চণ্ডী

দেবীমাহাত্ম্যম্ গ্রন্থের সর্বোচ্চ দেবী উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ

চণ্ডী

চণ্ডী (সংস্কৃত: चण्डी) বা চণ্ডিকা দেবীমাহাত্ম্যম্ গ্রন্থের সর্বোচ্চ দেবী। তিনি দুর্গা সপ্তশতী নামেও পরিচিত। মহাকালী, মহালক্ষ্মীমহাসরস্বতী দেবীর সমন্বয়ে চণ্ডীকে উক্ত গ্রন্থে সর্বোচ্চ সত্ত্বা বলে উল্লেখ করা হয়েছে । তিনি দেবী পার্বতীর উগ্র অবতার বিশেষ,গ্রন্থের অন্তঃভাগে মূর্তিরহস্য অংশে তাকে অষ্টাদশভুজা মহালক্ষ্মী নামে অভিহিত করা হয়েছে।

দ্রুত তথ্য চণ্ডী, দেবনাগরী ...
চণ্ডী
Thumb
চতুর্ভুজা চণ্ডী
দেবনাগরীचण्डी
অন্তর্ভুক্তিমহাশক্তি ,পার্বতী
মন্ত্রওঁ ঐং হ্রীং ক্লীং চামুণ্ডায়ৈ বিচ্চে
বাহনসিংহ
সঙ্গীশিব
বন্ধ

ব্যুৎপত্তি

দেবীমাহাত্ম্যম্ গ্রন্থে "চণ্ডী" বা "চণ্ডিকা" দেবীকে সর্বোচ্চ দেবীর মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। কোবার্নের মতে,চণ্ডী বা চণ্ডিকা হলেন ভয়ংকরী ও ক্রোধোন্মত্তা দেবী। দেবী চণ্ডীর সমমনস্কা কন্যা হলেন সর্পদেবী মনসা। উল্লেখ্য, প্রাচীন সংস্কৃতে "চণ্ডিকা" শব্দটি কোথাও পাওয়া যায় না। বৈদিক সাহিত্যেও এই শব্দটির কোনো উল্লেখ নেই। তবে রামায়ণমহাভারতেও শব্দটির উল্লেখ না থাকলেও, একটি স্তোত্রে "চণ্ড" ও "চণ্ডী" কথাদুটি বিশেষণ হিসেবে পাওয়া যায়।[]

প্রাচীন সংস্কৃত রচনায় চণ্ডী কথাটির অনুপস্থিতির কারণ হল এই দেবী হিন্দুধর্মের অব্রাহ্মণ্য শাখার দেবতা। ইনি প্রকৃতপক্ষে বঙ্গদেশের অনার্য আদিবাসী সমাজের দেবী।

দেবীমাহাত্ম্যম্ গ্রন্থে চণ্ডী বা চণ্ডিকা শব্দদুটি মোট ২৯ বার ব্যবহৃত হয়েছে। অনেক গবেষক মনে করেন এই দেবীর উৎস প্রাচীন বঙ্গদেশের শাক্ত সম্প্রদায়ের তন্ত্র সাধনায়। "চণ্ডী" শব্দটি দেবীর সর্বাপেক্ষা পরিচিত অভিধা। দেবীমাহাত্ম্যম্ গ্রন্থে চণ্ডী, চণ্ডিকা, অম্বিকা ও দুর্গা শব্দগুলি সমার্থক শব্দ হিসেবে ব্যবহৃত।[]

পৌরাণিক উপাখ্যান

দেবীমাহাত্ম্য গ্রন্থের দ্বিতীয় অধ্যায়ে দেবীর উৎস ব্যাখ্যা করা হয়েছে: "মহিষাসুরের নেতৃত্বে অসুরদের সঙ্গে দীর্ঘ যুদ্ধের পর দেবতারা পরাজিত হলে তাঁরা ব্রহ্মাকে পুরোধা করে বিষ্ণুসকাশে উপস্থিত হন, সেখানে তখন মহাদেবও অবস্থান করছিলেন। মহিষাসুরের কাছে তাঁদের নিগৃহীত হওয়ার বিবরণ দেবাদিদেব ও নারায়ণের ক্রোধাগ্নি প্রজ্জ্বলিত করে,যা গগনস্পর্শী তেজঃপুঞ্জের আকারে একত্রিত হয়। এর সঙ্গে যোজিত হয় ব্রহ্মা ও সমবেত অন্যান্য দেবতাদের তেজ। দেবগণের সেই শক্তি সম্মিলিত হয়ে এক মহাজ্যোতির সৃষ্টি করলে দশদিক আলোকে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। সেই অভূতপূর্ব ত্রিলোক-উদ্ভাসী আলোকবর্তী ক্রমে এক নারীমূর্তি ধারণ করে। এভাবেই দেবতাদের দেহসঞ্জাত তেজঃপুঞ্জ হতে মহাদেবীর উৎপত্তি হয়।"

"এই দেবী ছিলেন মহাশক্তি। তিনি ত্রিনয়না, তাঁর কপালে অর্ধচন্দ্র শোভিত। দেবীর বহু হাতে বহু প্রকার অস্ত্র, গায়ে দিব্যবস্ত্র , বহুমূল্য অলংকার ও মালা, বর্ম ও কবচ, যা সকল দেবতা এই মহাদেবীকে উপহার দিয়েছিলেন। তাঁর সোনার অঙ্গ সহস্র সূর্যের ন্যায় উজ্জ্বল। এইরূপে সিংহবাহিনী দেবী চণ্ডী হয়ে উঠলেন বিশ্বশক্তির মূর্তিস্বরূপ।" দেবী চণ্ডী দেবতাদের অঙ্গসম্ভূতা হলেও স্বয়ং আদ্যাশক্তি পরমাপ্রকৃতি মহামায়া। পরবর্তী সময়ে দেবী পার্বতী শুম্ভাসুর নিশুম্ভাসুর বধ হেতু নিজের কৃষ্ণকোষ থেকে পুনরায় অম্বিকাকে সৃষ্টি করেন। তিনি ও তাঁর ললাটসম্ভূতা কালী অসুর বধ করেন ও আদ্যাশক্তির দেহে আবার বিলীন হয়ে যান। [][] স্কন্দপুরাণে অনুরূপ একটি কাহিনী রয়েছে। এই পুরাণে আরো বলা হয়েছে যে- দেবী পার্বতী দেহসম্ভূতা এক দেবী চণ্ড ও মুণ্ড নামক অসুরদ্বয়কে বধ করেন।[] এবং এর থেকে তাঁর নাম হয় চামুণ্ডা। এই চামুুণ্ডা বা কালিকা দেবীর চণ্ডীরই অপর রূপ।

মূর্তিতত্ত্ব

Thumb
চণ্ডীর ব্রহ্মদেশীয় রূপ দেবী চণ্ডী

দেবীমাহাত্ম্য গ্রন্থের মধ্যম চরিতে বর্ণিত ধ্যানমন্ত্র অনুযায়ী দেবী চণ্ডী অষ্টাদশভুজা - অক্ষমালা, পরশু, গদা, তীর, ধনুক, বজ্র, পদ্ম, কমণ্ডলু, মুদ্গর, শূল, খড়্গ, ঢাল, শঙ্খ, ঘণ্টা, মধুপাত্র, ত্রিশূল, অঙ্কুশ,ডমরু এবং ও সুদর্শন চক্র ধারণ করেন। তিনি রক্তবর্ণা ও পদ্মাসনা।[]

কোনো কোনো মন্দিরে দেবী চণ্ডী মহাকালী, মহালক্ষ্মী ও মহাসরস্বতী দেবী রূপে পৃথক পৃথকভাবে পূজিতা হন। আবার কোথাও কোথাও দেবীর চতুর্ভুজা মূর্তিরও পূজা করা হয়। এই চতুর্ভুজা মূর্তিকল্প আগমতন্ত্র থেকে গৃহীত ও "শ্রীশ্রী চণ্ডী" গ্রন্থের ধ্যানাংশে বিধৃত। ধ্যানমন্ত্র এরূপ "বন্ধুককুসুমাভাসাং পঞ্চমুণ্ডাধিবাসিনীম্। স্ফুরচ্চন্দ্রকলারত্নমুকুটাং মুণ্ডমালিনীম্।। ত্রিনেত্রাং রক্তবাসসং পীনোন্নতঘটস্তনীম্। পুস্তকঞ্চাক্ষমালাঞ্চ বরঞ্চাভয়কং ক্রমাৎ। দধতীং সংস্মরেন্নিত্যমুত্তরাম্নায়মানিতাম্।।"

- পঞ্চমুণ্ডের আসনে অধিষ্ঠিতা ( পঞ্চমুণ্ড = পাঁচটি মুণ্ড অথবা পঞ্চমুণ্ডধারী শিব) , বন্ধুকপুষ্পের ন্যায় রক্তবর্ণা, চন্দ্রকলাবিশিষ্ট রত্নমুকুট ও মুণ্ডমালা ধারিণী, ত্রিনয়না, রক্তবস্ত্রপরিহিতা, ঘটের ন্যায় উন্নত স্তনযুক্তা, চতুর্ভুজে ক্রমান্বয়ে পুস্তক, অক্ষমালা বা বর্ণমালা, বর ও অভয়মুদ্রা ধারিনী, উত্তর আম্নায়ের সম্মাননীয়া দেবী(চণ্ডী)কে নিত্য উত্তমরূপে স্মরণ করি।

মন্দির

দেবী চণ্ডীর কয়েকটি বিখ্যাত মন্দিরের তালিকা নিচে দেওয়া হল:

Thumb
চণ্ডী মন্দির, হরিদ্বার

বাংলার লোকবিশ্বাস

সারাংশ
প্রসঙ্গ

চণ্ডী পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম জনপ্রিয় লৌকিক দেবী। খ্রিষ্টীয় ত্রয়োদশ থেকে ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে দেবী চণ্ডীর মাহাত্ম্য প্রচারের জন্য একাধিক চণ্ডীমঙ্গল কাব্য রচিত হয়। এর ফলে লৌকিক চণ্ডী দেবী মূলধারার হিন্দুধর্মে স্থান করে নেন। মঙ্গলকাব্য ধারার চণ্ডী দেবী কালীর সমতুল্য।[] তিনি শিবের স্ত্রী গিরিজা পার্বতীর অবতার গণেশকার্তিকের জননী।[] চণ্ডীর ধারণাটি নানা বিবর্তনের মধ্য দিয়ে এসেছে। তাই চণ্ডীর পূজাও বিভিন্ন প্রকার।

চণ্ডী সৌভাগ্যের দেবী। সুখসমৃদ্ধি, সন্তান, বিজয় ইত্যাদি কামনায় তার মঙ্গলচণ্ডী,সঙ্কটমঙ্গলচণ্ডী,রণচণ্ডী,কুলুইচণ্ডী,গন্ডকীচণ্ডী,ওলাইচণ্ডী,বনচণ্ডী,নাগমঙ্গলচণ্ডী ইত্যাদি মূর্তিগুলি পূজা করা হয়। ওলাইচণ্ডীর পূজা হয় মহামারি ও গবাদিপশুর রোগ নিবারণের উদ্দেশ্যে।[১০]

পশ্চিমবঙ্গের বহু গ্রামের নামের সঙ্গে দেবী চণ্ডীর নাম যুক্ত। প্রাচীন কামতাপুর রাজ্যের সমগ্র জনজাতি ও রাজ্যের মঙ্গলের জন্য এই পূজা করতেন। বানগড়ের রাজা বিষ্ণুবর্মণ স্বাধীন বানগড়ে একটি বিশাল চণ্ডী মন্দির স্থাপন করেছিলেন। বৈদেশিক আক্রমণের ফলে মন্দিরটি অবলুপ্ত। বানগড়ের ইতিহাস বিকৃত করা হয়েছে। বর্তমানেও মন্দির ও রাজবাড়ির ইতিহাস লুট করা হয়েছে। তবে জনগনের বিশ্বাস আছে বলে সমগ্র উত্তরবঙ্গ জুড়ে আজও চণ্ডীপূজা হয়ে থাকে। এছাড়াও বৃহত্তর দক্ষিণ কলকাতার বেহালা-বড়িষা অঞ্চলে চণ্ডীপূজা ও মেলা আজও সমধিক প্রসিদ্ধ।

মঙ্গলচণ্ডীর পূজা সমগ্র পশ্চিমবঙ্গ এমনকি অসমেও প্রচলিত।[১১]

পাদটীকা

তথ্যসূত্র

Loading related searches...

Wikiwand - on

Seamless Wikipedia browsing. On steroids.