মিয়ানমার (বর্মী: မြန်မာ, [mjəmà][ক]) দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মূল এশীয় মহাদেশীয় ভূ-খণ্ডে অবস্থিত একটি প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র। এছাড়া এটি বাংলা ভাষায় ব্রহ্মদেশ, বর্মা বা বার্মা[খ] নামেও পরিচিত। দেশটি ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত বার্মা নামে পরিচিত ছিল। ১৯৮৯ সালের ১৯শে জুন সামরিক জান্তা সরকার দেশটির আনুষ্ঠানিক সরকারি নাম বদলে রাখে মিয়ানমার সংঘ প্রজাতন্ত্র (বর্মী: ပြည်ထောင်စု သမ္မတ မြန်မာနိုင်ငံတော်, [pjìdàuɴzṵ θàɴmədaa̰ mjəmà nàiɴŋàɴdɔ̀] মিয়ামা নাইঙান্ডো)। মিয়ানমার নামটি জাতিসংঘের স্বীকৃতি লাভ করলেও কিছু সরকার (বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়া) এই নামটি ব্যবহার করে না। মিয়ানমারের উত্তর ও উত্তর-পূর্ব সীমান্তে চীন, পূর্বে লাওস, দক্ষিণ-পূর্বে থাইল্যান্ড, উত্তর-পশ্চিমে বাংলাদেশ ও ভারত অবস্থিত। দক্ষিণ, পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিমে ভারত মহাসাগরের আন্দামান সাগর ও বঙ্গোপসাগরে দেশটির উপকূলীয় তটরেখা রয়েছে। মিয়ানমারের দক্ষিণভাগটি একটি দীর্ঘ সংকীর্ণ ভূখণ্ড যা মালয় উপদ্বীপ ধরে দক্ষিণে বিস্তৃত। তিনদিকে পর্বতবেষ্টিত ও বাকি দিকে সমুদ্রবেষ্টিত মিয়ানমার ভৌগোলিকভাবে খানিকটা বিচ্ছিন্ন একটি দেশ। ৬ লক্ষ ৭৬ হাজার ৫৫২ বর্গকিলোমিটার আয়তনবিশিষ্ট মিয়ানমার আয়তনের বিচারে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মূল মহাদেশীয় ভূখণ্ডের (ইন্দোচীন) বৃহত্তম দেশ। দেশের উপকূলীয় অঞ্চলটি নিম্ন মিয়ানমার ও অভ্যন্তরীণ অঞ্চলটি ঊর্ধ্ব মিয়ানমার হিসেবে পরিচিত। মিয়ানমারের দক্ষিণভাগে বঙ্গোপসাগরের উপকূলে অবস্থিত রেঙ্গুন বা ইয়াঙ্গুন দেশটির প্রাক্তন রাজধানী ও বৃহত্তম নগরী।[৩] ২০০৫ সালের নভেম্বরে সামরিক সরকার জাতীয় রাজধানীকে দেশের মধ্যভাগে সরিয়ে পরিকল্পিতভাবে নির্মিত নতুন একটি শহরে স্থাপন করে, যার নাম নেপিডো। মান্দালয় আরেকটি বৃহৎ শহর। মিয়ানমার একটি পর্বতময় দেশ। উত্তরভাগে অবস্থিত কুমোন পর্বতশ্রেণীতে দেশের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ হকাকাবো অবস্থিত, যার উচ্চত ৫,৮৮১ মিটার। মধ্য মিয়ানমারে ইরাবতী ও সিত্তাং নদীগুলিকে ঘিরে উর্বর নিম্নভূমি অঞ্চলগুলি অবস্থিত, যেখানে দেশের সিংহভাগ মানুষ বাস করে। মিয়ানমারের জলবায়ু ক্রান্তীয় বা গ্রীষ্মমণ্ডলীয় প্রকৃতির। দেশের বেশিরভাগ অংশে গ্রীষ্মকালে ভারী বৃষ্টিপাত হয়। মিয়ানামারের আয়তনের প্রায় ৪৩% অরণ্যে আবৃত। সবচেয়ে বৃষ্টিবহুল অঞ্চলগুলিতে চিরসবুজ অতিবৃষ্টি অরণ্য বিকাশ লাভ করেছে। অপেক্ষাকৃত কম বৃষ্টিবহুল অঞ্চলগুলিতে টিক গাছ ও অন্যান্য পর্ণমোচী বৃক্ষ জন্মে। মিয়ানমারে বহু বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী আছে। অতিবৃষ্টি অরণ্যগুলিতে বিভিন্ন প্রজাতির পাখি, সাপ ও বানর আছে। বাঘ ও হাতি বর্তমানে হুমকির সম্মুখীন। পাহাড়ি এলাকাগুলিতে ভল্লুক এবং ব-দ্বীপ অঞ্চলগুলিতে কুমিরের দেখা মেলে।
মিয়ানমার সংঘ প্রজাতন্ত্র
| |
---|---|
রাজধানী | নেপিডো[ক] ১৯°৪৫′ উত্তর ৯৬°৬′ পূর্ব |
বৃহত্তম নগরী | ইয়াঙ্গুন[খ] |
সরকারি ভাষা | বর্মী |
স্বীকৃত ভাষা | ইংরেজি[১] |
স্বীকৃত আঞ্চলিক ভাষা |
|
দাফতরিক লিপি | বর্মী লিপি |
নৃগোষ্ঠী |
|
ধর্ম |
|
জাতীয়তাসূচক বিশেষণ | বর্মী[৬] |
সরকার | সামরিক জান্তা এককেন্দ্রিক আইনসভা-স্বাধীন প্রজাতন্ত্র |
মিন সোয়ে (ভারপ্রাপ্ত) | |
মিন অং হ্লাইং | |
• রাষ্ট্রীয় প্রশাসন পরিষদের সহসভাপতি ও উপপ্রধানমন্ত্রী | সো উইন |
আইন-সভা | সংঘ সভা |
• উচ্চকক্ষ | জাতীয়তা সভা |
প্রতিনিধি সভা | |
প্রতিষ্ঠা | |
• পিউ নগররাষ্ট্রসমূহ | আনু. ১৮০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ |
• বগান রাজ্য | ২৩ ডিসেম্বর ৮৪৯ |
• তাউঙু রাজবংশ | ১৬ অক্টোবর ১৫১০ |
২৯ ফেব্রুয়ারি ১৭৫২ | |
• ব্রিটেন কর্তৃক অন্তর্ভুক্তকরণ | ১ জানুয়ারি ১৮৮৬ |
৪ জানুয়ারি ১৯৪৮ | |
• ১৯৬২ সামরিক অভ্যুত্থান | ২ মার্চ ১৯৬২ |
• “বর্মা” থেকে “মিয়ানমার” নামান্তর | ১৮ জুন ১৯৮৯ |
• রাষ্ট্রপতিত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠা | ৩০ মার্চ ২০১১ |
১ ফেব্রুয়ারি ২০২১ | |
আয়তন | |
• মোট | ৬,৭৬,৫৭৮ কিমি২ (২,৬১,২২৮ মা২) (৩৯শ) |
• পানি (%) | ৩.০৬ |
জনসংখ্যা | |
• ২০১৭ আদমশুমারি | ৫৩,৫৮২,৮৫৫ (২০১৭)[৭] (২৬শ) |
• ঘনত্ব | ৭৬/কিমি২ (১৯৬.৮/বর্গমাইল) (১২৫শ) |
জিডিপি (পিপিপি) | ২০২২ আনুমানিক |
• মোট | $২৪৩.৪২০ বিলিয়ন[৮] (৬৩শ) |
• মাথাপিছু | $৪,৫১৭[৮] (১৪২শ) |
জিডিপি (মনোনীত) | ২০২২ আনুমানিক |
• মোট | $৬৩.০৫২ বিলিয়ন[৮] (৭১শ) |
• মাথাপিছু | $১,১৭০[৮] (১৬০শ) |
জিনি (২০১৭) | ৩০.৭[৯] মাধ্যম |
মানব উন্নয়ন সূচক (২০১৯) | ০.৫৮৩[১০] মধ্যম · ১৪৭শ |
মুদ্রা | ক্যত (K) (MMK) |
সময় অঞ্চল | ইউটিসি+০৬:৩০ (মিমাস) |
গাড়ী চালনার দিক | ডান |
কলিং কোড | +৯৫ |
আইএসও ৩১৬৬ কোড | MM |
ইন্টারনেট টিএলডি | .mm |
২০২২ সালের হিসাব অনুযায়ী মিয়ানমারের জনসংখ্যা ৫ কোটি ৫৮ লক্ষ। এদের সিংহভাগই বর্মী বা বামার নৃগোষ্ঠীর মানুষ। এছাড়া শান, কারেন ও আরাকানি বা রাখাইনসহ অন্যান্য তাৎপর্যপূর্ণ সংখ্যালঘু নৃগোষ্ঠী বিদ্যমান। এছাড়া এখানে অনেক চীনা ও ভারতীয় অভিবাসী বাস করে। জনগণের প্রায় ৭০% গ্রামীণ অঞ্চলে বাস করে। বর্মী ভাষা মিয়ানামারের সরকারি ভাষা। জনসংখ্যার ৮৮% বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। রাখাইনদের এক-তৃতীয়াংশ ইসলাম ধর্মাবলম্বী, যারা রোহিঙ্গা নামে পরিচিত। মিয়ানমারের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের মধ্যে রয়েছে লাক্ষিক সামগ্রী ও পুতুলনির্মাণ কলা এবং থিংইয়ান নামক জল ছিটানো উৎসবসহ আরও অন্যান্য পালপর্বণ। আদিবাসী জনগোষ্ঠীগুলি দেশটির সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। এদের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি আছে। দেশের সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থানগুলি হল প্রাচীন বাগান শহর, শোয়েদাগোন প্যাগোডা ও ইনলে হ্রদ। ২০২০ সালের কোভিড বৈশ্বিক মহামারী ও ২০২১ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পরে পর্যটকের সংখ্যা ব্যাপক হ্রাস পেয়েছে। মোহিঙ্গা নামক ঐতিহ্যবাহী মাছের নুডুল স্যুপ ও লাফেত থোএ নামক চা-পাতার সালাদ আন্তর্জাতিকভাবে সুখ্যাত।
মিয়ানমারে সাক্ষরতার হার ৮৯%। দেশের শিক্ষাখাতে তহবিলের অভাব আছে। ইয়াঙ্গন বিশ্ববিদ্যালয় সবচেয়ে খ্যাতনামা উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান। স্বাস্থ্যসেবা তেমন সুলভ নয়; পুরষদের গড় আয়ু ৬৩ বছর এবং নারীদের ৬৯ বছর। গণপরিবহন অনুন্নত এবং কেবলমাত্র ৪০% জনগণ আন্তর্জাল (ইন্টারনেট) ব্যবহার করে। মিয়ানমার একটি দরিদ্র রাষ্ট্র। দেশের শ্রমশক্তির প্রায় অর্ধেক কৃষিকাজে নিয়োজিত। ধান (চাল), আখ, শিমজাতীয় উদ্ভিদ, চিনাবাদাম, ভুট্টা ও তুলা দেশের প্রধান ফসল। গরু-ছাগল-ভেড়া, শূকর ও মহিষ প্রধান পালিত পশু। মৎস্যশিকার খাদ্যের আরেকটি উৎস। বনগুলি থেকে টিক ও অন্যান্য ধরনের কাঠ আহরণ করা হয়। পরিবহন ও পর্যটন খাতের সম্প্রসারণ ঘটছে। দেশের শ্রমশক্তির প্রায় ৩৫% সেবাখাতে কাজ করে। মিয়ানমারের অর্থনীতিতে শিল্পখাতের অবদান কম। শিল্পকারখানাগুলিতে পোশাক, সিমেন্ট ও রাসায়নিক সার উৎপাদিত হয়। দেশটির স্থূল অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বা জিডিপি বছরে প্রায় ৬৮০০ কোটি মার্কিন ডলার ও মাথাপিছু জিডিপি প্রায় ১২৫০ মার্কিন ডলার। বন্যা, সংঘাত ও আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার কারণে অর্থনীতি সংকুচিত হয়ে পড়েছে। মিয়ানমার খনিজ তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস, জেড পাথক ও কাঠসহ আরও অনেক প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ। বন উজাড় ও পরিবেশ দূষণ গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা। টেকসই শক্তির ব্যবহার নেই বললেই চলে। দেশে বিচিত্র সব বণ্যপ্রাণীর বাস। ইরাবতী শুশুক (ডলফিন) বিপন্ন প্রজাতি। সমৃদ্ধ খনিজ ভাণ্ডারের অধিকারী মিয়ানমারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিল্পখাতটি হল মূল্যবান রত্নপাথরের শিল্প। দেশটি বিশ্বের সর্ববৃহৎ জেড পাথর উৎপাদক এবং উচ্চমানের চুনি বা লালমণির জন্য দেশটি বিখ্যাত।
মিয়ানমার নামে একটি সংসদীয় প্রজাতন্ত্র হলেও দেশটির রাজনীতি গোলযোগময়। সর্বশেষ ২০২১ সালে একটি সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে। দেশের সামরিক বাহিনী টাটমাডো রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তার করে আছে এবং তাদের কারণে নাগরিক স্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা খর্ব হয়েছে। আইনি ব্যবস্থাটি ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ আইন ও প্রচলিত রীতিনীতিভিত্তিক। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী টাটমাডো দেশটির রাজনৈতিক ও প্রতিরক্ষা খাতে আধিপত্য কায়েম করে আছে। দেশের বাজেটের ১৫%-ই সামরিক খাতে বরাদ্দ করা হয়। মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর মানবাধিকার লংঘনের ব্যাপক ইতিহাস বিদ্যমান। নৃগোষ্ঠীগত সংঘাত, সামরিক দমনপীড়ন ও পৌর এলাকাগুলিতে অপরাধের উচ্চহার জনগণের নিরাপত্তার জন্য উদ্বেগজনক। মিয়ানমার সোনালী ত্রিভুজের অংশ বিধায় ব্যাপক পরিমাণ মাদক চোরাচালান ঘটে, যা সংঘবদ্ধ অপরাধ ও অস্থিতিশীলতাকে উস্কে দেয়। সহিংসতার কারণে ৩০ লক্ষেরও বেশি ব্যক্তি বাস্তুচ্যুত হয়েছে ও তাদের জন্য সরকারি সহায়তা খুবই সীমিত। মিয়ানমার আসিয়ান ও জাতিসংঘের সদস্য হলেও দেশটির বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা বিদ্যমান। চীনের সাথে দেশটির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকলেও মানবাধিকার লংঘনের কারণে পশ্চিমা দেশগুলির সাথে সম্পর্ক শীতল।
আজ থেকে প্রায় ২ হাজার বছর আগে পিউ নামক একটি জনগোষ্ঠী এ অঞ্চলে বাস করতে শুরু করে ও অঞ্চলটির উত্তরভাগে একাধিক শহরের পত্তন করে। দক্ষিণে মন জনগোষ্ঠীর বাস ছিল। খ্রিস্টীয় ৯ম শতকে মিয়ানমারের মধ্যভাগের পাগান শহরকে কেন্দ্র করে বর্মী নৃগোষ্ঠীর লোকেরা একটি শক্তিশালী রাজ্য গড়ে তোলে। ১১শ শতকের মধ্যভাগে এসে বর্মী শাসক আনাওরাহতা বর্তমান মিয়ানমারের অন্তর্গত প্রায় সমস্ত ভূখণ্ডকে একত্রিত করে একটি মাত্র রাজ্য গঠন করেন। এই রাজ্যটি বৌদ্ধ সংস্কৃতির একটি কেন্দ্রে পরিণত হয়। ১৩শ শতকে মঙ্গোল বাহিনীর আক্রমণে রাজ্যটি ভেঙে যায়। ১৮শ শতকের মধ্যভাগে আলাউংপায়া নামেরে একজন রাজা মিয়ানমারকে পুনরায় একত্রিত করেন। ১৯শ শতকে মিয়ানমার ও যুক্তরাজ্যের মধ্যে তিনটি ইঙ্গ-বর্মী যুদ্ধ সংঘটিত এবং ব্রিটিশরা ১৮৮৬ সালে সম্পূর্ণ অঞ্চলটি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। ব্রিটিশরা অঞ্চলটিকে বার্মা বলে ডাকত। বার্মা ১৯৪৮ সালের ৪ঠা জানুয়ারি যুক্তরাজ্যের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। দেশটির স্বাধীনতা-পরবর্তী ইতিহাস সামরিক শাসন, গণতন্ত্রপন্থী প্রতিবাদ, চলমান নৃগোষ্ঠীগত সংঘাত বিশেষ করে রোহিঙ্গা সংকটের দ্বারা চিহ্নিত। দেশটি ২০শ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকেই রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে বাকি বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন। ১৯৬২ সাল থেকে বেশিরভাগ সময় ধরেই দেশটি কর্তৃত্ববাদী সামরিক শাসনের অধীনে পরিচালিত হয়েছে। ১৯৮৮ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত শাসনকারী সামরিক সরকার সব ধরনের প্রতিবাদ দমন করে। দেশটির বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। ২১শে অক্টোবর ২০১০ তারিখ থেকে দেশটির নতুন জাতীয় সঙ্গীত ও জাতীয় পতাকা প্রবর্তন করা হয়। বিরোধী দলীয় নেতা ও গণতন্ত্রপন্থী আন্দোলনকর্মীরা পরিবর্তনের জন্য চাপ প্রয়োগ করে এবং ২০১১ সালে একটি নতুন সংবিধান প্রণীত হয়, যেখানে একটি নির্বাচিত বেসামরিক সরকারের বিধান রাখা হয়। ২০১৫ সালে দেশটিতে অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। জাতীয় গণতন্ত্র লিগ দলটি বিপুল জয়লাভ করে সরকার গঠন করে, তবে সামরিক বাহিনী সেনা ও পুলিশ বাহিনীর উপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখে। ২০১৭ সালে সামরিক বাহিনী রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ব্যাপক সহিংসতা শুরু করে, কিন্তু মিয়ানমারের নির্বাচিত সরকার এর বিরুদ্ধে কোনও প্রতিক্রিয়া না দিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমালোচনার সম্মুখীন হয়। ২০১৮ সাল নাগাদ প্রায় ৭ লক্ষ রোহিঙ্গা মিয়ানমার ছেড়ে পালিয়ে বিদেশে, বিশেষ করে বাংলাদেশে চলে যায়। ঐ বছর আগস্টে জাতিসংঘের একটি প্রতিবেদনে মিয়ানমারের শীর্ষ সেনাপ্রধানদেরকে গণহত্যার দায়ে বিচারের সুপারিশ করা হয়। ২০২০ সালের নির্বাচনে জাতীয় গণতন্ত্র লিগ আবারও সহজ বিজয় অর্জন করলেও সামরিক বাহিনী নির্বাচনের ফলাফল অবৈধ ঘোষণা করে সেই বিজয় অস্বীকার করে এবং ২০২১ সালের ১লা ফেব্রুয়ারি আবার একটি সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে দেশটিতে পুনরায় সামরিক শাসনের সূত্রপাত করে। বর্তমানে ৩২% দারিদ্র্য হার, অর্থনৈতিক সংকোচন, চলমান নৃগোষ্ঠীয় সংঘাত, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়, বন উজাড়, মাদক উৎপাদন ও চোরাচালান, ইত্যাদি মিয়ানমারের কিছু গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা।
ব্যুৎপত্তি
বার্মা নামটি ব্রহ্মদেশ নামটির সঙ্গে সম্পর্কিত। সংস্কৃত ভাষায় এই দেশটি "ब्रह्मदेश" ("ব্রহ্মদেশ") নামে পরিচিত। বর্মী ভাষায় দেশটিকে "মিয়ানমা" নামে ডাকা হয়। চীনা ভাষায় (ম্যান্ডারিন) দেশটির নাম "মিআন" বা "মিআনদিআন"। ভারতের আসাম অঙ্গরাজ্যে একে "মান দেশ" বলে।
ইতিহাস
প্রাচীন ইতিহাস
প্রায় ১৩ হাজার বছর আগে বর্তমান মিয়ানমারে জনবসতির অবস্থান সর্ম্পকে জানা যায়। পিয়ু নামের উপজাতিরা ১ম শতকে বার্মা এলাকাতে দক্ষিণ দিকের ইরাবতী উপত্যকা দিয়ে প্রবেশ করে। অপর দিকে উত্তর দিক দিয়ে মুন জাতি প্রবেশ করে। ৯ম শতকে "মিরানমা" জাতি ইরাবতী উপত্যকার উপরে বসবাস শুরু করে।
পাগান রাজ্য ও টংগু সাম্রাজ্য
১৩ শতকের দিকে মিয়ানমারে কয়েকটি বিচ্ছিন্ন রাজ্য সৃষ্টি হয়। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল: আভা, আরাকান, হানথাবতী প্রভৃতি। টঙ্গু সাম্রাজ্য প্রথম ১৫শ শতকে বার্মাকে একত্রীকরণ করে। ১৮শ শতকে ব্রিটিশরা বার্মা দখল করে নেয়। ১৯৪৮ সালে বার্মা স্বাধীনতা লাভ করে। ১৯৬২ সালে দেশটিতে প্রথম সামরিক সরকার ক্ষমতায় অসীন হয়।
মোন গোষ্ঠীকে ইরাওয়াদি (সংস্কৃত ইরাবতী) উপত্যকায় আবাস গড়া প্রথম জনগোষ্ঠী মনে করা হয়। খ্রীস্টপূর্ব নবম শতকের মাঝে তারা দক্ষিণ মিয়ানমারে আধিপত্য বিস্তার করে। [১১]
খ্রীস্টপূর্ব প্রথম শতকে পিয়ুদের আগমন ঘটে। খ্রীস্টিয় অষ্টম শতকে তারা নানঝাও রাজ্যের আক্রমণের শিকার হয়। খ্রীস্টিয় নবম শতকের পূর্বে কোনসময়ে বর্মীরা বর্তমান তিব্বত থেকে ইরাওয়াদি উপত্যকায় আসা শুরু করে। ৮৪৯ সালের মধ্যে তারা পাগানকে কেন্দ্র করে শক্তিশালী রাজ্য গড়ে তোলে যা একসময় বর্তমান মিয়ানমারের প্রায় সম্পূর্ণ এলাকাজুড়ে বিস্তার লাভ করে। ১১০০ সালের মধ্যে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৃহৎ এলাকা তাদের নিয়ন্ত্রণে আসে।
দ্বাদশ শতাব্দীর শেষাংশে কুবলাই খান পাগান রাজ্য দখল করেন। ১৩৬৪ সালে বর্মীরা রাজত্ব পুনরুদ্ধার করে।
ব্রিটিশ বার্মা (১৮৮৫ - ১৯৪৮)
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিয়ানমারে জাপানিদের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি। রেঙ্গুন তথা বার্মা ১৯৪২-৪৫ পর্যন্ত সময়ে জাপানিদের দখলে ছিল। জাপানিদের তত্ত্বাবধানেই তৈরি হয়েছিল বার্মা ইনডিপেনডেন্ট আর্মি। জাপানি বাহিনীকে সহযোগিতা করেছিলেন জেনারেল অং সান এবং বার্মা ইনডিপেনডেন্ট আর্মি। তাদের উদ্দেশ্য ছিল তৎকালীন বার্মা থেকে ব্রিটিশ শাসনের উৎখাত। পরে জাপানিদেরও বিতাড়িত করে বার্মাকে স্বাধীন করা। ওই সময়ে নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোস কয়েকবার অং সানের সঙ্গে রেঙ্গুনে গোপন বৈঠকও করেছিলেন। দুজনের মধ্যে একধরনের সিদ্ধান্ত হয়েছিল একযোগে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে স্ব-স্ব দেশকে স্বাধীন করতে কাজ করার।
এ দুজনের মধ্যে মধ্যস্থতায় ছিলেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত মি. দিনা নাথ, যাঁর বার্মিজ নাম ছিল দত্ত কাহন থেইন থেইয়েন। তিনি তার রেঙ্গুনের বাড়িটির একাংশ ছেড়ে দিয়েছিলেন অং সানকে তার অফিস হিসেবে ব্যবহার করতে। এখানেই গোপন বৈঠক হয় সুভাষ বোস ও অং সানের। ‘হাউস অব মেমোরি’ নামে পরিচিত এবং বার্মার তথা ভারতের স্বাধীনতাসংগ্রামের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মি. দিনা নাথ পরে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলায় ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত দিল্লির লাল কেল্লায় এক বছর কারাভোগে ছিলেন। পরে দিনা নাথকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নেহেরু ভারতের সর্বোচ্চ খেতাবে ভূষিত করেছিলেন।
তৎকালীন বার্মা ভারতের স্বাধীনতার প্রায় এক বছর পর ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি স্বাধীনতা লাভ করে। জেনারেল অং সান স্বাধীনতার কয়েক মাস আগে জুলাই ১৯৪৭ সালে কথিত বিরোধী আততায়ীর হাতে মৃত্যুবরণ করেন।
আততায়ীর হাতে মৃত্যুর আগে অং সান যে কয়টি কাজ করে গিয়েছিলেন তার মধ্যে প্রধান ছিল বার্মার পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ এবং বিবদমান তিনটি গোষ্ঠীর—শান, কারেন ও চিনাদের সঙ্গে স্বায়ত্তশাসন নিয়ে একটি সমঝোতায় পৌঁছানো। এসব উপজাতীয় অঞ্চল এবং উপজাতীয়রা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির সঙ্গে সহযোগিতায় ছিল, বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, স্বাধীন সত্তা হিসেবে আত্মপ্রকাশের জন্য। কিন্তু তেমনটা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি করেনি। কেন ওই সব অঞ্চলকে স্বাধীন করেনি তার প্রধান কারণ চীনের সঙ্গে বর্তমানে এই তিন রাজ্যের ভূকৌশলগত অবস্থান।
অং সান পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতার যে সংগ্রামে লিপ্ত ছিলেন, তার অন্যতম সহযোগী ছিলেন বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গা নেতা, যাঁরা নিজেরাও ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে ছিলেন। এছাড়াও অং সানের বিপ্লবী কার্যকলাপের অন্যতম সাথীদের একটা বিরাট অংশই ছিল বাঙালী। কর্মসূত্রে প্রচুর বাঙালী বর্মার বিভিন্ন অঞ্চলে থাকতেন, তাদের মধ্যে কিছু সাম্যবাদী চিন্তাধারার তরুন বর্মা কমিউনিস্ট পার্টির গুরুত্বপূর্ণ স্থান অলংকৃত করেছিলেন। হরিনারায়ণ ঘোষাল, ডাক্তার অমর নাগ, সুবোধ মুখার্জী, অমর দে প্রমুখ ছিলেন অং সানের সাথী বাঙালি বিপ্লবী নেতা। ১৯৪৭ সালে অং সান ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্লেমেন্ট এটলির সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করে বার্মার স্বাধীনতা নিশ্চিত করেন। এর ঠিক দুই সপ্তাহ পরে অং সান প্যানগ্লোনগ কনফারেন্সে তিন গ্রুপের সঙ্গে স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করার চুক্তি করেন। কারণ, তিনি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক প্রশাসকদের বার্মা বিভাজনের কোনো অজুহাতই দিতে চাননি।
স্বাধীনতা-পরবর্তী যুগ (১৯৪৮-১৯৬২)
বার্মা স্বাধীন হয়েছিল অং সানের মৃত্যুর পর। ১৯৪৮ থেকে ১৯৬২ পর্যন্ত বার্মা চারটি বহুদলীয় নির্বাচন দেখেছে কিন্তু অং সানের সঙ্গে সম্পাদিত তিন প্রধান উপজাতীয়দের সঙ্গে চুক্তি বাস্তবায়িত হয়নি। উপরন্তু বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে অন্যান্য অঞ্চলে, যার মধ্যে রোহিঙ্গা–অধ্যুষিত আরাকান, যার বর্তমান নাম রাখাইন অঞ্চলও যুক্ত হয়।
সমাজতন্ত্র ও সামরিক শাসন (১৯৬২-২০১১)
১৯৬২ সালের ২ মার্চ মিয়ানমারের সামরিক জান্তা ক্ষমতা দখল করে। সামরিক জান্তার প্রধান ছিলেন নে উইন। তারা ২৭ মে ১৯৯০ সালে প্রথম নির্বাচন দেয়। এ নির্বাচনে অং সান সু চি এর দল "ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি" ৪৯২ টি অাসনের মধ্যে ৩৯২টি আসন পায়। কিন্তু নির্বাচনী আইনের মাধ্যমে তা বাতিল করা হয়। রেঙ্গুন নামটি ১৯৮৯ সালে সামরিক শাসকেরা পরিবর্তন করে রাখেন ইয়াঙ্গুন। নভেম্বর ২০০৫ সালে ইয়াঙ্গুন দেশের রাজধানীর মর্যাদা হারায়। বর্তমানে বার্মা বা মিয়ানমারের রাজধানী ইয়াঙ্গুন থেকে প্রায় ৬০০ কিলোমিটার দূরে অত্যন্ত পরিকল্পিত নতুন শহর নেপিডোতে।
রাজনীতি
সুদীর্ঘ সামরিক শাসনের ইতি ঘটিয়ে ২০১৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে জয়ী হয়ে গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা চালু হয়েছে। প্রধান রাজনৈতিক দলগুলি হলো ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি এবং ইউনিয়ন সংহতি ও উন্নয়ন পার্টি।
২০০৮ সালের মে মাসে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী খসড়া সংবিধান অনুমোদিত হয়েছিল। ২৯ মিলিয়ন ভোটারের মধ্যে ৯৯.৪% সরকারী ভোটগ্রহণের ৯৯.৪%, বহু আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক এবং ন্যাশনাল লিগ অফ ডেমোক্রেসি কর্তৃক বিস্তৃত রিপোর্টের দ্বারা সন্দেহজনক বলে গণ্য হয়েছে জালিয়াতি, ব্যালট স্টাফিং এবং ভোটারদের ভয় দেখানো।
২০১০ সালের নির্বাচনের ফলে সামরিক-সমর্থিত ইউনিয়ন সংহতি ও উন্নয়ন দলের পক্ষে একটি বিজয় হয়েছিল। বিভিন্ন বিদেশী পর্যবেক্ষকরা নির্বাচনের ন্যায্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। নির্বাচনের একটি সমালোচনা ছিল যে কেবল সরকার অনুমোদিত অনুমোদিত রাজনৈতিক দলগুলিকে এতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল এবং গণতন্ত্রের জনপ্রিয় জাতীয় লীগকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছিল। তবে নির্বাচনের অবিলম্বে সরকার গণতন্ত্রের অ্যাডভোকেট এবং জাতীয় লীগ ফর ডেমোক্রেসির নেতা অং সান সু চি'র গৃহবন্দীকরণের অবসান ঘটিয়েছে এবং দেশজুড়ে অবাধে চলাফেরা করার ক্ষমতাটিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা হিসাবে বিবেচনা করা হয় আরও খোলামেলা দিকে সামরিক আন্দোলন। ২০১১ সালে অপ্রত্যাশিত সংস্কারের পরে, এনএলডি জ্যেষ্ঠ নেতারা একটি রাজনৈতিক দল হিসাবে নিবন্ধকরণ এবং ভবিষ্যতে উপনির্বাচনে প্রার্থী দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
মিয়ানমারের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ইতিহাস বিরোধী দলগুলির মধ্যে গণতান্ত্রিক কাঠামো প্রতিষ্ঠা করার সংগ্রামের দ্বারা আচ্ছাদিত। নিবিড়ভাবে অনুষ্ঠিত সামরিক শাসন থেকে একটি মুক্ত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এই রাজনৈতিক রূপান্তর মিয়ানমারের ভবিষ্যত নির্ধারণ করে বলে ব্যাপকভাবে বিশ্বাস করা হয়। ২০১৫ সালের সাধারণ নির্বাচনে অং সান সু চির ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসির অবিচ্ছিন্ন বিজয় এই উত্তরণের সফল সমাপ্তির জন্য আশা জাগিয়ে তুলেছে।
মিয়ানমার দুর্নীতি অনুধাবন সূচকে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসাবে বিশ্বব্যাপী ১৬৬ টি দেশের মধ্যে ১৩৩ তম স্থান পেয়েছে এবং ২০১ -2016 সালের মধ্যে ১ ম সংখ্যায় সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত হয়েছে।
সামরিক শক্তি
মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী তাতমাডো নামে পরিচিত। এর মিগ-২৯এসএওম ধরনের ৩০টি যুদ্ধ বিমান রয়েছে যা বিমানবাহিনীর প্রধান যুদ্ধবহর। নৌবহরে ভারতীয় সিন্ধুবীর ডুবোজাহাজ ক্রয়ের কথা চলছে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক
চীন
১৯৪৯ সালে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি ক্ষমতায় আসার পর থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত চীনের সঙ্গে বৈরী সম্পর্ক ছিল মিয়ানমারের[১২]। মিয়ানমারের অভ্যন্তরে বিদ্রোহী কমিউনিস্ট পার্টি অব বার্মা (সিপিবি)-এর মূল পৃষ্ঠপোষক ছিল চীন। ১৯৭৮ সালে চীনা নেতা দেং জিয়াও পেং মিয়ানমার সফরে আসেন। ১৯৮৬ তে সিপিবির ওপর থেকে সম্পূর্ণ সমর্থন তুলে নেয় চীন। বৈরী সম্পর্ক দারুণভাবে সহযোগিতার দিকে নতুন মোড় নেয়। তারা তেল-গ্যাস, খনিজ সম্পদসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিনিয়োগসহ বাণিজ্যিক সুবিধা পায়। এ সময় চীন সামরিকভাবে মিয়ানমারকে সহায়তা করতে থাকে। ১৯৮৯ সালে মিয়ানমার চীন থেকে ১.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম ক্রয় করে।[১৩] ভারতের ওপর ভূরাজনৈতিক কৌশলগত সুবিধা বাড়াতে মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হয় চীনের। মিয়ানমারের অভ্যন্তরে জাতিগত বিদ্রোহ, বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন দমনে মিয়ানমারকে বহুমুখী সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় চীন। চীনের সমর্থন মিয়ানমারের সামরিক জান্তাকে অধিকতর শক্তিশালী করে। তারা এই সুযোগকে ব্যবহার করে দেশের মধ্যে যেমন তাদের ক্ষমতা বাড়ায়, তেমনি একটি শক্তিশালী সমরশক্তির দেশ হিসেবে গড়ে উঠতে চীনের সর্বোচ্চ সহায়তা পেতে থাকে।
প্রশাসনিক অঞ্চলসমূহ
মিয়ানমার দেশটি মূল মিয়ানমার অঞ্চল এবং আরও সাতটি রাজ্য নিয়ে গঠিত। এগুলি হলো চিন, কাচিন, কারেন, মন, রাখাইন (আরাকান) এবং শান। মূল বার্মা সাতটি বিভাগে বিভক্ত - ইরাবতী, মাগওয়ে, মান্দালয়, ব্যাগো, রেংগুন, সাগাইং, এবং তেনাসসেরিম।
ভূগোল
আয়তন ও ভূ-প্রকৃৃতি
মিয়ানমারের মোট আয়তন ৬৭৬,৫৫২ বর্গকিলোমিটার। উত্তর-দক্ষিণে এর দৈর্ঘ্য প্রায় ২,০৮৫ কিলোমিটার। পূর্ব-পশ্চিমে এর সর্বোচ্চ বিস্তার প্রায় ৯৩০ কিলোমিটার। উপকূলীয় এলাকাটি নিম্ন মিয়ানমার এবং অভ্যন্তরীণ অংশটি ঊর্ধ্ব মিয়ানমার নামে পরিচিত। অশ্বখুরাকৃতি পর্বতব্যবস্থা ও ইরাবতী নদীর উপত্যকা দেশটির ভূ-সংস্থানের প্রধান বৈশিষ্ট্য। উত্তরের পর্বতগুলির সর্বোচ্চ শৃঙ্গ হকাকাবো রাজি-র উচ্চতা ৫,৮৮১ মিটার। এটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সর্বোচ্চ শৃঙ্গ। আরও দুইটি পর্বতব্যবস্থা উত্তর থেকে দক্ষিণে বিস্তৃত। আরাকান ইয়োমা পর্বতমালাটি মিয়ানমার ও ভারতীয় উপমহাদেশের মধ্যে একটি প্রাচীরের সৃষ্টি করেছে। এর পর্বতগুলির উচ্চতা প্রধানত ৯১৫ মিটার থেকে ১,৫২৫ মিটার পর্যন্ত হয়। অন্যদিকে শান মালভূমি থেকে বিলকাতং পর্বতশ্রেণীটি প্রসারিত হয়ে দক্ষিণ-পূর্ব নিম্ন মিয়ানমার এবং দক্ষিণ-পশ্চিম থাইল্যান্ডের সীমান্ত বরাবর চলে গেছে। শান মালভূমিটি চীন থেকে প্রসারিত হয়েছে এবং এর গড় উচ্চতা প্রায় ১,২১৫ মিটার।
মিয়ানমারের অভ্যন্তরভাগে কেন্দ্রীয় নিম্নভূমিগুলি মূলত সরু ও দীর্ঘ। এগুলি ইরাবতী-সিত্তাং নদীর ব-দ্বীপ এলাকায় প্রায় ৩২০ কিলোমিটার প্রশস্ত। এই ব-দ্বীপীয় সমভূমিগুলি অত্যন্ত উর্বর এবং দেশের সবচেয়ে অর্থনৈতিক গুরুত্ববিশিষ্ট অঞ্চল। এদের মোট আয়তন প্রায় ৪৭,০০০ বর্গকিলোমিটার। মিয়ানমারের উত্তর-পশ্চিমের আরাকান উপকূল এবং দক্ষিণ-পশ্চিমের তেনাসসেরিম উপকূল উভয়েই শিলাময় এবং এগুলির কাছে অনেক দ্বীপ অবস্থিত। মিয়ানমারে বেশ কিছু উৎকৃষ্ট প্রাকৃতিক পোতাশ্রয় আছে।
সীমানা
মিয়ানমার ৬৭৮,৫০০ বর্গকিলোমিটার (২৬১,৯৭০ বর্গমাইল) এলাকাজুড়ে বিস্তৃত। মিয়ানমারের পশ্চিমে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বিভাগ এবং ভারতের মিজোরাম, উত্তর-পশ্চিমে ভারতের আসাম, নাগাল্যান্ড ও মণিপুর অবস্থিত। মিয়ানমারের সীমানার উত্তর-পূর্বাংশের ২,১৮৫ কিলোমিটার জুড়ে আছে তিব্বত এবং চীনের ইউনান প্রদেশ। দক্ষিণ-পূর্বে রয়েছে লাওস ও থাইল্যান্ড। দক্ষিণ-পশ্চিম এবং দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর ও আন্দামান সাগরের সাথে মিয়ানমারের ১,৯৩০ কিলোমিটার উপকূল রেখা রয়েছে।
আবহাওয়া ও জলবায়ু
মিয়ানমারের অধিকাংশই কর্কটক্রান্তি ও বিষুবরেখার মাঝে অবস্থিত। ব-দ্বীপ অঞ্চলে বার্ষিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ প্রায় ২,৫০০ মিলিমিটার (৯৮ ইঞ্চি), তবে মধ্য মিয়ানমারের শুষ্ক এলাকায় তা ১,০০০ মিলিমিটারের কম। উত্তরের অপেক্ষাকৃত শীতল এলাকায় গড় তাপমাত্রা ২১ °সেলসিয়াস। উপকূলীয় ও ব-দ্বীপ এলাকায় গড় তাপমাত্রা ৩২ °সেলসিয়াস।
জীবজগৎ
উদ্ভিদজগৎ
মূল্যবান সেগুন ও বিষুবীয় গাছপালায় ভরা বন মিয়ানমারের শতকরা ৪৯ ভাগের বেশি এলাকা জুড়ে রয়েছে। অন্যান্য গাছের মধ্যে রাবার, বাবলা, বাঁশ, ম্যানগ্রোভ, নারিকেল উল্লেখযোগ্য। উত্তরাঞ্চলে ওক, পাইন ইত্যাদি রয়েছে বিপুল পরিমাণে।
প্রাণীজগৎ
বন্য জীবজন্তুর মধ্যে বাঘ, গণ্ডার, বুনো মহিষ, মেঘলা চিতা, বুনো শূকর, শিয়াল, হরিণ, কৃষ্ণসার, বনছাগল, হাতি, উল্লুক, বানর, চামচিকা, বনরুই এবং কলাবাদুড় পাওয়া যায়। আটশ'রও বেশি প্রজাতির পাখি পাওয়া যায় যার মাঝে আছে সবুজ টিয়া, পাতি ময়না, ময়ূর, লাল বনমোরগ, বাবুই, কাক, বক, মানিকজোড়, লক্ষ্মীপেঁচা প্রভৃতি। সরীসৃপের মাঝে রয়েছে কুমির, তক্ষক, গুই সাপ, অজগর, শঙ্খচূড়, কচ্ছপ প্রভৃতি। স্বাদু পানির মাছ পাওয়া যায় বিপুল পরিমাণে, যা এখানকার খাদ্যের গুরুত্বপূর্ণ উৎস।
অর্থনীতি
কয়েক দশক স্থবিরতা, অব্যবস্থাপনা এবং বিচ্ছিন্নতায় ভুগতে মিয়ানমার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যতম দারিদ্র্য দেশ। আধুনিক প্রযুক্তিতে দক্ষ শিক্ষিত লোকবলের অভাব মিয়ানমারের অর্থনীতিতে বাধা সৃষ্টি করেছে, যদিও বিদেশী দেশ ও সংস্থার সহযোগিতায় নতুন সরকার দ্বারা চালিত সাম্প্রতিক সংস্কার ও বিকাশ এটিকে অতীতের বিষয়টিকে পরিণত করার লক্ষ্য নিয়েছে।
রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মতাদর্শগত লড়াই জীবনযাত্রাকে প্রভাবিত করেছে। কয়েক দশক গৃহযুদ্ধ এবং অশান্তি মিয়ানমারের বর্তমান স্তরের দারিদ্র্য এবং অর্থনৈতিক অগ্রগতির অভাবকে অবদান রেখেছে। ব্যক্তিগত জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় মানবিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবকাঠামোগত উন্নতি মনোনিবেশিত সরকারি প্রচেষ্টা গ্রহণ করতে পারেনি। মিয়ানমারে পর্যাপ্ত অবকাঠামোগত অভাব রয়েছে। জিনিসপত্র মূলত থাই সীমান্তের ওপারে (যেখানে বেশিরভাগ অবৈধ ওষুধ রফতানি হয়) এবং ইরাবতী নদীর তীরে। রেলপথ পুরানো এবং প্রাথমিক, 19 তম শতাব্দীর শেষের দিকে নির্মাণের পর থেকে কয়েকটি মেরামত করে প্রধান শহরগুলি বাদে মহাসড়কগুলি সাধারণত অপরিবর্তিত থাকে। ২০১০-১১ সালে বাংলাদেশ মিয়ানমারকে 179 ডলার আমদানির বিপরীতে $ 9.65 মিলিয়ন ডলারের পণ্য রফতানি করেছিল মিলিয়ন। 2000 এর দশকে মিয়ানমারে চিকিৎসা এবং চিকিৎসা সরঞ্জামের বার্ষিক আমদানি ছিল 160 মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
সাম্প্রতিক বছরগুলিতে, চীন এবং ভারত উভয়ই অর্থনৈতিক সুবিধার জন্য মিয়ানমার সরকারের সাথে সম্পর্ক জোরদার করার চেষ্টা করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ অনেক দেশ মিয়ানমারের উপর বিনিয়োগ ও বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন ২০১২ সালে তাদের বেশিরভাগ নিষেধাজ্ঞাকে হ্রাস করেছে বৈদেশিক বিনিয়োগ মূলত চীন, সিঙ্গাপুর, ফিলিপাইন, দক্ষিণ কোরিয়া, ভারত এবং থাইল্যান্ড থেকে আসে।
দেশের সমস্ত বড় শিল্প কর্পোরেশনগুলিতে (তেল উৎপাদন এবং ভোগ্যপণ্য থেকে শুরু করে পরিবহন ও পর্যটন পর্যন্ত) তাতমাডো (মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী) সর্বাধিক অংশীদারদের অবস্থান রয়েছে।
জনসংখ্যা
মিয়ানমারের বর্তমান জনসংখ্যা ৫৫মিলিয়ন।
ভাষা
বর্মী ভাষা মিয়ানমারের সরকারি ভাষা। বর্মী ভাষাতে মিয়ানমারের প্রায় ৮০% লোক কথা বলেন। এছাড়াও মিয়ানমারে স্থানীয় আরও প্রায় ১০০টি ভাষা প্রচলিত। এদের মধ্যে কারেন ভাষারসহ বেশ কিছু উপভাষা (প্রায় ৩০ লক্ষ বক্তা) এবং শান ভাষার উপভাষাগুলি (প্রায় ৩০ লক্ষ বক্তা) উল্লেখযোগ্য। সংখ্যালঘু ভাষাগুলির মধ্যে আরাকানি ভাষা, চিনা ভাষার বিভিন্ন উপভাষা, জিংপো ভাষা, রোহিঙ্গা ভাষা, লু ভাষা এবং পারাউক ভাষা উল্লেখযোগ্য।
ধর্ম
মিয়ানমার একটি বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র। এখানে ৮৮% মানুষ বৌদ্ধ ধর্মে বিশ্বাসী। এখানে 8% খ্রিস্টান এবং অল্প সংখ্যক মুসলিম ও হিন্দু রয়েছে।
আরও দেখুন
টীকা
- বিলেতি উচ্চারণ:/ˌmjænˈmɑːrˌ
ˈmjænmɑːr/ , মার্কিন উচ্চারণ: /ˈmjɑːnmɑːrˌˌmjɑːnˈmɑːr/ । টীকা: উইকিপিডিয়ার আইপিএ রীতিনীতি অনুসারে বিলেতি ইংরেজিতেও /r/ নির্দেশ করতে হয়, যদিও শুধু কিছু বিলেতি ইংরেজি ভাষাভাষী অক্ষরের শেষে র বা r উচ্চারণ করে। জন ওয়েলস যেমন ব্যাখ্যা করেছেন, মিয়ানমার ও বর্মা উভয়ের ইংরেজি বানানগুলো ইংরেজির একটি অ-রসদৃশ বৈচিত্র্য অনুমান করে, যেখানে r হরফটি ব্যঞ্জনবর্ণের আগে বা শেষে কেবল একটি দীর্ঘ স্বরধ্বনি নির্দেশ করার কাজ করে: [ˈmjænmɑː, ˈbɜːmə]। সুতরাং যুক্তরাজ্য ও উত্তর আমেরিকার কিছু বক্তাদের দ্বারা মিয়ানমারের শেষ শব্দাংশের উচ্চারণ [mɑːr] বা বর্মার উচ্চারণ [bɜːrmə] প্রকৃতপক্ষে একটি বানান-উচ্চারণ যা অ-রসদৃশ বানানরীতির একটি ভুলবোঝাবুঝির উপর ভিত্তি করে তৈরি। মিয়ানমারের চূড়ান্ত র বা r উচ্চারণের উদ্দেশ্যে যুক্ত হয়নি, বরং এটি নিশ্চিত করতে হাজির রয়েছে যেন চূড়ান্ত উচ্চারণ বিস্তৃত আ-এর (/ɑː/) মতো করা হয়। যদি বর্মী নাম မြန်မာ [mjəmà] ইংরেজিতে “Myanma” রূপে লেখা হয়, তাহলে সকল ইংরেজিভাষী কর্তৃক এটির শেষে /ə/ উচ্চারিত হবে। যদি এটির বানান “Myanmah” লেখা হয়, তবে শেষাংশটি সব ইংরেজিভাষীর দ্বারা /ɑː/ উচ্চারিত হবে। - বর্মী: ပြည်ထောင်စု သမ္မတ မြန်မာနိုင်ငံတေ [pjìdàʊɴzṵ θàɴməda̰ mjəmà nàɪɴŋàɴdɔ̀]
তথ্যসূত্র
গ্রন্থপঞ্জি
বহিঃসংযোগ
Wikiwand in your browser!
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.