মৌর্য সাম্রাজ্য
সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত সাম্রাজ্য উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
মৌর্য সাম্রাজ্য (সংস্কৃত: मौर्य साम्राज्यम्) প্রাচীন ভারতে লৌহ যুগের একটি বিস্তীর্ণ সাম্রাজ্য ছিল। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য দ্বারা প্রতিষ্ঠিত এবং পরবর্তীতে মৌর্য রাজবংশ দ্বারা শাসিত এই সাম্রাজ্য ৩২১ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ১৮৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত টিকে ছিল।[১৪] ভারতীয় উপমহাদেশের পূর্বদিকে সিন্ধু-গাঙ্গেয় সমভূমিতে অবস্থিত মগধকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এই সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল পাটলিপুত্র।[১৫][১৬] এটি ছিলো ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম সাম্রাজ্য।
মৌর্য সাম্রাজ্য मौर्य साम्राज्यम् | |||||||||||||||||||||
---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|
৩২২ খ্রিস্টপূর্ব – ১৮৪ খ্রিস্টপূর্ব | |||||||||||||||||||||
![]() | |||||||||||||||||||||
রাজধানী | পাটলিপুত্র (বর্তমান পাটনা, বিহার) | ||||||||||||||||||||
প্রচলিত ভাষা | সংস্কৃত (সাহিত্যিক ও একাডেমিক), মাগধী প্রাকৃত (আঞ্চলিক ভাষা) | ||||||||||||||||||||
ধর্ম | |||||||||||||||||||||
সরকার | কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র এবং রাজমণ্ডলে বর্ণিত পরম রাজতন্ত্র[১১] | ||||||||||||||||||||
সম্রাট | |||||||||||||||||||||
• ৩২২–২৯৮ খ্রিস্টপূর্ব | চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য | ||||||||||||||||||||
• ২৯৮–২৭২ খ্রিস্টপূর্ব | বিন্দুসার | ||||||||||||||||||||
• ২৬৮–২৩২ খ্রিস্টপূর্ব | অশোক | ||||||||||||||||||||
• ২৩২–২২৪ খ্রিস্টপূর্ব | দশরথ মৌর্য | ||||||||||||||||||||
• ২২৪–২১৫ খ্রিস্টপূর্ব | সম্প্রতি | ||||||||||||||||||||
• ২১৫–২০২ খ্রিস্টপূর্ব | শালিশুক | ||||||||||||||||||||
• ২০২–১৯৫ খ্রিস্টপূর্ব | দেববর্মণ | ||||||||||||||||||||
• ১৯৫–১৮৭ খ্রিস্টপূর্ব | শতধনবান | ||||||||||||||||||||
• ১৮৭–১৮৪ খ্রিস্টপূর্ব | বৃহদ্রথ মৌর্য | ||||||||||||||||||||
ঐতিহাসিক যুগ | লৌহ যুগ | ||||||||||||||||||||
• নন্দ সাম্রাজ্যের বিজয় | ৩২২ খ্রিস্টপূর্ব | ||||||||||||||||||||
• পুষ্যমিত্র শুঙ্গ কর্তৃক বৃহদ্রথের হত্যা | ১৮৪ খ্রিস্টপূর্ব | ||||||||||||||||||||
আয়তন | |||||||||||||||||||||
২৬১ খ্রিস্টপূর্ব[১২] (low-end estimate of peak area) | ৩৪,০০,০০০ বর্গকিলোমিটার (১৩,০০,০০০ বর্গমাইল) | ||||||||||||||||||||
২৫০ খ্রিস্টপূর্ব[১৩] (high-end estimate of peak area) | ৭০,০০,০০০ বর্গকিলোমিটার (২৭,০০,০০০ বর্গমাইল) | ||||||||||||||||||||
মুদ্রা | পানাস | ||||||||||||||||||||
| |||||||||||||||||||||
বর্তমানে যার অংশ | আফগানিস্তান বাংলাদেশ ভুটান ভারত ইরান নেপাল পাকিস্তান |
মৌর্য সাম্রাজ্য তৎকালীন যুগের অন্যতম বৃহত্তম সাম্রাজ্য হিসেবে পরিগণিত হত, শুধু তাই নয়, ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে এর চেয়ে বড় সাম্রাজ্য কখনো তৈরী হয়নি।[১৭][১৮] ৩২২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য নন্দ রাজবংশ উচ্ছেদ করে এই সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন এবং তারপর মহান আলেকজান্ডারের সেনাবাহিনীর পশ্চাৎ অপসারণের সুযোগে নিজ সামরিক শক্তিবলে মধ্য ও পশ্চিম ভারতের আঞ্চলিক রাজ্যগুলিকে জয় করে বিরাট সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন। ৩১৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যেই গ্রীক সত্রপগুলিকে পরাজিত করে মৌর্য সাম্রাজ্য সম্পূর্ণ উত্তর-পশ্চিম ভারত জুড়ে বিস্তৃত হয়।[১৯] বর্তমান যুগের মানচিত্রের নিরিখে এই সাম্রাজ্য উত্তরে হিমালয়, পূর্বে আসাম, পশ্চিমে বালুচিস্তান ও হিন্দুকুশ পর্বতমালা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।[১৯] চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য ও বিন্দুসার এই সাম্রাজ্যকে দক্ষিণ ভারতে বিস্তৃত করেন এবং অশোক কলিঙ্গ রাজ্য জয় করে সমগ্র দক্ষিণ ভারতে মৌর্য সাম্রাজ্যের শাসন প্রতিষ্ঠিত করেন। অশোকের মৃত্যুর পঞ্চাশ বছরের মধ্যেই ১৮৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এই সাম্রাজ্যের পতন ঘটে মগধে শুঙ্গ রাজবংশের উত্থান ঘটে। এটি ছিলো ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম সাম্রাজ্য।
এপিকগ্রাফি বলা হয় -লেখ সংক্রান্ত বিদ্যাকে।
মৌর্য সম্রাট অশোকের বেশিরভাগ শিলালেখ লেখা হয়েছিল --প্রাকৃত ভাষায় ও ব্রাহ্মী লিপিতে।
ইতিহাস
সারাংশ
প্রসঙ্গ
চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য এবং চাণক্য

চাণক্য বা কৌটিল্য বা বিষ্ণুগুপ্ত তক্ষশীলার[২০] ব্রাহ্মণ[২১] আচার্য[২২] এবং বিষ্ণুর উপাসক ছিলেন।.[২৩] চাণক্যের সহায়তায় চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য একটি সুবিশাল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন। প্রবাদানুসারে, মগধ শাসনকারী নন্দ রাজবংশের সম্রাট ধননন্দ দ্বারা অপমানিত হয়ে চাণক্য নন্দ সাম্রাজ্য ধ্বংস করার প্রতিজ্ঞা করেন।[২৪] চন্দ্রগুপ্তকথা নামক গ্রন্থানুসারে, চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য ও চাণক্যের সেনাবাহিনী প্রথমদিকে নন্দ সাম্রাজ্যের কর্তৃক পরাজিত হয়। কিন্তু চন্দ্রগুপ্ত এরপর বেশ কয়েকটি যুদ্ধে ধননন্দ ও তার সেনাপতি ভদ্রশালাকে পরাজিত করতে সক্ষম হন এবং অবশেষে পাটলিপুত্র নগরী অবরোধ করে ৩২১ খ্রিটপূর্বাব্দে মাত্র কুড়ি বছর বয়সে নন্দ সাম্রাজ্য অধিকার করেন।[২৫] বিশাখদত্ত রচিত মুদ্রারাক্ষস নামক সংস্কৃত নাটকে চাণক্যের কূটনৈতিক বুদ্ধির সহায়তায় চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের শাসন প্রতিষ্ঠার ঘটনা বর্ণিত রয়েছে।
৩২৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মহান আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পরে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য তার সাম্রাজ্যের উত্তর পশ্চিম সীমান্তে অবস্থিত ম্যাসিডনীয় সত্রপ রাজ্যগুলির দিকে নজর দেন। তিনি পশ্চিম পাঞ্জাব ও সিন্ধু নদ উপত্যকা অঞ্চলের শাসক ইউদেমোস ও পাইথনের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হন বলে মনে করা হয়।[nb ১] আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর ব্যাক্ট্রিয়া ও সিন্ধু নদ পর্যন্ত তার সাম্রাজ্যের পূর্বদিকের অংশ সেনাপতি প্রথম সেলেউকোস নিকাতোরের অধিকারে আসে। ৩০৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তিনি চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হন। এই সংঘর্ষের সঠিক বর্ণনা পাওয়া যায় না, কিন্তু যুদ্ধে পরাজিত হয়ে প্রথম সেলেউকোস নিকাতোর তাকে আরাকোশিয়া, গেদ্রোসিয়া ও পারোপামিসাদাই ইত্যাদি সিন্ধু নদের পশ্চিমদিকের বিশাল[২৭][২৮] অঞ্চল সমর্পণ করতে[২৯] এবং নিজ কন্যাকে তার সাথে বিবাহ দিতে বাধ্য হন।[nb ২] চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের সঙ্গে মৈত্রী চুক্তির পর প্রথম সেলেউকোস নিকাতোর পশ্চিমদিকে প্রথম আন্তিগোনোস মোনোফথালমোসের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হন।[nb ৩] চন্দ্রগুপ্ত প্রথম সেলেউকোস নিকাতোরকে ৫০০টি যুদ্ধ-হস্তী দিয়ে সহায়তা করেন।[২৯][৩১][৩২], যা ইপসাসের যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে তাকে জয়লাভে সহায়তা করে।
এরপর চন্দ্রগুপ্ত দক্ষিণ ভারতের দিকে অগ্রসর হন। তিনি বিন্ধ্য পর্বত পেরিয়ে দাক্ষিণাত্য মালভূমির সিংহভাগ দখল করতে সক্ষম হন। এর ফলে কলিঙ্গ ও দাক্ষিণাত্যের অল্পকিছু অংশ বাদে সমগ্র ভারত মৌর্য সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়।[২৫] সঙ্গম সাহিত্যের বিখ্যাত তামিল কবি মমুলনার মৌর্য্য সেনাবাহিনী দ্বারা দাক্ষিণাত্য আক্রমণের ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন।[৩৩]
বিন্দুসার

২৯৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের স্বেচ্ছা অবসরের পর তার পুত্র বিন্দুসার মাত্র বাইশ বছর বয়সে সিংহাসন লাভ করেন। বিন্দুসার মৌর্য সাম্রাজ্যকে তিনি দক্ষিণ দিকে আরো প্রসারিত করেন এবং কলিঙ্গ, চের, পাণ্ড্য ও চোল রাজ্য ব্যতিরেকে সমগ্র দক্ষিণ ভারত ছাড়াও উত্তর ভারতের সমগ্র অংশ তার করায়ত্ত হয়। তার রাজত্বকালে তক্ষশীলার অধিবাসীরা দুইবার বিদ্রোহ করেন কিন্তু বিন্দুসারের পক্ষে তা দমন করা সম্ভব হয়নি।
অশোক

২৭২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে বিন্দুসারের মৃত্যু হলে উত্তরাধিকারের প্রশ্নে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। বিন্দুসার তার অপর পুত্র সুসীমকে উত্তরাধিকারী হিসেবে চেয়েছিলেন, কিন্তু সুসীমকে উগ্র ও অহঙ্কারী চরিত্রের মানুষ হিসেবে বিবেচনা করে বিন্দুসারের মন্ত্রীরা তার অপর পুত্র অশোককে সমর্থন করেন।[৩৪] রাধাগুপ্ত নামক এক মন্ত্রী অশোকের সিংহাসনলাভের পক্ষে প্রধান সহায়ক হয়ে ওঠেন এবং পরবর্তীকালে তার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। অশোক শঠতা করে সুসীমকে একটি জ্বলন্ত কয়লা ভর্তি গর্তে ফেলে দিয়ে হত্যা করেন। দীপবংশ ও মহাবংশ গ্রন্থানুসারে, বীতাশোক নামক একজন ভাইকে ছেড়ে অশোক বাকি নিরানব্বইজন ভাইকে হত্যা করেন, কিন্ত এখনো পর্যন্ত এই ঘটনার কোন ঐতিহাসিক প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ২৬৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে পিতার মৃত্যুর তিন বছর পরে তিনি মৌর্য সাম্রাজ্যের সিংহাসনে আরোহণ করেন।
সিংহাসনে আরোহণ করে অশোক পরবর্তী আট বছর তার সাম্রাজ্য বিস্তারে মনোনিবেশ করেন। উত্তরে হিন্দুকুশ পর্বতমালা থেকে শুরু করে দাক্ষিণাত্যের কিছু অংশ বাদ দিয়ে সমগ্র ভারতবর্ষ তার করায়ত্ত হয়।[৩৫] তার রাজত্বকালের অষ্টম বর্ষে তিনি কলিঙ্গ আক্রমণ করেন। এই ভয়াবহ যুদ্ধে প্রায় এক লক্ষ মানুষ নিহত হন এবং দেড় লক্ষ মানুষ নির্বাসিত হন।[৩৬][৩৭] অশোকের ত্রয়োদশ শিলালিপিতে বর্ণিত হয়েছে যে কলিঙ্গের যুদ্ধে প্রচুর মানুষের মৃত্যু ও তাদের আত্মীয় স্বজনদের অপরিসীম কষ্ট লক্ষ্য করে অশোক দুঃখে ও অনুশোচনায় দগ্ধ হন।[৩৭][৩৮][৩৯] এই ভয়ানক যুদ্ধের কুফল লক্ষ্য করে যুদ্ধপ্রিয় অশোক একজন শান্তিকামী ও প্রজাদরদী সম্রাট এবং বৌদ্ধ ধর্মের একজন পৃষ্ঠপোষকে পরিণত হন। অশোকের পৃষ্ঠপোষকতায় শুধুমাত্র মৌর্য সাম্রাজ্য নয়, এশিয়ার বিভিন্ন রাজ্যে বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারিত হয়।[৪০] তার পুত্র মহিন্দ ও কন্যা সংঘমিত্রা সিংহলে বৌদ্ধ ধর্ম প্রচার করেন।[৪১]
পতন
অশোকের মৃত্যুর পরবর্তী পঞ্চাশ বছর দশরথ, সম্প্রতি, শালিশুক, দেববর্মণ, শতধনবান ও বৃহদ্রথ এই ছয় জন সম্রাটের রাজত্বকালে মৌর্য সাম্রাজ্য দুর্বল হতে থাকে। শেষ সম্রাট বৃহদ্রথ নিজ সেনাবাহিনীর প্রধান সেনাপতি পুষ্যমিত্র শুঙ্গ কর্তৃক নিহত হওয়ার পর, মৌর্য সাম্রাজ্যের পতন এবং শুঙ্গ সাম্রাজ্যের সূচনা ঘটে।[৪২]:২৪, ২৫
পাদটীকা
তথ্যসূত্র
বহিঃসংযোগ
Wikiwand - on
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.