ভাগবত পুরাণ
হিন্দু ধর্মগ্রন্থ / From Wikipedia, the free encyclopedia
ভাগবত পুরাণ (দেবনাগরী: भागवतपुराण; অন্যান্য নাম শ্রীমদ্ভাগবত মহাপুরাণ, শ্রীমদ্ভাগবতম্ বা ভাগবত;) হল একটি হিন্দু মহাপুরাণ। এটি একটি ভক্তিবাদী ধর্মগ্রন্থ। বিষ্ণুর পূর্ণ অবতার তথা "স্বয়ং ভগবান" কৃষ্ণের প্রতি গভীর ব্যক্তিগত ভক্তিই এই পুরাণের প্রধান আলোচ্য বিষয়।[1] হিন্দু পৌরাণিক সাহিত্যের অনেক কাহিনি তথা বিষ্ণুর চব্বিশ জন অবতারের কাহিনি ভাগবত পুরাণে লিপিবদ্ধ রয়েছে। ভাগবত পুরাণই প্রথম পুরাণ যেটি কোনো ইউরোপীয় ভাষায় অনূদিত হয়। ১৭৮৮ সালে ভাগবতের তামিল সংস্করণের একটি ফরাসি অনুবাদ প্রকাশিত হয় যা ঔপনিবেশিক যুগে অনেক ইউরোপীয়কে হিন্দুধর্ম তথা ১৮ শতকের হিন্দু সংস্কৃতির সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। [2] এরপর ১৮৪০ থেকে ১৮৫৭ সালের মধ্যে ভাগবত পুরাণের তিনটি ফরাসি অনুবাদ প্রকাশিত হয়।[3] পদ্মপুরাণের শ্রেণিবিন্যাস অনুসারে ভাগবত পুরাণ একটি সাত্ত্বিক পুরাণ (অর্থাৎ, এই পুরাণ কল্যাণ ও পবিত্রতার সঙ্গে যুক্ত)।[4] প্রচলিত হিন্দু বিশ্বাস অনুসারে, ব্যাস এই পুরাণের রচয়িতা। ভাগবত পুরাণে প্রায়শই আদি শঙ্করাচার্য্যের অদ্বৈত দর্শন, রামানুজাচার্যের বিশিষ্টাদ্বৈত দর্শন এবং মধ্বাচার্যের দ্বৈতবাদ দর্শনের সংমিশ্রণ দেখা যায়।[5][6][7][8] প্রায় সব ভারতীয় ভাষায় এটি ব্যাপকভাবে পাওয়া যায়।
ভাগবত পুরাণ কে পবিত্রতম ও সর্বশ্রেষ্ঠ পুরাণ মনে করা হয়। কারণ, এটি বিষ্ণু ও তার বিভিন্ন অবতারের (প্রধানত কৃষ্ণের) প্রতি ভক্তির কথা প্রচার করে।[9] এই পুরাণে জাগতিক কর্মের বন্ধন থেকে মুক্তি, বিশুদ্ধ আধ্যাত্মিক জ্ঞান অর্জনের উপায় ও বিষ্ণুভক্তির মাহাত্ম্য বর্ণিত হয়েছে।[10]
ভাগবত পুরাণে , অন্যান্য পুরাণের মতোই বিশ্বতত্ত্ব , জ্যোতির্বিদ্যা, বংশতালিকা , ভূগোল, কিংবদন্তি, সঙ্গীত, নৃত্য, যোগ ও সংস্কৃতি প্রভৃতি বিষয় সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে । [5][11]
ভারতীয় পৌরাণিক কাহিনীগুলোতে যে কিংবদন্তিটি বহুবার লক্ষ্য করা যায় তা হলোঃ
অশুভ শক্তি ও পরোপকারী দেবতাদের পরস্পর যুদ্ধে অসুরেরা জয়লাভ করে ও পৃথিবী শাসন করে। পরম সত্য পুনরায় কৃষ্ণরূপে (যার অপর নাম "হরি" বা "বাসুদেব" ) আবির্ভূত হন। তিনি প্রথমে অসুরদের সাথে শান্তি স্থাপন করেন, তাদের স্বভাব বোঝেন, তারপর তৎপরতার সাথে তাদের পরাজিত করে আশা, ন্যায়বিচার, স্বাধীনতা এবং সুখ পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন। [12]
ভাগবত পুরাণ সর্বাধিক প্রভাবশালী পুরাণ। অষ্টাদশ পুরাণের মাঝে এটি অন্যতম। ইতিহাস রামায়ণ, মহাভারতের পাশাপাশি অন্যান্য পুরাণের সাথে এটিকে "পঞ্চম বেদ" বলা হয়ে থাকে।[13][14]
ভাগবত পুরাণ অনুসারে, কৃষ্ণের অভ্যন্তরীণ প্রকৃতি এবং বহিঃস্থ রূপ বেদের অনুরূপ এবং তা বিশ্বকে অশুভ শক্তির হাত থেকে রক্ষা করে। [15]
ভাগবত পুরাণে বিষ্ণুকে (নারায়ণ) পরব্রহ্ম বলে উল্লেখ করে বলা হয়েছে, তিনিই অসংখ্য বিশ্ব সৃষ্টি করে প্রতিটির মধ্যে ঈশ্বর-রূপে প্রবেশ করেন।[16] বিষ্ণু রজোগুণ অবলম্বন করে ব্রহ্মা রূপে প্রত্যেক বিশ্বের মধ্যে চোদ্দোটি করে জগৎ সৃষ্টি করেন; সত্ত্বগুণ গ্রহণ করে বিষ্ণু রূপে সেই জগৎগুলি রক্ষা ও প্রতিপালন করেন এবং মহাকল্পের অন্তকালে তমোগুণ অবলম্বন করে রুদ্র রূপে সেই জগৎগুলি ধ্বংস করেন।[17][18]
এই পুরাণ প্রথমে মুখে মুখে প্রচলিত ছিল। এর বর্তমান রূপটি খ্রিস্টীয় ৪র্থ থেকে ১০ম শতাব্দীর মধ্যবর্তী কোনো এক সময়ে লিপিবদ্ধ হয়। [3] ভাগবত পুরাণের পাণ্ডুলিপিগুলি আঠার শতকের মধ্যে সংশোধিত অসংখ্য অসামঞ্জস্যপূর্ণ সংস্করণে টিকে আছে ও বিভিন্ন ভারতীয় ভাষা জুড়ে অসংখ্য বার সংশোধিত হয়েছে। [19]
গ্রন্থটি মোট ৩৩২টি অধ্যায় ও ১৮,০০০ শ্লোক সহ দ্বাদশ স্কন্ধের সমন্বয়ে গঠিত। [20] বিষ্ণুর যে মানবরূপ কৃষ্ণের প্রতি ভক্তি ভাগবত পুরাণের আলোচ্য, সেই কৃষ্ণের কাহিনি এই পুরাণের ১০ম স্কন্ধে প্রায় ৪,০০০ শ্লোকে এককভাবে বর্ণিত হয়েছে। এই স্কন্ধটি সমগ্র ভাগবত পুরাণের এক-চতুর্থাংশ জুড়ে রয়েছে।[3] কৃষ্ণের জন্ম থেকে অন্তর্ধান পর্যন্ত সকল ঘটনা এই স্কন্ধেই সুসংবদ্ধভাবে লিপিবদ্ধ রয়েছে। এছাড়াও এখানে রয়েছে ভক্তিযোগের আচরণ-পদ্ধতি, ভক্তির ব্যাখ্যা এবং বিভিন্ন ধরনের ভক্তির বর্ণনা।[5] অনেক বৈষ্ণব ভাগবত (১/৩/৪০) অনুসারে, এই গ্রন্থটিকে ও কৃষ্ণকে অভিন্ন এবং এই গ্রন্থটিকেই কৃষ্ণের বাণীমূর্তি বা বাঙ্ময় বিগ্রহ মনে করেন। [20][21]
ভাগবত পুরাণের সকল কাহিনি ব্যাসের পুত্র শুকের মুখে বর্ণনাচ্ছলে কথিত হয়েছে। ভাগবত পুরাণ অনুসারে, প্রায় পাঁচ হাজার বছর পূর্বে পরীক্ষিতের নিকট ভাগবত কথিত হয়েছিল। মহাভারতে আছে রাজা পরীক্ষিৎ কৃষ্ণের তৎপরতায় জীবন পেয়েছিলেন। ভাগবত পুরাণে দেখা যায়, মৃত্যুপথযাত্রী পরীক্ষিৎ শুকের মুখে কৃষ্ণের কথা জানতে চান। তার নানা প্রশ্নের উত্তরে সাত দিনে শুক তার কাছে ভাগবত পুরাণের কাহিনি বিবৃত করেন। আজ অবধি ভক্তদের দ্বারা ভাগবত পাঠ ও কীর্তন করা হয়।