Loading AI tools
উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
বাংলাদেশের খেলাধুলা বলতে বাংলাদেশে যেসব খেলাধুলা প্ৰচলিত সেগুলোকে বুঝায়।
কাবাডি হলো বাংলাদেশের জাতীয় খেলা।[1] খেলাটি সারা দেশে অনুষ্ঠিত হয়। কাবাডি এশিয়ান গেমসে বাংলাদেশ নিয়মিত অংশ নিচ্ছে। যাইহোক, অন্যান্য খেলার সাম্প্রতিক উত্থানের ফলে এর জনপ্রিয়তা হ্রাস পেয়েছে। বাংলাদেশ একসময় বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ দল হিসেবে বিবেচিত হলেও অর্থের অভাবে এবং অন্যান্য কারণে এখন দুর্বল হয়ে পড়েছে।
ফুটবল বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় খেলা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল এদেশের জন-মানুষের প্রতিনিধি হিসেবে ভারতের বিভিন্ন স্থানে প্রদর্শনী ফুটবল খেলে বিশ্ব জনমত গঠনে সহায়তা করেছে।[2][3]
ক্রিকেট দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা। ১৯৯৭ সালে জাতীয় দল আইসিসি ট্রফি জিতে এবং ১৯৯৯ সালে প্রথমবারের মতো ক্রিকেট বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জনের পর এর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়। ২০০০ সালে, বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিলের পূর্ণ সদস্য হয়, যা ফলে টেস্ট ক্রিকেট খেলার অনুমতি পায়। বাংলাদেশ নিয়মিত অনেক আন্তর্জাতিক একদিনের ম্যাচ, টেস্ট ম্যাচ এবং টি-টোয়েন্টি আন্তর্জাতিক আয়োজন করে থাকে। ২০১১ সালে বাংলাদেশ, ভারত ও শ্রীলঙ্কার সাথে ক্রিকেট বিশ্বকাপ আয়োজন করে। ২০১৪ সালের আইসিসি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ আয়োজনের জন্যও বাংলাদেশ নির্বাচিত হয়েছিল। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড দেশের এই খেলাটি উন্নয়ন পরিচালনার জন্য প্রধান নিয়ন্ত্রক সংস্থা।
২০১৫ আইসিসি ক্রিকেট বিশ্বকাপে, বাংলাদেশ ইংল্যান্ডকে হারিয়ে প্রথমবারের মতো কোয়ার্টার ফাইনালে পৌঁছেছিল। তবে তারা ভারতের বিপক্ষে কোয়ার্টার ফাইনালে হেরে যায়। ইংল্যান্ড এবং ওয়েলসে অনুষ্ঠিত ২০১৭ সালের আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সেমিফাইনালেও বাংলাদেশ পৌঁছেছিল, কিন্তু সেমিফাইনালে আবার ভারতের কাছে হেরে যায়। বাংলাদেশ মহিলা দল ২০১৮ এশিয়া কাপের ফাইনালে ভারতকে পরাজিত করে ছয়বারের বিজয়ী ভারতের পর দ্বিতীয় দল হিসেবে ট্রফি জিতেছে।
৯ ফেব্রুয়ারী ২০২০ তারিখে, বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ ক্রিকেট দল দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত ২০২০ অনূর্ধ্ব-১৯ ক্রিকেট বিশ্বকাপের ফাইনালে ভারতকে হারিয়ে জয়লাভ করে। এটি কোনো আইসিসি ইভেন্টের বাংলাদেশের প্রথম জয়।
হকি বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় খেলা। এটি জনপ্রিয়তা বিবেচনা করে ক্রিকেট এবং ফুটবলের ঠিক পরে আসে। তবে, এই খেলাটির কর্মকর্তাদের দায়িত্বের অভাব এবং অপশাসন ফলে হ্রাস পেতে থাকে। যদিও বাংলাদেশ নিয়মিতভাবে ১৯৮৫ সালে থেকে হকি এশিয়া কাপে অংশগ্রহণ করেছে। বাংলাদেশ হকি ফেডারেশন, খেলাটির জন্য জাতীয় পরিচালনা কমিটি, প্রতি বছর দেশে কিছু দেশীয় প্রতিযোগিতা আয়োজন করে, বিশেষত প্রিমিয়ার বিভাগ হকি লিগ|
দাবা বাংলাদেশের একটি জনপ্রিয় ইনডোর খেলা এবং দেশটি অনেক প্রতিভাবান দাবা খেলোয়াড়ের জন্ম দিয়েছে। বাংলাদেশী দাবা খেলোয়াড় নিয়াজ মোরশেদ প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার যিনি ১৯৮৭ সালে দক্ষিণ এশিয়া থেকে আবির্ভূত হন। বাংলাদেশ দাবা ফেডারেশন ১৯৭৯ সালে ফিদে এর সদস্য হয়েছে। প্রতি বছর এটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রায় ১৫ থেকে ২০টি টুর্নামেন্টের আয়োজন করে। বাংলাদেশী দাবা চ্যাম্পিয়নশিপ হলো দেশের বার্ষিক ব্যক্তিগত জাতীয় দাবা চ্যাম্পিয়নশিপ।
এক্কাদোক্কা খেলাটি সাধারণত মেয়েদের মধ্যে খেলা হয়।[4][5] এটি মাটির পাত্রের ছোট ভাঙা টুকরো দিয়ে খেলা হয় এবং এটি স্থানীয় ভাবে গুটি নামে পরিচিত। এটি আয়তক্ষেত্রাকার বা গোলাকার সমতল ভূমিতে খেলা হয়। প্রায় তিন গজ দীর্ঘ লম্বা একটি আয়তক্ষেত্র মাটিতে আঁকা হয় এবং আয়তক্ষেত্রটি আবার ছয়টি আয়তক্ষেত্রাকার কক্ষে বিভক্ত থাকে। প্রতিটি কক্ষের একটি সাধারণ নাম থাকে, যেমন প্রথম কক্ষকে এক-এর-ঘর বলা হয়, দ্বিতীয় কক্ষকে দুই-এর-ঘর বলা হয়, এই ভাবে পাঁচটি সংখ্যার নামে কক্ষ থাকে যথা এক্কা, দোক্কা, তদক্কা, চৌক্কা, পক্কা।[6] তবে শেষ বড় অর্ধবৃত্তকার ছককে সমুদ্র বলা হয়, প্রতিটি কক্ষ বা ছকে কিছু নির্দিষ্ট পয়েন্ট থাকে।[7][8]
গ্রামবাংলার কিশোর-কিশোরীদের কাছে জনপ্রিয় এবং মজার একটি খেলা গোল্লাছুট। শহরের কিশোর-কিশোরীদের অনেকেই এ খেলাটির সঙ্গে পরিচিত নয়। এ খেলায় দৌড়াদৌড়ি ও ছোটাছুটির জন্য বেশ জায়গা লাগে। সমানসংখ্যক সদস্যের দুটি দল থাকে এবং এ দুই দলের মধ্যে এ খেলা অনুষ্ঠিত হয়। খেলোয়াড়ের সংখ্যা ৪-৬ থেকে ৮-১০ জন পর্যন্ত হতে পারে। এ খেলায় দল গঠনের নিয়মটি বেশ মজার। প্রথমে দুটি দলের জন্য দুজন দলনেতা নির্ধারণ করা হয়। এরপর অন্য খেলোয়াড়দের দুজন করে জুটি বেঁধে একটু দূরে যেতে বলা হয়। প্রত্যেক জুটির প্রতিজন পৃথকভাবে তাদের নাম রাখে, তারপর দলনেতাদের সামনে এসে নাম বলে এবং যে নাম যে দলনেতার পছন্দ হয় সে সেই নাম ধরে ডাক দেয়। তখন ওই নামের জন তার দলে যোগ দেয়। কাবাডির মতো গোল্লাছুটে দম হয় না। ছোটাছুটি ও দৌড়াদৌড়ির ফলে এতে উত্তম শারীরিক ব্যায়াম হয়। সাধারণত কিশোর-বালকরা এতে অংশগ্রহণ করে। পাশাপাশি কিশোর-বালিকাদেরও এ খেলায় অংশগ্রহণ করতে দেখা যায়।[9]
ডাংগুলি বাংলার অন্যতম গ্রামীণ খেলা।[4][5] সাধারণত কিশোর বয়সী ছেলেরা এই খেলা খেলে। এই খেলার দুটি উপকরণ রয়েছে। উপকরণ দুটি হল- একটি দেড় থেকে দুই ফুট লম্বা লাঠি (ডাং), অপরটি গুলি, যা প্রায় দুই ইঞ্চি লম্বা ছোট লাঠি, যার দুই প্রান্ত কিছুটা সূঁচালো করা থাকে। দুই থেকে পাঁচ-ছয়জন করে দুই দলে বিভক্ত হয়ে এটি খেলতে পারে। প্রথমে খোররলা মাঠে একটি ছোট গর্ত করা হয়। যারা দান পায় তাদের একজন গর্তের ওপর গুলি রেখে ডান্ডা মেরে সেটিকে দূরে ফেলার চেষ্টা করে। প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়েরা চারিদিকে দাঁড়িয়ে থেকে সেটিকে লুফে নিতে চায়। তারা সফল হলে ঐ খেলোয়াড় আউট হয়, আর ধরতে না পারলে গর্তের ওপর রাখা ডান্ডা লক্ষ করে ছুড়ে মারতে হয়। প্রথম খেলোয়াড় গুলিকে ধরতে বা ডান্ডায় আঘাত করে যদি প্রথম খেলোয়াড় আউট হয় তবে গুলিকে ধাক্কা দেওয়ার জন্য দ্বিতীয় খেলোয়াড় পরিবর্তন করে। প্রথম খেলোয়াড় যদি আউট না হয়, তবে সে পুনরায় খেলা শুরু করে। এটি দুটি ধাপে সম্পন্ন হয়, প্রথমে সে গুলির একপাশে আঘাত করার চেষ্টা করে বাতাসে রাখার জন্য সামান্য ঝাঁকুনি দেয়, তারপরে সে দন্ডের দ্বারা গর্তের থেকে দূরে দূরে পাঠাতে গুলিতে আঘাত করার চেষ্টা করেন। মূলত খেলোয়াড়কে ৩ বার আঘাত করার সুযোগ দেওয়া হয়। যদি সে ৩ বার ব্যর্থ হয়, তবে খেলোয়াড়কে আউট বলে ঘোষণা করা হবে এবং দ্বিতীয় খেলোয়াড় খেলা শুরু করে।
ইচিং বিচিং বাংলাদেশ সহ ভারত উপমহাদেশের একটি জনপ্রিয় গ্রামীণ খেলা।[10] সাধারণত এই খেলার জন্য শিশু ও কিশোরীরা গ্রাম সংলগ্ন সবুজ মাঠকে নির্বাচন করে। উচ্চতা অতিক্রম এই খেলার একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
ইচিং বিচিং চিচিং ছা
প্রজাপতি উড়ে যা
দু'জন খেলোয়াড় পাশাপাশি বসে খেলোয়াড়দের অতিক্রম করার জন্য উচ্চতা নির্মাণ করে দেয়। প্রথমে তারা দু'পায়ের গোড়ালি দিয়ে উচ্চতা নির্মাণ করে। খেলোয়াড়রা উচ্চতা অতিক্রম করার পর তারা পায়ের উপর আরেক পা তু্লে দিয়ে উচ্চতা বাড়িয়ে দেয়। এইভাবে পায়ের উপর প্রসারিত করতল স্থাপন করে উচ্চতা বাড়িয়ে তোলা হয়। উচ্চতা অতিক্রম করার পর বসে থাকা খেলোয়াড়রা দুই পা মুক্ত করে ত্রিকোণাকার একটি সীমানা তৈরি করে। এই পায়ে ঘেরা স্থানটি পা তুলে দম দিতে দিতে বা ছড়া আওড়াতে আওড়াতে তিনবার অতিক্রম করে লাফ দিয়ে পার হতে হয়। এই সীমানা অতিক্রম করার পর বসে থাকা খেলোয়াড়দের যুক্ত পাকে প্রতিটি খেলোয়াড় শূন্যে লাফিয়ে ইচিং বিচিং ছড়া বলতে বলতে দুইবার করে অতিক্রম করে নেয়। এটিই খেলার শেষ পর্ব।
ওপেন টু বাইস্কোপ বাংলাদেশের গ্রামীণ খেলাধুলার মধ্যে অন্যতম।[10] এর সরলতার কারণে মেয়েদের কাছে ওপেন টু বাইস্কোপ খেলাটি আজ পর্যন্ত জনপ্রিয়তা পেয়ে আসছে। এটি একটি সহায়ক খেলা। দল গঠন করার জন্য এই খেলাটি খেলা হয়। এই খেলাটির সাথে জড়িত ছড়া-গানটি ব্রিট্রিশ যুগের ইংরেজ সাহেবদের বিনোদনের প্রতি ইঙ্গিত করে।
ওপেন টু বাইস্কোপ
নাইন টেন তেইশ কোপ
সুলতানা বিবিয়ানা
সাহেব বাবুর বৈঠকখানা
সাহেব বলেছে যেতে
পান সুপারি খেতে
পানের আগায় মরিচ বাটা
স্প্রিংএর চাবি আঁটা
যার নাম রেনুবালাতাকে দেবো মুক্তার মালা।
দু'জন দলপতি ফুল অথবা ফলের নামে নিজেদের দলের নাম নির্বাচন করে। তারা মুখোমুখি দাঁড়িয়ে দু'হাত দিয়ে একটি তোরণ নির্মাণ করে। খেলায় অংশগ্রহণকারী খেলোয়াড়রা পরস্পরের কাঁধে হাত রেখে রেলগাড়ির মতো সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে ছড়া বলতে বলতে এই তোরণের নীচ দিয়ে যাতায়াত করতে থাকে। ছড়া শেষ হবার মূহুর্তে যে খেলোয়াড় তোড়নের মধ্যে অবস্থান করে তাকে দলপতিরা হাতের মধ্যে বন্দী করে। তারা তাকে জিজ্ঞাসা করে সে কোন দলে যোগ দেবে। তখন সে তার পছন্দের দলে যোগ দেয়। এই ভাবে প্রতিটি খেলোয়াড় দুই দলে বিভক্ত হয়ে মূল খেলা শুরু করে। কখনো কখনো মূল খেলা হিসেবেই ওপেন টু বাইস্কোপ খেলাটি খেলা হয়ে থাকে।
কড়ি খেলা বাংলাদেশের একটি গ্রামীণ খেলা।[10] যে সব কৈশোর উত্তীর্ণ মেয়েদের চলাফেরা নিয়ন্ত্রিত সাধারণত তারাই কড়ি বেশি খেলে থাকে। কড়ি পাঁচ গুটির মতই সমান জনপ্রিয় একটি খেলা। কড়ি হিসাবে পাটখড়ি বা খেজুরের বিচি দিয়ে কড়ি বানিয়ে গ্রামে খেলা হয়ে থাকে।
খুশুর খুশুর দুর্গা মাসুর
তিন তালিয়া মার কেলিয়া
কুমড়ার চাক ধাপ্পা দিয়াহাতের কড়ি হাতে থাক
কড়ি খুবই সহজ ও সরল একটি খেলা। চারটি কড়ি কোনো মসৃণ স্থানে হাত থেকে গড়িয়ে দিয়ে জোড়ায় জোড়ায় টোকা দিয়ে আঘাত করে পয়েন্ট সংগ্রহ করা হয়। আঘাত করতে ব্যর্থ হলে বা কড়ি চালার পর এক সাথে লেগে থাকলে ঐ খেলোয়াড়ের দান নষ্ট হয়ে যায় এবং অন্য জন খেলা শুরু করে। নিজের মাথার চুল দিয়ে গ্রামের মেয়েরা প্রায়ই আপাত স্পর্শ করে থাকা গুটিকে পৃথক প্রমাণ করে থাকে। কড়ি চালার পর যদি তিনটি গুটির বুক উপড়ে থাকে তবে ঐ দান নষ্ট হয় আর যদি চারটি গুটিই বুক উপড়ে থাকা অবস্থায় পড়ে তবে প্রতি গুটির জন্য চারটি করে পয়েন্ট পাওয়া যায় এবং এই গুটি সংগ্রহ করা নিয়ে খেলোয়াড়দের মাঝে কাড়াকাড়ি পড়ে যায়।
বাংলাদেশের গ্রামীণ খেলাধুলার মধ্যে কানামাছি একটি চমৎকার খেলা। এ দেশের সর্বত্র শিশু কিশোররা এ খেলা খেলে থাকে।[11] কানামাছি খেলার সময় নিচের ছড়াটি বলতে হয়।
কানামাছি ভোঁ ভোঁ
যারে পাবি তারে ছো
এ খেলায় কাপড় দিয়ে একজনের চোখ বেঁধে দেয়া হয়, সে অন্য বন্ধুদের ধরতে চেষ্টা করে। যার চোখ বাঁধা হয় সে হয় ‘কানা’। অন্যরা ‘মাছি’র মতো তার চারদিক ঘিরে কানামাছি ছড়া বলতে বলতে তার গায়ে টোকা দেয়। চোখ বাঁধা অবস্থায় সে অন্যদের ধরার চেষ্টা করে। সে যদি কাউকে ধরতে পারে এবং বলতে পারে তার নাম তবে ধৃত ব্যক্তিকে কানা সাজতে হয়।[12][13]
লাঠি খেলা একটি ঐতিহ্যগত মার্শাল আর্ট যেটি বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের কিছু জায়গায় চর্চা করা হয়।[14] 'লাঠি খেলা' অনুশীলনকারীকে 'লাঠিয়াল' বলা হয়।[15] এছাড়াও, লাঠি চালনায় দক্ষ কিংবা লাঠি দ্বারা মারামারি করতে পটু কিংবা লাঠি চালনা দ্বারা যারা জীবিকা অর্জন করে, তিনি/তাঁরা লেঠেল বা লাঠিয়াল নামে পরিচিতি পান।[16]
লাঠি একটি প্রাকৃত শব্দ যেটি সংস্কৃত ফর্ম ইয়াস্টি থেকে এসেছে। সুতরাং, লাঠি খেলাকে লাঠির কৌশল বলা যেতে পারে।[17] দক্ষিণ এশীয় ভাষায় বাংলাসহ হিতোপদেশ আছে যে যার আছে লাঠি তার আছে ক্ষমতা। লাঠি খেলায় যে দক্ষ বা লাঠি খেলা নিয়ে যাদের বসবাস তারাও লাঠিয়াল হিসাবে পরিচিত।[18]
লাঠি মুগুর, গদা বা ডাণ্ডা বিশেষ যেটি সাধারণত শক্ত বাঁশ দিয়ে তৈরি হয় এবং কখনও কখনও একটি লোহার রিংয়ের সঙ্গে আবদ্ধ অবস্থায় দুর্দান্ত অস্ত্রে পরিণত হয়।[18]
লাঠি খেলা লাঠি দিয়ে আত্মরক্ষা শেখায়। ব্রিটিশ শাসনামলে অবিভক্ত বাংলার জমিদাররা (পূর্ব বাংলা ও পশ্চিম বঙ্গ) নিরাপত্তার জন্য লাঠিয়ালদের নিযুক্ত করত। চরাঞ্চলে জমি দখলের জন্য মানুষ এখনও লাঠি দিয়ে মারামারি করে। মহরম ও পূজাসহ বিভিন্ন ধর্মানুষ্ঠানে এই খেলাটি তাদের পরাক্রম ও সাহস প্রদর্শনের জন্য খেলা হয়ে থাকে। এই খেলার জন্য ব্যবহৃত লাঠি সাড়ে চার থেকে পাঁচ ফুট লম্বা, এবং প্রায়ই তৈলাক্ত হয়। অত্যাশ্চর্য কৌশলের সঙ্গে প্রত্যেক খেলোয়াড় তাদের নিজ নিজ লাঠি দিয়ে রণকৌশল প্রদর্শন করে। শুধুমাত্র বলিষ্ঠ যুবকেরাই এই খেলায় অংশ নিতে পারে।[18] কিন্তু বর্তমানে শিশু থেকে শুরু করে যুবক, বৃদ্ধ সব বয়সের পুরুষেরাই লাঠিখেলায় অংশ নিয়ে থাকেন।[19] উত্তরবঙ্গে, ঈদের সময়ে চাদি নামক একটি অনুরূপ খেলা খেলা হয়। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ অংশে পূজাসহ বিভিন্ন ধর্মানুষ্ঠানের সময় "লাঠি খেলা" এর প্রদর্শনী এখনও আছে। পুরু বাংলায় গুরুসাদে দত্ত কর্তৃক ব্রাতাশ্রী আন্দোলনের সময়ও লাঠি খেলা অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল।[18]
লাঠিয়াল বাহিনী সড়কি খেলা, ফড়ে খেলা, ডাকাত খেলা, বানুটি খেলা, বাওই জাক (গ্রুপ যুদ্ধ), নরি বারী (লাঠি দিয়ে উপহাস যুদ্ধ) খেলা এবং দাও খেলা (ধারালো অস্ত্র দিয়ে উপহাস যুদ্ধ) খেলা দেখায়। এর মধ্যে ডাকাত খেলার উপস্থাপনা ঈদে জনপ্রিয় খেলা হিসেবে প্রসিদ্ধ। লাঠিখেলার আসরে লাঠির পাশাপাশি বাদ্যযন্ত্র হিসেবে ঢোলক, কর্নেট, ঝুমঝুমি, কাড়া ইত্যাদি ব্যবহূত হয় এবং সঙ্গীতের সাথে চুড়ি নৃত্য দেখানো হয়।[19][20]
লাঠি খেলার অসাধারণ ইতিহাস আছে কিন্তু এর জনপ্রিয়তা এখন পড়তির দিকে।[21] ঈদ উপলক্ষে লাঠিখেলার আয়োজন সিরাজগঞ্জ, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া, জয়পুরহাট, পঞ্চগড়, নড়াইল প্রভৃতি জেলায় ভিন্ন নামে দেখা যায়।[19] লাঠি খেলা নিয়ে বর্তমানে নতুন দল তৈরি হচ্ছে না। এছাড়া পৃষ্ঠপোষকতার অভাবেও লাঠি খেলা হারিয়ে যেতে বসেছে।[22]
কুতকুত গ্রামীণ কিশোরী-তরুণীদের অন্যতম প্রধান খেলা।[10] উঠানে শস্য শুকাতে দেবার ফাঁকে কিংবা বিকালের নরম আলোয় গৃহের আঙ্গিনায় কৈশর পেরোনো তরুণীরা কুতকুত খেলায় মেতে ওঠে। বর্ষার পরের নরম মাটিতে মাটির ভাঙ্গা তৈজসপত্রের অংশ দিয়ে দাগ কেটে কুতকুতের জন্য ঘর বানানো হয়। বাংলার গ্রামীণ মেয়েরা যে কোনো ঋতুতেই এই খেলা খেলে থাকে। কুতকুত খেলায় ঘর বেচাকেনার বিষয়টি বাণিজ্যের প্রতি গ্রামীণ নারীদের সচেতনতাকে তুলে ধরে।
লাইলি লুইলি বাঁশের চোঙ
বাঁশ কাটলে টাকা থোং
এত টাকা নেবো না
লাইলির বিয়া দিব না
লাইলির আম্মা কাঁন্দেগলায় রশি বান্দে
আয়তক্ষেত্রাকার মোট ৭/৮টি ঘর আঁকা হয় এবং এই ঘরগুলোর শেষ মাথায় অর্ধচন্দ্রাকৃতির আর একটি ঘর বানানো হয়। প্রথম ঘরে গুটি ফেলে এক পা শূন্যে রেখে এবং দম দিতে দিতে গুটিকে সবগুলো ঘর অতিক্রম করে অর্ধচন্দ্রাকৃতির ঘরে এনে পা নামিয়ে দম ফেলা যায়। তার পর এই ঘর থেকে গুটিকে পা দিয়ে আঘাত করে সব ঘর অতিক্রম করানোর চেষ্টা করা হয়। গুটিটি সব ঘর অতিক্রম না করলে অর্ধচন্দ্রাকৃতির ঘর থেকে বের হয়ে শূন্যে পা তুলে দম নিতে নিতে তাকে আবার আগের নিয়মে ঘর থেকে বের করে আনতে হয়। খেলোয়াড়রা কপালে গুটি রেখে উপর দিকে তাকিয়ে ৮টা ঘরের দাগে পা না ফেলে অর্ধচন্দ্রাকৃতির ঘরে যেয়ে আবার প্রথম ঘরে ফেরত আসতে পারলে সে ঘর কেনার যোগ্যতা অর্জন করে। কুতকুত খেলায় যে ঘর কেনা হবে সেই ঘরে পা বা গুটি ফেলা যাবেনা। ঘর কেনার প্রক্রিয়াকালীন সময় খেলোয়াড়ের দাঁত দেখা গেলে ঐ খেলোয়াড়ের খেলা ঐ অবস্থায় মারা যায়। ক্রমান্বয়ে ঘর কিনে শেষ ঘরটি দখল করার মাধ্যমে খেলার নিষ্পত্তি হয়।
অতীতে বাংলাদেশে ষাঁড়ের লড়াই একটি প্রসিদ্ধ খেলারূপে প্রচলন ছিল। লড়াই করার জন্য ষাঁড় গরু আলাদাভাবে লালন পালন করা হতো। এর দ্বারা হাল চাষ বা অন্য কোন ধরনের কাজ করা হতো না। ষাঁড়টিকে মোটাতাজা করা হতো শুধু লড়াই করার জন্য। শুকনো মৌসুমে গ্রামের বাজারে ঢোল পিটিয়ে ষাঁড়ের লড়াই দেখার আমন্ত্রন জানানো হতো। মাঠে ষাঁড়ের মালিকগণ তাদের ষঁড়গুলোকে বিভিন্ন রঙিন কাপড়, ঘুংগুর, দোয়াল দিয়ে গেঁথে নিয়ে আসতেন। দুদিকে দুজন রশি দিয়ে বেঁধে নিয়ে এসে দুপক্ষের ষাঁড়কে ছেড়ে দিয়ে সবাই মিলে ঢাক ঢোল পিটিয়ে ও বিভিন্ন তালে তালে গান করত। এভাবে উপস্থিত সকল ষাঁড়ের মধ্যে যে ষাঁড়টি প্রথম স্থান পেত তাকে পুরস্কার দেয়া হতো। সে পুরস্কার গরুর গলায় বেঁধে বাজারে বাজারে দেখানো হতো। বর্তমানে এই শৌখিন প্রথা বিলুপ্তির পথে।[23]
বউচি বাংলাদেশের একটি গ্রামীণ ও ঐতিহ্যবাহী খেলা।[10]
বউচি খেলায় দুইটি দলের প্রয়োজন হয়। প্রত্যেক দলে ৮ থেকে ১০ জন করে খেলোয়াড় হলে খেলা জমে। মাঠ অথবা বাড়ির উঠোন যেখানে খুশি সেখানে এই খেলা খেলা যায়। খেলার প্রারম্ভে ২০-২৫ ফুট দূরত্বে মাটিতে দাগ কেটে দুটি ঘর তৈরি করতে হয়। দুই দলের মধ্যে যারা প্রথমে খেলার সুযোগ পায় তাদের মধ্যে থেকে একজনকে বউ বা বুড়ি নির্বাচন করা হয়। দুটি ঘরের মধ্যে একটি ঘর হবে বড়, যেখানে এক পক্ষের বউ বাদে সব খেলোয়াড় থাকবে। আর ছোট ঘরে দাঁড়াবে বউ। ছোট ঘরটিকে বউঘর বা বুড়িঘর বলে। বউয়ের বিচক্ষণতার ওপর খেলার জয় পরাজয় নির্ভর করে। খেলায় বউঘর থেকে বউকে ছুটে আসতে হবে বড় ঘরটিতে। বিপক্ষ দলের খেলোয়াড়েরা সব সময় পাহারায় থাকে যেন বউ ঘর থেকে বের হতে না পারে। বউ বাইরে এলে যদি বিপক্ষ দলের কেউ তাকে ছুঁয়ে দেয় তাহলে ওই পক্ষের খেলা শেষ হয়ে যায়।
পরবর্তীতে বিপক্ষ দল খেলার সুযোগ পায়। বড় ঘরটিতে যারা থাকে তারা দম নিয়ে বিপক্ষ দলের খেলোয়াড়দের তাড়া করে। দম নিয়ে তাড়া করলে বিপক্ষ দলের খেলোয়াড়রা দিগ্বিদিক ছুটে পালায়। তা সত্তে ও সবসময় খেয়াল রাখে বউ যেন যেতে না পারে। দম নিয়ে যাওয়া খেলোয়াড় যদি বিপক্ষ দলের কাউকে ছুঁয়ে দেয় তবে সে খেলোয়াড় মারা পড়ে। মারা পড়া খেলোয়াড় চলতে থাকা খেলায় অংশ নিতে পারে না। এভাবে বিপক্ষ দলের খেলোয়াড় মেরে বউকে বড় ঘরে ফিরে আসতে সুযোগ করে দেওয়ার চেষ্টা করতে থাকে বউয়ের সঙ্গী খেলোয়াড়েরা। বউ যদি বিনা ছোঁয়ায় বড় ঘরে চলে আসতে পারে তাহলে বিজয় অর্জন হয়। বিজয়ী দল পুনরায় খেলা শুরু করবে। যদি বউকে বিপক্ষ দল ছুঁয়ে দেয় তাহলে বিপক্ষ দল খেলার সুযোগ পাবে। এভাবে পর্যায়ক্রমে খেলা চলতে থাকে।
জব্বারের বলীখেলা এক বিশেষ ধরনের কুস্তি খেলা, যা চট্টগ্রামের লালদিঘী ময়দানে প্রতিবছরের ১২ই বৈশাখে অনুষ্ঠিত হয়।[10] এই খেলায় অংশগ্রহণকারীদেরকে বলা হয় বলী। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় কুস্তি বলীখেলা নামে পরিচিত। ১৯০৯ সালে চট্টগ্রামের বদরপাতি এলাকার ধনাঢ্য ব্যবসায়ী আবদুল জব্বার সওদাগর এই প্রতিযোগিতার সূচনা করেন।[24] তার মৃত্যুর পর এই প্রতিযোগিতা জব্বারের বলী খেলা নামে পরিচিতি লাভ করে। জব্বারের বলীখেলা একটি জনপ্রিয় ও ঐতিহ্যমন্ডিত প্রতিযোগিতা হিসেবে বিবেচিত। বলীখেলাকে কেন্দ্র করে লালদিঘী ময়দানের আশে পাশে প্রায় তিন কিলোমিটার জুড়ে বৈশাখী মেলার আয়োজন হয়। এটি বৃহত্তর চট্টগ্রাম এলাকার সবচেয়ে বৃহৎ বৈশাখী মেলা।
ভারতবর্ষের স্বাধীন নবাব টিপু সুলতানের পতনের পর এই দেশে ব্রিটিশ শাসন শুরু হয়। বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশ এবং একই সঙ্গে বাঙালি যুবসম্প্রদায়ের মধ্যে ব্রিটিশবিরোধী মনোভাব গড়ে তোলা এবং শক্তিমত্তা প্রদর্শনের মাধ্যমে তাদের মনোবল বাড়ানোর উদ্দেশ্যে চট্টগ্রামের বদরপতি এলাকার ব্যবসায়ী আবদুল জব্বার সওদাগর বলী খেলা বা কুস্তি প্রতিযোগিতার প্রবর্তন করেন। ১৯০৯ সালের ১২ বৈশাখ নিজ নামে লালদীঘির মাঠে এই বলীখেলার সূচনা করেন তিনি। ব্যতিক্রমধর্মী ক্রীড়া প্রতিযোগিতা আয়োজনের জন্য ব্রিটিশ সরকার আবদুল জব্বার মিয়াকে খান বাহাদুর উপাধিতে ভূষিত করলেও তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি আমলে বৃহত্তর চট্টগ্রাম ছাড়াও বার্মার আরাকান অঞ্চল থেকেও নামী-দামি বলীরা এ খেলায় অংশ নিতেন।
চট্টগ্রাম বলির দেশ। কর্ণফুলী ও শঙ্খ নদীর মধ্যবর্তী স্থানের উনিশটি গ্রামে মল্ল উপাধিধারী মানুষের বসবাসের ছিল। প্রচণ্ড দৈহিক শক্তির অধিকারী মল্লরা সুঠামদেহী সাহসী পুরুষ এবং তাদের বংশানুক্রমিক পেশা হচ্ছে শারীরিক কসরৎ প্রদর্শন। এই মল্লবীরেরাই ছিলেন বলিখেলার প্রধান আকর্ষণ ও বলিখেলা আয়োজনের মূল প্রেরণা।[25] চট্টগ্রামের বাইশটি মল্ল পরিবার ইতিহাস প্রসিদ্ধ। আশিয়া গ্রামের আমান শাহ মল্ল, চাতরি গ্রামের চিকন মল্ল, কাতারিয়া গ্রামের চান্দ মল্ল, জিরি গ্রামের ঈদ মল্ল ও নওয়াব মল্ল, পারি গ্রামের হরি মল্ল, পেরলা গ্রামের নানু মল্ল, পটিয়ার হিলাল মল্ল ও গোরাহিত মল্ল, হাইদগাঁওর অলি মল্ল ও মোজাহিদ মল্ল, শোভনদন্ডীর তোরপাচ মল্ল, কাঞ্চননগরের আদম মল্ল, ঈশ্বরখাইনের গনি মল্ল, সৈয়দপুরের কাসিম মল্ল, পোপাদিয়ার যুগী মল্ল, খিতাপচরের খিতাপ মল্ল, ইমামচরের ইমাম মল্ল, নাইখাইনের বোতাত মল্ল, মাহাতার এয়াছিন মল্ল, হুলাইনের হিম মল্ল, গৈরলার চুয়ান মল্ল।[26]
এখন পেশাদার বলির (কুস্তিগির) অভাবে বলিখেলার তেমন আকর্ষণ না থাকলেও জব্বারের বলীখেলার মূল উপজীব্য হয়ে উঠেছে মেলা। তাই অনেকে বলীখেলার পরিবর্তে একে বৈশাখী মেলা হিসেবেই চিনে। জব্বার মিয়ার বলী খেলা ও বৈশাখী মেলা চট্টগ্রামের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও অহংকারে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে দেশের সবচেয়ে বড় লোকজ উৎসব হিসেবে এটিকে চিহ্নিত করা হয়। খেলাকে কেন্দ্র করে তিন দিনের আনুষ্ঠানিক মেলা বসার কথা থাকলেও কার্যত পাঁচ-ছয় দিনের মেলা বসে লালদীঘির ময়দানের চারপাশের এলাকা ঘিরে। জব্বারের বলী খেলার পাশাপাশি জেলার বিভিন্ন স্থানে যেমন কক্সবাজারে ডিসি সাহেবের বলী খেলা, সাতকানিয়ায় মক্কার বলী খেলা, আনোয়ারায় সরকারের বলী খেলা, রাউজানে দোস্ত মোহাম্মদের বলী খেলা, হাটহাজারীতে চুরখাঁর বলী খেলা, চান্দগাঁওতে মৌলভীর বলী খেলা এখনও কোনরকমে বিদ্যমান।
টোপাভাতি বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের মেয়েদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি খেলা।[27] সাধারনত শিশুরা এই খেলা খেলে থাকে। টোপা মানে হাঁড়ি বা রান্না করার বাসন এবং ভাতি হলো ভাত রান্না করা।[28] এজন্য রান্না করার এ খেলাকে টোপাভাতি বলা হয়।
প্রথমে শিশুরা পাটকাঠি বা বাঁশের কঞ্চি দিয়ে ছোট ঘর তৈরি করে। এরপর এর উপরে গাছের পাতা, কলা পাতা অথবা পলিথিন দিয়ে ছাউনি দেয়। প্রথমে একজনকে কাছেই কোথাও কাল্পনিক বাজারে পাঠানো হয়। সে বাজার থেকে বিভিন্ন কাল্পনিক জিনিসপত্র বাজার করে আনে। সাধারনত গাছের পাতা তরকারি হিসেবে, বালু ভাত হিসেবে বাজার থেকে নিয়ে আসে। বাজার করার সময় কাঁঠাল গাছের পাতা টাকা হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এরপর একজন সেসব জিনিসপত্র রান্না করে সবাইকে খেতে দেয়। শিশুরা রান্নার জন্য সাধারনত খেলনা হাড়ি-পাতিল ব্যবহার করে। খাওয়ার সময় থাল হিসেবেও গাছের পাতা ব্যবহার করে থাকে। এই খেলার মধ্যে গ্রাম বাংলার পারিবারিক আবহ ফুটে উঠে।
দাড়িয়াবান্ধা বাংলাদেশের গ্রামীণ খেলাধুলার মধ্যে একটি পরিচিত খেলা।[10] বাংলাদেশের জাতীয় খেলা হাডুডুর মতোই সকল অঞ্চলের আরেকটি জনপ্রিয় খেলা। এ দেশের সর্বত্র স্থানীয় নিয়ম কানুন অনুযায়ী এ খেলা হয়ে থাকে। জাতীয় রিক্রিয়েশন এ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশের জন্য এ খেলার গ্রহণ যোগ্য আইন কানুন প্রণয়ন করেছে। প্রায় সব এলাকার শিশুরাই এ খেলাটি খেলতে পছন্দ করে। ছেলে, মেয়ে, এমনকি বড়দেরও এ খেলায় অংশ নিতে দেখা যায়।
এ খেলার মাঠটি ৫০ ফুট লম্বা ও ২০ ফুট প্রস্থে, মাঝখানে সমান্তরাল ৫০ ফুট লম্বা ও ১ ফুট চওড়া একটি লাইন থাকবে। ১ ফুট অন্তর আড়াআড়ি ৪টি লাইনে সমগ্র কোর্টটি ১০ইঞ্চি/১০টি খোপে ভাগ করা থাকবে। আড়াআড়ি ৬টি লাইন ১ ফুট চওড়া হবে।
প্রত্যেক দলে ৬ জন করে খেলোয়াড় থাকে। টস করে আক্রমণকারী ও প্রতিরক্ষাকারী স্থির করা হয়। ২৫ মিনিট খেলা, ৫ মিনিট বিশ্রাম, পুনরায় ২৫ মিনিট খেলা-এই নিয়মে খেলা চলে। খেলার সময় একজন মারা পড়লে অন্যদলের অর্ধাংশ আক্রমণ করার সুযোগ পাবে। খেলায় একজন রেফারী ৬ বা ১২ জন দাড়িয়া জজ ও ২ জন স্কোরার থাকে। খেলার ফলাফল অমীমাংসিত থাকলে ১০-১-১০ মিনিট পুনরায় খেলে খেলার ফলাফল নির্ধারিত করা যায়।
প্রথমে মাটিতে দাগ কেটে ঘর তৈরি করা হয়। ঘর দেখতে অনেকটা ব্যাডমিন্টনের কোর্টের মতো। দুই দলে চার-পাঁচজন করে খেলোয়াড় হলে জমে। কম হলেও দুজন করে খেলোয়াড় লাগবেই। সমতলভূমিতে কোদাল দিয়ে দাগ কেটে ঘর কাটা যায়। বর্গাকার একটি ঘরে সামনে-পেছনে সমান দূরত্বে দুটি করে দাগ কাটতে হয়। এ দুই দাগের মাঝে এক হাত পরিমাণ জায়গা রাখতে হয়। এগুলোকে বলে আড়া কোর্ট। দুটি আড়া কোর্ট জোড়া দিয়ে মাঝখানে একটি কোর্ট তৈরি করা হয়। মাঝখানের এই কোর্টকে বলে 'খাড়া কোর্ট'। খেলোয়াড় যত বেশি হবে, কোর্টের সংখ্যাও তত বাড়বে। প্রতিটি আড়া কোর্টে একজন করে খেলোয়াড় দাঁড়ায়। এখানেই দাঁড়িয়ে অন্য দলের খেলোয়াড়দের ঘরের ভেতর ঢুকতে বাধা দেয়। কোর্টের ওপর বা ঘরের ভেতর অন্য দলের খেলোয়াড়কে ছুঁতে পারলে সে মারা পড়ে। সামনের খেলোয়াড় তার পেছনের খাড়া কোর্ট ব্যবহার করতে পারে। যে দল খেলার সুযোগ পায়, তারা সামনের ঘর দিয়ে ঢুকে পেছনের ঘর দিয়ে বেরোতে থাকে। সব ঘর পেরোনোর পর আবার পেছনের ঘর থেকে সামনে আসে। কোর্টে দাঁড়িয়ে থাকা অন্য দলের খেলোয়াড়দের ছোঁয়া বাঁচিয়ে সবাই ফিরে আসতে পারলে গেম হয়। যারা কোর্টে দাঁড়িয়ে থাকে, তাদের খেলোয়াড়দের কারো পা যদি দাগে পড়ে তবে তারা ঘর ছেড়ে দেয়। অন্য দল ঘরে দাঁড়ানোর সুযোগ পাবে। এভাবে অনেক সময় ধরে খেলাটি খেলা যায়। দাড়িয়াবান্ধার কোর্টের সঠিক কোনো মাপ নেই। একজন খেলোয়াড় দৌড়ে কতটুকু ঘর সামলাতে পারবে, তার ওপর ভিত্তি করে ঘর কাটা হয়। তবে সব ঘরের গঠন একই থাকে।
অন্যভাবে বলা যায়, ছক বাধা ঘর দাড়িয়াবান্ধার আসল বৈশিষ্ট্য। খেলা হয় দুটি দলের মধ্যে। প্রত্যেক দলে ৫/৬ থেকে শুরু করে ৮/৯ জন পর্যন্ত খেলোয়াড় থাকে। খেলা শুরুর আগেই মাটির উপর দাগ কেটে ঘরের সীমানা নির্ধারণ করা হয়। খেলায় ঘরের সীমানার বাধ্যবাধকতা থাকায়, দ্রুত দৌড়ের চেয়ে কৌশল ও প্যাঁচের কসরত জানতে হয় বেশি। ১ নম্বর ঘরকে কোন কোন অঞ্চলে বদন ঘর, ফুল ঘর বা গদি ঘর বলে। ২ নম্বর ঘরটি লবণ ঘর বা পাকা ঘর বা নুন কোট নামে পরিচিত। ঘরগুলোর মাঝ বরাবর যে লম্বা দাগটি থাকে তাকে কোথাও বলে দৌড়েছি, আবার কোথাও বলে শিড়দাড়া বা খাড়াকোট। আর প্রস্ত বরাবর রেখাগুলোকে বলে পাতাইল কোট। দাড়িয়াবান্ধা খেলার জন্য প্রয়োজন সমতল জমি যেখানে কোদাল দিয়ে কেটে কিম্বা চুন দিয়ে দাগ দিয়ে নিতে হয়।
সমান্তরাল রেখার মধ্যে অন্তত এক হাত জায়গা থাকতে হবে যাতে যে-কোন খেলোয়াড় এই জায়গা দিয়ে যাতায়াত করতে পারে। যাতায়াত করার সময় দাগে যাতে পা না পড়ে সেদিকে খেয়াল রাখতে হয়। অন্য ঘরগুলোতেও খেলোয়াড়ের দাড়ানোর জন্য কমপক্ষে এক হাত পরিমাণ জায়গার লাইন থাকবে। দাগে কারোই পা পড়া চলবে না।খেলার শুরুতে গদি ঘরে একদলের খেলোয়াড়রা অবস্থান নেয়। অন্যেরা প্রতিঘরের সঙ্গে অঙ্কিত লম্বরেখা বরাবর দাঁড়ায়। যেহেতু এই খেলায় ছোঁয়াছুয়ির ব্যাপার আছে, সেজন্যে কোন খেলোয়াড় যদি ছোঁয়া বাঁচিয়ে সব ঘর ঘুরে এসে আবার গদি ঘরে ফিরতে পারে তবে সে এক পয়েন্ট পায়। একদল প্রথমে খেলার সুযোগ পায়, সেই সুযোগকে বলে ঘাই। পয়েন্ট পেলে ঘাই তাদের দখলে থাকে। তবে সব ঘর ঘুরে আসার সময় বিপক্ষের কোন খেলোয়াড় যদি ছুঁয়ে ফেলে তবে পুরো দলই ঘাই হারায়। এভাবে চলতে থাকে খেলা।
সবাই সব ঘর ঘুরে আসার উপর নির্ভর করে খেলার ফলাফল। একজনের অসতর্কতা বা অক্ষমতা পুরো দলকেই ঘাই হারিয়ে বিপক্ষ দলের ভূমিকায় নামায়।
এই খেলায় কোন খরচ লাগে না এবং বেগ, তেজ প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের দরুন এটি দেশের ছোট-বড় সবার জনপ্রিয় খেলা।
নুনতা বাংলাদেশের গ্রাম-গঞ্জের শিশু/ কিশোররা এই খেলা খেলে থাকে। এই খেলা সাধারনত দলবেধে খেলতে হয়। দল যত ভারী হয় খেলা তত মজার হয়। নুনতা খেলায় একজন একটি বৃত্তাকার ঘরের মলিক থাকে এবং তাকে অন্যদের দৌড়ে ধরতে হয়।[10]
নুনতা খেলায় প্রথমে মাটিতে দাগ কেটে বৃত্তাকার ঘর বানানো হয়। এরপর একজনকে “নুনতা” নির্বাচন করা হয় ও সে ঘরের বাইরে থাকে। অন্যরা ঘরের ভেতরে অবস্থান করে। নুনতা ঘরের বাইরে থেকে ছড়া কাটতে থাকে “নুনতা বলোরে”। অন্যরা সমস্বরে বলতে থাকে “এক হলোরে”। এভাবে “নুনতা” সাত পর্যন্ত বলার পর অন্যদের প্রশ্ন জিগ্গেস করে। প্রশ্ন করা শেষ হলে ঘরের ভেতর থেকে সবাই দৌড়ে পালায় ও “নুনতা” সেই ঘর দখল করে।
এরপর “নুনতা” শ্বাস বন্ধ করে গুণ-গুণ শব্দে বা ছড়া কাটতে কাটতে বের হয়ে অন্যদের ধরার চেষ্টা করে। যাকে প্রথম ধরতে পারে সে এসে “নুনতার” সাথে যোগ দিয়ে অন্যদের ধরার চেষ্টা করে আর এভাবেই নুনতার দল ভারী হয়। যে সবার শেষে ধরা পরে, সে পরবর্তী পর্বের জন্য ঘরের মালিক হয়। এখানে উল্লেখ্য “নুনতা” যদি দৌড়ানো অবস্থায় শ্বাস নেয় তাহলে অন্যরা তাকে ছুঁয়ে দেয় এবং ঘেরে পৌঁছানো না পর্যন্ত পিঠে মারতে থাকে। নুনতা খেলার সময় যে ছড়াটি বলতে হয়ঃ
নুনতা বলোরে
এক হলোরে
নুনতা বলোরে
দুই হলোরে....(এভাবে সাত পর্যন্ত)
...আমার ঘরে কে?
-আমি রে।
কি খাস?
-লবণ খাই।
লবণের সের কত?
-এইটা
লবণের দাম দিবি কবে?
-লাল শুক্কুরবারে (শুক্রবার)।
কয় ভাই? কয় বোন?
-পাঁচ ভাই, পাচঁ বোন।
একটা বোন দিয়ে যা..-ছঁতে পারলে নিয়ে যা।
নৌকাবাইচ হলো নদীতে নৌকা চালনার প্রতিযোগিতা। "বাইচ" শব্দটি ফার্সি "বাজি" শব্দজাত যার বিবর্তন এরূপ: বাজি>বাইজ>বাইচ। এর অর্থ খেলা। তবে এখানে দাঁড় টানার কসরত ও নৌকা চালনার কৌশল দ্বারা বিজয় লাভের লক্ষ্যে আমোদ-প্রমোদমূলক প্রতিযোগিতা বোঝায়। একদল মাঝি নিয়ে একেকটি দল গঠিত হয়। এমন অনেকগুলো দলের মধ্যে নৌকা দৌড় বা নৌকা চালনা প্রতিযোগিতাই হল নৌকা বাইচ। ফার্সি শব্দ বাইচ’এর অর্থ বাজি বা খেলা। নৌকার দাঁড় টানা ও নৌকা চালনার কৌশল দিয়ে প্রতিযোগিরা জয়ের জন্য খেলেন বা বাজি ধরেন।[10]
নদীমাতৃক বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, আনন্দ আয়োজন, উৎসব ও খেলাধুলা সবকিছুতেই নদী ও নৌকার সরব আনাগোনা। হাজার বছরের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সংস্করণ বাংলাদেশের নৌকা বাইচ। এক সময় এ দেশে যোগাযোগ ছিল নদী কেন্দ্রিক আর বাহন ছিল নৌকা। এখানে নৌ শিল্পকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে বিভিন্ন শিল্পকেন্দ্র। এসব শিল্পে যুগ যুগ ধরে তৈরি হয় দক্ষ ও অভিজ্ঞ কারিগর। এভাবে একসময় বিভিন্ন নৌযানের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়।
নদীমাতৃক বাংলাদেশে নৌকাবাইচ লোকায়ত বাংলার লোকসংস্কৃতির একটি অংশ। তবে কবে এদেশে গণবিনোদন হিসেবে নৌকাবাইচের প্রচলন হযেছির তার সঠিক ইতিহাস পাওয়া যায় না। "বাইচ" শব্দটির ব্যুৎপত্তি বিবেচনা করে অনুমিত হয়েছে যে মধ্যযুগের মুসলমান নবাব, সুবেদার, ভূস্বামীরা, যাদের নৌবাহিনী, তারা এই প্রতিযোগিতামূলক বিনোদনের সূত্রপাত করেছিলেন। তবে এ বিষয়ে দুটি জনশ্রুতি আছে।
মুসলিম যুগের নবাব-বাদশাহদের আমলে নৌকা বাইচ বেশ জনপ্রিয় ছিল। অনেকে মনে করেন, নবাব বাদশাহদের নৌ বাহিনী থেকেই নৌকা বাইচের গোড়াপত্তন হয়। পূর্ববঙ্গের ভাটি অঞ্চলের রাজ্য জয় ও রাজ্য রক্ষার অন্যতম কৌশল ছিল নৌ শক্তি। বাংলার বার ভূঁইয়ারা নৌ বলেই মোগলদের সাথে যুদ্ধ করেছিলেন। মগ ও হার্মাদ জলদস্যুদের দমনে নৌ শক্তি কার্যকর ভূমিকা রাখে। এসব রণবহর বা নৌবহরে দীর্ঘাকৃতির ছিপ জাতীয় নৌকা থাকত। বর্তমানে নৌকা কেন্দ্রিক নৌবাহিনী নেই।
বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরনের নৌকা দেখা যায়। বাইচের নৌকার গঠন কিছুটা বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। এই নৌকা হয় সরু ও লম্বাটে। লম্বায় যেমন অনেক দঘল ; ঠিক তেমনই চওড়ায় খুবই সরু। কারণ সরু ও লম্বাটে হওয়ার দরুন নদীর পানি কেটে দরতরিয়ে দ্রুত চলতে সক্ষম এবং প্রতিযোগিতার উপযোগী। নৌকার সামনের গলুইটাকে খুব সুন্দর করে সাজানো হয়। তাতে কখনো করা হয় ময়ূরের মুখ, কখনো রাজহাঁস বা অন্য কোনো পাখীর মুখাবয়ব। নৌকাটিতে উজ্জ্বল রঙের কারুকাজ করে বিভিন্ন নকশা তৈরি করা হয়। সর্বোপরি নৌকাটিকে দর্শকের সামনে যথাসম্ভব আকর্ষণীয় করে তোলার চেষ্টা থাকে।
"বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বাইচের নৌকার গঠন" কারুকার্য ও গঠনের দিকে তাকালে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার বাইচের নৌকাগুলোর মধ্যে বৈচিত্র্যতা দেখা যায়। একেক অঞ্চলের নৌকা বাইচের জন্য একেক রকমের নৌকার প্রচলন রয়েছে। ঢাকা, গফরগাঁও, ময়মনসিংহ এ অঞ্চলগুলোতে বাইচের জন্য সাধারণত কোশা নৌকা ব্যবহৃত হয়। এর গঠন সরু এবং লম্বায় প্রায় ১৫০ ফুট থেকে ২০০ ফুট পর্যন্ত হয়। কোশা নৌকার সামনের ও পেছনের অংশ একেবারে সোজা। কোশা নৌকা তৈরিতে শাল, শীল কড়ই, চাম্বুল ইত্যাদি গাছের কাঠ ব্যবহৃত হয়। টাঙ্গাইল ও পাবনায় নৌকা বাইচে সরু ও লম্বা ধরনের ছিপ জাতীয় দ্রুতগতি সম্পন্ন নৌকা ব্যবহৃত হয়। এর গঠনও সাধারণত সরু এবং লম্বায় প্রায় ১৫০ ফুট থেকে ২০০ ফুট পর্যন্ত হয়। এর সামনের দিকটা পানির সাথে মিশে থাকে আর পেছনের অংশটি পানি থেকে প্রায় ৫ ফুট পর্যন্ত উঁচু হয়। এই নৌকায় সামনের ও পেছনের মাথায় চুমকির বিভিন্ন কারুকার্য থাকে। ছিপ জাতীয় বাইচ নৌকা তৈরিতেও শাল, গর্জন, শীল কড়ই, চাম্বুল ইত্যাদি গাছের কাঠ ব্যবহৃত হয়। কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, আজমিরিগঞ্জ ও সিলেট অঞ্চলে বাইচের জন্য সারেঙ্গী নৌকা ব্যবহৃত হয়। এর আকারও কোশা ও ছিপ জাতীয় বাইচ নৌকার মতই সরু লম্বায় প্রায় ১৫০ থেকে ২০০ ফুট তবে এর প্রস্থ একটু বেশি ৫ থেকে ৬ ফুট পর্যন্ত হয়। এর সামনের ও পেছনের দিকটা পানি থেকে দু-তিন ফুট উঁচু থাকে এবং মুখটা হাঁসের মুখের মতো চ্যাপ্টা হয়। চট্টগ্রাম, নোয়াখালী জেলার নিম্নাঞ্চল ও সন্দ্বীপে বাইচের জন্য সাম্পান ব্যবহৃত হয়। সাম্পান দেখতে জাহাজের মতো। ঢাকা ফরিদপুরে ব্যবহৃত হয় গয়না নৌকা। গয়না দৈর্ঘ্যে প্রায় ১০০ ফুট থেকে ১২৫ ফুট মাঝখানে ৮ থেকে৯ ফুট প্রশস্ত। এর সামনের দিকটা পানি থেকে ৩ ফুট ও পেছনের দিকটা পানি থেকে ৪, ৫ ফুট উঁচু হয়।
বাইচের নৌকাগুলোর বিভিন্ন নাম রয়েছে। যেমন, অগ্রদূত, ঝরের পাখি, পঙ্খিরাজ, ময়ূরপঙ্খী, সাইমুন, তুফান মেল, সোনার তরী, দীপরাজ ইত্যাদি।
নৌকায় ওঠার আবার অনেক আনুষ্ঠানিকতা রয়েছে। সকলে পাক-পবিত্র হয়ে গেঞ্জি গায়ে মাথায় একই রঙের রুমাল বেধে নেয়। সবার মধ্যখানে থাকেন নৌকার নির্দেশক। দাঁড়িয়ে থেকে নৌকা চালান পেছনের মাঝিরা। প্রতিটি নৌকায় ৭, ২৫, ৫০ বা ১০০ জন মাঝি থাকতে পারেন।
উপযুক্ত নৌকায় দু’পাশে মাঝিরা সার বেধে বসে পড়ে বৈঠা হাতে। মাঝিদের বৈঠা টানাকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করার জন্য একজন পরিচালক থাকে যাকে বলা হয় গায়েন। সে বসবে নৌকার গলুই-এ। মাঝিরা একত্রে জয়ধ্বনি সহকারে নৌকা ছেড়ে দিয়েই এক সাথে কোনো একটি গান গাইতে আরম্ভ করে এবং সেই গানের তালের ঝোঁকে ঝোঁকে বৈঠা টানে; যার ফলে কারও বৈঠা ঠোকাঠুকি না-লেগে এক সাথে পানিতে অভিঘাত সৃষ্টি করতে থাকে। গায়েন বা পরিচালক কাঁসির শব্দে এই বৈঠার এবং গানের গতি বজায় রাখতে সাহায্য করে। অন্য সব নৌকাকে পেছনে ফেলে নিজেদের নৌকাকে সবার আগে যাওয়ার চেষ্টায় প্রয়োজন বোধে কাঁসির শব্দে বৈঠার গতি বাড়ানোর নির্দেশ দেয়া হয় এবং সেই সাথে গানের গতিও বেড়ে চলে। এ ছাড়া এই সময় দেহ ও মনের উত্তেজনার বশেই গানের মধ্যে 'হৈ, হৈয়া" এই ধরনের শব্দের ব্যবহার দেখা যায়। এটি সারি গানের বিশেষ বৈশিষ্ট্য।
নৌকাবাইচের সময় মাল্লারা সমবেত কণ্ঠে যে গান গায় তা সারি গান নামে অভিহিত। নৌকার মধ্যে ঢোল তবলা নিয়ে গায়েনরা থাকেন। তাদের গানগুলো মাঝিদের উৎসাহ আর শক্তি যোগায়। ঢোল ও করতালের সাথে সাথে নৌকা বাইচে সকল মাঝি মাল্লারা তালে তালে এক সুরে গান গেয়ে ছুটে চলেন। নৌকাবাইচের সময় মাঝি-মাল্লারা সমবেত কণ্ঠে যে গান গায়। একটি জনপ্রিয় সারিগান নিম্নরূপ:
আল্লায় বলিয়া নাও খোল রে ভাই সক্কলি। আল্লাহ বলিয়া খোল। ওরে আল্লা বল নাও খোল শয়তান যাবে দূরে। ওরে যে কলমা পইড়া দেছে মোহাম্মদ রাসূলরে ভাই সক্কল।...
নৌকা বাইচকে উৎসাহ প্রদান ও ঐতিহ্যকে ধরে রাখার লক্ষে প্রতি বছর বাংলাদেশে জাতীয় নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। বাংলাদেশে প্রধানত ভাদ্র-আশ্বিন মাসে নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতা হয়। বাংলাদেশের জাতীয় নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতার দূরত্ব ৬৫০ মিটার। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশের নৌকা বাইচের উন্নয়নের জন্য ‘বাংলাদেশ বোয়িং ফেডারেশন’ গঠিত হয়। সনাতন নৌকা বাইচ ও বোয়িং এর মধ্যে সমন্বয় সাধন করাই বাংলাদেশ বোয়িং ফেডারেশনের কাজ। এ ফেডারেশনটি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক বোয়িং ফেডারেশনের সদস্য। বাংলাদেশ ১৯৯০ সালে একটি আন্তর্জাতিক নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিভিন্ন নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। যেমন, ড্রাগন বোট রেস, বোয়িং বোট রেস, সোয়ান বোট রেস, কাইয়াক ও কেনিয় বোট রেস ইত্যাদি।
পুতুল খেলা বাংলাদেশের গ্রামীণ শিশুদের কাছে অন্যতম জনপ্রিয় খেলা।[29] এটি সাধারনত মেয়েরা বেশি খেলে থাকে। দেশের সর্বত্রই পুতুল খেলা সমান জনপ্রিয়।[30] পুতুল খেলেনি এমন মেয়ে বাংলাদেশে নেই বললো চলে। বর্তমানে পুতুল শৌখিন মানুষের সংগ্রহেরও বস্তু। ফরিদপুর ও ময়মনসিংহ অঞ্চলের দুটি ছড়াগানে পুতুল বিয়ের আনন্দ-বেদনার চমৎকার ছবি ফুটে উঠেছেঃ
চম্পা ফুলের গন্ধে
জামাই আইছে আনন্দে
চম্পা ফুলের সুবাসে
জামাই আইছে আহাসে-(ময়মনসিংহ)
হলদি গুটি গুটি
চিরা কুটি কুটি
আজ ফুতলির বিয়া
ফুতলিরি নিয়া যাবে
ঢাকে বাড়ি দিয়া
ফেসী কান্দে ওসী কান্দে
কান্দে মাইয়ার মা
হোলা বিড়াল কাইন্দা মরেঢোক মেলায় না।
-(ফরিদপুর)
পুতুল সাধারনত মানবাকৃতিতে মাটি, কাঠ অথবা কাপড় দিয়ে তৈরি করা হয়। পুতুল সাধারনত শিশুরা বাড়িতে বসেই তৈরি করে। এছাড়া বিভিন্ন মেলা, যেমন বৈশাখী মেলা, পূজা, রথের মেলা, পৌষ সংক্রান্তি, চড়ক পূজা, শিবরাত্রি, মহররম, ঈদ ইত্যাদি অনুষ্টানের সময় পুতুল বিক্রি করা হয়। এছাড়া বর্তমানে মাটির পুতুলের সাথে সাথে প্লাস্টিকের পুতুলও অনেক পাওয়া যায়।[31]
"নিয়মকানুন" প্রথমে নানা রকমের পুতুল কাপড় অথবা রং দিয়ে সাজানো হয়। এরপর মেয়ে পুতুলকে গয়না দিয়ে কনে সাজানো হয় এবং ছেলে পুতুলকে বর সাজিয়ে শিশুরা তাদের বিয়ে দেয়। রান্না-বান্না, সন্তান লালন-পালন, মেয়ে পুতুলের সাথে ছেলে পুতুলের বিয়ে ইত্যাদি নানা বিষয়ের অভিনয় করেই খেলা হয় পুতুল খেলা। আসলে পুতুল খেলার মধ্যে পুরো সংসারের একটা ছবি ফুটে ওঠে। পুতুলগুলুকে ছোট শিশুরা তাদের সন্তান মনে করে। তারা পুতলদের মায়ের মতই আদর স্নেহ দিয়ে আগলে রাখে। শুধু তাই নয় শিশুরা পুতুলদেরকে আবার শাষণও করে। পুতুল খেলার সবচেয়ে আকর্ষণীয় পর্ব হলো একজনের মেয়ের সঙ্গে আরেক জনের ছেলে পুতুলের বিয়ে দেয়া।
ফুল টোকা বাংলাদেশের গ্রামীণ শিশু কিশোরদের অন্যতম খেলা।[10] বাড়ির আঙ্গিনাতে কিংবা স্কুলের মাঠে মেয়েরা ফুল টোকা খেলে থাকে। শিশু বয়স থেকে কৈশোর পর্যন্ত এই খেলায় অংশ নেয় গ্রামের মেয়েরা। এই খেলায় কোনো উপকরণ লাগে না।
সাইকেল বাজে ক্রিং ক্রিং
বাবুর দোকানে
রাজার বেটির বিয়ে হইছে পাক্কা দালানে
মা দেবে খোঁপা বান্ধে
বাবা দিবে বিয়ে
ফুলের আগায় কড়িদশমনকা ভরি
দলপতি সহ দুই দলে ভাগ হয়ে কিছুটা দূরত্বে মুখোমুখি বসে এই খেলা শুরু করতে হয়। দুই দল নিজেদের খেলোয়াড়দের নাম ফুল অথবা ফলের নামে রেখে থাকে। দলপতি অপর পক্ষের যে কোনো খেলোয়াড়ের চোখ দুইহাতে চেপে ধরে সাংকেতিক নামে তার যে কোনো একজন খেলোয়াড়কে ডাকে। সে খেলোয়াড় এসে চোখ ধরে রাখা খেলোয়াড়টির কপালে আলতো করে টোকা দিয়ে নিজের জায়গায় গিয়ে বসে। চোখ খোলার পর ঐ খেলোয়াড়কে যে টোকা দিয়েছে তাকে শনাক্ত করতে হয়। সফল হলে সে সামনের দিকে লাফ দেবার সুযোগ পায়। এইভাবে যে দলের খেলোয়াড় লাফ দিয়ে প্রথমে সীমানা অতিক্রম করে সেই দলই জয়ী হয়।
বাঘ ছাগল খেলা, গ্রামীণ বাংলাদেশের একটি জনপ্রিয় খেলা। এই খেলা সাধারনত শিশুরা খেলে থাকে।[32] বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে ছেলে ও মেয়ে উভয়ই এ খেলা খেলে থাকে। এই খেলাটি কোন কোন জায়গায় অ্যাঙ্গা অ্যাঙ্গা খেলা নামেও পরিচিত।[33]
বাঘ ছাগল খেলায় প্রথমে মাটিতে দাগ কেটে বৃত্ত তৈরি করা হয়। এরপর দল থেকে একজনকে বাঘ নির্বাচন করা হয় এবং দলের বাকী খেলোয়াড় ছাগল হিসেবে বৃত্তের ভেতর অবস্থান করে। বাঘের কাজ হলো বৃত্তের বাইরে থেকে, বৃত্তের ভেতর আক্রমণ করা এবং একটি ছাগল ছিনিয়ে নেয়া। এভাবে বাঘ একজন একজন করে নিয়ে তার দল ভারী করে। শেষ পর্যন্ত যে ছাগল বৃত্তের ভেতরে টিকে থাকতে পারে, সে পরবর্তী দানের জন্য বাঘ নির্বাচিত হয়।[32]
বাঘ, ছাগদলকে আক্রমণ করার সময় বিভিন্ন রকম কৌশল অবলম্বন করে। এবং কোন ছাগলকে আক্রমণ করলে ছাগদলের অন্য সদস্যরা তাকে টেনে ধরে রাখে। খেলা চলতে থাকে দুই পক্ষের কথোপকথনের মধ্য দিয়ে, বাঘ প্রথমে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলতে থাকে, অ্যাঙ্গা, অ্যাঙ্গা। এরপর ছাগলরা সমস্বরে বলে, “কান্দো ক্যান?” এভাবে কথোপকথনের মাঝেই বাঘ ছাগদলকে আক্রমণ করে।
বাঘঃ অ্যাঙ্গা, অ্যাঙ্গা।
ছাগদলঃ কান্দো ক্যান?
বাঘঃ গরু হারাইছে
ছাগদলঃ কি গরু?
বাঘঃ নাঙ্গা গরু।
ছাগদলঃ শিঙ্গি কী?
বাঘঃ কুষ্টার আঁশ।
ছাগদলঃ একটা গান গাও, শুনি
বাঘঃ এতি চোর, বেতি চোর
চলে আয় আমার স্যায়না চোর।
বাংলাদেশের গ্রামীণ কিশোর ছেলেদের সবচেয়ে আকর্ষণীয় খেলা মার্বেল।[10] কোন কোন অঞ্চলে মার্বেল খেলাকে বিঘত খেলাও বলে। সম্ভবত অভিভাবকদের নিষেধাজ্ঞাই এই খেলার প্রতি কিশোরদের অদম্য আকর্ষণ সৃষ্টি করে। এই খেলার নিষ্পত্তি হয় অন্যের মার্বেল খেলে জিতে নিজের করে নেবার মাধ্যমে।
মার্বেল খেলার জন্য কমপক্ষে দুইজন খেলোয়াড় দরকার হয়। তিন, চার, পাঁচ, বা সাতজন মিলেও খেলা যায়। পরিষ্কার সমতল ভুমি এই খেলার জন্য উপযোগী। প্রথমে দুইটি একটি রেখা টানতে হয়। রেখা থেকে চার-পাঁচ হাত দূরে একটি গর্ত করতে হয় যেন একটি মার্বেল সেই গর্তে বসতে পারে। আঞ্চলিক ভাষায় রেখাটিকে ‘জল্লা’(কোথাও ‘জই’ নামে পরিচিত) এবং গর্তটিকে ‘কেপ’ বলে। জল্লার বাইরে পা রেখে প্রত্যেকে একটি করে মার্বেল কেপ এ ফেলার চেষ্টা করে। যার মার্বেল কেপ এ পড়ে বা সবচেয়ে কাছে যায় সে প্রথম দান পায়। সবাই প্রথম যে দান পায় তার হাতে ২/৩/৪টি করে মার্বেল জমা দেয়। সে মার্বেলগুলো ছকের বাইরে বসে সামনের দিকে ওই গর্তের আশপাশে আলতো করে ছড়িয়ে দেয়। এরপর অন্য খেলোয়াড়রা একটা নির্দিষ্ট মার্বেলকে বলে ‘বাদ’। অর্থাৎ ওই মার্বেল ছাড়া বাকি যে কোন একটি মার্বেলকে অন্য একটি মার্বেল ছেড়ে দিয়ে স্পর্শ করতে হবে। যদি এমনটা পারে তাহলে ওই দান সে জিতে যায়। আর না পারলে পরবর্তী জন একইভাবে খেলার সুযোগ পায়। তবে ‘বাদ’ দেয়া মার্বেল কিংবা অন্য একাধিক মার্বেলকে ছুড়ে দেয়া মার্বেল স্পর্শ করলে ওই খেলোয়াড়কে ফাইন দিতে হয়। এবং দান জেতার জন্য পরবর্তী খেলোয়াড় ফাইন হওয়া মার্বেলসহ সেগুলো ছড়িয়ে দিয়ে খেলতে থাকে। যে কেউ দান জিতলে আবার পুনরায় খেলা শুরু হয়। এভাবেই চলতে থাকে যতক্ষণ না প্রতিপক্ষ আত্মসমর্পণ করে কিংবা তার কাছের মার্বেল শেষ না হয়ে যায়।
মোরগ লড়াই বাংলাদেশ ও ভারতবর্ষের পশ্চিমবঙ্গে বিভিন্ন বিদ্যালয়ের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় এই খেলা আয়োজন করা হয়ে থাকে।[34] এটি সাধারনত ছেলেদের খেলা।[35] গ্রামাঞ্চলের ছেলেদের কাছে এটি অতন্ত্য জনপ্রিয় একটি খেলা।
মোরগ লড়াই খেলায় একদল ছেলে গোল হয়ে একপায়ে দাড়িয়ে থাকে। দুই হাত দিয়ে অপর পা পিছনে ভাজ করে রাখতে হয়। রেফারি যখন বাশিঁতে ফুঁ দেন তখনই খেলোয়াড়রা একে অপরকে ভাজ করা পা দিয়ে মারতে থাকে। কেউ পরে গেলে সে বাতিল বলে গণ্য হয়। এভাবে শেষ পর্যন্ত তিনজন থাকে। তাদের মধ্য থেকে ১ম, ২য় ও ৩য় নির্ধারন করা হয়।
লাটিম বাংলাদেশের অন্যতম একটি গ্রামীণ খেলার উপকরণ।[10]
আগে সুতার মিস্ত্রিরাই গ্রামের কিশোরদেরকে লাটিম বানিয়ে দিতো। তারা সাধারণত পেয়ারা ও গাব গাছের ডাল দিয়ে এই লাটিম তৈরি করতো। নির্বাচিত পাট থেকে লাটিমের জন্য লতি বা ফিতা বানানো হতো। বর্তমানে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে তুলাজাতীয় নরম কাঠ দিয়ে লাটিম এবং গেঞ্জির কাপড় দিয়ে লাটিমের ফিতা বানানো হয়।
লৌহশলাকাকে অক্ষ বানিয়ে কাঠের বানানো গোলকটিকে খেলোয়াড় ২-৩ হাত দীর্ঘ এক টুকরো দড়ি বা সূতলি দিয়ে অক্ষশীর্ষ থেকে ক্রমশ গোলকটির নিম্নার্ধ সুষমভাবে পেঁচিয়ে হাতের প্রধানত তর্জনী ও বৃদ্ধঙ্গুল ব্যবহার ক'রে উঁচু থেকে ছুঁড়ে মাটি বা কিছুর তলে ঘুরায়।
সাধারণত তিন ধরনের লাটিম খেলা হয়। ১। বেল্লাপার ২। ঘরকোপ ৩। ঘুরতি কোপ
বেল্লাপারে একটি দাগ কেটে সীমানা চিহ্নিত করা হয়। প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় নির্ধারণী খেলায় যে লাটিম পরাজিত হয় তাকে ঘর থেকে নিজেদের লাটিম দিয়ে আঘাত করে করে প্রতিযোগিরা সীমানা পার করে দেয়। ঘুর্ণায়মান লাটিম হাতে নিয়েও প্রতিযোগী লাটিমকে আঘাত করা যায়। মাটিতে রাখা লাটিমকে আঘাত করতে ব্যর্থ হলে ঐ লাটিমের স্থানে ব্যর্থ লাটিমকে রাখা হয় এবং তাকে বেল্লা পার করা হয়। শর্ত অনুযায়ী সীমানা পার করা লাটিমকে নিজের লাটিম বা দা দিয়ে কোপ দেওয়া হয়।
লাটিমের ফিতা ও লাটিম দিয়ে একটি বৃত্ত আঁকার পর বৃত্তের ভিতর বন্দী লাটিমগুলোকে রাখা হয়। বৃত্তের ভিতরের লাটিমগুলিকে বাইরের মুক্ত প্রতিযোগীদের লাটিম দিয়ে আঘাত বা কোপ মেরে ক্ষত করাই এই লাটিম খেলার উদ্দেশ্য। ঘুরতি কোপ:প্রতিযোগীদের মধ্যে একজন লাটিম ঘুরিয়ে দেয় আর অন্যরা তাদের লাটিম ঘুরিয়ে ওটাকে আঘাত করার চেষ্টা করে।এভাবে সবাই একবার করে ঘোরায়।
লুডু খেলা বাংলাদেশে অন্যতম বিনোদন হিসেবে বিবেচিত।[10] ঘরের বিছানায় অথবা মাটিতে মাদুর পেতে কৈশোর অতিক্রান্ত ছেলে মেয়েরা এ খেলাটি খেলে থাকে। এই খেলাটির সরঞ্জাম বাণিজ্যিক ভিত্তিতে উৎপাদন করা হয়। গ্রামের বিবাহিত মহিলারাও অবসর সময়ে এই খেলাটি খেলে থাকে।
লুডু বিভিন্ন প্ৰকার হয়ে থাকে। যে সকল লুডু খেলার প্ৰচলন বাংলাদেশে দেখা যায় তা হলোঃ
এই খেলায় প্রতিটি প্রতিযোগির চারটা করে গুটি থাকে, প্রতিটি খেলোয়াড় একটি নির্দিষ্ট ঘর দখল করে। যে প্রতিযোগী ডাই চেলে প্রথম ছক্কা ফেলতে পারে সে'ই তার ঘর থেকে গুটি বের করে যাত্রা শুরু করতে পারে। প্রতিটি প্রতিযোগীকে এভাবে ঘর থেকে বের হয়ে পুরো ছক অতিক্রম করে নিজের ঘরে ফিরে এসে গুটি পাকাতে হয়। সবশেষে যার সবগুলো গুটি নির্দিষ্ট ঘরে পৌছায় সে বিজয়ী হয়।
লুডু খেলার ছকের পেছনে সাপ খেলার ঘর আঁকা থাকে। এই খেলায় যে প্রতিযোগী ডাই চেলে প্রথমে ১ (এক) ফেলতে পারে সে ঘর থেকে বের হবার সুযোগ পায়। এক থেকে একশ পর্যন্ত যে প্রতিযোগী যেতে পারে সে'ই জয়ী হয়। যে গুটি সাপের মুখে এসে পড়ে সাপ তাকে কেটে দেয় অর্থাৎ সাপের মুখ থেকে লেজ অঙ্কিত ঘরে পিছিয়ে আসে এবং যে গুটি মই এর গোড়া অঙ্কিত ঘরে আসে সেটি মই বেয়ে মই এর উপরের ঘরটিতে পৌঁছে যায়।
"পৃথিবী ভ্ৰমণ লুডু" পৃথিবী ভ্ৰমণ লুডুর মাধ্যমে বিশ্বকে জানা যায়। এ লুডুও একইভাবে খেলা হয়। বোর্ডে উড়োজাহাজ, ট্ৰেন, বাস ইত্যাদির উল্লেখ থাকে। ছক্কায় এক ফোঁটা উঠলে গুটি ঘর থেকে বের হবে। এরপরে ছক্কায় যে নম্বরের ফোঁটা উঠবে সে নম্বরের সাহায্যে খেলোয়াড় সেই দেশে যাবে। এভাবে একটি নির্দিষ্ট জায়গা থেকে শুরু করে সারা পৃথিবী ঘুরে যে সকলের আগে পাক্কা ঘরে পৌঁছাবে সেই জয়ী হবে।
ষোল গুটি বাংলাদেশের গ্রামীণ পুরুষদের অন্যতম প্রধান খেলা।[10] অলস অবসরে গ্রামের যুবক ও মধ্যবয়সী পুরুষেরা ষোলগুটি খেলে। মাটিতে দাগ কেটে শুকনো ডাল ভেঙ্গে গুটি বানিয়ে চলে এই দীর্ঘমেয়াদি খেলা। খেলার এত সহজ সরঞ্জাম গ্রামবাসীর উৎসব মুখর মনের বহিঃপ্রকাশকেই প্রমাণ করে।
সাধারণত মাটিতে দাগ কেটে ষোল গুটির ঘর বানানো হয়। প্রতি পক্ষেই ১৬টি করে গুটি থাকে। শুধু ঘরের মাঝখানের দাগটি দান চালার জন্য খালি থাকে। কোনাকুনি দাগের গুটিগুলো সারা ঘর জুড়ে এক ঘর করে কোনাকুনি খেতে পারে। উলম্ব দাগ কাটা ঘরের গুটিগুলো লম্বভাবে এক ঘর করে খেতে পারে। অপর পক্ষের গুটিকে ডিঙ্গাতে পারলেই সে গুটি কাটা পড়ে। এই ভাবে প্রতিপক্ষের গুটির সংখ্যা কমিয়ে শূন্য করে ফেলতে পারলেই খেলা শেষ হয়ে যায়। তবে অঞ্চলভেদে ১৩টি কিংবা নির্দিষ্ট সংখ্যক গুটি খেয়ে ফেলতে পারলেই খেলা শেষ হয়ে যায়। সেক্ষেত্রে খেলা শুরুর আগেই সংখ্যাটি ঠিক করে নেয়া হয়। ষোল গুটির আর একটি রূপান্তর হলো বাঘ ছাগল খেলা। এক পক্ষ ষোলটি গুটি নেয় এবং অন্য পক্ষ একটি গুটি নিয়ে বাঘ ছাগল খেলা খেলে। একটি গুটিকে বাঘ এবং ষোলটি গুটিকে ছাগল বলে। বাঘের কোনাকুনি এবং লম্বালম্বি সব ধরনের গতিই বৈধ। ছাগল বা ষোল গুটির চাল অন্য খেলার মতই। ১৬ গুটি দিয়ে বাঘের চাল বন্ধ করে দিতে পারলেই খেলা শেষ হয়ে যায়। আর বাঘ চেষ্টা করে প্রতিপক্ষের সবগুলো গুটিকে খেয়ে নিতে। ১৬ গুটি খেলাটির সবচেয়ে আধুনিক সংস্করন বর্তমানে আন্ড্রয়েড প্লাটফর্মের জন্য ডেভেলাপ করা হয়েছে। এই অ্যাপ্লিকেশনটি গুগল প্লে স্টোর থেকে সংগ্রহ করা যাবে।
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.