কলকাতা ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের রাজধানী, সর্ববৃহৎ শহর ও প্রধান বন্দর হিসেবে বিরাজমান। এটি ১৯১১ সালের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী ছিল। পরবর্তীকালে এটা অবিভক্ত বাংলা প্রদেশের রাজধানী হয়। শুধুমাত্র লন্ডনের পরই দ্বিতীয় স্থানে অবস্থিত এটাকে ‘সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় নগর’ হিসেবে বিবেচনা করা হতো। এর নিজস্ব মার্জিত ঔপনিবেশিক স্থাপত্যের জন্য কলকাতাকে ‘প্রাসাদ নগরী’ও বলা হতো। বঙ্গোপসাগর থেকে প্রায় ১৩৮ কিলোমিটার উত্তর দিকে হুগলি (ভাগীরথী) নদীর বাম (পূর্ব) তীরে অবস্থিত এটি অন্য তিন দিকে থেকে উত্তর চব্বিশ পরগণা জেলা এবং দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার দ্বারা বেষ্টিত।

ফোর্ট উইলিয়াম, কলকাতা, উইলিয়াম উড অঙ্কিত, ১৮২৮ খ্রি.

নামের উৎস

Thumb
কালীঘাট মন্দির, ১৮৮৭ খ্রি.; একটি মতে, "কালীক্ষেত্র" শব্দটি থেকে "কলিকাতা" নামটির উৎপত্তি

সপ্তাদশ শতাব্দীর শতাব্দীর শেষভাগে সুতানুটি, ডিহি কলিকাতাগোবিন্দপুর নামে তিনটি গ্রাম নিয়ে কলকাতা শহরটি গড়ে ওঠে। এর মধ্যে ডিহি কলিকাতা নামটি থেকে কলকাতা নামটির উৎপত্তি।[1]

"কলিকাতা" বা "কলকাতা" নামটির উৎপত্তি সম্পর্কে গবেষকদের মধ্যে মতান্তর রয়েছে:

  • একটি মতে, "কালীক্ষেত্র" (হিন্দু দেবী কালীর ক্ষেত্র) নামটি থেকে "কলিকাতা" বা "কলকাতা" নামটির উৎপত্তি।
  • কালীঘাট মন্দিরের কর্তৃপক্ষের মতে, "কালীঘাট" (হিন্দু দেবী কালীর ঘাট) থেকে "কলিকাতা" বা "কলকাতা" নামটির উৎপত্তি।[2]
  • মতান্তরে, "কিলকিলা" (অর্থাৎ,"চ্যাপ্টা এলাকা") কথাটি থেকে "কলিকাতা" নামটির উৎপত্তি হয়।[3]
  • অন্য এক মতে খালকাটা শব্দ দুটির বিকৃতির ফলে কলকাতা নামটির উৎপত্তি ঘটে।[4]
  • অপর মতে, এই অঞ্চলটি কলিচুনকাতা (নারকেল ছোবড়ার আঁশ) উৎপাদনের জন্য বিশেষভাবে পরিচিত ছিল। সেই থেকেই কলিকাতা নামটির উৎপত্তি ঘটে।[3]

বাংলায় কলিকাতা বা কলকাতা নামটি প্রচলিত হলেও ইংরেজি ভাষায় এই শহর আগে ক্যালকাটা (লাতিন লিপি: Calcutta) নামে পরিচিত ছিল। ২০০১ সালে নামের বাংলা উচ্চারণের সঙ্গে সমতা রেখে ইংরেজিতেও শহরের নাম কোলকাটা (লাতিন লিপি: Kolkata) রাখা হয়।[5]

প্রাক-ব্রিটিশ যুগ

কলকাতার নিকটবর্তী চন্দ্রকেতুগড়ে[6] প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্য চালিয়ে প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে যে এই অঞ্চলটি বিগত দুই হাজার বছরেরও বেশি সময়কাল ধরে জনবসতিপূর্ণ।[7] মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের একাধিক গ্রন্থে হুগলি নদীর তীরবর্তী কলিকাতা গ্রামের উল্লেখ পাওয়া যায়। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল বিপ্রদাস পিপলাইয়ের মনসাবিজয় কাব্য (১৪৯৫ খ্রি.), মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর কবিকঙ্কণ চণ্ডী (১৫৯৪-১৬০৬ খ্রি.), সৈয়দ আলাওলের পদ্মাবতী (১৬৪৫–৫২ খ্রি.), কৃষ্ণরাম দাসের কালিকামঙ্গল (১৬৭৬–৭৭ খ্রি.), সনাতন ঘোষালের ভাষা-ভাগবত (১৬৭৯–৮০ খ্রি.) ও কৃষ্ণদাসের নারদপুরাণ (১৬৯২ খ্রি.)।[8][9] ১৫৮২ সালে রাজা টোডরমলের নির্দেশে সমগ্র বাংলা সুবা (প্রদেশ) জরিপ করে ওয়ালিশ-ই-জমা তুমার নামে একটি তালিকা প্রস্তুত করা হয়। আবুল ফজলের আইন-ই-আকবরি (১৫৯০ খ্রি.) গ্রন্থে উদ্ধৃত এই তালিকাটিতে "কলিকাতা" গ্রামটির উল্লেখ রয়েছে।[8][9] এছাড়াও গোলাম হোসেন সেলিম রচিত রিয়াজ-উস-সালাতিন (১৭৮৬ খ্রি.) নামক একটি ফার্সি গ্রন্থেও "কলিকাতা" গ্রামের উল্লেখ রয়েছে।[8] ১৬৯০ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলায় বাণিজ্য বিস্তারের উদ্দেশ্যে এই অঞ্চলে পদার্পণ করে। এই সময় থেকেই শহর কলকাতার লিখিত ইতিহাসের সূচনা। জব চার্নক নামে কোম্পানির এক প্রশাসককে সাম্রাজ্যবাদী ঐতিহাসিকগণ কলকাতার প্রতিষ্ঠাতা মনে করতেন।[10] যদিও আধুনিক গবেষকগণ এই মত খণ্ডন করেছেন। ২০০৩ সালে একটি জনস্বার্থ মামলার পরিপ্রেক্ষিতে কলকাতা হাইকোর্ট জানিয়ে দেন যে কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে কলকাতার প্রতিষ্ঠাতা অভিধায় অভিহিত করা যাবে না।[11]

সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দী

সপ্তদশ শতাব্দীর শেষভাগে বর্তমান কলকাতা অঞ্চলটি সুতানুটি, গোবিন্দপুরডিহি কলিকাতা নামে তিনটি গ্রামে বিভক্ত ছিল। গ্রাম তিনটি ছিল বাংলার নবাবের প্রত্যক্ষ শাসনাধীনে। এই সময় প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী ওলন্দাজ, পর্তুগিজফরাসি শক্তিগুলিকে প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে ইংরেজ কর্তৃপক্ষ গোবিন্দপুরে একটি দুর্গনির্মাণের পরিকল্পনা করেন। ১৭০২ সালে ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গের নির্মাণকার্য সমাপ্ত হয়।[12] এই দুর্গটি ছিল একাধারে একটি সেনানিবাস ও আঞ্চলিক সেনা কার্যালয়। কলকাতা "প্রেসিডেন্সি সিটি" ঘোষিত হয় এবং পরে বাংলা প্রেসিডেন্সির সদরে পরিণত হয়।[13] এই সময় ফরাসি বাহিনীর সঙ্গে কোম্পানির ছোটোখাটো সংঘর্ষ লেগেই থাকত। ফরাসিদের ঠেকাতে ১৭৫৬ সালে কোম্পানি ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গের সংস্কার শুরু করে। বাংলার তদনীন্তন নবাব সিরাজদ্দৌলা এই সামরিক আয়োজনের প্রতিবাদ জানালেও ইংরেজ কর্তৃপক্ষ তাতে কর্ণপাত করেননি। ক্ষুব্ধ সিরাজ এরপর কলকাতা আক্রমণ করে দুর্গ দখল করে নেন এবং ইংরেজদের কলকাতা থেকে বিতাড়িত করেন। এরপরই ইংরেজরা কুখ্যাত অন্ধকূপ হত্যার গল্প রটনা করে।[14] অবশ্য এক বছর পরে রবার্ট ক্লাইভের নেতৃত্বে কোম্পানির বাহিনী কলকাতা পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছিল।[14] ১৭৭২ সালে কলকাতা ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী ঘোষিত হয়। পরবর্তীকালে ১৮৬৪ সাল থেকে ভারতের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী অধুনা উত্তরাখণ্ড রাজ্যের শৈলশহর সিমলায় সাময়িকভাবে স্থানান্তরিত করার রেওয়াজ শুরু হয়।[15] ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে কলকাতার চারপাশের জলাভূমিগুলি বুজিয়ে ফেলা হয়। হুগলি নদীর তীরবর্তী অঞ্চলে গড়ে ওঠে গভর্নমেন্ট প্লেস বা অফিসপাড়া। লর্ড ওয়েলেসলির (গভর্নর-জেনারেল ১৭৯৭-১৮০৫) শাসনকালে শহরের উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি ঘটেছিল। তার আমলেই কলকাতার অধিকাংশ সরকারি ভবনের নির্মাণকার্য শুরু হয়। এই ভবনগুলির বিশালতা ও স্থাপত্যসৌকর্যই কলকাতাকে "প্রাসাদ নগরী" বা "সিটি অফ প্যালেসেস" সম্মান প্রদান করেছিল।[16] অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আফিম ব্যবসার অন্যতম কেন্দ্রও ছিল কলকাতা। স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত আফিম কলকাতায় নিলামে উঠত এবং তারপর জাহাজবন্দি করে তা চীনে পাঠানো হত।[17]

নবজাগরণ

Thumb
সেকালের কলকাতা বন্দরে জাহাজ থেকে হাতি নামানোর দৃশ্য, হারপারস উইকলি থেকে, ১৮৫৮।
Thumb
চিৎপুর রোডের (অধুনা রবীন্দ্র সরণি) দৃশ্য; উইলিয়াম সিম্পসনের ইন্ডিয়া এনসিয়েন্ট অ্যান্ড মর্ডার্ন বইতে প্রকাশিত হয়, ১৮৬৭।

ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে কলকাতা শহর দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। শহরের দক্ষিণে যে অংশে ব্রিটিশরা বাস করতেন সেটিকে ইংরেজিতে বলা হত "হোয়াইট টাউন" (লাতিন লিপি: White Town) এবং উত্তরে যে অংশে ভারতীয়েরা বাস করত সেটিকে ইংরেজিতে বলা হত "ব্ল্যাক টাউন" (লাতিন লিপি: Black Town)।[18] ১৮৫০-এর দশক থেকে কলকাতা শহর বস্ত্রবয়ন ও পাটশিল্পে বিশেষ সমৃদ্ধি অর্জন করতে শুরু করে। এর ফলে ব্রিটিশ সরকার এখানে রেলপথ ও টেলিগ্রাফ প্রকল্পের মতো পরিকাঠামো উন্নয়নমূলক প্রকল্পে প্রচুর অর্থ বিনিয়োগ করেন। ব্রিটিশ ও ভারতীয় সংস্কৃতির মিশ্রণে শহুরে বাঙালিদের মধ্যে এক নব্য বাবু শ্রেণির উদ্ভব ঘটেছিল। এই বাবুরা ছিলেন সাধারণত উচ্চবর্ণীয় হিন্দু, ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত ও সংবাদপত্রের পাঠক। পেশাগতভাবে এঁরা ছিলেন জমিদার, সরকারি কর্মচারী বা শিক্ষক।[19] ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলার নবজাগরণ নামে পরিচিত যে যুগান্তকারী সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংস্কার আন্দোলন বাঙালি সমাজের চিন্তাধারা ও রুচির আমূল পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম হয়েছিল তার পটভূমিও ছিল এই কলকাতা শহর। বাংলার নবজাগরণ শুধু বাংলা নয়, সমগ্র ভারতের পথপ্রদর্শক হয়েছিল। এই আন্দোলনের পুরোধাপুরুষেরা ছিলেন রাজা রামমোহন রায় (১৭৭২–১৮৩৩), হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও (১৮০৯–১৮৩১), রামতনু লাহিড়ী (১৮১৩–১৮৯৮), দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮১৭–১৯০৫), ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০–১৮৯১), বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৩৮–১৮৯৪), রামকৃষ্ণ পরমহংস (১৮৩৬–১৮৮৬), কেশবচন্দ্র সেন (১৮৩৮–১৮৮৪), স্বামী বিবেকানন্দ (১৮৬৩–১৯০২) প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ।

Thumb
শহিদ মিনার (তদানীন্তন অক্টারলোনি মনুমেন্ট) থেকে কলকাতার বিস্তৃত দৃশ্য, ১৮৩২, জ্যাকব জনসন

ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন

Thumb
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বিমান থেকে কলকাতা বন্দরের দৃশ্য, ১৯৪৫।
Thumb
কলকাতার রাস্তায় প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবসের দাঙ্গায় নিহতদের মৃতদেহ, ১৯৪৬।

১৮৮৩ সালে রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় জাতীয় সম্মেলনের আয়োজন করেন। এটিই ছিল ঊনবিংশ শতাব্দীর ভারতের প্রথম রাজনৈতিক সম্মেলন।[10] এরপর ধীরে ধীরে কলকাতা ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের এক গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে পরিণত হয়। বিশেষত বিপ্লবী সংগঠনগুলির অন্যতম প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হয় কলকাতা শহর। ১৯০৫ সালে সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে কলকাতায় ব্যাপক গণবিক্ষোভ ও ব্রিটিশ দ্রব্য বয়কট (স্বদেশী আন্দোলন) শুরু হয়।[20] এই সব গণআন্দোলনের তীব্রতা এবং দেশের পূর্বভাগে অবস্থিত কলকাতা থেকে দেশ শাসনের প্রশাসনিক অসুবিধার কারণে ১৯১১ সালে ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী দিল্লিতে স্থানান্তরিত করা হয়।[21] ১৯২৩ সালে ক্যালকাটা মিউনিসিপ্যাল অ্যাক্টের অধীনে কলকাতার স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন কর্তৃপক্ষ কলকাতা পৌরসংস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯২৪ সালে এই পৌরসংস্থার প্রথম মেয়র নির্বাচিত হন চিত্তরঞ্জন দাশ। পরবর্তীকালে সুভাষচন্দ্র বসু, বিধানচন্দ্র রায়, আবুল কাশেম ফজলুল হক প্রমুখ বিশিষ্ট স্বাধীনতা সংগ্রামীরা এই পদ অলংকৃত করেছিলেন।[22] দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন জাপানি সেনাবাহিনী একাধিকবার কলকাতা শহর ও বন্দরে বোমা নিক্ষেপ করেছিল।[23] কলকাতায় জাপানি বোমাবর্ষণের প্রথম ও শেষ ঘটনাটি ঘটে যথাক্রমে ১৯৪২ সালের ২০ ডিসেম্বর[24] এবং ১৯৪৪ সালের ২৪ ডিসেম্বর।[25] যুদ্ধের সময় কলকাতায় পঞ্চাশের মন্বন্তরে লক্ষাধিক মানুষ অনাহারে মারা যান। এই মন্বন্তরের কারণ ছিল সামরিক তাণ্ডব, প্রশাসনিক ব্যর্থতা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ।[26] ১৯৪৬ সালে পৃথক মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তানের দাবিতে এক ভয়ংকর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় কলকাতায় চার হাজারেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারান।[27][28][29] ভারত বিভাগের সময়ও বহু মানুষ সাম্প্রদায়িকতার শিকার হন। দেশভাগের পর বহুসংখ্যক মুসলমান পূর্ব পাকিস্তানে পাড়ি জমান এবং সেই দেশের লক্ষ লক্ষ হিন্দু কলকাতায় চলে আসেন। এর ফলে শহরের জনপরিসংখ্যানে একটি বিরাট পরিবর্তন সূচিত হয়।[30]

স্বাধীনতা-উত্তর যুগ

Thumb
কলকাতা পৌরসংস্থার ক্রম বিবর্ধন

১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীনতা অর্জন করলে ব্রিটিশ বাংলা প্রেসিডেন্সির হিন্দুপ্রধান পশ্চিমাঞ্চল পশ্চিমবঙ্গ নামে ভারতের একটি অঙ্গরাজ্যে পরিণত হয়। কলকাতা এই রাজ্যের রাজধানীর মর্যাদা পায়। এই সময় দেশভাগ-জনিত তীব্র অর্থনৈতিক সংকট ও পূর্ব পাকিস্তান থেকে হিন্দু শরণার্থীদের ব্যাপক হারে পশ্চিমবঙ্গে অনুপ্রবেশ রাজ্যের তথা শহরের অর্থনীতির উপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করে। এই সমস্যার মোকাবিলা করার জন্য পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায় একাধিক কার্যকরী উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করেন। কলকাতার জনসংখ্যার চাপ কমাতে শহরের উপকণ্ঠে চব্বিশ পরগনা জেলায় (অধুনা উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলা) সল্টলেক (অধুনা বিধাননগরের একটি অংশ) ও নদিয়া জেলায় কল্যাণী নামে দুটি পরিকল্পিত উপশহর গড়ে তোলা হয়। কলকাতা বন্দরের সাহায্যার্থে সহযোগী হলদিয়া বন্দর নির্মিত হয়। হুগলি নদীর নাব্যতা রক্ষার জন্য ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনাও গৃহীত হয়।[31]

স্বাধীনতার পর ১৯৫১ ও ১৯৫৬ সালে কর্পোরেশন আইন সংশোধন করা হয়। ১৯৮০ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার শেষবার এই আইন সংশোধন করেন। সংশোধিত নতুন আইন কার্যকর হয় ১৯৮৪ সালে। ১৯৯২ সালে ভারতীয় সংবিধানের ৭৪তম সংশোধনী বিল পাস হলে কলকাতা পৌরসংস্থা সামাজিক ন্যায় ও আর্থিক উন্নয়নের স্বার্থে পরিকল্পনা গ্রহণের ক্ষমতা পায়।[32]

বিধানচন্দ্রের মৃত্যুর পর ১৯৬০ ও ১৯৭০-এর দশকে ব্যাপক বিদ্যুৎ বিভ্রাট, ধর্মঘট ও জঙ্গি নকশাল আন্দোলনের ফলে শহরের পরিকাঠামো ব্যবস্থা গভীরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে শহরের অর্থনৈতিক অবক্ষয়ের সূত্রপাত ঘটে।[33] ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পূর্ব পাকিস্তানের বহুসংখ্যক মানুষ শরণার্থী হিসাবে কলকাতায় আশ্রয় নিলে শহরের অর্থনীতির উপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি হয়।[34] আবার, বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে কলকাতা শহরই ছিল ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের অন্যতম প্রাণকেন্দ্র। পশ্চিমবঙ্গের ৩৪ বছরের সিপিআই(এম)-নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট শাসন বিশ্বের দীর্ঘতম মেয়াদের গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত কমিউনিস্ট সরকারের একটি উদাহরণ।[35][36]

১৯৮০-এর দশকের মধ্যভাগে কলকাতাকে ছাপিয়ে মুম্বই (তৎকালীন নাম বোম্বাই) ভারতের সর্বাধিক জনবহুল শহরের শিরোপা অর্জন করে।[37] ১৯৯০-এর দশকে ভারত সরকারের অর্থনৈতিক উদারীকরণের নীতি শহরের অর্থনৈতিক হৃতগৌরব পুনরুদ্ধারে অনেকাংশে সহায়ক হয়। ২০০০ সাল থেকে তথ্যপ্রযুক্তি শিল্প কলকাতার অর্থনীতিতে নতুন গতির সঞ্চার করেছে। শহরের উৎপাদন ক্ষেত্রেও উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি সম্ভব হয়েছে।[37] ২০০১ সালে কলকাতার ইংরেজি নাম ক্যালকাটা (লাতিন লিপি: Calcutta) বদলে কোলকাটা (লাতিন লিপি: Kolkata) করার ফলে পৌরসংস্থাটির নাম "কলিকাতা পৌরসংস্থা"-র পরিবর্তে "কলকাতা পৌরসংস্থা" করা হয়।[32]

তথ্যসূত্র

বহিঃসংযোগ

Wikiwand in your browser!

Seamless Wikipedia browsing. On steroids.

Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.

Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.