কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন
বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় রেলস্টেশন উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় রেলস্টেশন উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন (দাপ্তরিক নাম ঢাকা রেলওয়ে স্টেশন) হলো বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় অবস্থিত কেন্দ্রীয় রেলওয়ে স্টেশন। এটি দেশের বৃহত্তম স্টেশন ও পরিবহন খাতে ব্যস্ততম অবকাঠামো, যা রাজধানীর প্রবেশদ্বার হিসেবে বিবেচিত। এছাড়াও এটি প্রতিষ্ঠার দশকের আধুনিক ভবনগুলোর মধ্যে অন্যতম হিসেবে বিবেচিত। ১ মে ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দে এটি চালু করা হয়।[2][5][6][7]
কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন পাকিস্তান আমলে তৈরি হলেও স্টেশনের রেলপথটি ব্রিটিশ ভারতীয় আমলে নির্মিত হয়। পাকিস্তান সৃষ্টির পর ঢাকায় অবস্থিত পুরোনো রেলওয়ে স্টেশনটি অপর্যাপ্ত হওয়ায় শহরের কমলাপুর এলাকায় আরেকটি রেলওয়ে স্টেশন নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ১৯৬৮ সালে নির্মিত এই রেলওয়ে স্টেশনটি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত গণহত্যার স্বাক্ষী ছিল।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এখানে দেশের প্রথম অভ্যন্তরীণ কন্টেইনার ডিপো স্থাপন করা হয়। বিভিন্ন সময়ে স্টেশন ভবনটি স্থানান্তর ও ভেঙ্গে ফেলার প্রস্তাব ও সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও কর্তৃপক্ষ ও বিশিষ্টজনদের আপত্তির ফলে তা করা হয়নি। বর্তমানে এই স্টেশনকে ঘিরে মাল্টিমোডাল পরিবহন হাব নির্মাণের কাজ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে, যা ২০৩০ সালের মধ্যে সম্পন্ন করার কথা রয়েছে।
এই স্টেশন বর্তমানে বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত। সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো ভাসমান জনগোষ্ঠী, প্ল্যাটফর্মের উচ্চতা, নিরাপত্তাহীনতা, অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড, পদচারী সেতু ব্যবহারে যাত্রীদের অনাগ্রহ, কুলিদের সমস্যা, তথ্যের অপ্রাপ্যতা ইত্যাদি। স্টেশনে ১১টি প্ল্যাটফর্ম রয়েছে। এর পাশাপাশি এখানে হাসপাতাল, মসজিদ, থানাসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা রয়েছে।
১৮৮৫ সালে ব্রিটিশ শাসনামলে ঢাকা স্টেট রেলওয়ে নারায়ণগঞ্জ–বাহাদুরাবাদ ঘাট রেলপথ নির্মাণ করে। এই রেলপথটির একটি অংশ খুলে দিয়ে ঢাকার পুরোনো শহর থেকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত রেল পরিবহন সেবা চালু করা হয়। ১৮৯৫ সালে[8] অন্যান্য পরিষেবা সহ ঢাকা রেলওয়ে স্টেশন (যা ফুলবাড়িয়া রেলওয়ে স্টেশন নামেও পরিচিত) নির্মাণ সম্পন্ন হয়।[9] স্টেশনটি ঢাকার মূল শহরের দক্ষিণে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। একই বছরে ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ ও ময়মনসিংহ পর্যন্ত ট্রেন চলাচল শুরু হয়। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাজন ও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ঢাকা পূর্ববঙ্গের (পরবর্তীতে পূর্ব পাকিস্তান) রাজধানী হয়। সেই সময় রেলপথটি তেজগাঁও রেলওয়ে স্টেশন থেকে সোজা ফুলবাড়িয়ায় যেতো।[10]
বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে, বিশেষত ১৯৪৭ সালের পর ঢাকার নগরায়ন ও এর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটে। বিদ্যমান রেলপথটি উত্তরদিকে প্রসারিত হয়ে ঢাকাকে পুরনো ও নতুন শহরে দ্বিখণ্ডিত করে ফেলে। একই সাথে এই রেলপথ বিভিন্ন স্থানে সড়ক অতিক্রম করায় উত্তর-দক্ষিণের সড়কে যানচলাচল বাধাগ্রস্ত হতো। এছাড়াও ঢাকার উত্তর দিকে অবস্থিত পুরোনো ঢাকা রেলওয়ে স্টেশনটি অপূর্ণাঙ্গ ছিল। এখানে শুধু একটি প্ল্যাটফর্ম, একটি ছোট প্রাঙ্গণ ও একটি লোকোমোটিভ শেড (আক্ষ. 'ভ্রমণ সহায়ক ছাউনি') ছিল। তাই ধারণা করা হয়েছিল, স্টেশনটিকে তুলনামূলক কম ঘনবসতিপূর্ণ স্থানে স্থানান্তর করা হলে তেমন কোনো বাঁধা ছাড়াই উত্তর-দক্ষিণের যানবাহনের প্রবাহ সহজ হবে এবং পুরোনো ও নতুন ঢাকা একত্রিত হবে। ১৯৪৮ সালে বিশেষজ্ঞরা স্টেশনটিকে কমলাপুরে স্থানান্তরের পরামর্শ দেন।[7] ১৯৫২ সালে শহরের বাইরের স্টেশনটিকে স্থানান্তরের পরিকল্পনার পাশাপাশি তেজগাঁও থেকে গেন্ডারিয়া পর্যন্ত নতুন রেলপথ স্থাপনের পরিকল্পনা করা হয়। তবে অর্থসংকটে সেই পরিকল্পনা তখন বাস্তবায়ন করা যায়নি।[11] পরামর্শ প্রদানের ১০ বছর পর তথা ২০ ডিসেম্বর ১৯৫৮ সালে প্রাদেশিক সরকার কমলাপুরে ১৯৬৪ সালের মধ্যে নতুন রেলওয়ে স্টেশন নির্মাণ করার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করে। সেই সময় প্রকল্পের জন্য ₨৪.৫৬ কোটি বরাদ্দ করা হয় যার ৬০% অর্থ প্রাদেশিক সরকারের দেওয়ার কথা ছিলো।[12] স্টেশনটি নির্মাণের পূর্বে নির্মাণস্থলে একটি ধানক্ষেত ছিলো।[6] তেজগাঁও থেকে রেলপথের গতিমুখ পরিবর্তন করে খিলগাঁও, এরপর সেখান থেকে কমলাপুর পর্যন্ত নেওয়া হয়।[7] ১৯৬৫ সালে পুরোনো ঢাকা রেলওয়ে স্টেশনের কার্যক্রম সম্পর্কিত সমস্ত উপাদান নতুন রেলওয়ে স্টেশনে স্থানান্তর করা হয়।[11] ২৭ এপ্রিল ১৯৬৮ সালে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর আবদুল মোনেম খান স্টেশনটি উদ্বোধন করেন।[13] উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খান উপস্থিত ছিলেন।[7] এর নির্মাণ ব্যয় ₨১৩.৫ কোটি।[13] এর এক বছর পরে স্টেশন ভবনে রেলওয়ে ডাক সেবার প্রাদেশিক দপ্তর স্থানান্তর করা হয়।[14]
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ষোলো বছর পর, ১৯৮৭ সালের ১১ এপ্রিলে এই রেলওয়ে স্টেশনে দেশটির প্রথম অভ্যন্তরীণ কন্টেইনার ডিপো চালু করা হয়।[5] ২০০৫ সালে মার্কিন পরামর্শক ফার্ম লুই বার্জার গ্রুপ ঢাকা মহানগরীর জন্য একটি কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা (এসটিপি) প্রস্তুত করে।[15] সেই এসটিপিতে কেন্দ্রীয় রেলওয়ে স্টেশনটি টঙ্গীতে স্থানান্তরের পরামর্শ দেওয়া হলেও ঢাকা পরিবহন সমন্বয় বোর্ড কর্তৃক গঠিত স্থায়ী কমিটি প্রস্তাবটি নাকচ করে দেয়।[16] ২০১০-এর দশকে সরকার রেলওয়ে স্টেশনটি গাজীপুর জেলায় স্থানান্তরের প্রস্তাব করে। কিন্তু নগরবাসীর অসুবিধার কথা বিবেচনা করে রেলপথ মন্ত্রণালয় প্রস্তাবটির বিরোধিতা করে।[17] ২০১৩ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে স্টেশন ভবনটি চারবার সংস্কার করা হয়েছে।[18]
২০১৬ সালে শুরু হওয়া ঢাকা–যশোর রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পের অধীনে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনকে অন্তর্ভুক্ত ছয়টি রেলস্টেশন সংস্কারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।[19] ২০২০ সালে ঢাকায় অবস্থিত রেলওয়ে ভবনে অনুষ্ঠিত একটি সরকারি সভায় জানানো হয় যে সংস্কার কাজের অংশ হিসেবে স্টেশনে তিনটি নতুন ডুয়েলগেজ রেলপথ ও স্টেশনের ব্রডগেজ রেলপথের জন্য একটি নতুন প্ল্যাটফর্ম নির্মাণ করা হবে।[20]
বিদ্যমান নারায়ণগঞ্জ–বাহাদুরাবাদ ঘাট রেলপথের ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত অংশটি মিটারগেজ থেকে ডুয়েলগেজে উন্নীতকরণের জন্য এবং পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের জন্য ৪ ডিসেম্বর ২০২২ থেকে বন্ধ ঘোষণা করা হয়।[21] এই ঘোষণার ফলে কমলাপুর থেকে নারায়ণগঞ্জ রেলওয়ে স্টেশন পর্যন্ত ট্রেন চলাচল স্থগিত করা হয়, যার ফলে ওই পথে টাকা বাঁচাতে ট্রেনে যাতায়াতকারী যাত্রীদের দুর্ভোগ পোহাতে হয়।[22] দেশটির রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন ১৪ জানুয়ারি ২০২৩ সালে জানিয়েছিলেন যে মার্চের মধ্যে ট্রেন চলাচলের জন্য অংশটি খুলে দেওয়া হবে। কিন্তু দুটি প্রকল্পের কাজ শেষ না হওয়ায় তা করা সম্ভব হয়নি।[23] ২৫ জুলাই ২০২৩ তারিখে রেলমন্ত্রী ঘোষণা করেন যে আগস্টের প্রথম দিনে ঢাকা–নারায়ণগঞ্জ সেকশন পুনরায় চালু করা হবে।[24] চূড়ান্ত প্রতিশ্রুত দিনে কমলাপুর থেকে নারায়ণগঞ্জে রেলগাড়ি চলাচল আবার শুরু হয়।[25]
২০১৮ সালে কাজিমার সাথে সরকারি–বেসরকারি যৌথ বিনিয়োগে (পিপিপি) ঢাকা বিমানবন্দর, তেজগাঁও ও কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন ঘিরে মাল্টিমোডাল হাব নির্মাণ করার প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়। এর অধীনে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনের চারপাশে অবকাঠামো নির্মাণ করার পরিকল্পনা করা হয়; পরিকল্পনায় বহুতল আবাসন ভবন, হোটেল, শপিং মল, পাতাল ও উড়ালপথ অন্তর্ভুক্ত করা হয়।[26] ২০১৯ সালে বাংলাদেশ রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ স্টেশন ভবনের সামনে মাল্টিমোডাল হাব নির্মাণে আপত্তি জানায়।[27] ২০২০ সালে বাংলাদেশ রেলওয়ে ও ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড ঢাকা মেট্রো রেলের এমআরটি লাইন ৬-এর সঙ্গে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনের যোগাযোগ ঘটানোর সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু বর্তমান স্টেশনটি এমআরটি লাইন ৬-এর প্রস্তাবিত পথের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়ায় কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনটি ভেঙে ১৩০ মিটার উত্তরে নতুন জায়গায় তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।[28] দেশের বিভিন্ন স্থপতি ও ব্যক্তিবর্গ এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে।[29] ২০২১ সালের ৩০ জানুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে রেলওয়ে স্টেশনটি ভেঙ্গে ফেলার অনুমতি দেওয়া হয়। কিন্তু ফেব্রুয়ারিতে রেলপথ মন্ত্রণালয় কমলাপুর স্টেশন ভেঙ্গে ফেলার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে। তবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জানায়, প্রয়োজনে অদূর ভবিষ্যতে রেলওয়ে স্টেশনটি স্থানান্তর করা হতে পারে।[30][31] ভেঙ্গে ফেলার পরিবর্তে সরকার রেলওয়ে স্টেশন এলাকায় ভূগর্ভস্থ মেট্রোরেল, সাবওয়ে, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ও বাস র্যাপিড ট্রানজিটের জন্য স্টেশন তৈরির পরিকল্পনা করে। এগুলো সবই মাল্টিমোডাল হাবের অংশ, যা ২০৩০ সালের মধ্যে সম্পন্ন করার কথা রয়েছে।[2]
২০২০ সালে কোভিড-১৯ মহামারীর সময়ে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে প্রবেশাধিকার ও রেল সেবা বন্ধ করে দেওয়া হয়।[32] জুন মাসে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন খুলে দেওয়া হলেও ঈদুল আজহা উপলক্ষে কর্তৃপক্ষ অতিরিক্ত ট্রেনের ব্যবস্থা করেনি।[33] ২০২১-এর লকডাউনের সমাপ্তির পরে সরকার ট্রেনের টিকেট অনলাইনে বিক্রয় বাধ্যতামূলক করে। এর ফলে স্টেশনের সেবা থেকে নিম্নবিত্তের লোকজন বঞ্চিত হয়। অন্যদিকে বিনা টিকেটে স্টেশনে ঢুকতে না দেওয়ায় তারা ট্রেনের ছাদে চড়ে ভ্রমণ করতে পারেনি।[34] লকডাউনের দ্বিতীয় পর্যায় শেষ হওয়ার পর কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন খুলে দেওয়ার মাধ্যমে রেল যোগাযোগ শুরু হয়।[35] ২০২২ সালের প্রথম দিকে সার্স-কোভ-২ ভাইরাসের ওমিক্রন প্রকারণের ফলে স্টেশনে নতুন করে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে টিকেট বিক্রয় অর্ধেকে নামিয়ে আনা হয়।[36] একই বছরের ঈদুল আজহার সময় সরকার কর্তৃক মোটরসাইকেল চলাচল জেলায় সীমিত রেখে আন্তঃজেলা চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়। এই নিয়ম জারির ফলে স্টেশনে যাত্রীদের মাত্রাতিরিক্ত ভীড়ে দুর্ভোগের সৃষ্টি হয়।[37] ফলস্বরূপ ট্রেনের সময়সূচি বিপর্যয় দেখা দেয়।[38]
কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনের স্থপতি ছিলেন দুজন: ড্যানিয়েল ডানহাম ও বব বুই। দুজনই লুই বার্জার গ্রুপের স্থপতি হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানে এসেছিলেন।[28] ডানহামের নির্দেশনায় এর নকশা প্রস্তুতের প্রক্রিয়া আরম্ভ হয় যা রবার্ট বাউগি অব্যাহত রাখেন।[1]
ডানহাম ও বুইয়ের নকশায় একটি প্রশস্ত স্প্যানের কাঠামো অন্তর্ভুক্ত ছিল যা অঞ্চলটির জলবায়ুর জন্য উপযুক্ত। আর এটা তাদের কাছে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। এর জন্য তারা স্টেশন ভবনের ছাদের কংক্রিটের কাঠামো নকশা করে। স্থাপনায় একটি প্যারাসল ছাদ অন্তর্ভুক্ত ছিল যা তখন নতুন ছিল। ছাদটি নিম্নমুখী আন্তঃসংযুক্ত কাঠামোর একটি সারিকে আশ্রয় দেয়। ভবনের শৈলী ছিলো মৃদুভাবে সূক্ষ্মাগ্র ও খিলান করা খোলসসমূহের এক ছন্দময় বিন্যাস। এটি গ্রীষ্মমণ্ডলীয় আবহাওয়ার একটি সাধারণ চিত্র তুলে ধরে, যেখানে একটি ছাতা বর্ষার জল হতে সুরক্ষা প্রদান করে। স্টেশনটির নকশায় একটি একত্রিত ছাউনি ভিত্তিক ছাদের নিচে স্টেশনের টিকেট বুথ, প্রশাসনিক অফিস, যাত্রী বিশ্রামকেন্দ্র ও অপেক্ষা করার স্থান সমেত বিভিন্ন কার্যকরী স্থান রয়েছে।[7]
পুরো স্থাপনাটি ৩৬টি বর্গক্ষেত্রের সমন্বয়ে গঠিত। এতে মোট ৪৯টি কলাম রয়েছে। এর ওপর দাঁড়িয়ে আছে ৩৬টি সরু কংক্রিটের গম্বুজ নিয়ে একটি ছাদ। ৫৯ ফুট উঁচু প্রতিটি কলাম ওপরের দিকে গিয়ে চারটি শাখা বিস্তার করে ছাদটাকে ধরে রেখেছে।[28]
১৯৯৯ সালে রেলওয়ে স্টেশনের প্রবেশপথে "সূর্যকেতন" নামক একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়। এটি ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হওয়া রেলওয়ে কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সম্মান জানানোর উদ্দেশ্যে নির্মিত হয়েছিল।[39]
১৯৭১ সালে অপারেশন সার্চলাইট শুরু করার পর শীঘ্রই পাকিস্তান সেনাবাহিনী কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে আক্রমণ করে। তারা স্টেশনে আসা ট্রেনে থাকা যাত্রীদের হত্যা করে ট্রেনগুলো পুড়িয়ে দেয়। এই গণহত্যায় রেলওয়ে স্টেশনের আনুমানিক ৩০ জন কর্মচারী মারা যায়।[39]
২২ জুন ২০০৯ সালে সাঙ্কেতিক ব্যবস্থার ভুলের কারণে স্টেশনে মহানগর প্রভাতী ও এক্সপ্রেসের মধ্যে সংঘর্ষে ১ জন নিহত ও ৪০ জন আহত হয়।[40]
২০১৪ সালের ২৯ ডিসেম্বরে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে লরি ও ট্রেনের সংঘর্ষের ফলে একটি দুর্ঘটনা ঘটে। এর ফলে ৬ জন মারা যায়।[41] ২০১৭ সালের ১২ আগস্টে ঈদুল আজহাকে কেন্দ্র করে পরিচালিত রেলওয়ে থানার অভিযানে স্টেশন থেকে বিভিন্ন অপরাধে অভিযুক্ত ১৮ জন ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়।[42] ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসে স্টেশনের নিয়ন্ত্রণ কক্ষে আগুন লাগার ফলে ট্রেনের সময়সূচিতে বিপর্যয় দেখা দেয়। একই বছরের ২৩ মে তারিখে স্টেশন মাস্টারের কক্ষে আগুন লাগে, তবে তা অগ্নি নির্বাপন যন্ত্রের ব্যবহারে নিভিয়ে ফেলা সম্ভব হয়।[43] এরপর ১৯ আগস্টে স্টেশনের এক পরিত্যক্ত বগিতে ধর্ষণের পর একটি মেয়েকে হত্যার ঘটনা ঘটে।[44] ২০২১ সালের ২৩ ডিসেম্বরে স্টেশন ভবনের দ্বিতীয় প্ল্যাটফর্মে ট্রেনের নিচে চাপা পড়ে একজনের মৃত্যু ঘটে।[45]
২০২২ সালের ৯ জানুয়ারিতে ট্রেনের বগি জোড়া দেওয়ার সময় রেলওয়ে স্টেশনের একজন পয়েন্টসম্যান কাটা পড়ে মারা যায়।[46] একই বছরের ২৩ তারিখে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে স্টেশন মাস্টারের জিনিসপত্র চুরির ঘটনা ঘটে। পরবর্তীতে তদন্ত চলাকালীন সময় ১৮ মে তারিখে গোয়েন্দা পুলিশ চোর সমেত চুরি যাওয়া মাল উদ্ধার করতে সক্ষম হয়।[47] ৭ মে তারিখে স্টেশনে থাকা একটি কার্গো কন্টেইনারে আগুন লাগার পর দমকল বাহিনীর তিনটি ইউনিটের চেষ্টায় তা নিয়ন্ত্রণে আসে।[48]
৭ অক্টোবরে স্টেশনের প্রথম প্ল্যাটফর্মে একটি সতেরো বছর বয়সী কিশোরীকে গণধর্ষণ করা হয়। এই ঘটনায় ৬ জন জড়িত ছিল, যারা স্টেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে কাজ করতো।[49] ২০২২ সালের ২০ অক্টোবরে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনের একদল টিকেট কালোবাজারিদের গ্রেফতার করে। দলটি ২০১৫ সাল থেকে বাকিদের থেকে স্টেশনের ট্রেনের টিকেট কিনে নিয়ে অধিক মূল্যে বিক্রয় করতো। তাদের এই কালোবাজারির ফলে স্টেশনে টিকেট সংকট দেখা দিতো।[50] ২০২২ সালের ২৯ ডিসেম্বরে সরকারবিরোধী বিক্ষোভের সময় প্লাটফর্মে বোমা বিস্ফোরণের ফলে একজন রেলওয়ে পুলিশ সদস্য মারা যান।[51]
২০২৩ সালের ঈদুল ফিতরে অনলাইন থেকে অগ্রীম টিকেট না ক্রয় করে স্টেশন প্রবেশে ও ট্রেনের ছাদে বসে ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা প্রদান করা হয়।[52] এই নিষেধাজ্ঞার ফলে দ্রুত টিকেট বিক্রি হয়ে যাওয়ায় স্টেশন প্লাজায় ঈদের আগে টিকেট কিনতে এসে কেউ কেউ ভোগান্তিতে পড়েন।[53] তাই স্টেশনের কাউন্টারগুলোয় টিকেট প্রত্যাশী মানুষের ভীড় অনুপস্থিত ছিলো।[54]
এই স্টেশনে এগারটি প্ল্যাটফর্ম রয়েছে। প্রতিটি ৯১৮.৪ মিটার[55] দীর্ঘ। নিম্নে প্ল্যাটফর্মগুলোর সংখ্যা অনুযায়ী বর্ণনা দেওয়া হলো:
কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে ঢাকা অভ্যন্তরীণ কন্টেইনার ডিপো নামক একটি ইয়ার্ড আছে। এটি চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের মালিকানায় রয়েছে। ২০১৫ সালে সাইফ পাওয়ার টেক লিমিটেড এর পরিচালনার দায়িত্ব পায়।[57] স্টেশন ভবনের নিকটে ৩২ একর জমিতে এটি অবস্থিত।[58] এটি চট্টগ্রাম বন্দরের ৭০ ভাগ কন্টেইনারের মাত্র ১০ শতাংশ তথা ৯০,০০০ টিইইউএস ধারণ করার সক্ষমতা রাখে।[59]
৪.৩ একর জমিতে ১৯৮৬ সালে রেলওয়ে জেনারেল হাসপাতাল, কমলাপুর প্রতিষ্ঠা করা হয়। বাংলাদেশ রেলওয়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের চিকিৎসা সেবা দেওয়ার উদ্দেশ্যে হাসপাতালটি যাত্রা শুরু করে। ২০১৩ সালে সরকারি–বেসরকারি অংশীদারিত্বের অধীনে[60] হাসপাতাল পরিচালনা করার পরিকল্পনা করা হয়। এর দুই বছর পরে, হাসপাতালের শয্যা ১০০ তে উন্নীত করে সবার জন্য এর সেবা উন্মুক্ত করা হয়।[61] এর বর্তমান শয্যা সংখ্যা ৪০টি।[62]
"ঢাকা রেলওয়ে স্টেশন কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ" নামে যাত্রীদের ব্যবহারের জন্য এখানে একটি মসজিদ রয়েছে। প্রতি বছর রমজান মাসে ইফতারে এই মসজিদ থেকে নামাজ পড়তে আসা যাত্রীদের বিনামূল্যে খাবার বিতরণ করা হয়।[63]
রেলওয়ে পুলিশ কমলাপুরে একটি থানা পরিচালনা করে। এই থানায় একটি হাজতখানা রয়েছে। এই থানায় রেলওয়ে স্টেশন থেকে অভিযুক্ত আটক ব্যক্তিদের রাখা হয়। ২০২১ সালে থানা ভবনটি আধুনিকায়ন ও সংস্কার করা হয়। সংস্কারকাজের পর কয়েদী ও পুলিশ সদস্যের জন্য এখানে পাঠাগার ও পানযোগ্য পানির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।[64]
২০২২ সাল অনুযায়ী কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন ব্যবহার করে দৈনিক অন্তত এক লাখ পনেরো হাজার মানুষ যাত্রা করে।[2] রেলওয়ে স্টেশনটিতে প্রতি বছর ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা উপলক্ষে বাড়ি ফেরার অপেক্ষায় থাকা মানুষের ভীড় দেখা যায়। তবে কোভিড-১৯ মহামারীর সময়ে ব্যতিক্রম চিত্র দেখা গিয়েছিল।[65]
২০১৪ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ঢাকায় গৃহহীন মানুষের সংখ্যা অন্তত সাত হাজার। তাদের অনেকে অর্থের অভাবে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে বসবাস করে। বর্তমানে এটি শহরের নিঃস্ব জনগোষ্ঠীর আবাসস্থলের মধ্যের অন্যতম।[66]
নিরাপত্তাহীন এই রেলওয়ে স্টেশনটি ভবঘুরেদের অপরাধের লক্ষ্যবস্তু। গোয়েন্দা শাখার তথ্য অনুযায়ী এই রেলওয়ে স্টেশনে অপকর্ম করতে অপরাধীরা মুখিয়ে থাকে। গোয়েন্দা শাখার এক কর্মকর্তার মতে স্টেশনটি যাত্রীদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। রেলওয়ে পুলিশের তথ্য অনুযায়ী ২০২১ সালে স্টেশন ভবন থেকে ৮৬ অপরাধীকে গ্রেফতার করা হয়।[67] এর পাশাপাশি এটি মাদক কারবারিদের জন্য নিরাপদ স্থান।[68]
২০২২ সালে নিউজবাংলা২৪.কমের প্রতিবেদন অনুযায়ী সন্ধ্যার পর থেকে স্টেশনে নিরাপত্তা ও পুলিশ সদস্যের অভাব দেখা যায়। প্রতিবেদক স্টেশনের কিছু লোককে প্রকাশ্যে মাদক গ্রহণ করতে দেখা যায়। প্রতিবেদকের একটি সাক্ষাৎকারে স্টেশনের কুলি জানায় যে রাত ১২টার পর পুলিশ সরিয়ে নেওয়া হয়। অন্যদিকে, রেলওয়ে পুলিশ কর্তৃপক্ষ স্টেশনের নিরাপত্তাহীনতার জন্য জনবলের অভাবকে দায়ী করে।[69]
কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনের প্ল্যাটফর্মগুলোর উচ্চতা ট্রেনের উচ্চতার সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ।[70] যেহেতু স্টেশনটি নির্মাণের সময় পূর্ব পাকিস্তানের সব ট্রেনগুলো মিটার গেজ ছিল, তাই মিটার গেজের সাথে মিল রেখে প্ল্যাটফর্মের উচ্চতা ঠিক করা হয়েছিল। ফলাফলস্বরূপ, যাত্রীরা প্ল্যাটফর্ম থেকে ব্রডগেজ ও ডেমু ট্রেনে উঠতে সমস্যায় পড়ে।[71] ২০২১ সালে প্ল্যাটফর্মের সমস্যা সমাধানের জন্য স্টেশনে সংস্কারকাজ করা হয়। কিন্তু ২.৭ কোটি টাকা ব্যয়ে সংস্কার করার পর স্টেশনের মানহীন সংস্কার নিয়ে প্রশ্ন উঠে।[56]
২০২১ সাল অনুযায়ী এই রেলওয়ে স্টেশনে কর্মরত কুলির সংখ্যা ছিল ২১০ জন। স্টেশনে কুলি হিসেবে কাজ করতে কমলাপুরের কর্তৃপক্ষ থেকে অনুমতি নিতে হয়। জাগো নিউজ-এর একজন সাংবাদিকের প্রতিবেদন অনুযায়ী এখানে কুলি হিসেবে কাজ করতে ঘুষ দিতে হচ্ছে। এছাড়া, অভিযোগ রয়েছে যে কুলিদের সাহায্য বা সমস্যা সমাধান করতে স্টেশন কর্তৃপক্ষ কোন ব্যবস্থা নেয় না।[72] আরও অভিযোগ রয়েছে যে কুলিরা পণ্য বহনে সরকার নির্ধারিত টাকার চেয়ে বেশি আদায় করে থাকে।[73]
স্টেশনের অধিকাংশ ডিসপ্লে ও শিডিউল বোর্ড অকার্যকর। এর পাশাপাশি যাত্রীরা স্টেশনের পুলিশ তথ্যকেন্দ্র থেকে ট্রেন চলাচলের সঠিক তথ্য পাননা।[74] স্টেশনে ট্রেন সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্যের জন্য যাত্রীরা স্টেশন মাস্টারকে না পাওয়ার জন্য ফলে সমস্যার সম্মুখীন হয়ে থাকে।[75] ট্রেনের সময়সূচি ঘোষণা করতে থাকা মাইক্রোফোনের শব্দ স্পষ্ট না হওয়ায় বিভ্রান্তিতে পড়তে হয়।[76]
স্টেশনের প্ল্যাটফর্মগুলোতে চলাচলের জন্য প্রতিটি প্ল্যাটফর্মে পদচারী সেতুর ব্যবস্থা আছে। কিন্তু অনেক যাত্রী সেগুলো ব্যবহারের বদলে রেলপথের উপর দিয়ে হেঁটে পারাপার হওয়া সত্ত্বেও স্টেশন কর্তৃপক্ষ তাদের বাধা দেওয়া বা নিরুৎসাহিত করতে কোন পদক্ষেপ নেয় না।[77]
বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ও অন্যান্য সংস্কৃতিতে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনকে প্রায়ই তুলে ধরা হয়ে থাকে। বছরের পর বছর স্টেশনটিকে অনেক বাংলাদেশী চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন প্রযোজনায় ব্যবহার করা হয়েছে। এই স্টেশনে বহু চলচ্চিত্র ও অনুষ্ঠানের চিত্রধারণ করা হয়েছে, যেমন: সত্তা,[78] ফেরেশতে,[79] ইস্টিশন ইত্যাদি।[80]
বঙ্গবন্ধু হাইটেক সিটিতে অবস্থিত বঙ্গবন্ধু হাইটেক সিটি রেলওয়ে স্টেশনের আসল নকশাটি এই স্টেশনের আদলে করা হয়েছে।[81] দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত সিলেট রেলওয়ে স্টেশনের স্থাপনাটি দেখতে এই কেন্দ্রীয় রেলওয়ে স্টেশনের মতো।[82]
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.