Loading AI tools
আধ্যাত্মিকতা, সন্ন্যাস জীবন, ত্যাগের উপর হিন্দু পাঠ্য উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
জাবালোপনিষদ্ (সংস্কৃত: जाबाल उपनिषत्) হল হিন্দুধর্মের একটি অপ্রধান উপনিষদ্। সংস্কৃত ভাষায় রচিত এই উপনিষদ্টি শুক্লযজুর্বেদের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। জাবালোপনিষদ্ ২০টি সন্ন্যাস উপনিষদের অন্যতম।
জাবালোপনিষদ্ একটি প্রাচীন ধর্মগ্রন্থ তথা প্রাচীনতম উপনিষদ্গুলির অন্যতম। ৩০০ খ্রিষ্টাব্দেরও আগে রচিত এই গ্রন্থে সাংসারিক জীবন পরিত্যাগ করে আধ্যাত্মিক জ্ঞান অনুসন্ধানের বিষয়টি আলোচিত হয়েছে। এতে হিন্দুদের পবিত্র তীর্থ বারাণসী (অধুনা ভারতের উত্তরপ্রদেশ রাজ্যে অবস্থিত) নগরীটিকে একটি আধ্যাত্মিক পরিভাষায় (‘অভিমুক্তম্’) বর্ণনা করা হয়েছে। এছাড়া এই গ্রন্থে বলা হয়েছে যে, মানুষের অন্তরে নিহিত আত্মাই পবিত্রতম স্থানের মর্যাদা পাওয়ার যোগ্য।
জাবালোপনিষদের মতে, আশ্রম নির্বিশেষে যে কেউ গ্রহণের অধিকারী। মুখ্য উপনিষদ্-সহ প্রাচীনতর বৈদিক ধর্মগ্রন্থগুলিতে আত্মহত্যার স্বীকৃতি না থাকলেও জাবালোপনিষদে কোনও কোনও পরিস্থিতিতে আত্মহত্যাকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে এই গ্রন্থে বলা হয়েছে, অসুস্থ ব্যক্তিও ‘মানস সন্ন্যাস’ গ্রহণ করতে পারেন। বেদান্ত দর্শনকে অনুসরণ করে জাবালোপনিষদ্ বলেছে যে, যিনি সত্যকার সন্ন্যাস গ্রহণ করবেন, তিনি নৈতিক জীবন যাপন করবেন এবং চিন্তা, বাক্য বা কার্যের দ্বারা কাউকে আঘাত করবেন না। এমন সন্ন্যাসী সব ধরনের আনুষ্ঠানিক ক্রিয়াকাণ্ড পরিত্যাগ করবেন। তিনি কারোর সঙ্গে সম্পর্কের বন্ধন রাখবেন না এবং আত্মা ও ব্রহ্মের একত্ব চিন্তায় মগ্ন থাকবেন।
জাবালোপনিষদ্ একটি প্রাচীন উপনিষদ্। এটির রচনাকাল ৩০০ খ্রিস্টাব্দের পূর্বে এবং আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীর পরে।[4] যে সকল ধর্মগ্রন্থে সাংসারিক জীবন পরিত্যাগ করে শুধুমাত্র আধ্যাত্মিক জ্ঞানের অনুসন্ধানে জীবন অতিবাহিত করার কথা বলা হয়েছে, জাবালোপনিষদ্ সেগুলির অন্যতম।[5]
জাবালোপনিষদের মূল উপজীব্য ধ্যান ও সন্ন্যাসের ধারণা দু’টি।[6] ঋষি যাজ্ঞবল্ক্য “এই উপনিষদের প্রবক্তা রূপে” আধ্যাত্মিক জ্ঞান অর্জনের জন্য সাংসারিক জীবন ত্যাগ করার উপদেশ দিয়েছেন। এই জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে “সন্ন্যাসের ইচ্ছা সহ সকল ইচ্ছাকে অতিক্রম করা সম্ভব।”[7]
প্রাচ্যধর্ম ও নীতিবিদ্যার অধ্যাপক সর্বপল্লি রাধাকৃষ্ণনের মতে, এই উপনিষদে কোনো কোনো ক্ষেত্রে আত্মহত্যা করাকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। উল্লেখ্য, প্রাচীনতর বৈদিক ধর্মগ্রন্থ ও মুখ্য উপনিষদ্গুলিতে আত্মহত্যা করাকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি।[8] এই গ্রন্থে বারাণসী নগরীর কথাও আলোচনা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, “শিব এই স্থান কখনও ত্যাগ করেন না।” এই নগরীকে একটি পবিত্র স্থান হিসেবেও এই উপনিষদে শ্রদ্ধা জানানো হয়েছে।[9] এই গ্রন্থটিই প্রাচীনতম ধর্মগ্রন্থ যেখানে বলা হয়েছে যে, জীবনের চারটি স্তর (‘আশ্রম’) সন্ন্যাস গ্রহণের ক্ষেত্রে কোনো বাধা নয়। মানুষ যে কোনো সময়ে সন্ন্যাস গ্রহণ করতে পারেন।[10] জাবালোপনিষদ্ বেদান্ত দর্শনের দৃষ্টিকোণ থেকে সন্ন্যাসীর সঠিক জীবনযাত্রার প্রণালী ব্যাখ্যা করেছে। এই গ্রন্থে বলা হয়েছে, সন্ন্যাসী কোনো আনুষ্ঠানিক ক্রিয়াকাণ্ড থেকে বিরত থাকবেন, যজ্ঞোপবীত পরিধান করবেন না এবং শুধুমাত্র আত্মজ্ঞানেই নিমগ্ন থাকবেন।[11]
বৈদিক সাহিত্যে মানব জীবনের তিনটি ‘আশ্রম’ (জীবনের স্তর) বর্ণিত হয়েছিল। এগুলির প্রথম দুটি হল: ‘ব্রহ্মচর্য’ (ছাত্রজীবন) ও ‘গার্হস্থ্য’ (সাংসারিক জীবন)। বৈদিক সাহিত্যে জীবনের তৃতীয় স্তরটিতে ‘বানপ্রস্থ’ (অবসরপ্রাপ্ত বা বনবাসীর জীবন) ও ‘সন্ন্যাস’ (সংসারত্যাগীর জীবন) একত্রে একটি আশ্রম হিসেবে বর্ণিত হয়। মহাত্মা জ্যোতিবা ফুলে রোহিলখণ্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক সতী শিবেন্দ্র চন্দ্র বলেছেন, জাবালোপনিষদেই প্রথম বাণপ্রস্থ ও সন্ন্যাসকে জীবনের দুটি পৃথক আশ্রম হিসেবে বর্ণনা করা হয়।[12] যদিও ইউনিভার্সিটি অফ টেক্সাস অ্যাট অস্টিনের অধ্যাপক প্যাট্রিক ওলিভেল বলেছেন যে, আরুণেয়োপনিষদে প্রথম এই দুটি স্তরকে পৃথক করা হয়। আরুণেয়োপনিষদ্ সম্ভবত প্রাচীনতর উপনিষদ্।[13]
অন্যান্য প্রাচীন ভারতীয় ধর্মগ্রন্থগুলির মতো জাবালোপনিষদেরও সঠিক রচনাকাল জানা যায় না।[2] পুথিগত সূত্র ও রচনাভঙ্গি দেখে অনুমান করা হয় যে, এই গ্রন্থটি প্রাচীন। ৩০০ খ্রিষ্টাব্দে রচিত আশ্রমোপনিষদ্ গ্রন্থের আগেই এই গ্রন্থটি রচিত হয়েছিল।[5] জাপানি বৈদিক সাহিত্য-বিশারদ হাজিমে নাকামুরা বলেছেন যে, জাবালোপনিষদ্ ও পরমহংসোপনিষদ্ গ্রন্থদুটি খ্রিস্টের জন্মের সমসাময়িক কালে রচিত হয়।[14] জার্মান উপনিষদ্-বিশেষজ্ঞ জোয়াকিম স্প্রোকহফ বলেছেন যে, এই গ্রন্থের রচনাকাল খ্রিস্টের জন্মের কয়েক শতাব্দী আগে থেকে খ্রিস্টের জন্মের সমসাময়িক কালের মধ্যবর্তী কোনো এক সময়।[2] অন্যদিকে জার্মান ভারততত্ত্ববিদ জর্জ ফিউরস্টাইন বলেছেন, এই উপনিষদ্টি ৩০০ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ রচিত হয়।[4] এই উপনিষদ্ সন্ন্যাস-বিষয়ক প্রাচীনতম উপনিষদ্গুলির অন্যতম।[4]
মুক্তিকোপনিষদ্ গ্রন্থে রাম ও হনুমানের কথোপকথনের আকারে ১০৮টি উপনিষদের যে তালিকা দেওয়া হয়েছে, সেই তালিকায় জাবালোপনিষদ্ গ্রন্থটি ১৩শ সংখ্যক।[15] কোলব্রুকের উত্তর ভারতে জনপ্রিয় ৫২টি উপনিষদের সংকলনে এই উপনিষদ্টি ৫১শ সংখ্যক।[16] নারায়ণের দক্ষিণ ভারতে জনপ্রিয় ৫২টি উপনিষদের সংকলনে এই উপনিষদ্টি পাণ্ডুলিপি অনুসারে ৩৯শ বা ৪০শ সংখ্যক।[17] দক্ষিণ ভারতে প্রকাশিত পরবর্তী সংকলনগুলিতে এই উপনিষদ্টি ১০৮টি উপনিষদের অন্যতম।[18] ১৯শ শতাব্দীর সংস্কৃত পণ্ডিত রামময় তর্করত্ন কর্তৃক বিবলিওথিকা ইন্ডিকায় প্রকাশিত ৩০টি অপ্রধান উপনিষদের তালিকায় এই উপনিষদ্টি ২৮শ সংখ্যক।[19]
জাবালোপনিষদ্ ২০টি সন্ন্যাস উপনিষদের অন্যতম।[20] ১৬৫৬ সালে সুলতান মহম্মদ দারা শিকোহ ৫০টি উপনিষদ্ সংকলিত করে ওউপানেখট (Oupanekhat) শিরোনামে ফারসি ভাষায় প্রকাশ করতে সহায়তা করেন। এই সংকলনে জাবালোপনিষদ্ গ্রন্থটির নাম দ্জাবাল (Djabal) ও সংখ্যা ২৯।[21] ১৮০১-০২ সালে ফারসি অনুবাদটি অবলম্বনে অ্যানকুটিল ডু পেরোন গ্রন্থটি লাতিন ভাষায় অনুবাদ করেন। এই অনুবাদে তিনি বলেছিলেন, ভারতীয়রা সর্বদা এই উপনিষদ্গুলির সংকলন পাঠ করেন। তারা “জানেন যে, এগুলি ধর্ম সম্পর্কে শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ।”[21] অ্যানকুটিলের অনুবাদের মাধ্যমে উপনিষদ্গুলি আর্থার সোপেনহায়ার ও অন্যান্য পাশ্চাত্য দার্শনিকদের দৃষ্টিগোচর হয়।[22]
জাবালোপনিষদ্ ছয়টি অধ্যায়ে বিন্যস্ত।[1] প্রথম পাঁচটি অধ্যায়ে ঋষি যাজ্ঞবল্ক্য পাঁচটি প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন। প্রশ্নগুলি করেছেন বৃহস্পতি, অত্রি, ব্রহ্ম-আত্মা সম্পর্কে জিজ্ঞাসুগণ, রাজা জনক এবং পুনরায় অত্রি।[23] শেষ অধ্যায়ে কয়েকজন বিশিষ্ট ঋষির তালিকা দেওয়া হয়েছে, যাঁরা আদর্শ সন্ন্যাসী হিসেবে কথিত।[24]
বর্তমানে প্রাপ্ত উপনিষদ্টির দুটি পাঠান্তর দেখা যায়। একটি পাঠে ছয়টি অধ্যায় ১৪টি শ্লোকে বিন্যস্ত।[25] অপর পাঠে ছয়টি অধ্যায়ের বিষয়বস্তু এক হলেও শ্লোকসংখ্যা এক নয়।[26]
প্রথম তিনটি অধ্যায়ে সকল সত্ত্বা তথা সর্বোচ্চ সত্যের (ব্রহ্ম) স্থান নির্ধারণ করা হয়েছে। সেই সঙ্গে ধ্যানের মাধ্যমে কীভাবে সেই স্থানে উত্তীর্ণ হওয়া যায়, তাও বলা হয়েছে। তাছাড়া এই অংশে হিন্দু দেবতা শিব ও পবিত্র নগরী বারাণসীর বিবরণ রয়েছে।[27][28] পরবর্তী তিনটি অধ্যায় সন্ন্যাস সম্পর্কিত।[29] এখানে পরমহংসের (যিনি আধ্যাত্মিকতার সর্বোচ্চ স্তরে উন্নীত হয়েছেন, সন্ন্যাসের সকল বাহ্য চিহ্ন বর্জন করেছেন এবং ব্রহ্ম ও আত্মার প্রকৃতির অনুসন্ধানে সকল সাংসারিক বন্ধন ও জাগতিক সুখ পরিহার করেছেন[27]) বৈশিষ্ট্য আলোচিত হয়েছে।[30]
জাবালোপনিষদ্ গ্রন্থের প্রথম অধ্যায়ে বৃহস্পতি ও যাজ্ঞবল্ক্যের কথোপকথন বিবৃত হয়েছে। এই অধ্যায়ে বৃহস্পতি যাজ্ঞবল্ক্যকে জিজ্ঞাসা করছেন যে, সকল জীবের সত্ত্বা ব্রহ্ম কোথায় বাস করেন।[24] যাজ্ঞবল্ক্য বলছেন, সকল জীবের সত্ত্বা ব্রহ্মের নিবাস কুরুক্ষেত্র। এই স্থান ‘অভিমুক্তম্’ নামে পরিচিত। শিব এই স্থান কখনও ত্যাগ করেন না।[23] এই ‘অভিমুক্তম্’ বারাণসীর একটি অংশ।[31] পরিব্রাজক জীবন শেষ করে সকল সন্ন্যাসীর উচিত ‘অভিমুক্তম্’-এ বাস করা।[24] জাবালোপনিষদ্ অনুসারে, এই স্থানেই মৃত্যুর ঠিক পূর্বে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের সময় রুদ্র মোক্ষ প্রদান করেন। এর ফলে মৃত ব্যক্তি ‘বিদেহ মুক্তি’ (মৃত্যুর পরবর্তীকালে লব্ধ মোক্ষ) লাভ করেন।[31][24] এই স্থানটি পবিত্র এবং পূজার যোগ্য। এই স্থান ত্যাগ করা অনুচিত।[24][25]
দ্বিতীয় অধ্যায়ে ঋষি অত্রি যাজ্ঞবল্ক্যকে জিজ্ঞাসা করছেন, “আমি কীভাবে এই অনন্ত বিমূর্ত আত্মাকে জানতে পারব?”[32] যাজ্ঞবল্ক্য বলছেন, আত্মাকে ‘অভিমুক্তম্’-এ পাওয়া যায়।[33] এরপর অত্রি জিজ্ঞাসা করছেন, ‘অভিমুক্তম্’কে কীভাবে পাওয়া যায়?[32] জাবালোপনিষদ্ এখানে শব্দের খেলার মাধ্যমে একটি আক্ষরিক ও গুপ্ত রূপক অর্থ প্রকাশ করছে।[1] যাজ্ঞবল্ক্য বলছেন, ‘অভিমুক্তম্’কে পাওয়া যায় ‘বরণা’ ও ‘অসি’র বা ‘বর্যতি’ ও ‘নাশ্যতি’র মধ্যবর্তী স্থানে।[1]
ভৌগোলিক দিক থেকে বারাণসী শহরটি গঙ্গা নদীর তীরে, যেখানে দুটি ছোটো ও প্রায় শুকিয়ে আসা নদী বরণা ও অসি মিলিত হয়েছে, সেইখানে অবস্থিত।[1][33] এই গ্রন্থে ব্যবহৃত রূপকতত্ত্বটি হল, ‘বরণা’ শব্দের অর্থ ‘এইখানে ইন্দ্রিয়ের ভ্রান্তিগুলি দূর হয়’ (‘বর্যতি’) এবং 'অসি' শব্দের অর্থ ‘ইন্দ্রিয়ের প্রভাবে সৃষ্ট পাপগুলি বিনষ্ট হয়’ (‘নাশ্যতি’)।[32][33] এই প্রতীকী উত্তরটি শুনে অত্রি পুনরায় প্রশ্ন করছেন, “কিন্তু এই ‘অভিমুক্তম্’ কোথায়?’ যাজ্ঞবল্ক্য বলছেন, অত্রির মধ্যেই ‘অভিমুক্তম্’ রয়েছে। “যেখানে তাঁর নাক ও ভ্রুদ্বয় মিলিত হয়েছে, সেখানেই স্বর্গরাজ্যের স্থান এবং ব্রহ্মের সর্বোচ্চ বিশ্ব।”[32][34] এই ‘অভিমুক্তম্’ হল ‘ব্রহ্মের আবাসস্থল’।[35]
যিনি ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করেন, তিনি এটিকেই নিজের অন্তরে নিহিত ‘অভিমুক্তম্’-এ আত্মা মনে করেন।[32][36] এই শ্লোকটির ব্যাখ্যা করতে গিয়ে রামনাথন বলেছেন যে, যিনি ‘অভিমুক্তম্’-এর সত্য প্রকৃতিটি জানেন, তিনি বুঝতে পারেন যে, “ব্যক্তি আত্মাই হলেন নির্গুণ ব্রহ্ম।”[25]
তৃতীয় অধ্যায়টি এই উপনিষদের ক্ষুদ্রতম অধ্যায়। এখানে ব্রহ্মবিদ্যার জিজ্ঞাসুরা যাজ্ঞবল্ক্যকে জিজ্ঞাসা করছেন, কোন স্তোত্রের সাহায্যে মানুষ অমরত্ব লাভ করে।[37] যাজ্ঞবল্ক্য শতরুদ্রীয় নামে একটি স্তোত্রের কথা বলছেন। এই স্তোত্রে রুদ্রের একশোটি নাম পাওয়া যায়।[37] যজুর্বেদের বাজসনেয় সংহিতায় (১৬/১ থেকে ১৬/৬৬ শ্লোক) এই স্তোত্রটি পাওয়া যায়।[38] এই স্তোত্রের আত্মার বিভিন্ন উপাধির উল্লেখ আছে।[1]
জাবালোপনিষদ্ গ্রন্থের চতুর্থ অধ্যায়ে বিদেহর রাজা জনক যাজ্ঞবল্ক্যকে বলছেন, “প্রভু, সন্ন্যাস ব্যাখ্যা করুন।”[38]
যাজ্ঞবল্ক্য জানাচ্ছেন, ‘ব্রহ্মচর্য’ (ছাত্রজীবন) সম্পূর্ণ করার পর ব্যক্তি ‘গার্হস্থ্য’ (গৃহস্থ জীবন) আশ্রমে প্রবেশ করে। তারপর ‘বাণপ্রস্থ’ (অবসর গ্রহণ) এবং শেষে সন্ন্যাস (সংসার ত্যাগ করে পরিব্রাজক ভিক্ষু রূপে তীর্থ ভ্রমণ) গ্রহণ করে। যাজ্ঞবল্ক্য আরও বলছেন, এই ক্রম ছাড়াও ব্রহ্মচর্য সম্পূর্ণ করার পর অথবা গার্হস্থ্য আশ্রম থেকে অবসর গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গেই, যজ্ঞ করে হোক বা না করে, যে কোনো অবস্থাতেই সন্ন্যাস গ্রহণ করা যায়।[38][37] ওলিভেলের মতে, যজ্ঞ বলতে এখানে পরোক্ষে বিবাহকে বোঝানো হয়েছে। তাই এই গ্রন্থ মতে, বিবাহিত বা চিরকুমার উভয়েই সন্ন্যাস গ্রহণের অধিকারী।[38]জাবালোপনিষদ্ বলছে, যে দিনই কোনো ব্যক্তি সংসার থেকে নিজেকে বিচ্যুত মনে করবেন, সেই দিনই তিনি সন্ন্যাস গ্রহণ করতে পারবেন। তিনি সেই সময় যে আশ্রমে আছেন, সেই আশ্রম সম্পূর্ণ করার প্রয়োজন হবে না।[39]
যাজ্ঞবল্ক্য বলছেন যে, সন্ন্যাস গ্রহণের সময় কেউ কেউ প্রজাপতি যজ্ঞ অনুষ্ঠান করেন। কিন্তু এটি করা উচিত নয়।[41] তার পরিবর্তে প্রাণস্বরূপ অগ্নিকে আহুতি দেওয়া উচিত।[42] তার অন্তরের তিন গুণকে (‘সত্ত্ব’ বা সদ্গুণ, ‘রজঃ’ বা শক্তি ও ‘তমঃ’ বা অন্ধকার) আহুতি দেওয়া উচিত।[42][43][পাদটীকা 1] তার উচিত ‘প্রাণ’কে (আভ্যন্তরীণ জীবনীশক্তি) বন্দনা করা। কারণ প্রাণই হল অগ্নির ‘যোনি’ (উৎসস্থল)।[41][42] যদি তিনি এই অগ্নিকে চয়ন করতে না পারেন, তবে তার উচিত সন্ন্যাস গ্রহণের পূর্বে ‘ওঁ! সকল দেবগণকে অর্পণ করি, স্বাহা’ বলে জল উৎসর্গ করা।[41] এই উৎসর্গীকরণের পর তার উচিত মুক্তিদাতা মন্ত্র ওঁ-ই যে তিন বেদ তা জানা[পাদটীকা 2] এবং ব্রহ্মোপাসনা করা।[41][50]
যদি সে শারীরিক কারণে (সন্ন্যাস পালনে) একান্তই অসমর্থ হয়, তবে সে শুধু মনোবাক্যে সন্ন্যাস অনুশীলন করতে পারে।
— জাবালোপনিষদ্ গ্রন্থে যাজ্ঞবল্ক্যের উক্তি, অধ্যায় ৫[51]
পঞ্চম অধ্যায়ে অত্রি যাজ্ঞবল্ক্যকে জিজ্ঞাসা করছেন, ব্রহ্ম উপাসনা যজ্ঞোপবীত ছাড়া সম্ভব কিনা। জার্মান ভারততত্ত্ববিদ অধ্যাপক পল ডুসেনের অনুবাদ অনুসারে, যাজ্ঞবল্ক্যের উত্তরটি হল এই যে, “আত্মাই যজ্ঞোপবীত।”[52] সন্ন্যাসী বা পরিব্রাজক যখন ভোজন করেন বা আচমন করেন, তখনই তিনি আত্মাকে আহুতি দেন।[52] ‘প্রাণ’কে (জীবনীশক্তি) ভোজন করানো ও শৃঙ্গার করানোই সন্ন্যাসীর একমাত্র কর্তব্য।[53]
যাজ্ঞবল্ক্য বলছেন, সন্ন্যাসী ‘ন্যায়সঙ্গত যুদ্ধে’ প্রাণত্যাগ করে বীরোচিত মৃত্যু বরণ করতে পারেন,[54] অথবা অনশনে, অথবা জল বা অগ্নিতে প্রবেশ করে, অথবা মহাপ্রস্থানে যাত্রা করেও মৃত্যু বরণ করতে পারেন।[52][55][পাদটীকা 3] উপনিষদের এই অংশটি থেকে কোনো কোনো গবেষক মনে করেছেন যে, জাবালোপনিষদ্ স্বেচ্ছামৃত্যুর অধিকার স্বীকৃতি দিয়েছে এবং নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে আত্মহত্যাকেও অনুমোদন করছে।[57][পাদটীকা 4] অন্যান্য বৈদিক ধর্মগ্রন্থ ও মুখ্য উপনিষদ্গুলির ধারণা এক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ভিন্ন। সেই সকল গ্রন্থে আত্মহত্যাকে ভ্রান্ত মনে করা হয়।[8][60]
এই উপনিষদ্ মনে করে, সন্ন্যাসীর তীর্থযাত্রা তাকে ব্রহ্মজ্ঞানের যাত্রাপথে নিয়ে যাবে। এই পথে তার চিন্তা হবে পবিত্র। তার সঙ্গে সম্পদ থাকবে না। তার মস্তক মুণ্ডিত হয়ে। তিনি কাষায় বস্ত্র পরিধান করবেন। কারও প্রতি শত্রুতা পোষণ করবেন না। এবং ভিক্ষাবৃত্তি করে জীবন ধারণ করবেন।[50][61] তবে অসমর্থ বা মানসিকভাবে দুর্বল ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি বাধ্যতামূলক নয়। তারা মনোবাক্যে সন্ন্যাস অনুশীলন করবেন।[62][51]
ষষ্ঠ তথা শেষ অধ্যায়ে যাজ্ঞবল্ক্য পরমহংস বা আদর্শ সন্ন্যাসীগণের একটি তালিকা দিয়েছেন।[পাদটীকা 5] এঁরা হলেন সম্বর্তক, আরুণি, শ্বেতকেতু, দুর্বাসা, ঋভু, নিদাঘ, জড়ভরত, দত্তাত্রেয় ও রৈবতক।[51] পরমহংসগণ সন্ন্যাসের কোনো বাহ্য চিহ্ন ধারণ করেন না। তাদের ধর্মকর্ম গোপন থাকে। তাদের দেখে পাগল মনে হয়।[64][51] তারা দণ্ড ও কমণ্ডলু ধারণ করেন না, মাথায় জটা রাখেন না বা যজ্ঞোপবীত পরিধান করেন না। তারা শুধু আত্মার অনুসন্ধানে রত থাকেন।[65][66]
যিনি যেমন নগ্ন অবস্থায় জন্মগ্রহণ করেছেন, তেমনই নগ্ন অবস্থায় থাকেন; যিনি অনুকূল ও প্রতিকূলতার দ্বন্দ্বের (যেমন আনন্দ-বিষাদ ইত্যাদি) অতীত; যাঁর নিজস্ব কোনো সম্পত্তি নেই; যিনি শুধু সত্যের পথে ব্রহ্মের প্রতি আত্মনিবেদিত; যাঁর হৃদয় পবিত্র; যিনি জীবনধারণের জন্য যথাসময়ে বাইরে গিয়ে ভিক্ষা চান;[পাদটীকা 6] উদরই যাঁর একমাত্র তৈজসপত্র; ভিক্ষা পাওয়া বা না পাওয়ায় যিনি বিচলিত হন না; যিনি গৃহহীন হয়ে পরিত্যক্ত গৃহ, মন্দির, তৃণের স্তুপ, বল্মীক, বৃক্ষতল, মৃৎশিল্পীর কর্মশালা, নদীতীর, পর্বতগুহা, সংকীর্ণ উপত্যকা, গাছের কোটর, ঝরনা বা উন্মুক্ত প্রান্তরে বাস করেন; যিনি আকাঙ্ক্ষা-রহিত, ‘আমিত্বে’র অনুভূতিহীন, পরম সন্তোষ সহকারে পরমাত্মায় স্থিত; যিনি কোনো দুষ্কর্মে রত থাকেন না; [...] তাঁকেই বলা হয় পরমহংস।
— জাবালোপনিষদ্, অধ্যায় ৬ (সংক্ষেপিত)[51]
পরমহংস হলেন সেই সন্ন্যাসী যিনি আত্ম-অনুসন্ধানে রত থাকেন। তিনি সকল দুষ্কর্ম পরিত্যাগ করেন। অন্তরে কোনো অশুভ চিন্তাকে শান দেন না। তিনি আত্ম ও ব্রহ্মের ধ্যানে আত্মনিবেদন করেন।[67]
ওলিভেলের মতে, যে পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ উপনিষদে ব্যক্তি কখন সন্ন্যাস গ্রহণ করে সংসার ত্যাগ করবেন সেই সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হয়েছে, সেগুলি হল জাবালোপনিষদ্, আরুণেয়োপনিষদ্, লঘু-সন্ন্যাসোপনিষদ্, কঠশ্রুত্যোপনিষদ্ ও পরমহংসোপনিষদ্।[68] লঘু-সন্ন্যাসোপনিষদ্, কঠশ্রুত্যোপনিষদ্ ও পরমহংসোপনিষদ্ অনুসারে, ব্রহ্মচর্য, গার্হস্থ্য ও বাণপ্রস্থ আশ্রমের অন্তে বয়োজ্যেষ্ঠ্য ও পরিবারের নিকটাত্মীয়দের অনুমতি গ্রহণ করে সন্ন্যাস গ্রহণ করা উচিত। অন্যদিকে জাবালোপনিষদ্ ও আরুণেয়োপনিষদ্ অনুসারে, কখন সন্ন্যাস গ্রহণ করা যায়, তা ব্যক্তি ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল। তার জন্য কোনো আশ্রমধর্ম পালন সম্পূর্ণ করা বা কারও অনুমতি গ্রহণ আবশ্যক নয়।[68]
জাবালোপনিষদ্ মতে, যখনই হৃদয়ে ‘বৈরাগ্যে’র (সংসারে অশ্রদ্ধা) উদয় হয়, তখনই কোনো পূর্বশর্ত ব্যতিরেকেই সন্ন্যাস গ্রহণ করা যায়। তৎক্ষণাৎ সন্ন্যাস গ্রহণের আধ্যাত্মিক অধিকার আছে সেই ব্যক্তির।[69] আদি শঙ্কর,[পাদটীকা 7] বিজ্ঞানেশ্বর, সুরেশ্বর ও নীলকণ্ঠ প্রমুখ মধ্যযুগীয় পণ্ডিতবর্গ জাবালোপনিষদ্ গ্রন্থে উল্লিখিত এই ধারণাটিকে বেদসম্মত বলে উল্লেখ করেছেন। পরবর্তীকালের পণ্ডিতেরা এই ধারণাটিকে ‘বিকল্প’ বলেছেন। এই ধারণাটিকে সমাজ ও রাষ্ট্র স্বীকার করে থাকে।[71] জাবালোপনিষদ্ সন্ন্যাসের অধিকার ও সন্ন্যাসজীবন সংক্রান্ত বিষয়ে কয়েকটি ধর্মশাস্ত্রের সঙ্গে একমত। কিন্তু মনুস্মৃতি (৬। ৩৫-৩৭) প্রভৃতি কয়েকটি শাস্ত্রের সঙ্গে এটির মতৈক্য হয়নি। সন্ন্যাসগ্রহণের অধিকার সংক্রান্ত বিষয়ে এই গ্রন্থের মতটি বিতর্কিত। যদিও মধ্যযুগীয় হিন্দু পণ্ডিতেরা এই উপনিষদের উপরই আস্থা রেখেছেন এবং এটির পক্ষ অবলম্বন করেছেন।[72]
জাবালোপনিষদ্ অন্যান্য ধর্মগ্রন্থের উপরেও প্রভাব বিস্তার করেছিল ১৪শ শতাব্দীর অদ্বৈতবাদী পণ্ডিত ও বিজয়নগর সাম্রাজ্যের কুলগুরু বিদ্যারণ্যের জীবন্মুক্তি-বিবেক গ্রন্থে মোক্ষপ্রাপ্তদের বিবরণদের দেওয়ার সময় জাবালোপনিষদ্ গ্রন্থের উল্লেখ করা হয়েছে।[73]
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.