কপিল (সংস্কৃত: कपिल) হলেন একজন বৈদিক ঋষি যিনি সাংখ্য দর্শনের প্রবর্তক। সাংখ্য হচ্ছে ভারতীয় ষড়দর্শনের মাঝে একটি আস্তিক্যবাদী দর্শন। ভাগবত পুরাণে এই দর্শনের আস্তিক্যবাদী ধারাটির উল্লেখ পাওয়া যায়।[1] হিন্দুদের প্রচলিত বিশ্বাস অনুসারে, তিনি ব্রহ্মার পৌত্র মনুর বংশধর। ভাগবত পুরাণের বর্ণনা অনুসারে কপিলের পিতা ছিলেন কর্দম মুনি এবং মাতা দেবাহুতি। এই শাস্ত্রে কপিলকে বিষ্ণুর একটি অবতার বলে উল্লেখ করা হয়েছে এবং ভাগবত পুরাণে অবতারদের তালিকায় তার নামও পাওয়া যায়। ভগবদ্গীতায় কপিলকে একজন সিদ্ধযোগী বলা হয়েছে।
কপিল | |
---|---|
দর্শন | সাংখ্য |
সম্মান | হিন্দশাস্ত্রে তাঁকে মনুর বংশধর বলা হয়েছে। |
কপিলের জীবন বৃত্তান্ত
কপিলাবাস্তু নামক নগরে কপিল জন্মগ্রহণ করেন। আনুমানিক ৭২৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তিনি আবির্ভূত হন। তিনি গৌতম বুদ্ধের পূর্ববর্তী ছিলেন বলে অনুমান করা হয়। ভাগবত পুরাণের তৃতীয় স্কন্দে কপিলের জীবনের বর্ণনা পাওয়া যায়। এখানে তাঁকে কর্দম মুনি ও দেবাহুতির পুত্র বলা হয়েছে। তিনি সতী অনুসূয়ার ভ্রাতা ও গুরু। কপিলকে সর্বোচ্চ দেবতা বিষ্ণুর একটি অবতার বলে উল্লেখ করা হয়েছে এবং ভাগবত পুরাণে অবতারদের তালিকায় তার নামও পাওয়া যায়। পিতা গৃহত্যাগ করলে কপিল নিজের মা দেবাহুতিকে যোগ ও বিষ্ণু-ভক্তি শিক্ষা দেন। এর ফলে দেবাহুতি মোক্ষ লাভ করেন। ভাগবত পুরাণের একাদশ অধ্যায়ে কপিলের সাংখ্য দর্শন কৃষ্ণ উদ্ধবকে শিখিয়েছিলেন। এই অংশটি উদ্ধব গীতা নামে পরিচিত।[2]
শ্রীকৃষ্ণ শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় কপিলের উল্লেখ করেছেন:
বৃক্ষের মধ্যে আমি বট, ঋষিগণের মধ্যে আমি দেবর্ষি নারদ, গন্ধর্বগণের মধ্যে আমি চিত্ররথ ও সিদ্ধগণের মধ্যে আমি কপিল। (১০। ২৬)
গঙ্গার জন্ম
স্বর্গের নদী গঙ্গার মর্ত্যে অবতরণের কাহিনিতে কপিল একজন প্রধান চরিত্র। রামের পূর্বপুরুষ সগর ৯৯ বার অশ্বমেধ যজ্ঞ করেছিলেন। শততম যজ্ঞের সময় দেবরাজ ইন্দ্র ঈর্ষান্বিত হয়ে ঘোড়াটিকে অপহরণ করে কপিলের আশ্রমে রেখে গেলেন।[3]
সগরের ষাট হাজার পুত্র ঘোড়াটিকে খুঁজতে বেরলেন। তারা কপিলকে চোর অপবাদ দিলে, কপিল তাঁদের ভস্ম করে দিলেন। সগরের পৌত্র অংশুমান কপিলের কাছে এসে ষাট হাজার পুত্রের প্রাণ ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানালেন। কপিল বললেন, স্বর্গের নদী গঙ্গা নেমে এসে তাঁদের ভস্ম স্পর্শ করলে তবেই তারা প্রাণ ফিরে পাবেন।[4] পরে সগরের বংশধর ভগীরথ তপস্যা করে গঙ্গাকে মর্ত্যে নিয়ে এসেছিলেন।
বংশ-পরম্পরা
হিন্দুশাস্ত্র মতে, কপিল হলেন বিষ্ণুভক্ত অসুররাজ প্রহ্লাদের বংশধর ।
শিক্ষা
কপিলের সাংখ্য দর্শনের উল্লেখ বিভিন্ন হিন্দু ধর্মগ্রন্থে পাওয়া যায়:
মহাভারত
- কপিল বলেন, “কর্মের মাধ্যমে শুধু দেহ শুদ্ধ হয়। জ্ঞান (জ্ঞানীর কাছে) সর্বোচ্চ। (কর্মের মাধ্যমে) মনের কলুষতা দূরীভূত হল এবং ব্রহ্মের সন্তোষ জ্ঞান, দয়া, ক্ষমা, শান্তি, প্রেম ও সততায় পরিণত হলে কর্ম থেকে মুক্তি আসে। এই পথে ব্রহ্ম লাভ করা যায়। এই পথে কেউ সর্বোচ্চ সত্য জানতে পারে।” (মহাভারত, শান্তিপর্ব)
- ভীষ্ম (যুধিষ্ঠিরকে) বললেন, “হে শত্রুজয়কারী যুধিষ্ঠির, কপিলের অনুগামী সাংখ্য-মতাবলম্বীরা বলেন, মানবদেহে পাঁচটি দোষ আছে। এগুলি হল: কামনা, ক্রোধ, ভয়, নিদ্রা ও শ্বাস। এগুলি সকল জীবের দেহেই দেখা যায়। যাঁরা জ্ঞানী, তারা ক্ষমার দ্বারা ক্রোধকে জয় করেন। সকল কর্মের উদ্দেশ্যকে ছেঁটে ফেলে কামকে জয় করা যায়। সত্ত্বের চর্চার মাধ্যমে নিদ্রাকে জয় করা যায়। সতর্কতার মাধ্যমে জয় করা যায় ভয়কে। আর শ্বাসকে জয় করা যায় নিয়ন্ত্রিত আহারের মাধ্যমে। (মহাভারত, শান্তিপর্ব) [5]
ভাগবত পুরাণ
- “এই জগতে আমি এসেছি সাংখ্য দর্শন শিক্ষা দিতে। যাঁরা অপ্রয়োজনীয় জাগতিক কামনার হাত থেকে মুক্তি পেতে চান, তারা এই দর্শন শিক্ষা করবেন। এই আত্ম-উপলব্ধির পর বোঝা কঠিন। কালের স্রোতে তা হারিয়ে গিয়েছে। তাই আমি কপিলের দেহ ধারণ করে তা পুনরায় প্রবর্তন করতে এবং মানবসমাজে সেই দর্শন আবার শিক্ষা দিতে এসেছি।” (৩।২৪।৩৬-৩৭)
- “যখন কেউ কামনা ও লোভ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হয়, ‘আমি’ ও ‘আমার’ এই ভ্রান্ত দেহবোধ নষ্ট হয়, তখন তার মন শুদ্ধ হয়। সেই শুদ্ধ অবস্থায় সে কথাকথিত জাগতিক সুখ ও দুঃখকে অতিক্রম করে যায়।” (৩।২৫।১৬)
বৌদ্ধধর্মে প্রভাব
কোনো কোনো বৌদ্ধ পণ্ডিত দাবি করেন, গৌতম বুদ্ধ পূর্বজন্মে কপিল ছিলেন। অশ্বঘোষ তার বুদ্ধচরিত গ্রন্থে লিখেছেন বুদ্ধ সাংখ্যবাদী শিক্ষকের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলেন এবং তার মতবাদের কিছু অংশ সাংখ্য প্রভাবিত।[6]
আধুনিক হিন্দুসমাজে অবস্থান
পশ্চিমবঙ্গের গঙ্গাসাগরে বঙ্গোপসাগর ও গঙ্গা নদীর মোহনার কাছে কপিল মুনির মন্দির আছে। প্রতি বছর পৌষ মাসে সেখানে বিরাট মেলা হয়।[6]
স্বামী বিবেকানন্দ কপিলকে “বিশ্বের শ্রেষ্ঠ মনস্তাত্ত্বিক” বলেছেন। তার মতে, “জগতে এমন কোনো দর্শন নেই, যা কপিলের কাছে ঋণী নয়।” [7]
এছাড়া আসামের বরাক উপত্যকার সিদ্ধেশ্বর শিববাড়ি ছিল কপিল মুনির সাধনস্থল।[8]
পাদটীকা
বহিঃসংযোগ
Wikiwand in your browser!
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.