Loading AI tools
উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
দালাল আইন, ১৯৭২ বলতে দ্যা বাংলাদেশ কোলাবরেটরস (স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল) অর্ডার, ১৯৭২ (ইংরেজি: "The Bangladesh Collaborators (Special Tribunals) Order, 1972")-কে বুঝনো হয়।[1] কখনো কখনো এটিকে রাষ্ট্রপতির আদেশ ১৯৭২ সালের ৮ নং (ইংরেজি: PRESIDENT'S ORDER NO. 8 OF 1972) হিসাবেও পরিচিত উল্লেখ করা হয়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য মুক্তিযুদ্ধের সময় যেসব রাজাকার, আলবদর, আলশামস পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সদস্যদের সহায়তা করেছে তাদের বিচারের জন্য ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি এই আইনটি প্রণয়ন করা হয় এবং ১৯৭৩ সালের অক্টোবর পর্যন্ত এই আইনের আওতায় ২,৮৮৪টি মামলা দায়ের করা হয়। এসব মামলায় সাজা দেওয়া হয় ৭৫২ জনকে। এদের মধ্যে মৃত্যুদণ্ড, যাবজ্জীবনসহ বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ছিল। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ৩১ অক্টোবর দালাল আইন বাতিল করার পর থেকে সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের কারাগার থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়।[2] ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতির ঘোষণা দ্বারা আইনটির প্রয়োগ শুরু হয়। ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি আইনটির আদেশ জারি হলেও পরবর্তীকালে একই বছরের ৬ ফেব্রুয়ারি, ১ জুন এবং ২৯ আগস্ট তারিখে তিন দফা সংশোধনীর মাধ্যমে আইনটি চূড়ান্ত হয়। পরবর্তীকালে দালাল আইনের অধীনে ৩৭ হাজারের বেশি ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং বিভিন্ন আদালতে তাদের বিচার আরম্ভ হয়। এর পাশাপাশি সরকারি চাকরিতে কর্মরতদের কেউ দালালি এবং যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন কি না তা যাচাই করার জন্য ১৯৭২ সালের ১৩ জুন একটি আদেশ জারি করে যা তখন গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়।
১৯৭২ সালের ১৭ মার্চ শহীদদের পরিবারবর্গের পক্ষ থেকে পাক যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে ঢাকার রাজপথে মিছিল বের হয়। মিছিলে পাক যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবি করা হয়।
১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু জাতির উদ্দেশে দেয়া বেতার ও টিভি ভাষণে পাক যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রসঙ্গটি আবার সামনে নিয়ে আসেন। পাক প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো পাকিস্তানে আটকে পড়া পাঁচলাখ বাঙ্গালীকে ফেরত দেয়ার বিষয়টি পাক যুদ্ধবন্ধীদের মুক্তির সঙ্গে শর্তযুক্ত করায় শেখ মুজিবুর রহমান এ ভাষণে বলেন, ‘তাদেরকে (পাকিস্তানে আটকে পড়া বাঙ্গালী) ফিরিয়ে দেয়া হোক। এ ইস্যুকে কোনোক্রমে যুদ্ধবন্দীদের সমপর্যায়ে ভাবা চলবে না। কারণ তাদের (পাক যুদ্ধবন্ধীদের) মধ্যে এমন অনেক আছেন যারা শতাব্দীর নৃশংসতম হত্যার অপরাধে অপরাধী। তারা মানবিকতাকে লঙ্ঘন করেছে এবং আন্তর্জাতিক নীতিমালার ভিত্তিতে বিচার হবে।’
১৯৭২ সালের ১৬ মে বঙ্গবন্ধু সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, ‘বাংলাদেশে পাক হানাদার বাহিনীর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্দেশ্যে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় অর্ডিন্যান্স প্রণয়নের কাজ এগিয়ে চলছে। ইতোমধ্যে কলাবরেটের আইনের অধীনে কলাবরেটর-দালালদের বিচারের কাজ শুরু হয়ে গেছে।’
১৯৭২ সালের ২ জুলাই কুষ্টিয়ার এক জনসভায় তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু পুনরায় জোর দিয়ে বলেন, ‘পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী বাংলাদেশের মাটিতে পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবে। কোনো ব্যক্তি বাংলাদেশের মাটিতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না।’
১৯৭২ সালের ২৯ আগস্ট আইনমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন পাকিস্তানের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রসঙ্গে বলেন, ‘সেপ্টেম্বর মাসে পাকিস্তানের যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের সম্পর্কিত তদন্তের পূর্ণাঙ্গ পর্যালোচনা প্রকাশ করা হবে।’
এরপর ১৯৭৩ সালের ১৭ এপ্রিল প্রকাশিত বাংলাদেশ সরকারের এক প্রেস রিলিজে বলা হয়, তদন্তের মাধ্যমে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর মধ্য থেকে ১৯৫ জনকে গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, জেনেভা কনভেনশনের আর্টিকেল তিন এর লঙ্ঘন, হত্যা, ধর্ষণ, লুটের অপরাধে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে বিচারের জন্য চিহ্নিত করা হয়েছে।
১৯৭৩ সালের ১ জুনের এক খবরে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পর্কে বলা হয়, ‘টোকিও ও নুরেমবার্গ বিচারের সময় যে মূল নীতি অনুসরণ করা হয়েছিল তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য জাতীয় সংসদে বাজেট অধিবেশনে একটি বিল পেশ করা হবে।’
১৯৭৩ সালের ৮ জুন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এক সাক্ষাৎকারে জানান, ‘ইতিপূর্বে তালিকাভুক্ত পাক যুদ্ধাপরাধীদের সংখ্যা ১২০০ থেকে কমে ১৯৫ জন হয়েছে। এই ১৯৫ জন পাক যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবেই।’
১১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৩ তারিখে বাংলার বাণী পত্রিকার একটি খবরের শিরোনাম "দালাল মন্ত্রী ইসহাকের যাবজ্জীবন কারাদন্ড"। চারদলীয় জোটের শরিক খেলাফত মজলিসের একাংশের আমির মাওলানা মোহাম্মদ ইসহাক সেই ‘দালাল মন্ত্রী’। তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সমর্থনে গঠিত ডা. মালিক মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন। স্বাধীনতার পর ওই মন্ত্রিসভার অন্য সদস্যদের সঙ্গে তাঁকেও গ্রেপ্তার করা হয়। রায়ের প্রায় ১০ মাস পর ’৭৩-এর ৫ ডিসেম্বর তিনি মুক্তি পান। মুক্তিযুদ্ধের পর সব মিলিয়ে তিনি প্রায় ২৪ মাস কারাগারে ছিলেন। মালিক মন্ত্রিসভায় জামায়াতে ইসলামীর দুজন সদস্য ছিলেন। তাঁদের মধ্যে দলের বর্তমান জ্যেষ্ঠ নায়েবে আমির মাওলানা আবুল কালাম মোহাম্মদ ইউসুফ অর্থমন্ত্রী এবং সাবেক ভারপ্রাপ্ত আমির আব্বাস আলী খান শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের পর তাঁরা দুজনই গ্রেপ্তার হন। একাত্তরের ১৪ আগস্ট ‘আজাদী দিবসে’ জয়পুরহাটে রাজাকার ও পুলিশ বাহিনীর সম্মিলিত কুচকাওয়াজে সভাপতির ভাষণে প্রয়াত আব্বাস আলী খান বলেছিলেন, ‘রাজাকাররা বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সমূলে ধ্বংস করে দিতে জান কোরবান করতে বদ্ধপরিকর।’ আবুল কালাম ইউসুফ ’৭১ সালের মে মাসে খুলনার খানজাহান আলী সড়কের একটি আনসার ক্যাম্পে ৯৬ জন জামায়াতকর্মী নিয়ে প্রথম রাজাকার বাহিনী গঠন করেন। দৈনিক সংগ্রামসহ সে সময়ের সংবাদপত্রগুলোতে এ খবর ছাপা হয়। ১৯৭৩ সালের ৩০ নভেম্বর সাধারণ ক্ষমাসংক্রান্ত প্রেসনোটে বলা হয়, ‘ধর্ষণ, খুন, খুনের চেষ্টা, ঘরবাড়ি অথবা জাহাজে অগ্নিসংযোগের দায়ে দণ্ডিত ও অভিযুক্তদের ক্ষেত্রে ক্ষমা প্রদর্শন প্রযোজ্য হইবে না।’ ১১ জানুয়ারি, ১৯৭২ দৈনিক বাংলায় প্রকাশিত খবরে দেখা যায়, পাকিস্তান থেকে দেশে ফিরে ১০ জানুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে দেওয়া বক্তৃতায় শেখ মুজিবুর রহমান যুদ্ধবন্দী ও দালালদের বিচারের ঘোষণা দেন। ১ এপ্রিল ১৯৭২, দৈনিক পূর্বদেশ অনুযায়ী, পরে খুলনায় এক জনসভায় বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন, কেউ দালালদের জন্য সুপারিশ করলে তাকেও দালাল সাব্যস্ত করা হবে। ১০ এপ্রিল ১৯৭২, দৈনিক ইত্তেফাক অনুযায়ী, বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের পক্ষে বিবৃতি দেওয়া এবং পাকিস্তান সরকারে যোগ দেওয়া আওয়ামী লীগের গণপরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদের ২৩ জনকে বহিষ্ককার করেন।
৩০ নভেম্বর, ১৯৭৩ সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার আগে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত দালাল আইনে গ্রেফতার ছিল মোট প্রায় ৩৭ হাজার ৪৭১ জন। তাদের দ্রুত বিচারের জন্য সরকার সারা দেশে ৭৩টি বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে। ১৯৭৩-এর অক্টোবর পর্যন্ত দুই হাজার ৮৮৪টি মামলা নিষ্পত্তি হয়। ৩০ নভেম্বর ১৯৭৩ - এ অভিযুক্ত প্রায় ৩৭ হাজার ৪৭১ জনের মধ্য থেকে অপরাধের কোন প্রকার প্রমাণ না পাওয়ায় ৩৬ হাজার ৪০০ জনের জন্য বঙ্গবন্ধু ‘সাধারণ ক্ষমা’ ঘোষণা করেন।[3][4][5] ক্ষমাপ্রাপ্ত এই ৩৬ হাজার ৪০০ জনের মধ্য থেকে ১৯৭৩ সালের ১৭ ই ডিসেম্বরের সময়ের ভিতরে ২১ হাজার বন্দীকে মুক্তি দেওয়া হয়।[6] সারাদেশে ৭৩টি বিশেষ ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে ২২ মাসে বাকী ২ হাজার ৮৪৮ জনের বিচার হয়। তাদের মধ্যে বিচারে ৭৫২ জনের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ প্রমানিত হয় এবং তাদের সাজা দেওয়া হয়। বাকী ২০৯৬ জন বেকসুর খালাস পায়।[7]
পরে ’৭৫-এর ৩১ ডিসেম্বর জিয়াউর রহমান দালাল আইন বাতিল করার পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। সে সময় চারটি সুনির্দিষ্ট অপরাধে কারাগারে আটক ১১ হাজার আসামি, এমনকি সাজাপ্রাপ্তরাও জেল থেকে ছাড়া পায়। ১৪ মার্চ, ১৯৭৩ তারিখে দৈনিক পূর্বদেশ-এ প্রকাশিত খবরের শিরোনাম ছিল 'দালাল আইনে সা’দ আহমদের যাবজ্জীবন কারাদন্ড'। খবরে বলা হয়, কুষ্টিয়া সেশন জজ-৩-এর বিশেষ ট্রাইব্যুনালের সদস্য আর কে বিশ্বাস কুষ্টিয়া শান্তি কমিটির সদস্য সা’দ আহমদকে পাক বাহিনীকে সহযোগিতা, অপহরণ ও নরহত্যার অভিযোগে এবং কুষ্টিয়া-১১ আসনে সাজানো উপনির্বাচনে অংশ নিয়ে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার কারণে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দিয়েছেন। রায়ে আদালত বলেন, ‘অভিযুক্তের আরও বেশি শাস্তি দেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু এই জেলার একজন সফল আইনজীবী হিসেবে অতীতের কাজের জন্য তাঁকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেওয়া হলো।’ ১১ জুন, ১৯৭২ তারিখে দৈনিক বাংলায় প্রধান শিরোনাম ছিল−‘দালালির দায়ে মৃত্যুদন্ড’। কুষ্টিয়ার দায়রা জজ ও বিশেষ ট্রাইব্যুনালের সদস্য রবীন্দ্র কুমার বিশ্বাস ৮ জুন রাজাকার চিকন আলীর বিরুদ্ধে এ রায় দেন। কুষ্টিয়ার মিরপুর গ্রামের চিকন আলীর বিরুদ্ধে ’৭১ সালের ১৯ অক্টোবর একই গ্রামের ইয়াজউদ্দিনকে গুলি করে মারার অভিযোগ ছিল। পরে উচ্চ আদালত সাজা কমিয়ে চিকন আলীকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেন। আট বছর চার মাস জেল খাটার পর দালাল আইন বাতিলের সুযোগে চিকন আলী ছাড়া পান।
৬ অক্টোবর, ১৯৭২ দৈনিক বাংলায় প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়, প্রখ্যাত শিক্ষক অধ্যাপক ড. এ কে আজাদ হত্যার অভিযোগে ১৯৭২ এর ৫ অক্টোবর ঢাকার বিশেষ ট্রাইব্যুনালের জজ সৈয়দ সিরাজউদ্দীন হোসেন আইয়ুব আলী, মকবুল হোসেন ও যোবায়ের নামের তিন আলবদর সদস্যকে মৃত্যুদন্ড দেন। ১৯৭১ সালের ১৫ ডিসেম্বর আজিমপুরের দায়রা শরিফের বাসভবন থেকে ড. আজাদকে অপহরণ করে আলবদররা।
দালাল আইনে সবচেয়ে বেশি কারাদন্ড হয় কুমিল্লার দেবীদ্বার উপজেলার জাফরগঞ্জ গ্রামের দালাল আবদুল হাফিজের। হত্যা, লুট ও দালালি মামলায় বিভিন্ন ধারায় তাঁকে আদালত ৪১ বছরের দন্ড দেন। ১৯৭৩ সালের ১২ এপ্রিল বাংলার বাণী পত্রিকায় এ সংবাদ প্রকাশিত হয়।
মামলার বিবরণে দেখা যায়, ’৭১-এর ১৫ অক্টোবর রাতে আবদুল হাফিজ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদস্যদের নিয়ে নিজ গ্রামের ইয়াসিন মিয়ার বাড়িতে ঢুকে তাঁর ভাগ্নে শাহ আলমকে হত্যা এবং ইয়াসিন মিয়ার বাবাকে অপহরণ করেন। ইয়াসিন মিয়া বাড়ির পেছন দিয়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। পরে দুই হাজার টাকা মুক্তিপণ দিয়ে তাঁর বাবাকে মুক্ত করেন তিনি।
১৯৭২ সালের জুলাই মাসে বগুড়ার ধুনট উপজেলার কালেরপাড়া ইউনিয়নের সরুগ্রামের আয়েজ মন্ডলের তিন ছেলেকে দন্ড দেওয়া হয়। তাঁদের মধ্যে মফিজুর রহমান ওরফে চান মিয়াকে মৃত্যুদন্ড, মোখলেছুর রহমান ওরফে খোকা মিয়া ও মশিউর রহমান ওরফে লাল মিয়াকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেওয়া হয়। ধুনট উপজেলার নান্দিয়ারপাড়া গ্রামের নুরুল ইসলাম তাঁদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করেছিলেন। উচ্চ আদালত পরে চান মিয়াকে মৃত্যুদন্ডের বদলে ২০ বছর সাজা দেন। অপর দুই ভাইয়ের সাজাও কমিয়ে প্রত্যেককে ১০ বছর কারাদন্ড দেওয়া হয়। মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলার চর শিলমন্দি (এখন পূর্ব শিলমন্দি) গ্রামের মাতবর কেরামত আলী কাজীর বিরুদ্ধে দুটি মামলায় মোট আট বছর কারাদন্ড হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ান্তি কমিটিতে যোগ দিয়েছিলেন। বাংলাদেশ হওয়ার পর তাঁর বিরুদ্ধে দড়ি চর শিলমন্দি গ্রামের সামসুদ্দিন মাস্টার ও সিরাজ নামের দুই মুক্তিযোদ্ধা মামলা করেন। উভয় মামলায় কেরামত আলীর সাজা হয়। কেরামত কাজী ১৯৯০ সালে মারা যান। নীলফামারীর সৈয়দপুরে রাজাকার ইজহার আহমেদের সহযোগিতায় মুক্তিযুদ্ধের সময় ওই এলাকায় অনেক হত্যাকাণ্ড ঘটে বলে অভিযোগ আছে। স্বাধীনতার পর শহীদ পরিবারের সদস্য প্রভু দয়াল আগারওয়াল ইজহারের বিরুদ্ধে তাঁর বাবা দানবীর শহীদ তুলসীরাম আগারওয়ালকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে ধরিয়ে দেওয়ার অভিযোগে মামলা করেন। ১৯৭১ সালের ১২ এপ্রিল রংপুরের নিসবেতগঞ্জের বধ্যভুমিতে তুলসীরামকে হত্যা করা হয়। ১৯৭২ ও ১৯৭৩ সালের দৈনিক পত্রিকাগুলো পর্যালোচনা করে দেখা যায়, কয়েক দিন পরপরই তখনকার পত্রিকায় দালাল আইনে সাজা হওয়ার খবর প্রকাশিত হতো। দৈনিক বাংলার ৭ ডিসেম্বর ১৯৭৩ সংখ্যায় প্রকাশিত সংবাদে দেখা যায়, ঢাকার বিশেষ আদালত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তিন সহযোগী ময়মনসিংহের মকবুল হোসেন, আইয়ুব আলী ও ঢাকার আতিয়ার রহমানকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেন। ’৭১-এর ১৫ ডিসেম্বর অভিযুক্ত এই তিনজন ঢাকার আজিমপুর থেকে ধরে নিয়ে মন্টুকে হত্যা করেন। ১৯৭২ সালের ৯ জানুয়ারি আজাদ পত্রিকার খবরে বলা হয়, ডা. মালিকের মন্ত্রিসভার পূর্তমন্ত্রী মোশাররফ হোসেনকে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীকে যুদ্ধ পরিচালনায় সহায়তার জন্য যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেওয়া হয়েছে। ১৯৭২ সালের ৪ এপ্রিল দৈনিক বাংলায় প্রকাশিত এক সংবাদে দেখা যায়, ঢাকার বিশেষ আদালত পূর্ব পাকিস্তান বিবিসির সংবাদদাতা নিজামউদ্দীনের অপহরণের সঙ্গে জড়িত আলবদর সিদ্দিকুর রহমান ও মোহাম্মদ গালিবকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেন। ১৯৭১-এর ১২ ডিসেম্বর অভিযুক্ত ব্যক্তিরা নিজামউদ্দীনের ঢাকার তৎকালীন রোকনপুর হাউস থেকে অন্য আলবদরদের সহায়তায় অপহরণ করেন। ১৯৭৩ সালের ১২ জুলাই দৈনিক বাংলায় প্রকাশিত এক সংবাদে দেখা যায়, রাজশাহীর বিশেষ ট্রাইব্যুনাল শ্রী কান্তি দাস হাওলাদারকে হত্যার অভিপ্রায়ে অপহরণ করায় মুজিবুর রহমান নামে এক রাজাকারকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেন। ১৯৭৩ সালের ১৪ এপ্রিল তৎকালীন পূর্বদেশ পত্রিকায় একটি খবর ছিল, পাক বাহিনীর সঙ্গে যোগসাজশ এবং তিন পল্লীবধুর শ্লীলতাহানির অভিযোগে মৌলভীবাজারের দীরুল আজীর আসিফ আলীকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেওয়া হয়। ১৯৭৩ সালের ২০ এপ্রিল দৈনিক সংবাদ-এর একটি খবরে দেখা যায়, কুমিল্লায় বিশেষ আদালত আবদুল হামিদ ও আজিজউল্লাহ্ নামের দুই দালালকে সশ্রম যাবজ্জীবন কারাদন্ড দিয়েছেন। রফিক উদ্দিন নামের এক মুক্তিযোদ্ধাকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে ধরিয়ে দেওয়ার অপরাধে তাঁদের সাজা দেন আদালত।
১৯৭৩ সালের ৩০ নভেম্বর দালাল আইনে আটক ৩৭,৪৭১ জনের মধ্য থেকে ৩৬,৪০০ জন ব্যক্তির জন্য ‘সাধারণ ক্ষমা’ ঘোষণা করা হয়। তবে এই সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার ৫ নং ধারায় বলা হয়, ‘যারা বর্ণিত আদেশের নিচের বর্ণিত ধারাসমূহে শাস্তিযোগ্য অপরাধে সাজাপ্রাপ্ত অথবা যাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে অথবা যাদের বিরুদ্ধে নিম্নোক্ত ধারা মোতাবেক কোনটি অথবা সব ক’টি অভিযোগ থাকবে। ধারাগুলো হলো: ১২১ (বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালানো অথবা চালানোর চেষ্টা), ১২১ ক (বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালানোর ষড়যন্ত্র), ১২৮ ক (রাষ্ট্রদ্রোহিতা), ৩০২ (হত্যা), ৩০৪ (হত্যার চেষ্টা), ৩৬৩ (অপহরণ),৩৬৪ (হত্যার উদ্দেশ্যে অপহরণ) ৩৬৫ (আটক রাখার উদ্দেশ্যে অপহরণ),৩৬৮ (অপহৃত ব্যক্তিকে গুম ও আটক রাখা), ৩৭৬ (ধর্ষণ), ৩৯২ (দস্যুবৃত্তি), ৩৯৪ (দস্যুবৃত্তিকালে আঘাত), ৩৯৫ (ডাকাতি), ৩৯৬ (খুনসহ ডাকাতি),৩৯৭ (হত্যা অথবা মারাত্মক আঘাতসহ দস্যুবৃত্তি অথবা ডাকাতি), ৪৩৫ (আগুন অথবা বিস্ফোরক দ্রব্যের সাহায্যে ক্ষতিসাধন),৪৩৬ (বাড়িঘর ধ্বংসের উদ্দেশ্যে আগুন অথবা বিস্ফোরক দ্রব্য ব্যবহার), ফৌজদারি দণ্ডবিধির ৪৩৬ (আগুন অথবা বিস্ফোরক দ্রব্যের সাহায্যে কোন জলযানের ক্ষতিসাধন) অথবা এসব কাজে উৎসাহ দান। এসব অপরাধী কোনোভাবেই ক্ষমার যোগ্য নন।’
সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পর ধীরে ধীরে অনেক দালাল বা সহযোগীকে মুক্তি দেওয়া হয়। যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত শান্তি কমিটির প্রধান খাজা খায়রুদ্দিন ৭ ডিসেম্বর ১৯৭৩ সালে কারাগার থেকে মুক্তি পান।[8] যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত মুসলিম লীগ নেতা খান এ সবুর ১৯৭৩ সালের ৫ ডিসেম্বর কারাগার থেকে মুক্তি পান।[8] ঘোষণার পর যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত গভর্নর ডাঃ আবদুল মুতালিব মালেক সহ পিডিপি'র নেতা শাহ আজিজুর রহমান, শর্ষীনার পীর আবু জাফর মোহাম্মদ সালেহ, ওয়াহিদুজ্জামান, সাবেক আওয়ামী লীগ নেতা একেএম শামসুল হক, জামায়েত নেতা একেএম ইউসুফ, আব্বাস আলী খান এবং আরও অনেকে মুক্তি পান।[9][10]
সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পরও ১১ হাজারের বেশি ব্যক্তি এ সকল অপরাধের দায়ে কারাগারে আটক ছিল এবং তাদের বিচার কার্যক্রম চলতে ছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে ১৯৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর দালাল আইন বাতিল করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া হয়। ১৯৭৫ এর ৩১ ডিসেম্বর জেনারেল জিয়া সামরিক অধ্যাদেশ জারী করে দালাল আইন বাতিল করেন। থেমে যায় যুদ্ধাপরাধের বিচার কার্যক্রম। শেখ মুজিবুর রহমান সরকারের জারী করা আইনগুলো একের পর এক অধ্যাদেশ জারী মধ্য দিয়ে রহিত করা হয়।[11] ১৯৭৬ সালে 'Second proclamation order no. ২ of ১৯৭৬' জারী করে ধর্ম-ভিত্তিক রাজনীতি করার লক্ষ্যে সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদের শর্তাদি তুলে দেয়া হয়। ১৯৭৬ এর ১৮ জানুয়ারি নাগরিকত্ব ফিরে পাবার জন্য মন্ত্রণালয় থেকে আবেদন করতে বলা হয় সবচেয়ে আলোচিত যুদ্ধাপরাধী গোলাম আজমকে। এছাড়াও 'proclamation order no. ১ of ১৯৭৭' দ্বারা সংবিধানের ১২ নম্বর অনুচ্ছেদ তুলে দেয়া হয়। মার্শল ল'র আওতায় এসব অধ্যাদেশ জারী করে জেনারেল জিয়ার সরকার। এসব অধ্যাদেশে স্বাক্ষর করেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম।[11]
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.