Remove ads
উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
কনস্টান্টিনোপল বিজয় (গ্রিক: Άλωση της Κωνσταντινούπολης, Alōsē tēs Kōnstantinoupolēs; তুর্কি: İstanbul'un Fethi) ১৪৫৩ খ্রিষ্টাব্দে উসমানীয় সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মদ কর্তৃক শহরটি অধিকারের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। পূর্বে এটি পূর্ব রোমান (বাইজেন্টাইন) সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল। শহর অধিকারের পূর্বে এটি জুলিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসারে ১৪৫৩ খ্রিষ্টাব্দের ৬ এপ্রিল থেকে ২৯ মে পর্যন্ত অবরোধের সম্মুখীন হয়। এরপর চূড়ান্তভাবে শহরটি উসমানীয়দের অধিকারে আসে।
কনস্টান্টিনোপল বিজয় | |||||||
---|---|---|---|---|---|---|---|
মূল যুদ্ধ: বাইজেন্টাইন-উসমানীয় যুদ্ধ এবং ইউরোপে উসমানীয় যুদ্ধ | |||||||
কনস্টান্টিনোপলের শেষ অবরোধ, ১৫ শতকের ফরাসি অনুচিত্র | |||||||
| |||||||
বিবাদমান পক্ষ | |||||||
| |||||||
সেনাধিপতি ও নেতৃত্ব প্রদানকারী | |||||||
| |||||||
শক্তি | |||||||
হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতি | |||||||
সর্বমোট ৪,০০০ জন নিহত (সৈনিক ও বেসামরিক লোক মিলিয়ে)[২৩][২৪] ৩০,০০০ এর মত লোককে দাসে পরিণত করা হয় বা বহিষ্কার করা হয়[২৫] |
অজ্ঞাত তবে অসংখ্য ২৬০ জন উসমানীয় বন্দী মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত[২৬] | ||||||
কনস্টান্টিনোপলে বিজয়কে ১৫০০ বছরের মত টিকে থাকা রোমান সাম্রাজ্যের সমাপ্তি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।[২৮] উসমানীয়দের এই বিজয়ের ফলে উসমানীয় সেনাদের সামনে ইউরোপে অগ্রসর হওয়ার পথে আর কোনো বাধা থাকল না। খ্রিষ্টানজগতে এই পতন ছিল বিরাট ধাক্কার মত। বিজয়ের পর সুলতান মুহাম্মদ তার রাজধানী এড্রিনোপল থেকে সরিয়ে কনস্টান্টিনোপলে নিয়ে আসেন। শহর অবরোধের আগে ও পরে শহরের বেশ কিছু গ্রীক ও অগ্রীক বুদ্ধিজীবী পালিয়ে যায়। তাদের অধিকাংশ ইতালিতে চলে যায় এবং ইউরোপীয় রেনেসাতে সাহায্য করে।
বেশ কিছু ইতিহাসবিদ কনস্টান্টিনোপলের বিজয় ও বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের পতনকে মধ্য যুগের সমাপ্তি হিসেবে দেখেন।[২৯]
রোমান সম্রাট কন্সট্যান্টাইন কর্তৃক ৩৩০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে কনস্টান্টিনোপল রাজধানী হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছিল। পরবর্তী ১১ শতাব্দী যাবত শহরটি বেশ কয়েকবার অবরোধ সম্মুখীন হলেও ১২০৪ খ্রিষ্টাব্দে চতুর্থ ক্রুসেডের সময় ছাড়া এটি কেউ দখল করতে পারেনি।[৩০] ক্রুসেডাররা কনস্টান্টিনোপলকে ঘিরে একটি অস্থায়ী ল্যাটিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে। তবে সাম্রাজ্যের বাকি অংশ বেশ কিছু গ্রীক রাষ্ট্র, বিশেষ করে নাইসিয়া, এপিরাস ও ট্রেবিজন্ডে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এই গ্রীকরা মিত্র হিসেবে ল্যাটিন শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করলেও বাইজেন্টাইন মুকুটের জন্যও নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগীতায় লিপ্ত হয়।
নাইসিয়ানরা ১২৬১ খ্রিষ্টাব্দে কনস্টান্টিনোপল অধিকার করে নেয়। দুর্বল এই সাম্রাজ্যে অল্প পরিমাণে শান্তি বিরাজ করছিল। এরপর ল্যাটিন, সার্বিয়ান, বুলগেরিয়ান ও উসমানীয় তুর্কিরা আক্রমণ করে।[১৩] [৩১][৩২][৩৩] ১৩৪৬ থেকে ১৩৪৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত স্থায়ী ব্ল্যাক ডেথ বলে পরিচিত মহামারীতে শহরের প্রায় অর্ধেক অধিবাসী মৃত্যুবরণ করে।[৩৪][৩৫] এছাড়াও দুই শতাব্দী আগে ক্রুসেডারদের আক্রমণে ফলে অর্থনৈতিক ও আঞ্চলিক আধিপত্য খর্ব হওয়ার কারণে লোকসংখ্যা কমছিল। ফলে ১৪৫৩ খ্রিষ্টাব্দে শহরটি বড় মাঠ দ্বারা পৃথক করা কিছু দেয়ালঘেরা গ্রামের সমষ্টি ছিল। পুরো শহরটির চারদিক পঞ্চম শতাব্দীর থিওডোসিয়ান দেয়াল দ্বারা ঘেরা ছিল।
১৪৫০ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ সাম্রাজ্য ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে পড়ে। এসময় শহরের বাইরের কয়েক বর্গ মাইল, মারমারা সাগরের প্রিন্স দ্বীপ ও পেলোপন্নিস ও এর সাংস্কৃতিক কেন্দ্র মিস্ট্রাস নিয়ে গঠিত ছিল। চতুর্থ ক্রুসেডের ফলশ্রুতিতে সৃষ্ট স্বাধীন ট্রেবিজন্ড সাম্রাজ্য কৃষ্ণ সাগরের উপকূলে টিকে ছিল।
১৪৫১ খ্রিষ্টাব্দে সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মদ তার পিতার উত্তরাধিকারী হন। ১৯ বছর বয়সী তরুণ শাসক অযোগ্য হবেন এবং বলকান ও এজিয়ান অঞ্চলের খ্রিষ্টানদের জন্য হুমকি হবেন না বলে ব্যাপকভাবে ধারণা করা হত।[৩৬] তার দরবারে পাঠানো দূতদের সাথে মুহাম্মদের বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ এই ধারণাকে আরো বাড়িয়ে তোলে।[৩৭] কিন্তু তার কাজ তার কথার চাইতেও শক্ত প্রমাণিত হয়। ১৪৫২ এর শুরুতে তিনি বসফোরাসে রুমেলি হিসারি নামক দ্বিতীয় উসমানীয় দুর্গ গড়ে তোলেন।[৩৮] কনস্টান্টিনোপলের কয়েক মাইল উত্তরে ইউরোপীয় অংশ এই দুর্গ গড়ে তোলা হয়। তার প্রপিতামহ প্রথম বায়েজিদ এই দুর্গের অনুরূপ আনাদোলু হিসারি তৈরী করেছিলেন। এটি এশীয় অংশে ছিল। এই দুর্গ দুটির কারণে তুর্কিরা বসফরাসের উপর চলমান নৌযানের উপর পূর্ণ কর্তৃত্ব স্থাপন করতে সক্ষম হয়।[৩৭] বিশেষত এটি উত্তরে কৃষ্ণ সাগর উপকূলের জেনোয়া কলোনি থেকে কনস্টান্টিনোপল আসার পথে বাধা প্রদান করে। কৌশলগত অবস্থানের কারণে নতুন দুর্গকে ‘’বোগাযকেসেন’’ বলা হত যার অর্থ “প্রণালি-রুদ্ধকারী” বা “গলা-কর্তনকারী”। ১৪৫২ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবর সুলতান মুহাম্মদ তুরাখান বেগকে পেলোপন্নিসের উদ্দেশ্যে বিরাট এক নৌবহর নিয়ে অভিযানের নির্দেশ দেন এবং আসন্ন কনস্টান্টিনোপল অবরোধের সময় যাতে থমাস ও ডেমেট্রিওস তাদের ভাই সম্রাট একাদশ কনস্টান্টাইন পেলেইওলোগসকে সাহায্য করতে না পারে সে উদ্দেশ্যে সেখানে অবস্থানের নির্দেশ দেন।[৩৯]
বাইজেন্টাইন সম্রাট একাদশ কনস্টান্টাইন সুলতান মুহাম্মদের উদ্দেশ্য বুঝতে পারেন এবং পশ্চিম ইউরোপের কাছে সাহায্য চেয়ে আবেদন করেন। কিন্তু শতাব্দীব্যাপী যুদ্ধ ও পূর্ব ও পশ্চিমের চার্চের মধ্যকার বিরোধের ফলে কাঙ্ক্ষিত সাহায্য পাওয়া যায়নি। ১০৫৪ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ইস্টার্ন চার্চের উপর পোপ আধিপত্য আরোপ করছেন বলে অভিযোগ ছিল। ১২৭৪ খ্রিষ্টাব্দে প্রতীকী ইউনিয়ন গঠনের ব্যাপারে আলোচনা হয় এবং প্রকৃতই কিছু পেলেইওলোগি সম্রাটকে ল্যাটিন চার্চে গ্রহণ করা হয়। সম্রাট অষ্টম জন পেলেইওলোগস কিছুকাল পূর্বে ফ্লোরেন্স কাউন্সিলে পোপ চতুর্থ ইউজেনের ইউনিয়নের ব্যাপারে আলোচনা করেন। এসব ঘটনার ফলে কনস্টান্টিনোপলের ইউনিয়নে বিরোধীদের মধ্যে ব্যাপক প্রোপাগান্ডা শুরু হয় এবং বাইজেন্টাইন চার্চের জনগণ ও নেতৃবৃন্দ বিভক্ত হয়ে পড়ে। গ্রীক ও ইটালিয়ানদের মধ্যকার জাতিগত বিদ্বেষ যা ১২০৪ এ ল্যাটিনদের কনস্টান্টিনোপল আক্রমণের সময় থেকে শুরু হয়েছিল, তাও এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে। ফলে ইউনিয়নটি ব্যর্থ হয়। পোপ পঞ্চম নিকোলাস ও রোমান চার্চ এর ফলে খুবই অসন্তুষ্ট হয়।
১৪৫২ খ্রিষ্টাব্দের গ্রীষ্মে রুমেলি হিসারি নির্মাণ সম্পূর্ণ হওয়ার পর ঝুকি খুবই নিকটবর্তী হয়ে পড়ে। ইউনিয়ন ব্যবস্থা চালু করা হবে এমন প্রতিশ্রুতি দিয়ে কনস্টান্টাইন পোপকে চিঠি লেখেন।[৩৭] পোপ পঞ্চম নিকোলাস সুযোগ ব্যবহারে আগ্রহী থাকলেও পশ্চিমা রাজন্যবর্গের উপর তার প্রভাব বাইজেন্টাইনদের আকাঙ্খা অনুযায়ী ছিল না। তাদের মধ্যে কেউ কেউ পোপের বর্ধিষ্ণু নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে সতর্ক অবস্থানে ছিল। বিশেষত, ইউরোপে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের মধ্যকার একশত বছরব্যাপী যুদ্ধ, স্পেনের রিকনকোয়েস্টার চূড়ান্ত পর্যায়ে অবস্থান, জার্মান রাজ্যগুলোর মধ্যে লড়াই এবং ১৪৪৪ খ্রিষ্টাব্দে ভারনার যুদ্ধে হাঙ্গেরি ও পোল্যান্ডের পতন, এসব ঘটনার কারণে কাঙ্ক্ষিত সাহায্য পাওয়া যায়নি। উত্তর ইটালির বাণিজ্যিক নগর রাষ্ট্রগুলো থেকে কিছু সৈনিক আসলেও উসমানীয়দের সাথে পাল্লা দিতে পারার মত পশ্চিমা অবদান খুবই নগন্য ছিল। কিছু পশ্চিমা ব্যক্তি তাদের নিজ উদ্যোগে শহর রক্ষায় এগিয়ে আসে। তাদের অন্যতম হলেন জেনোয়ার সুদক্ষ সৈনিক জিওভান্নো জিসটিনিয়ানি। তিনি ১৪৫৩ এর জানুয়ারি ৭০০ জন সৈনিক নিয়ে উপস্থিত হন।[৪০] দেয়ালঘেরা শহর রক্ষায় তার দক্ষতার জন্য জন্য সম্রাট তাকে দেয়ালের প্রতিরক্ষার সম্পূর্ণ দায়িত্ব প্রদান করেন। একই সময় গোল্ডেন হর্নে অবস্থানরত ভেনিসিয়ান জাহাজগুলো ভেনিসের অনুমতি ছাড়াই সম্রাটকে তাদের দায়িত্ব গ্রহণের আগ্রহ জানায়। পোপ নিকোলাস তিনটি জাহাজ সাহায্যের জন্য পাঠান। এগুলো মার্চের শেষের দিকে যাত্রা করে।[৪১]
ইতিমধ্যে ভেনিসে এ বিষয়ে আলাপ শুরু হয় যে তারা কনস্টান্টিনোপলকে কী ধরনের সাহায্য প্রদান করবে। সিনেটে একটি নৌবহর প্রেরণের সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু এতে দেরী হয়ে যায়। এপ্রিলে যখন এটি যাত্রা করে তখন যুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য যথেষ্ট দেরি হয়ে গিয়েছিল।[৪২] একই সময় কনস্টান্টাইন উপহার প্রদানের মাধ্যমে সুলতানকে বিরত রাখার চেষ্টা করেন। কিন্তু তার দূতকে মৃত্যুদন্ড দেয়ার ফলে সে চেষ্টাও ব্যাহত হয়। ফলে বাইজেন্টাইনদের কূটনীতিতে কাজ হয়নি।[৩৭]
গোল্ডেন হর্ন থেকে নৌ হামলার আশঙ্কা থেকে সম্রাট কনস্টান্টাইন পোতাশ্রয়ের মুখে একটি শিকল লাগানোর আদেশ দেন। এই শিকল যেকোনো তুর্কি জাহাজকে আটকানোর জন্য যথেষ্ট ছিল। বিদেশী সাহায্য আসার আগ পর্যন্ত অবরোধের সময় বৃদ্ধির ব্যাপারে বাইজেন্টাইনরা যে দুটি কৌশলের উপর নির্ভরশীল ছিল এটি হল তার অন্যতম।[৪৩] ১২০৪ খ্রিষ্টাব্দের চতুর্থ ক্রুসেডের সময় শত্রুরা গোল্ডেন হর্ন দিক থেকে দেয়াল ভেদ করতে সক্ষম হয়েছিল। তাই এই কৌশল প্রয়োগ করা হয়।
কনস্টান্টিনোপলের প্রতিরক্ষার জন্য নিয়োজিত বাহিনীর সেনাসংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম ছিল। এতে সর্বমোট ৭০০০ সৈনিক ছিল যাদের মধ্যে ২০০০ জন ছিল বিদেশী।[৪৪] অবরোধ আরোপের সময় আশপাশের এলাকা থেকে আগত শরণার্থীসহ মোট ৫০,০০০ এর মত মানুষ ছিল বলে ধারণা করা হয়।[৪৫] সম্রাটের বেতনভুক্ত তুর্কি কমান্ডার ডোরগানো সমুদ্রের পার্শ্ববর্তী শহরের একটি অংশ বেতনভুক্ত তুর্কিদের সাহায্যে রক্ষার দায়িত্ব পান। এই তুর্কিরা সম্রাটের প্রতি অনুগত থাকেএবং পরবর্তী লড়াইয়ে প্রাণ হারায়।
অন্যদিকে উসমানীয়রা লোকবলের দিক থেকে ব্যাপক পরিমাণে ছিল। সাম্প্রতিক গবেষণা ও উসমানীয় আর্কাইভের তথ্য থেকে জানা যায় যে ৫০,০০০-৮০,০০০ উসমানীয় সৈনিক এতে অংশ নেয়। এদের মধ্যে ৫,০০০ থেকে ১০,০০০ জেনিসারি বাহিনী ছিল। জেনিসারিরা হল উচ্চশ্রেণীর পদাতিক সেনা।[২][১৪][১৫] সেসাথে হাজার হাজার খ্রিষ্টান সৈনিক, যাদের মধ্যে সার্বিয়ান নেতা ডুরাড ব্রানকোভিকের পাঠানো ১,৫০০ সার্বিয়ান অশ্বারোহী যুদ্ধে অংশ নেয়। সুলতানের প্রতি আনুগত্য হিসেবে এই সেনাদেরকে পাঠানো হয়। কিন্তু এর কয়েকমাস পূর্বে তিনি কনস্টান্টিনোপলের দেয়াল পুনর্নির্মাণের জন্য অর্থ পাঠিয়েছিলেন। অবরোধের সমসাময়িক পশ্চিমা সাক্ষীরা অতিরঞ্জিত করে সুলতানের সামরিক ক্ষমতার বর্ণনা দিয়েছে। তাদের ভাষ্য মতে ১,৬০,০০০ থেকে ২,০০,০০০ বা ৩,০০,০০০ পর্যন্ত সৈনিক ছিল।[২]
সুলতান মুহাম্মদ সমুদ্রের দিক থেকে শহর অবরোধের জন্য একটি নৌবহর গড়ে তোলেন। এটি অংশত গেলিপোলির গ্রিক নাবিকদের নিয়ে গঠিত হয়েছিল।[১৪] সমকালীন হিসাবমতে উসমানীয় নৌবহরে জাহাজ সংখ্যা ছিল ১০০(টেডালডি),[৪৬] ১৪৫(বারবারো),[৪৭] ১৬০(ইউবেরটিনো পুসকুলো),[৪৮] ২০০-২৫০ (ইসিডোর অব কিয়েভ,[৪৯] লিওনার্দো দি চিও)[৫০] থেকে ৪৩০(স্ফ্রানটজ)।[১৬] আধুনিককালের আরো বাস্তবিক হিসাব মতে নৌবহরে ১২৬টি জাহাজ ছিল। এটি বিশেষত ৬টি বৃহৎ জাহাজ, ১০টি সাধারণ জাহাজ, ১৫টি ছোট জাহাজ, ৭৫টি বড় নৌকা এবং ২০টি ঘোড়া পরিবহনের নৌকা গঠিত হয়।[১৯]
উসমানীয়রা মাঝারি আকারের কামান তৈরীতে দক্ষ একথা অবরোধের আগে সবার জানা ছিল। কিন্তু গোলা ছোড়ার পাল্লা প্রতিপক্ষের ধারণার বাইরে চলে যায়। অস্ত্রের ক্ষেত্রে উসমানীয়দের এই সক্ষমতা উরবান নামক এক হাঙ্গেরিয়ান (কারো মতে জার্মান) ব্যক্তির কারণে সম্ভব হয়।[৫১] তার নকশা করা একটি কামানের নাম ছিল “শাহি”। এটির দৈর্ঘ্য ছিল ২৭ ফুট (৮.২ মি) এবং এটি ৬০০ পাউন্ডের (২৭২ কেজি) একটি গোলা প্রায় এক মাইল (১.৬ কিমি) দূরে ছুড়ে মারতে পারত।[৫২]
উরবান প্রাথমিকভাবে বাইজেন্টাইনদের অধীনে কাজ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তারা তার প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ দিতে অক্ষম ছিল। এরপর উরবান কনস্টান্টিনোপল ত্যাগ করেন এবং সুলতান মুহাম্মদের কাছে যান। তিনি দাবি করেন যে তার অস্ত্র ব্যবিলনের দেয়ালকে উড়িয়ে দিতে পারে। পর্যাপ্ত অর্থ ও উপাদান লাভের পর এড্রিনোপলে তিনি তিন মাসের মধ্যে কামান নির্মাণ করেন। এখান থেকে ৬০টি ষাঁড়ের সাহায্যে এটি কনস্টান্টিনোপলে নিয়ে যাওয়া হয়। উরবান তুর্কি বাহিনীর জন্য অন্যান্য কামানও নির্মাণ করেন।[৫৩]
উরবানের কামানে কিছু ত্রুটিও ছিল। এটিকে পুনরায় ব্যবহার করতে তিন ঘণ্টা লাগত। কামানের গোলার সরবরাহ খুবই কম ছিল। বলা হয় যে কামানটি ছয় সপ্তাহ পর আপনা থেকেই অকেজো হয়ে যায়। তবে এই বিষয়টি বিতর্কিত।[২] ১৫০ মাইল (২৪০ কিমি) দূরে অস্ত্র কারখানা হওয়ায় সুলতানকে বিশাল কামানকে বহনের জন্য বাড়তি ঝামেলা পোহাতে হয়। বলা হয় যে উরবানের এই কামানকে বহন করতে ৬০ টি ষাঁড় ও ৪০০ মানুষ প্রয়োজন হয়েছিল।[৫১]
সুলতান মুহাম্মদ থিওডোসিয়ান দেয়াল আক্রমণের পরিকল্পনা করেন। এই দেয়ালগুলো কনস্টান্টিনোপলকে পশ্চিম দিকের আক্রমণ থেকে বাচিয়ে রেখেছিল। শুধু পানিবেষ্টিত অংশই দেয়াল ঘেরা ছিল না। ১৪৫৩ এর ২ এপ্রিল সোমবার ইস্টারের পরের দিন তার সেনারা শহরের বাইরে অবস্থা নেয়।
উসমানীয় সেনাবাহিনীর একটি বড় অংশ গোল্ডেন হর্নের দক্ষিণে অবস্থান নেয়। কারাদজা পাশার অধীনস্থ নিয়মিত ইউরোপীয় সেনারা দেয়ালের পুরো দৈর্ঘ্য জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। আনাতোলিয়ার নিয়মিত বাহিনী ইশাক পাশার নেতৃত্বে দক্ষিণে লুকাস থেকে মারমারা সাগর পর্যন্ত অবস্থান নেয়। সুলতান মুহাম্মদ নিজে তার লাল ও সোনালি তাবু ‘’মেসোটেচিওনের’’ কাছে অবস্থান নেন। এখানে কামান ও জেনিসারিরা অবস্থান নিয়েছিল। বাশি-বেজোক নামের সেনারা প্রথম সারির পেছনে অবস্থান নেয়। জাগান পাশার অধীনস্থ অন্যান্য সেনারা হোল্ডেন হর্নের উত্তরে অবস্থান নেয়। গোল্ডেন হর্নের জলার উপর নির্মিত একটি রাস্তার মাধ্যমে যোগাযোগ রক্ষা করা হত।[৫৪]
শহরে প্রায় ২০ কিমি দেয়াল দিয়ে ঘেরা ছিল। এটি ছিল সেসময়ের অন্যতম মজবুত দেয়াল। কিছুকাল পূর্বে অষ্টম জন পেলেইওলোগস এটির সংস্কার করেন। দেয়ালের অবস্থা যথেষ্ট ভাল ছিল। ফলে বাইজেন্টাইনদের ধারণা ছিল পশ্চিমা সাহায্য আসার আগ পর্যন্ত তারা নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতে পারবে।[৫৫] তার উপর প্রতিরক্ষাকারীরা ২৬ টি জাহাজের একটি নৌবহর দ্বারা শক্তি প্রাপ্ত ছিল। এর মধ্যে ৫টি জেনোয়া, ৫টি ভেনিস, ৩টি ভেনিসিয়ান ক্রিট, ১টি আনকোনা, ১টি আরাগন, ১টি ফ্রান্স থেকে ও প্রায় ১০টি বাইজেন্টাইনদের জাহাজ ছিল।[৭]
৫ এপ্রিল সুলতান তার শেষ সেনাদল নিয়ে পৌছলে বাইজেন্টাইনরা তাদের অবস্থান গ্রহণ করে।[৫৬] সংখ্যার অপ্রতুলতার কারণে দেয়ালের সব অংশে অবস্থান নেয়া তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না বিধায় সিদ্ধান্ত হয় যে শুধু বাইরের দেয়ালে সেনা মোতায়েন করা হবে। কনস্টান্টাইন ও তার গ্রিক সেনারা দেয়ালের মাঝের অংশ রক্ষায় অবস্থান নেয়। দেয়ালের এই অংশটিকে সবচেয়ে দুর্বল অংশ হিসেবে দেখা হত এবং এই দিক থেকে আক্রমণের আশঙ্কা বেশি ছিল। জিসটিনিয়ানি সম্রাটের উত্তর দিকে অবস্থান নেন। পরবর্তীতে অবরোধ চলার সময় তিনি সম্রাটের অবস্থানের জায়গায় চলে আসেন। তার পূর্বের অবস্থানে বোকিয়ারডি ভাইদের দায়িত্ব দেয়া হয়। মিনট্টো ও তার ভেনিসিয়ানরা ব্লেচারনে প্রাসাদে টিউডোরো কেরিসটো, লেনগেসকো ভ্রাতৃবৃন্দ ও আর্চবিশপ লিউনার্দো অব চিওস এর সাথে অবস্থান নেন। সম্রাটের বাম পাশে কিছুটা দক্ষিণে সেনানায়ক কাটানিও ও জেনোয়ার সৈনিকেরা এবং গ্রীক সৈনিকদের সাথে অবস্থানরত থিওফিলিস পেলেইওলোগস অবস্থান করছিলেন। দেয়ালের একটি অংশে ভেনিসিয়ান ব্যক্তি ফিলিপ্পো কনটারিনি এবং সর্বদক্ষিণে ডিমিটরিয়াস কেন্টাকুজেনাস অবস্থান নেন। সমুদ্রের দেয়ালে অপেক্ষাকৃত কম সৈনিক মোতায়েন করা হয়। স্টেডিয়ানে জেকোবো কনটারিনি, তার বাম পাশে গ্রীক পুরোহিতদের একটি দল এবং এলিউথেরিয়াস পোতাশ্রয়ে যুবরাজ ওরহানকে দায়িত্ব দেয়া হয়। জেনোয়াস ও কাটালান সৈনিকদের সাথে পিরে জুলিয়া প্রাসাদে অবস্থান নেন। কিয়েভের কার্ডিনাল ইসিডর উপদ্বীপের প্রান্তে অবস্থান নেন। দক্ষিণ উপকূলের সমুদ্র দেয়ালগুলোতে গেব্রিয়েল ট্রেভিসানোর অধীন ভেনিসিয়ান ও জেনোয়ার নাবিকরা পাহারার দায়িত্ব পালন করে। কৌশলগত কারণে শহরের ভেতর দুইটি রিজার্ভ বাহিনী রাখা হয়। এর একটি হল লুকাস নটরাসের অধীনে পেট্রায় ও অন্যটি নিসেফোরোস পেলেইওলোগসের অধীনে চার্চ অব দ্য হলি এপস্টলসের কাছে। ভেনিসিয়ান কমান্ডার আল্ভিসো ডিয়েডো পোতাশ্রয়ের জাহাজগুলোকে নেতৃত্ব দেন। বাইজেন্টাইনদের কামান থাকলেও সেগুলো উসমানীয়দের তুলনায় ছোট ছিল এবং গোলা ছোড়ার পর কামানের পেছনদিকের ধাক্কার ফলে তাদের নিজেদের দেয়ালেরই ক্ষতি হচ্ছিল।[৫৭]
ডেভিড নিকোলের মতে (২০০০ খ্রিষ্টাব্দ), কনস্টান্টিনোপল খুব সহজেই বিজয় হয় একথাটা সঠিক নয়। মানচিত্রে দেখানোর মত পুরো ব্যাপারটি একপক্ষীয় ছিল না।[৫৮] এমনও দাবি করা হয় যে কনস্টান্টিনোপল ঐ সময় ইউরোপের সবচেয়ে মজবুত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার শহর ছিল।[৫৯]
অবরোধের শুরুতে সুলতান মুহাম্মদ শহরের বাইরে বাইজেন্টাইনদের শক্তিকেন্দ্রগুলো ধ্বংস করার জন্য তার সেরা সৈনিকদের পাঠান। কয়েকদিনের মধ্যে বসফরাসের কাছে থেরাপিয়া দুর্গ ও স্টুডিয়াস গ্রামে মারমারা সাগরের নিকটে অনুরূপ আরেকটি দুর্গ দখল করা হয়। মারমারা সাগরে প্রিন্সেস দ্বীপপুঞ্জ এডমিরাল বালতুঘলুর নৌবহর দখল করে নেয়।[৬০] কয়েক সপ্তাহ ধরে কামানগুলো শহরের দেয়ালের উপর গোলাবর্ষণ করতে থাকে। কিন্তু সুনির্দিষ্টভাবে হামলা করতে না পারা এবং হামলার গতি তুলনামূলকভাবে কম হওয়ায় বাইজেন্টাইনরা ক্ষতিগ্রস্ত অংশ দ্রুত মেরামত করতে সক্ষম হয়।[৬১]
ইতিমধ্যে বেশ কয়েকবার চেষ্টার পরও বালতুঘলুর অধীন উসমানীয় নৌবহরগুলো গোল্ডেন হর্নে প্রবেশ করতে পারেনি। বাইজেন্টাইনরা এর প্রবেশমুখে প্রতিরক্ষামূলক ধাতব শিকল বসিয়ে দেয়ায় এই অবস্থার সৃষ্টি হয়। বাইরের কোনো জাহাজকে গোল্ডেন হর্নে প্রবেশে বাধা দেয়া তুর্কি নৌবহরের প্রধান কাজ হলেও ২০ এপ্রিল চারটি খ্রিষ্টান জাহাজের একটি ক্ষুদ্র দল বেশ বড় লড়াইয়ের পর এতে ঢুকে পড়ে।[৬২] এতে বাইজেন্টাইনদের মনোবল বেড়ে যায় এবং সুলতানের জন্য অবস্থা অসুবিধাজনক হয়ে পড়ে।[৬১] বালতুঘলুর অধীনস্থ সৈনিকেরা লড়াইয়ের সময় তার সাহসিকতার ব্যাপারে নিশ্চিত করায় ব্যর্থতা সত্ত্বেও তাকে ক্ষমা করা হয়।
এরপর সুলতান মুহাম্মদ অন্য পথ অবলম্বনের সিদ্ধান্ত নেন। তিনি গোল্ডেন হর্নের উত্তরে গালাটার উপর দিয়ে চর্বি মাখানো কাঠের একটি রাস্তা তৈরীর আদেশ দেন। ২২ এপ্রিল জাহাজগুলোকে টেনে গোল্ডেন হর্নে নিয়ে যাওয়া হয়।[৬১] ফলে রসদ সরবরাহ করা জেনোয়ার জাহাজগুলো বাধার মুখে পড়ে এবং বাইজেনটাইনদের মনোবল ভেঙ্গে যায়। ২৮ এপ্রিল রাতে উসমানীয় জাহাজগুলো ধ্বংস করার একটা চেষ্টা চালানো হয়। কিন্তু উসমানীয়রা পূর্বে সংকেত পাওয়ায় খ্রিষ্টান বাহিনী ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং পিছু হটে। এরপর বাইজেন্টাইনরা গোল্ডেন হর্নের অংশে অধিক মাত্রায় সেনা সমাবেশ করে। ফলশ্রুতিতে অন্য অংশের প্রতিরক্ষা দুর্বল হয়ে পড়ে। ২৯ এপ্রিল ২৬০ জন উসমানীয় বন্দীকে উসমানীয়দের চোখের সামনে দেয়ালের উপর শিরশ্ছেদ করা হয়।[২৬] ভূমির দেয়ালে বেশ কয়েকবার আক্রমণের পরও তুর্কিরা সফলতা লাভ করেনি। ভেনিসিয়ান সার্জন নিকোলো বারবারো তার ডায়েরিতে জেনিসারিদের আক্রমণের বিষয়ে লেখেন,
“ | তারা তুর্কিদের দেয়ালের নিচ দিয়ে যুদ্ধের জন্য আসতে দেখল, বিশেষত জেনিসারিদের ... এবং যখন তাদের এক বা দুইজন মারা যায়, আরো তুর্কি চলে আসে এবং মৃতদেরকে নিয়ে যায় ... তারা দেয়ালের কত নিকটে এসে গিয়েছে সে বিষয়ে ভাবছিল না। আমাদের লোকেরা মৃতদেহ বহনকারী তুর্কিদের দিকে কামান ও ক্রসবোর সাহায্যে আক্রমণ কর এবং তাদের দুজনেই মৃতে পরিণত হয়, এরপর আরো একজন তুর্কি তাদেরকে নিতে এগিয়ে আসে, কেউই মৃত্যুকে ভয় পাচ্ছিল না, তারা স্বেচ্ছায় দশজন মরতে প্রস্তুত ছিল কিন্তু একজন তুর্কির লাশও দেয়ালের কাছে ফেলে রাখতে রাজি ছিল না।[৪৭] | ” |
যুদ্ধক্ষেত্রে বাধাপ্রাপ্ত হওয়ায় উসমানীয়রা ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গ দিয়ে দেয়ালের বাধা ভাঙ্গার চেষ্টা করে। মে মাসের মধ্যভাগ থেকে ২৫ মে পর্যন্ত খনন কাজ চলে। অধিকাংশ খননকারী ছিল সার্বিয়ান শাসক কর্তৃক প্রেরিত নোভো বরডোর জার্মান বংশোদ্ভূত। তাদেরকে সেনাপতি জাগান পাশার অধীনে দায়িত্ব দেয়া হয়। বাইজেন্টাইনরা জোহাননেস গ্রান্ট (বলা হয় যে তিনি জার্মান ছিলেন, তবে স্কটিশ এর ব্যাপারেও মত আছে) নামক একজন প্রকৌশলীকে নিয়োগ দেয়। তার কাজ ছিল পাল্টা সুড়ঙ্গ খুড়ে তুর্কি খননকারীদের হামলা করা। ১৬ মে এর রাতে বাইজেন্টাইনরা প্রথম সার্বিয়ান সুড়ঙ্গ আবিষ্কার করে। পরবর্তী সুড়ঙ্গগুলো ২১, ২৩ ও ২৫ মে ধরা পড়ে এবং গ্রীক ফায়ার ও লড়াইয়ের মাধ্যমে ধ্বংস করে দেয়া হয়। ২৩ মে বাইজেন্টাইনরা দুই জন তুর্কি অফিসারকে গ্রেপ্তার ও নির্যাতন করে সুড়ঙ্গের অবস্থান জেনে নেয় ও সেগুলো ধ্বংস করে।[৬৩]
২১ মে সুলতান মুহাম্মদ কনস্টান্টিনোপলে একজন দূত পাঠান। শহর তার কাছে হস্তান্তর করা হলে অবরোধ তুলে নেয়া হবে বলে তিনি প্রস্তাব দেন। তিনি প্রতিশ্রুতি দেন যে সম্রাট ও অন্য যেকোন বাসিন্দাকে তাদের সম্পত্তিসহ চলে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হবে। তাছাড়া সম্রাটকে পেলোপোননিসের গভর্নর হিসেবে মেনে নেয়ারও প্রস্তাব দেন। সর্বশেষে তিনি শহরে যারা থেকে যাবে তাদের নিরাপত্তার নিশ্চয়তাও দেন। কনস্টান্টাইন উচ্চমাত্রায় করপ্রদান ও তুর্কিদের হস্তগত হওয়া দুর্গ ও এলাকাকে উসমানীয় সম্পত্তি হিসেবে মেনে নিতে সম্মত হন।[৬৪] তবে কনস্টান্টিনোপলের ব্যাপারে তিনি বলেন,
“ | আপনাকে শহর হস্তান্তর করা আমার বা এর অধিবাসীদের উপর নির্ভর করে না; আমরা সবাই স্বেচ্ছায় মৃত্যুবরণের সিদ্ধান্ত নিয়েছি এবং আমরা আমাদের জীবনের পরোয়া করবো না।[৬৫] | ” |
এই সময়ের মধ্যে সুলতান মুহাম্মদ তার উচ্চপদস্থ অফিসারদের সাথে চূড়ান্ত বৈঠক করেন। তবে কিছু দ্বিমত দেখতে পান। তার অন্যতম উজির হালিল পাশা যিনি সবসময় সুলতানের শহর জয়ের পরিকল্পনার বিরোধিতা করতেন, সুলতানকে সতর্ক করে অবরোধ তুলে নিতে বলেন। হালিল পাশার স্থলে জাগান পাশাকে দায়িত্ব দেয়া হয়। জাগান পাশা অবিলম্বে আক্রমণের পক্ষে ছিলেন। ঘুষ গ্রহণের অভিযোগে সে বছরে হালিল পাশার মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়।[৬৬] সুলতান দেয়াল ধ্বংস করার পরিকল্পনা করেন যাতে বাইজেন্টাইনদের প্রতিরোধ দুর্বল হয়ে পড়ে এবং চূড়ান্ত আক্রমণের প্রস্তুতি নেয়া যায়।
২৬ মে সন্ধায় চূড়ান্ত আক্রমণ শুরু হয় এবং পরদিন পর্যন্ত তা জারি থাকে।[৬৭] যুদ্ধসভার সিদ্ধান্তের ৩৬ ঘণ্টা পর উসমানীয়রা তাদের সৈন্যচালনা শুরু করে।[৬৭] ২৮ মে সৈনিকদের প্রার্থনা ও বিশ্রামের জন্য মঞ্জুর করা হয়। এরপর চূড়ান্ত আক্রমণ পরিচালনা করা হয়। বাইজেন্টাইন অংশে ১২টি জাহাজের ক্ষুদ্র ভেনিসিয়ান নৌবহর এজিয়ান সাগরে তল্লাশির পর রাজধানী পৌছে সম্রাটকে জানায় যে ভেনিসিয়ান রসদের কোনো জাহাজ পথিমধ্যে নেই।[৬৮] ২৮ মে উসমানীয় সেনারা চূড়ান্ত আক্রমণের জন্য প্রস্তুত হলে শহরে বড় আকারের ধর্মীয় পদযাত্রার আয়োজন করা হয়। সন্ধায় হাগিয়া সোফিয়ায় বক্তৃতা দেয়া হয় যাতে সম্রাট এবং ল্যাটিন ও গ্রিক উভয় চার্চ অংশ নেয়।[৬৯]
২৯ মে মধ্যরাতের কিছু পরে আক্রমণ শুরু হয়। উসমানীয় সাম্রাজ্যের খ্রিষ্টান সৈনিকরা প্রথম আক্রমণ করে। এরপর অনিয়মিত আজাপ ও আনাতোলিয়ানরা আক্রমণ করে। শহরের উত্তর অংশের দেয়ালে তারা আক্রমণ করে। এই দেয়ালগুলো কামানের আক্রমণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এগুলো এগারো শতকে নির্মাণ করা হয় এবং যথেষ্ট দুর্বল ছিল। জিওভান্নো জিসটিনিয়ানি আক্রমণের সময় মারাত্মক আহত হন।[২][৪৯][৫৭] তার এই অবস্থা প্রতিরোধকারীদের ভেতর ভিতির সঞ্চার করে।[৭০] তাকে চিওস নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তিনি কয়েকদিন পর মারা যান।
জিসটিনিয়ানির অধীন জেনোয়ার সৈনিকরা শহরের ভেতর ও পোতাশ্রয়ের দিকে পিছু হটে। কনস্টান্টাইন ও তার সৈনিকেরা এখন তাদের নিজের প্রতিরক্ষার উপর নির্ভর করতে হয়। তারা জেনিসারিদের কিছু সময় পর্যন্ত প্রতিরোধ করলেও একসময় তারা শহরে ঢুকে পড়ে। যখন একটি ফটকে তুর্কি পতাকা দেখা যায় তখন সৈনিকদের মধ্যে ভীতির সঞ্চার হয় এবং উলুবাতলি হাসান তার সৈনিকদের নিয়ে এগিয়ে গেলে প্রতিরোধ ভেঙ্গে যায়। কথিত আছে যে সম্রাট কনস্টান্টাইন তার বেগুনি রাজপোষাক ছুড়ে ফেলে চূড়ান্ত লড়াইয়ে নেতৃত্ব দেন। এই যুদ্ধে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। অন্যদিকে নিকোলো বারবারো নামক ভেনিসিয়ান প্রত্যক্ষদর্শীর মতে, তুর্কিরা সান রোমানো ফটক দিয়ে ঢুকে পড়লে কনস্টান্টাইন ফাঁসিতে ঝুলে পড়েন। তবে তার পরিণতি কী হয়েছিল তা অজানা থেকে যায়।[৭১]
হামলার পর উসমানীয় সেনারা শহরের সড়ক, প্রাক্তন ফোরা, এবং চার্চ অব দ্য হলি এপস্টলস এসব এলাকায় চলে আসে। সুলতান মুহাম্মদের ইচ্ছা ছিল যে তার নবনিযুক্ত পেট্রিয়ার্ককে একটি পদ দেয়া যাতে তিনি তার খ্রিষ্টান প্রজাদের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারেন। তাই তিনি চার্চ অব দ্য হলি এপস্টলসের মত স্থাপনা রক্ষার জন্য একটি নিরাপত্তা দল পাঠান।
সেনারা হাগিয়া সোফিয়ার সামনের চত্বর অগাস্টিয়ামে চলে আসে। এর ব্রোঞ্জের ফটকের ভেতর বিপুল বেসামরিক লোক স্বর্গীয় নিরাপত্তার আশায় অবস্থান নিয়েছিল। দেয়াল ভেঙ্গে ফেলার পর সৈনিকরা মূল্যবান বস্তুকে অধিকার করা শুরু করে। সুলতান ততকালীন প্রথা হিসেবে তিন দিন পর্যন্ত সৈনিকদের শহরের সম্পদ অধিকারের অনুমতি দেন।[৭২]
উসমানীয়দের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অজানা। তবে বেশ কয়েকটি আক্রমণ অসফল হয়েছিল বলে ইতিহাসবিদদের ধারণা এর সংখ্যা ব্যাপক। বারবারোর বর্ণনা মতে নর্দমায় হঠাত ঝড়ের ফলে সৃষ্ট বৃষ্টির পানির মত রক্ত বয়ে যাচ্ছিল এবং তুর্কি ও খ্রিষ্টানদের মৃতদেহ সাগরে ভাসছিল।[৪৭]
বিজয়ের তৃতীয় দিন সুলতান মুহাম্মদ সব ধরনের লুটপাট বন্ধের নির্দেশ দেন এবং সৈনিকদের শহরের বাইরে পাঠান।[২৩] ঘটনার একজন প্রত্যক্ষদর্শী বাইজেন্টাইন ইতিহাসবিদ জর্জ স্ফ্রান্টজেজের বর্ণনা অনুযায়ী,[৭৩][৭৪]
“ | আমাদের শহরের পতনের তৃতীয় দিন সুলতান তার বিজয় উদযাপন করেন। তিনি এই মর্মে আদেশ জারি করেনঃ লুকিয়ে থাকা সকল বয়সের নাগরিকদেরকে মুক্ত মানুষের মত বেরিয়ে আসতে হবে এবং তাদের কোনো প্রশ্ন করা হবে না। তিনি এও ঘোষণা করেন যে অবরোধের আগে যারা শহর ত্যাগ করে চলে গেছে তাদের বাড়ি ও সম্পদ পুনর্বহাল করা হবে, যদি তারা বাড়ি ফিরে আসে তবে তাদের সাথে তাদের পদ ও ধর্ম অনুযায়ী ব্যবহার করা হবে, যেন কিছুই পরিবর্তন হয়নি। | ” |
হাগিয়া সোফিয়াকে মসজিদে রূপান্তর করা হয়। তবে গ্রীক অর্থোডক্স চার্চকে আগের মতই রেখে দেয়া হয় এবং গেনাডিয়াস স্কোলারিয়াসকে কনস্টান্টিনোপলের পেট্রিয়ার্ক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়।
সুলতান মুহাম্মদ আক্রমণ করতে পারেন একথা জেনেও মিস্ট্রাসের মোরিয়ান দুর্গে কনস্টান্টাইনের ভাই থমাস ও ডিমিট্রিয়াস পরস্পর লড়াই করছিলেন। ১৪৬০ পর্যন্ত তারা তাদের অবস্থান ধরে রাখেন। কনস্টান্টিনোপলের পতনের বহুকাল আগে ডিমিট্রিয়াস ক্ষমতার জন্য থমাস, কনস্টান্টাইন ও তার অন্য ভাই জন ও থিওডরের সাথে লড়াই করেন।[৭৫] উসমানীয়রা মোরিয়া আক্রমণ করলে থমাস রোমে পালিয়ে যান। ডিমিট্রিয়াস একটি পুতুল রাষ্ট্র চালানোর আশা করেন কিন্তু তাকে বন্দী করা হয় এবং বাকি জীবন তাকে বন্দী হিসেবে কাটাতে হয়। রোমে থমাস ও তার পরিবার বহিষ্কৃত বাইজেন্টাইন সম্রাট হিসেবে ১৫০৩ পর্যন্ত পোপ ও অন্যান্য পশ্চিমা শাসকদের কাছ থেকে কিছু আর্থিক সাহায্য পান। ১৪৬১ তে স্বাধীন বাইজেন্টাইন রাষ্ট্র ট্রেবিজন্ড সুলতান মুহাম্মদের অধীনে আসে।[৭৫]
কনস্টান্টিনোপলের অধিকারের মাধ্যমে সুলতান তার নতুন রাজধানী পেয়ে যান। ইউরোপে উসমানীয়দের অগ্রসরে এরপর আর কোনো বড় বাধা থাকল না। খ্রিষ্টান জগতে এই শহর হাতছাড়া হওয়ার ঘটনা ব্যাপক আলোড়ন তোলে এবং পশ্চিমা খ্রিষ্টানদের প্রাচ্যের প্রতি আগ্রাসী দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলতে সহায়ক হয়। পোপ পঞ্চম নিকোলাস ক্রুসেডের মত আরেকটা আক্রমণের ডাক দেন। যখন কোনো ইউরোপীয় শাসক এতে রাজি হল না, পোপ নিজেই যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন কিন্তু তার মৃত্যুর ফলে এই পরিকল্পনা সাধিত হয়নি।
ফ্লোরেন্সের চ্যান্সেলর কোলুসিসো সেলুটাটি কর্তৃক ১৩৯৬ খ্রিষ্টাব্দে চালু হওয়া সাংস্কৃতিক বিনিময়ের আওতায় গ্রীক পন্ডিতরা ইটালীয় নগর রাষ্ট্রগুলোতে যাওয়া আসা শুরু করে।[৭৬] এই বিজয়ের পর অনেক গ্রিক শহর ছেড়ে ল্যাটিন পাশ্চাত্যে চলে যায়। তারা তাদের সাথে গ্রেকো রোমান ঐতিহ্যকে ইটালি ও অন্যান্য অঞ্চলে নিয়ে আসে। ফলে রেনেসা এতে উপকৃত হয়।[৭৭][৭৮] শহরে থেকে যাওয়া অবশিষ্ট গ্রীকদের বেশিরভাগ শহরের ফানার ও গালাটা নামক অংশে বসবাস করত। উসমানীয় শাসকদের অধীনে অনেক ফানারিয় উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করে।
পন্ডিতরা কনস্টান্টিনোপলের পতনকে মধ্য যুগের সমাপ্তি এবং রেনেসার শুরু হিসেবে দেখেন। এর কারণ হল, এই ঘটনার পর ইউরোপে পুরনো ধর্মীয় রীতির অবসান হয় এবং কামান ও বারুদের ব্যবহার শুরু হয়। উক্ত এলাকায় তুর্কিদের একাধিপত্যের কারণে এটি ইউরোপ ও এশিয়ার মধ্যে বাণিজ্যের মূল সংযোগস্থল হয়ে দাঁড়ায়। ফলে ইউরোপীয়রা সমুদ্রপথে এশিয়া আসার পথ বের করাকে গুরুত্বের সাথে দেখা শুরু করে।[৭৯]
বাইজেন্টিয়াম শব্দটি দ্বারা আধুনিক ইতিহাসবিদরা পরবর্তী রোমান সাম্রাজ্যকে বোঝান। কনস্টান্টিনোপল থেকে শাসন করা সাম্রাজ্যকে তৎকালীন সময়ে “রোমান সাম্রাজ্য” বলা হত। সম্রাট কনস্টান্টাইন এই শহরের নাম দিয়েছিলেন “নতুন রোম”। কনস্টান্টিনোপলের পতনের পর এর উত্তরাধিকার নিয়ে কোন্দল শুরু হয়। রাশিয়ানরা নিজেদেরকে বাইজেন্টাইন উত্তরাধিকারী হিসেবে দাবি করে। সুলতান মুহাম্মদ নিজেকে রোমান সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী হিসেবে গণ্য করতেন এবং নিজেকে ‘’কায়সার-ই রুম’’ বা রোমের সিজার হিসেবে ঘোষণা করেন। তবে তাকে “বিজয়ী” হিসেবেই বেশি স্মরণ করা হয়। তার প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক ব্যবস্থা ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে তুর্কি প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্টাকাল পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। এই আদর্শিক সংঘাত রাশিয়া ও উসমানীয় সাম্রাজ্যের মধ্যে যুদ্ধে ইন্ধন যোগায়। আঠারো ও উনিশ শতকে রুশ সেনারা ধীরে ধীরে কনস্টান্টিনোপলের দিকে অগ্রসর হয়। ১৮৭৭-১৮৭৮ এর রুশ-তুর্কি যুদ্ধের সময় রুশ সেনারা টোপকাপি প্রাসাদের দশ মাইল (১৬ কিমি) পশ্চিমে কনস্টান্টিনোপলের ইয়েশিলকো শহরতলীতে এসে পৌছায়।
সার্বিয়ার জার স্টিফেন ডুসান ও বুলগেরিয়ার জার ইভান আলেক্সান্ডার দুজনেই নিজেদেরকে রোমান সাম্রাজ্যের ন্যায়সঙ্গত উত্তরাধিকারী দাবি করেন। অন্যান্য দাবিদাররা, যেমন ভেনিস প্রজাতন্ত্র ও পবিত্র রোমান সাম্রাজ্য ইতিহাসের গর্ভে হারিয়ে যায়।
তুর্কিরা সামরিক ও রাজনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার পাশাপাশি প্রাচ্যের মুসলিম ব্যবসায়ীদের মসলা ব্যবসার ধারা পতনের দিকে যেতে থাকে। আগে মুসলিম ব্যবসায়ীরা মধ্যবর্তী হিসেবে ব্যবসায়ে ভূমিকা পালন করত। ইউরোপীয়রা ১৬ শতক পর্যন্ত কনস্টান্টিনোপলের মাধ্যমে ব্যবসা পরিচালনা করে। কিন্তু মূল্যবৃদ্ধির কারণে তারা ভিন্ন পথ আবিষ্কারের দিকে মনোনিবেশ করে যাতে উসমানীয়, সাফাভি, সাফাভি রাজবংশ ও মামলুক ব্যবসায়ীদের পাশ কাটিয়ে যাওয়া যায়। পর্তুগিজ, স্পেনিশ ও ডাচ জাহাজগুলো আফ্রিকার দক্ষিণ প্রান্ত ধরে ভারতে আসার পথ আবিষ্কারের প্রচেষ্টা চালায়। প্রকৃতপক্ষে কলম্বাস যদি ভারত আবিষ্কারের জন্য বের না হতেন তবে তিনি কখনো নতুন পৃথিবী খুঁজে পেতেন না।
মধ্যযুগের জ্যোতির্বিদরা ১৪৫৩ এর মে চন্দ্রগ্রহণ পর্যবেক্ষণ করেন। এসময় চাঁদের প্রায় দুই তৃতীয়াংশ ঢাকা পড়ে যায়। অবশিষ্ট অংশের আলো কখনো কখনো লাল দেখায়। এই ঘটনাকে শহরের ক্ষমতা বদলের পূর্বাভাস হিসেবে দেখা হত।
কনস্টান্টিনোপলের পতনকে কেন্দ্র করে গ্রীসে বেশ কিছু কিংবদন্তি রয়েছে। বলা হয় যে ২২ মে ১৪৫৩ এর চন্দ্রগ্রহণ শহরের পতনের পূর্বাভাস ছিল।[৮০] চারদিন পর পুরো শহর কুয়াশায় আচ্ছন্ন হয়ে যায়। এই অঞ্চলে মে মাসে এমনটা আগে হত না। সেদিন সন্ধ্যায় কুয়াশা মিটে যাওয়ার পর হাগিয়া সোফিয়ার গম্বুজে অদ্ভুত একটা আলো দেখা যায়। কেউ কেউ এটিকে পবিত্র আত্মার শহর ত্যাগ হিসেবে ব্যাখ্যা করে।[৮১] অন্যরা তখনও আশা ধরে রেখেছিল। তাদের ধারণা ছিল এটি শহর রক্ষার জন্য আসা জন হুনয়াডির বাহিনীর লোকেদের ক্যাম্পফায়ারের আলো।[৮২] তবে বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব মতে আলোটি মূলত বিরুপ আবহাওয়ার জন্যই ছিল।
আরেকটি ভাষ্যমতে প্রথম তুর্কি সৈনিক শহরে প্রবেশের পর দুজন পাদ্রী ধর্মীয় গীতি পড়তে পড়তে ক্যাথেড্রালের দেয়ালে অদৃশ্য হয়ে যান। কিংবদন্তি অনুসারে, কনস্টান্টিনোপল যেদিন আবার খ্রিষ্টানদের হাতে আসবে সেদিন তারা ফিরে আসবেন।[৮৩] আরেকটি কিংবদন্তি মতে, যখন উসমানীয়রা শহরে প্রবেশ করে একজন ফেরেশতা সম্রাটকে উদ্ধার করে এবং তাকে মার্বেলে রূপান্তরিত করে গোল্ডেন গেটের কাছে ভূগর্ভস্থ একটি গুহায় লুকিয়ে রাখে। সেখানে তিনি পুনর্জীবন লাভের জন্য অপেক্ষা করছেন (এটি ঘুমন্ত বীর কিংবদন্তির আরেকরূপ)।[৮৪][৮৫]
উসমানীয়দের হাতে কনস্টান্টিনোপলের ক্ষমতা আসার বহু বছর পরও পশ্চিম ইউরোপে এর পুনরায় অধিকারের বিষয়টি একটি লক্ষ্য হিসেবে টিকে ছিল। তবে পশ্চিম ইউরোপ ১৬ শতকে প্রবেশের সাথে সাথে ক্রুসেডের যুগ শেষ হতে শুরু করে।
প্রথমদিকে পাশ্চাত্যে একটি ক্রুসেডের ইচ্ছা প্রবলভাবে দেখা যায়। তবে এতে ধর্মীয় আবেগের পরিবর্তে রেনেসার প্রভাব ছিল। প্রাচীন ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার মনোভাব এখানে প্রভাব বিস্তার করে।
কনস্টান্টিনোপলের পতনের পর এনিয়াস সিলভিয়াস আক্ষেপ করে বলেন, “হোমার ও প্লেটো দ্বিতীয়বার মৃত্যুবরণ করলেন”। হারানো শহরের ব্যাপারে এই বক্তব্য যথার্থ ছিল না। অধিকন্তু, কনস্টান্টিনোপলের উদ্বাস্তুরা ইটালিতে তাদের প্রাচীন পুথিগুলো নিয়ে আসে এবং প্লেটোনিক ও নিউ-প্লেটোনিক দর্শনের চর্চায় সাহায্য করে।
পোপ দ্বিতীয় পাইয়াস দুঃখের প্রকাশ হিসেবে বেশ কিছু গান রচনা করেন। বুরগুনডির ডিউক ফিলিপ দ্য গুড তুর্কিদের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নেন। তবে উসমানীয়দের শক্তিবৃদ্ধি সেসাথে প্রটোস্টান্ট সংস্কার ও এর পাল্টা সংস্কারের ফলে কনস্টান্টিনোপলের পুনর্দখল অসম্ভব হয়ে পড়ে। এমনকি একসময় ক্রুসেডে প্রবলভাবে অংশগ্রহণ করা ফ্রান্স উসমানীয়দের মিত্রে পরিণত হয়।
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.