Remove ads
উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
বার্মা অভিযান হলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ে বৃটেন শাসিত বার্মায় সংঘটিত হওয়া এমন একটি যুদ্ধ যেখানে বৃটেন ও চীন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগীতায় একজোট হয়ে জাপান, থাইল্যান্ড ও আজাদ হিন্দ ফৌজের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। তৎকালীন ব্রিটিশ সাম্রাজ্য প্রাথমিকভাবে ব্রিটিশ শাসিত ভারত, বৃটেনের নিজস্ব সেনাবাহিনী (৮টি পদাতিক ডিভিশন এবং ৬টি ট্যাংক রেজিমেন্ট) এবং পূর্ব ও পশ্চিম আফ্রিকায় অবস্থিত বৃটেনের ঔপনবেশিক সাম্রাজ্যভুক্ত দেশগুলো থেকে প্রায় ১০,০০,০০০ সৈন্য সমেত স্থল, নৌ ও বিমান বাহিনী গঠন করে বার্মা অভিযান যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। সেই সময় জাপানী সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণে বার্মাতে ব্রিটিশ-বিরোধী কিছু স্বাধীনতাকামী বিদ্রোহী বর্মি-সেনাবাহিনীর দল গড়ে উঠে, যারা যুদ্ধের শুরুতে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে প্রাথমিকভাবে অবরোধ গড়ে তোলায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল।
বার্মা অভিযান | |||||||
---|---|---|---|---|---|---|---|
মূল যুদ্ধ: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ে প্রশান্তমহাসাগরীয় অঞ্চলের যুদ্ধ। | |||||||
স্ক্র্যাগি পর্বতে ইম্ফালের যুদ্ধে ১০ম গূর্খা ডিভিশন কর্তৃক তোলা চিত্রের দৃশ্য। | |||||||
| |||||||
বিবাদমান পক্ষ | |||||||
Medical Support: | থাইল্যান্ড | ||||||
সেনাধিপতি ও নেতৃত্ব প্রদানকারী | |||||||
|
| ||||||
শক্তি | |||||||
| |||||||
হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতি | |||||||
টেমপ্লেট:দেশের উপাত্ত Republic of China (1912–49) ~১১৭,৩৯১ অসুস্থসহ
~86,600 অসুস্থতা ছাড়া[১৫][১৬]
৩,২৫৩ সর্বমোট ক্ষয়ক্ষতি[১৭][১৮][ঙ] মিত্রশক্তি সর্বমোট: ~২,০৭,২৪৪ |
~৫,০০০ অথবা আরো বেশি[২৩] অক্ষশক্তি সর্বমোট: ~২,১০,০০০ | ||||||
250,000[২৪] to 1,000,000[১৫] Burmese civilians killed[চ] | |||||||
|
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এই অভিযানে কিছু উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যের উপস্থিতি পরিলক্ষিত হয়। বার্মার আবহাওয়া, রোগবালাই এবং ভূ-খন্ডের মতো ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য উক্ত অভিযানে বিশেষ প্রভাব ফেলতে দেখা গিয়েছিলো। এই অভিযানে পরিবহন অবকাঠামোর সুযোগ সুবিধাসমূহের অভাবের দরুন সেনাবাহিনীর সদস্যদের যথাসময়ে সরানো ও সৈন্য সরবরাহ এবং আহতদের নিরাপদ জায়গায় পৌছানর ক্ষেত্রে সামরিক প্রকৌশল ও বায়ুপথের উপর বিশেষ জোড় দিতে হয়েছিল। বৃটেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের নিজ নিজ কৌশলের অগ্রাধিকার থাকার দরুন রাজনৈতিক দিক দিয়েও এই অভিযান বেশ জটিল ছিল।
এছাড়া প্রশান্তমহাসাগরীয় অঞ্চল হিসেবে এই অভিযান ছিল মিত্রশক্তির দেশসমূহ কর্তৃক প্রথম কোন স্থল অভিযান, যেটির ভয়াবহতা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ সময় পর্যন্ত গড়িয়েছিল। এই অভিযানের নেপথ্যে কারণ হিসেবে এই অঞ্চলের ভৌগোলিকগত অবস্থানই দায়ী। যুদ্ধের শুরুর দিকে বৃটেন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় অবস্থিত তার কিছু সাম্রাজ্য হারালেও, পরে ভারতীয় এলাকায় জাপানের জয়ের এই অগ্রযাত্রা বন্ধ হয়ে যায়।
অভিযান পরিচালনায় এই অঞ্চলের জলবায়ু বৈশিষ্ট্যগত বর্ষাকালীন বৃষ্টি কার্যকর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। ব্রিটিশ ভারতে দূর্ভিক্ষ ও অন্যান্য রাজনৈতিক বিশৃংখলা এবং নাৎসি জার্মানিকে হারানোর জন্য মিত্রশক্তির দেশসমূহের দেওয়া অগ্রাধিকার মূলত এই অভিযানের সময়কালকে আরো দীর্ঘায়িত করেছিল; যার ফলে এই অভিযান চারটি দশার অবতারণা ঘটায়। যথাক্রমেঃ "জাপান কর্তৃক ব্রিটিশ সাম্রাজ্য আক্রমণ যা ব্রিটিশদের বিতাড়িত করতে বাধ্য করে", "১৯৪২ সালে চীন এবং ব্রিটিশ-ভারতের ব্যর্থতার দরুন বার্মা হাতছাড়া হয়ে যাওয়া", "১৯৪৪ সালে ইম্ফাল ও কোহিমার যুদ্ধে জাপানের বিজয় যা শেষ অব্দি জাপানের ভারত আক্রমণের পথ সুগম করে" এবং "মিত্রশক্তির দেশসমূহের ১৯৪৪-১৯৪৫ এর দিকে বার্মা পুনরুদ্ধার"।
জাপানের প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল বার্মার তৎকালীন রাজধানী এবং গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্র-বন্দর রেঙ্গুন (যা বর্তমানে ইয়াঙ্গুন নামে পরিচিত) দখল করা। ব্রিটিশরা চীনকে স্থলপথে যে সরবরাহ পাঠাতো, সেটি বন্ধ করে দেওয়ার জন্যই মূলত জাপান আত্মরক্ষার এই কৌশল অবলম্বন করেছিল। ১৯৪২ সালের জানুয়ারি মাসে জাপানের পঞ্চদশ সেনাবাহিনীর লেফট্যানেন্ট জেনারেল শজিরো ইদা'র নের্তৃত্বে পদাতিক সেনাবাহিনীর দুইটি বিভাগ থাইল্যান্ডের উত্তরাভিমুখে যাত্রা করে (যেহেতু সেই সময় জাপানের সাথে থাইল্যান্ডের একটি বন্ধুত্বপূর্ণ-চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল) এবং জাপানী সেনাবাহিনীরা থাইল্যান্ডের জঙ্গলাস্তীর্ণ পর্বত হতে বার্মার দক্ষিণ্যের রাজ্য তেনাসেরিমে একটি সামরিক আক্রমণ পরিচালিত করে।
শক্ত প্রতিরোধ জয় করে জাপানীরা অবশেষে সফলতার সাথে কাউকারেইক শহর আক্রমণ করে এবং সালবীন নদীর অববাহিকায় অবস্থিত মৌলাম্যায়াইন শহর দখল করে ফেলে। এরপর জাপানীরা মায়ানমারের উত্তরের দিকে শুরু করলো এবং সফলতার সাথে শক্তিমত্তায় ব্রিটিশদের ছাড়িয়ে যাচ্ছিলো। শেষে ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীর ১৭ম পদাতিক বিভাগ সীতাংগ নদীতে পিছু হটতে চেয়েছিল। কিন্তু ব্রিটিশ-ভারতীয় সেনারা সেখানে পৌছানোর আগে জাপানী সৈন্যরা সেই নদীর একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্রীজে অনেক আগেই পৌঁছে যায়। দখল ঠেকাতে জাপানীরা ব্রীজটি শেষে ধ্বংস করে এবং ধ্বংসের পর থেকে এটি বিতর্কমূলক বিষয়ে পরিণত হয়ে যায়।
১৭ম ব্রিটিশ-ভারতীয় পদাতিক সেনাবাহিনী দুইটি ব্রীজ হারানোর পর বুঝতে পারে যে, রেঙ্গুন শহরকে আর রক্ষা করা যায় নি। আমেরিকা, বৃটেন, ডাচ ও অস্ট্রেলিয়ান সংযুক্ত সেনাবাহিনীর সেনাপ্রধান জেনারেল আর্চিবাল্ড ওয়েভেল তারপরেও তার সেনা সদস্যদের রেঙ্গুন ধরে রাখার নির্দেশ দিয়েছিলেন, যেহেতু তিনি আরো সেনা-সরবরাহ পাবেন বলে বৃটেনের মধ্যপ্রাচ্যের বাকি ঔপনিবেশিক অঞ্চলগুলো থেকে প্রতিশ্রুতি পেয়েছিলেন। প্রতিশ্রুতিমতো সেনাবাহিনীর কিছু ইউনিট এলেও জাপানের আক্রমণের জবাবে বৃটেনের প্রতি-আক্রমণ কার্যত ব্যর্থ হয় এবং রেঙ্গুন শহরটির বন্দর ও তেল-শোধনাগার পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেলে ব্রিটিশ শাসিত বার্মিজ আর্মির নতুন সেনাপ্রধান জেনারেল হ্যারল্ড আলেক্সান্ডার শহরটি পুরোপুরি খালি করার নির্দেশ দেয়। জাপানী সেনাবাহিনী কর্তৃক অবরোধ এড়ানোর জন্য ব্রিটিশ শাসিত বার্মিজ আর্মির অবশিষ্টাংশ শেষে পশ্চাদপসরণ করে।
যুদ্ধক্ষেত্রের পূর্বভাগে ইয়ুনান-বার্মা সড়কের যুদ্ধে চীনা সেনাবাহিনীর ২০০তম বিভাগ তাদের মিত্র দেশ বৃটেনকে সাহায্য করার জন্য মায়ানমারের বর্তমান উপজেলা তংগুতে সংগঠিত হওয়া যুদ্ধের সময় জাপানী সেনাদের কিছু সময়ের জন্য যুদ্ধে ব্যস্ত রাখে। কিন্তু চীনা সৈনিকরা যখন জাপানীদের আটকে রাখতে ব্যর্থ হয়, তখন মিয়ানমারের কায়াহ রাজ্যে অগসর হওয়ার জন্য জাপানের ৫৬তম পদাতিক সেনাদের পথ খুলে যায় এবং লাশিও শহর দখলের জন্য জাপানের সেনাবাহিনী তখন উত্তরের পথ ধরে শান রাজ্যে অগ্রসর হতে থাকে ও ইয়ুনান রাজ্যে চীনা সৈনিকদের পরাস্ত করে শক্তিমত্তায় আরো ছাড়িয়ে যেতে থাকে।
১৯৪২ সালের মার্চ মাসে রেঙ্গুন পতনের পর, মিত্রশক্তিরা চৈনিক সেনাবাহিনীর সহায়তায় বার্মার উত্তরের দিকে শক্তিশালী অবস্থান নিতে শুরু করে। অন্যদিকে বার্মার ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনী ও চীনের সেনাদের পরাস্ত এবং সিঙ্গাপুর দখলে নেওয়ার পর জাপানীরাও সেখান থেকে তাদের সৈন্যদলের অতিরিক্ত দুইটি পদাতিক সেনাবাহিনীর বিভাগ পেয়ে শক্তিশালী অবস্থানে চলে আসে। কিন্তু অন্যদিকে সেই সময় মিত্রশক্তিরা ক্রমবর্ধমান বর্মি বিদ্রোহীদের সম্মুখীন হতে থাকে এবং বার্মার যে জায়গাগুলোতে মিত্রশক্তিরা অবস্থান করছিলো, সেখানকার প্রশাসনিক ব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে ভেঙ্গে পরে। সরবরাহের উৎসসমূহ ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পর মিত্রশক্তির সেনাপ্রধানরা বার্মা থেকে তাদের সৈন্যদল সরিয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়।
ক্ষুধার্ত শরণার্থী, পথভ্রষ্ট ও বিশৃংখল অবস্থা, কাঁচা রাস্তা ও সৈন্যদলদের আহত অবস্থাসহ আরো নানা কারণে বর্ষা শুরু হওয়ার আগেই ব্রিটিশ সেনাবাহিনীরা আর যুদ্ধ না করে মণিপুরের রাজধানী ইম্ফলের পথ ধরে বার্মা থেকে ভারতে চলে আসে। ভারতের তৎকালীন বেসামরিক কর্তৃপক্ষগুলোর কাজের ধীর গতির দরুন তারা সেই সময় চাহিদা মাফিক সৈন্য ও শরণার্থীদের চাহিদায় যথাযথ সাড়া দিতে পারে নি। যার ফলে অনেক সৈন্য এবং শরণার্থীদের সেই সময় বর্ষায় খোলা আকাশের নিচে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে নিজেদের আশ্রয়স্থল খুঁজে নিতে হয়েছিল।
যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হওয়ার কারণে বৃটেনের মিত্র দেশ চীন সেই সময় বৃটেনের যুদ্ধ ছেড়ে পালিয়ে আসার খবর জানতেও পারে নি। যখন অনুধাবন করতে পারলো যে, ব্রিটিশদের সহায়তা ছাড়া জাপানীদের সাথে আর পেরে উঠা যাবে না, ঠিক তখনই জেনারেল চিয়াং কাই-শেক এর অধীনের থাকা কিছু চীনা সৈনিক খুব দ্রুতই এবং বিশৃংখলভাবে যুদ্ধ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে আসে। আর ভারতে আসার পর তাদের আমেরিকার সেনাপ্রধান জেনারেল জোসেফ স্টিলওয়েলের অধীনে অধীনস্থ করা হয়। আহত সৈন্যরা আরোগ লাভের পর তাদের আবারো সু-সজ্জিত করা হয় এবং আমেরিকা সেনা প্রশিক্ষকদের দ্বারা প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। কিন্তু কিছু চৈনিক সৈনিকরা নিকটবর্তী বনাঞ্চলের পথ ধরে ইয়ুনান প্রদেশে ফিরে যেতে চেষ্টা করেছিল, যার মধ্যে অর্ধেকই যাত্রাপথে মারা গিয়েছিল।
ফেসবুকে ১৯৪১ সালের ২১ শে ডিসেম্বর, জাপান ও থাইল্যান্ডের মধ্যে যে চুক্তি সম্পন হয়েছিল সে চুক্তি অনুযায়ী কায়া এবং শান রাজ্য থাইল্যান্ডের অধীনে এবং এই দুইটি রাজ্য ছাড়া বাকি পুরো বার্মা জাপানের অধীনে চলে গিয়েছিল। ড় চুক্তি অনুসারে ১৯৪২ সালের ১০ই মে থাইল্যান্ডের সেনাবাহিনী মিয়ানমারের শান রাজ্যে প্রবেশ করে। পলায়নপর চীনের ৯৩ম বিভাগের সেনাবাহিনীসহ থাইল্যান্ডের নিজস্ব তিনটি পদাতিক বাহিনীর দল ও অশ্বারোহী দল থাই বিমান বাহিনীর সহায়তায় বার্মায় রাজ্য দুইটি দখলে নিয়ে নেয়। শান রাজ্যের অন্যতম শহর কেংতুং-এর উপর থাই সেনাবাহিনীরা মে মাসের ২৭ তারিখে পাকাপাকিভাবে দখল করে ফেলে।
জুলাইয়ের ১২ তারিখে শান রাজ্যের সেনাশাসক জেনারেল ফিন চুনহাভান শান রাজ্যের দক্ষিণে অবস্থিত থাইল্যান্ডের ৩য় ডিভিশনের সেনাবাহিনীদের নির্দেশ দেয় কায়াহ রাজ্য দখল এবং কায়াহ রাজ্যের রাজধানী লইকাউ-এ অবস্থিত চীনের ৫৫তম ডিভিশনের সৈন্যদের তাড়িয়ে দেওয়ার জন্য। মূলত লইকাউ শহরে অবস্থিত এই চৈনিক সেনাগুলো পালাতে পারে নি কারণ যে পথ ধরে ইয়ুনান যায়, সে পথটি থাই আর জাপানী সেনাবাহিনী কর্তৃক পূর্বেই দখল হয়ে গিয়েছিল। শেষে থাই সেনারা অনেক চীনা সেনাদের যুদ্ধ বন্দি হিসেবে আটক করে রাখে।
বর্ষাকাল শেষ হওয়ার পর জাপানীরা তাদের আক্রমণ প্রচেষ্টার আর পুনরাবৃত্তি ঘটায় নি। জাপানীরা বরং জেনারেল বা মাও এর তত্ত্বাবধানে বার্মায় একটি স্বাধীন বর্মি সরকার গঠন করে এবং অং সান-কে সেনা-প্রধান করে বার্মার স্বাধীনতাকামী সৈন্যদের নতুনভাবে গঠন করে তাদের নবগঠিত বার্মা রক্ষার দায়িত্ব ন্যস্ত করে। কিন্তু বাস্তবে, উভয় নবগঠির বর্মি সরকার এবং সেনাবাহিনীরা আসলে জাপানি কর্তৃপক্ষ কর্তৃকই নিয়ন্ত্রিত হতো।
অপরদিকে মিত্রশক্তির বার্মা অভিযানে জাপানীদের সাথে পেরে না উঠা, সামরিক অধ্যয়নে হতাশার সমীক্ষা হিসেবে পরিচয় লাভ করে। সেই সময় বৃটেনের শুধু তিনটি যুদ্ধ অভিযান চালিয়ে যাওয়ার শক্তিমত্তা ছিল; আর সেগুলো হলো দুইটি মধ্যপ্রাচ্যের উভয়প্রান্তে নাৎসি জার্মানিদের বিরুদ্ধে এবং আরেকটি হলো দূরপ্রাচ্যে, যেখানে বৃটেনের যথাযথ সরবরাহের অভাবে যুদ্ধ হারাতে বসছিল। কিন্তু সেই সময় লন্ডন এবং ওয়াশিংটনের মধ্যে যে চুক্তি হয়েছিল সেখানে "জার্মানিই প্রথম" নীতি অর্থাৎ যে করেই হোক জার্মানিকে মধ্যপ্রাচ্যে কোণঠাসা করতে হবে নীতির উপর জোড় দিতে হয়েছিল।
যুদ্ধের জন্য যে প্রস্তুতি সেই সময় মিত্রশক্তিরা গঠন করেছিল, তা মূলত ভারতের পূর্বাংশের অঞ্চলগুলোতে বিশৃংখলা সৃষ্টির কারণে ব্যাপকভাবে বাধাপ্রাপ্ত হয়েছিল। সেই সময় পশ্চিম বঙ্গ ও বিহার রাজ্যে ভারত ছাড়ো আন্দোলন চারদিকে ছড়িয়ে পরেছিল; যা দমন করতে ব্রিটিশদের বৃহৎ সংখ্যক সেনাবাহিনীর প্রয়োগ করতে হয়েছিল। তৎকালীন বাংলা রাজ্যে পঞ্চাশের মন্বন্তর নামক এমনকি একটি সর্বনাশা দূর্ভিক্ষও হয়েছিল, যে দূর্ভিক্ষে ৩ মিলিয়নের মতো মানুষ অনাহারে ও বিভিন্ন রোগবালাইয়ে কারণে মারা গিয়েছিল। এই ধরনের বিশৃংখল পরিবেশে ব্রিটিশদের পক্ষে সম্ভব ছিল না আসামে যুদ্ধ সংক্রান্ত ব্যাপারে নিরবিচ্ছিন যোগাযোগ রাখার এবং স্থানীয় শিল্পকারখানাগুলোকে যুদ্ধের জন্য কাজে লাগানোর। আর তাই যুদ্ধরত বার্মার কাছে ভারতের এলাকাগুলোতে এই অনাহার, দূর্ভিক্ষ ও নানা ধরনের রোগবালাইয়ের মতো প্রতিকূলতার দরুন যুদ্ধরত মিত্রশক্তির সৈন্যদের মনোবল কমে গিয়েছিল যার কারণে তাদের প্রশিক্ষণ প্রক্রিয়া প্রদানে সময় অনেক বেশি লেগেছিল।
কিন্তু এতো প্রতিকূলতার মধ্যেও মিত্রশক্তির সৈন্যরা ১৯৪২ থেকে ৪৩ এর দিকে শুষ্ক মৌসুমে দুইটি সামরিক আক্রমণ পরিচালিত করে। মিত্রশক্তির প্রথম আক্রমণের মধ্যে একটি ছিল বার্মার রাখাইন রাজ্যে। এই আক্রমণের মাধ্যমে ব্রিটিশ-ভারতীয় সেনাবাহিনী মূলত মায়ু উপদ্বীপ এবং আক্যব দ্বীপ দখল করতে চেয়েছিল, যেখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিমান-ঘাঁটি অবস্থিত ছিল। ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর একটি ডিভিশান ডনবাইক নামক একটি জায়গায় অগ্রসর হয়েছিল যেটি ছিল মায়ু উপদ্বীপ থেকে কিছুটা দূরে। কিন্তু জাপানী সৈন্যদের একটি ছোট কিন্তু পরিখা দ্বারা সুরক্ষিত সৈন্যদল ব্রিটিশ সৈন্যদের সেই জায়গায় রুখে দেয়। যুদ্ধের এই পর্যায়ে, মিত্রশক্তিরা অনুধাবন করতে পেরেছিল যে, রণকৌশলগত পরিকল্পনার অভাবের দরুন তাদের দ্বারা জাপানীদের খনন করা পরিখায় অবস্থিত জাপানী সৈন্যদের হারানো সম্ভবপর হবে না। তাই ব্রিটিশ-ভারতীয় সেনাদের নিয়ে পরিচালনা করা মিত্রশক্তির এই পুনঃআক্রমণ শেষ পর্যন্ত বহু ক্ষয়-ক্ষতি সমেত ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। মিত্র শক্তির এই পুনঃআক্রমণের জবাবে মধ্য বার্মা থেকে জাপানী সৈন্যরা সীমান্তবর্তী এলাকায় আসতে শুরু করে এবং দুর্গম নদী ও পর্বত অতিক্রম করে তারা সংখ্যায় মিত্রশক্তির সেনাবাহিনীদের ছাড়িয়ে যেতে থাকে। ক্লান্ত ব্রিটিশ সৈন্যরা যুদ্ধক্ষেত্রে নিজেদের আত্মরক্ষার স্থান ধরে রাখতে পারে নি এবং শেষে যুদ্ধের অনেক সরঞ্জাম পরিত্যাগ করে তাদের নিজেদের ভারতীয় সীমানায় পালাতে বাধ্য হয়।
ব্রিটিশদের দ্বিতীয় আক্রমণ বিতর্কিত ছিল। বিগ্রেডিয়ার অর্ড উইনগেইটের নেতৃত্বে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর বিশেষ দল চিন্ডিটস্, জাপানী সৈন্যদের ফ্রন্ট লাইনে অনুপ্রবেশ করে এবং বার্মার একদম গভীরে অগ্রসর হতে থাকে। এই সামরিক অভিযানের উদ্দেশ্য ছিল বার্মার উত্তর-দক্ষিণ রেলপথ বিনষ্ট করে দেওয়া এবং এই সামরিক অভিযানের কোডনাম দেওয়া হয়েছিল "অপারেশন লংক্লোথ" হিসেবে। ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর প্রায় ৩০০০ সেনাসদস্য বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত হয়ে সেই অভিযানে বার্মায় অনুপ্রবেশ করেছিলো। অনুপ্রবেশকারি এই ব্রিটিশ সৈন্যরা বার্মার উত্তরে রেলপথ বিনষ্ট করে জাপানীদের যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রায় দুই সপ্তাহের জন্য সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। মূলত এই ধরনের অপারেশন আদৌ হয়েছিল কি না সে ব্যাপারে ধৌওয়াশা রয়ে যায় যা থেকে বিতর্কের জন্ম দেয়। অনেকের মতে, মিত্রশক্তির সৈন্য এবং ব্রিটিশ-ভারতীয় সৈন্যদের হারিয়ে যাওয়া মনোবল ফিরানোর জন্য এবং জংগলে লুকিয়ে থাকা জাপানী সৈন্যদের সাথে দৃঢ়তার সহিত যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার জন্যই ব্রিটিশ কমান্ডাররা এমন আত্ম-অপপ্রচার চালিয়েছিল।
ডিসেম্বর ১৯৪৩ থেকে নভেম্বর ১৯৪৪ পর্যন্ত এই সময়গুলোতে বার্মা অভিযানে মিত্রশক্তি তাদের রণকৌশলে সফলতার সাথে পরিবর্তন আনে। মিত্রশক্তির নেতৃত্বদানে উন্নতি, প্রশিক্ষণ এবং সরবরাহে বৃদ্ধি, একসঙ্গে বৃহত্তর অস্ত্রশক্তি এবং বিমান-বাহিনীর ক্রমবর্ধমান শক্তিমত্তা ব্রিটিশ সৈনিকদের যে আত্মবিশ্বাস এনে দিয়েছিল, সেই আত্মবিশ্বাস পূর্বে তাদের কখনই ছিল না। আরাকান রাজ্যে ব্রিটিশ সেনাবাহিনী সফলতার সাথে জাপানী সৈন্যদের প্রতিহত করে এবং জাপানী সৈন্যরা যখন ভারত আক্রমণে অগ্রসর হয়, তখন ব্রিটিশ ভারতীয় সৈন্যরা এই প্রতি-আক্রমণের পালটা জবাব দেয় এবং জাপানী সৈন্যদের চিন্দুইন নদীর পথ ধরে বার্মায় পালিয়ে যেতে বাধ্য করে।
১৯৪৩ সালে মিত্রশক্তিরা জেনারেল লুই মাউন্টবেটেনের নেতৃত্বে "দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া কমান্ড (SEAC)" নামক শুধু দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জন্য একটি আলাদা সৈনা বাহিনীর দল গঠন করে। এছাড়াও ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রেলযোগাযোগের উন্নয়ন সাধন, প্রশিক্ষণ, অস্ত্র-সরঞ্জাম, সেনাসদস্যদের স্বাস্থ্যের উন্নতি এবং মনোবল বাড়ার দরুন জেনারেল উইলিয়াম স্লিমের নেতৃত্বে থাকা বহুজাতিক সৈন্যদল ব্রিটিশ চতুর্দশ সেনাবাহিনীর দিন দিন উন্নতি হতে থাকে। মিত্রশক্তিরা সেই সময় যে বিশেষ নতুন ব্যবস্থার প্রত্যাবর্তন করেছিল, তা হলো বায়ুপথে যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং সৈন্যদলের সরবরাহ।
"দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া কমান্ড (SEAC)" সেই সময় অনেক পরিকল্পনা হাতে নিয়েছিল কিন্তু সঠিক এবং যথাযথ সরবরাহের অভাবের দরুন অনেকগুলো পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা সম্ভবপর হয় নি। যেমনঃ আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ এবং আরাকান রাজ্যে অবতরণের মাধ্যমে যে সামরিক অপারেশনের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছিল, তা ইউরোপে নরম্যান্ডি অবতরণ নামক একটি বিশেষ সামরিক অভিযান পরিচালনার জন্য বিমানগুলো সেখানে পাঠিয়ে দেওয়া হলে গৃহীত সেই সামরিক পরিকল্পনা আর বাস্তবায়ন করা যায় নি।
অপরদিকে মিত্রশক্তির সবচেয়ে বড় পদক্ষেপগুলোর মধ্যে একটি ছিল, জেনারেল চিয়াং কাই-শেক-এর পরামর্শে জেনারেল জোসেফ স্টিলওয়েলের কর্তৃক প্রশিক্ষিত "উত্তর কম্ব্যাট এরিয়া কমান্ড (NCAC)" নামক চীনা সৈনিক দল দ্বারা বার্মা সড়কের বিকল্প হিসেবে লেডো সড়কের নির্মাণ কাজে হাত দেওয়া। রাস্তা নির্মাণের কাজের গতিবেগ বাড়ানোর জন্য জেনারেল অর্ড উইনগেইটকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, তার নের্তৃত্বে থাকা বিশেষ ব্রিটিশ সেনা দল চিন্ডিট যেন চীনা সৈনিকদল "উত্তর কম্ব্যাট এরিয়া কমান্ড (NCAC)" কে সাহায্য করার মাধ্যমে রাস্তা নির্মাণের কাজে অংশগ্রহণ করে এবং উত্তর ফ্রট থেকে আসা জাপানী সরবরাহ বিনষ্ট করতে সহায়তা করে। এছাড়া চৈনিক সেনাবাহিনীর জেনারেল চিয়াং কাই-শেক দ্বিমত পোষণ করলেও পরে চীনের ইয়ুনান প্রদেশ থেকে মিত্রশক্তির জাপানীদের আক্রমণের পরিকল্পনার ব্যাপারে একমত পোষণ করে।
ব্রিটিশ চতুর্দশ সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে, ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীর পঞ্চদশ কোর যখন আরাকান রাজ্যে পুনঃহামলার জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকে, তখন অন্যদিকে ব্রিটিশ-ভারতীয় সেনাবাহিনীর চতুর্থ কোর মণিপুরের রাজধানী ইম্ফালের সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে জাপানীদের যুদ্ধের মাধ্যমে ব্যস্ত রাখে যাতে করে ব্রিটিশ সেনাবাহিনী অন্য ডিভিশন যখন সম্ভাব্য অন্যান্য বৃহৎ হামলাগুলো পরিচালনা করবে, তা থেকে জাপানীদের মনোযোগ যেন বিহ্বল করে দেওয়া যায়।
ঠিক যে সময়ে মিত্রশক্তি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বিশেষ সামরিক তত্ত্বাবধানের জন্য "দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া কমান্ড (SEAC)" গঠন করেছিল, তার ঠিক একই সময়েই জাপানী সেনাবাহিনী লেফটেন্যান্ট জেনারেল মাসাকাজু কাওয়াবের তত্ত্বাবধানে বার্মা এরিয়া সেনাবাহিনী নামের আরেকটি সৈন্যদল গঠন করে যা মূলত জাপানী সেনাবাহিনীর পঞ্চদশ আর্মি এবং নতুনভাবে গঠিত ২৮তম সেনাবাহিনীর নির্দেশনার অধীনে ছিল।
জাপানী সেনাবাহিনীর পঞ্চদশ আর্মির নতুন কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল রেন্যা মুতাগুচি ভারত আক্রমণ করার ব্যাপারে বিশেষ আগ্রহী ছিল। কিন্তু বার্মা এরিয়া সেনাবাহিনী এই আক্রমণের পরিকল্পনা রদ করেছিল। কিন্তু পরে তারা জানতে পারলো যে, সিঙ্গাপুর সদর-দপ্তরে অবস্থিত তাদের ঊর্ধ্বতন জাপানী দক্ষিণ এক্সপেডিশ্যানারি সেনাবাহিনী শাখা এই আক্রমণের ব্যাপারে বিশেষ আগ্রহী। পরবর্তীতে জাপানী সেনাবাহিনীর বিশেষ দল "দক্ষিণ এক্সপেডিশ্যানারি সেনাবাহিনী শাখা'র" সদস্যদের যখন এই আক্রমনের ঝুঁকির ব্যাপারে বুঝানো হয়, তখন অন্যদিকে জাপানী সেনাবাহিনীর এই বিশেষ শাখা এটা জানতে পারে যে টোকিওতে অবস্থিত জাপানী সেনাবাহিনীর সদর দপ্তর মুতাগুচির ভারত আক্রমণের পরিকল্পনার পক্ষে।
জাপানী সেনাবাহিনীরা মূলত সেই সময় ভারতে সামরিক অভিযানের বিষয় নিয়ে আজাদ হিন্দ ফৌজের সেনাপ্রধান সুভাষচন্দ্র বসু কর্তৃক প্রভাবিত ছিল। আজাদ হিন্দ ফৌজের বেশিরভাগ সৈন্যরা ছিল মূলত সিঙ্গাপুরে অবস্থিত ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীর দলের সদস্যরা, যাদের বেশির ভাগই ছিল তামিল জনগোষ্ঠীর। সুভাষচন্দ্র বোসের পরিকল্পনায় আজাদ হিন্দ ফৌজের সৈন্যরা "চলো দিল্লি" নামক একটি সামরিক মার্চে অংশগ্রহণ করে। মুতাগুচি এবং সুভাষ, উভয়ই মূলত বিশ্বাস করতো যে, কার্যকরভাবে ব্রিটিশ শাসিত ভারত আক্রমনের মধ্য দিয়ে সফলতা আসবেই। মুতাগুচির ঊর্ধ্বতন এবং অধস্তনদের ভারত আক্রমণ নিয়ে নানা ধরনের ভয়-আশঙ্কা সাথে নিয়েই শেষ পর্যন্ত ভারতের উত্তর-পূর্বাংশের রাজ্যগুলোতে জাপানী সেনাবাহিনীরা অপারেশন ইউ-গো নামক সামরিক আক্রমণ পরিচালিত করে।[২৫]
জেনারেল স্টিলওয়েলের নের্তৃত্বে মার্কিন অস্ত্র সুসজ্জিত দুইটি চৈনিক সেনাবাহিনীর বিভাগ গঠিত হয় যার মধ্যে একটি ছিল চৈনিক সেনাবাহিনী পরিবাহিত এম-৩ হাল্কা ট্যাংক এবং আরেকটি ছিল মার্কিন সেনাবাহিনীর দূরগামী অনুপ্রবেশকারি ব্রিগেড "মেরিল মারাওডের্স্"।
১৯৪৩ সালে চৈনিক সেনাবাহিনীর ৩৮তম ডিভিশন জেনারেল সান লি-জেন এর নের্তৃত্বে আসামের লেডো সড়ক থেকে বার্মার কাছিন রাজ্যের রাজধানী ম্যিতক্যিনা এবং গুরুত্বপূর্ণ মগুং শহরে আক্রমণের জন্য অগ্রসর হয়। সেই সময় জাপানী সেনাবাহিনীর ১৮তম ডিভিশান শক্তিমত্তার দিক দিয়ে মার্কিনী সেনাবাহিনীর বিশেষ দল মেরিল মারাওডের্সদের ছাড়িয়ে যায় এবং জাপানী সৈন্যরা তখন মার্কিন সেনাবাহিনীর সেই বিশেষ দলের হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
অপরদিকে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর বিশেষ দল চিন্ডিটস কে বার্মার উত্তরে ইন্দ শহরে জাপানীদের যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করার মাধ্যমে মার্কিন জেনারেল স্টিলওয়েল ও তার নের্তৃত্বে থাকা সৈন্যদের সহায়তা করতে হয়েছিল। আর অন্যদিকে ১৯৪৪ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি মিত্রশক্তির সেনাবাহিনীর একটি দল ভারতের উত্তর-পূর্বাংশের রাজ্যগুলোর সাথে বার্মার সীমান্তবর্তী অঞ্চল পাটকাইয়ে সামরিক আক্রমণ পরিচালনার জন্য অগ্রসর হতে থাকে। অপরদিকে ব্রিটিশ বিমান বাহিনী রয়্যাল এয়ার ফোর্স এবং মার্কিন বিমান বাহিনী জাপানী সীমারেখার পিছনে ইন্দ শহরের আশেপাশে একটি জায়গায় অবতরণের জন্য একটি শক্ত বিমান-ঘাঁটি নির্মাণ করে।
ইতোমধ্যে ইয়ুনান রাজ্যে অবস্থিত চীনা সৈনিকেরা এপ্রিল মাসের দ্বিতীয়ার্ধে প্রায় ৭৫,০০০ সৈনিক নিয়ে সালবীন নদী অতিক্রম করে ৩০০ কি.মি. (১৯০ মিটার) অঞ্চলের ভিতর ঢুকে পরে। জেনারেল ওয়েই লিহুয়াং এর নের্তৃত্বে অনুপ্রবেশকারি চীনা সেনাবাহিনীর ১২টি ডিভিশনের ১,৭৫,০০০ জন সৈনিক[৭] জাপানের ৫৬তম ডিভিশনের সেনাদের উপর আক্রমণ শুরু করে। চীনা সৈনিকদের আক্রমণের জবাবে, জাপানী সৈন্যরা বার্মার উত্তরে দুইটি সম্মুখ যুদ্ধে লড়াইয়ে ব্যস্ত হয়ে পরে।
অপরদিকে মে মাসের ১৭ তারিখে ব্রিটিশ বিশেষ সামরিক বাহিনী চিন্ডিটস এর নের্তৃত্ব জেনারেল স্লিম থেকে মার্কিন জেনারেল স্টিলওয়েলের হাতে ন্যস্ত হয়। নতুন জেনারেলের হাতে দায়িত্ব পরার পর ব্রিটিশ বাহিনী চিন্ডিটস জাপানী সীমারেখার পেছন দিক থেকে স্টিলওয়েল ও তার সেনাবাহিনীর আওতাভুক্ত এলাকায় চলে আসে এবং জেনারেল স্টিলওয়েল তাদের কিছু বে-সামরিক কাজের দায়িত্ব অর্পণ করেন, যার দরুন তারা সেই সময় অস্ত্র দ্বারা সজ্জিত ছিল না এবং তাদের ভারত থেকে অন্যত্র সরানো হয়েছিল।
মে মাসের ১৭ তারিখে চীনা সেনাবাহিনীর দুইটি রেজিমেন্ট যথাক্রমেঃ ইউনিট গালাহাড (মেরিল মারাওডের্স) এবং কাছিন গেরিলারা কাছিন রাজ্যের রাজধানী ম্যিতক্যিনায় অবস্থিত জাপানীদের একটি বিমান ঘাঁটি দখল করে ফেলে। যদিও এই শহরের বিমান ঘাঁটি দখল করতে পারলেও মিত্রশক্তির সেনাবাহিনীরা বেশিদিন সেই সাফল্য ধরে রাখতে পারে নি; কেননা ৩ অগাস্টে সেই ম্যিতক্যিনা শহর জাপানীরা আবার পুনঃদখলে সচেষ্ট হয়। কিন্তু তথাপি স্বল্প সময়ের জন্য হলেও মিত্রশক্তির ম্যিতক্যিনা বিমান-ঘাঁটি দখল ভারত থেকে চীনের দক্ষিণ-পশ্চিম শহর চংকিং এ অবস্থিত মার্কিন বিমান ঘাঁটি এবং জেনারেল চিয়াং কাই-শেক-কে তার গৃহীত সামরিক পরিকল্পনায় সাহায্য করার জন্য অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল।
কিন্তু মে মাসের শেষের দিকে চীনা সেনাবাহিনী কর্তৃক চীনের ইয়ুনান প্রদেশ থেকে জাপানীদের হামলার যে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছিল তা বর্ষাকালীন বৃষ্টি এবং বিমান-বাহিনীর সহায়তা ও সরবরাহের অভাবের দরুন বাধাগ্রস্থ হয়ে পরে। জাপানের শক্তিশালী একটি ইউনিটের সৈন্যদলেরা তখন আক্রমণের জবাবে প্রতি-আক্রমণ শুরু করে এবং চীনা সৈনিকদের বার্মার দিকে অগ্রসর হতে বাধা প্রদানে সচেষ্ট হয়।
লেফটেন্যান্ট জেনারেল ফিলিপ ক্রিস্টিসনের নের্তৃত্বে ব্রিটিশ-ভারতীয় সেনাবাহিনীর পঞ্চদশ-কোর আরাকান রাজ্যের মায়ু উপদ্বীপ আক্রমনের জন্য তার নের্তৃতাধীন সৈন্যদের পুনঃনির্দেশ প্রদান করে। কিন্তু এই অভিযান পরিচালনা করতে গিয়ে ব্রিটিশ-ভারতীয় ও বৃটেন শাসিত পশ্চিম-আফ্রিকান বিভাগের সৈন্যদের খাড়া পাহাড়ী রেঞ্জের বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীর ৫ম পদাতিক সৈন্যদল ১৯৪৪ সালে জানুয়ারীর ৯ তারিখ বার্মার রাখাইন রাজ্যের ছোট শহর মংডু দখলে সচেষ্ট হয়। এরপরে ব্রিটিশ-ভারতীয় সেনাবাহিনীর কোরের সেনারা মংডুর সাথে কালাপানজিন উপত্যকা সংযোগকারি একটি রেলপথ সুড়ঙ্গ দখলে অগ্রসর হয় কিন্তু জাপানী সেনারা দখলের জবাবে পাল্টা আক্রমণ শুরু করে। অন্যদিকে জাপানী সেনাবাহিনীর ৫৫তম ডিভিশন মিত্রশক্তির অধিভুক্ত এলাকায় অনুপ্রবেশ করে এবং পশ্চাৎ দিক থেকে এসে ব্রিটিশ-ভারতীয় সেনাবাহিনীর ৭ম ডিভিশনকে আক্রমণ করে সেই ডিভিশনের হেডকোয়ার্টার পর্যন্ত ঢুকে পরে।
পূর্বের ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে মিত্রশক্তিরা যুদ্ধের এই পর্যায়ে শত্রুদের আক্রমণের বিরুদ্ধে আরো দৃঢ়তার সাথে নিজেদের অবস্থান শক্ত করে। যুদ্ধের এই পর্যায়ে ব্রিটিশ সৈনিকরা প্যারাশুটের মাধ্যমে তাদের প্রয়োজনীয় সামরিক সরবরাহ পেতে থাকে। ফেব্রুয়ারির ৫ থেকে ২৩ তারিখের অ্যাডমিন বক্সের যুদ্ধে জাপানীরা ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ব্রিটিশ-ভারতীয় সেনাবাহিনীর চতুর্দশ-কোর এর উপর আক্রমণ শুরু করে আরা আক্রান্ত ডিভিশনকে সহায়তার জন্য ৫ম ডিভিশনের সৈন্যরা গাক্যেদাইয়ুস গিরপথ ধরে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রবেশ করে। ৫ম ডিভিশনের সেনারা যখন ট্যাংক দিয়ে জাপানীদের সাথে যুদ্ধ শুরু করে, তখন সেই আক্রমণের জবাবে প্রতি-আক্রমণ দিতে জাপানী সেনারা ব্যর্থ হয়। যদিও অ্যাডমিন-বক্সের এই যুদ্ধে গড়পরতা হিসাবে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ উভয় দিক থেকে একই ছিল কিন্তু এই যুদ্ধে জাপানীরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষুতিগ্রস্থ হয়েছিল। মিত্রশক্তি এলাকায় জাপানী সৈন্যদের হঠাৎ অনুপ্রবেশ এবং তাদের ঘেরাও কর্মসূচি পরিচালনার রণকৌশল মূলত মিত্রশক্তি সৈন্যদের আতংকিত করতে ব্যর্থ হয়েছিল। আর এই ব্যর্থতার কারণের মধ্যে ছিল জাপানীদের দ্বারা মিত্রশক্তির দেশসমূহের সরবরাহসমূহ দখল করতে না পারার অক্ষমতা।
সেন্ট্রাল ফ্রন্টে নিজেদের সৈন্যসামন্ত বৃদ্ধি করার পরই, পরের সপ্তাহের মধ্যেই ব্রিটিশ-ভারতীয় সেনাবাহিনীর ১৪শ কোর তাদের এই অভিযান শেষ করে। বর্ষাকালের আগমনের পর রেলপথ টানেল দখল করার মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ বাহিনী তাদের অভিযানের সমাপ্তি ঘটায়।
লেফটেন্যান্ট জেনারেল জিওফ্রে স্কুন্স এর নেতৃত্বে ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীর চতুর্থ কোরের দুইটি ডিভিশন চিন্দুইন নদীতে অগ্রসর হয়। যার মধ্যে একটি ডিভিশনকে ইম্ফালে সংরক্ষণ করা হয়। এক গোপনীয় সূত্রে খবর পাওয়া গিয়েছিল যে, জাপানী সেনারা ব্রিটিশদের উপর একটি বৃহৎ আক্রমণ পরিচালনা করতে চলেছে। শেষে জেনারেল স্লিম এবং স্কুন্স তাদের পূর্ব-গৃহীত পরিকল্পনা রদ করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং নতুন পরিকল্পনানুযায়ী জাপানীদের যাতে তাদের সামর্থ্যের সীমারেখা ছাড়িয়ে ব্রিটিশদের সাথে যুদ্ধে অবতীর্ণ করতে বাধ্য করা যায়, সেটি মাথায় রেখেই ব্রিটিশরা তাদের নতুন রণকৌশল প্রণয়নে হাত দিয়েছিল। কিন্তু জাপানীরা ঠিক কব নাগাদ আক্রমণ করবে এবং স্পষ্টত কোন উদ্দেশ্যের জন্য জাপানীরা আক্রমণ করবে সে ব্যাপারে একটা ধৌঁয়াশা ব্রিটিশদের মধ্যে থেকে যায়।
তিনটি পদাতিক ডিভিশন ও "ইয়ামামোটো ফোর্স" নামক একটি ব্রিগেড আকারের সৈন্যদল এবং আজাদ হিন্দ ফৌজের প্রাথমিক রেজিমেন্ট দিয়ে জাপানের পঞ্চদশ সেনাবাহিনী গঠিত হয়। জাপানের ৩৩ম ডিভিশনের সেনাদের দিয়ে কোহিমা দখল করে ইম্ফলকে আলাদা করার মধ্য দিয়ে জেনারেল মুতাগুচি পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন ব্রিটিশ-ভারতীয় সেনাবাহিনীর ৪র্থ কোরের অগ্রসরের সম্মুখভাগ ধ্বংস করে অতঃপর মণিপুর রাজধানী ইম্ফল দখল করার জন্য। ব্রহ্মপুত্র নদের অববাহিকার উপত্যকায় অবস্থিত গুরুত্বপূর্ণ শহর ডিমাপুর দখল করার মাধ্যমে জেনারেল মুতাগুচি রাজধানী ইম্ফল দখলের সুযোগ গ্রহণ চেয়েছিল। মূলত ডিমাপুর শহর দখলের নেপথ্যে কারণ ছিল মূলত মার্কিন জেনারেল স্টিলওয়েল তার মিত্র দেশ চীনের সেনাবাহিনীদের হিমালয়ের হাম্প এলাকার উপর দিয়ে আকাশপথে যে সামরিক সরবরাহ পাঠাতো, তা বন্ধ করাই ছিল জেনারেল মুতাগুচির অন্যতম উদ্দেশ্য।
জাপানী সেনারা মার্চের ৮ তারিখ চিন্দুইন নদী অতিক্রম করে ফেলে। অন্যদিকে জেনারেল স্লিম এবং স্কুন্স তদের নের্তৃত্বাধীন সেনাদের নির্দেশ দিতে বিলম্ব করায় ব্রিটিশ-ভারতীয় সেনাবাহিনীর ১৭শ পদাতিক বাহিনী বার্মার তিদ্দিম অঞ্চলে আটকে পরে। কিন্তু তারপরও এই ডিভিশন লড়াই চালিয়ে যেতে থাকে এবং জেনারেল স্কুন্সের সংরক্ষিত ডিভিশন তাদের সাহায্যের জন্য আকাশপথে প্যারাশ্যুটের মাধ্যমে আটকে পরা ডিভিশনের জন্য সরবরাহ প্রেরণ করতে থাকে। কোহিমার উত্তরের অংশে যখন জাপানের ৩১ম ডিভিশন প্রবেশ করে তখন ব্রিটিশ-ভারতীয় সেনাবাহিনীর ৫০তম প্যারাশ্যুট ডিভিশন জাপানীদের সাথে পেরে উঠতে অসমর্থ হয় এবং শংশক নামক জায়গায় তারা পরাজিত হয়। আর এভাবেই জাপানের ১৫শ সেনাবাহিনীর ডিভিশন দ্বারা ইম্ফল আক্রমণের জন্য আরো সহজতর হয়ে উঠে। কিন্তু অন্যদিকে আরাকানে পরিচালিত জাপানের আক্রমণটি যেহেতু ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়, তাই স্লিম তার ব্রিটিশ-ভারতীয় সেনাবাহিনীর ৫ম ডিভিশনকে আকাশপথে মধ্যে ফ্রন্টে পাঠাতে সক্ষম হয়। দুইটি ব্রিগেড ইম্ফালে পাঠানো হয়; যেখান থেকে একটি ডিমাপুর থেকেই সরাসরি ওখানে চলে যায়।
এপ্রিলের সপ্তাহের প্রথমার্ধেই ব্রিটিশ-ভারতীয় সেনাবাহিনীর ৪র্থ কোরের সৈন্যরা ইম্ফালের কেন্দ্রভূমিতে সংখ্যায় বাড়তে শুরু করে। সেই মাসে জাপানীরা যে আক্রমণগুলো নিজেদের পক্ষ থেকে পরিচালিত করে, তার বেশির ভাগই ব্রিটিশ সৈন্যরা প্রত্যাহত করে। ইম্ফালের উত্তরে মে মাসের শুরুতেই জেনারেল স্লিম এবং স্কুন্স তাদের নের্তৃত্বে থাকা সেনাবাহিনীদের দ্বারা ইম্ফালের উত্তরের অংশে ঘাঁটিগাড়া জাপানের ১৫তম ডিভিশনের সেনাদের উপর প্রতি-আক্রমণ পরিচালনা শুরু করে। বর্ষাকাল শুরু হওয়ার দরুন এবং চতুর্থ কোরের সৈন্যদের সরবরাহের ঘাটতি দেখা দেওয়ায় এই প্রতি-আক্রমণের অগ্রগতি তাই মন্থর ছিল।
এছাড়াও এপ্রিল মাসের শুরুতে লেফটেন্যান্ট জেনারেল কোতোকু সাতোর নের্তৃত্বে জাপানের ৩১ ডিভিশনের সেনাবাহিনীরা কোহিমায় পৌছায়। ব্রিটিশদের সেনাবাহিনীর ছোটদল আক্রমণ এবং জাপানী সেনাদের ডিমাপুরের দিকে অগ্রসর করানোর পরিবর্তে জেনারেল সাতো হিল-স্ট্যাশন নামক জায়গা দখল করার পরিকল্পনা করেন। হিল-স্ট্যাশনের এই দখল ৫ এপ্রিল থেকে ১৮ এপ্রিল পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। নবগঠিত ব্রিটিশ ভারতীয় ত্রয়োত্রিংশ কোরের লেফটেন্যান্ট জেনারেল মন্টাগু স্টপফোর্ড ঐ অঞ্চলে সামরিক অভিযান পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করে। অন্যদিকে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর ২য় পদাতিক ডিভিশনও সেই অঞ্চলে প্রতি-আক্রমণ চালিয়ে যেতে থাকে এবং মে মাসের ১৫ তারিখের দিকে তারা জাপানীদের কোহিমা ব্রীজ ছাড়তে বাধ্য করে। এছাড়াও মিত্রশক্তি পৌছানোর মধ্যবর্তীকালীন সময়ে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর ত্রয়োবিংশ কোর নতুনভাবে আবারো আক্রমণ পরিচালনা করে।
যুদ্ধের এই পর্যায়ে জাপানীরা তাদের সহনশীলতার শেষ প্রান্তে এসে পৌছায়। জাপানীদের সৈন্যদল, বিশেষ করে ১৫শ এবং ৩১শ ডিভিশনের সৈন্যরা ক্ষুধার্থ এবং বর্ষাকালীন সময়ে নানা ধরনের রোগবালাইয়ের সৈন্যদের মধ্যে দ্রুত ছড়াতে থাকে। জেনারেল সাতো জেনারেল মুতাগুচি কে জানিয়ে দিয়েছিল যে, যদি আর সরবরাহ করা না হয়, তবে তিনি তার অধীনে থাকা সৈন্যদের কোহিমা থেকে অন্যত্র সরিয়ে ফেলবেন। যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ থাকলেও সাতো ও তার সৈন্যদল যুদ্ধ না করে পশ্চাদপসরণ করে। যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে সময় ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর চতুর্থ ও একত্রিংশ বাহিনীর কোর ডিমাপুর-ইম্ফাল সড়লে এসে মিলিত হয় এবং এভাইবেই ইম্ফাল দখলমুক্ত হয়।
আর অন্যদিকে মুতাগুচি ও জেনারেল কাওয়াবে নতুনভাবে আক্রমণের নির্দেশ পুনর্বহাল রাখেন। এই দুই জেনারেলের আদেশমতে জাপানের ত্রয়োত্রিংশ ডিভিশন ও ইয়ামোতো বাহিনী যুদ্ধ চালিয়ে গেলেও জুনের শেষের দিকে যুদ্ধজনিত এবং রোগবালাইয়ের দরুন তারা প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির সম্মমুখীন হয়, যার ফলে তাদের আক্রমণ চালিয়ে যাওয়ার মতো আর কোন শক্তি অবশিষ্ট ছিল না। ইম্ফাল অভিযানের শেষমেষ পাকাপাকিভাবেই জুলাই মাসে সমাপ্ত হয় এবং ব্যাথিত মনোবল নিয়ে জাপানীরা চিন্দুইন নদীর পথধরে পশ্চাদপসরণ করে।
জাপানের ইতিহাসে এটি অন্যতম পরাজয় হিসেবে বিবেচিত হয়। সেই যুদ্ধে জাপানের প্রায় ৫০-৬০,০০০ এর মতো সৈনিক নিহত হয়[২৬] এবং ১,০০,০০০ বা তার চেয়ে বেশি সৈনিক আহত হয়।[২৭] আর জাপানী সৈনিকদের বেশিরভাগ ক্ষয়ক্ষতিই রোগবালাই, অপুষ্টি এবং যুদ্ধকালীন অবসাদ থেকে। মিত্রশক্তিদেরও এই যুদ্ধে প্রায় ১২,৫০০ জন সৈনিকদের নিয়ে ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়, যার মধ্যে ২,২৬৯ জনই যুদ্ধে নিহত হয়েছিল।[২৮] এই যুদ্ধে পরাজয়ের পরে জেনারেল মুতাগুচি তার অধীনস্থ সেনাবাহিনীর ডিভিশনের সেনাপ্রধান এবং সাথে নিজেকেও তার দায়িত্বপ্রাপ্ত পথ থেকে অব্যাহতি দিয়ে দিয়েছিল।
অগাস্ট থেকে নভেম্বর মাসের বর্ষাকালীন সময়গুলোতে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর চতুর্দশ সৈন্যদল জাপানীদের খোঁজার জন্য চিন্দুইন নদীর দিকে অগ্রসর হতে থাকে। যখন ব্রিটিশ শাসিত পূর্ব-আফ্রিকান ডিভিশনের সেনাবাহিনীরা কাবাউ উপত্যকাতে অগ্রসর হয়, তখন অন্যদিকে ব্রিটিশ-ভারতীয় সেনাবাহিনীর ৫ম ডিভিশন তিদ্দিম পর্বতের দিকে। নভেম্বরের শেষের দিকে ব্রিটিশ সৈন্যদল কালেওয়া পুনরুদ্ধার এবং চিন্দুইন নদীর তীরে অনেকগুলো আক্রমণের পাদভূমি তৈরী করে।
১৯৪৪ সালের শেষের দিক এবং ১৯৪৫ সালের প্রথম দিকে মিত্রশক্তিরা বার্মায় অনেকগুলো সামরিক আক্রমণ পরিচালনা করে। এছাড়াও ১৯৪৪ সালে মিত্রশক্তি তাদের যুদ্ধক্ষেত্রের সম্মুখভাগ অবস্থানের পরিবর্তন সাধন করে। "একাদশ সেনাবাহিনী সদর দপ্তর" "দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মিত্রশক্তির স্থলবাহিনী" নামক নতুন সামরিক শাখা কর্তৃক প্রতিস্থাপিত হয় এবং "উত্তর কম্ব্যাট এরিয়া কমান্ড (NCAC)" এবং ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর চতুর্দশ কোরও এই নতুন সামরিক শাখার সদর দপ্তর কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হতে শুরু করে। যদিও সেই সময় মিত্রশক্তিরা চীনকে স্থলপথে সরবরাহ পাঠানোর জন্য লেডো রোড নির্মাণ কাজ শেষ করতে চাইছিল, কিন্তু আদতে এই রোড নির্মিত না হলেও যুদ্ধক্ষেত্রে চীনের উপর কোন বিরূপ প্রভাব পরতো না।
অন্যদকে জাপানী সৈন্যরাও ঊর্ধ্বতনদের আদেশে তাদের যুদ্ধক্ষেত্রের কৌশলে অনেক পরিবর্তন সাধন করতে থাকে। এই পরিবর্তনের মধ্যে একটি ছিল জেনারেল কাওয়াবের পরিবর্তে বার্মা এরিয়া আর্মিতে সেনাপ্রধান পদে জেনারেল হ্যোতারো কিমুরা কে আসীনকরণ। কিন্তু পদে বসার পর জেনারেল কিমুরা চিন্দুইন নদীতে মিত্রশক্তির সাথে যুদ্ধ করতে অস্বীকৃতি জানায়। এছাড়া যুদ্ধক্ষেত্রে সরঞ্জামের ঘাটতি এবং সৈন্যদের অবস্থা শোচনীয় হওয়ায় তিনি ইরাবতি নদী থেকেও অপসৃত করার সিদ্ধান্ত নেন।
ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর পঞ্চদশ কোর আরাকান রাজ্যে তাদের ধারাবাহিকতার তৃতীয় বর্ষে আক্যব দ্বীপের দিকে অগ্রসর হওয়ার অভিযান অব্যাহত রাখে। যুদ্ধের এই পর্যায়ে জাপানীরা শারীরিক ও মানসিকভাবে এতোটাই দূর্বল হয়ে পরেছিল যে, মন্থরগতিতে চলমান মিত্রশক্তির আগমনের আগেই জাপানীরা যুদ্ধ না করে পশ্চাদপসরণ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল। জাপানীরা ১৯৪৪ সালের ৩১শে ডিসেম্বর যুদ্ধ ছেড়ে আক্যব দ্বীপ থেকে প্রস্থান করে। আর তাই কোন বাধা-বিপত্তি ছাড়াই ব্রিটিশ সেনাবাহিনী ১৯৪৫ সালের জানুয়ারীর ৩ তারিখ আক্যব দ্বীপের পুনরাধিকার অর্জন করে। ইতোমধ্যে অভিযানের নিমিত্তে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর জন্য অবতরণের বিমানও তাদের সামরিক সরবরাহে চলে এসেছিল। অন্যদিকে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর পঞ্চদশ কোর স্থল ও বিমান হামলার মাধ্যমে রাখাইন রাজ্যের রাজধানী সিত্বে অবস্থিত ম্যেবন উপদ্বীপও আবার পুনঃদখলে আনে এবং ম্যেবন উপদ্বীপ দখলের ১০ দিন পরে কাংগউ নামক জায়গায় হিল ১৭০ এর যুদ্ধে পলায়নরত জাপানী সেনাদের উপর ব্রিটিশ সেনাবাহিনী হামলা চালায়। জানুয়ারি মাস শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত বার্মায় ব্রিটিশ আর জাপানীদের মধ্যে দফায় দফায় যুদ্ধ সংগঠিত হয়, যে যুদ্ধগুলোতে মূলত জাপানীরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
সেই সময় ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর পঞ্চদশ কোরের অন্যতম উদ্দেশ্যগুলোর মধ্যে একটি ছিলঃ রাখাইন রাজ্যে অবস্থিত রামরী দ্বীপ এবং চেদুবা দ্বীপ দখল করে মিত্রশক্তির জন্য একটি শক্ত বিমান ঘাঁটি তৈরী করা যাতে করে তারা আকাশপথ ব্যবহার করে বার্মায় তাদের সামরিক অভিযান চালিয়ে যেতে পারে। অনেক জাপানী সৈন্যই রামরী দ্বীপের যুদ্ধে নিহত হয়েছিল। ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর চতুর্দশ ডিভিশনের সৈন্যদের সাহায্য করার জন্য পঞ্চদশ সেনাবাহিনীকে সেই সময় তাদের সামরিক অভিযান সংকুচিত করতে হয়েছিল।
চীনের মেইন ফ্রন্টে মিত্রশক্তির সেনাপ্রধান দ্বারা গঠিত "উত্তর কম্ব্যাট এরিয়া কমান্ড (NCAC)" দূর্বল হিসেবে প্রমাণিত হলেও, ১৯৪৪ সালে সামরিক বাহিনীর এই বিশেষ শাখাটি তাদের সামরিক অগ্রসরতা অব্যাহত রাখে। ১৯৪৪ সালের ডিসেম্বরের ১০ তারিখে "উত্তর কম্ব্যাট এরিয়া কমান্ড (NCAC)" এর পার্শ্ববাহিনী ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর ৩৬শ পদাতিক বাহিনীর ডিভিশন, ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর চতুর্দশ ডিভিশনের সৈন্যদের সাথে উত্তর বার্মার ইন্দ নামক জায়গায় যোগাযোগ স্থাপন করে। আর এর পাঁচ দিন পরেই মিত্রশক্তির তত্ত্ববধানে গঠিত চীনা সেনাবাহিনীর "উত্তর কম্ব্যাট এরিয়া কমান্ড (NCAC)" কাছিন রাজ্যে অবস্থিত মায়ানমারের গুরুত্বপূর্ণ শহর ভামো দখল আনে।
উত্তর কম্ব্যাট এরিয়া কমান্ড (NCAC) এর চীনা সৈনিকেরা আবার ১৯৪৫ সালের ২১শে জানুয়ারি ইয়ুনান প্রদেশে অবস্থিত চিয়াং কাই-শেকের সৈন্যদের সাথে যোগাযোগ করে। আর তখন তারা জানতে পারে যে, মিত্রবাহিনী কর্তৃক চীনা সৈনিকদের সামরিক সহায়তার জন্য যে লেডো রোডের কাজ নির্মানাধীন ছিল, তাও সমাপ্ত হয়ে যায়, যদিও যুদ্ধের এই পর্যায়ে এসে লেডো রোডের আর কোন প্রয়োজনীয়তা আছে কি না সে ব্যাপারে সন্দেহ থেকে যায়। অন্যদিকে চিয়াং কাই-শেক উত্তর কম্ব্যাট এরিয়া কমান্ড (NCAC) এর সেনাপ্রধান ড্যানিয়েল ইসোম সুলতানের সাথে যোগাযোগ করে তাদের সামরিক অগ্রযাত্রা বন্ধ করার পরামর্শ দেয়, কেননা যে লাশিও দখলের জন্য উত্তর কম্ব্যাট এরিয়া কমান্ড (NCAC) অগ্রসর হচ্ছিলো, তা অনেক আগেই ৭ই মার্চ দখল হয়ে গিয়েছিলো। এটি মূলত ব্রিটিশদের পরিকল্পনাকে বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছিল, কেননা ব্রিটিশরা চেয়েছিল বর্ষা শুরু হওয়ার আগে মে মাসের শুরুতে যেন ইয়াঙ্গুনে তারা পৌছাতে পারে। সেই সময় তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল সরাসরি মার্কিন বাহিনীর প্রধান জর্জ মার্শালকে এই বলে বার্তা পাঠিয়েছিল যে, উত্তর কম্ব্যাট এরিয়া কমান্ড (NCAC) এর জন্য বরাদ্দকৃত বিমানগুলো যেন বার্মাতেই রাখা হয়।[২৯] অন্যদিকে এপ্রিলের ১ তারিখ থেকে উত্তর কম্ব্যাট এরিয়া কমান্ড (NCAC) তাদের সামরিক অভিযান সেই দিন থেকে বন্ধ করে ভারত এবং চীনে ফেরত যায়। তাদের পরিবর্তে "ওএসএস ডিটাচম্যান্ট ১০১" নামক মার্কিন বিশেষ গেরিলা দল উত্তর কম্ব্যাট এরিয়া কমান্ড (NCAC) এর অবশিষ্ট সামরিক দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেয়।
ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর চতুর্দশ ডিভিশন, ব্রিটিশ বাহিনীর বাকি চতুর্থ কোর এবং ত্রয়োত্রিংশ কোর কে সাথে নিয়ে বার্মায় একটি বৃহৎ সামরিক আক্রমণ পরিচালিত করে। যদিও ইরাবতি নদী থেকে জাপানী সৈন্যরা পালিয়ে যাওয়ার কারণে মিত্রশক্তিদের সামরিক পরিকল্পনায় পরিবর্তন আনতে হয়েছিল; কিন্তু তথাপি এর মাধ্যমে মূলত মিত্রশক্তির শক্তিমত্তারই প্রতিফলন হয়েছিল। যখন ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর ত্রয়োত্রিংশ ডিভিশন রেঙ্গুনের উত্তরে অবস্থিত গুরুত্বপূর্ণ শহর মান্ডলে-তে অগ্রসর হচ্ছিল, তখন অপরদিকে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর চতুর্থ কোর-কে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল ইরাবতি নদীর তীরে অবস্থিত পোকোক্কু নামক জায়গা এবং বার্মার মধ্যবর্তী শহর মেইকতিলাতে অবস্থিত জাপানীদের যোগাযোগ-সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিতে।
১৯৪৫ সালের জানুয়ারি এবং ফেব্রুয়ারির মধ্যবর্তী সময়ে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর ত্রয়োত্রিংশ কোর ইরাবতি নদীর কাছাকাছি অবস্থিত মান্ডলে শহর দখল করতে সক্ষম হয়। মান্ডলে পুনরুদ্ধারের সময় ব্রিটিশ এবং জাপানীদের মধ্যে অনেক যুদ্ধ হয়েছিল। মূলত এই যুদ্ধে জাপানীদের সংরক্ষিত সৈন্যদের উপর আক্রমণ করা হয়। সেই একই ফেব্রুয়ারি মাসে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর চতুর্থ কোর দ্বারা পরিচালিত ব্রিটিশ-ভারতীয় সেনাবাহিনীর ৭ম ডিভিশন পোকোক্কু শহর সফলভাবে দখল করে। এছাড়াও এই ডিভিশনটির পশ্চাতে ব্রিটিশ-ভারতীয় সেনাবাহিনীর ১৭তম এবং ২৫৫তম ডিভিশনও তাদের অনুসরণ করতে করতে শেষে মেইকতিলা শহরে এসে থামে। মধ্য বার্মার উন্মুক্ত ভূখন্ডে, ব্রিটিশ-ভারতীয় এই বিশেষ শাখা রণকৌশলে জাপানীদের ছাপিয়ে যায় এবং মার্চের ১ তারিখ ব্রিটিশরা মেইকতিলা দখলে আনতে সফল হয়। এই যুদ্ধ চারদিনের মাথায় সমাপ্ত হয়।
জাপানীরা চেয়েছিল মেইকতিলাতে তাদের সৈন্যদের পুনর্বহাল করে, সেখানে থাকা ব্রিটিশ সৈন্যদের হটিয়ে শহরটি আবার পুনর্দখল করতে। কিন্তু জাপানীদের সামরিক আক্রমণ রণকৌশল দিক দিয়ে দূর্বল ছিল যার কারণে তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছিল। মার্চ মাসের শেষের দিকে জাপানীরা যুদ্ধক্ষেত্রে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিল এবং সেই যুদ্ধে জাপানীরা অনেক কামান এবং ট্যাংক-বিধ্বংসী অনেক অস্ত্র হারিয়েছিল। শেষে পেরে না উঠে জাপানীরা আক্রমণ থামিয়ে দেয় এবং প্যাবুয়ে নামক জায়য়ায় পালিয়ে আসে।
ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর ত্রয়োত্রিংশ কোর মান্ডলে শহরে তাদের আক্রমণ আবারো পরিচালিত করে। এছাড়া ব্রিটিশ সেনাবাহিনী সেখানে জাপানীদের একটি দুর্গতেও আক্রমণ করে যেটি জাপানীরা প্রায় এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে নিজেদের দখলে ধরে রেখেছিল। সাংস্কৃতিক এবং ঐতিহ্যগত নিদর্শন সংবলিত মান্ডলে শহর যা কিছুর অস্তিত্ব ছিল, তার সবকিছুই সেই সময় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের রণক্ষেত্রে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল।
যদিও মিত্রশক্তিরা সাফল্যের সাথে বার্মার মধ্যাংশে অগ্রসর হতে পেরেছিল কিন্তু সংকট এড়ানোর জন্য বর্ষা শুরু হওয়ার আগেই মিত্রশক্তিদের রেঙ্গুনের বন্দর দখল করা অত্যাবশকীয় হয়ে পরেছিলো। এছাড়াও ১৯৪৫ সালের বসন্তে রেঙ্গুন দখলের নিমিত্তে তাড়াহুরা করার জন্য অন্যতম কারণগুলোর মধ্যে একটি ছিল গোয়েন্দা সংগঠন ফোর্স ১৩৬ গঠন, যা দ্বারা জাপান কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত বর্মি জাতীয়তাবাদি সৈন্যদলদের মধ্যে বিদ্রোহ সৃষ্টি করার প্রয়াসে মিত্রশক্তিরা এই সংস্থা গঠন করেছিল। এছাড়া সেই সময় মিত্রশক্তিরা জাপানের দিকে যতোই এগিয়ে আসছিল, জাপানী সৈন্যদের মধ্যে ততোই নিজেদের মধ্যে প্রকাশ্য বিদ্রোহ ফুঁটে উঠছিলো।
জাপানী সেনাবাহিনীর অষ্টাবিংশ ডিভিশনের শক্ত প্রতিরোধের সত্ত্বেও ব্রিটিশ বাহিনীর ত্রয়োত্রিংশ কোর ইরাবতি নদীতে সামরিক আক্রমণ চালিয়ে অগ্রসর হচ্ছিলো। ব্রিটিশ বাহিনীর চতুর্থ কোর "রেলপথ উপত্যকায়" আরেকটি বড় ধরনের সামরিক আক্রমণ পরিচালিত করে, যেটি "সীতাং নদীর" পেছনেই ছিল। এই আক্রমণের প্রারম্ভ তারা করেছিল মূলত প্যাবুয়ে গঞ্জে অবস্থিত জাপানের ত্রয়োত্রিংশ ডিভিশনের অবশিষ্ট সৈনিকদের আক্রমণের মধ্য দিয়ে। সেই সময় শুষ্ক জলপথে অবস্থানরত জাপানী সেনারা প্রথম দিকে আক্রমণের জবাবে প্রতি-আক্রমণের জবাব দিলেও, পরবর্তীতে ভারি ট্যাংক এবং যান্ত্রিক অস্ত্রসমেত বাকি পদাতিক ব্রিটিশ সেনাবাহিনীরা যখন জাপানী সৈনিকদের পেছনে আসতে থাকে, তখন সেখানেই জাপানের ঐ ডিভিশনের বাকি সৈন্যদের হার মানতে হয়।
এছাড়াও জাপানী সেনাবাহিনীদেরও শুরুর দিকে কিন্তু রেঙ্গুন দখল করার প্রচেষ্টা অতোটা সহজ ছিল না। রেঙ্গুনে অগ্রসর হওয়ার সময় জাপানের পঞ্চদশ ডিভিশনের সেনাবাহিনীর তাঙ্গু নামক জেলায় ব্রিটিশ প্রভাবিত কারেন জাতিগোষ্ঠীর (মায়ানমারে অবস্থিত চৈনিক-তিব্বতীয় জাতিগোষ্ঠী) প্রতিরোধের সম্মুখীন হতে হয়েছিল। একইভাবে মিত্রশক্তিরাও রেঙ্গুনে পৌছানোর সময় এপ্রিলের ২৫ তারিখ উত্তর রেঙ্গুনের বাগো অঞ্চলে জাপানের পশ্চাদ্ভাগরক্ষী সৈনিকদের আক্রমণের সম্মুখীন হতে হয়। জেনারেল হেইতারো কিমুরা সেই সময় শেষ রক্ষার জন্য কর্মরত জাপানী সৈনিক, নৌ-সৈনিক, এমনকি রেঙ্গুনে অবস্থিত বে-সামরিক জাপানী নাগরিকদেরও ১০৫ স্বাধীনতাকামী মিশ্র ব্রিগেডে অন্তর্ভুক্ত করেছিলো। এই মিশ্র সামরিক সংগঠন ততটা পরিপক্ব না হলেও ব্রিটিশ সেনাবাহিনীদের প্রায় ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত রুখে রেখেছিল এবং রেঙ্গুনে জাপানীদের ক্ষয়ক্ষতির ফলে যে শূণ্যতার সৃষ্টি হয়েছিল, তা ততদিন পর্যন্ত ঐ মিশ্র সামরিক সংগঠনটি দ্বারা পরিপূর্ণ হয়েছিল।
ব্রিটিশদের সামরিক সরবরাহে যে সংকট দেখা দিয়েছিল তা প্রশমিত করার জন্য ব্রিটিশ সেনাবাহিনীদের চতুর্দশ ডিভিশন মূল রাজধানীতে পৌছার আগেই ব্রিটিশ বাহিনীর পঞ্চদশ বাহিনীকে রেঙ্গুনে আকাশ ও স্থলপথে একটি উভচর সামরিক আক্রমণ পরিচালিত করতে হয়েছিল। যুদ্ধে সহায়তার জন্য অবতরণের যে বিমানগুলো ইউরোপে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিলো, তার দরুন অনেকবারই অপারেশন ড্র্যাকুলা নামক এই উভচর অভিযান মূলতবি করা হয়। কিন্তু শেষতক থাইল্যান্ডের ফুকেট দ্বীপে বিমান হামলার মাধ্যমে এই অভিযান কার্যকর হয়।
অন্যদিকে জেনারেল স্লিম আশঙ্কা করছিলেন যে, বর্ষাকালকে কাজে লাগিয়ে জাপান তার শেষ সৈন্য পর্যন্ত রেঙ্গুনকে যে কোন উপায়েই রক্ষা করবে, যেটা পরিণামে ব্রিটিশ চতুর্দশ সেনাবাহিনীকে সরবরাহের ক্ষেত্রে বিপদের দিকে ঠেলে দিতে পারে। সেই দৃষ্টিকোণ থেকেই জেনারেল স্লিম খুব স্বল্প সময়ের মধ্যে অভিযান ড্র্যাকুলা পরিচালনা করার সিদ্ধান্ত নেয়। ফুকেটে হামলার জন্য যেসব নৌ-সৈন্যরা নিযুক্ত ছিল, তাদের সেখান থেকে ফিরিয়ে এনে অভিযান ড্র্যাকুলার অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং অন্যদিকে আক্যব এবং রামরী দ্বীপ থেকে চতুর্দশ ডিভিশনের সৈন্যদের আনা হয় স্থল পথে অভিযানের কার্যকর করার জন্য।
মে মাসের এক তারিখে গূর্খা প্যারাশ্যুট ব্যাটালিয়ন কে আনা হয় এলিফ্যান্ট পয়েন্টে এবং তাদের দ্বারা অভিযান পরিচালনা করে ইয়াঙ্গুন নদীর অববাহিকা থেকে অবশিষ্ট জাপানী সৈন্যদের পরাস্ত করা হয়। ব্রিটিশ-ভারতীয় সেনাবাহিনীর ২৬তম ডিভিশন কে এর পরের দিন জাহাজযোগে সেখানে আনা হয়। তারা যখন সেখানে এসে উপস্থিত হয়, তখন তারা আবিষ্কার করলো যে, প্রতিপক্ষের জাপানী জেনারেল কিমুরা ২২ তারিখেই রেঙ্গুন থেকে জাপানী সৈনিকদের খালি করার নির্দেশ দিয়ে ফেলেছিলেন। জাপানীরা ইয়াঙ্গুন ত্যাগ করার পূর্বে সেখানে ব্রিটিশরা আসার আগ পর্যন্ত লুটপাট এবং আইন-বিহীন নানা ধরনের অপরাধ সংগঠিত হয়েছিল। ১৯৪৫ সালের মে মাসের ২ তারিখের দুপুরে বর্ষাকালীন মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়েছিল। মূলত বৃষ্টি শুরু হওয়ার কিছু ঘণ্টা আগেই মিত্রশক্তিরা রেঙ্গুনকে জাপানী সৈন্যদের থেকে মুক্ত করেছিল।
শেষে মে মাসের ৬ তারিখে এই অভিযানে নেতৃত্বদানকারি ১৭তম এবং ২৬তম ডিভিশন রেঙ্গুনের দক্ষিণে ৪৫ কি.মি. (২৮ মাইল) এলাকায় লেগু নামক অঞ্চলে এসে মিলিত হয়।
রেঙ্গুন দখলের পর ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর ত্রয়োত্রিংশ কোরের যে অবশিষ্ট সৈন্যসামন্ত বার্মায় রয়ে গিয়েছিল, তাদের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য ত্রয়োত্রিংশ ডিভিশন থেকে দ্বাদশ ডিভিশনের একটি সদর দপ্তর গঠন করা হয়।
ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর ত্রয়োত্রিংশ কোরের সেনাবাহিনীদের ইরাবতি উপত্যকায় প্রতিরোধ এবং আরাকান রাজ্যে থেকে পালিয়ে আসার পর জাপানের অষ্টাবিংশ ডিভিশনের সেনাবাহিনীরা মধ্য-বার্মার ইরাবতি এবং সিত্বাং নদীর মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত বনাঞ্চলে ঢাকা পেগু পাহাড়ী অঞ্চলে অবস্থান গ্রহণ করে। জাপানের ঐ ডিভিশনের সেনাবাহিনীরা মূলত সেই সময় তাদের সেনাবাহিনীর পুনর্জাগরণ ঘটানোর জন্য বার্মা এরিয়া সেনাবাহিনীর সাথে যোগদানের সিদ্ধান্ত নেয়। এই পুনর্জাগরণ সফল করার জন্য জাপানী জেনারেল কিমুরা জাপানী সেনাবাহিনীর ত্রয়োত্রিংশ ডিভিশনের বার্মা এরিয়া সেনাবাহিনীর সাথে যোগদান করে সিত্বাং নদীর ধারে একটি সামরিক আক্রমণ পরিচালনা করার নির্দেশনা প্রদান করে। জুলাইয়ের ৩ তারিখ তারা সিত্বং নদীর মোড়ে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর অবস্থানে আক্রমণ চালায়। কিন্তু জুলাইয়ের ১০ তারিখে বার্মা জুড়ে বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে জাপান এবং মিত্রশক্তি উভয়ই যুদ্ধ প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেয়।
বন্যা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে জাপানীরা খুব তাড়াতাড়ি পুনঃআক্রমণ চালায়। কিন্তু ১৭ জুলাইয়ের আগ পর্যন্ত জেনারেল শোজো সাকুরাইয়ের সেনাবাহিনীরা এই যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত ছিল না। যার ফলে জাপানী সেনাদের সামরিক অভিযানের এই পুনর্জাগরণ তাদের জন্য দূর্যোগ হয়ে দেখা দেয়। জাপানীদের যেসব জায়গায় অবস্থান নেওয়ার কথা ছিল, ব্রিটিশ সেনাবাহিনীরা কামান সমেত পূর্ব থেকে ঠিক সেইসব জায়গায় লুকিয়ে অবস্থান নিয়েছিল। অপরিপক্ব বাঁশের ভেলা দিয়ে সিত্বাং নদী পার হওয়ার সময় শ'খানেক জাপানী সৈন্য নদীতে ডুবে নিহত হয়। অন্যদিকে বার্মার গেরিলা সৈন্যরা নদীর পূর্ব দিকে পথভ্রষ্ট হয়ে আসা অনেক ব্রিটিশ সৈনিকদের হত্যা করতে সক্ষম হয়। কিন্তু তারপরও সেই যুদ্ধে জাপানীরা প্রায় ১০,০০০ এর মতো সৈনিক হারায়, যা ছিল জাপানের অষ্টাবিংশ সেনাবাহিনীর অর্ধেক। কিন্তু ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর ক্ষয়ক্ষতির দিক দিয়ে পরিমাণ ছিল যৎসামান্য।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া পাকাপাকিভাবে নিজেদের দখলে আনার অভিযান পরিকল্পনার জন্য মিত্রশক্তির জেনারেল মাইলস ডেম্পসের নের্তৃত্বে থাকা ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর চতুর্দশ এবং পঞ্চদশ কোর ভারতে ফিরে যায়। জেনারেল অভ্রি লিনফিল্ড রবার্টসের নেতৃত্বে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর নতুন চতুর্ত্রিংশ কোর গঠন করা হয় এবং চতুর্দশ সেনাবাহিনীকে দায়িত্ব দেওয়া হয় তা দেখা শোনা করার জন্য।
মূলত মালয় অঞ্চলের পশ্চিম পার্শ্বে অভিযান জিপার নামক এই উভচর (স্থল ও আকাশপথ) অভিযান পরিচালনার নিমিত্তে এই নতুন ডিভিশন গঠন করা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পারমাণবিক বোমা হামলার কিছু আগে এই অভিযান পরিচালিত হওয়ার কথা থাকলেও দ্রুততম সময়ে মালয় অঞ্চল দখল করার জন্য এটি যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে পরিচালিত হয়।
বার্মা অভিযানের সামরিক এবং রাজনৈতিক ফলাফল মিত্রশক্তিদের মধ্যে বাদানুবাদের পরিবেশ সৃষ্টি করে। বার্মা অভিযানের চূড়ান্ত পরিণতি আসার আগ পর্যন্ত সেই সময় বার্মা মূলত জাপানীদের অধীনেই ছিল। কিন্তু সেই সময় সম-সাময়িক মার্কিন কর্তৃপক্ষ এবং অনেক মার্কিনী ইতিহাসবেত্তা মতামত হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন যে, চীন এবং প্রশান্তমহাসাগরীয় অঞ্চল থেকে জাপানের স্থল-বাহিনীর মনোযোগ সরিয়ে দেওয়ার জন্যই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বার্মা অভিযানের এই প্রারম্ভ। তথাপি অন্যদিকে ব্রিটিশ-ভারতীয় সেনাবাহিনীরা সফল বার্মা অভিযানের এই ফলাফলকে নিজেদের গৌরব এবং বিজয় হিসেবেই ব্যক্ত করছিল। কিন্তু যুদ্ধের পূর্বে ব্রিটিশ-শাসিত বার্মায় বার্মার মানুষদের মধ্যে স্বাধীনতার যে আন্দোলন মাথা-চাড়া দিয়ে উঠেছিল এবং যুদ্ধের ফলে বার্মার অর্থনীতির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির দরুন যুদ্ধ-পরবর্তী বার্মায় ব্রিটিশদের যুদ্ধের পরে বার্মা ধরে রাখা সম্ভবপর ছিল না।
অন্যদিকে জাপানের সেনাবাহিনীরা ১৯৪৪ সালে ভারত আক্রমণের জন্য যে সামরিক অভিযান পরিচালনা করেছিল, তা মূলত যুদ্ধ শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত তাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আর অপরদিকে সিঙ্গাপুর আর ১৯৪২ সালে বার্মা হারিয়ে ব্রিটিশ সেনাবাহিনী যে কোন মূল্যে ব্রিটিশ ভারত রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করেছিলো, তার ফলশ্রুতিতে বার্মা অভিযানে জাপানীদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি সমেত শোচনীয় পরাজয় বরণ করতে হয়েছিল। ব্রিটিশ-শাসিত ভারতে ১৯৪৪ সালে কোহিমা এবং ইম্ফলে ব্রিটিশ সেনাবাহিনী আত্ম-রক্ষার অভিযানে যে সফলতা দেখিয়েছিল, তাই মূলত তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের বার্মা যুদ্ধে তাদের জন্য অনুপ্রেরণার রসদ জুগিয়েছিলো।
মার্কিনী ইতিহাসবেত্তা রেইমন্ড কালাহান তার এক বিবৃতিতে ব্যক্ত করেন যে, "ফরাসি, ডাচ এবং আমেরিকানদের মতো সাম্রাজ্য না গোটালেও, যুদ্ধক্ষেত্রে স্লিমের বিজয় ব্রিটিশদের যে সহায়তা প্রদান করেছিল তা আত্ম-সম্মানের সাথে ব্রিটিশদের উপমহাদেশ ত্যাগ করতে সহায়তা করেছিল।"[৩০]
বার্মা অভিযানে মার্কিনীদের মূল উদ্দেশ্য ছিল মূলত ভারতের উত্তরে অবস্থিত যুদ্ধাক্রান্ত তৎকালীন মিত্র দেশ চীনকে সহায়তা প্রদান করা। এছাড়া বার্মা অভিযানের প্রথম দিকে মার্কিনীরা হাম্প নামক হিমালয়ের পূর্বাংশের শেষ প্রান্তে চীনকে আকাশপথে যে সামরিক সহায়তা প্রদান করতো, তা মূলত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে জাপানীদের পরাজয়ের আগ পর্যন্ত কোন কাজেই আসে নি। এছাড়া ইয়ুনান প্রদেশে দায়িত্বরত চীনা জেনারেল চিয়াং কাই-শেকের আত্ম-সিদ্ধি এবং সীমাহীন দূর্নীতির কারণেও মার্কিনী কর্তৃপক্ষ কর্তৃক পাঠানো সেই সাহায্যগুলো চীনের সাথে জাপানের যুদ্ধে নিস্ফলা হিসেবে সমালোচিত হয়েছিল।
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.