Remove ads
মিশর ও সিরিয়ার সুলতান উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
আবু নাসির সালাহুদ্দিন ইউসুফ ইবনে আইয়ুব (কুর্দি: سەلاحەدینی ئەییووبی/Selahedînê Eyûbî; আরবি: صلاح الدين يوسف بن أيوب) (১১৩৭/১১৩৮ – ৪ মার্চ ১১৯৩) বা (বাংলায় প্রসিদ্ধ নাম) সালাহুদ্দিন আইয়ুবি[ক] ছিলেন মিশর ও সিরিয়ার প্রথম সুলতান এবং আইয়ুবীয় রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা। পাশ্চাত্যে তিনি সালাদিন বলে পরিচিত। তিনি কুর্দি জাতিগোষ্ঠীর লোক ছিলেন।[৪][৫][৬] শামে ইউরোপীয় ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে তিনি মুসলিম প্রতিরোধের নেতৃত্ব দেন। ক্ষমতার সর্বোচ্চ শিখরে তার সালতানাতে মিশর, সিরিয়া, মেসোপটেমিয়া, হেজাজ, ইয়েমেন এবং উত্তর আফ্রিকার অন্যান্য অংশ অন্তর্ভুক্ত ছিল।
সালাহউদ্দিন আইয়ুবি | |||||
---|---|---|---|---|---|
মিশর ও সিরিয়ার সুলতান | |||||
রাজত্ব | ১১৭৪-১১৯৩ | ||||
রাজ্যাভিষেক | ১১৭৪, কায়রো | ||||
পূর্বসূরি | নুরুদ্দিন জেনগি | ||||
উত্তরসূরি | আফযাল (সিরিয়া) আজিজ উসমান (মিশর) | ||||
জন্ম | ৫৩২ হিজরি (১১৩৮ খ্রিষ্টাব্দ) তিকরিত, মসুল আমিরাত | ||||
মৃত্যু | ৪ মার্চ ১১৯৩ (৫৫ বছর) দামেস্ক, সিরিয়া | ||||
সমাধি | |||||
দাম্পত্য সঙ্গী | ইসমতউদ্দিন খাতুন | ||||
| |||||
রাজবংশ | আইয়ুবীয় | ||||
পিতা | নাজমুদ্দিন আইয়ুব | ||||
ধর্ম | সুন্নি ইসলাম[১][২][৩] |
১১৬৩ সালে তার জেনগি বংশীয় ঊর্ধ্বতন নুরউদ্দিন জেনগি তাকে ফাতেমীয় মিশরে প্রেরণ করেন। ক্রুসেডারদের আক্রমণের বিরুদ্ধে সামরিক সাফল্যের মাধ্যমে সালাহউদ্দীন ফাতেমীয় সরকারের উচ্চপদে পৌঁছান। ফাতেমীয় খলিফা আল আদিদের সাথে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। ১১৬৯ সালে তার চাচা শেরকোহ মৃত্যুবরণ করলে আল আদিদ সালাহউদ্দীনকে তার উজির নিয়োগ দেন। নেতৃত্বাধীন খিলাফতে মুসলিমদের এমন পদ দেয়া বিরল ঘটনা ছিল। উজির থাকাকালে তিনি ফাতেমীয় শাসনের প্রতি বিরূপ ছিলেন। আল আদিদের মৃত্যুর পর তিনি ক্ষমতা গ্রহণ করেন এবং বাগদাদের আব্বাসীয় খিলাফতের আনুগত্য ঘোষণা করেন। পরবর্তী বছরগুলোতে তিনি ফিলিস্তিনে ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালান, ইয়েমেনে সফল বিজয় অভিযানের আদেশ দেন এবং উচ্চ মিশরে ফাতেমীয়পন্থি বিদ্রোহ উৎখাত করেন।
১১৭৪ সালে নূরউদ্দিনের মৃত্যুর অল্পকাল পরে সালাহউদ্দীন সিরিয়া বিজয়ে ব্যক্তিগতভাবে নেতৃত্ব দেন। দামেস্কের শাসকের অনুরোধে তিনি শান্তিপূর্ণভাবে শহরে প্রবেশ করেন। ১১৭৫ সালের মধ্যভাগে তিনি হামা ও হিমস জয় করেন। জেনগি নেতারা তার বিরোধী হয়ে পড়ে। সরকারিভাবে তারা সিরিয়ার শাসক ছিল। এরপর শীঘ্রই তিনি জেনগি সেনাবাহিনীকে পরাজিত করেন এবং আব্বাসীয় খলিফা আল মুসতাদি কর্তৃক মিশর ও সিরিয়ার সুলতান ঘোষিত হন। উত্তর সিরিয়া ও জাজিরায় তিনি আরও অভিযান চালান। এসময় হাশিশীনদের দুটি হত্যাচেষ্টা থেকে তিনি বেঁচে যান। ১১৭৭ সালে তিনি মিশরে ফিরে আসেন। ১১৮২ সালে আলেপ্পো জয়ের মাধ্যমে সালাহুদ্দিন সিরিয়া জয় সমাপ্ত করেন। তবে জেনগিদের মসুলের শক্তঘাঁটি দখলে সমর্থ হননি।
সালাহউদ্দীনের ব্যক্তিগত নেতৃত্বে আইয়ুবী সেনারা ১১৮৭ সালে হাত্তিনের যুদ্ধে ক্রুসেডারদের পরাজিত করে। এর ফলে মুসলিমদের জন্য ক্রুসেডারদের কাছ থেকে ফিলিস্তিন জয় করা সহজ হয়ে যায়। এর ৮৮ বছর আগে ক্রুসেডাররা ফিলিস্তিন দখল করে নিয়েছিল। ক্রুসেডার ফিলিস্তিন রাজ্য এরপর কিছুকাল বজায় থাকলেও হাত্তিনের পরাজয় এই অঞ্চলে মুসলিমদের সাথে ক্রুসেডার সংঘাতের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। সালাহউদ্দীন ছিলেন মুসলিম, আরব, তুর্কি ও কুর্দি সংস্কৃতিতে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব।[৭] ১১৯৩ সালে তিনি দামেস্কে মৃত্যুবরণ করেন। তার অধিকাংশ সম্পদ তিনি তার প্রজাদের দান করে যান। উমাইয়া মসজিদের পাশে তাকে দাফন করা হয়। সেখানে তার মাজার অবস্থিত।
সালাহুদ্দিন আইয়ুবী মেসোপটেমিয়ার তিকরিতে জন্মগ্রহণ করেন। তার ব্যক্তিগত নাম ইউসুফ, সালাহুদ্দিন হল লকব যার অর্থ “বিশ্বাসের ন্যায়পরায়ণ”।[৮] তার পরিবার কুর্দি বংশোদ্ভূত[৪] এবং মধ্যযুগীয় আর্মেনিয়ার ডিভিন শহর থেকে আগত।[৯][১০] নুরউদ্দিন জেনগি ছিলেন তার নানা। এসময় তার নিজ রাওয়াদিদ গোত্র আরবিভাষী বিশ্বের অংশ হয়ে যায়।[১১] সালাহউদ্দিনের যুগে শেখ আবদুল কাদের জিলানীর চেয়ে বেশি প্রভাব আর কোনো পণ্ডিতের ছিল না এবং সালাহউদ্দিন তার ও তার শিষ্যদের দ্বারা দৃঢ়ভাবে প্রভাবিত ও সহায়তা পেয়েছিলেন।[১২][১৩] ১১৩২ সালে মসুলের শাসক ইমাদউদ্দিন জেনগির পরাজিত সেনাবাহিনী পিছু হটার সময় টাইগ্রিসের দিকে বাধাপ্রাপ্ত হয়। এসময় সালাহুদ্দিনের পিতা নাজমুদ্দিন আইয়ুব এখানকার তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন। তিনি সেনাদের জন্য ফেরির ব্যবস্থা করেন এবং তাদের তিকরিতে আশ্রয় দেন। মুজাহিদউদ্দিন বিহরুজ নামক একজন প্রাক্তন গ্রিক দাস এসময় উত্তর মেসোপটেমিয়ায় সেলজুক পক্ষের সামরিক গভর্নর ছিলেন। তিনি জেনগিদের সাহায্য করার জন্য আইয়ুবের বিরোধী হন। ১১৩৭ সালে আইয়ুবের ভাই আসাদউদ্দিন শিরকুহ বিহরুজের এক বন্ধুকে সম্মান রক্ষার লড়াইয়ে হত্যা করার পর তাকে তিকরিত থেকে বিতাড়িত করেন। বাহাউদ্দিন ইবনে শাদ্দাদের মতে যে রাতে সালাহুদ্দিনের পরিবার তিকরিত ত্যাগ করে সে রাতেই তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ১১৩৯ সালে আইয়ুব ও তার পরিবার মসুলে চলে আসেন। এখনে ইমাদউদ্দিন জেনগি তাদের পূর্ব অবদান স্বীকার করে আইয়ুবকে বালবিকের দুর্গের কমান্ডার নিয়োগ দেন। ১১৪৬ সালে ইমাদউদ্দিনের মৃত্যুর পর তার পুত্র নুরউদ্দিন জেনগি আলেপ্পোর অভিভাবক এবং জেনগি রাজবংশের নেতা হন।[১৪]
এসময় সালাহুদ্দিন দামেস্কে বসবাস করছিলেন। বলা হয় যে তিনি এই শহরের প্রতি দুর্বল ছিলেন। তবে তার অল্প বয়সের তথ্য বেশি পাওয়া যায় না। শিক্ষা সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, “বড়রা যেভাবে বৃদ্ধি পেয়েছেন সেভাবে শিশুদের গড়ে তোলা হয়”। তার একজন জীবনীকার আল ওয়াহরানির মতে সালাহুদ্দিন ইউক্লিড, আলমাজেস্ট, পাটিগণিত ও আইন সম্পর্কিত প্রশ্নের উত্তর দিতে পারতেন।[১৪] কিছু সূত্র মতে ছাত্রাবস্থায় তিনি সামরিক বাহিনীর চেয়ে ধর্মীয় বিষয়ে বেশি আগ্রহী ছিলেন।[১৫] ধর্মীয় বিষয়ে তার আগ্রহে প্রভাব ফেলা আরেকটি বিষয় হল প্রথম ক্রুসেডের সময় খ্রিষ্টানদের কর্তৃক জেরুজালেম অধিকার।[১৫] ইসলাম ছাড়াও বংশবৃত্তান্ত, জীবনী এবং আরবের ইতিহাস ও পাশাপাশি আরব ঘোড়ার রক্তধারা সম্পর্কে তার জ্ঞান ছিল। আবু তামামের রচিত হামাশ তার সম্পূর্ণ জানা ছিল।[১৪] তিনি কুর্দি এবং তুর্কি ভাষায় কথা বলতে পারতেন।[১৬]এবং তিনি ছিলেন একজন কুর্দি
চাচা আসাদউদ্দিন শিরকুহর তত্ত্বাবধানে সালাহুদ্দিনের সামরিক কর্মজীবন শুরু হয়। শিরকুহ এসময় দামেস্ক ও আলেপ্পোর আমির নুরউদ্দিন জেনগির একজন গুরুত্বপূর্ণ সামরিক কমান্ডার ছিলেন। ১১৬৩ সালে ফাতেমীয় খলিফা আল আদিদের উজির শাওয়ার শক্তিশালী বনু রুজাইক গোত্রের দিরগাম নামক ব্যক্তি দ্বারা মিশর থেকে বিতাড়িত হন। তিনি নুরউদ্দিনের কাছে সামরিক সহযোগিতা চাইলে নুরউদ্দিন তা প্রদান করেন। তিনি ১১৬৪ সালে দিরগামের বিরুদ্ধে শাওয়ারের অভিযানে সহায়তার জন্য শিরকুহকে পাঠান। ২৬ বছরের সালাহুদ্দিন এসময় তার সাথে যান।[১৭] শাওয়ার পুনরায় উজির হওয়ার পর তিনি শিরকুহকে মিশর থেকে তার সেনা সরিয়ে নিতে বলেন। কিন্তু শিরকুহ তা প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি বলেন যে নুরউদ্দিনের ইচ্ছা যে তারা মিশরে অবস্থান করবেন। এ অভিযানে সালাহুদ্দিনের ভূমিকা অল্প ছিল।[১৮]
বিলবাইসের পর ক্রুসেডার-মিশরীয় বাহিনী এবং শিরকুহর বাহিনী গাজার পশ্চিমে নীল নদের সন্নিকটে মরু সীমান্তে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়। সালাহুদ্দিন এতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। এতে তিনি জেনগি সেনাবাহিনীর দক্ষিণভাগের নেতৃত্ব দেন। কুর্দিদের একটি দল এসময় বাম পাশের দায়িত্বে ছিল। শিরকুহ ছিলেন মধ্য ভাগের অবস্থানে। প্রথমদিকে ক্রুসেডাররা সাফল্য লাভ করলেও অঞ্চলটি তাদের ঘোড়ার জন্য উপযুক্ত ছিল না। কায়সারিয়ার কমান্ডার হিউ সালাহুদ্দিনের দলকে আক্রমণের সময় গ্রেপ্তার হন। মূল অবস্থানের দক্ষিণ প্রান্তের ছোট উপত্যকায় লড়াইয়ের পর জেনগিদের কেন্দ্রীয় শক্তি আগ্রাসী অবস্থানে চলে আসে। সালাহুদ্দিন পিছন থেকে তাদের সাথে যুক্ত হন।[১৯]
এ যুদ্ধে জেনগিরা বিজয়ী হয়। ইবনে আল আসিরের মতে সালাহুদ্দিন শিরকুহকে লিখিত ইতিহাসের সবচেয়ে স্মরণীয় বিজয়ে সাহায্য করেন। তবে এতে শিরকুহর অধিকাংশ লোক মারা যায় এবং কিছু সূত্র মতে এই যুদ্ধ সামগ্রিক জয় ছিল না। সালাহুদ্দিন ও শিরকুহ আলেক্সান্দ্রিয়ার দিকে যাত্রা করেন। সেখানে তাদের অভ্যর্থনা জানান হয় এবং অর্থ, অস্ত্র প্রদান ও শিবির স্থাপন করতে দেয়া হয়।[২০] শহর অধিকার করতে এগিয়ে আসা একটি শক্তিশালী ক্রুসেডার-মিশরীয় দলকে প্রতিহত করার জন্য শিরকুহ তার সেনাবাহিনীকে বিভক্ত করেন। তিনি ও তার অধীন সেনারা আলেক্সান্দ্রিয়া থেকে অন্যত্র যাত্রা করেন এবং সালাহুদ্দিন ও তার অধীনস্থ সেনারা শহর রক্ষার জন্য থেকে যান।[২১]
শিরকুহ মিশরে শাওয়ার ও প্রথম আমালরিকের সাথে ক্ষমতার লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়েন। এতে শাওয়ার আমালরিকের সহায়তা চান। বলা হয় যে ১১৬৯ সালে শাওয়ার সালাহুদ্দিন কর্তৃক নিহত হন। এরপরের বছর শিরকুহ মৃত্যুবরণ করেন।[২২] নুরউদ্দিন শিরকুহর জন্য উত্তরাধিকারী বাছাই করেন। কিন্তু আল আদিদ সালাহুদ্দিনকে শাওয়ারের স্থলে উজির নিয়োগ দেন।[২৩]
শিয়া খলিফার অধীনে একজন সুন্নিকে উজির মনোনীত করার কারণ নিয়ে একাধিক মত রয়েছে। ইবনে আল আসিরের দাবি করেছেন যে খলিফার উপদেষ্টারা “সালাহুদ্দিনের চেয়ে ছোট বা দুর্বল কেউ নেই” এবং “একজন আমিরও তার আনুগত্য বা তার অধীনতা মানে না” এমন পরামর্শ দেয়ার কারণে তাকে নিয়োগ দেয়া হয়। এ মতানুযায়ী কিছু মতবিরোধের পর অধিকাংশ আমির তাকে মেনে নেন। আল আদিদের উপদেষ্টারা সিরিয়া ভিত্তিক জেনগি ধারাকে ভেঙে দেয়ার উদ্দেশ্য পোষণ করছিলেন। আল ওয়াহরানি লিখেছেন যে সালাহুদ্দিনের পরিবারের সুনাম ও তার সামরিক দক্ষতার জন্য তাকে নিয়োগ দেয়া হয়। ইমাদউদ্দিন আল ইসফাহানির লিখেছেন যে শিরকুহর জন্য সংক্ষিপ্তকালের শোকের পর জেনগি আমিররা সালাহুদ্দিনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেন এবং তাকে উজির হিসেবে নিয়োগ দেয়ার জন্য খলিফাকে চাপ দেন। যদিও বিদ্রোহী মুসলিম নেতাদের কারণে অবস্থা জটিল ছিল, বেশ কিছু সিরিয়ান শাসক মিশরীয় অভিযানে অবদানের জন্য সালাহুদ্দিনকে সমর্থন করেন।[২৪]
আমীর হওয়ার পর তিনি প্রভূত ক্ষমতা ও স্বাধীনতা অর্জন করলেও পূর্বের চেয়েও বেশি পরিমাণে আল আদিদ ও নুরউদ্দিনের মধ্যে আনুগত্যের প্রশ্নের সম্মুখীণ হয়। সে বছরের পরবর্তীকালে মিশরীয় সেনাদের একটি দল ও তার আমিররা সালাহুদ্দিনকে হত্যার চেষ্টা চালায়। কিন্তু তার প্রধান গোয়েন্দা আলি বিন সাফওয়ানের গোয়েন্দা তথ্যের মাধ্যমে তা প্রকাশ পেয়ে যায়। ষড়যন্ত্রকারী নাজি, ফাতেমীয় প্রাসাদের বেসামরিক নিয়ন্ত্রণকর্তা মুতামিন আল খিলাফাকে গ্রেপ্তার ও হত্যা করা হয়। এরপরের দিন ফাতেমীয় সেনাবাহিনীর রেজিমেন্টের ৫০,০০০ কালো আফ্রিকান সেনা সালাহুদ্দিনের শাসনের বিরুদ্ধে বেশ কিছু মিশরীয় আমিরের সাথে বিরোধীতা করে এবন বিদ্রোহে করে। ২৩ আগস্ট সালাহুদ্দিন এই উত্থান বিনাশ করেন এবং এরপর কায়রো থেকে কোনো সামরিক হুমকি আসেনি।[২৫]
১১৬৯ সালের শেষের দিকে নুরউদ্দিনের পাঠানো সাহায্যের মাধ্যমে দামিয়াতের কাছে বৃহৎ ক্রুসেডার-বাইজেন্টাইন সেনাবাহিনীকে পরাজিত করেন। এরপর ১১৭০ সালের বসন্তে নুরউদ্দিন সালাহুদ্দিনের পিতাকে সালাহুদ্দিনের অনুরোধে এবং বাগদাদের খলিফা আল মুসতানজিদের অনুপ্রেরণায় মিশরে পাঠান। আল মুসতানজিদ প্রতিপক্ষ খলিফা আল আদিদকে উৎখাত করতে মনস্থির করেন।[২৬] সালাহুদ্দিন মিশরে তার অবস্থান শক্ত করেন এবং সমর্থন ঘাঁটি বিস্তৃত করেন। তিনি এই অঞ্চলে তার পরিবারের সদস্যদের উচ্চপদ প্রদান করেন। মালিকি মাজহাবের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে তিনি আদেশ দেন। সেসাথে শাফি মাজহাবের জন্যও প্রতিষ্ঠান তৈরী করা হয়।[২৭]
মিশরে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার পর সালাহুদ্দিন ১১৭০ সালে দারুম অবরোধের মাধ্যমে ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেন।[২৮] আমালরিক গাজা থেকে তার টেম্পলার গেরিসন সরিয়ে নেন যাতে দারুম রক্ষা করতে সহায়তা পাওয়া যায়। কিন্তু সালাহুদ্দিন তার সেনাদের সরিয়ে নেন এবং গাজায় এগিয়ে আসেন। শহরের দুর্গের বাইরের অঞ্চল ধ্বংস করে দেয়া হয়। দুর্গে প্রবেশ করতে না চাওয়ায় অধিবাসীদের অধিকাংশকে হত্যা করা হয়।[২৯] সে বছরের ঠিক কবে এলিয়াতের ক্রুসেডার দুর্গ তিনি কবে আক্রমণ ও অধিকার করেন তা স্পষ্ট নয়। এটি আকাবা উপসাগরের একটি দ্বীপের উপর অবস্থিত ছিল। এটি মুসলিম নৌবাহিনীর যাতায়াতে হুমকি ছিল না। কিন্তু ক্ষুদ্র মুসলিম নৌবহরকে তা ব্যতিব্যস্ত করে রাখে ফলে সালাহুদ্দিন এটি দখল করেন।[২৮]
ইমাদউদ্দিনের মতে ১১৭১ সালের জুন মাসে নুরউদ্দিন সালাহুদ্দিনকে মিশরে আব্বাসীয় খিলাফত প্রতিষ্ঠার কথা বলে চিঠি লেখেন। দুই মাস পর শাফি ফকিহ নাজমুদ্দিন আল খাবুশানির উৎসাহে সালাহুদ্দিন তা সম্পন্ন করেন। ফকিহ নাজমুদ্দিন শিয়া শাসনের বিরোধী ছিলেন। কয়েকজন মিশরীয় আমির এর ফলে নিহত হন। আল আদিদকে বলা হয় যে তাদেরকে বিদ্রোহের কারণে হত্যা করা হয়েছে। এরপর তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। একটি সূত্র মতে তাকে বিষপ্রয়োগ করা হয়। অসুস্থ অবস্থায় তিনি তার সাথে দেখা করার জন্য সালাহুদ্দিনকে জানান যাতে তার সন্তানদের দেখাশোনার অনুরোধ করতে পারেন। সালাহুদ্দিন তা প্রত্যাখ্যান করেন এই আশঙ্কায় যে এটি আব্বাসীয়দের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা হবে। কিন্তু আল আদিদ কী চাইছিলেন তা জানার পর তিনি দুঃখ প্রকাশ করেন।[৩০] পাঁচ দিন পর ১৩ সেপ্টেম্বর আল আদিদ মৃত্যুবরণ করেন। কায়রো ও ফুসতাতে আব্বাসীয় খলিফার নামে খুতবা পাঠ করা হয় এবং আল মুসতাদিকে খলিফা হিসেবে ঘোষণা করা হয়।[৩১]
২৫ সেপ্টেম্বর সালাহুদ্দিন জেরুজালেম রাজ্যের মরু দুর্গ কেরাক ও মন্ট্রিয়ালের উদ্দেশ্যে কায়রো ত্যাগ করেন। সিরিয়ার দিক থেকে এসময় নুরউদ্দিনের আক্রমণ করার কথা ছিল। তার অনুপস্থিতিতে মিশরের ভেতরে ক্রুসেডার নেতারা ভেতর থেকে আক্রমণ করার জন্য বিশ্বাসঘাতকদের মধ্যে সমর্থন বৃদ্ধি করছে এবং বিশেষত ফাতেমীয়রা তার ক্ষমতা খর্ব করে পূর্বাবস্থা ফিরিয়ে আনতে চায় এমন সংবাদ পাওয়ার পর মন্ট্রিয়াল পৌছার পূর্বে সালাহুদ্দিন কায়রোতে ফিরে আসেন। এর ফলে নুরউদ্দিন একা হয়ে পড়েন।[৩২]
১১৭৩ সালের গ্রীষ্মে একটি নুবিয়ান সেনাবাহিনী আসওয়ান অবরোধের জন্য আর্মেনীয় উদ্বাস্তুসহ এগিয়ে আসে। শহরটির আমির সালাহুদ্দিনের সহায়তা চান এবং সালাহুদ্দিনের ভাই তুরান শাহর অধীনে তাদের সাহায্য পাঠানো হয়। এরপর নুবিয়ানরা চলে যায় কিন্তু ১১৭৩ সালে আবার ফিরে আসে তবে আবার তাদের ফিরিয়ে দেয়া হয়। এসময় মিশরীয় সেনারা আসওয়ান থেকে অগ্রসর হয় এবং নুবিয়ার শহর ইবরিম অধিকার করে। সালাহুদ্দিন তার শিক্ষক ও বন্ধু নুরউদ্দিনকে ৬০,০০০ দিনার, চমৎকার প্রণ্য, কিছু রত্ন, উৎকৃষ্ট জাতের গাধা এবং একটি হাতি উপহার হিসেবে পাঠান। এসব দামেস্কে পাঠানর সময় সালাহুদ্দিন ক্রুসেডার এলাকা আক্রমণের সুযোগ পান। তিনি মরুভূমির দুর্গের উপর আক্রমণ চালাননি। কিন্তু ক্রুসেডার অঞ্চলে বসবাসরত মুসলিম বেদুইনদের সেখান থেকে সরিয়ে আনেন যাতে ফ্রাঙ্করা গাইড থেকে বঞ্চিত হয়।[৩৩]
১১৭৩ সালের ৩১ জুলাই সালাহুদ্দিনের পিতা একটি ঘোড়া দুর্ঘটনায় আহত হন। ৯ আগস্ট তিনি মারা যান।[৩৪] ১১৭৪ সালে সালাহুদ্দিন তুরান শাহকে ইয়েমেন জয় ও এর এডেন বন্দর আইয়ুবী শাসনের অন্তর্গত করার জন্য পাঠান।
১১৭৪ সালের মার্চে নুরউদ্দিন একটি ভূমিকম্পের পর বাগদাদে ফিরে আসেন। অনেক ঐতিহাসিকের মতে এটি ছিল ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ ভূমিকম্প। নুরউদ্দিন শাসক হিসেবে বিপর্যয়ের খবর শোনার পর ফিরে আসেন। তার কিছু শত্রু তার অনুপস্থিতির সুযোগ নিতে থাকে যা তার ফিরে আসায় প্রভাব ফেলেছে। পরবর্তী সপ্তাহগুলোতে তার সমস্ত মনোযোগ জনগণের উপর ছিল,যার ফলে তিনি বিশ্বাসঘাতক ও হাসান সাব্বাহর দল যাদেরকে ক্রুসেডাররা সমর্থন করত, তাদের কাছ থেকে তার প্রতি হুমকির কথা উপেক্ষা করেন। ১১৭৪ সালের এপ্রিলের শেষের দিকে বিষপ্রয়োগের ফলে গলায় ব্যথা অনুভব করার পর থেকে সমস্যার প্রথম সূত্র পাওয়া যায়। তার চিকিৎসকদের অনেক প্রচেষ্টার পরও নুরউদ্দিন ১১৭৪ সালের ১৫ মে মৃত্যুবরণ করেন। কিছু শক্তিশালী অভিজাত ব্যক্তির দল নুরউদ্দিনের ক্ষমতা তার এগারো বছর বয়সী পুত্র আস সালিহ ইসমাইল আল মালিকের উপর অর্পণ করেন। তার মৃত্যুর ফলে সালাহুদ্দিন ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে তার শক্তিশালী মিত্র হারিয়ে ফেলেন। সালিহর কাছে লেখা চিঠিতে তিনি জানান যে তিনি তার শত্রুদের বিরুদ্ধে লড়াই করবেন এমনকি তারা যদি মুসলিম দাবিও করে ; যদিনা তিনি ও তার সমর্থকরা নুরউদ্দিনের নীতির বিরুদ্ধে গিয়ে ক্রুসেডারদের সাথে মিত্রতা থেকে বিরত থাকেন।
নুরউদ্দিনের মৃত্যুর পর সালাহুদ্দিন কঠিন সিদ্ধান্তের মুখোমুখি হন। তিনি মিশর থেকে ক্রুসেডারদের উপর আক্রমণ করতে পারতেন , অথবা সিরিয়ায় সালিহর কাছ থেকে আমন্ত্রণ লাভ করার আগ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারতেন। এছাড়াও বিদ্রোহীদের হাতে পড়ার আগেই তিনি সিরিয়াকে তার শাসনের অংশে পরিণত করতে পারতেন। কিন্তু ইতঃপূর্বে তার আমীরের অধীন অঞ্চলে হামলা করলে তা তার অনুসৃত ইসলামি বিধানের লঙ্ঘন হতে পারে এবং এই ঘটনা তাকে একজন প্রতারক হিসেবে তুলে ধরতে পারে যা ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বাধা তৈরি করবে এমন আশঙ্কা করেন। তিনি দেখতে পান যে সিরিয়া অধিকার করার জন্য তাকে হয় সালিহর কাছ থেকে আমন্ত্রণ পেতে হবে বা তাকে সাবধান করতে হবে যে ক্রমবর্ধমান নৈরাজ্য ক্রুসেডারদের তরফ থেকে হামলার আশঙ্কা তৈরী করবে।[৩৫]
সালিহ যখন আগস্টে আলেপ্পোতে চলে যান তখন শহরের আমির ও নুরউদ্দিনের দক্ষ সেনাদের প্রধান গুমুশতিগিন তার উপর অভিভাবকত্ব দাবি করেন। তিনি দামেস্ক থেকে শুরু করে সিরিয়া ও জাজিরাতে তার সকল বিরোধীকে পদচ্যুত করার প্রস্তুতি নেন। এই জরুরি অবস্থায় দামেস্কের আমির মসুলের দ্বিতীয় সাইফউদ্দিন গাজিকে সাহায্য চেয়ে বার্তা পাঠান। কিন্তু তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। এর ফলে সালাহুদ্দিনের কাছে সাহায্য চাওয়া হয় এবং তিনি তা প্রদান করেন।[৩৬][৩৭] সালাহুদ্দিন ৭০০ বর্শাধারী ঘোড়সওয়ার নিয়ে যাত্রা করেন। কেরাক পার হয়ে তিনি বুসরা পৌছান। তার বর্ণনা অনুযায়ী “এখানে আমির, সৈনিক ও বেদুইনরা তার সাথে যোগ দেয় এবং তাদের অন্তরের অনুভূতি তাদের চেহারায় ফুটে উঠে।“ ২৩ নভেম্বর তিনি দামেস্কে ফিরে আসেন। দামেস্কের দুর্গে প্রবেশের আগ পর্যন্ত তিনি তার পিতার পুরনো বাসগৃহে অবস্থান নেন। চারদিন পর দুর্গ উন্মুক্ত হয়। তিনি এরপর দুর্গে অবস্থান নেন এবং নাগরিক আতিথেয়তা গ্রহণ করেন।[৩৬]
ভাই তুগতিগিনকে দামেস্কের গভর্নর হিসেবে রেখে সালাহুদ্দিন পূর্বে নুরউদ্দিনের অধিকারে থাকা আংশিক স্বাধীন শহরসমূহের দিকে রওনা দেন। তার সেনাবাহিনী হামা সহজে দখল করে নেয়। তবে তারা দুর্গের ক্ষমতার জন্য হিমস আক্রমণ এড়িয়ে যান।[৩৮] সালাহুদ্দিন উত্তরে আলেপ্পোর দিকে যাত্রা করেন। গুমুশতিগিন ক্ষমতাত্যাগে অস্বীকৃতি জানালে ৩০ ডিসেম্বর তা অবরোধ করা হয়।[৩৯] সালাহুদ্দিনের কাছে বন্দী হতে পারে ভেবে সালিহ প্রাসাদের বাইরে এসে অধিবাসীদের কাছে আবেদন জানায় যাতে তারা আত্মসমর্পণ না করে। সালাহুদ্দিনের একজন বর্ণনা লেখকের মতানুযায়ী "জনতা তার কথার জাদুতে চলে আসে।"[৪০]
সেসময় সিরিয়ায় হাশাশিনদের প্রধান ছিলেন রশিদউদ্দিন সিনান ফাতেমীয় খিলাফত উচ্ছেদ করার কারণে সালাহুদ্দিনের প্রতি বিরূপ ছিলেন। গুমুশতিগিন তাকে অনুরোধ করেন যাতে সালাহুদ্দিনকে তার ক্যাম্পে হত্যা করা হয়।[৪১] ১১৭৫ সালের ১১ মে তেরজন হাশাশিনের একটি দল সালাহুদ্দিনের ক্যাম্পে সহজে প্রবেশ করে কিন্তু আবু কুবাইসের নসিহউদ্দিন খুমারতেকিন কর্তৃক চিহ্নিত হয়ে পড়ে। সালাহুদ্দিনের একজন সেনাপতির হাতে একজনের মৃত্যু হয় এবং অন্যান্যদের পালানোর সময় হত্যা করা হয়।[৪০][৪২][৪৩] সালাহুদ্দিনের অগ্রগতি প্রতিহত করার জন্য তৃতীয় রেমন্ড নহরুল কবিরের কাছে তার সেনাদের সমবেত করেন। মুসলিম অঞ্চল আক্রমণের জন্য এটি তাদের কাছে উপযুক্ত ছিল। সালাহুদ্দিনের এরপর হোমসের দিকে যাত্রা করেন। কিন্তু শহরের দিকে সাইফউদ্দিনের কাছ থেকে একটি সাহায্যকারী বাহিনী পাঠানো হয়েছে শুনে ফিরে আসেন।[৪৪]
ইতিমধ্যে সিরিয়া ও জাজিরায় সালাহুদ্দিনের প্রতিপক্ষরা তার বিরুদ্ধে প্রপাগান্ডা যুদ্ধ শুরু করেন। তারা দাবি করতে থাকে সালাহুদ্দিন তার নিজের অবস্থা (নুরউদ্দিনের অধীনস্থ) ভুলে গেছেন এবং সাবেক প্রভুর সন্তানকে অবরোধ করে তার প্রতি কোনো সম্মান দেখাচ্ছেন না। সালাহুদ্দিন অবরোধ তুলে নিয়ে প্রপাগান্ডা শেষ করার লক্ষ্য স্থির করেন। তিনি দাবি করেন যে তিনি ক্রুসেডারদের কাছ থেকে ইসলামকে রক্ষা করছেন। তার সেনারা হামা ফিরে এসে সেখানকার ক্রুসেডার সেনাদের মুখোমুখি হয়। ক্রুসেডাররা এখান থেকে ফিরে যায়। সালাহুদ্দিন ঘোষণা করেন যে এটি "মানুষের অন্তরের দরজা উন্মুক্তকারী বিজয়"।[৪৪] এরপর শীঘ্রই ১১৭৫ সালের মার্চে তিনি হিমস প্রবেশ করেন এবং এর দুর্গ অধিকার করেন।[৪৫]
সালাহুদ্দিনের সাফল্য সাইফউদ্দিনকে সতর্ক করে তোলে। জেনগিদের প্রধান হিসেবে তিনি সিরিয়া ও মেসোপটেমিয়াকে তার পরিবারের বলে বিবেচনা করতেন এবং সালাহুদ্দিন কর্তৃক তার বংশের অধিকৃত স্থান দখল করায় রাগান্বিত হয়ে পড়েন। সাইফউদ্দিন একটি বড় আকারের সেনাদল গঠন করে আলেপ্পোর দিকে পাঠান। আলেপ্পোর প্রতিরোধকারীরা এর আশঙ্কায় ছিল। মসুল ও আলেপ্পোর যৌথ বাহিনী হামায় সালাহুদ্দিনের বিরুদ্ধে অগ্রসর হয়। প্রথমে সালাহুদ্দিন দামেস্ক প্রদেশের উত্তর দিকের সমস্ত বিজিত এলাকা ত্যাগ করার মাধ্যমে জেনগিদের সন্ধি করতে চেষ্টা করেন। কিন্তু তারা তা প্রত্যাখ্যান করে এবং তাকে মিশর ফিরে যেতে বলা হয়। সংঘর্ষ অনিবার্য দেখতে পেয়ে সালাহুদ্দিন যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হন। যুদ্ধে সালাহুদ্দিনের বাহিনী বিজয়ী হয়। এ বিজয়ের ফলে সালিহর উপদেষ্টারা সালাহুদ্দিনকে দামেস্ক, হিমস ও হামা এবং আলেপ্পোর বাইরের কিছু শহরে সালাহুদ্দিনের নিয়ন্ত্রণ মেনে নিতে বাধ্য হয়। [৪৬]
জেনগিদের বিরুদ্ধে বিজয়ের পর সালাহুদ্দিন নিজেকে রাজা ঘোষণা করেন। সালিহর নাম জুমার খুতবা ও মুদ্রা থেকে বাদ দেয়া হয়। বাগদাদের আব্বাসীয় খলিফা সালাহুদ্দিনের ক্ষমতাপ্রাপ্তিকে স্বাগত জানান এবং তাকে মিশর ও সিরিয়ার সুলতান হিসেবে ঘোষণা করেন। আইয়ুবী ও জেনগিদের মধ্যে ক্ষমতার লড়াই হামার যুদ্ধের পর শেষ হয়ে যায়নি। সাইফউদ্দিন ক্ষুদ্র রাজ্য দিয়ারবাকির ও জাজিরা থেকে সেনা সংগ্রহ করার সময় সালাহুদ্দিন মিশর থেকে ব্যাপক সেনা সমাবেশ করেন।[৪৭] তিনি আলেপ্পো থেকে ২৫ কিমি দূরে তিল সুলতানে পৌছান এবং সেখানে সাইফউদ্দিনের সেনাদের সাথে লড়াই হয়। জেনগিরা সালাহুদ্দিনের বাহিনীর বাম অংশকে ভেঙে ফেলতে সক্ষম হয়। এসময় সালাহুদ্দিন জেনগিদের প্রধান অংশকে আক্রমণ করেন। জেনগি সেনারা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। সাইফউদ্দিনের অধিকাংশ অফিসাররা নিহত বা বন্দী হয়। সাইফউদ্দিন পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। জেনগি সেনা ক্যাম্প, ঘোড়া, মালামাল, তাবু ইত্যাদি আইয়ুবীদের হস্তগত হয়। যুদ্ধবন্দীদের মুক্তি দেয়া হয়। যুদ্ধলব্ধ সম্পদ সেনাদের মধ্যে বিলিয়ে দেয়া হয়। তবে সালাহুদ্দিন নিজের জন্য কিছু রাখেননি।[৪৮]
তিনি আল্লেপোর দিএক এগিয়ে যান। যাত্রাপথে তার সেনারা বুজা ও এরপর মানবিজ অধিকার করে। এখান থেকে তারা পশ্চিমে আজাজ দুর্গ অবরোধের জন্য এগিয়ে যায়। কয়েকদিন পর সালাহুদ্দিন তার এক সেনাপতির তাবুতে বিশ্রাম নেয়ার সময় এক হাশাশিন তাকে ছুরি দিয়ে মাথায় আক্রমণ করেন। তার শিরস্ত্রাণের ফলে হামলা সফল হয়নি। তিনি হামলাকারীকে ধরে ফেলেন। আততায়ীকে হত্যা করা হয়। এ ঘটনার জন্য তিনি গুমুশতিগিনকে দায়ী করেন এবং অবরোধে শক্তিবৃদ্ধি করেন।[৪৯]
২১ জুন আজাজ অধিকৃত হয়। গুমুশতিগিনকে মোকাবেলা করার জন্য সালাহউদ্দদিন তার সেনাদেরকে আলেপ্পোর দিকে পাঠান। তার হামলা এবারও প্রতিহত করা হয়। তিনি একটি সন্ধি ও আলেপ্পোর সাথে পারস্পরিক মিত্রতা স্থাপন করা হয়। এতে গুমুশতিগিন ও সালিহকে শহরে নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতে হয় এবং বিনিময়ে তারা সালাহুদ্দিনকে তার অধিকৃত সকল এলাকায় সার্বভৌম হিসেবে মেনে নেয়। মারদিন ও কাইফার আমিররা সালাহুদ্দিনকে সিরিয়ার রাজা হিসেবে মেনে নেয়।
সালাহুদ্দিন তার প্রতিপক্ষ জেনগি ও জেরুজালেম রাজ্যের (১১৭৫ এর গ্রীষ্মে অধিকার করে নেয়া হয়) সাথে চুক্তিতে আসলেও রশিদউদ্দিন সিনানের নেতৃত্বাধীন হাশাশিনদের হুমকির সম্মুখীন হন। নুসাইরিয়া পর্বতমালায় তাদের ঘাঁটি ছিল। তারা নয়টি দুর্গ নিয়ন্ত্রণ করত। এগুলো সবই উচ্চভূমিতে অবস্থিত ছিল। সালাহুদ্দিন ১১৭৬ সালের আগস্টে নুসাইরিয়া রেঞ্জে তার সেনাবাহিনীকে নিয়ে যান। একই মাসে ব্যর্থ হয়ে পিছু হটতে হয়। অধিকাংশ মুসলিম ইতিহাসবিদদের মতে সালাহুদ্দিনের চাচা, হামার গভর্নর সিনান ও সালাহুদ্দিনের মধ্যে শান্তিচুক্তির মধ্যস্থতা করেন।[৫০][৫১]
হাশাশিনদের গুপ্ত ঘাঁটি আক্রমণ করলে তারা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। তিনি তার রক্ষীদের সংযোগ আলো সরবরাহ করেন এবং তার তাবুর চারপাশে খড়ি ও কয়লা ছিটিয়ে দেয়া হয় যাতে হাশাশিনদের পদচিহ্ন শনাক্ত করা যায়।[৫২] এই বিবরণ অনুযায়ী, একরাতে সালাহুদ্দিনের রক্ষীরা মাসাইফ পাহাড়ে আলোর স্ফুলিংগ দেখতে পায় এবং তা আইয়ুবী তাবুর মধ্যে হারিয়ে যায়। এসময় সালাহুদ্দিন জেগে উঠে কাউকে তার তাবু থেকে বের হয়ে যেতে দেখতে পান। তার বিছানার পাশে বিষাক্ত ছুরির সাথে গেথে দেয়া একটি বার্তা পাওয়া যায়। এতে লেখা ছিল যে তিনি যদি তার এই অভিযান বন্ধ না করেন তবে এজন্য তার মৃত্যু হতে পারে। সালাহুদ্দিন চিৎকার দিয়ে উঠেন এবং দাবি করেন সিনান নিজেই তার তাবুতে এসেছিল।[৫২]
অন্য একটি বিবরণ অনুযায়ী সালাহুদ্দিন তার সেনাদের সরিয়ে নিয়েছিলেন কারণ লেবানন পর্বতের কাছে একটি ক্রুসেডার দলকে প্রতিহত করা জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় ছিল।[৫১] হাশাশিনরা তার সাথে একপ্রকার মিত্রতা স্থাপন করতে চায়। ক্রুসেডারদের বিতাড়নে পারস্পরিক লাভ আছে বিবেচনা করে সালাহুদ্দিন ও সিনান এরপর সহযোগীতার সম্পর্ক বজায় রাখেন এবং সালাহুদ্দিনের সেনাদের শক্তিবৃদ্ধির জন্য কিছু লড়াইয়ে সিনান সেনাসরবরাহ করেন।[৫৩]
নুসাইরিয়া পর্বত ত্যাগের পর সালাহুদ্দিন দামেস্কে ফিরে আসেন। তার সিরিয়ান সেনারা বাড়ি ফিরে যায়। তিনি তুরান শাহকে সিরিয়ার দায়িত্ব দেন এবং ব্যক্তিগত লোকদের নিয়ে মিশরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। ২২ সেপ্টেম্বর তিনি কায়রো পৌছান। দুই বছর অনুপস্থিত থাকার পর ফিরে আসায় মিশরকে সংগঠিত ও তদারক করার জন্য তার সময় ব্যয় করতে হয়। শহরের প্রতিরক্ষা মজবুত করা হয়। শহরের দেয়াল সংস্কার করা হয় এবং বর্ধিত অংশ তৈরী করা হয়। এসময় কায়রো দুর্গের নির্মাণ শুরু করা হয়।[৫৪] ২৮০ ফুট (৮৫ মি) গভীর বির ইউসুফ (“ইউসুফের কুয়া”) সালাহুদ্দিনের নির্দেশে খনন করা হয়। কায়রোর বাইরে নির্মিত প্রধান স্থাপনা ছিল গিজার বড় সেতু। মুরিশ আক্রমণ ঠেকাতে প্রতিরক্ষার অংশ হিসেবে এটি নির্মিত হয়েছিল।[৫৫]
সালাহুদ্দিন কায়রোর উন্নয়ন সাধন করেন। এখানে তলোয়ার প্রস্তুতকারকদের শিক্ষালয় স্থাপন করা হয় এবং রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ প্রশাসনিক আদেশ এখান থেকে দেয়া হত। ১১৭৭ সালের নভেম্বরে তিনি ফিলিস্তিনে আক্রমণ পরিচালনা করেন। ক্রুসেডাররা সম্প্রতি দামেস্কের অঞ্চলের ভেতর আক্রমণ চালায়। ফলে সালাহুদ্দিন চুক্তি আর বলবত নেই ধরে নেন। আলেপ্পোর উত্তরে হারিমের দুর্গ দখলের জন্য ক্রুসেডাররা বড় আকারের একটি সেনাবাহিনী প্রেরণ করেন। ফলে দক্ষিণ ফিলিস্তিনে কম সংখ্যক প্রতিরক্ষাকারী অবস্থান করছিল।[৫৫] সালাহুদ্দিন অবস্থা অনুকূল বিবেচনা করেন আসকালন যাত্রা করেন। একে তিনি “সিরিয়ার বধু” বলতেন। উইলিয়াম অব টায়ারের বিবরণ অনুয়ায়ী আইয়ুবী সেনাবাহিনীতে মোট ২৬০০০ সেনা ছিল আদের ৮,০০০ ছিল বিশেষ সৈনিক আর ১৮,০০০ সুদানের কালো সৈনিক। সেনাবাহিনী গ্রামাঞ্চলের দিকে এগিয়ে গিয়ে রামলা ও লুদ আক্রমণ করে এবং তাদের জেরুজালেমের ফটক পরন্ত তাড়িয়ে নেয়।[৫৬]
আইয়ুবীরা রাজা বল্ডউইনকে তার গাজা ভিত্তিক টেম্পলারদের নিয়ে আসকালনে প্রবেশ করতে দেয়। ক্রুসেডার বাহিনী শুধু ৩৭৫জন নাইট নিয়ে গঠিত হলেও সালাহুদ্দিন দক্ষ সেনাপতিদের উপস্থিতির জন্য আক্রমণ থেকে বিরত থাকেন। ২৫ নভেম্বর আইয়ুবী সেনাবাহিনীর বৃহৎ অংশ অনুপস্থিত থাকায় মন্টগিজার্ডের যুদ্ধে সালাহুদ্দিন ও তার সেনারা রামলার কাছে অতর্কিত আক্রমণের সম্মুখীন হন। সেনারা অবস্থান গঠনের আগে টেম্পলাররা আইয়ুবী সেনাদের উপর ঝাপিয়ে পড়ে। প্রাথমিকভাবে সালাহুদ্দিন তার সেনাদের সুসংগঠিত করতে সচেষ্ট হন। কিন্তু তার পরবর্তীকালে পরাজয় অনিবার্য হয়ে উঠায় তিনি সেনাদের নিয়ে মিশর ফিরে আসেন। [৫৭]
যুদ্ধে পরাজয়ে দমে না গিয়ে সালাহুদ্দিন পুনরায় ক্রুসেডারদের সাথে লড়াইয়ের প্রস্তুতি নেন। ১১৭৮ সালের বসন্তে তিনি হোমসের দেয়ালের কাছে ঘাঁটি স্থাপন করেন এবং তার সেনাপতিদের সাথে ক্রুসেডার সেনাদের কিছু খন্ডযুদ্ধ সংঘটিত হয়। হামায় তার বাহিনী জয়লাভ করে এবং অনেক শত্রুসেনা বন্দী হয়। বিশৃংখলা সৃষ্টির দায়ে তাদের শিরোচ্ছেদের আদেশ দেয়া হয়। বছরের বাকি সময় তিনি সিরিয়ায় শত্রুদের সাথে লড়াই না করে অবস্থান করেন।[৫৮]
সালাহুদ্দিনের গোয়েন্দারা তাকে জানায় যে ক্রুসেডাররা সিরিয়া আক্রমণের পরিকল্পনা করছে। তিনি তার সেনাপতি ফররুখশাহকে তার এক হাজার সেনা নিয়ে দামেস্কের সীমানায় কোনো আক্রমণ হচ্ছে কিনা তা দেখার জন্য পাহারা দেয়ার নির্দেশ দেন এবং যুদ্ধ এড়িয়ে ফিরে আসতে বলেন। তাকে বলা হয় এরপর পাহাড়ের উপর মশাল জ্বালানোর জন্য যাতে সালাহুদ্দিন এরপর অগ্রসর হতে পারেন। ১১৭৯ সালের এপ্রিলে বল্ডউইনের নেতৃত্বাধীন ক্রুসেডাররা কোনো প্রতিরোধ হবে না ধরে রাখে এবং গোলান মালভূমির পূর্বে মুসলিম পশুপালকদের উপর আচমকা হামলা চালানোর অপেক্ষায় থাকে। ফররুখশাহর বাহিনীর উদ্দেশ্যে বল্ডউইন খুব দ্রুত যাত্রা করেন। তাদের মধ্যে সংঘটিত লড়াইয়ে আইয়ুবীরা জয়ী হয়। এ বিজয়ের পর সালাহুদ্দিন মিশর থেকে আরো সেনা আনার পরিকল্পনা করেন। তিনি আল আদিলকে ১৫০০ ঘোড়সওয়ার পাঠাতে বলেন।[৫৯]
১১৭৯ সালের গ্রীষ্মে রাজা বন্ডউইন দামেস্কের দিকের পথে একটি চৌকি স্থাপন করেন এবং জর্ডান নদীর দিকের পথ সুরক্ষিত করতে চান। সালাহুদ্দিন ১,০০,০০০ স্বর্ণমুদ্রার বিনিময়ে এই কাজ বন্ধের জন্য বল্ডউইনকে প্রস্তাব দেন। কিন্তু এতে সাড়া মেলেনি। এরপর তিনি টেম্পলারদের অবস্থান করা চেস্টেলেট নামক দুর্গ ধ্বংস করতে উদ্যত হন। ক্রুসেডাররা দ্রুত মুসলিমদের আক্রমণ করতে এগিয়ে আসলে বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ে। তাদের পদাতিকরা পিছিয়ে পড়ে। তারা প্রাথমিক সাফল্য লাভ করলেও সালাহুদ্দিন পরে সফল হন এবং তার সেনারা ক্রুসেডারদের আক্রমণ করে। যুদ্ধে আইয়ুবীরা জয়ী হয়। অনেক উচ্চপদস্থ নাইট গ্রেপ্তার হয়। সালাহুদ্দিন এরপর দুর্গ দখলের জন্য যাত্রা করেন। ১১৭৯ সালের ৩০ এপ্রিল এটির পতন হয়।[৬০]
১১৮০ সালের বসন্তে সালাহুদ্দিন সাফাদ অঞ্চলে অবস্থান করার সময় জেরুজালেমের ক্রুসেডার রাজ্যের বিরুদ্ধে একটি ব্যাপক আকারের অভিযান চালানোর ব্যাপারে চিন্তিত ছিলেন। বল্ডউইন তার কাছে শান্তিপ্রস্তাব পাঠান। খরা ও ফসল কম থাকায় সালাহুদ্দিন চুক্তিতে উপনীত হন। রেমন্ড অব ট্রিপলি এই চুক্তির বিরোধীতা করলেও পরে তার এলাকায় আইয়ুবী সেনাদের এক অভিযান ও টারটুস বন্দরে সালাহুদ্দিনের নৌবহর উপস্থিত হওয়ার পর তা মানতে রাজি হন।[৬১]
১১৮০ সালের জুনে কেইফার অরতুকি আমির নুরউদ্দিন মুহাম্মদের জন্য সালাহুদ্দিন একটি অভ্যর্থনার আয়োজন করেন। এতে তাকে ও তার ভাই আবু বকরকে ১,০০,০০০ দিনার মূল্যের উপহার দেয়া হয়। অরতুকি আমিরদের সাথে মিত্রতা স্থাপন এবং মেসোপটেমিয়া ও আনাতোলিয়ার আমিরদের প্রভাবিত করা এর উদ্দেশ্য ছিল। পূর্বে সালাহুদ্দিন নুরউদ্দিন ও সেলজুক সুলতান দ্বিতীয় খিলজি আরসালান যুদ্ধের মুখোমুখি হলে তাদের মধ্যে সমঝোতা করান। খিলজি আরসালান দাবি করেন যে তার মেয়েকে বিয়ে করার মোহর হিসেবে নুরউদ্দিন তাকে দেয়া এলাকা ফিরিয়ে দেবেন। আরসালান সংবাদ পেয়েছিলেন যে তার মেয়েকে অপমান করা হয়েছে এবং সেলজুক অঞ্চল লাভের জন্য তাকে ব্যবহার করা হচ্ছে। নুরউদ্দিন সালাহুদ্দিনকে এই ব্যাপার মধ্যস্থতা করার অনুরোধ জানান। তবে আরসালান তা প্রত্যাখ্যান করেন।[৬২]
নুরউদ্দিন এবং সালাহুদ্দিন গেইক সুতে সাক্ষাত করার পর শীর্ষ সেলজুক আমির আল দীন আল হাসান আরসালানের মেনে নেয়ার সংবাদ নিশ্চিত করেন। এরপর একটি চুক্তি হয়। সালাহুদ্দিন পরবর্তীকালে আরসালানের কাছ থেকে জানতে পারেন যে নুরউদ্দিন তার মেয়েকে আরো অপমান করছে। এতে সালাহুদ্দিন ক্ষিপ্ত হন। তিনি মালাতয়া আক্রমণের হুমকি দেন। হুমকির পর সেলজুকরা আলোচনার জন্য চাপ দেয়। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হয় যে আরসালানের কন্যাকে এক বছরের জন্য পাঠিয়ে দেয়া হবে এবং যদি নুরউদ্দিন শর্ত মানতে ব্যর্থ হয় তবে সালাহুদ্দিন তার সমর্থন প্রত্যাহার করবেন।[৬২]
ফররুখশাহকে সিরিয়ার দায়িত্বে রেখে ১১৮১ সালের শুরুতে সালাহুদ্দিন কায়রোতে ফিরে আসেন। আবু শামার বর্ণনা অনুযায়ী তিনি মিশরে রমজানের রোজা রাখতে চাইছিলেন এবং গ্রীষ্মে হজের জন্য মক্কায় যেতে চাইছিলেন। অজ্ঞাত কারণে তিনি তার পরিকল্পনা বদলান এবং জুন মাসের দিকে নীল নদের অঞ্চলে পরিদর্শনে বের হন। এখানে তিনি পুনরায় বেদুইনদের সাথে কঠিন অবস্থার মুখোমুখি হন। তিনি তাদের দুই তৃতীয়াংশ জায়গির অপসারণ করেন যাতে ফায়ুমের জায়গিরদের ক্ষতিপূরণ দেয়া যায়। এছাড়াও বেদুইনরা ক্রুসেডারদের সাথে ব্যবসা করার দায়ে অভিযুক্ত ছিল। শস্য বাজেয়াপ্ত করা হয় এবং তাদেরকে পশ্চিমে বসতি সরিয়ে নিতে বাধ্য করা হয়। পরবর্তীতে আইয়ুবী যুদ্ধজাহাজ নদীপথে বেদুইন জলদস্যুদের উপর আক্রমণ করে।[৬৩]
১১৮১ সালের জুনে সাইফউদ্দিন মারা যাওয়ার পর তার ভাই ইজ্জউদ্দিন মসুলের নেতৃত্ব লাভ করেন।[৬৪] ডিসেম্বরের ৪ তারিখ জেনগি যুবরাজ আস সালিহ আলেপ্পোতে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর পূর্বে তিনি তার প্রধান কর্মকর্তাকে শপথ করান যে তিনি ইজ্জউদ্দিনের প্রতি অনুগত থাকবেন কারণ তিনি ছিলেন সালাহুদ্দিনকে প্রতিহত করতে পারার মত একমাত্র জেনগি শাসক। ইজ্জউদ্দিনকে আলেপ্পোয় স্বাগত জানানো হয়। তিনি তার ভাই ইমাদউদ্দিন জেনগির উপর সিনজারের বিনিময়ে আলেপ্পোর ভার অর্পণ করেন। জেনগিদের সাথে করা পূর্বের চুক্তির কারণে সালাহুদ্দিন এসকল আদানপ্রদানে কোনো হস্তক্ষেপ করেননি।[৬৫]
১১৮২ সালের ১১ মে সালাহুদ্দিন তার অর্ধেক মিশরীয় আইয়ুবী সেনা ও বেশ সংখ্যক বেসামরিক লোক নিয়ে সিরিয়ার উদ্দেশ্যে কায়রো ত্যাগ করেন। সালাহুদ্দিন একে অশুভ মনে করেন। এরপর তিনি আর মিশরে আসেননি।[৬৪] ক্রুসেডাররা তার মোকাবেলা করার জন্য সীমান্তে সমবেত হয়েছে জানতে পেরে তিনি সিনাই উপদ্বীপের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যান।[৬৬] জুনে তিনি দামেস্কে পৌছে জানতে পারেন যে ফররুখশাহ গেলিলি আক্রমণ করেছেন। জুলাই মাসে সালাহুদ্দিন ফরুরখশাহকে কাওকাব আল হাওয়া আক্রমণ করতে পাঠান। পরে আগস্টে আইয়ুবীরা বৈরুত জয়ের জন্য নৌ ও স্থল আক্রমণ চালায়। এই অভিযান ব্যর্থ হয়। সালাহুদ্দিন তা পরিত্যাগ করেন এবং মেসোপটেমিয়ার দিকে নজর দেন।[৬৭]
হারানের আমির কুকবারি সালাহুদ্দিনকে জাজিরা অঞ্চল অধিকারের জন্য আমন্ত্রণ জানান। এটি মেসোপটেমিয়ার উত্তর অংশ ছিল। জেনগিদের সাথে তার চুক্তি ১১৮২ সালের সেপ্টেম্বরে শেষ হয়ে যায়।[৬৮] জাজিরায় তার অগ্রসর হওয়ার পূর্বে এখানের জেনগি শাসকদের মধ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধি পেয়েছিল।[৬৯] সালাহুদ্দিন ইউফ্রেটিস নদী অতিক্রম করার পূর্বে তিন দিন ধরে আলেপ্পো অবরোধ করার মাধ্যমে চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার ইঙ্গিত দেন।[৬৮]
বিরা পৌছার পর নদীর কাছে সালাহুদ্দিনের সাথে কুকবারি ও হিসান কাইফার নুরউদ্দিন যুক্ত হন। এই যৌথ বাহিনী জাজিরার শহরগুলো জয় করে নেয়। প্রথম এডেসা, এরপর সারুজ, রাকা, কারকেসিয়া ও নুসাইবিন তাদের অধিকারে আসে।[৬৮] রাকা একটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল ছিল। এসময় এর দায়িত্বে ছিলেন কুতুবউদ্দিন ইনাল। ইতঃপূর্বে ১১৭৬ সালে তিনি সালাহুদ্দিনের কাছে মানবিজ হারিয়েছিলেন। সালাহুদ্দিনের বিশাল সেনাবাহিনী দেখে তিনি প্রতিরোধের তেমন চেষ্টা করেননি এবং তাকে তার সম্পদ ধরে রাখার অধিকার দেয়া হবে এই শর্তে আত্মসমর্পণ করেন। বেশ কিছু কর বাতিল করে শহরের অধিবাসীদের উপর প্রভাব ফেলেন, কোষাগারের নথি থেকে সেগুলো মুছে ফেলা হয় এবং বলা হয় যে “সবচেয়ে খারাপ শাসক হল তারা যাদের নিজেদের টাকার থলে পূর্ণ থাকে আর জনগণ থাকে দুর্বল।“ রাকা থেকে তিনি আল ফুদাইন, আল হুসাইন, মাকসিম, দুরাইন, আরাবান ও খাবুর জয়ের জন্য এগিয়ে যান। এসব অঞ্চল তার প্রতি আনুগত্য স্বীকার করে।[৭০]
সালাহুদ্দিন নুসায়বিনের দিকে এগিয়ে যান। এই অঞ্চল কোনো বাধা প্রদর্শন করেনি। মাঝারি আকারের শহর হিসেবে নুসায়বিন তেমন গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। কিন্তু মারদিন ও মসুলের মধ্যে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত স্থান ছিল এবং দিয়ারবাকিরে সহজে পৌছানো যেত।[৭১] এসব বিজয়ের মাঝে সালাহুদ্দিন সবগ্নাদ পান যে ক্রুসেডাররা দামেস্কের গ্রামগুলোতে আক্রমণ চালাচ্ছে। ইতোমধ্যে আলেপ্পোতে শহরের আমির জানগি উত্তর ও পূর্বে সালাহুদ্দিনের শহর যেমন বালিস, মানবিজ, সারুক, বুজা ও আল কারজাইনে আক্রমণ করেন। তিনি এমনকি আল আজাজে নিজের দুর্গ ধ্বংস করে দেন যাতে আইয়ুবীরা তা জয়ে করলে ব্যবহার করতে না পারে।[৭১]
সালাহুদ্দিন তার দৃষ্টি মসুল থেকে আলেপ্পোর দিকে সরিয়ে নেন এবং তার ভাই তাজুল মুলুককে তেল খালিদ দখলের জন্য পাঠান। এই শহরটি অবরোধ করা হয়। কিন্তু শহরের শাসক ১৭ মে সালাহুদ্দিন ব্যক্তিগতভাবে উপস্থিত হওয়ার পর আত্মসমর্পণ করেন। ইমাদউদ্দিনের মতে তেল খালিদের পর সালাহুদ্দিন উত্তরে আইন তাবের দিকে এগিয়ে অবস্থান নেন। ২১ মে তিনি শহরের বাইরে শিবির স্থাপন করেন এবং নিজে আলেপ্পো দুর্গের পূর্ব দিকে অবস্থান নেন। তার সেনারা বানাকুসার শহরতলি থেকে উত্তর পূর্বে এবং বাব জানান থেকে পশ্চিম দিকে অবস্থান নেয়। প্রাথমিক সাফল্যের জন্য তার সেনাবাহিনী খুব ঝুঁকিপূর্ণভাবে শহরের নিকট অবস্থান নেয়।[৭২]
জানগি দীর্ঘ সময় প্রতিরোধ করেননি। প্রজাদের মধ্যে তিনি অজনপ্রিয় ছিলেন। তিনি সিনজারে ফেরার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। এই শহর তিনি পূর্বে শাসন করতেন। সালাহুদ্দিনের সাথে তার আলোচনায় সিদ্ধান্ত হয় যে তিনি আলেপ্পোকে সালাহুদ্দিনের হাতে তুলে দেবেন এবং বিনিময়ে তাকে সিনজার, নুসায়বিন ও রাকার নিয়ন্ত্রণ দেয়া হবে। জানগি এসব অঞ্চলকে সামরিক সহায়তার শর্তবলে সালাহুদ্দিনের অনুগত হিসেবে নিয়ন্ত্রণ করবেন। ১২ জুন আলেপ্পো আইয়ুবীদের হস্তান্তর করা হয়।[৭৩] আলেপ্পোর জনগণ এই আলোচনার ব্যাপারে অবগত ছিল না। ফলে দুর্গে সালাহুদ্দিনের পতাকা উত্তোলন করা হলে তারা আশ্চর্য হয়। সালাহুদ্দিনকে শহরে স্বাগত জানানো হয় এবং দুজন আমির যার মধ্যে একজন সালাহুদ্দিনের পুরনো বন্ধু ইজ্জউদ্দিন জুরুদুকও ছিলেন, তার প্রতি আনুগত্য জানান। সালাহুদ্দিন শহরের হানাফি আদালতের স্থলে শাফি আদালত স্থাপন করেন। জানগিকে দুর্গের গুদামের সম্পদ যা তিনি নিতে পারবেন তা নিয়ে যেতে দেয়া হয়। বাকি গুলো সালাহুদ্দিন কিনে নেন। সালাহুদ্দিনের জন্য আলেপ্পো জয় আট বছরের প্রতীক্ষার অবসান ছিল।[৭৪][৭৫]
আলেপ্পো দুর্গে এক রাত অবস্থান করার পর তিনি হারিমের দিকে অগ্রসর হয়। এটি ক্রুসেডারদের অবস্থানস্থল এন্টিওকের নিকটে ছিল। শহরটির শাসনকর্তা ছিলেন সুরহাক নামক একজন মামলুক। সালাহুদ্দিন হারিমের বদলে তাকে বুসরা শহর ও দামেস্কে সম্পত্তি প্রদানের প্রস্তাব করেন। কিন্তু সুরহাক আরো বেশি দাবি করলে তার নিজ গেরিসন তাকে পরিত্যাগ করেন। সালাহুদ্দিনের ডেপুটি তাকিউদ্দিন তাকে গ্রেপ্তার করেন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল যে তিনি হারিমকে এন্টিওকের তৃতীয় বোহেমন্ডের কাছে হস্তান্তরের পরিকল্পনা করছিলেন। হারিমের আত্মসমর্পণের পর সালাহুদ্দিন এর প্রতিরক্ষা মজবুত করেন। অগ্রসর হওয়ার পূর্বে তিনি বেশ কিছু প্রশাসনিক বিষয় নিষ্পত্তি করে যান। তিনি বোহেমন্ডের সাথে চুক্তিতে আসেন এবং এর বিনিময়ে তার কাছে বন্দী মুসলিমদের ফিরিয়ে দেয়া হয়। আলমউদ্দিন সুলায়মানের কাছে আজাজ ও সাইফউদ্দিন আল ইয়াজকুজের কাছে আলেপ্পোর দায়িত্ব প্রদান করা হয়।[৭৬]
সালাহুদ্দিন মসুলের দিকে অগ্রসর হওয়ার সাথে সাথে তাকে এত বড় শহর জয় ও এই কাজের যথার্থতার কথা চিন্তা করতে হয়।[৭৭] মসুলের জেনগিরা আব্বাসীয় খলিফা আন নাসিরের কাছে আবেদন নিয়ে যায়। নাসিরের উজির তাদের সমর্থন করেন। আন নাসির উচ্চ পদস্থ ধর্মীয় নেতা নাসির বদর আল বদরকে দুই পক্ষের মধ্যে মধ্যস্থতার জন্য পাঠান। সালাহুদ্দিন ১১৮২ সালের ১০ নভেম্বর শহরে পৌছান। ইজ্জউদ্দিন তার শর্ত স্বীকার করেননি। সালাহুদ্দিন এরপর শহর অবরোধ করেন।[৭৮]
কয়েকটি খন্ড লড়াই ও খলিফা কর্তৃক অবরোধে অচলাবস্থা সৃষ্টির পর সালাহুদ্দিন নিজ সম্মান হানি না করে ও সামরিক চাপ বজায় রেখে পেছনে সরে আসার ব্যাপারে চিন্তা করেন। তিনি সিনজার আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন। এটি ইজ্জউদ্দিনের ভাই শরফউদ্দিনের অধীনে ছিল। ১৫ দিন অবরোধের পর ৩০ ডিসেম্বর এর পতন হয়।[৭৯] সালাহুদ্দিনের কমান্ডার ও সৈনিকরা শৃঙ্খলা ভেঙে শহর লুট শুরু করে। সালাহুদ্দিন গভর্নর ও তার কর্মকর্তাদের সুরক্ষার জন্য মসুলে পাঠিয়ে দেন। সিনজারে গেরিসন প্রতিষ্ঠার পর তিনি ইজ্জউদ্দিন কর্তৃক গঠিত আলেপ্পো, মারদিন ও আর্মেনিয়ার বাহিনীর সম্মিলিত সেনাদলের অপেক্ষায় থাকেন।[৮০] সালাহুদ্দিন ও তার সেনাবাহিনী হারানে ১১৮৩ সালের ফেব্রুয়ারি এদের সাক্ষাত পান। কিন্তু তার অগ্রসর হওয়ার সংবাদ শুনে তারা শান্তি প্রস্তাব পাঠায়। প্রতিটি সেনাদল তাদের শহরে চলে যায়। আল ফাদিল লিখেছেন, "তারা (ইজ্জউদ্দিনের সম্মিলিত বাহিনী) পুরুষের মত এগিয়ে আসে, নারীদের মত গায়েব হয়ে যায়।"
২ মার্চ মিশর থেকে আল আদিল চিঠিতে সালাহুদ্দিনকে জানান যে ক্রুসেডাররা ইসলামের কেন্দ্রস্থলে আক্রমণ করেছে। রেনল্ড ডা শাটিলন আকাবা উপসাগরে লোহিত সাগর তীরের শহর ও গ্রাম আক্রমণের জন্য নৌবহর পাঠিয়েছিলেন। এটি সমুদ্রে প্রভাব বৃদ্ধি বা বাণিজ্য পথ দখলের প্রচেষ্টা ছিল না, বরং এক প্রকার দস্যুতা ছিল।[৮১] ইমাদউদ্দিন লিখেছেন যে এই আক্রমণ মুসলিমদের জন্য ভীতিকর ছিল কারণ তারা সমুদ্র পথে আক্রমণে অভ্যস্ত ছিল না। ইবনে আল আসিরের মতে স্থানীয় অধিবাসীদের ধারণা ছিল না যে ক্রুসেডাররা যোদ্ধা নাকি বণিক।[৮২]
ইবনে জুবায়ের বলেছেন যে ক্রুসেডাররা ষোলটি মুসলিম জাহাজ জালিয়ে দেয়। এরপর একটি হজ্জযাত্রীদের জাহাজ ও আইদাবে একটি ক্যারাভান দখল করা হয়। তিনি এও উল্লেখ করেছেন যে তাদের মদিনা আক্রমণের পরিকল্পনা ও মুহাম্মদ এর শরীর সরিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা ছিল। আল মাকরিজি যোগ করেন যে ক্রুসেডাররা তার মাজার ক্রুসেডার অঞ্চলে স্থানান্তরিত করতে চাইছিল যাতে মুসলিমদের সেখানে গিয়ে তা জেয়ারত করতে হয়। আল আদিল একজন আর্মেনীয় যোদ্ধা লুলুর মাধ্যমে ফুসতাত থেকে আলেক্সান্দ্রিয়ায় তার যুদ্ধজাহাজগুলো সরিয়ে নেন। তারা ক্রুসেডারদের বাধা অপসারণ করেন। তাদের অধিকাংশ জাহাজ ধ্বংস করা হয়। যারা নোঙর করে মরুভূমির দিকে পালিয়েছিল তাদের বন্দী করা হয়।[৮৩] বেঁচে যাওয়া ক্রুসেডারদের সংখ্যা ছিল ১৭০। সালাহুদ্দিন বিভিন্ন মুসলিম শহরে তাদের মৃত্যুদন্ডের আদেশ দেন।[৮৪]
সালাহুদ্দিনের দৃষ্টিকোণ থেকে মসুলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ভালো চলছিল কিন্তু এরপরও তিনি তার উদ্দেশ্য পূরণে ব্যর্থ হন। তাকিউদ্দিন তার সেনাদের হামায় ফিরিয়ে আনেন। নাসিরউদ্দিন মুহাম্মদ ও তার সেনারা ফিরে যায়। এসব ঘটনা ইজ্জউদ্দিন ও তার মিত্রদের পাল্টা আঘাতের সুযোগ করে দেয়। পুরনো জোট হারান থেকে ১৪০ কিমি দূরে হারজামে সংগঠিত হয়। এপ্রিলের প্রথমদিকে নাসিরউদ্দিনের জন্য অপেক্ষা না করে সালাহুদ্দিন ও তাকিউদ্দিন এই জোটের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন।[৮৫] এপ্রিলের শেষনাগাদ তিন দিন ধরে লড়াই চলার পর আইয়ুবীরা আমিদ দখল করে নেয়। তিনি শহরটি মালপত্রসহ নুরউদ্দিন মুহাম্মদের হাতে অর্পণ করেন। এতে ৮০,০০০ মোমবাতি, একটি টাওয়ার ভর্তি তীরের অগ্রভাগ ও ১০,৪০,০০০ বই ছিল। এর বিনিময়ে নুরউদ্দিন সালাহুদ্দিনের প্রতি আনুগত্যের শপথ নেন যে ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে তার প্রতিটি অভিযানে তাকে অনুসরণ করবেন। আমিদের পতন মারদিনের গাজিকে সালাহুদ্দিনের প্রতি আনুগত্য প্রকাশের উপলব্ধি করতে সহায়তা করে। ফলে ইজ্জউদ্দিনের জোট দুর্বল হয়ে পড়ে।[৮৬]
ইজ্জউদ্দিনের বিরুদ্ধে খলিফা আন নাসিরের সমর্থন লাভের জন্য সালাহুদ্দিন চেষ্টা করেন। তিনি ইজ্জউদ্দিনের বিরুদ্ধে ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে মুসলিমদের লড়াইয়ে বাধাপ্রদানকারী বলে অভিযোগ তোলেন। সালাহুদ্দিন নিজের অবস্থানের সপক্ষে দাবি করেন যে তিনি সিরিয়াতে ক্রুসেডারদের সাথে লড়াই, হাশাশিনদের ধর্মদ্রোহিতা ও মুসলিমদের অন্যায় কর্ম বন্ধ করতে এসেছেন। তিনি আরো প্রতিশ্রুতি দেন যে যদি মসুল তার হাতে দেয়া হয় তবে তা জেরুজালেম, কনস্টান্টিনোপল, জর্জিয়া ও মাগরেবে আলমোহাদ অঞ্চল জয়ে কাজে দেবে।[৮৭]
১১৮২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর বাইসান আক্রমণের উদ্দেশ্যে সালাহুদ্দিন জর্ডান নদী অতিক্রম করেন। এ স্থান খালি পাওয়া যায়। পরের দিন তার সেনারা শহরটি ধ্বংস করে জ্বালিয়ে দেয় এবং পশ্চিমদিকে যাত্রা করে। কারাক ও শাওবাক থেকে যাত্রা করা ক্রুসেডার সাহায্যকারী বাহিনী নাবলুসের পথে তাদের মুখোমুখি হয়। এদের অনেকেই বন্দী হয়। ইতোমধ্যে গাই অব লুসিগনানের নেতৃত্বাধীন মূল ক্রুসেডার বাহিনী সেফোরিয়াস থেকে আল ফুলার দিকে এগিয়ে যায়। সালাহুদ্দিন ৫০০ জন যোদ্ধা পাঠান যাতে তার বাহিনীকে হামলার মাধ্যমে ব্যস্ত রাখা যায় এবং তিনি নিজে আইন জালুতের দিকে অগ্রসর হয়। ক্রুসেডার বাহিনীতে তাদের সবচেয়ে বড় সেনাবহর ছিল কিন্তু তা মুসলিমদের তুলনায় সংখ্যায় কম ছিল। আইয়ুবীদের কয়েকটি হামলার পর ক্রুসেডাররা আর আক্রমণে ইচ্ছুক ছিল না। সালাহুদ্দিন তার সেনাদের নিয়ে নদীর দিকে ফিরে যান এবং এসময়ে সরবরাহও কমে যায়।[৭৬]
ক্রুসেডারদের হামলা সালাহুদ্দিনকে পরবর্তী পদক্ষেপে উদ্বুদ্ধ করে। রেনল্ড অব শাটিলন লোহিত সাগরে মুসলিম বাণিজ্য ও হজ্জযাত্রীদের বহরকে আক্রমণ করেন। এই জলপথটি উন্মুক্ত রাখা সালাহুদ্দিনের জন্য জরুরি ছিল। প্রতিউত্তরে ১১৮২ সালে বৈরুত আক্রমণের জন্য সালাহুদ্দিন ৩০টি জাহাজের একটি নৌবহর গড়ে তোলেন। রেনল্ড মক্কা ও মদিনা আক্রমণের হুমকি দিয়েছিলেন। পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে সালাহুদ্দিন দুইবার কেরাক অবরোধ করেন। এটি ১১৮৩ থেকে ১১৮৪ পর্যন্ত রেনল্ডের অধীন ছিল। এরপর ১১৮৫ সালে হজ্জযাত্রীদের একটি ক্যারাভানে রেনল্ড আক্রমণ চালান। ১৩ শতকের Old French Continuation of William of Tyre অনুযায়ী রেনল্ড সালাহুদ্দিনের বোনকে একটি ক্যারাভান হামলায় বন্দী করেছিলেন। সমসাময়িক অন্যান্য মুসলিম ও ফ্রাঙ্কিশ সূত্রগুলোতে এর উল্লেখ নেই তবে তাদের মতে একটি অগ্রবর্তী ক্যারাভানে রেনল্ডের হামলার পর সালাহুদ্দিন তার বোন ও বোনের পুত্রের নিরাপত্তার জন্য রক্ষীদের পাঠান ফলে তাদের কোনো ক্ষতি হয়নি।
কেরাক অবরোধ ব্যর্থ হওয়ার পর সালাহউদিন তার সাময়িকভাবে তার মনোযোগ অন্য এক দীর্ঘমেয়াদি কাজের দিকে সরিয়ে নেন এবং মসুলের আশেপাশে ইজ্জউদ্দিন (মাসুদ ইবনে মওদুদ ইবনে জানগি) এলাকার উপর আক্রমণ শুরু করেন। এরপর মাসুদ আজারবাইজান ও জিবালের ক্ষমতাশালী গভর্নরদের সাথে মিত্রতা স্থাপন করেন। মসুলের প্রতিরক্ষাকারীরা যখন জানতে পারে যে সাহায্য আসছে তারা প্রতিরোধ বৃদ্ধি করে। এসময় সালাহুদ্দিন অসুস্থ হয়ে পড়েন। ১১৮৬ সালের মার্চে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।[৮৮]
১১৮৭ সালের জুলাই সালাহুদ্দিন ক্রুসেডার জেরুজালেম রাজ্যের অধিকাংশ এলাকা দখল করে নেন। ১১৮৭ সালের ৪ জুলাই হাত্তিনের যুদ্ধে জেরুজালেমের রাজা গাই অব লুসিগনান ও তৃতীয় রেমন্ডের সম্মিলিত বাহিনীর সাথে সালাহুদ্দিনের বাহিনী মুখোমুখি হয়। যুদ্ধে ক্রুসেডার সেনাবাহিনী প্রায় সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। ক্রুসেডারদের জন্য এটি একটি বিপর্যয় ছিল এবং ক্রুসেডের ইতিহাসে এটি গতি নিয়ন্ত্রক হিসেবে ভূমিকা পালন করে। রেনল্ড অব শাটিলনকে বন্দী করা হয়। মুসলিমদের উপর তার আক্রমণের জন্য সালাহুদ্দিন ব্যক্তিগতভাবে তাকে হত্যা করেন। এসব ক্যারাভানের যাত্রীরা মুসলিম ও ক্রুসেডারদের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তির কথা বলে তার অনুগ্রহ চেয়েছিল কিন্তু রেনল্ড তা উপেক্ষা করেন এবং মুহাম্মদ কে অপমান করেন। একথা শোনার পর সালাহুদ্দিন রেনল্ডকে হত্যার শপথ নিয়েছিলেন।[৮৯] গাই অব লুসিগনানকেও বন্দী করা হয়। রেনল্ডের মৃত্যুদন্ড দেখে তিনি আতঙ্কিত ছিলেন এই ভেবে যে হয়তো তাকেও মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবে। তবে সালাহুদ্দিন তাকে ক্ষমা করে দেন এবং বলেন যে, “রাজা অন্য রাজাকে হত্যা করে না, কিন্তু ঐ লোকটা সকল সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল এবং তাই আমি এমন আচরণ করেছি।“[৯০]
সালাহুদ্দিন প্রায় সব ক্রুসেডার শহর জয় করেছিলেন। ১১৮৭ সালের ২ অক্টোবর শুক্রবার তার সেনাবাহিনী অবরোধের পর জেরুজালেম জয় করে। অবরোধের শুরুতে তিনি জেরুজালেমে বসবাসরত ফ্রাঙ্কিশদের কোনো নিরাপত্তা না দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এ কারণে বেলিয়ান অব ইবেলিন প্রায় ৫,০০০ মুসলিম বন্দীকে হত্যা ও ইসলামের পবিত্র স্থান আল আকসা মসজিদ ও কুব্বাত আস সাখরা ধ্বংস করে ফেলার হুমকি দেন। সালাহুদ্দিন তার উপদেষ্টাদের সাথে পরামর্শক্রমে এবং শর্তে রাজি হন। জেরুজালেমের রাস্তায় চুক্তি পরে শোনানো হয় যাতে সবাই চল্লিশ দিনের মধ্যে প্রস্তুত হতে পারে এবং সালাহুদ্দিনকে মুক্তিপণ দিতে পারে।[৯১] শহরের প্রত্যেক ফ্রাঙ্ক নারী, পুরুষ বা শিশুর জন্য সেসময়ের মূল্য অনেক কম মুক্তিপণ ধার্য করা হয় (আধুনিক হিসাবে ৫০ ডলার)। তবে তার কোষাধ্যক্ষের ইচ্ছার বাইরে গিয়ে অনেক পরিবার যারা মুক্তিপণ দিতে সক্ষম ছিল না তাদের মুক্তি দেন।[৯২][৯৩] জেরুজালেমের পেট্রিয়ার্ক হেরাক্লিয়াস বেশ পরিমাণ অর্থ সংগ্রহ করেন যার মাধ্যমে ১৮,০০০ গরিব নাগরিকের মুক্তিপণ আদায় করা হয়। বাকি ১৫,০০০ জনের জন্য কিছু ছিল না বিধায় বন্দীত্ব বরণ করতে হত। সালাহুদ্দিনের ভাই আল আদিল তাদের মধ্য থেকে ১,০০০ জনকে তার ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য রাখতে চান এবং বাকিদের মুক্তি দেয়া হয়। অধিকাংশ পদাতিক সৈনিককে দাস হিসেবে বিক্রি করে দেয়া হয়।[৯৪] জেরুজালেম বিজয়ের পর সালাহুদ্দিন ইহুদিদের শহরে পুনরায় বসবাসের অনুমতি দেন।[৯৫] আসকালনের ইহুদি সম্প্রদায় এই ডাকে সাড়া দেয়।[৯৬]
আধুনিক লেবাননের উপকূলে টায়ার ছিল ক্রুসেডারদের শেষ গুরুত্বপূর্ণ শহর। কৌশলগতভাবে এটি প্রথমে জয় করা বেশি কার্যকরী ছিল। কিন্তু জেরুজালেম ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ শহর বিধায় সালাহুদ্দিন প্রথম জেরুজালেম জয় করার সিদ্ধান্ত নেন। টায়ারের নেতৃত্বে ছিলেন কনরাড অব মন্টিফেরাট। তিনি এর শক্তিবৃদ্ধি করেন এবং সালাহুদ্দিনের দুইটি অবরোধ ব্যর্থ করতে সক্ষম ছিলেন। ১১৮৮ সালে টরটসায় সালাহুদ্দিন গাই অব লুসিগনানকে মুক্তি দেন এবং তাকে তার স্ত্রী রাণী সিবিলা অব জেরুজালেমের কাছে পাঠিয়ে দেন। তারা প্রথমে ত্রিপলি ও এরপর এন্টিওক যান। ১১৮৯ সালে তারা টায়ারের শাসন দাবি করলে কনরাড তাদের দাবি মানতে অস্বীকৃতি জানান। তিনি গাই অব লুসিগনানকে রাজা হিসেবে মানতেন না। এরপর গাই এক্রে অবরোধ করেন।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]
সালাহুদ্দিনের সাথে জর্জিয়ার রাণী তামারের বন্ধুত্বমূলক সম্পর্ক ছিল। সালাহুদ্দিনের জীবনীকার বাহাউদ্দিন ইবনে শাদ্দাদ উল্লেখ করেছেন যে সালাহুদ্দিন জেরুজালেম জয় করার পর জর্জিয়ান রাণী জেরুজালেমের জর্জিয়ান মঠের সম্পদগুলো ফিরিয়ে দেয়ার জন্য অনুরোধ জানিয়ে দূত প্রেরণ করেন। সালাহুদ্দিনের পদক্ষেপ লিপিবদ্ধ করা হয়নি। তবে রাণীর প্রচেষ্টা সফল হয়েছিল বলে মনে করা হয় কারণ আক্রের বিশপ জ্যাকুস ডা ভিটরি উল্লেখ করেছেন যে জর্জিয়ানরা অন্যান্য খ্রিষ্টান তীর্থযাত্রীদের মত না হয়ে বরং বিনা বাধা তাদের পতাকা নিয়ে শহরে চলাচল করতে পারত। ইবনে শাদ্দাদ দাবি করেন যে রাণী তামার বাইজেন্টাইন সম্রাটকে ট্রু ক্রস ফিরিয়ে আনায় তার প্রচেষ্টা নিয়ে সালাহুদ্দিনকে ২,০০,০০০ স্বর্ণখন্ড প্রদানের অতিরঞ্জিত দাবি করেন।[৯৭][৯৮]
It is equally true that his generosity, his piety, devoid of fanaticism, that flower of liberality and courtesy which had been the model of our old chroniclers, won him no less popularity in Frankish Syria than in the lands of Islam.
René Grousset (writer)[৯৯]
হাত্তিনের যুদ্ধ ও জেরুজালেমের পতন তৃতীয় ক্রুসেডকে উদ্বুদ্ধ করে। ইংল্যান্ডের রাজা রিচার্ড দ্য লায়নহার্ট গাই অব লুসিগনানের এক্রে অবরোধে নেতৃত্ব দেন। তারা শহর জয় করেন এবং নারী ও শিশুসহ প্রায় ৩,০০০ মুসলিম বন্দীকে হত্যা করেন।[১০০] বাহাউদ্দিন ইবনে শাদ্দাদ লিখেছেন:
হত্যার অভিপ্রায় কয়েকপ্রকারে বলা হয়; কারো মতে মুসলিমরা যেসব খ্রিস্টানদের হত্যা করে তাদের বদলা হিসেবে বন্দীদের হত্যা করা হয়। অন্যান্যরা বলে যে ইংল্যান্ডের রাজা আসকালন জয়ের চেষ্টার আগে এত সংখ্যক বন্দী রাখাকে অনর্থক মনে করেন। আসল কারণ শুধু আল্লাহই জানেন।[১০০]
২৮ আগস্ট থেকে ১০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে বন্দী ক্রুসেডারদের হত্যার মাধ্যমে এর প্রতিশোধ নেয়া হয়। ১১৯১ সালের ৭ সেপ্টেম্বর আরসুফের যুদ্ধে সালাহুদ্দিনের সেনাবাহিনীর সাথে রিচার্ডের সেনাবাহিনীর লড়াই হয়। এতে সালাহুদ্দিনের বাহিনী বেশ হতাহত হয় এবং পিছু হটতে বাধ্য হয়। আরসুফের যুদ্ধের পর রিচার্ড তার বাহিনী নিয়ে আসকালনের দিকে অগ্রসর হন। রিচার্ডের পরবর্তী পদক্ষেপ বুঝতে পেরে সালাহুদ্দিন শহর খালি করে দেন এবং শহর থেকে বেশ কয়েক মাইল দূরে অবস্থান নেন। রিচার্ড শহরে উপস্থিত হলে এটি পরিত্যক্ত দেখে অবাক হন। পরের দিন তিনি জাফায় পিছু হটার প্রস্তুতি নেয়ার সময় সালাহুদ্দিন আক্রমণ করেন। মারাত্মক লড়াইয়ের পর রিচার্ডের পিছু হটতে বাধ্য হয়। এই দুই বাহিনীর মধ্যে এটি সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ লড়াই ছিল। জেরুজালেম জয়ের জন্য রিচার্ডের সকল সামরিক পদক্ষেপ ও যুদ্ধ ব্যর্থ হয়। যুদ্ধে ব্যবহারের জন্য তার মাত্র ২,০০০ পদাতিক সৈন্য ও ৫০ জন পদাতিক নাইট ছিল। শহরের খুব কাছে পৌছালেও এত কম সেনা নিয়ে তা জয় করা সম্ভব ছিল না। সামরিক প্রতিপক্ষ হওয়ার পরও সালাহুদ্দিন ও রিচার্ডের সম্পর্ক ভিন্ন মাত্রার ছিল। আরসুফে রিচার্ড তার ঘোড়া হারিয়ে ফেললে সালাহুদ্দিন তাকে দুইটি ঘোড়া পাঠান। রিচার্ড সালাহুদ্দিনের ভাইকে বিয়ে করার তার বোন জোয়ানকে প্রস্তাব করেন এবং জেরুজালেম বিয়ের উপহার করার কথা বলেন।[১০১] তবে সালাহুদ্দিন ও রিচার্ডের মুখোমুখি সাক্ষাত হয়নি। চিঠি বা বার্তাবাহকের মাধ্যমে তাদের যোগাযোগ হত। ১১৯২ সালে তারা রামলার চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এর মাধ্যমে ঠিক করা হয় যে জেরুজালেম মুসলিমদের হাতে থাকবে কিন্তু তা খ্রিস্টান তীর্থযাত্রীদের জন্য উন্মুক্ত হবে। এই চুক্তি ল্যাটিন রাজ্যকে টায়ার থেকে জাফা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ করে দেয়।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]
রাজা রিচার্ডের ফিরে যাওয়ার অল্পকাল পর ১১৯৩ সালের ৪ মার্চ সালাহুদ্দিন দামেস্কে অসুস্থ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর সময় তার ব্যক্তিগত সম্পদের মধ্যে এক টুকরো স্বর্ণ ও চল্লিশ টুকরো রূপা ছিল।[১০২] তিনি তার অধিকাংশ খ্যাতনামা সম্পদ গরিব প্রজাদের দান করে যান।[১০৩] দামেস্কের উমাইয়া মসজিদের বাইরে তাকে দাফন করা হয়। সাত শতাব্দী পর জার্মান সম্রাট দ্বিতীয় উইলিয়াম মাজারে একটি মার্বেলের শবাধার দান করেন। মূল কবরে কোনো পরিবর্তন করা হয়নি। এর পরিবর্তে তা পাশে রাখা হয়।
ইমাদউদ্দিনের বর্ণনা অনুযায়ী ১১৭৪ সালে মিশর ত্যাগের পূর্বে সালাহুদ্দিনের পাঁচ জন পুত্র ছিল। সালাহুদ্দিনের জ্যেষ্ঠ সন্তান আল আফদাল ইবনে সালাহুদ্দিন ১১৭০ সালে এবং আল আজিজ উসমান ১১৭২ সালে জন্মগ্রহণ করেন। দ্বিতীয়জন সিরিয়ায় সালাহুদ্দিনের সাথে ছিলেন। তার তৃতীয় পুত্র ছিলেন আজ জহির গাজি। ইনি পরে আলেপ্পোর শাসক হন।[১০৪] ১১৭৭ সালে আল আফদানের মায়ের গর্ভে সালাহুদ্দিনের আরেক সন্তান জন্মগ্রহণ করে। কালকাশান্দি কর্তৃক রক্ষিত চিঠিতে ১১৭৮ সালের মে মাসে তার বারোতম পুত্রের জন্মের সংবাদ পাওয়া যায়। তবে ইমাদউদ্দিনের তালিকা অনুযায়ী তা সালাহুদ্দিনের সপ্তম সন্তান। পুত্র মাসুদ ১১৭৫ সালে ও ইয়াকুব ১১৭৬ সালে জন্মগ্রহণ করেন।[১০৫]
ক্রুসেডারদের সাথে সাহসী লড়াইয়ের জন্য সালাহুদ্দিন ইউরোপে বেশ সুনাম অর্জন করেন। মধ্যযুগের পর তার আলোচনা শেষ হয়ে যাওয়ার পর গোথহল্ড এফরাইম লেসিংসের নাটক নাথান দ্য ওয়াইজ ও স্যার ওয়াল্টার স্কটের উপন্যাস দ্য তালিসমান এ তাকে চিত্রিত করা হয়। তাকে নিয়ে সমসাময়িক দৃষ্টিভঙ্গিসমূহ এসকল রচনা থেকে উঠে আসে। জোনাথন রিলে স্মিথের মতে স্কটের সালাহুদ্দিন চিত্রায়ণ হল "আধুনিক (১৯ শতক) সময়ের একজন উদাহ ইউরোপীয় ভদ্রলোক যার পাশে মধ্যযুগের পাশ্চাত্য ব্যক্তিদের সর্বদা নিচু অবস্থায় দেখা যায়।"[১০৬] ১০৯৯ সালে জেরুজালেম দখলের পর ক্রুসেডারদের গণহত্যার পরও সালাহুদ্দিন সব সাধারণ খ্রিষ্টান ও এমনকি খ্রিষ্টান সেনাদেরও ক্ষমা করেন ও নিরাপদে যেতে দেন। গ্রিক অর্থোডক্স খ্রিষ্টানদের তুলনামূলক ভালো আচরণ করা হয় কারণ তারা পশ্চিমা ক্রুসেডারদের বিরোধীতা করত। তারিক আলির উপন্যাস দ্য বুক অব সালাহুদ্দিনে সালাহুদ্দিন ও তার সময়কার পৃথিবী নিয়ে বর্ণনা রয়েছে।[১০৭]
বিশ্বাসের পার্থক্য সত্ত্বেও সালাহুদ্দিনকে খ্রিষ্টান নেতারা, বিশেষত রিচার্ড সম্মান করতেন। রিচার্ড একবার সালাহুদ্দিনকে মহান রাজা বলে প্রশংসা করেন এবং বলেন যে কোনো সন্দেহ ছাড়াই তিনি ইসলামি বিশ্বের সবচেয়ে মহান ও শক্তিশালী নেতা।[১০৮] সালাহুদ্দিনও রিচার্ডকে খ্রিষ্টান নেতাদের মধ্যে সবচেয়ে সম্মানিত বলে উল্লেখ করেন। সন্ধির পর সালাহুদ্দিন ও রিচার্ড সম্মানের নিদর্শন হিসেবে পরস্পরকে অনেক উপহার পাঠান। ১১৯১ সালের এপ্রিল এক ফ্রাঙ্কিশ নারীর তিন মাস বয়সী শিশু ক্যাম্প থেকে হারিয়ে যায় ও তাকে বাজারে বিক্রি করে দেয়া হয়। ফ্রাঙ্করা তাকে সালাহুদ্দিনের কাছে সাহায্যের জন্য যেতে বলে। বাহাউদ্দিনের বর্ণনা অনুযায়ী সুলতান তার নিজের অর্থে সন্তানটিকে কিনে নিয়ে মহিলাটিকে ফেরত দেন এবং ক্যাম্পে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করেন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষ দিকে ব্রিটিশ জেনারেল এডমন্ড এলেনবি তুর্কিদের কাছ থেকে দামেস্ক দখল করতে সফল হন। কিছু সুত্র মতে শহরে তার প্রবেশের পর তিনি সালাহুদ্দিনের বিখ্যাত ভাস্করযের সামনে তার তলোয়ার উচিয়ে স্যালুট জানান এবং ঘোষণা করেন, “আজ ক্রুসেডের যুদ্ধ সম্পূর্ণ হল”। তিনি আজীবন ১৯১৭ সালে তার ফিলিস্তিন বিজয়কে ক্রুসেড হিসেবে বলার বিরোধীতা করেছেন। ১৯৩৩ সালে তিনি বলেন: "জেরুজালেম কৌশলগত কারণে গুরুত্বপূর্ণ ছিল, এ যুদ্ধে কোনো ধর্মীয় কারণ ছিল না।"[১০৯] ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম উসমানীয় সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে তার বিজয়কে কার্টুন প্রকাশের মাধ্যমে উদ্যাপন করে। এতে দেখানো হয় যে রিচার্ড স্বর্গ থেকে জেরুজালেমের দিকে তাকিয়ে আছেন এবং শিরোনাম ছিল "শেষ পর্যন্ত আমার স্বপ্ন সত্য হল।"[১১০][১১১]
১৮৯৮ সালে জার্মান সম্রাট দ্বিতীয় উইলিয়াম সালাহুদ্দিনের সম্মানার্থে তার মাজার পরিদর্শন করেন।[১১২] এই সফর জাতীয়তাবাদী আরবদের মাঝে সালাহুদ্দিনের নতুন ভাবমূর্তি গড়ে তোলে এবং তাকে পাশ্চাত্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামে একজন বীর হিসেবে চিত্রিত করা হয়। ওয়াল্টার স্কট ও অন্যান্য ইউরোপীয়দের দ্বারা সৃষ্ট সালাহুদ্দিন ভাবমূর্তিকে তার লালন করতেন। সালাহুদ্দিনের কুর্দি বংশোদ্ভূত হওয়াকে বিবেচনা করা হত না। এর ফলে মুসলিম বিশ্বে সালাহুদ্দিনের হারিয়ে যাওয়া সুনাম ফিরে আসে যা আর সফল ব্যক্তি মিশরের বায়বার্স কর্তৃক ঢাকা পড়ে গিয়েছিল।[১১৩]
আধুনিক আরব রাষ্ট্রগুলো সালাহুদ্দিনকে বেশ কয়েকভাবে স্মরণ করে। ইরাকের তিকরিত ও সামারায় প্রতিষ্ঠিত সালাহুদ্দিন গভরনোরেট তার নামে প্রতিষ্ঠিত হয়। এছাড়া ইরাকি কুর্দিস্তানের আরবিলে তার নামে সালাহুদ্দিন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আরবিলের একটি শহরতলী মাসিফ সালাহুদ্দিনও তার নামে নামকরণ করা হয়।
সালাহুদ্দিনের সাথে সংশ্লিষ্ট অল্প কিছু অবকাঠামো আধুনিক শহরগুলোতে টিকে আছে। তিনি সর্বপ্রথম কায়রোর দুর্গ মজবুত করেন। সিরিয়ায় ক্ষুদ্র শহরেও প্রতিরক্ষা দুর্গ ব্যবস্থা রয়েছে সালাহুদ্দিন এই ব্যবস্থা মিশরে চালু করেন।
আইয়ুবীয় রাজবংশ তার মৃত্যুর পর মাত্র ৫৭ বছর টিকে থাকলেও আরব বিশ্বে তার খ্যাতি এখনও টিকে রয়েছে। ২০ শতকে আরব জাতীয়তাবাদের উত্থান, বিশেষত আরব-ইসরায়েলি সংঘাতের সালাহুদ্দিনের বীরত্ব ও নেতৃত্ব নতুনভাবে গুরুত্ব লাভ করেন। আধুনিক দিনের জায়নবাদ বিরোধী আরব কাছে তার জেরুজালেম বিজয় অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে। এছাড়াও তার অধীনে আরব বিশ্বের এক হওয়া আরব জাতীয়তাবাদি, যেমন জামাল আবদেল নাসেরদের কাছে ঐক্যের মন্ত্র হিসেবে কাজ করে। একারণে মিশরের জাতীয় প্রতীক হিসেবে সালাহুদ্দিনের ঈগল প্রতীক ব্যবহার করা হয়। এরপর অন্যান্য বেশ কিছু আরব রাষ্ট্র যেমন ইউনাইটেড আরব রিপাবলিক, ইরাক, লিবিয়া, ফিলিস্তিন ও ইয়েমেনের কাছে স্বীকৃত হয়।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.