Remove ads
ভারতীয় ইসলামি পণ্ডিত, চিন্তাবিদ, শিক্ষাবিদ, প্রচারক, সংস্কারক, গণবুদ্ধিজীবী ও লেখক উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
সৈয়দ আবুল হাসান আলী হাসানী নদভী (৫ ডিসেম্বর ১৯১৩ — ৩১ ডিসেম্বর ১৯৯৯; আলী মিঁয়া নামেও পরিচিত) বিংশ শতাব্দীর ভারতের একজন নেতৃস্থানীয় ইসলামি পণ্ডিত, চিন্তাবিদ, শিক্ষাবিদ, প্রচারক, সংস্কারক, গণবুদ্ধিজীবী এবং ইতিহাস, জীবনী, সমসাময়িক ইসলাম ও ভারতের মুসলিম সম্প্রদায়ের উপর অসংখ্য বইয়ের লেখক।[১][২] তিনি উনবিংশ শতাব্দীর ইসলামি পুনরুজ্জীবনবাদী সৈয়দ আহমদ বেরলভির বংশধর এবং দেওবন্দ আন্দোলনের অন্যতম বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব ছিলেন।[৩][৪] তার শিক্ষা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে একটি জীবন্ত সম্প্রদায় হিসেবে ভারতীয় মুসলিমদের সম্মিলিত অস্তিত্বের সমগ্র বর্ণালীকে আবৃত করেছিল৷ লেখনী ও বক্তৃতায় আরবি ভাষার উপর তার আধিপত্যের কারণে, ভারতীয় উপমহাদেশের বাইরেও, বিশেষ করে আরব বিশ্ব ছিল তার প্রভাবের বিস্তৃত ক্ষেত্র।[৫] ১৯৫০ এবং ১৯৬০-এর দশকে তিনি আরব জাতীয়তাবাদ এবং সর্ব-আরববাদকে একটি নতুন জাহেলিয়া হিসেবে কঠোরভাবে আক্রমণ করেছিলেন এবং সর্ব-ইসলামবাদ প্রচার করেছিলেন।[১]
দারুল উলুম নদওয়াতুল উলামা, লখনউ বিশ্ববিদ্যালয় ও দারুল উলুম দেওবন্দে লেখাপড়া সমাপ্ত করে ১৯৩৪ সালে তিনি দারুল উলুম নদওয়াতুল উলামাতে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন, পর্যায়ক্রমে ১৯৫৪ সালে শিক্ষা পরিচালক, ১৯৬১ সাল থেকে আমৃত্যু প্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।[৩] তিনি ১৯৪১ সালে প্রতিষ্ঠিত জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হলেও এর সাথে তার আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক ছিল স্বল্পস্থায়ী, ১৯৪২ সালে তিনি এই সংগঠন থেকে আলাদা হয়ে তাবলিগ জামাতের দিকে ঝুঁকে পড়েন, তার প্রভাবে নদওয়াতে তাবলিগ জামাত একটি শক্তিশালী উপস্থিতি লাভ করে।[৩] ১৯৫১ সালে তিনি পয়ামে ইনসানিয়াতের সূচনা করেন, যা ১৯৭৪ সালে পরিপূর্ণ আন্দোলনে রূপ নেয়।[৬] ১৯৫৯ সালে তিনি মজলিসে তাহকিকাত ওয়া নাশরিয়াতে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেন।[৭] ১৯৬০ সালে তাকে সভাপতি করে দ্বীনি তালিমি কাউন্সিল গঠিত হয়।[৮] তিনি ১৯৬২ সালে সৌদি সরকারের প্রতিষ্ঠিত বিশ্ব মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন।[৯] এছাড়াও তিনি দারুল উলুম দেওবন্দের পরিচালনা কমিটির সদস্য, মদিনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিলর ও সিন্ডিকেট সদস্য, আন্তর্জাতিক ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় মালয়েশিয়ার রুকন ছিলেন।[১০] তিনি মদিনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ও দামেস্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিথি অধ্যাপকও ছিলেন।[৩] ১৯৭৩ সালে তিনি অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড প্রতিষ্ঠার সাথে যুক্ত ছিলেন, ১৯৮৩ থেকে তিনি এই সংগঠনের নেতৃত্ব প্রদান করেন।[৩] ১৯৭৭ সালে তিনি দারুল মুসান্নিফীন শিবলী একাডেমির নির্বাহী পরিষদের সভাপতি মনোনীত হন।[১১] ১৯৮৩ সালে তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ অক্সফোর্ড সেন্টার ফর ইসলামিক স্টাডিজ উদ্ভোদন করেন, তিনি এই সেন্টারের সভাপতি ছিলেন।[১২][১৩] তিনি ১৯৮৫ সালে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ব ইসলামি সাহিত্য সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি।[১৪]
নদভীর ধর্মীয় অভিমুখীতা তার মাতৃ শিক্ষায়তন দারুল উলুম নদওয়াতুল উলামাকে প্রতিফলিত করে। এটি ভারতীয় মুসলিম সংস্কৃতি ও পরিচয় সংরক্ষণ এবং আরবিকে একটি জীবন্ত ভাষা হিসেবে গুরুত্ব দিয়ে আরব বিশ্বের সাথে সম্পর্ক জোরদার করার ওপর জোর দেয়।[৩] তিনি আরবি ও উর্দু, উভয় ভাষায় প্রচুর সাহিত্যকর্ম সৃষ্টি করেছেন, যার মধ্যে অনেকগুলো ইংরেজি ও অন্যান্য পশ্চিমা ভাষায় অনূদিত হয়েছে এবং অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।[৩] তার রচনাবলির সংখ্যা ৫ শতকেরও অধিক।[১০] সতেরো বছর বয়সে তার প্রথম আরবি প্রকাশনা ছিল সৈয়দ আহমদ বেরলভির উপর একটি প্রবন্ধ যা আল মানারে ১৯৩১ সালে প্রকাশিত হয়,[৩] পরবর্তীতে ১৯৩৯ সালে তার প্রথম গ্রন্থ হিসেবে সীরাতে সৈয়দ আহমদ শহীদ প্রকাশিত হয়।[১৫] তার সবচেয়ে বিখ্যাত গ্রন্থ ১৯৫০ সালে প্রকাশিত মুসলমানদের পতনে বিশ্ব কী হারালো?[৩] এটি তাকে আরব বিশ্বে প্রসিদ্ধি এনে দেয়। এই গ্রন্থে তিনি মুসলমানদের বিশ্ব নেতৃত্ব গ্রহণের আহ্বান জানান।[১০] ভারতের প্রথম আলেম হিসেবে তাকে ১৯৫১ সালে সৌদি রাজ পরিবার হজ্জের সময় মক্কার চাবি হস্তান্তর করে এবং যে কাউকে সঙ্গে নেয়ার অনুমতি দেয়।[১০] তিনি ইসলামের একটি রাজনৈতিক মাত্রাকে স্বীকার করলেও ইসলামি সক্রিয়তা সম্পর্কে তার দৃষ্টিভঙ্গি অনেক ইসলামপন্থীদের থেকে উল্লেখযোগ্যভাবে ভিন্ন ছিল।[৩] ইসলামি পুনরুজ্জীবন এবং "ইসলাম প্রতিষ্ঠা" সম্পর্কে তার দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হয়েছে সংগ্রামী সাধকদের ইতিহাস গ্রন্থে।[৩] তিনি তার শিক্ষক হুসাইন আহমদ মাদানির সাথে একমত হয়ে ভারত বিভাজনের বিরোধিতা করেছিলেন। ১৯৬০-এর দশকে তার রাজনৈতিক সক্রিয়তা বিকশিত হয়েছিল।[৩] ১৯৬৪ সালে তার আহ্বানে নিখিল ভারত মুসলিম মজলিসে মুশাওয়ারাত প্রতিষ্ঠিত হয়।[১৬] ১৯৮০ সালে তিনি ইসলাম পরিষেবায় বাদশাহ ফয়সাল পুরস্কার লাভ করেন।[৩] ১৯৮১ সালে তাকে কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানজনক ডক্টর অব লেটার্স দেওয়া হয়।[১৭] ১৯৯৯ সালে তিনি সুলতান ব্রুনাই আন্তর্জাতিক পুরস্কার পান।[১৮] ১৯৯৯ সালে তিনি বর্ষসেরা ইসলামিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে দুবাই আন্তর্জাতিক পবিত্র কুরআন পুরস্কার লাভ করেন।[১৯]
আবুল হাসান আলী হাসানী নদভী ১৩৩২ হিজরির ৬ মুহররম মোতাবেক ১৯১৩ সালের ৫ ডিসেম্বর রোজ শুক্রবার দায়েরায়ে শাহ আলামুল্লাহ নামে পরিচিত তাকিয়া কেলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।[২০] এই গ্রামটি ভারতের উত্তরপ্রদেশ রাজ্যের রায়বেরেলি জেলায় অবস্থিত। তার পিতা সৈয়দ আব্দুল হাই হাসানী, মাতা খায়রুনেসা এবং তার দাদার নাম সৈয়দ ফখরুদ্দীন খেয়ালী।[২১] তার পিতৃ পরম্পরা ইসলামের নবী মুহাম্মদ (স.)-এর দৌহিত্র হাসান ইবনে আলী পর্যন্ত পৌঁছে।[২২] তার শৈশবের বেশিরভাগ সময় কেটেছে লখনউতে যেখানে তার পিতা আব্দুল হাই হাসানী একটি চিকিৎসালয় চালাতেন। তার পিতা দারুল উলুম নদওয়াতুল উলামার প্রধান ছিলেন, আরবি ও উর্দুতে বেশ কয়েকটি গ্রন্থের রচয়িতা, তার মধ্যে ৮ খণ্ডে লিখিত ভারতীয় মুসলমানদের উপর আরবি জীবনী অভিধান নুযহাতুল খাওয়াতির অন্যতম।[২৩]
শৈশবে স্থানীয় মসজিদের ঐতিহ্যবাহী মক্তবে তার প্রাথমিক কুরআন অধ্যয়ন সমাপ্ত হয়। পরে মোটামুটি সাত বছর বয়স থেকে তিনি বিভিন্ন শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে অন্যান্য শিক্ষাগ্রহণ শুরু করেন।[২৪] চাচা আজিজুর রহমান নদভী ও গোলাম মুহাম্মাদ নদভী শিমলাভীর নিকট উর্দু এবং মাহমুদ আলীর কাছে ফার্সি পড়েন। তার কাছে তিনি তার পিতার রচিত তালিমুল ইসলাম ও নূরুল ঈমান সমাপ্ত করেন।[২৫] নয় বছর বয়সে তার পিতা মৃত্যুবরণ করেন। তার পরিবার লখনউ থেকে গ্রামের বাড়ি তাকিয়া কেলাতে চলে যায়, সেখানে তিনি তার এক মামার কাছ থেকে ফার্সি ভাষার পাঠ নিতে থাকেন। পরবর্তীতে তার বড় ভাই আব্দুল আলী হাসানী তাকে লখনউতে নিয়ে আসেন, এখানে তিনি ১৯২৪ সালে শেখ খলিল ইবনে মুহাম্মদের নিকট ব্যক্তিগতভাবে অবৈতনিক আরবি ভাষার শিক্ষাগ্রহণ শুরু করেন, ৩ বছরে তিনি তার নিকট আরবি সাহিত্যের পাঠ সমাপ্ত করেন।[২৬][২৭] তার চাচা মুহাম্মাদ ইসমাঈলের নিকট ফার্সি ভাষার বোস্তাঁ পড়েন। মাষ্টার মুহাম্মাদ যামানের নিকট তিনি উর্দু ও অংক অনুশীলন করতেন।[২৫] এছাড়াও তিনি জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়াতে অধ্যয়নরত তার বড় চাচাতো ভাই হাবিবুর রহমানের কাছ থেকে উর্দু সাহিত্যের কিছু প্রশিক্ষণ পেয়েছিলেন। তৎকালীন কুরআনের প্রসিদ্ধ মুফাসসির খাজা আবদুল হাই তাদের পরিবার পরিদর্শনে আসলে বড় ভাইয়ের নির্দেশে তিনি তার কাছেও কুরআনের উপর একটি কোর্স সমাপ্ত করেন। বিখ্যাত ব্যাকরণবিদ সৈয়দ তালহার অধীনে আরবি ব্যাকরণ অধ্যয়ন করেন। ১৩ বছর বয়সে তিনি আরবি ভাষায় উচ্চতর অধ্যয়নের জন্য লখনউ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। তিনি ছিলেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বকনিষ্ঠ ছাত্র।[২৮]
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.