মঙ্গল গ্রহ
সৌরজগতের চতুর্থ গ্রহ / From Wikipedia, the free encyclopedia
মঙ্গল হলো সূর্য থেকে চতুর্থ দূরবর্তী গ্রহ এবং বুধের পরেই সৌরজগতের দ্বিতীয়-ক্ষুদ্রতম গ্রহ। ইংরেজি ভাষায় মঙ্গল গ্রহ রোমান পুরাণের যুদ্ধদেবতা মার্সের নাম বহন করে এবং প্রায়শই এই গ্রহটিকে “লাল গ্রহ” নামে অভিহিত করা হয়।[16][17] এর জন্য দায়ী এই গ্রহের পৃষ্ঠতলে ফেরিক অক্সাইডের আধিক্য, যার ফলে গ্রহটিকে লালচে রঙের দেখায় এবং খালি চোখে দৃশ্যমান মহাজাগতিক বস্তুগুলির মধ্যে এই গ্রহটিকে স্বতন্ত্রভাবে দর্শনীয় করে তোলে।[18] মঙ্গল একটি শিলাময় গ্রহ এবং এর বায়ুমণ্ডল ঘনত্বহীন। এই গ্রহের পৃষ্ঠভাগের বৈশিষ্ট্যগুলির মধ্যে যেমন চাঁদের মতো অভিঘাত খাদ দেখা যায়, তেমনি পৃথিবীর মতো উপত্যকা, মরুভূমি ও মেরুস্থ হিমছত্রও চোখে পড়ে।
বিবরণ | |||||||||||||
---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|
উচ্চারণ | মোংগোল্ গ্রোহো[1] (শুনুনⓘ) | ||||||||||||
বিশেষণ | মঙ্গলীয় | ||||||||||||
কক্ষপথের বৈশিষ্ট্য[2] | |||||||||||||
যুগ জে২০০০ | |||||||||||||
অপসূর | ২৪৯২০০০০০ কিমি (১৫৪৮০০০০০ মা; ১.৬৬৬ AU) | ||||||||||||
অনুসূর | ২০৬৭০০০০০ কিমি (১২৮৪০০০০০ মা; ১.৩৮২ AU) | ||||||||||||
অর্ধ-মুখ্য অক্ষ | ২২৭৯৩৯২০০ কিমি (১৪১৬৩৪৯০০ মা; ১.৫২৩৬৭৯ AU) | ||||||||||||
উৎকেন্দ্রিকতা | ০.০৯৩৪ | ||||||||||||
কক্ষীয় পর্যায়কাল | ৬৮৬.৯৮০ d (১.৮৮০৮৫ yr; ৬৬৮.৫৯৯১ সোলস)[3] | ||||||||||||
যুতিকাল | ৭৭৯.৯৬ d (২.১৩৫৪ yr) | ||||||||||||
গড় কক্ষীয় দ্রুতি | ২৪.০০৭ km/s (৮৬৪৩০ কিমি/ঘ; ৫৩৭০০ মা/ঘ) | ||||||||||||
গড় ব্যত্যয় | ১৯.৪১২°[3] | ||||||||||||
নতি |
| ||||||||||||
উদ্বিন্দুর দ্রাঘিমা | ৪৯.৫৫৮° | ||||||||||||
নিকটবিন্দুর সময় | ৩ আগস্ট ২০২০[5] | ||||||||||||
অনুসূরের উপপত্তি | ২৮৬.৫০২° | ||||||||||||
উপগ্রহসমূহ | ২ | ||||||||||||
ভৌত বৈশিষ্ট্যসমূহ | |||||||||||||
গড় ব্যাসার্ধ | ৩৩৮৯.৫ ± ০.২ কিমি[lower-alpha 2][6] (২১০৬.১ ± ০.১ মা) | ||||||||||||
বিষুবীয় ব্যাসার্ধ | ৩৩৯৬.২ ± ০.১ কিমি[lower-alpha 2] [6] (২১১০.৩ ± ০.১ মা; 0.533 Earths) | ||||||||||||
মেরু ব্যাসার্ধ | ৩৩৭৬.২ ± ০.১ কিমি[lower-alpha 2] [6] (২০৯৭.৯ ± ০.১ মা; 0.531 Earths) | ||||||||||||
সমরূপতার | ০.০০৫৮৯±০.০০০১৫ | ||||||||||||
পৃষ্ঠের ক্ষেত্রফল | ১৪৪৭৯৮৫০০ কিমি২[7] (৫৫৯০৭০০০ মা২; 0.284 Earths) | ||||||||||||
আয়তন | ১.৬৩১৮×১০১১ km3[8] (0.151 Earths) | ||||||||||||
ভর | ৬.৪১৭১×১০২৩ কিg[9] (0.107 Earths) | ||||||||||||
গড় ঘনত্ব | ৩.৯৩৩৫ গ্রাম/সেমি৩[8] (০.১৪২১ পা/ইঞ্চি৩) | ||||||||||||
বিষুবীয় পৃষ্ঠের অভিকর্ষ | ৩.৭২০৭৬ মি/সে২[10] (১২.২০৭২ ফুট/সে২; 0.3794 g) | ||||||||||||
মুক্তি বেগ | ৫.০২৭ km/s (১৮১০০ কিমি/ঘ; ১১২৫০ মা/ঘ) | ||||||||||||
ঘূর্ণনকাল | ১.০২৮ d ২৪ঘ ৩৯মি ৩৬সে (synodic; solar day) | ||||||||||||
নাক্ষত্রিক ঘূর্ণনকাল | ১.০২৫৯৫৭ d ২৪ঘ ৩৭মি ২২.৭সে[8] | ||||||||||||
বিষুবীয় অঞ্চলে ঘূর্ণন বেগ | ২৪১.১৭ মি/সে (৮৬৮.২২ কিমি/ঘ; ৫৩৯.৪৯ মা/ঘ) | ||||||||||||
অক্ষীয় ঢাল | ২৫.১৯° (কক্ষতলের প্রতি)[3] | ||||||||||||
উত্তর মেরুর বিষুবাংশ | ৩১৭.৬৮১৪৩° ২১ঘ ১০মি ৪৪সে | ||||||||||||
উত্তর মেরুর বিষুবলম্ব | ৫২.৮৮৬৫০° | ||||||||||||
প্রতিফলন অনুপাত | |||||||||||||
| |||||||||||||
আপাত মান | −২.৯৪ থেকে +১.৮৬[14] | ||||||||||||
কৌণিক ব্যাস | ৩.৫–২৫.১″[3] | ||||||||||||
বায়ুমণ্ডল[3][15] | |||||||||||||
পৃষ্ঠের চাপ | ০.৬৩৬ (০.৪–০.৮৭) কেপা ০.০০৬২৮ atm | ||||||||||||
গঠন |
| ||||||||||||
পৃথিবী ও মঙ্গলের আবর্তন কাল ও ক্রান্তিবৃত্ততলের সাপেক্ষে ঘূর্ণাক্ষের নতি প্রায় একই রকমের হওয়ায় মঙ্গল গ্রহের দিনরাত্রির সময়কাল ও ঋতুচক্র পৃথিবীরই অনুরূপ। সৌরজগতের বৃহত্তম আগ্নেয়গিরি তথা উচ্চতম পর্বত অলিম্পাস মনস এবং বৃহত্তম গভীর গিরিখাতগুলির অন্যতম ভেলস মেরিনারিস মঙ্গল গ্রহেই অবস্থিত। উত্তর গোলার্ধের মসৃণ বোরিয়ালিস অববাহিকা এই গ্রহের ৪০% স্থান অধিকার করে রয়েছে। সম্ভবত বৃহৎ আকারের কোনও সংঘাতের ফলে এই অববাহিকাটি সৃষ্টি হয়েছিল।[19][20] মঙ্গল গ্রহের প্রাকৃতিক উপগ্রহের সংখ্যা দুইটি। এগুলির নাম হলো ফোবোস ও ডিমোস। এই উপগ্রহ দুটি আকারে খুবই ছোট ও অনিয়তাকার। সম্ভবত এই দুটি মঙ্গল ট্রোজান ৫২৬১ ইউরেকার মতো মঙ্গলের অভিকর্ষজ টানে আটকে পড়া দুটি গ্রহাণু।[21]
এ পর্যন্ত বেশ কয়েকটি মনুষ্যবিহীন নভোযান পাঠিয়ে মঙ্গল গ্রহে অনুসন্ধান চালানো হয়েছে। এদের মধ্যে মঙ্গল গ্রহে প্রেরিত প্রথম নভোযান ছিল মেরিনার ৪, যা নাসা কর্তৃক ১৯৬৪ সালের ২৮শে নভেম্বর উৎক্ষেপিত হয়। নভোযানটি ১৯৬৫ সালের ১৫ই জুলাই মঙ্গল গ্রহের সবচেয়ে নিকটে পৌঁছায়। এটি মঙ্গল গ্রহের দুর্বল বিকিরণ বলয় শনাক্ত করে ও পৃথিবীর তুলনায় তা ০.১% হিসেবে পরিমাপ করে। এছাড়াও নভোযানটি মঙ্গল গ্রহের একাধিক ছবি তোলে, যা ছিল মহাকাশ থেকে তোলা অন্য গ্রহের প্রথম ছবি।[22] সোভিয়েত মার্স ৩ অভিযানে একটি অবতরণী যুক্ত করা হয়। এর ফলে ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে মঙ্গল গ্রহে নভোযানটির মসৃণ অবতরণ সম্ভব হয়, যদিও অবতরণের কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।[23] এরপর ১৯৭৬ সালের ২০শে জুলাই ভাইকিং ১ সর্বপ্রথম মঙ্গল পৃষ্ঠে সফলভাবে অবতরণে সক্ষম হয়।[24] ১৯৯৭ সালের ৪ঠা জুলাই মার্স পাথফাইন্ডার মঙ্গল গ্রহে অবতরণ করে এবং ৫ই জুলাই এর ভেতরে থাকা সোজারনারকে অবমুক্ত করে, যা ছিল মঙ্গলে বিচরণকারী প্রথম রোবটিক রোভার।[25] মঙ্গল গ্রহে প্রেরিত ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থার প্রথম নভোযান মার্স এক্সপ্রেস ২০০৩ সালের ২৫শে ডিসেম্বর মঙ্গলের কক্ষপথে পৌঁছায়।[26] ২০০৪ সালের জানুয়ারিতে নাসার দুটি মঙ্গল অনুসন্ধানী যান স্পিরিট ও অপরচুনিটি মঙ্গলে অবতরণ করে। স্পিরিট রোভারটি ২০১০ সালের ২২শে মার্চ পর্যন্ত এবং অপরচুনিটি ২০১৮ সালের ১০ই জুন অবধি সক্রিয় ছিল।[27] মঙ্গলীয় জলবায়ু ও ভু-তত্ত্ব পর্যবেক্ষণের জন্য নাসা ২০১২ সালের ৬ই আগস্ট কিউরিওসিটি রোভারকে মঙ্গলপৃষ্ঠে অবতরণ করায়, যা ছিল মার্স সায়েন্স ল্যাবরেটরি মিশনের অংশ।[28] ২০১৪ সালের ১৪ই সেপ্টেম্বর চতুর্থ মহাকাশ সংস্থা হিসেবে ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা (ইসরো) মঙ্গল পরিদর্শন করে, তারা আন্তঃগ্রহ অভিযানের অংশ হিসেবে মঙ্গলযানকে মঙ্গল গ্রহের কক্ষপথে পাঠায়।[29]
অতীতে মঙ্গল গ্রহ বাসযোগ্য ছিল কিনা, সেই সঙ্গে বর্তমানে এই গ্রহে প্রাণের অস্তিত্ব আছে কিনা তা জানার জন্য অনুসন্ধান চলছে। ভবিষ্যতে ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থার রোজালিন্ড ফ্রাঙ্কলিন রোভারসহ কয়েকটি জ্যোতির্জীববৈজ্ঞানিক অভিযানের পরিকল্পনাও গৃহীত হয়েছে।[30][31][32][33] মঙ্গলের পৃষ্ঠভাগে তরল জলের অস্তিত্ব সম্ভব নয়। কারণ, এই গ্রহের বায়ুমণ্ডলীয় চাপ খুবই কম, পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলীয় চাপের ১% মাত্র।[34] সবচেয়ে কম উঁচু স্থানগুলি অল্প সময়ের জন্য তা বাড়ে মাত্র।[35][36] মেরুস্থ হিমছত্র দুটি প্রধানত জল দ্বারাই গঠিত।[37][38] দক্ষিণ মেরুর হিমছত্রটিতে জলীয় বরফের পরিমাণ এতটাই যে, সেই বরফ গলে গেলে সমগ্র গ্রহের পৃষ্ঠভাগ ১১ মিটার (৩৬ ফু) গভীর জলের আস্তরণে ডুবে যাবে।[39] ২০১৬ সালের নভেম্বর মাসে নাসা জানায় মঙ্গলের ইউটোপিয়া প্ল্যানিশিয়া অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণে ভূগর্ভস্থ বরফের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। সেই জলের যে আনুমানিক পরিমাণ শনাক্ত করা গিয়েছে, তা সুপিরিয়র হ্রদের মোট জলের পরিমাণের সমান।[40][41][42]
পৃথিবী থেকে খালি চোখেই মঙ্গল গ্রহকে দেখা যায়। এই গ্রহের লালচে রঙের জন্য এটিকে সহজেই শনাক্ত করা যায়। মঙ্গলের আপাত মান সর্বাধিক −২.৯৪ পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়, যা শুধুমাত্র শুক্র গ্রহ, চাঁদ ও সূর্যের চেয়ে কম।[14] পৃথিবী ও মঙ্গল পরস্পরের সবচেয়ে কাছে এলে পৃথিবীর বুকে স্থাপিত আলোক দূরবিনগুলি পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের বাধা কাটিয়ে মঙ্গল গ্রহের ৩০০ কিলোমিটার (১৯০ মা) বা ততোধিক পরিব্যাপ্ত স্থানগুলিকে পর্যবেক্ষণ করতে পারে।[43]