মিশরের আদি রাজত্ব (ইংরেজি - Early Dynastic Period ; জার্মান - Frühdynastische Periode ; ৩১০০ - ২৬৮৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) বলতে মিশরের ইতিহাসের প্রাচীনতম ঐতিহাসিক সময়কে সাধারণভাবে বোঝানো হয়ে থাকে। উত্তর ও দক্ষিণ মিশরের ঐক্যবদ্ধ হয়ে একটি একক রাজ্য গড়ে ওঠার সময়কালকে (৩১০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) এর সূচনাপর্ব ধরা হয়ে থাকে ও তৃতীয় রাজবংশের তথা পুরাতন রাজত্বের সূচনা পর্যন্ত সাধারণভাবে এর ব্যাপ্তি ছিল বলে ধারণা করা হয়।[1] মিশরের প্রথম ও দ্বিতীয় রাজবংশের রাজত্বকালকে এই যুগের অন্তর্ভুক্ত হিসেবে গণ্য করা হয়।[2] এই সময়ের প্রথমদিকে মিশরের রাজধানী ছিল তিথনিস। পরবর্তীকালে প্রথম রাজবংশের আমলে তা মেমফিসে সরিয়ে আনা হয়।
সূচনা
উচ্চ ও নিম্ন মিশর তথা দক্ষিণ ও উত্তর মিশরের একত্রীকরণের মাধ্যমে এই ঐতিহাসিক সময়পর্বের সূচনা। ফারাও মেনেসের রাজত্বকালেই এই ঐক্য সাধিত হয়। খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকের মিশরীয় সন্ন্যাসী মানেথো'র এগিপটিয়াকা ("মিশরের ইতিহাস") থেকেও এই তথ্যই সমর্থিত হয়। তবে আধুনিক ঐতিহাসিকরা তার সঠিক পরিচয় নিয়ে নিশ্চিত হতে পারেননি। অনেকে তাকে তৃতীয় নাকাদা সংস্কৃতিকালীন নৃপতি নারমের বলে মনে করে থাকেন।[3][4][5] আবার কারুর মতে প্রথম রাজবংশের ফারাও হোর-আহা ও মেনেস একই মানুষ।[6] সেই হিসেবে অনেকেই তাকেই প্রথম রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবেও মনে করে থাকেন।[7] যাই হোক না কেন, মিশরীয় ঐতিহ্য অনুসারে তাকে পরবর্তী ৩০০০ বছর স্থায়ী ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসেবে মিশর শাসন করা ফারাওদের প্রথমজন বলে গণ্য করা হয়।
রেডিওকার্বন পদ্ধতিতে প্রাপ্ত তথ্য থেকে গবেষকরা আজ অনেকটাই নিশ্চিত যে মিশরের আদি রাজত্বকালীন প্রথম রাজবংশভুক্ত বা তার আগের রাজবংশপূর্ব যে বিভিন্ন ফারাওয়ের সম্পর্কে আমরা জানতে পারি, তাদের নির্দিষ্ট সময়কাল ও ক্রমপর্যায় সম্পর্কে আমাদের ধারণার বেশ কিছু সংশোধনের প্রয়োজন আছে।[8]
প্রথম রাজবংশ
মূল নিবন্ধ - প্রথম রাজবংশ
প্রথম রাজবংশের ফারাওদের ক্রমতালিকা সম্বন্ধে আজ ঐতিহাসিকরা অনেকটাই নিশ্চিত। এই রাজবংশের প্রথম ফারাও ছিলেন মেনেস অথবা নারমের, শেষ শাসক ছিলেন কা। এই বংশের আটজন নৃপতির কথা জানতে পারা যায়। এঁদের সকলেই আবিডোসে সমাধিস্থ হন। এই রাজবংশের প্রায় শেষ পর্যন্ত ঐতিহ্যানুসারে রাজার মৃত্যুর পর তার নিকটাত্মীয় ও বিশ্বস্ত কর্মচারীদেরও রাজার সাথে পাঠানো হত। রাজার কবরের পাশেই ছোট ছোট বর্গাকার কবরে রাজার সমাধিস্থলেই তাদেরও স্থান হত।
এই রাজবংশের আমলে মেয়েদেরও যে যথেষ্ট গুরুত্ব ছিল, তার প্রমাণ রাণী মেরিৎনেইত; ফারাও ডেনের আমলে তার যে কতটা গুরুত্ব ছিল তা আন্দাজ করা যায় তার সমাধি থেকে। সমাধিটি যথেষ্ট বড়; তার উপর তার নিজস্ব ব্যক্তিগত চিহ্ন (পিনতাদেরা) এবং ধর্মীয় আচার ও রীতি পালনের জন্য নিজস্ব জায়গা; সমাধিস্থলটিও যথেষ্ট বড়, পৃথক ও রাজকীয়[9] - এ'সব কিছুই তার পৃথক রাজকীয় মর্যাদারই ইঙ্গিতবাহী।[10] এর থেকে ঐতিহাসিকরা আন্দাজ করেন যে ফারাও ডেন'এর অল্পবয়সে একটা উল্লেখযোগ্য সময় ফারাও'এর হয়ে তিনিই হয়তো রাজকীয় কাজকর্ম দেখাশুনো করতেন।[10] সেই কারণেই হয়তো ফারাও ডেন তার মাকে সিংহাসনের যুগ্ম অধিকারীর সম্মান প্রদান করেছিলেন। অবশ্য মিশরের ইতিহাসে এ'রকম ঘটনার উদাহরণ আমরা পরেও দেখতে পাই, যেমন দ্বাদশ রাজবংশের রাণী নোফ্রুসোবেক বা অষ্টাদশ রাজবংশের রাণী হাতশেপসুত।[11]
মিশরের প্রথম রাজবংশের শাসনকাল নানা কারণে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। এইসময় প্রশাসনিক বহু রীতির প্রথম প্রচলন ঘটে; নতুন নতুন প্রশাসনিক পদ্ধতির প্রয়োগও দেখতে পাওয়া যায়। যেমন, এইসময় থেকেই গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক অধিকর্তা ও রাজকীয় পরিবারের সদস্যদের জন্য হা-তিয়া (প্রাদেশিক গভর্নর), ইরি-পাৎ, আজ-মের, প্রভৃতি সম্মানসূচক পদবী ও পদ প্রচলিত হয়। ফারাও হোর-ডেন রাজকীয় উপাধির প্রচলন করে নিসুত-বিতি উপাধি গ্রহণ করেন; তার উত্তরাধিকারী ফারাও আনেজিব এই উপাধিকেই কিছুটা পরিবর্তন করে নেবুই হিসেবে পরিচিত হন। প্রথম রাজবংশের প্রত্যেক শাসকই নিজেদের জন্য আলাদা আলাদা রাজকীয় প্রাসাদ নির্মাণ করান। সুনির্দিষ্ট বৈদেশিক নীতির রূপায়নের নজিরও আমরা এই আমলে লক্ষ করি। পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন সাম্রাজ্য, যেমন সিরিয়া, নুবিয়া বা লেভান্তের সঙ্গে সম্পর্কের নিরিখে এই সম্পর্ক নির্ধারিত হত। পশ্চিম দিকের প্রতিবেশী লিবীয়দের সাথে এইসময় মিশরের যুদ্ধবিগ্রহ ছিল একপ্রকার নৈমিত্তিক ঘটনা।
মিশরবিদরা অনেকেই সন্দেহ করেন, প্রথম রাজবংশের শেষের দিকে সিংহাসন নিয়ে দ্বন্দ্ব শুরু হয়; এর পরিণামেই আবিডোসের রাজকীয় সমাধিক্ষেত্র এইসময় লুটের শিকার হয়।[12] এইসময় সিংহাসনে বসেন কিছু অখ্যাতনামা ফারাও, যেমন স্নেফেরকা, সেখেৎ বা হোরাস-বা; এঁদের সম্বন্ধে আমরা খুব একটা কিছু জানি না।
দ্বিতীয় রাজবংশ
দ্বিতীয় রাজবংশের সূচনাকালে পরপর তিনজন ফারাও সম্পর্কে মিশরবিদরা অনেকটাই নিশ্চিত; এঁদের মধ্যে প্রথমজন ছিলেন হোতেপসেখেমুই; তারপরে সিংহাসনে বসেন ফারাও নেবরে ও শেষে ক্ষমতায় আসেন নিনেতিয়ের; তৃতীয়জনের মৃত্যুর পর সিংহাসন নিয়ে দ্বন্দ্ব পুনরায় মাথা চাড়া দেয় বলে ঐতিহাসিকরা অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করে থাকেন।[12][13]
ভোলফগাং হেলক, ওয়াল্টার ব্রায়ান এমেরি, হেরমান এ. শ্ল্যোগল, ইউর্গেন ফন বেকেরট, প্রমুখ মিশরবিদদের মতে দ্বিতীয় রাজবংশের আমলে মিশর দু'টি পৃথক সাম্রাজ্যে বিভক্ত হয়ে পড়ে; উচ্চ ও নিম্নমিশর প্রশাসনিকভাবে বিচ্ছিন্ন ও স্বতন্ত্র সাম্রাজ্যে পরিণত হয়। সেনেড, সেথ-পেরিবসেন এবং সেখেমিব-পেরেনমাৎ'এর মতো ফারাওরা শুধুমাত্র উচ্চমিশরে রাজত্ব করেন; তাদের ক্ষমতার কেন্দ্র ছিল আবিডোস; অন্যদিকে একইসময়ে সেনেফেরকা, নেফেরকারে/ আকা, হুদিয়েফা বা নেফেরকাসোকার, প্রমুখ ফারাওরা নিম্নমিশরে রাজত্ব করেন ও মেমফিসকে তাদের শাসনকেন্দ্র হিসেবে বেছে নেন। এই অনুমানের অন্যতম ভিত্তি হল ফারাও সেখেমিব ও পেরিবসেন'এর নামাঙ্কিত কিছু কাদামাটি নির্মিত শীলমোহর; উচ্চ ও নিম্ন মিশরের মধ্যে প্রশাসনিক বিভাজন এখানে সুনির্দিষ্টভাবে উল্লিখিত। যেমন উপরিউক্ত শীলগুলিতে রাজকীয় শীলমোহর ব্যবহারের অধিকারীদের সুস্পষ্টভাবে "উচ্চমিশরের ফারাও'এর প্রতিনিধি" ও উচ্চ আধিকারিকদের "উচ্চমিশরের ফারাও'এর ভৃত্য" হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।[12][13][14][15]
তথ্যসূত্র
Wikiwand in your browser!
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.