Loading AI tools
উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
হাত্তিনের যুদ্ধ বা হিত্তিনের যুদ্ধ (আরবি: معركة حطين) ১১৮৭ সালের ৪ জুলাই শনিবার ক্রুসেডার জেরুজালেম রাজ্য ও আইয়ুবীদের মধ্যে সংঘটিত হয়।
হাত্তিনের যুদ্ধ | |||||||
---|---|---|---|---|---|---|---|
মূল যুদ্ধ: তৃতীয় ক্রুসেড | |||||||
মধ্যযুগের একটি পান্ডুলিপিতে হাত্তিনের যুদ্ধের চিত্র | |||||||
| |||||||
বিবাদমান পক্ষ | |||||||
জেরুজালেম রাজ্য কাউন্টি অফ ত্রিপোলি নাইটস টেম্পলার নাইটস হসপিটালার অর্ডার অব সেন্ট লাজারুস অর্ডার অফ মাউন্টজয়[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] প্রিন্সিপলিটি অব এন্টিওক | আইয়ুবীয় | ||||||
সেনাধিপতি ও নেতৃত্ব প্রদানকারী | |||||||
গাই অব লুসিগনান ত্রিপলির তৃতীয় রেইমন্ড বেলিয়ান অব ইবেলিন গেরার্ড দ্য রিডফোর্ড রেইনল্ড অব শাটিলন গার্নিয়ের দে নাবলুস তোরোনের চতুর্থ হাম্পফ্রে আইমেরি অফ লুসিগনান সিডনের রেজিনাল্ড এদেসার তৃতীয় জোসেলিন |
সালাহুদ্দিন আইয়ুবি গোকবরি প্রথম মুযাফফর উমর[1] প্রথম আদিল আফযাল বিন সালাহউদ্দিন[2] | ||||||
শক্তি | |||||||
| |||||||
হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতি | |||||||
অসংখ্য | স্বল্প সংখ্যক |
সালাহুদ্দিন আইয়ুবির অধীন মুসলিম সেনাবাহিনী ব্যাপক সংখ্যক ক্রুসেডার সেনাকে হত্যা করে। জেরুজালেম পুনরায় অধিকার করে ও অন্যান্য কিছু ক্রুসেডার অধিকৃত শহর দখল করে।[9] যুদ্ধের ফলাফল হিসেবে মুসলিমরা আবার পবিত্র ভূমিতে প্রধান সামরিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়।[9] খ্রিষ্টানদের এই পরাজয় তৃতীয় ক্রুসেডের সূচনা করে। হাত্তিনের যুদ্ধের দুই বছর পর এই ক্রুসেড শুরু হয়।
এই যুদ্ধে বর্তমান ইসরায়েলের তিবিরিয়া নামক স্থানের নিকটবর্তী স্থানে সংঘটিত হয়। হিত্তিন শহরের নিকটবর্তী এই যুদ্ধক্ষেত্রে দুই চূড়া বিশিষ্ট একটি পাহাড় রয়েছে। এটি তিবিরিয়া ও পশ্চিমে আক্কার পথের মধ্যবর্তী বিস্তৃত পর্বতমালার গিরিপথের পাশে অবস্থিত। দারবুল হাউয়ারনাহ রাস্তাটি রোমানরা তৈরী করে। এটি জর্ডান নদী, গেলিলি সাগর ও ভূমধ্যসাগরীয় উপকূলের মধ্য প্রধান পথ হিসেবে কাজ করত।
১১৮৬ সালে গাই অব লুসিগনান জেরুজালেমের রাজা হন। তার স্ত্রী সিবিলার সন্তান পঞ্চম বল্ডউইনের মৃত্যুর পর স্ত্রীর পদাধিকার বলে তিনি ক্ষমতা পান। এসময় জেরুজালেম রাজ্য গাই, সিবিলা ও রেইনল্ড অব শাটিলন সেসাথে গেরার্ড অব রিডফোর্ট ও নাইটস টেম্পলারদের মত নতুন আগতদের মধ্যকার বিরোধে বিভক্ত ছিল। ত্রিপলির তৃতীয় রেইমন্ড যিনি শিশু রাজা পঞ্চম বল্ডউইনের অভিভাবক ছিলেন, তিনি ও তার নেতৃত্বাধীন অভিজাতরা গাইয়ের রাজা হওয়ার বিরোধিতা করেন। রেইমন্ড অবস্থার কারণে বীতশ্রদ্ধ দেখতে পান যে তার অনুসারী ব্যারনরা গাই ও সিবিলার প্রতি অনুগত রয়েছে। তিনি এরপর বিপরীত দিকে জর্ডান নদী থেকে তিবিরিয়ার দিকে চলে যান।[10] অবস্থা এতটাই খারাপ ছিল যে রেইমন্ড ও গাইয়ের মধ্যে প্রায় যুদ্ধ চলছিল। গাই রেইমন্ডের স্ত্রী এসিভার মাধ্যমে তিবিরিয়া দুর্গ জয় করতে চাইছিলেন। রেইমন্ডের সমর্থক বেলিয়ান অব ইবেলিনের মধ্যস্ততায় যুদ্ধ এড়ানো সম্ভব হয়।
ইতিমধ্যে জেরুজালেমকে ঘিরে থাকা মুসলিম রাষ্ট্রগুলো ১১৭০ ও ১১৮০ এর দশকে সালাহুদ্দিন কর্তৃক ঐক্যবদ্ধ হয়। ১১৬৯ সালে সালাহুদ্দিন মিশরের উজির নিযুক্ত হন এবং শীঘ্রই সুলতান হিসেবে দেশের শাসনভার লাভ করেন। ১১৭৪ সালে দামেস্কে তিনি তার শাসন জারি করেন। ১১৭৬ সাল নাগাদ আলেপ্পো ও ১১৮৩ সাল নাগাদ মসুলে তার কর্তৃত্ব স্থাপিত হয়। ফলে প্রথমবারের মত জেরুজালেম রাজ্য মুসলিম শাসিত অঞ্চল দ্বারা আবদ্ধ হয়ে পড়ে। ১১৭৭ সালে ক্রুসেডাররা সালাহুদ্দিনকে মন্টগিসারডের যুদ্ধের পরাজিত করে এবং ১১৮০ এর দশকের প্রথমদিকে দুপক্ষের মধ্যে একটি সন্ধি ছিল। কিন্তু রেইনল্ড একটি মুসলিম ক্যারাভেনকে আক্রমণ করলে সন্ধি ভঙ্গ হয়। এছাড়া রেইনল্ড মক্কা আক্রমণের হুমকিও দিয়েছিল।
১১৮৭ সালের এপ্রিলে রেইমন্ড সালাহুদ্দিনের সাথে একটি চুক্তির বিষয়ে সম্মত হন। তাদের চুক্তির অংশ হিসেবে রেইমন্ড গ্যালিলিতে একটি পরিদর্শন দল আগমণের ব্যাপারে সুলতানকে অনুমতি দেন। একই সময় গাইয়ের পক্ষে বেলিয়ানের নেতৃত্বাধীন একটি দল উক্ত এলাকা দিয়ে অতিক্রম করছিল। রেইমন্ড বেলিয়ানকে উপদেশ দেন যাতে বেলিয়ান মুসলিম সেনারা চলে যাওয়ার আগ পর্যন্ত আফুলা দুর্গে অবস্থান করেন। কিন্তু তার পরামর্শ উপেক্ষা করা হয়।[4] ১ মে ক্রিসনের যুদ্ধে আল-আফদালের অধীন একটি ক্ষুদ্র দলকে তাদেরকে পরাজিত করা হয়। সালাহুদ্দিনের সাথে লড়াইয়ের উদ্দেশ্যে সেনাসমাবেশ করা গাইয়ের সাথে রেইমন্ড এরপর একমত হন।
মে মাসের শেষের দিকে সালাহুদ্দিন তার জীবনের সর্ববৃহৎ সেনা সমন্বয়ে একটি সেনাদল গঠন করেন। এতে প্রায় ১২,০০০ নিয়মিত অশ্বারোহীসহ মোট ৩০,০০০ এর মত সৈনিক ছিল। জর্ডান নদী অতিক্রম করার পূর্বে ৩০ জুন তিনি তেল-আশতারায় তার বাহিনীকে পর্যবেক্ষণ করেন। প্রতিপক্ষ ক্রুসেডাররা জিপরিতে একত্রিত হয়। এতে জেরুজালেম ও ত্রিপলি থেকে ১,২০০ জন ও এন্টিওক থেকে ৫০ জন নাইটসহ মোট ২০,০০০ সৈনিক ছিল। এটি সালাহুদ্দিনের বাহিনীর তুলনায় ক্ষুদ্র হলেও ক্রুসেডারদের তুলনায় বড় ছিল।[4] রেইমন্ড ও গাই ক্রুসেডার সেনা সহকারে আক্কায় মিলিত হন। ইউরোপীয় সূত্রগুলোর মতে নাইটদের পাশাপাশি সেখানে বড় ধরনের হালকা অশ্বারোহী বাহিনী ও ১০,০০০ এর মত পদাতিক সৈনিক ছিল। সম্পূরক হিসেবে ক্রসবোম্যানরাও উপস্থিত হয় এবং বেশ বড় সংখ্যক ভাড়াটে সৈনিকও ছিল।[11] আক্কার বিশপ সেনাবাহিনীর সাথে থেকে ক্রস বহন করছিলেন। তিনি পেট্রিয়ার্ক হেরাক্লিয়াসের স্থান নেন।[4]
জুলাইয়ের ২ তারিখ সালাহুদ্দিন তিবিরিয়ায় রেইমন্ডের একটি দুর্গ অবরোধে ব্যক্তিগতভাবে নেতৃত্ব দেন। এসময় মূল মুসলিম সেনারা কাফ্র সাবতে অবস্থান করছিল। সালাহুদ্দিন গাইকে সাফুরিয়ার ঝর্ণা থেকে সরাবার জন্য প্রলুব্ধ করতে চাইছিলেন। তিবিরিয়ার গেরসন সালাহুদ্দিনকে অর্থ পরিশোধ করতে চেয়েছিল কিন্তু সালাহুদ্দিন তা গ্রহণে অস্বীকৃতি জানান। ঐদিনই দুর্গের পতন হয়। একটি টাওয়ার খুড়ে ফেলা হয় এবং এটি ধ্বসে পড়ে সালাহুদ্দিনের সৈনিকরা ভেতরে বাধাদানকারীদেরকে হত্যা ও বন্দী করে।
রেইমন্ডের স্ত্রী এসিভা দুর্গের ভেতর আবদ্ধ হয়ে পড়েন। খনন আরম্ভ হলে সালাহুদ্দিন খবর পান যে গাই ফ্রাঙ্ক সেনাবাহিনীকে পূর্বের দিকে নিয়ে আসছেন। ক্রুসেডাররা ফাঁদে পা দেয়।
জুলাই ২ তারিখ ক্রুসেডারদের একটি যুদ্ধসভার ফলে গাইয়ের নিজের প্রতিরক্ষার ত্যাগের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ফ্রাঙ্কদের মধ্যকার ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের কারণে এই সভার বিষয়ে তথ্য পক্ষপাতদুষ্ট হলেও রেইমন্ড সালাহুদ্দিনের ফাঁদ অনুযায়ী আক্কা থেকে তিবিরিয়ার দিকে এগিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে মতবিরোধ করেন বলে প্রতীয়মান হয়। অধিকন্তু গাইয়ের তিবিরিয়ার ব্যাপারে চিন্তিত হওয়া উচিত ছিল না, এটি রেইমন্ডের ব্যক্তিগত অধিকারে ছিল এবং রাজ্যের নিরাপত্তার জন্য ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত ছিল। মতবিরোধের ফলে গেরার্ড ও রেইনল্ড রেইমন্ডকে ভীরু বলে অভিযোগ করেন। ফলে গাই আক্রমণ করতে প্রভাবিত হন।
এরপর গাই সেনাবাহিনীকে সালাহুদ্দিনের বিরুদ্ধে তিবিরিয়ার দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য আদেশ দেন। এটিই সালাহুদ্দিনের পরিকল্পনা ছিল। এর মাধ্যমে ক্রুসেডারদেরকে তাদের দুর্গ অবরোধ না করে যুদ্ধক্ষেত্রেই পরাজিত করা সম্ভব ছিল।
এছাড়াও সালাহুদ্দিন অনাকাঙ্খিতভাবে দ্রুজদের কাছ থেকে মিত্রতা লাভ করেন। জামাল আদ-দিন হাজির মাধ্যমে শারাহমুলে এই মিত্রতা স্থাপিত হয়। জামালের পিতা কারামা নূর উদ্দিন জেনগির পুরনো মিত্র ছিলেন।[12] শারাহমুল শহর ক্রুসেডারদের কর্তৃক বেশ কয়েকবার হামলার স্বীকার হয়েছিল। জামাল আদ-দিন হাজির মতে তার বড় তিন ভাইকে হত্যা করে।
ক্রুসেডাররা সাফুরিয়া থেকে ৩ জুলাই তাদের যাত্রা শুরু করে। গাই সেনাদের মধ্যভাগ, রেইমন্ড অগ্রভাগ এবং বেলিয়ান, রেইনল্ড পেছনের দিক নিয়ন্ত্রণ করেন। মুসলিম সেনারা প্রায় সাথেসাথে ক্রুসেডারদেরকে ব্যতিব্যস্ত করে তোলে।
সেদিন দুপুর নাগাদ ফ্রাঙ্কিশ সেনাবাহিনী সাফুরিয়া থেকে ছয় মাইল (১০ কিমি) দূরের গ্রাম তুরানের একটি জলধারায় পৌছায়। সালাহুদ্দিনের মতে এখানে “ফ্রাঙ্কিশ পদাতিকদের বাজপাখি ও অশ্বারোহীদের ঈগলগুলো পানির পাশে উড়ছিল”।
তিবিরিয়া পর্যন্ত আরো ৯ মাইল (১৪ কিমি) পথ বাকি ছিল। ফলে যাত্রার জন্য দিনের অর্ধেক সময় বাকি থাকায় এই পানির উৎস থেকে নিজেদের সরিয়ে নেয়া মানে সালাহুদ্দিনের নিশ্চিত হামলার মুখোমুখি হতে হত। ১১৮২ সালে ফ্রাঙ্কিশ সেনাবাহিনী শত্রুদের বিরুদ্ধে এক দিনে ৮ মাইল (১৩ কিমি) অগ্রসর হতে পারত এবং ১১৮৩ সালে পুরো দিনে ছয় মাইল (১০ কিমি) অতিক্রমে সক্ষম হন। কিন্তু সালাহুদ্দিনের লেখা অনুযায়ী, “গাইয়ের উদ্দেশ্যের বিপরীত হয়ে এমন কাজ করার জন্য শয়তান তাকে প্রলুব্ধ করে।“ অর্থাৎ, অজ্ঞাত কারণে গাই অনেক বিকেলে তিবিরিয়ার উদ্দেশ্যে এগিয়ে যাওয়া শুরু করেন।
যখন সালাহুদ্দিন তিবিরিয়া দখল করার পর ফিরে আসেন এবং ফ্রাঙ্কিশরা তুরান ত্যাগ করে, মুসলিমরা হামলা করা শুরু করে। সালাহুদ্দিন তার সেনাবাহিনীর দুইটি অংশকে ফ্রাঙ্কিশদের বিরুদ্ধে পাঠান ও তুরানের জলধারা দখল করে নেন। ফলে ফ্রাঙ্কিশদের পিছু হটার পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। এই পরিকল্পনা সালাহুদ্দিনকে বিজয় দান করে।
ক্রুসেডারদের পরিকল্পনায় বড় ধরনের পরিবর্তন আসে। ক্রুসেডাররা সালাহুদ্দিনের সাথে সরাসরি লড়তে পারবে না এমন বিশ্বাস নিয়ে রেইমন্ড গাইকে বাহিনীর বাম ও অগ্রভাগ ৬ মাইল (৯.৭ কিমি) দূরের হাত্তিনের জলধারার দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রলুব্ধ করেন। সেখান থেকে তারা পরেরদিনই তিবিরিয়ার দিকে যাত্রা করতে পারবে।[13]
আসন্ন আক্রমণে ফ্রাঙ্কিশদের পশ্চাতভাগ নিরবচ্ছিন্ন আক্রমণের কারণে অচলাবস্থায় ছিল। এসময় সমগ্র বাহিনী মেসকানা গ্রামের নিকট উচ্চভূমিতে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। ক্রুসেডাররা মুসলিম পরিবেষ্টিত অবস্থায় ক্যাম্প করতে বাধ্য হয়। ফলে তাদের কাছে কোনো পানি ছিল না এবং রসদ ও নতুন সৈন্য আগমনের সুযোগও হারায়। গাইয়ের আশা ছিল যে তার লোকেরা পরেরদিন সকালে হাত্তিনের জলধারায় পৌছতে পারবে।[14]
যখন ক্রুসেডাররা পানির জন্য পিপাসার্ত হয়ে পড়েছিল সেসময় উটের ক্যারাভেন মুসলিম সেনাবাহিনীর জন্য তিবিরিয়া হ্রদ (বর্তমানে ‘’গেলিলি সাগর’’ বলে পরিচিত) থেকে ছাগলের চামড়ার ব্যাগে পানি বয়ে নিয়ে আসছিল।[15]
বাহাউদ্দিন ইবনে শাদ্দাদ ফ্রাঙ্কিশ সেনাবাহিনীর অবস্থা সংক্ষেপে বর্ণনা করে লিখে গেছেন।
৪ জুলাইয়ের সকালে ক্রুসেডাররা তাদেরকে সমস্যায় ফেলার জন্য সালাহুদ্দিনের বাহিনীর সৃষ্ট আগুনের ধোয়ার কারণে কিছু দেখতে পারছিল না। এর মাধ্যমে মুসলিম সেনাবাহিনীর একাংশের কমান্ডার প্রতিপক্ষের উপর ৪০০ তীর ছুড়ে মারেন। গেরার্ড ও রেইনল্ড গাইকে যুদ্ধের জন্য সেনাবিন্যাস ও হামলার পরামর্শ দেন। গাইয়ের ভাই আমালরিক এই কাজ সম্পন্ন করেন। রেইমন্ড প্রথম ডিভিশনের নেতৃত্ব দেন। তার সাথে এন্টিওকের তৃতীয় বোহেমন্ডের পুত্র রেইমন্ড অব এন্টিওক ছিলেন। অন্যদিকে বেলিয়ান ও এডেসার তৃতীয় জোসেলিন পশ্চাতভাগ বিন্যাস করেন। এই প্রস্তুতি সম্পন্ন হওয়ার সময় রেইমন্ডের পাঁচজন নাইট সালাহুদ্দিনের কাছে ক্রুসেডার শিবিরের দুর্বল অবস্থার কথা ফাঁস করে দেয়।
পিপাসার্ত ও মনোবল ভেঙ্গে পড়া ক্রুসেডাররা শিবির গুটিয়ে নেয় ও হাত্তিনের জলধারার দিকে নিজেদের গন্তব্য ঘুরিয়ে নেয়। কিন্তু তাদের এই পদক্ষেপে সালাহুদ্দিনের সেনারা বাধা দেয়। এর ফলে সামনে আগানোর বা পিছিয়ে আসার পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। কাউন্ট রেইমন্ড তিবিরিয়া হ্রদের দিকে হামলা ভেঙ্গে দেয়ার দুটি প্রচেষ্টা চালান। দ্বিতীয়বার তিনি তার মূল বাহিনী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন ও পিছিয়ে আসতে বাধ্য হন।
রেইমন্ড পালানোর পর গাইয়ের অবস্থান এখন আরো বেপরোয়া হয়ে উঠে। অধিকাংশ ক্রুসেডার পদাতিক সৈনিক ধ্বংসযজ্ঞ এড়ানোর জন্য দলত্যাগ করে। গাই মুসলিম অশ্বারোহীদের গতিরোধ করার জন্য তাবু স্থাপন করার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু পদাতিকদের সুরক্ষা ছাড়া নাইটদের ঘোড়াগুলো মুসলিম তীরন্দাজদের কারণে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় এবং অশ্বারোহীদেরকে পায়ে ভর দিয়ে লড়াই করতে হয়। এরপর তারা দুজনই পিছু হটেন।
এখন ক্রুসেডাররা ঘেরাও হয়ে পড়ে। তিনটি বেপরোয়া হামলা ছাড়া তারা সালাহুদ্দিনের কোনো ক্ষতি করতে পারেনি ফলে পরাজিত হয়। সালাহুদ্দিনের ১৭ বছর বয়সী এক পুত্র আল-আফদান এই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। মুসলিম লেখক ইবনে আল-আসিরের লেখায় এটির উদ্ধৃতি রয়েছে
যখন ফ্রাঙ্কদের রাজা (গাই) তার দল নিয়ে পাহাড়ের উপর ছিলেন, তারা মুখোমুখি অবস্থান করা মুসলিমদের বিরুদ্ধে একটি ভয়ংকর হামলা চালায় যাতে তারা তাদেরকে আমার পিতার (সালাহুদ্দিন) কাছে ফিরিয়ে দিতে পারে। আমি তার দিকে তাকালাম এবং তিনি বিষাদগ্রস্ত হয়ে পড়লেন ও তার গাত্রবর্ণ ফ্যাকাসে হয়ে গেল। তিনি তার দাড়ি ধরলেন ও অগ্রসর হলে, চিৎকার দিয়ে বললেন “শয়তানদেরকে ফেলে দাও!” মুসলিমরা এগিয়ে যায়, লড়াইয়ে পুনরায় অংশ নেয় এবং পাহাড়ে চড়ে। যখন আমি দেখলাম যে মুসলিমদের পশ্চাদ্ধাবনে ফ্রাঙ্করা পিছিয়ে যাচ্ছে আমি আনন্দে চিৎকার দিয়ে উঠলাম, “আমরা তাদের পরাজিত করেছি!” কিন্তু ফ্রাঙ্করা এগিয়ে আসে প্রথমবারের মত হামলা চালায় এবং মুসলিমদের আমার বাবার কাছে ফেরত পাঠায়। তিনি আবার প্রথমবারের মত করেন এবং মুসলিমরা ফ্রাঙ্কদের দিকে আবার ফিরে যায় ও তাদেরকে পাহাড় থেকে পিছু হটায়। আমি আবার চিৎকার দিয়ে উঠি, "আমরা তাদের পরাজিত করেছি!" কিন্তু আমার বাবা আমার পাশে ঘুরেন ও বলেন, "শান্ত হও! যতক্ষণ না ঐ তাবুটি (গাইয়ের) ধ্বংস না হচ্ছে ততক্ষণ আমরা তাদেরকে হারায়নি।" তিনি আমাকে একথা বলার পর তাবুটি ধ্বংস হয়। সুলতান ঘোড়া থেকে নামেন, সর্বশক্তিমান আল্লাহর কাছে সিজদায় নত হন ও আনন্দে কেঁদে ফেলেন।[16]
মুসলিম সেনারা রাজা গাইয়ের রাজকীয় তাবু দখল করে। সেসাথে যুদ্ধে আক্কার বিশপ নিহত হলে তার ট্রু ক্রসও দখল করে। গাই, তার ভাই দ্বিতীয় আমালরিক, রেইনল্ড অব শাটিলন, মন্টফেরাটের উইলিয়াম, গেরার্ড দ্য রিডফোর্ট, টোরনের হামফ্রে, জাবালার হাফ, বোট্রনের পিলভেইন, জিবেলেতের হাফ ও অন্য আরো অনেকে বন্দী হয়। সম্ভবত ৩,০০০ খ্রিষ্টান সৈনিক পালাতে সক্ষম হয়। বেনামী লেখকের লেখা De Expugnatione Terrae Sanctae per Saladinum Libellus অনুযায়ী রেইমন্ড, জোসেলিন, বেলিয়ান ও রেজিনাল্ড অব সিডন যুদ্ধের মধ্যবর্তী অবস্থায় পালিয়ে যান। কিন্তু এটি অন্যান্য সূত্রগুলো দ্বারা সমর্থিত নয় এবং এতে লেখকের শত্রু মনোভাব প্রকাশিত হয়।
ক্লান্ত বন্দীদেরকে সালাহুদ্দিনের তাবুতে আনা হয়। সালাহুদ্দিনের ঔদার্যের নিদর্শন হিসেবে গাইকে বরফ পানির একটি পানপাত্র দেয়া হয়। গাই এই পাত্র তার সঙ্গী রেইনল্ডের দিকে দিলে সালাহুদ্দিন তাকে এটি পান করার অনুমতি দেন কিন্তু কিছুক্ষণ পর বলেন যে তিনি রেইনল্ডকে পানি প্রদান করেননি এবং এর কারণে মুসলিম রীতি অনুযায়ী আতিথেয়তায় আবদ্ধ না। যখন সালাহুদ্দিন রেইনল্ডকে শপথ ভঙ্গকারী হিসেবে অভিযুক্ত করেন, রেইনল্ড উত্তর দেন "রাজারা সবসময় এভাবেই কাজ করে। আমি এর বেশি কিছু করিনি।" সালাহুদ্দিন এরপর নিজের তরবারী দিয়ে রেইনল্ডের শিরশ্ছেদ। গাই রেইনল্ডের পরিণতি দেখে হাটুর উপর ভর দিয়ে বসে পড়ে। কিন্তু সালাহুদ্দিন তাকে উঠতে বলার পর বলেন, "রাজা কখনো অন্য রাজাকে হত্যা করে না; কিন্তু ঐ লোকটা সব সীমা অতিক্রম করেছিল এবং তাই আমি তার সাথে এই আচরণ করেছি। এই লোকটিকে তার অপরাধপ্রবণতা ও বিশ্বাসঘাতকতার জন্য মরতে হয়েছে।"
ট্রু ক্রসকে বর্শার সাথে বাধে দামেস্কে পাঠিয়ে দেয়া হয়। সালাহুদ্দিনের সেনাবাহিনীর কিছু লোক এসময় ফ্রাঙ্কিশ বন্দীদেরকে দাস হিসেবে নিয়ে সেনাবাহিনী ত্যাগ করে।
৫ জুলাই রোববার, সালাহুদ্দিন তিবিরিয়ার দিকে ছয় মাইল (১০ কিমি) যাত্রা করে এবং সেখানে কাউন্টেস এসিভা দুর্গের নিয়ন্ত্রণ সমর্পণ করেন। তাকে তার পরিবার, অনুসারী ও সহায় সম্মদসহ ত্রিপলি যেতে অনুমতি দেয়া হয়। রেইমন্ড অব ত্রিপলি যুদ্ধ থেকে পালানোর পর ১১৮৭ সালে প্লুরেসিতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।
মৃত্যুদন্ড প্রাপ্তদের দন্ড শিরশ্ছেদের মাধ্যমে কার্যকর করা হয়। বন্দী অনেক ক্রুসেডার নিজেদের টেম্পলার নাইট হওয়ার মিথ্যা দাবি করে যাতে সালাহুদ্দিনের লোকেরা তাদেরকেও শিরশ্ছেদ করে। নাইটস হসপিটালার সেইন্ট নিকাসিয়াসকে খ্রিষ্টান শহীদ হিসেবে সম্মান করা হয়। বলা হয় যে তিনিও নিহতদের মধ্যে একজন।[17]
গাইকে দামেস্কে বন্দী হিসেবে নেয়া হয়। পরে তিনি মুক্তিপণের বিনিময়ে ছাড়া পান।
২০,০০০ সৈনিক নিয়ে মাঠে নামার কারণে ক্রুসেডারদের দুর্গ ও আবাসথলগুলো অরক্ষিত হয়ে পড়ে। হাত্তিনে বড় ধরনের পরাজয় সালাহুদ্দিনের বিপক্ষে লড়াইয়ের জন্য স্বল্পসংখ্যক রিজার্ভ সৈনিকের উপস্থিতি প্রমাণ করে।[19] এই পরাজয়ের ফলাফল হিসেবে সালাহুদ্দিনের সেনারা ক্রুসেডারদের এলাকা দখলে নিয়ে নেয়।[20] মধ্য সেপ্টেম্বর নাগাদ সালাহুদ্দিন আক্কা, নাবলুস, জাফা, টোরন, সিডন, বৈরুত ও আসকেলন দখল করে নেন। সৌভাগ্যবশত কনরাড অব মন্টফেরাটের আগমনের কারণে টায়ার রক্ষা পায়। রাণী সিবিলা, পেট্রিয়ার্ক হেরাক্লিয়াস ও বেলিয়ান জেরুজালেম প্রতিরক্ষা করতে থাকেন। ২ অক্টোবর বেলিয়ান সালাহুদ্দিনের সাথে আত্মসমর্পণের ব্যাপারে আলোচনা করেছিলেন (দেখুন জেরুজালেম অবরোধ (১১৮৭))।
এরনলের বিবরণ অনুযায়ী পরাজয়ের খবর শোনার পর পোপ তৃতীয় আরবান শোকে মৃত্যুবরণ করেন।
টায়ারের আর্চবিশপ জোসিয়াস এবং অন্যান্য তীর্থযাত্রী ও ভ্রমণকারীদের কর্তৃক হাত্তিনের পরাজয়ের খবর ইউরোপ পৌছায়। নতুন ক্রুসেডের জন্য অবিলম্বে পরিকল্পনা তৈরী হয়; পোপ অষ্টম গ্রেগরি অডিটা ট্রিমেন্ডি জারি করেন এবং ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সে সালাহুদ্দিন টিথে নামক ফান্ডে অর্থ সংগ্রহ শুরু হয়।
তৃতীয় ক্রুসেড ১১৮৯ এর আগ পর্যন্ত শুরু হয়নি। এতে ফিলিপ অগাস্টাস, রিচার্ড লায়নহার্ট ও ফ্রেডেরিক বারবারোসা পৃথক পৃথকভাবে নেতৃত্বে দেন।