Loading AI tools
তিব্বৎ, ভুটান এবং পূর্ব এশিয়াকে দেওয়া ভারতীয় বৌদ্ধ তান্ত্রিক ঐতিহ্য উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
বজ্রযান ( সংস্কৃত: वज्रयान, "বজ্রবাহী যান", "হীরকযান" বা "অবিনাশী যান") এবং সাথে অন্যান্য নাম সমূহ যেমনঃ মন্ত্রযান, গুহ্যমন্ত্রযান , তন্ত্রযান, গুপ্ত মন্ত্র, তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্ম, এবং গুপ্ত বৌদ্ধধর্ম, বৌদ্ধ ধর্মের এমন শাখা বা ঐতিহ্যকে নির্দেশ করে যা তন্ত্র এবং "গোপন মন্ত্র" এর সাথে যুক্ত , যা মধ্যযুগীয় ভারতীয় উপমহাদেশে বিকাশ লাভ করেছিল এবং তিব্বত, নেপাল, অন্যান্য হিমালয় রাজ্য, পূর্ব এশিয়া এবং মঙ্গোলিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছিলো।
বজ্রযান এর আচার-আচরণ ও ধর্মশাস্ত্র সাধারণত বৌদ্ধধর্মের নির্দিষ্ট শাখা বা বংশের সাথে যুক্ত যা শাখার সদস্য বা বংশধারীদের ধর্মানুশাসন এর মাধ্যমে বিস্তার লাভ করে। অন্যান্যরা সাধারণত এই ধর্মানুশাসন ও ধর্মশাস্ত্র সমূহকে বৌদ্ধ তন্ত্র হিসাবে চিহ্নিত করে। [1] এই ধর্মানুশাসন এর মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন মন্ত্র, ধরণী, মুদ্রা, মন্ডল এর ব্যবহার এবং বিভিন্ন দেবতা ও বুদ্ধের মুর্তি তৈরি করা ও চিত্রায়ন করা।
প্রথাগত বজ্রযান সূত্র বলে যে, তন্ত্র এবং বজ্রযানের ধর্মানুশাসন বা ধারার চর্চা শুরু হয়েছিলো শাক্যমুনি বুদ্ধ এবং অন্যান্য ধর্মগুরু যেমন বোধিসত্ত্ব বজ্রপানি এবং পদ্মসম্ভব এর শিক্ষা ও অনুশাসন এর মাধ্যমে। বৌদ্ধ শিক্ষার সমসাময়িক ইতিহাসবিদরা বিবেচনা করেন যে এই ধর্মানুশাসন মধ্যযুগীয় ভারতের তান্ত্রিক যুগে (সি. ৫ম শতাব্দীর পরে) শুরু হয়েছিলো। [2]
বজ্রযান ধর্মগ্রন্থ অনুসারে, বজ্রযান শব্দটি বৌদ্ধধর্ম অনুসারে মোক্ষলাভের তিনটি পথের/উপায়ের বা বাহন এর মধ্যে একটিকে বোঝায়, এই তিন বাহনের অন্য দুটি বাহন হল শ্রাবকায়ান ( যা হিনায়ান নামেও পরিচিত) এবং মহাযান ( যা পারমিতায়ান নামে পরিচিত) ।
বর্তমানে বেশ কিছু বৌদ্ধ তান্ত্রিক প্রথা যেমন তিব্বতীয় বৌদ্ধধর্ম, চাইনিজ গুপ্ত বৌদ্ধধর্ম, শিঙ্গন বৌদ্ধধর্ম এবং নেওয়ার বৌদ্ধধর্ম এর অনুশীলনের প্রচলন রয়েছে।
তিব্বতি বৌদ্ধধর্মে,যা ভারত, নেপাল এবং ভুটানের হিমালয় অঞ্চলে চর্চা করা, বৌদ্ধ তন্ত্রকে প্রায়শই বজ্রযান (তীব্বতিঃ རྡོ་ རྗེ་ ཐེག་པ་,উচ্চারনঃদোজে থেকপা) এবংগোপন মন্ত্র (সংস্কৃত:গুহ্যমন্ত্র, তীব্বতিঃགསང་སྔགས་, উচ্চারনঃ স্যাংগ গ্যাক ) বলা হয়। বজ্র হল ইন্দ্রের সাথে সম্পর্কিত একটি অস্ত্র যাকে পৌরাণিক গ্রন্থে অবিনশ্বর এবং অটুট (হীরার মতো) এবং অত্যন্ত শক্তিশালী (বজ্রের মতো) বলে বলা হয়েছে। এইভাবে, বজ্রযানকে বিভিন্নভাবে হীরযান, বজ্রবাহী যান, অবিনশ্বর যান ইত্যাদি নামে ডাকা হয়।
চীনা গুহ্য বৌদ্ধধর্মকে সাধারণত বিভিন্ন নামে ডাকা হয় যেমন ঝেনিয়ান ( চীনা : 真言, আক্ষরিক অর্থে "সত্য শব্দ", যা মন্ত্রকে বোঝায়), তাংমি বা হানমি (চীনা : 唐密 - 漢密, " ত্যাং গুহ্য ধর্ম" বা " হান গুহ্য ধর্ম"), মিজোং (চীনা : 密宗, "গুপ্ত সম্প্রদায়") বা মিজিয়াও (চীনা: 密教; রহস্যময় শিক্ষা)। চীনা শব্দ mì密 ("গোপন, রহস্যময়") হল সংস্কৃত শব্দ গুহ্য ("গোপন, গোপন, গভীর, বিমূর্ত") এর একটি চীনা অনুবাদ। [3]
জাপানে, বৌদ্ধ গুপ্ততত্ত্বকে মিকিও (密教, "গোপন শিক্ষা") বা শিঙ্গন ( ঝেনিয়ানের একটি জাপানি উচ্চারন বা বিবর্তন) নামে ডাকা হয়, যা শিংগন-শু (真言宗) নামক একটি নির্দিষ্ট শাখাকেও বোঝায়।
তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মকে সম্পর্কিত করা হয়া মহাসিদ্ধ নামে পথে ঘাটে বিচরণকারী মধ্যযুগীয় ভারতীয় যোগী সম্প্রদায়ের সাথে। [4] রবার্ট থারম্যানের মতে, প্রথম সহস্রাব্দের শেষার্ধে এই তান্ত্রিক যোগীরা প্রসার লাভ করেছিলো। [2] রেনল্ডস (2007) এর মতে,উত্তর ভারতে মধ্যযুগীয় সময়ে মহাসিদ্ধদের প্রচলন হয়েছিলো এবং যারা বৌদ্ধ মঠগুলিতে ব্যবহৃত ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধর্মীয় আচার পালন করতো যেমন তারা শ্মশানে সাধনা করতো। [5]
যেহেতু তন্ত্র চর্চার প্রধান মুখ্য বিষয় ছিলো বিষকে জ্ঞানে রুপান্তিরত করা, তাই বিভিন্ন যোগী গোষ্ঠীরা , প্রায়শই বিভিন্ন পবিত্র স্থান ( পিঠ ) এবং ক্ষেত্রে তন্ত্র গনচক্রে একত্রিত হতো যেখানে তারা নাচ, গান, যৌন সহবাসে অংশগ্রহণ করতো এবং নিষিদ্ধ খাবার যেমন মদ,মূত্র এবং মাংস ভক্ষণ করতো। [6] বৌদ্ধ সাহিত্যে উল্লেখিত অন্তত দুইজন মহাসিদ্ধদেরকে শৈব নাথ সাধকদের ( গোরক্ষনাথ এবং মতসেন্দ্রনাথ ) সাথে তুলনা করা যায় যারা হঠ যোগের চর্চা করতেন।
শুম্যানের মতে, অষ্টম শতাব্দীতে বাংলায় সহজ -সিদ্ধি নামে একটি চর্চা গড়ে উঠেছিলো। [7] এই চর্চায় সংখ্যাঘরিষ্ঠতা ছিলো দীর্ঘ চুলের পথে ঘাটে বিচরণকারী মহাসিদ্ধদের যারা প্রতিষ্ঠিত বৌদ্ধ ধর্ম আচরণকে প্রকাশ্যে প্রশ্ন ও উপহাস করেছিল। [8] এই মহাসিদ্ধরা বিভিন্ন সিদ্ধি যেমন জাদুকরী শক্তি যথা উড়তে পারা এবং মন ও শরীরের বিশেষ ক্ষমতা অর্জনের পাশাপাশি আধ্যাত্মিক মুক্তি লাভের প্রচেষ্টা করতো। [9]
রোনাল্ড এম. ডেভিডসন বলেছেন যে,
বৌদ্ধ সিদ্ধরা প্রমান করেছিলো যে একটি প্রাচীন সামাজিক ধরনকে কীভাবে তাদের নিজস্ব প্রয়োজনে রূপান্তর করা যায়-যেমন স্বাধীন ঋষি/জাদুকর, যারা কৃষিমাঠ ও বনের সীমানায় একটি সীমাবদ্ধ অঞ্চলে বসবাস করে। তাদের আচার-অনুষ্ঠানে যৌন চর্চা এবং মানব দেহের বিভিন্ন অংশ দিয়ে তৈরি বৌদ্ধ মন্ডল চিত্রায়নের সংমিশ্রন থাকে, যাতে করে বিশ্বব্রহ্মান্ডকে নিজ ইচ্ছানুসারে স্বকার্যে ব্যবহারের নিমিত্তে সিদ্ধ অর্জনে বাধা দেয় এমন প্রাকৃতিকি বিভিন্ন শক্তি সমূহের উপর নিয়ন্ত্রন আরোপ করা যায়। বৌদ্ধ প্রথা অনুসারে সিদ্ধকে, তার অতি চড়ম পর্যায়ে, আত্মরক্ষামূলক হিসেবে জ্ঞাত করা হয়, যা জনসহিংসতামূলক মধ্যযুগীয় সংস্কৃতির সাথে লড়াইয়ের জন্য আক্রমনাত্মক প্রবৃত্তি হিসেবে গ্রহণ এবং টেকসই করা হয়েছিলো। ব্যক্তিগত পবিত্রতার পাশাপাশি তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন গজুবকে যেমন তারা জাদুর মাধ্যমে বিভিন্ন প্রকারের পৈশাচিক নারী (ডাকিনী, যক্ষিণী, যোগিনী), শ্মশান ভূত (বেতাল), এবং অনান্য অতিপ্রাকৃত জিনিশ যা রাতে আচমকা দেখা দেয় তাদেরকে নিয়ন্ত্রন করতে পারে এই ধারণাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছিলো। মঠ এবং জনসমাজ উভয়ের মধ্যকার সীমানায় বসবাস করার জন্য, কেউ কেউ বিভিন্ন ভূতের (প্রেত, পিচাশ) সাথে সম্পর্কিত বিভিন্ন আচার আচরণ গ্রহণ করেছিলো শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় অনুশীলন হিসাবে নয় বরঞ্চ তাদেরকে ভয় করার একটি কারন হিসেবে।[10]
বৌদ্ধ তান্ত্রিক সাহিত্যে পাওয়া যায় এমন অনেক কিছুই সম্পূর্ণরূপে নতুন নয়। পূর্ববর্তী মহাযান সূত্রে ইতিমধ্যেই এমন কিছু তত্ত্বের উল্লেখ রয়েছে যা তান্ত্রিক রিতিতে গুরুত্ব পেয়েছে, যেমন মন্ত্র এবং ধরণী। [11] প্রকৃতপক্ষে বৈদিক যুগ হতেই প্রতিরক্ষামূলক শ্লোক বা বাক্যাংশের ব্যবহার শুরু হয়েছিলো এবং প্রথম দিকের বৌদ্ধ গ্রন্থে এর উল্লেখ দেখতে পাওয়া যায়, যেখানে সেগুলিকে পরিত্তা বলে অভিহিত করা হয়েছে। প্রাক-তান্ত্রিক গ্রন্থ সমূহ যেমন দীর্ঘ <i id="mwsg">সুখাবতীব্যূহ সূত্রে</i> অমিতাভের মতো বুদ্ধের দৃশ্যায়নের প্রচলন দেখা যায়। [12]
অন্যান্য মহাযান সূত্র যেমন গণ্ডব্যুহ এবং দাশভূমিকাতে এমন কিছু প্রাক-তান্ত্রিক উপাদান রয়েছে যেগুলিকে তান্ত্রিক গ্রন্থগুলির চাক্ষুস প্রমানের প্রধান উৎস হিসাবে বিবেচনা করা যেতে পারে। [13] পরবর্তীকালে মহাযান গ্রন্থ যেমন কর্ণাব্যুহ সূত্রতে (আনুমানিক ৪র্থ-৫ম শতাব্দী) ওম মণি পদমে হুম- এর মতো মন্ত্রের ব্যবহার ব্যাখ্যা করা হয়েছে যে মন্ত্র অবলোকিতেশ্বরের মতো প্রচন্ড শক্তিশালী বোধিসত্ত্ব এর সাথে সম্পর্কিত । জনপ্রিয় প্রজ্ঞাপারমিতাহৃদয় সূত্রেও একটি মন্ত্র রয়েছে।
বজ্রযান বৌদ্ধরা বৌদ্ধ তন্ত্র নামে একটি বৃহৎ গ্রন্থ তৈরি করেছিল, যার মধ্যে কিছু অংশের উৎপত্তির সময়কাল অন্তত খ্রিস্টাব্দ ৭ম শতাব্দ পর্যন্ত পাওয়া যায় তবে এর বয়সসীমা তার থেকেও পুরনো হতে পারে । ডেভিড স্নেলগ্রোভের মতে তন্ত্রের বয়স নির্ধারন করা "একটি কঠিন, প্রকৃতপক্ষে একটি অসম্ভব কাজ"। [14]
এই গ্রন্থগুলির মধ্যকার প্রথম দিকের কিছু গ্রন্থে যেমন ক্রিয়াতন্ত্রে যথা মঞ্জুশ্রী-মূল-কল্পতে (আনুমানিক 6 শতক), অসুস্থতা নিরাময়, আবহাওয়া নিয়ন্ত্রণ এবং প্রাচুর্য বাড়ানো সহ বেশিরভাগ পার্থিব উদ্দেশ্যে মন্ত্র এবং ধরণীর ব্যবহার দেখা যায়। [15] তত্ত্বসংগ্রহ তন্ত্র (সকল তথাগতের মূলনীতির সংকলন ), যাকে "যোগ তন্ত্র" হিসাবেও চিহ্নিত করা হয়, হচ্ছে প্রাচীনতম বৌদ্ধ তন্ত্রগুলির মধ্যে এমন একটি তন্ত্র যার প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে মোক্ষলাভ করা, পার্থিব লক্ষ্যের পরিবর্তে । অন্য একটি প্রাচীনতম তন্ত্রে, যেমন বজ্রশেখর সুত্রে (বজ্র শিখর), পাঁচ ধ্যানী বুদ্ধের নিদর্শন পাওয়া যায়। [16] অন্যান্য প্রাচীন তন্ত্রগুলির মধ্যে রয়েছে বৈরোচনসম্বোধি সূত্র এবং গুহ্যসমাজতন্ত্র (গোপনের সমাবেশ)। [17]
গুহ্যসমাজতন্ত্র হলো এমন একটি মহাযোগ শ্রেণীর তন্ত্র, যে তন্ত্র "বাম-হাত" ( বামাচার) আচার অনুশীলন যেমন মদ, নারী সঙ্গ বা যৌনাচার ও শ্নশান সাধনার মতো নিষিদ্ধ ব্যবহারের মাধ্যমে ক্রোধী দেবতাকে আহবান করার জন্য বিখ্যাত। [18] রিউজুন তাজিমা এই তন্ত্রগুলিকে "মহাযানবাদী চিন্তাধারার বিকাশ" এবং "অষ্টম শতাব্দীর শেষের দিকে একটি জনপ্রিয় আচার আচরন হিসেবে সংগঠিত হয়ে যা কালো জাদুবিদ্যার গুপ্ততত্ত্বে অধ:পতন হয়েছিলো " এই দুই ভাগে বিভক্ত করেছেন, [19] এই "কালো জাদুবিদ্যার গুপ্ততত্ত্ব" দ্বারা প্রধানত যোগিনী তন্ত্র এর পরবর্তী সময়বর্তী ভবঘুরে যোগীদের সাথে সম্পর্কিত কাজগুলকে বোঝান হয়। এই তন্ত্র সাধনা ও চর্চা তিব্বতি বৌদ্ধধর্মে টিকে যায়, তবে এই তন্ত্র সাধনা একজন প্রকৃত বাস্তব ব্যক্তির সাথে চর্চা করা খুবই বিরল। একজন যোগী বা যোগিনী তার সাধনার জন্য সাধারণতএকজন কল্পিত সঙ্গীর (একজন বৌদ্ধ তান্ত্রিক দেবতা, অর্থাৎ যীদাম) ব্যবহার করে থাকে।
এই পরবর্তী সময়কালের তন্ত্রগুলি যেমন হেবজ্র তন্ত্র এবং চক্রসম্বরতন্ত্রকে " যোগিনী তন্ত্র" হিসাবে চিহ্নিত করা হয় এবং এইগুলোকে নবম এবং দশম শতাব্দী সময়কার ভারতীয় বৌদ্ধ তন্ত্রের বিকাশের চূড়ান্ত রূপের প্রকাশ বলে ধারণা করা হয়। [15] দশম শতাব্দীতে কালচক্র তন্ত্রের বিকাশ ঘটে। [7] পূর্ববর্তী বৌদ্ধ আচারানুষ্ঠান থেকে কালচক্রে সবচেয়ে বেশী পার্থক্য রয়েছে, এবং এত ব্যাক্তি পূজা/অবতারবাদ ও জ্যোতিষশাস্ত্রের ব্যবহার পাওয়া যা অনান্য বৌদ্ধ সাহিত্যে পাওয়া যায় না। [8]
রোনাল্ড এম. ডেভিডসনের মতে, তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মের উত্থান হয়েছিলো মধ্যযুগের প্রথমদিকের (আনু. 500-1200 খ্রিষ্টাব্দ) ভারতীয় সামন্ততান্ত্রিক সমাজকাঠামোর বিপরীতে একটি প্রতিক্রিয়া হিসেবে যেখানে রাজাদেরকে দৈব বা ঈশ্বরের প্রতিরূপ হিসেবে দেখা হতো। যেভাবে রাজকীয় দুর্গ এবং তাদের রাজনৈতিক ক্ষমতাকে একটি সাম্রাজ্যিক রূপক হিসেবে দেখা হয় একইভাবে, তান্ত্রিক যোগীরা নিজেদের আচারনুষ্ঠানকে এমনভাবে সজ্জিত করেছিলো যে তাদের একটি দৈব মণ্ডলের অধিপতি ( রাজাধিরাজ ) হিসাবে প্রতিষ্ঠাপিত ( অভিষেক ) হওয়াকে যাতে একই রূপক হিসেবে দেখা হয়।। [20]
আদি বজ্রযানের উৎপত্তি নিয়ে বিভিন্ন পণ্ডিতগন গবেষণা করেছেন। ডেভিড সেফোর্ট রুয়েগ বলেন যে বৌদ্ধ তন্ত্র হচ্ছে "সর্ব-ভারতীয় ধর্মীয় স্তর" এর বিভিন্ন উপাদানের একটি সন্নিহিত সমাবেশ যা বিশেষভাবে বৌদ্ধ, শৈব বা বৈষ্ণব নয়। [21]
অ্যালেক্সিস স্যান্ডারসনের মতে, বজ্রযান বিদ্যার বিভিন্ন প্রথার উৎপন্ন হয়েছিল বিভিন্ন রাজ দরবারে বৌদ্ধ ও শৈব ধর্ম উভয়ের পৃষ্ঠপোষকতার ফলস্বরূপ। [22] এই দুটি ধর্ম আচারের মধ্যে সম্পর্ক মঞ্জুশ্রীমুলকল্পের মতো গ্রন্থে দেখতে পাওয়া যায়, যা পরবর্তীতে ক্রিয়াতন্ত্র নামে পরিচিত লাভ করে এবং এই গ্রন্থ বলা আছে যে শৈব, গরুড়পুরাণ এবং বৈষ্ণব তন্ত্রগুলিতে যে মন্ত্র আছে তা যদি বৌদ্ধরা সঠিক ভাবে প্রয়োগ করে তাহলে তা কাজ করবে কারন এগুলো মূলত মঞ্জুশ্রীর থেকে প্রাপ্ত হয়েছে। [23]
অ্যালেক্সিস স্যান্ডারসন উল্লেখ করেছেন যে, বজ্রযান যোগিনী তন্ত্রগুলি ব্যাপকভাবে উৎপন্ন লাভ করেছে বিদ্যাপীঠ হিসাবে পরিচিত শৈব ভৈরব তন্ত্রে উপস্থিত বিভিন্ন মন্ত্র হতে। স্যান্ডারসনের তুলনামূলক আলোচনায় দেখা যায় যে অনেক বিষয়ে যেমন "পূজাবিধি, আচার, দেবতা, মন্ত্র, মণ্ডল, পূজার পোশাক, কাপালিক সাজসজ্জা যেমন মাথার খুলির বাটি, বিশেষ ভাষা , গোপন অঙ্গভঙ্গি ও বাক্য" এর মধ্যে এই দুই ধর্মের মিল পাওয়া যায়। এমনকি শৈব পুরাণের বিভিন্ন অনুচ্ছেদের হুবহু উল্লেখ পাওয়া যায়। [24] স্যান্ডারসন অসংখ্য উদাহরণ দিয়েছেন যেমন পদ্মবজ্রের গুহ্যসিদ্ধি, যা গুহ্যসমাজ প্রথার সাথে সম্পর্কিত, যেখানে বিধান দেওয়া আছে কীভাবে শৈব গুরু হিসাবে কাজ করতে হবে এবং কীভাবে সদস্যদের শৈবসিদ্ধান্ত শাস্ত্র ও মণ্ডলে দীক্ষা দিতে হবে। [25] স্যান্ডারসন বলেছেন যে তন্ত্রসদ্ভব গ্রন্থে উল্লেখিত বিভিন্ন হিন্দু পীঠের তালিকার হুবহু উল্লেখ চক্রসম্বরতন্ত্র গ্রন্থে পাওয়া যায়, যা একটি অনুলিপি জনিত ত্রুটির আরম্ভ করে যেখানে একজন দেবতাকে একটি পীঠ হিসবে ভুল ভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। [26]
এদিকে রোনাল্ড এম. ডেভিডসন যুক্তি দেন যে, বজ্রতন্ত্রে শৈব বিদ্যাপীঠ গ্রন্থের সরাসরি প্রভাব সম্পর্কে স্যান্ডারসনের যুক্তিগুলি অস্পষ্ট কারণ " বিদ্যাপীঠ তন্ত্রগুলির কালানুক্রম কোনভাবেই এত সুপ্রতিষ্ঠিত নয়" [27] এবং "সহজলভ্য প্রামানিক তথ্যগুলো এই ইঙ্গিত দেয় যে নবম থেকে দশম শতাব্দীর কোনো এক সময়ে অভিনবগুপ্তের (আনুমানিক ১০০০ খ্রিস্টাব্দ) অনুমোদনের মাধ্যমে শৈব তন্ত্রের সূচনা হয়েছিলো। [28] ডেভিডসন আরও উল্লেখ করেছেন যে পীঠ বা পবিত্র স্থানগুলোর তালিকা "অবশ্যই বিশেষভাবে বৌদ্ধ ধর্মীয় নয় বা আলাদাভাবে কাপালিকদের মিলনস্থলও নয়, যদিও উভয় ধর্মে তাদের উল্লেখ পাওয়া যায়"। [29] ডেভিডসন আরও যোগ করেছেন যে বৌদ্ধদের মতোও শৈবধর্মে বিভিন্ন হিন্দু ও অহিন্দু দেবদেবী, আচার ও আচারনের অধিকরণ দেখতে পাওয়া যায়, যার উদাহরণ হচ্ছে " তুম্বুরুর মতো গ্রাম্য বা উপজাতীদের দেবতা"। [30]
ডেভিডসন আরো উল্লেখ করেছেন যে বৌদ্ধ এবং কাপালিকের পাশাপাশি অন্যান্য তপস্বীগণ (সম্ভবত পাশুপত শৈবসম্প্রদায় ) বিভিন্ন তীর্থস্থানে মিলিত হয়েছিলো এবং তাদের মধ্যে ও তাদের মধ্যকার বিভিন্ন গোষ্ঠী মধ্যে তাদের ধর্মীয় মতাদার্শ নিয়ে আলোচনা ও কথোপকথন হয়েছিলো । এইভাবে তিনি উপসংহারে বলেন:
বৌদ্ধ-কাপালিকদের মধ্যকার সংযোগ ধর্মীয় অনুকরন ও গ্রন্থের অধিকরণের মতো সহজ পক্রিয়ার থেকেও একটি জটিল বিষয়।এতে কোন সন্দেহ নেই যে বৌদ্ধ তন্ত্রগুলি কাপালিক এবং অন্যান্য শৈব মত দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়েছিল, তবে প্রভাবগুলো স্পষ্টতই পারস্পরিক ছিল। হয়তো আরোও একটি সূক্ষ্ণ ধারণা হতে পারে যে, এই প্রভাবগুলো স্থানীয়ভাবে বিকাশ লাভ করেছিলো এবং কিছু কিছু এলাকায় তাদের মিথস্ক্রিয়া হয়েছিলো আবার অন্য এলাকায় তারা সমবেতভাবে শত্রুতা বজায় রেখেছিলো। এইভাবে এই প্রভাবগুলোর প্রভাব স্থায়ী ও পারস্পরিক হয়েছিলো, এমনকি সেইসব স্থানেও যেখানে বৌদ্ধ ও কাপালিক সিদ্ধদের মধ্যে চরম বৈরিতা ছিল।। [31]
অ-ব্রাহ্মণ্যবাদী এবং অচ্ছুত উপজাতীয় ধর্ম এবং তাদের নারী দেবতাদের (যেমন পর্ণসাবাড়ি এবং জাঙ্গুলী) প্রভাবের পক্ষেও ডেভিডসন যুক্তি দিয়েছিলেন। [32]
বেশ কয়েকটি বৌদ্ধ তন্ত্রের পাশাপাশি ঐতিহ্যবাহী তিব্বতি বৌদ্ধধর্ম অনুসারে, বুদ্ধ শাক্যমুনি তন্ত্র এবং বজ্রযান এর শিক্ষা দিয়েছিলেন, তবে শুধুমাত্র কিছু নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে। [33] [34] তন্ত্রগুলি কীভাবে প্রচারিত হয়েছিল তার বেশ কয়েকটি গল্প এবং সংস্করণ রয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ, জ্ঞান তিলক তন্ত্রে বুদ্ধের বক্তব্যের উল্লেখ রয়েছে যে এই তন্ত্রগুলি বোধিসত্ত্ব বজ্রপানি দ্বারা ব্যাখ্যা করা হবে। [33] সবচেয়ে বিখ্যাত কিংবদন্তিগুলির মধ্যে একটি হল ওড্ডিয়ান রাজ্যের রাজা ইন্দ্রভূতির (যিনি রাজা জা নামেও পরিচিত) সম্পর্কে (বজ্রপানি সাথে সম্পর্কিত একজন বৌদ্ধ মহাসিদ্ধ, কিছু কিছু ক্ষেত্রে তাঁরই একটি উদ্ভব বলে মনে করা হয়)। [33]
অন্যান্য কিংবদন্তিতে পাওয়া যায় যে পদ্মসম্ভবের কাছে বৌদ্ধ তন্ত্রের প্রকাশ হয়েছিলো, বলা হয় যে তিনি অমিতাভ ও অবলোকিতেশ্বরের একটি উদ্ভব এবং বুদ্ধ তাঁর আগমনের ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। কিছু কিংবদন্তি এও বলে যে পদ্মসম্ভব হল বুদ্ধ শাক্যমুনির সরাসরি পুনর্জন্ম। [34]
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.