মুন্সি আব্দুর রউফ (৮ মে ১৯৪৩ - ৮ এপ্রিল ১৯৭১)[1] বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে চরম সাহসিকতা আর অসামান্য বীরত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ যে সাতজন বীরকে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সামরিক সম্মান “বীর শ্রেষ্ঠ” উপাধিতে ভূষিত করা হয় তিনি তাঁদের অন্যতম।[3][4] তিনি ১৯৬৩ সালের ৮ মে পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলসে যোগদান করেন এবং মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তিনি নিয়মিত পদাতিক সৈন্য হিসেবে কর্মরত ছিলেন। পার্বত্য চট্টগ্রামের বুড়িঘাট গ্রামে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ সমরে ১৯৭১ সালের ৮ এপ্রিল (মতান্তরে ২০ এপ্রিল)[5] তিনি মর্টার শেলের আঘাতে শহীদ হন। তাঁকে রাঙামাটি জেলার নানিয়ারচর উপজেলার বুড়িঘাটে একটি টিলার ওপর সমাহিত করা হয়।

দ্রুত তথ্য বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আবদুর রউফ, জন্ম ...
বীরশ্রেষ্ঠ

মুন্সী আবদুর রউফ
Thumb
জন্ম(১৯৪৩-০৫-০৮)৮ মে ১৯৪৩
সালামতপুর (বর্তমান রউফ নগর), মধুখালি, ফরিদপুর
মৃত্যু৮ এপ্রিল ১৯৭১(1971-04-08) (বয়স ২৭)[1][lower-alpha 1]
বুড়িঘাট, মহালছড়ি, রাঙ্গামাটি
আনুগত্যবাংলাদেশ
কার্যকাল৮ মে ১৯৬৩ - ৮ এপ্রিল ১৯৭১
পদমর্যাদাল্যান্স নায়েক
ইউনিটপূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস
যুদ্ধ/সংগ্রামবাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ
পুরস্কারবীরশ্রেষ্ঠ
বন্ধ

জন্ম ও শৈশব

মুন্সি আব্দুর রউফ ১৯৪৩ সালের ৮ মে ফরিদপুর জেলার মধুখালী উপজেলার (পূর্বে বোয়ালমারী উপজেলার অন্তর্গত) সালামতপুর গ্রামে (বর্তমান নাম রউফ নগর)[6] গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।[1] তার বাবা মুন্সি মেহেদি হাসান ছিলেন স্থানীয় মসজিদের ইমাম এবং মাতা মুকিদুন্নেসা। তার ডাকনাম ছিলো রব। তার দুই বোনের নাম ছিল জোহরা এবং হাজেরা।[1] তিনি সাহসী ও মেধাবী ছিলেন, কিন্তু লেখাপড়ার প্রতি তেমন ঝোঁক ছিলো না। শৈশবে তার বাবার কাছে লেখাপড়ার হাতেখড়ি হয়।

শিক্ষা ও কর্মজীবন

১৯৫৫ সালে তার পিতার মৃত্যুর পর তিনি বেশিদূর লেখাপড়া করতে পারেন নি। সংসারের হাল ধরতে অষ্টম শ্রেণিতে লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে ১৯৬৩ সালের ৮ মে আব্দুর রউফ যোগ দেন ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসে। সেসময় তাঁকে ৩ বছর বেশি বয়স দেখাতে হয়েছিলো চাকরিটা পাওয়ার জন্য। চুয়াডাঙ্গার ইপিআর ক্যাম্প থেকে প্রাথমিক প্রশিক্ষণ শেষ করে আব্দুর রউফ উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য পশ্চিম পাকিস্তানে যান। ছয় মাস পরে তাঁকে কুমিল্লায় নিয়োগ দেওয়া হয়। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরুতে চট্টগ্রামে ১১ নম্বর উইং-এ (বর্তমানে নাইক্ষ্যংছড়ি ব্যাটালিয়ন ১১ বিজিবি, বান্দরবান)তিনি কর্মরত ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সঙ্গে স্বাধীনতা যুদ্ধে যোগদান করেন।[7][8][9][10][11]

মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা

১৯৭১ সালে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে মুন্সি আব্দুর রউফ তাতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের আগে তিনি চট্টগ্রামে ১১ উইং (বর্তমানে নাইক্ষ্যংছড়ি ব্যাটালিয়ন ১১ বিজিবি, বান্দরবান)-এ চাকুরিরত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলসের ল্যান্স নায়েক[12] হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তিনি মাঝারি মেশিনগান ডিপার্টমেন্টের ১ নং মেশিনগানার হিসেবে দ্বায়িত্ব পালন করতেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর তিনি অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙামাটি-মহালছড়ি জলপথে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। এই জলপথ দিয়ে পাকিস্তানি সশস্ত্রবাহিনীর চলাচল প্রতিরোধের দায়িত্ব পড়ে তার কোম্পানির উপর। কোম্পানিটি বুড়িঘাট এলাকার চেঙ্গিখালের দুই পাড়ে অবস্থান নিয়ে গড়ে তোলে প্রতিরক্ষা ঘাঁটি।

৮ এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনীর দুই কোম্পানি সৈন্য মর্টার, মেশিনগান ও রাইফেল নিয়ে বুড়িঘাটের মুক্তিবাহিনীর নতুন প্রতিরক্ষা ঘাঁটিকে বিধ্বস্ত করতে সাতটি স্পিডবোট এবং দুইটি লঞ্চ নিয়ে এগিয়ে আসতে থাকে। এটি ছিলো পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দ্বিতীয় কমান্ডো ব্যাটালিয়নের (এসএসজি) কোম্পানি। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরক্ষা ঘাঁটির কাছাকাছি পৌঁছেই পাকিস্তানি বাহিনী আক্রমণ শুরু করে। স্পিডবোট থেকে মেশিনগানের গুলি এবং আর লঞ্চ দুইটি থেকে তিন ইঞ্চি মর্টারের শেল নিক্ষেপ করছিলো মুক্তিযোদ্ধাদের দিকে। পাকিস্তানি বাহিনীর উদ্দেশ্য ছিলো রাঙামাটি-মহালছড়ির জলপথ থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের পিছু হটিয়ে নিজেদের অবস্থান প্রতিষ্ঠা।

যেভাবে শহীদ হন

অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মুক্তিযোদ্ধারাও প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পরিখায় অবস্থান নিয়ে নেন। কিন্তু পাকিস্তানি বাহিনীর গোলাগুলির তীব্রতায় প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভেঙে যায় এবং তারা মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক অবস্থান চিহ্নিত করে ফেলে। যুদ্ধের এই পর্যায়ে আব্দুর রউফ বুঝতে পারেন, এভাবে চলতে থাকলে ঘাঁটির সকলকেই পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে মৃত্যু বরণ করতে হবে। তিনি তখন কৌশলগত কারণে পশ্চাৎপসরণের সিদ্ধান্ত নেন। এই সিদ্ধান্ত সৈন্যদের জানানো হলে সৈন্যরা পিছু হটতে শুরু করে। এদিকে পাকিস্তানি বাহিনী তখন খুব কাছে চলে আসে। ফলে সকলে একযোগে পিছু হটতে থাকলে একসাথে সকলকেই মৃত্যুবরণ করতে হতে পারে ভেবে আব্দুর রউফ পিছু হটেন নি। সহযোদ্ধাদের পিছু হটার সুযোগ করে দিতে নিজে পরিখায় দাঁড়িয়ে অনবরত গুলি করতে থাকেন পাকিস্তানি স্পিডবোটগুলোকে লক্ষ্য করে। পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে একা কৌশলে লড়ছিলেন তিনি। তিনি তাদের সাতটি স্পিডবোট একে একে ডুবিয়ে দিলে তারা তাদের দুটি লঞ্চ নিয়ে পিছু হটতে বাধ্য হয়। লঞ্চ দুটো পিছু হটে রউফের মেশিনগানের গুলির আওতার বাইরে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান নেয়। পাকিস্তানি বাহিনী এরপর লঞ্চ থেকে মর্টারের গোলাবর্ষণ শুরু করে। মর্টারের গোলার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা রউফের একার পক্ষে সম্ভব ছিলো না। তবু তিনি চেষ্টা চালিয়ে যান। হঠাৎ একটি মর্টারের গোলা তার বাঙ্কারে এসে পড়ে এবং তিনি শহীদ হন। কিন্তু তার মৃত্যুর আগে সহযোগী যোদ্ধারা সবাই নিরাপদ দূরত্বে পৌঁছে যেতে পেরেছিলো। সেদিন আব্দুর রউফের আত্মত্যাগে তার কোম্পানির প্রায় ১৫০ জন মুক্তিযোদ্ধার জীবন রক্ষা পায়।

সমাধিস্থল

Thumb
রাঙামাটির নানিয়ার চরে তার কবর

শহীদ বীর শ্রেষ্ঠ মুন্সি আব্দুর রউফের সমাধি পার্বত্য জেলা রাঙামাটির নানিয়ার চরে অবস্থিত। তার অপরিসীম বীরত্ব, সাহসিকতা ও দেশপ্রেমের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাঁকে সর্ব্বোচ সম্মান বীর শ্রেষ্ঠ খেতাবে ভূষিত করে। বাংলাদেশ রাইফেলস ১৯৭৩ সালে সিপাহি মুন্সি আব্দুর রউফকে অনারারি ল্যান্স নায়েক পদে মরণোত্তর পদোন্নতি প্রদান করে।[13]

সম্মাননা

২০১৪-এ পিলখানায় বাংলাদেশ রাইফেলস কলেজের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ পাবলিক কলেজ[14] তার স্মৃতিতে শালবাগান, চট্টগ্রাম-রাঙামাটি সড়ক, সাপছড়ির মধ্যবর্তী স্থানে ইঞ্জিনিয়ারিং কন্সট্রাকশন ব্যাটালিয়ন (ECB-16) একটি স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করেছে।[15] মানিকছড়ি, মুসলিম পাড়া, মহালছড়ি, খাগড়াছড়ি এর একটি উচ্চ বিদ্যালয় তার নামে রাখা হয়েছে। সিলেটের একটি ক্রিকেট স্টেডিয়াম তার নামে রাখা হয়েছে।[16] ফরিদপুর জেলার একটি কলেজ তার নামে রাখা হয়েছে, যেটি সরকারিকরণ করা হয়েছে।[6]

চিত্রমালা

আরও দেখুন

টীকা

  1. বিভিন্ন স্থানে তার মৃত্যু তারিখ ২০ এপ্রিল হিসেবে পাওয়া যায়।[2]

তথ্যসূত্র

বহিঃসংযোগ

Wikiwand in your browser!

Seamless Wikipedia browsing. On steroids.

Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.

Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.