিসের প্রামাণ্যতা বিষয়ে যুগে যুগে শতাধিক গ্রন্থ রচনা করা হয়েছে।[10]
কিছু হাদিসে সন্দেহজনক ও এমনকি পরস্পরবিরোধী বক্তব্যও অন্তর্ভুক্ত থাকার জন্যে হাদিসের প্রমাণীকরণ ইসলামে অধ্যয়নের একটি প্রধান ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে।[22] শাস্ত্রীয় আকারে একটি হাদীসের দুটি অংশ আছে: সনদ ( বা বর্ণনাকারীদের শৃঙ্খল, যারা হাদিস বর্ণনা করেছেন) মতন ( হাদিসের মূল পাঠ)।[23][24][24] [25][26] স্বতন্ত্র হাদিসকে মুসলিম ধর্মগুরু ও আইনবিদগণ "সহিহ" (প্রমাণিক), "হাসান" ( মধ্যম মানসম্পন্ন) এবং "জয়িফের" (দুর্বল) মতো শ্রেণীতে শ্রেণীবদ্ধ করেছেন।[27] যাহোক, ভিন্ন দল ও ভিন্ন আলেম একটি হাদিসকে ভিন্নভাবে শ্রেণীবদ্ধ করতে পারেন।
সুন্নি ইসলামের পণ্ডিতদের মধ্যে হাদিস শব্দটি শুধুমাত্র মুহাম্মদের কথা, উপদেশ, অনুশীলন ইত্যাদিই নয়; এটি তাঁর সাহাবীদের কথা, উপদেশ ও অনুশীলন অন্তর্ভুক্ত করে।[28][29] শিয়া ইসলামে হাদিস হলো, সুন্নাহের মূর্ত প্রতীক, যা মুহাম্মাদ সা. ও তার পরিবার আহল আল-বাইতের (বারো ইমাম ও মুহাম্মদের সা. কন্যা ফাতিমা) কথা, কাজ ও অনুশীলন।[30]
হাদীস সংকলনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
সাহাবীগণ ইসলামের সর্বশেষ নবীর কথা ও কাজের বিবরণ অত্যন্ত আগ্রহ সহকারে স্মরণ রাখতেন। আবার কেউ কেউ তার অনুমতি সাপেক্ষে কিছু কিছু হাদীস লিখে রাখতেন। এভাবে তার জীবদ্দশায় স্মৃতিপটে মুখস্থ করে রাখার সাথে সাথে কিছু হাদীস লিখিত আকারে লিপিবদ্ধ ছিল। হযরত আলী, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস, হযরত আনাস ইবনে মালিক প্রমুখ সাহাবীগণ কিছু কিছু হাদীস লিপিবদ্ধ করে রাখতেন। হযরত আবূ হুরায়রা বলেন “আবদুল্লাহ ইবনে আমর ব্যতীত আর কোন সাহাবী আমার অপেক্ষা অধিক হাদীস জানতেন না। কারণ, তিনি হাদীস লিখে রাখতেন আর আমি লিখতাম না।”
নবীর জীবদ্দশায় ইসলামী রাষ্ট্রের প্রশাসনিক বহু কাজকর্ম লিখিতভাবে সম্পাদনা করা হতো। বিভিন্ন এলাকার শাসনকর্তা, সরকারী কর্মচারী এবং জনসাধারনের জন্য বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বিষয়ে লিখিত নির্দেশ প্রদান করা হতো। তাছাড়া রোম, পারস্য প্রভৃতি প্রতিবেশী দেশসমূহের সম্রাটদের সাথে পত্র বিনিময়, ইসলামের দাওয়াত এবং বিভিন্ন গোত্র ও সম্প্রদায়ের সাথে চুক্তি ও সন্ধি লিখিতভাবে সম্পাদন করা হতো। আর ইসলামের নবীর আদেশক্রমে যা লেখা হতো তাও হাদীসের অন্তর্ভুক্ত। ইসলামের নবীর মৃত্যুর পর বিভিন্ন কারণে হাদীস সংকলনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। কুরআন মাজীদের সাথে হাদীস সংমিশ্রণ হওয়ার আশংকায় কুরআন পুর্ণ গ্রন্থাকারে লিপিবদ্ধ না হওয়া পর্যন্ত হাদীস লিপিবদ্ধ করতে কেউ সাহস পায়নি। আবূ বকরের আমলে কুরআন মাজীদ গ্রন্থাকারে লিপিবদ্ধ হলে সাহাবীগণ হাদীস লিপিবদ্ধ করার ব্যাপারে আর কোন বাধা আছে বলে অনুভব করেননি। হিজরী প্রথম শতাব্দীর শেষভাগে সাহাবি ও তাবেয়ীগণ প্রয়োজন অনুসারে কিছু হাদীস লিপিবদ্ধ করেন।
অতঃপর উমাইয়া খলিফা উমর ইবনে আব্দুল আযীয হাদীস সংগ্রহের জন্য মদীনার শাসনকর্তা আবু বকর বিন হাজম সহ মুসলিমবিশ্বের বিভিন্ন এলাকার শাসনকর্তা ও আলিমগণের কাছে একটি ফরমান জারী করেন যে, আপনারা মহানবী হাদীসসমূহ সংগ্রহ করুন। কিন্তু সাবধান! মহানবী এর হাদীস ব্যতীত অন্য কিছু গ্রহণ করবেননা। আর আপনার নিজ নিজ এলাকায় মজলিস প্রতিষ্ঠা করে আনুষ্ঠানিকভাবে হাদীস শিক্ষা দিতে থাকুন। কেননা, জ্ঞান গোপন থাকলে তা একদিন বিলুপ্ত হয়ে যায়। এই আদেশ জারীর পর মক্কা, মদীনা, সিরিয়া, ইরাক এবং অন্যান্য অঞ্চলে হাদীস সংকলনের কাজ শুরু হয়। কথিত আছে যে, প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ইমাম ইবনে শিহাব আল-জুহরি সর্বপ্রথম হাদীস সংগ্রহ এবং সংকলনে হাত দেন। কিন্তু তার সংকলিত হাদীসগ্রন্থের সন্ধান পাওয়া যায়নি। এরপর ইমাম ইবনে জুরাইজ মক্কায়, ইমাম মালিক মদীনায়, আবদুল্লাহ ইবনে আব্দুল ওয়াহহাব মিসরে, আব্দুর রাজ্জাক ইয়েমেনে, আবদুল্লাহ ইবনে মুবারক খুরাসানে, এবং সূফিয়ান সাওরী ও হাম্মাদ ইবনে সালমা বসরায় হাদীস সংকলনে আত্ননিয়োগ করেন। এ যুগের ইমামগণ কেবল দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োজনীয় হাদীসগুলো ও স্থানীয় হাদীস শিক্ষাকেন্দ্রে প্রাপ্ত হাদীসসমূহ লিপিবদ্ধ করেছিলেন। তাদের কেউই বিষয়বস্তু হিসেবে বিন্যাস করে হাদীসসমূহ লিপিবদ্ধ করেননি।
এ যুগে লিখিত হাদীস গ্রন্থসমূহের মধ্যে ইমাম মালিকের “মুয়াত্তা” সর্বপ্রথম ও সর্বপ্রধান প্রামান্য হাদীসগ্রন্থ। ইমাম মালিকের “মুয়াত্তা” গ্রন্থটি হাদীস সংকলনের ব্যাপারে বিপুল-উৎসাহ উদ্দিপনার সৃষ্টি করেছিল। এটি হাদীসশাস্ত্র অধ্যায়নে মুসলিম মণিষীদের প্রধান আর্কষণে পরিণত হয়েছিল। এরই ফলশ্রূতিতে তৎকালীন মুসলিম বিশ্বে সর্বত্র হাদীস চর্চার কেন্দ্র কিতাবুল “উম্ম” এবং ইমাম আহমাদ বিন হাম্বলের “মাসনাদ” গ্রন্থদ্বয় হাদীসের উপর গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত। অতঃপর হিজরী তৃতীয় শতাব্দীতে অনেক মুসলিম মণিষী বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে প্রচুর হাদীস সংগ্রহ করেন। তন্মধ্যে বিখ্যাত হলেন ইমাম বুখারী, ইমাম মুসলিম, ইমাম আবূ দাউদ, ইমাম তিরমিজী, ইমাম নাসাঈ, এবং ইমাম ইবনে মাজাহ। এদের সংকলিত হাদীস গ্রন্থগুলো হলো সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম, সুনানে আবূ দাউদ, সুনান আত-তিরমিজী, সুনানে নাসাই এবং সুনানে ইবনে মাজাহ। এই ছয়খানা হাদীসগ্রন্থকে সন্মিলিতভাবে সিহাহ সিত্তাহ বা ছয়টি বিশুদ্ধ হাদীসগ্রন্থ বলা হয়। আব্বাসিয় যুগে হাদীস লিপিবদ্ধের কাজ পরিসমাপ্ত হয়।[31]
বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে হাদিস সংকলন
কুরআনিক দৃষ্টিভঙ্গিতে, ধারাবাহিকভাবে হাদিস সংকলন বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে উম্মাহ এর অবস্থা ও প্রয়োজনের দিক বিবেচনায়, প্রথমে সাহাবা ও পরবর্তীতে তাবেয়ী, তাবেঈ তাবেঈনসহ সারা উম্মাহ এর সাথে সম্পর্কযুক্ত। আল্লাহ তাআলা কুরআনে উল্লেখ করেন,
মুহাজির ও আনসারদের মধ্য হতে প্রথম ও অগ্রগামীরা, আর যারা তাদেরকে সততার সাথে অনুসরণ করেছে, আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন, আর তারাও তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট, তাদের জন্য তিনি প্রস্তুত করে রেখেছেন জান্নাত যার তলদেশে ঝর্ণাধারা প্রবাহিত, সেখানে তারা চিরকাল থাকবে। এটাই হল মহান সফলতা।
[সূরা আত-তাওবাহ্; আয়াত -১০০][32]
وَمَاۤ اَرۡسَلۡنٰکَ اِلَّا کَآفَّۃً لِّلنَّاسِ بَشِیۡرًا وَّنَذِیۡرًا وَّلٰکِنَّ اَکۡثَرَ النَّاسِ لَا یَعۡلَمُوۡنَ
"এবং কি[33], আমরা তো আপনাকে সমগ্ৰ মানবজাতির জন্যে সুসংবাদ দাতারূপে ও সতর্ককারী রূপে পাঠিয়নি? কিন্তু অধিকাংশ নির্দিষ্ট মানুষ তা জানে না।" [সূরা সাবা, আয়াত-২৮]
(সাহাবা) আবদুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, আমার উম্মাতের সর্বোত্তম মানুষ আমার যুগের মানুষ (সাহাবীগণ)। অতঃপর তৎপরবর্তী যুগ (তাবেঈন)। অতঃপর তৎপরবর্তী যুগ (তাবেঈ তাবেঈন)। অতঃপর এমন লোকদের আগমন হবে যাদের কেউ সাক্ষ্য দানের পূর্বে কসম এবং কসমের পূর্বে সাক্ষ্য দান করবে। ইব্রাহীম (নাখ্য়ী; রাবী) বলেন, ছোট বেলায় আমাদের মুরুব্বীগণ আল্লাহ্র নামে কসম করে সাক্ষ্য প্রদানের জন্য এবং ওয়াদা-অঙ্গীকার করার কারণে আমাদেরকে মারধর করতেন। [সহিহ বুখারী, হাদিস নং ৩৬৫১, হাদিসের মান; সহিহ হাদিস] [35]
তবে এহ্মেত্রে, মুসলিম জাতি বিষয়ভেদে প্রথমে তাদের মধ্যকার কর্তৃস্থানীয় ব্যক্তিগণের সিদ্ধান্ত, রায়, ভাল কাজের আদেশের অনুসরণ করে, যা সাধারণত তাদের বর্ননা, বইয়ের উপর নির্ভর করে করা হয়।
অনুসারীদের মধ্যে প্রথম পর্যায়ে সাহাবা, দ্বিতীয়ত তাবেঈন, তৃতীয়ত তাবেঈ তাবেঈন, চতুর্থ পর্যায়ে আলিম, আল্লামা, খলিফা, ইমাম, গ্রান্ড ইমাম, মুজতাহিদ, মুহাদ্দিস, মুয়াযযিন, গাজী, আমিরকে সাধারণত শুরু থেকেই ইসলামে কতৃস্থানীয় ব্যক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
- ওহে যারা ঈমান এনেছ; তোমরা আল্লাহর অনুগত কর এবং রসূলের অনুগত কর এবং অধিকারীর নির্দিষ্ট নির্দেশের[36]
অনুসারীদের থেকে[37]; যদি অতঃপর কোন বিষয়ে তোমাদের মধ্যে মতভেদ ঘটে, তবে তা প্রত্যার্পণ কর আল্লাহ এবং রসূলের প্রতি। এটা উওম ও প্রকৃষ্টতর,পরিণতিতে। [সূরা আন-নিসা, আয়াত ৫৯][38]
আল্লামা সাখাবি বলেন-
আভিধানিক অর্থে হাদিস শব্দটি কাদিম তথা অবিনশ্বরের বিপরীত আর পরিভাষায় বলা হয় রাসূলুাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দিকে সম্বন্ধযুক্ত। চাই তার বক্তব্য হোক বা কর্ম বা অনুমোদন অথবা গুণ এমন কী ঘুমন্ত অবস্থায় বা জাগ্রত অবস্থায় তাঁর গতি ও স্থির সবই হাদিস।
বুখারী শরিফের বিশিষ্ট ব্যাখ্যাগ্রন্থ عمدة القارى এর মধ্যে হাদিস সম্বন্ধে রয়েছে:
ইলমে হাদিস এমন বিশেষ জ্ঞান যার সাহায্যে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কথা, কাজ ও অবস্থা জানতে পারা যায়।
আর ফিক্হবিদদের নিকট হাদিস হলো আল্লাহর রাসূলের কথা ও কাজসমূহ। মুফতি সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ আমীমুল ইহসান বারকাতী এর মতে, হাদিস (حديث) এমন একটি বিষয় যা রাসূলুাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বাণী, কর্ম ও নীরবতা এবং সাহাবায়ে কেরাম, তাবিঈনদের কথা, কর্ম ও মৌন সম্মতিকে বুঝায়।[39]:
ইসলামে হাদিস সংরক্ষণ ও বর্ণনা ও প্রধান যাচাই-বাছাই পদ্ধতিসমূহ
ইসলামে হাদিস সংরক্ষণ মূলত বর্ননা ইসনাদ ও মতন এর সাথে সম্পর্কিত।
এখানে বর্ননা বা ইসনাদ মূলত এক দল কেন্দ্রিক (যারা সত্য পথ দেখায়), যারা ন্যায়বিচার এর মাধ্যমে যাচাই বাছাই (তাহকীক)[40] কেন্দ্রিক [41]সত্য প্রতিষ্ঠা করে অন্যান্যদের কাছে।
وَمِمَّنۡ خَلَقۡنَاۤ اُمَّۃٌ یَّہۡدُوۡنَ بِالۡحَقِّ وَبِہٖ یَعۡدِلُوۡنَ ٪
অর্থঃ এবং তাদের থেকে[42] আমরা সৃষ্টি করেছি, এক দল, যারা সত্য পথ দেখায় এবং সে অনুযায়ী ন্যায়বিচার করে। [সূরা আল আরাফ, আয়াত: ১৮১][43]
এই দল এর ক্রমধারা সাহাবাদের থেকে শুরু হয়ে হাদিস সংরহ্মণ হচ্ছে, এই দল এর বৈশিষ্ট্য হলো, তারা সত্য পথ দেখায় এবং সে অনুযায়ী ন্যায়চিার করে।
এই দল এর মাধ্যমেই ইসলাম প্রত্যেক প্রজন্মে এসেছে ও বিস্তার ঘটে, হাদিস সংরক্ষিত ও প্রচার হচ্ছে ।[44]
"তিনিই নিরক্ষরদের মাঝে পাঠিয়েছেন তাঁর রসূলকে তাদেরই মধ্য হতে, যে তাদের নিকট আল্লাহর আয়াত আবৃত্তি করে, তাদেরকে পবিত্র করে ও তাদেরকে শিক্ষা দেয় নিদিষ্ট কিতাব এবং নির্দিষ্ট প্রঙ্গা। যদিও ইতোপূর্বে তারা ছিল অবশ্যই সুস্পষ্ট বিভ্রান্তির মধ্যে।[45]
وَّاٰخَرِیۡنَ مِنۡہُمۡ لَمَّا[46] یَلۡحَقُوۡا[47] بِہِمۡ ؕ [48]وَہُوَ الۡعَزِیۡزُ الۡحَکِیۡمُ
অর্থঃ এবং অন্যান্যরা থেকে তাদের, কেন ধরা ভিতর তাদের? তিনি নির্দিষ্ট পরাক্রমশালী, নির্দিষ্ট প্রজ্ঞাময়।
[সূরা আল-জুমুআ (الجمعة), আয়াত: ৩][49]
ফিকহ থেকে, কেন ধরা তাদের ভিতর? "لَمَّا یَلۡحَقُوۡا بِہِمۡ ؕ", এর কিছু গ্রহণযোগ্য উত্তর।
১. মুসলিম জাতির নির্দিষ্ট ক্রমধারা তাদের ভিতর থেকে বাস্তবায়ন করতে।
২. মুসলিম জাতির প্রথম স্থরের বংশধারা তাদের ভিতর থেকে বাস্তবায়ন করতে।
৩. "তাদের ভিতর" এই বাক্যাংশটি অনেক ক্ষেত্রেই অন্য প্রসঙ্গ বোঝাতে পারে, যেমন কোনো গোষ্ঠীর মধ্যে একজন ব্যক্তি বা বিষয়ের অবস্থান।
৪. তাদের উত্তম নমুনা তাদের ভিতর থেকে প্রবাহিত করতে।
[50] ৫. নবী খলিফা থেকে খলিফার ধারা অব্যবহ্ত রাখতে, পরবর্তীতে তাদের স্বরূপ থেকে খলিফা প্রনয়ণ করতে তাদের প্যাটার্ন দ্বারা।[51]
আল-হাদিসের পরবর্তী যাচাই-বাছাই পদ্ধতিসমূহ।
আল্লাহ পবিত্র আল-কুরআনে বলেছেন,
تَبٰرَکَ الَّذِیۡ نَزَّلَ الۡفُرۡقَانَ عَلٰی عَبۡدِہٖ لِیَکُوۡنَ لِلۡعٰلَمِیۡنَ نَذِیۡرَا ۙ
অর্থঃ পরম কল্যাণময় তিনি যিনি তাঁর বান্দার প্রতি অবর্তীণ করেছেন নির্দিষ্ট নির্ণায়ক, যাতে সে বিশ্বজগতের জন্যে সতর্ককারী হয়,।
[সূরা আল ফুরকান (الفرقان), আয়াত: ১][52]
১. নির্দিষ্ট বাস্তবতার সম্বনয়ে যাচাই-বাছাই।
আল্লাহ বলেছেন,
مَا الۡحَآقَّۃُ ۚ
অর্থঃ নির্দিষ্ট অনস্বীকার্য বাস্তবতা কি?
وَمَاۤ اَدۡرٰىکَ مَا الۡحَآقَّۃُ ؕ
অর্থঃ এবং কি আপনাকে জানাবে, নির্দিষ্ট অনস্বীকার্য বাস্তবতা কি?
[সূরা আল-হাক্কাহ (الحآقّة), আয়াত: ২ এবং ৩][53][54]
২. নির্দিষ্ট বাস্তবতা নির্ভরশীল, আলাদা নির্দিষ্ট নির্ণায়কে বিচার-বুদ্ধি প্রয়োগ সাপেক্ষে যাচাই-বাছাই।
আল্লাহ বলেছেন,
وَقَالُوۡا لَوۡ کُنَّا نَسۡمَعُ اَوۡ نَعۡقِلُ مَا کُنَّا فِیۡۤ اَصۡحٰبِ السَّعِیۡرِ
অর্থঃ তারা আরও বলবেঃ যদি আমরা শুনতাম অথবা বুদ্ধি খাটাতাম, তবে আমরা আগুনের সঙ্গী হতাম না।
[সূরা আল-মুলক (الملك), আয়াত: ১০][55]
হাদীসে বলা হয়েছে,
আল্লাহ পাক সেই ব্যক্তিকে সতেজ, ও সমুজ্জ্বল রাখুন, যে আমার কথাগুলো শুনেছে, সংরক্ষণ করেছে এবং অপরজনের নিকট তা পৌঁছে দিয়েছে। (আবু দাউদ)[হাদিস নম্বর প্রয়োজন]
বলা হয়, যে ব্যক্তি মূলত অর্থেই হাদিস সন্ধানী হয় তার চেহারা সজীব বা নুরানি হয়ে ফুটে ওঠবে। অন্য হাদিসে বলা হয়েছে,
হে আল্লাহ, আমার উত্তরসূরিদের প্রতি রহম করুন। সাহাবিগণ জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া রাসূলুাল্লাহ! আপনার উত্তরসূরি কারা? তিনি বলেন, তারাই যারা আমার হাদিস বর্ণনা করে ও মানুষের নিকট শিক্ষা দেয়।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]
হাদিসে বলা হয়েছে,
“নিশ্চয়ই কিয়ামতের দিন তারাই আমার নিকটবর্তী হবে যারা অধিক হারে আমার প্রতি দরূদ ও সালাম পেশ করে।” (তিরমিজি)
এই হাদিসটি ইবনে হিব্বান তার হাদিসের গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেছেন এবং বলেছেন এই হাদিস এর ফায়েজ ও বরকত লাভ করবে নিশ্চিতভাবে মুহাদ্দিসানে কেরাম ও হাদিসের শায়খগণ। কারণ তারাই অধিক হারে হাদিস পড়ে, লিখে। যতবার হাদিস লিখবে বা পড়বে ততবার তিনি প্রিয়নবীর প্রতি দরূদ সালাম পড়বেন ও লিখবেন। এর ফলে রোজ কিয়ামতে সহজেই তারা প্রিয়নবীর নিকটবর্তী হতে পারবেন। [56]:
কিতাবুস সিত্তাহ
কিতাব কথাটি কিতাব كتاب থেকে আগত, যার অর্থ বই। আর আল-সিত্তাহ السته হচ্ছে ৬টি। ইসলামী পরিভাষায় হাদিসের ছয়খানা অন্যতম হাদিসগ্রন্থকে একত্রে কিতাবুস সিত্তাহ বলে।
ক্রমিক নং | গ্রন্থের নাম | সংকলকের নাম | জন্ম | ওফাত | জীবন কাল | হাদিস সংখ্যা |
১ | সহীহ বুখারী | মুহাম্মদ ইবনে ইসমাঈল ইবনে ইবরাহিম ইবনে মুগিরা | ১৯৪ হিজরি ১৩ শাওয়াল,৮২০ খ্রিষ্টাব্দের ২১ জুলাই | ২৫৬ হিজরি | ৬২ বছর | ৭৩৯৭টি |
২ | সহীহ মুসলিম | মুসলিম ইবনে হাজ্জাজ আল কুশায়রি আল নিশাপুরী | ২০৪ হিজরিতে নিশাপুরে | ২৬১ হিজরি | ৫৭ বছর | ৪০০০টি |
৩ | জামি' আত তিরমিজি | আবু ঈসা মুহাম্মদ ইবনে ঈসা আত-তিরমিজি | ২০৯ হিজরিতে খোরাসানের তিরমিজ শহরে | ২৭৯ হিজরি | ৭০ বছর | ৩৮১২টি |
৪ | সুনানে আবু দাউদ | আবু দাউদ সুলায়মান ইবনে আশআশ ইবনে ইসহাক | ২০২ হিজরিতে সিস্তান নামক স্থানে | ২৭৫ হিজরি | ৭৩ বছর | ৪৮০০টি |
৫ | সুনানে নাসাই | ইমাম আবু আবদুর রহমান আহমদ ইবনে শুআইব ইবনে আলি আল খোরাসানি আন-নাসাই | ২১৫ হিজরি নাসা শহরে | ৩০৩ হিজরি | ৮৮ বছর | ৫৭৬১ টি |
৬ | সুনানে ইবনে মাজাহ | আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে ইয়াজিদ ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে মাযাহ আল কাজবিনি | ২১৭ হিজরিতে কাসবিন শহরে | ২৭৩ হিজরি | ৬৪ বছর | ৪৩৪৯টি |
হাদিস গ্রন্থের তালিকা
১. মুয়াত্তা মালিক
২. মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবাহ
৩. মুয়াত্তা মুহাম্মাদ
৪. কিতাবুল আছার
৫. মুসনাদু আবী হানীফা
৬. ত্বহাবী শরীফ
৭. বুখারী
৮. মুসলিম
৯. তিরমিজি
১০. আবূদাউদ
১১. নাসাঈ
১২ ইবনু মাজাহ
১৩. সহীহ ইবনু হিব্বান
১৪. সহীহ ইবনু খুজাইমাহ
১৫. সুনানু বায়হাক্বী
সর্বোচ্চ হাদিস বর্ণনাকারী কয়েকজন সাহাবী
ক্রমিক নং | সাহাবীর নাম | ওফাত | জীবন কাল | বর্ণিত হাদিসের সংখ্যা |
১ | হযরত আবু হুরাইরাহ (রা.) (প্রকৃত নামঃ আবদুর রহমান) | ৫৭ হিজরি | ৭৮ বছর | ৫৩৭৪ টি |
২ | উম্মুল মুমিনিন হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) | ৫৮ হিজরি | ৬৭ বছর | ২২১০টি |
৩ | হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) | ৬৮ হিজরি | ৭১ বছর | ১৬৬০টি |
৪ | হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) | ৭০ হিজরি | ৮৪ বছর | ১৬৩০টি |
৫ | হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) | ৭৪ হিজরি | ৯৪ বছর | ১৫৪০টি |
হাদিস শাস্ত্রের কতিপয় পরিভাষা
সাহাবী (صحابى)
যেসব ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে ইসলামের নবীর সাহচর্য লাভ করেছেন বা তাকে দেখেছেন ও তার একটি হাদিস বর্ণনা করেছেন, অথবা জীবনে একবার তাকে দেখেছেন এবং ঈমানের সঙ্গে মৃত্যুবরণ করেছেন তাদেরকে সাহাবী বলা হয়।
তাবিঈ (تابعى)
যারা ইসলামের নবীর কোনো সাহাবীর নিকট হাদীস শিক্ষা করেছেন অথবা তাকে দেখেছেন এবং মুসলমান হিসাবে মৃত্যুবরণ করেছেন তাদেরকে তাবিঈ বলা হয়।
মুহাদ্দিস (محدث)
যে ব্যক্তি হাদিস চর্চা করেন এবং বহুসংখ্যক হাদিসের সনদ ও মতন সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞান রাখেন তাকে মুহাদ্দিস বলা হয়। [টীকা 2]
শায়খুল হাদিস
হাদিস শাস্ত্রে গভীর পাণ্ডিত্যের অধিকারী, দীর্ঘ দিন হাদিসের পঠন ও পাঠনে নিরত শায়খকে ‘শায়খুল হাদিস’ বলা হয়। ভারত উপমহাদেশে সহীহ বুখারি পাঠদানকারীকে ‘শায়খুল হাদিস’ বলা হয়।[57]
শায়খ (شيخ)
হাদিসের শিক্ষাদাতা রাবীকে (বর্ণনাকারীকে) শায়খ বলা হয়।
শাইখাইন (شيخين)
সাহাবীগণের মধ্যে আবু বকর ও উমরকে একত্রে শায়খায়ন বলা হয়। কিন্তু হাদিসশাস্ত্রে ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিমকে এবং ফিক্হ-এর পরিভাষায় ইমাম আবু হানিফা ও আবু ইউসুফকে একত্রে শায়খায়ন বলা হয়।
হাফিজ (حافظ)
যিনি সনদ ও মতনের বৃত্তান্ত সহ এক লক্ষ হাদিস আয়ত্ত করেছেন তাকে হাফিজ বলা হয়।
হুজ্জাত (حجة)
যিনি তিন লক্ষ হাদিস আয়ত্ত করেছেন তাকে হুজ্জাত বলা হয়।
হাকিম (حاكم)
যিনি সব হাদিস আয়ত্ত করেছেন তাকে হাকিম বলা হয়।
রিজাল (رجال)
হাদিসের রাবি সমষ্টিকে রিজাল বলে। যে শাস্ত্রে রাবি বা বর্ণনাকারীদের জীবনী বর্ণনা করা হয়েছে তাকে আসমাউর-রিজাল (اسماء الرجال) বলা হয়।
রিওয়ায়ত (رواية)
হাদিস বর্ণনা করাকে রিওয়ায়ত বলে। কখনও কখনও মূল হাদিসকেও রিওয়ায়ত বলা হয়। যেমন, এই কথার সমর্থনে একটি রিওয়ায়ত (হাদিস) আছে।
সনদ (سند)
হাদিসের মূল কথাটুকু যে সূত্র পরম্পরায় গ্রন্থ সংকলনকারী পর্যন্ত পৌঁছেছে তাকে সনদ বলা হয়। এতে হাদিস বর্ণনাকারীদের নাম একের পর এক সজ্জিত থাকে।
মতন (متن)
হাদিসের মূল কথা ও তার শব্দ সমষ্টিকে মতন বলে।
মরফু’ (مرفوع)
যে হাদিসের সনদ (বর্ণনা পরম্পরা) ইসলামের নবী হযরত মুহাম্মদ (ﷺ) পর্যন্ত পৌঁছেছে, তাকে মরফু’ হাদিস বলে।
মাওকুফ (موقوف)
যে হাদিসের বর্ণনা-সূত্র ঊর্ধ্ব দিকে সাহাবী পর্যন্ত পৌঁছেছে, অর্থাৎ যে সনদ-সূত্রে কোনো সাহাবীর কথা বা কাজ বা অনুমোদন বর্ণিত হয়েছে তাকে মাওকুফ হাদিস বলে। এর অপর নাম আসার (اثار) ।
মাকতু (مقطوع)
যে হাদিসের সনদ কোনো তাবিঈ পর্যন্ত পৌঁছেছে, তাকে মাকতু’ হাদিস বলা হয়।
মুত্তাফাকুন আলাইহি (متفق عليه)
যে হাদিসের বিশুদ্ধতার ব্যাপারে ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম উভয়ই একমত এবং তারা উক্ত হাদিস লিপিবদ্ধ করেছেন তাই মুত্তাফাকুন আলাইহি হাদিস।
সহিহ (ﺻﺤﻴﺢ )
যে মুত্তাসিল হাদিসের সনদে উল্লেখিত অর্থাৎ (ইত্তেসালে সনদ, জাবত, আদালত, সাজ না হওয়া, দোষ মুক্ত হওয়া,) প্রত্যেক বর্ণনাকারীই পূর্ণ আদালত ও জাবতা-গুণসম্পন্ন এবং হাদিসটি যাবতীয় দোষত্রুটি মুক্ত তাকে সহিহ হাদিস বলে।
হাসান (حسن)
যে হাদিসের কোনো বর্ণনাকারীর জাবত (প্রখর স্মরণশক্তি)গুণে পরিপূর্ণতার অভাব রয়েছে তাকে হাসান হাদিস বলা হয়। ফিকহবিদগণ সাধারণত সহিহ ও হাসান হাদিসের ভিত্তিতে শরিয়তের বিধান নির্ধারণ করেন।
যয়িফ ( ﺿﻌﻴﻒ)
যে হাদিসের বর্ণনাকারী কোনো হাসান হাদিসের বর্ণনাকারীর গুণসম্পন্ন নন তাকে যয়িফ/য'ইফ/ জইফ হাদিস বলে।
মাওজু’ (موضوع)
যে হাদিসের বর্ণনাকারী জীবনে কখনও ইচ্ছাকৃতভাবে ইসলামের নবীর নামে মিথ্যা কথা রটনা করেছে বলে প্রমাণিত হয়েছে, তার বর্ণিত হাদিসকে মাওজু’ হাদিস বলে। এরূপ ব্যক্তির বর্ণিত হাদিস গ্রহণ করা হয় না।
কুদসি’ (حديث قديس)
যে সকল হাদিসকে ইসলামের নবী (হযরত মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আল্লাহর বানী বলে উল্লেখ করেছেন, যা কুরআনের অন্তর্ভুক্ত নয়, সেগুলোকে হাদিসে কুদসি বলা হয়।
সুন্নি দৃষ্টিভঙ্গি
হাদীসের প্রকারভেদ
মুহাদ্দিসগণের পরিভাষায় যে হাদীসের মধ্যে ৫টি শর্ত পূরণ হয়েছে তাকে সহীহ হাদীস বলা হয় -
- হাদীসের সকল বর্ণনাকারী সৎ ও বিশ্বস্ত
- বর্ণনাকারীদের নির্ভুল বর্ণনার ক্ষমতা পূর্ণরূপে বিদ্যমান
- প্রত্যেক বর্ণনাকারী তার ঊর্ধ্বতন বর্ণনাকারী থেকে হাদীসটি স্বকর্ণে শুনেছেন বলে প্রমাণিত
- অন্যান্য প্রামাণ্য বর্ণনার বিপরীত নয় বলে প্রমাণিত
- সনদগত বা অর্থগত কোনো সূক্ষ্ম ত্রুটি নেই বলে প্রমাণিত
দ্বিতীয় শর্তে সামান্য দুর্বলতা থাকলে হাদীসটি হাসান বলে গণ্য হতে পারে। শর্তগুলোর অবর্তমানে হাদীসটি যয়ীফ বা দুর্বল অথবা মাউযূ বা বানোয়াট হাদীস বলে গণ্য হতে পারে।[58] ইসলামে দুর্বল ও বানোয়াট হাদীস আকীদার ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য নয়।তবে সালাফে সালেহীনগণ (সাহাবী,তাবেয়ী,তাবে-তাবেয়ী) দূর্বল হাদিসের উপর আমল করেছেন প্রমাণ পাওয়া গেলে আমল করতে অসুবিধা নেই।
সহিহ হাদীসের প্রকারভেদ
বর্ণনাকারীদের সংখ্যার দিক থেকে মুহাদ্দিসগণ সহীহ বা বিশুদ্ধ হাদীসকে দুই ভাগে ভাগ করেছেন -
- যেসকল হাদীস সাহাবীগণের যুগ থেকে সংকলন পর্যন্ত সকল স্তরে অনেক বর্ণনাকারী বর্ণনা করেছেন তাকে মুতাওয়াতির বা অতি প্রসিদ্ধ হাদীস বলা হয়।
- যেসকল হাদীস সাহাবীগণের যুগ থেকে সংকলন পর্যন্ত কোনো যুগে অল্প কয়েকজন বর্ণনাকারী বর্ণনা করেছেন তাকে আহাদ বা খাবারুল ওয়াহিদ হাদীস বলা হয়।
আকীদার ক্ষেত্রের মুতাওয়াতির বা অতি প্রসিদ্ধ হাদীস দ্বারা সুনিশ্চিত জ্ঞান লাভ করা যায়। অন্যদিকে খাবারুল ওয়াহিদ হাদীস দ্বারা সুনিশ্চিত জ্ঞান লাভ করা না গেলেও তা কার্যকর ধারণা প্রদান করে। কর্ম বিষয়ক বৈধ, অবৈধ ইত্যাদি বিধিবিধানের ক্ষেত্রে এই ধরনের হাদীসের উপরে নির্ভর করা হয়। আকীদার মূল বিষয় প্রমাণের জন্য সাধারণত এরূপ হাদীসের উপর নির্ভর করা হয় না। তবে মূল বিষয়ের ব্যাখ্যায় এর উপর নির্ভর করা হয়।
কুরআনে উল্লেখিত বা মুতাওয়াতির হাদীসের মাধ্যমে জানা কোনো বিষয় অস্বীকার করলে তা কুফরী হিসেবে গণ্য হয়। আর খাবারুল ওয়াহিদের মাধ্যমে জানা বিষয় অস্বীকার করলে তা বিভ্রান্তি হিসেবে গণ্য হয়। মুসলিমরা বিশ্বাস করে কুরআন পুরোপুরিই মুতাওয়াতির ভাবে বর্ণিত। কেউ একটি শব্দকেও সমার্থক কোনো শব্দ দিয়ে পরিবর্তন করেন নি। অন্যদিকে হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে সাহাবী তাবিয়ীগণ অর্থের দিকে বেশি লক্ষ্য রাখতেন। তারা প্রয়োজনে একটি শব্দের পরিবর্তে সমার্থক অন্য শব্দ ব্যবহার করতেন।[58]
বিশুদ্ধ হাদীসের উৎস
অল্প সংখ্যক মুহাদ্দিস কেবলমাত্র সহীহ হাদীস সংকলনের চেষ্টা করেন। অধিকাংশ মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও আলিম সনদসহ হাদীস উল্লেখ করলেও হাদীসটি কোন স্তরের তা বলার প্রয়োজন মনে করতেন না।
আল্লামা ইবনুস সালাহ বলেন -
বুখারী ও মুসলিম গ্রন্থের বাইরে সহীহ হাদীস খুঁজতে হবে মাশহুর হাদীসের গ্রন্থগুলোতে, যেমন - আবূ দাঊদ, তিরমিযী, নাসাঈ, ইবনু খুযাইমা, দারাকুতনী ও অন্যান্যদের সংকলিত গ্রন্থ। তবে এ সকল গ্রন্থে যদি কোনো হাদীস উদ্ধৃত করে তাকে সুস্পষ্টত 'সহীহ' বলে উল্লেখ করা হয় তবেই তা সহীহ বলে গণ্য হবে, শুধুমাত্র এ সকল গ্রন্থে হাদীসটি উল্লেখ করা হয়েছে বলেই হাদীসটিকে সহীহ মনে করা যাবে না। কারণ এ সকল গ্রন্থে সহীহ এবং যয়ীফ সব রকমের হাদীসই রয়েছে।
আল্লামা ইবনু হাজার আসকালানী বলেন -
দ্বিতীয় হিজরী শতাব্দী থেকে শুরু করে পরবর্তী সকল যুগের অধিকাংশ মুহাদ্দিসের রীতি ছিল যে, সহীহ, যয়ীফ, মাউযূ, বাতিল সকল প্রকার হাদীস সনদসহ সংকলন করা। তাঁদের মূলনীতি ছিল যে, সনদ উল্লেখ করার অর্থই হাদীসটি বর্ণনার দায়ভায় বর্ণনাকারীদের উপর ছেড়ে দেয়া, সংকলকের আর কোনো দায় থাকে না।
শিয়া দৃষ্টিভঙ্গি
শিয়া দৃষ্টিভঙ্গিতে ছয়জন প্রসিদ্ধ হাদিস সংগ্রাহককে এতটা মূল্যায়ন করা হয় না। শিয়া মতানুসারে পাঁচজন প্রসিদ্ধ হাদিস সংগ্রাহক রয়েছেন। এদের মধ্যে প্রথম চারজন সবচেয়ে প্রসিদ্ধ :
- কিতাব আল-কাফী
- আল-ইস্তিবসার
- তহজীব আল-আহকাম
- মুন লা ইয়াহ্দুরুহু আল-ফাকিহ
- নাহ্জুল বালাগা
ইবাদি দৃষ্টিভঙ্গি
ইবাদি মত মূলত আরব রাষ্ট্র ওমানে প্রচলিত। এই মতে সুন্নিদের অনুসৃত কিছু হাদিস গ্রহণ করা হয়, আবার অনেকগুলোই গ্রহণ করা হয় না। হাদিস গ্রহণের ব্যাপারে তাদের নিজস্ব মত রয়েছে। সুন্নিরা বিপুল সংখ্যক হাদিস গ্রহণ করেছেন যা ইবাদিরা করেন নি। তাদের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ এবং একচেটিয়া হাদিস গ্রন্থ হচ্ছে :
- আল-জামি আল-সহিহ্[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ] - যার অপর নাম মুসনাদ আল-রাবি ইবন হাবিব। আবু ইয়াকুব ইউসুফ ইবন ইবরাহিম আল-ওয়ারিজলানি এই গ্রন্থ সংকলন করেছেন।
অমুসলিম দৃষ্টিভঙ্গি
ইসলামের প্রায় সকল হাদিস যখন সংকলন শেষ হয় তার পরপরই পাশ্চাত্য জগতের সাথে মুসলিমদের মূল বিরোধ এবং সংযোগ শুরু হয়। একদিকে যেমন ক্রুসেডের মাধ্যমে সম্পর্ক দিনে দিনে বিরূপ আকার ধারণ করছিল অন্যদিকে আবার তেমনই একে অপরকে বোঝার চেষ্টা করছিল। পাশ্চাত্যে প্রথমে কুরআনের অনুবাদ করা হয়। এর অনেক পরে কতিপয় চিন্তাবিদ হাদিস এবং ইসলামী আইনশাস্ত্রসহ অন্যান্য বিষয়ে আগ্রহী হয়ে উঠেন। বর্তমান কালের কয়েকজন বিখ্যাত অমুসলিম হাদিস বিশেষজ্ঞ হচ্ছেন :
- হার্বার্ট বার্গ, The Development of Exegesis in Early Islam (২০০০)
- ফ্রেড এম. ডোনার, Narratives of Islamic Origins (১৯৯৮)
- উইলফ্রেড মেডিলাং, Succession to Muhammad (১৯৯৭)
ইসলামি বিশ্বাস অনুসারে জাল হাদিসসমূহ প্রধানত যাদের কাজ
আল্লাহ পবিত্র আল-কুরআনে বলেছেন,
قَالَ رَبِّ بِمَاۤ اَغۡوَیۡتَنِیۡ لَاُزَیِّنَنَّ لَہُمۡ فِی الۡاَرۡضِ وَلَاُغۡوِیَنَّہُمۡ اَجۡمَعِیۡنَ ۙ
অর্থঃ সে বললঃ হে আমার পালনকর্তা, আপনি যেমন আমাকে পথ ভ্রষ্ট করেছেন, আমিও নির্দিষ্ট পৃথিবীর মধ্যে শোভিত করব এবং তাদের সবাইকে পথ ভ্রষ্ঠ করে দেব।
اِلَّا عِبَادَکَ مِنۡہُمُ الۡمُخۡلَصِیۡنَ
অর্থঃ ব্যতীত, আপনার বান্দারা, তাদের মধ্যে নির্দিষ্ট মনোণীতরা।
قَالَ ہٰذَا صِرَاطٌ عَلَیَّ مُسۡتَقِیۡمٌ
অর্থঃ আল্লাহ বললেনঃ এটা আমা পর্যন্ত সোজা পথ।
[সূরা আল হিজর (الحجر), আয়াত: ৩৯, ৪০ এবং ৪১][59][60]
قَالَ فَبِمَاۤ اَغۡوَیۡتَنِیۡ لَاَقۡعُدَنَّ لَہُمۡ صِرَاطَکَ الۡمُسۡتَقِیۡمَ ۙ
অর্থঃ সে বললঃ আপনি আমাকে যেমন উদভ্রান্ত করেছেন, আমিও অবশ্য তাদের জন্যে আপনার সরল পথে বসে থাকবো।
ثُمَّ لَاٰتِیَنَّہُمۡ مِّنۡۢ بَیۡنِ اَیۡدِیۡہِمۡ وَمِنۡ خَلۡفِہِمۡ وَعَنۡ اَیۡمَانِہِمۡ وَعَنۡ شَمَآئِلِہِمۡ ؕ وَلَا تَجِدُ اَکۡثَرَہُمۡ شٰکِرِیۡنَ
অর্থঃ এরপর তাদের কাছে আসব তাদের সামনের দিক থেকে, পেছন দিক থেকে, ডান দিক থেকে এবং বাম দিক থেকে। আপনি তাদের অধিকাংশকে কৃতজ্ঞ পাবেন না।
[সূরা আল আরাফ (الأعراف), আয়াত: ১৬ এবং ১৭][62][63]
এ আয়াত সমূহ থেকে, জানা যায়, নির্দিষ্ট মানুষকে প্রথভ্রষ্ট করে প্রথমে ইবলিশ।
আর তাদের মধ্যে রয়েছে, ইবলীস বাহিনীর লোক।
মূলত ইবলীস এবং তাদের দ্বারা জাল হাদিস সমূহ এসেছে।
ইবলিশ মানুষকে প্রথভ্রষ্ট করতে যাদের প্রযুক্তির সাহায্য নেয়,
তাদের সম্পর্কে আল্লাহ বলেছেন,
فَالزّٰجِرٰتِ زَجۡرًا ۙ
অর্থ: অতঃপর যারা চালনা করে,
[সূরা আস ছাফ্ফাত (الصّافات), আয়াত: ২][64]
এখানে, চালনার তাফসির, বানোয়াট স্মৃতি চালনা, জাহান্নামে নেওয়ার অনূভুতি চালনা ইত্যাদি।
আল্লাহ এ আয়াতের কারণে, মূলত ইবলীসকে নির্দিষ্ট ফেরেশতাদের প্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগ দিয়েছে।
قَالَ اخۡرُجۡ مِنۡہَا مَذۡءُوۡمًا مَّدۡحُوۡرًا ؕ لَمَنۡ تَبِعَکَ مِنۡہُمۡ لَاَمۡلَـَٔنَّ جَہَنَّمَ مِنۡکُمۡ اَجۡمَعِیۡنَ
অর্থঃ আল্লাহ বললেনঃ বের হয়ে যা এখান থেকে লাঞ্ছিত ও অপমানিত হয়ে। তাদের যে কেউ তোর পথে চলবে, নিশ্চয় আমি তোদের সবার দ্বারা জাহান্নাম পূর্ণ করে দিব।
[সূরা আল আরাফ (الأعراف), আয়াত: ১৮][65]
আরও দেখুন
তথ্যসূত্র
গ্রন্থপঞ্জি
বহিঃসংযোগ
Wikiwand in your browser!
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.