Loading AI tools
১৯৪৩ সালে ভারতবর্ষে সংঘটিত একটি দুর্ভিক্ষ উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
খ্রিস্টাব্দ ১৯৪৩, বঙ্গাব্দ ১৩৫০ সালের বাংলার দুর্ভিক্ষ, যেটি পঞ্চাশের মন্বন্তর নামে পরিচিত, ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ ভারতের (বর্তমানে বাংলাদেশ ও পূর্ব ভারত) বাংলা প্রদেশে দুর্ভিক্ষ। আনুমানিক ২.১-৩ মিলিয়ন বা ২১ থেকে ৩০ লাখ,[upper-alpha 1] ৬০.৩ মিলিয়ন জনসংখ্যার মধ্যে, অপুষ্টি, জনসংখ্যা স্থানচ্যুতি, অস্বাস্থ্যকর অবস্থা এবং স্বাস্থ্য সেবার অভাবের কারণে অনাহার, ম্যালেরিয়া এবং অন্যান্য রোগে মারা গেছে। লক্ষ লক্ষ লোক দরিদ্র হয়েছিল কারণ এই সংকট অর্থনীতির বড় অংশকে অভিভূত করেছিল এবং সামাজিক কাঠামোকে বিপর্যয়করভাবে ব্যাহত করেছিল। অবশেষে, পরিবারগুলি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়; পুরুষরা তাদের ছোট খামার বিক্রি করে এবং কাজ খুঁজতে বা ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার জন্য বাড়ি ছেড়ে চলে যায়, এবং মহিলা ও শিশুরা গৃহহীন অভিবাসী হয়ে ওঠে, প্রায়শই সংগঠিত ত্রাণের সন্ধানে কলকাতা বা অন্যান্য বড় শহরে ভ্রমণ করে।[7] ইতিহাসবিদরা সাধারণত দুর্ভিক্ষকে নৃতাত্ত্বিক (মানবসৃষ্ট) হিসেবে চিহ্নিত করেন,[8] জোর দিয়ে বলেন যে যুদ্ধকালীন ঔপনিবেশিক নীতিগুলি তৈরি করেছিল এবং তারপরে সংকটকে আরও বাড়িয়ে তুলেছিল। কিন্তু, সংখ্যালঘু দৃষ্টিভঙ্গি বলে যে দুর্ভিক্ষ প্রাকৃতিক কারণে হয়েছিল।[9]
পঞ্চাশের মন্বন্তর | |
---|---|
দেশ | ব্রিটিশ ভারত |
অবস্থান | বাংলা এবং ওড়িশা |
সময়কাল | ১৯৪৩-১৯৪৪ |
মোট মৃত্যু | আনুমানিক ২১ লক্ষ[upper-alpha 1] শুধু বাংলাতে |
১৩৫০ বঙ্গাব্দে ( খ্রি. ১৯৪৩) এই দুর্ভিক্ষ হয়েছিল বলে একে 'পঞ্চাশের মন্বন্তর' বলা হয়। বিশেষ করে দুই বাংলায় দুর্ভিক্ষের করাল থাবা ছিল সবচেয়ে করুণ। এই করুণ পরিণতির জন্য তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলকে সরাসরি দায়ী করা হয়েছে একটি নতুন বইয়ে। চার্চিলস সিক্রেট ওয়ার শীর্ষক বইটি লিখেছেন ভারতীয় লেখিকা মধুশ্রী মুখার্জি। বইটিতে লেখিকা এই দুর্ভিক্ষকে মানবসৃষ্ট বলে নিন্দা করেছেন। চার্চিলের বিরুদ্ধে বইটিতে তিনি অভিযোগ তোলেন, এই দুর্ভিক্ষ সৃষ্টির পেছনে বর্ণবৈষম্যও তাকে কিছুটা উসকে দিয়েছে।
জাপান প্রতিবেশী দেশ মায়ানমার (তৎকালীন বার্মা) দখল করে নেওয়ার পর তেতাল্লিশের মন্বন্তর শুরু হয়। ওই সময় বার্মা ছিল চাল আমদানির বড় উৎস। এই মন্বন্তরে বাংলাজুড়ে প্রায় ৩০ লক্ষ লোক না খেয়ে মারা যান। ভারতবর্ষের তৎকালীন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসক সেনা ও যুদ্ধে নিয়োজিত কর্মীদের জন্য বিপুল পরিমাণ খাদ্য মজুদ করায় এই দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়।
মজুদ করার কারণে হু হু করে বেড়ে যায় চালের দাম। একই সঙ্গে বাজারে তা দুষ্প্রাপ্য হয়ে ওঠে। জাপান ভারত দখল করলে খাদ্য যাতে শত্রুর হাতে না পৌঁছায়, এ জন্য ব্রিটিশ সরকার আগাম কিছু ব্যবস্থা নেয়। বাংলাজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা নৌকা ও গরুর গাড়ি হয় বাজেয়াপ্ত—নয় তো ধ্বংস করে ফেলে তারা। এতে চাল বা খাদ্য বিতরণ-ব্যবস্থাও ভেঙে পড়ে।
বাঙালির প্রধান খাবার চালের আকাল দেখা দেওয়ায় ভাতের জন্য সারা বাংলায় হাহাকার পড়ে যায়। গ্রাম থেকে গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে দুর্ভিক্ষ। পথে-প্রান্তরে লুটিয়ে পড়তে থাকেন না খাওয়া মানুষ। এখানে-ওখানে পড়ে থাকতে দেখা যায় হাড্ডিসার লাশ। এ সময় জরুরি খাদ্য সরবরাহের জন্য চার্চিলের কাছে আবেদন করেও বারবার প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন ভারতের তৎকালীন ব্রিটিশ কর্মকর্তারা। বিভিন্ন গ্রাম থেকে তখন বুভুক্ষু হাজার হাজার মানুষ একমুঠো অন্নের আশায় স্রোতের মতো ধাই করেছেন কলকাতার দিকে। দেখা গেছে, এসব অভাগা দলে দলে পথের ওপর পড়ে ধুঁকছেন আর আবর্জনার পাশে উচ্ছিষ্টে ভাগ বসাতে পরস্পর লড়ছেন। একই সময় ব্রিটিশ কর্মকর্তা এবং তাদের তোষামুদে অবস্থাপন্ন ভারতীয় লোকজন বাড়িতে বসে ভূরিভোজ করছেন।
মধুশ্রী মুখার্জির মতে, ব্রিটিশরাজের শাসনামলের এই অন্ধকারতম অধ্যায়টি এত দিন ছিল আড়ালে পড়ে। তিনি তা আলোতে নিয়ে এসেছেন। মধুশ্রী তার বইয়ে এমন সব তথ্যপ্রমাণ তুলে ধরেছেন, এতে ওই দুর্ভিক্ষের দায়ভার সরাসরি চার্চিলের ওপর চেপেছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মন্ত্রিসভার যেসব বৈঠক হয়েছে, এসব বৈঠকের বিশ্লেষণ রয়েছে বইয়ে। রয়েছে মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন নথিপত্রের তথ্য। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে মধুশ্রীর ব্যক্তিগত সংগ্রহশালার তথ্য। এসব তথ্যপ্রমাণ থেকে জানা যায়, চালে ঠাসা ব্রিটিশ জাহাজগুলো অস্ট্রেলিয়া থেকে এসে ভারতের পাশ দিয়ে চলে গেছে ভূমধ্যসাগরীয় এলাকার দিকে। ওই এলাকায় খাদ্যশস্যের বিশাল মজুদ গড়ে তোলা হয়।
এক সাক্ষাৎকারে মধুশ্রী মুখার্জি সাংবাদিকদের বলেন, চার্চিল যে ত্রাণ-সহায়তাদানে অক্ষম ছিলেন, এ প্রশ্নই ওঠে না। তিনি ও তার ঘনিষ্ঠ মিত্ররা বারবার এ ধরনের উদ্যোগ ব্যর্থ করে দিয়েছেন।
ওই সময় যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়া সহায়তার হাত বাড়াতে চেয়েছিল, কিন্তু চার্চিলের মন্ত্রিসভা তা মেনে নেয়নি। এমনকি এক পর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্র যখন নিজের জাহাজে করে খাদ্য পাঠাতে চেয়েছে, ব্রিটিশ শাসক তাও গ্রহণ করেননি। জিওফিজিক্যাল রিসার্চ লেটার জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী এই দুর্ভিক্ষের পেছনে প্রাকৃতিক কারণ খুঁজে পায়নি ভারতীয় ও মার্কিন গবেষকদের একটি দল। অর্থাৎ এই দুর্ভিক্ষের জন্য আবহাওয়া নয় বরং তৎকালীন বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলের অমানবিক নীতিই দায়ী ছিলো।[10]
ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ের দিক থেকে মহামন্দার ফলে সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বাংলার আয়ের বণ্টনের কাঠামো এবং জনসংখ্যার বিকাশের জন্য কৃষিক্ষেত্রের ক্ষমতার উপর একটি ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করেছিল। এগুলির সঙ্গে যুক্ত ছিল দ্রুত বর্ধনশীল জনসংখ্যার অন্তর্ভুক্তি, পরিবারের ঋণ বৃদ্ধি, স্থায়ী কৃষি উৎপাদনশীলতা, সামাজিক বর্ধিতকরণ বৃদ্ধি, এবং জমি থেকে কৃষকশ্রেণির বিচ্ছিন্নতা।[11] তারা ১৯৪২ থেকে ১৯৪৩ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে আকস্মিক অর্থনৈতিক ঝড় মোকাবেলা করতে অক্ষম। লক্ষ লক্ষ মানুষ খাদ্যশস্যের অভাবের ঝুঁকির মধ্যে ছিল এবং কয়েক দশক ধরে ছিল।[12]
ভারত সরকারের দুর্ভিক্ষ কমিশন রিপোর্ট (১৯৪৫) বাংলাকে "চাল উৎপাদক ও চাল ভোক্তাদের একটি ভূমি" হিসাবে বর্ণনা করেছে।[upper-alpha 2] চাল বা ধান প্রদেশের কৃষি উৎপাদনের ওপর আধিপত্য বিস্তার করে, যা প্রদেশের কৃষি জমি ব্যবহারের প্রায় ৮৮ শতাংশ [13]এবং সমস্ত ফসল বপনের ৭৫ শতাংশ।[upper-alpha 3] সামগ্রিকভাবে, বঙ্গদেশ ভারতের এক তৃতীয়াংশের ধান উৎপাদন করত এবং উৎপাদনের পরিমাণ অন্য কোনও একক প্রদেশের চেয়ে বেশি। [13] চাল দৈনিক খাদ্যদ্রব্যের ৭৫-৮৫% হিসাব থাকে। [14]মাছ দ্বিতীয় প্রধান খাদ্য উৎস ছিল, [15] ক্ষুদ্র পরিমাণে গমকে খাদ্য হিসাবে গ্রহণ করা হত।[upper-alpha 4] অন্যান্য খাদ্যদ্রব্য সাধারণত স্বল্প পরিমাণে গ্রহণ করা হত।[14]
বাংলায় তিনটি মৌসুমি ফসল হিসাবে ধান চাষ করা হত। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল আমন ধান, যা শীতল ফসল হিসাবে মে ও জুনে বপন করা হয় এবং নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে তোলা হয়। এটি বছরে উৎপাদিত ধানের প্রায় ৭০ শতাংশ।[16] গুরুত্বপূর্ণভাবে, ১৯৪২ সালে চালের উৎপাদন (বিতর্কিত) কমে যাওয়া সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আমন ধান চাষের ক্ষেতে ঘটেছিল।[17]
বৃষ্টির জল বাংলার নদীগুলিকে পরিপূর্ণ করে দিত জলে, যার ফলে সেই সময় পরিবহনের নির্ভরযোগ্য মাধ্যম হয়ে উঠেছিল নদীগুলি এবং উপকূলীয় দক্ষিণ-পূর্ব সুন্দরবন সুবিশাল ব-দ্বীপ ও সমগ্র সুন্দরবন এলাকাতে নদী ছিল যোগাযোগের মাধ্যম। নদী পরিবহন বাংলার অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বিভিন্ন দিকের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল এবং নদী পথে পরিবহন ব্যবস্থা ছাড়া চালের উৎপাদন ও বিতরণে প্রায় অসম্ভব ছিল সেই সময়ে।[18] নদী মৎস্যজীবী ও পরিবহন শ্রমিকদের জীবনযাত্রার ব্যবস্থা করে ছিল এবং বিভিন্ন ব্যবসায়ের পণ্য সরবরাহ ও পরিপূরক দ্রব্য যেমন কুলার, বাতা ও ঝুড়ি প্রস্তুতকারকদের জন্য অপরিহার্য ছিল।[19] সড়ক পথ কম ছিল এবং সাধারণত তার মান বা অবস্থায় ভালো ছিল না[20] এবং বাংলার বিস্তৃত রেলপথ মূলত সঙ্কটের শেষ পর্যায় পর্যন্ত সামরিক কাজে নিয়োজিত ছিল।[21]
১৮৯০ থেকে ১৯১০ সালের মধ্যে বাংলায় রেলপথের উন্নয়ন দুর্ভিক্ষের অত্যধিক মৃত্যুহারে অবদান রাখে।
বাংলার পূর্ব ও পশ্চিমের অংশের মাটির মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। পূর্বাংশের বালুকাময় মাটি এবং সুন্দরবনের হালকা পাললিক মৃত্তিকা পশ্চিমবঙ্গের ভারী মৃত্তিকা পাওয়া যায়।[22]
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.