Loading AI tools
বাংলাদেশি ইসলামি পণ্ডিত, শিক্ষাবিদ ও ধর্মীয় নেতা উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
শাহ আহমদ শফী (আল্লামা শফী নামেও পরিচিত; ৫ এপ্রিল ১৯৩০ – ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২০) একজন ইসলামি পণ্ডিত এবং একবিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে বাংলাদেশে ইসলামি নবজাগরণের প্রতীক।[1][2] তাকে বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য আলেম হিসেবে বর্ণনা করা হয়।[3] একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় শাহবাগ আন্দোলন, নাস্তিক্যবাদ সহ ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী শক্তির বিপরীতে ইসলামপন্থী নেতা হিসেবে তার উত্থান ঘটে। হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমীর হিসেবে ২০১৩ সালে তিনি খোলা চিঠি প্রদানের মাধ্যমে সরকার এবং জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন, যার ধারাবাহিকতায় ১৩ দফা দাবি উত্থাপন, লংমার্চ এবং ঢাকা অবরোধের মাধ্যমে গড়ে ওঠা গণমানুষের প্রতিরোধ আন্দোলনের তিনি অবিসংবাদী নেতায় পরিণত হন।[4] ২০১০ সালে তিনি এই সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন এবং আমৃত্যু তিনি সংগঠনটির আমীর ছিলেন। তার সুপারিশে বাংলাদেশের পাঠ্যপুস্তকে পরিবর্তন আনা হয় এবং সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে গ্রিক দেবীর মূর্তি অপসারণ করা হয়। ১৯৮৬ থেকে ৩৪ বছর তিনি দারুল উলুম হাটহাজারীর মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন এবং বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের সভাপতি ছিলেন। তার নেতৃত্বে ২০১৮ সালে কওমি মাদ্রাসার সরকারি স্বীকৃতি অর্জিত হয়। এজন্য গঠিত বাংলাদেশ কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা কমিশন এবং কওমি মাদ্রাসার সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ আল হাইআতুল উলয়া লিল জামিআতিল কওমিয়া বাংলাদেশের তিনি চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।[5]
শাহ আহমদ শফী | |
---|---|
মহাপরিচালক, দারুল উলুম হাটহাজারী | |
কাজের মেয়াদ ১৯৮৬ – ২০২০ | |
নিয়োগদাতা | মুহাম্মদ ইউনুস |
পূর্বসূরী | মুহাম্মদ হামেদ |
উত্তরসূরী | আব্দুস সালাম চাটগামী |
আমীর, হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ | |
কাজের মেয়াদ ২০১০ – ২০২০ | |
উত্তরসূরী | জুনায়েদ বাবুনগরী |
সভাপতি, বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ | |
কাজের মেয়াদ ২০০৫ – ২০২০ | |
পূর্বসূরী | নূর উদ্দিন গহরপুরী |
উত্তরসূরী | মাহমুদুল হাসান |
চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা কমিশন | |
কাজের মেয়াদ ২০১২ – ২০১৭ | |
নিয়োগদাতা | শেখ হাসিনা |
চেয়ারম্যান, আল হাইআতুল উলয়া লিল জামিআতিল কওমিয়া বাংলাদেশ | |
কাজের মেয়াদ ২০১৮ – ২০২০ | |
নিয়োগদাতা | শেখ হাসিনা |
উত্তরসূরী | মাহমুদুল হাসান |
ব্যক্তিগত বিবরণ | |
জন্ম | শিলক, রাঙ্গুনিয়া, চট্টগ্রাম | ৫ এপ্রিল ১৯৩০
মৃত্যু | ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২০ ৯০) | (বয়স
জাতীয়তা | বাংলাদেশী |
প্রাক্তন শিক্ষার্থী | |
ব্যক্তিগত তথ্য | |
দাম্পত্য সঙ্গী | ফিরোজা বেগম |
সন্তান | ২ ছেলে ও ৩ মেয়ে |
পিতামাতা |
|
জাতিসত্তা | বাঙালি |
আখ্যা | সুন্নি |
ব্যবহারশাস্ত্র | হানাফি |
আন্দোলন | দেওবন্দি |
প্রধান আগ্রহ | হাদিস, শিক্ষা, তাসাউফ, ইসলামি পুনরুজ্জীবন |
উল্লেখযোগ্য কাজ | |
স্বাক্ষর | |
ঊর্ধ্বতন পদ | |
শিক্ষক | ইব্রাহিম বালিয়াভি ইজাজ আলী আমরুহী মুফতি ফয়জুল্লাহ |
এর শিষ্য | হুসাইন আহমদ মাদানি |
যাদের প্রভাবিত করেন | |
সাহিত্যকর্ম | শাহবাগে ইসলাম বিদ্বেষের প্রতিবাদে গর্জে উঠুন (২০১৩) |
তার লক্ষাধিক শিষ্য এবং দুই হাজার খলিফা ছিল। তিনি সকল মতের আলেমদের এক করতে সক্ষম হয়েছিলেন।[6] সৌদি আরবের হারামাইন শরিফাইনের ইমামদের নিকট তিনি শায়েখ হিসেবে প্রসিদ্ধ ছিলেন। জীবদ্দশায় তিনি শাইখুল ইসলাম উপাধিতে ভূষিত হন।[7] নারীশিক্ষার অগ্রদূত হিসেবে তার প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় চট্টগ্রাম অঞ্চলে সর্বপ্রথম বালিকা মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০২০ সালের দারুল উলুম হাটহাজারীর ছাত্র আন্দোলনের পর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। রেকর্ড সংখ্যক মানুষের উপস্থিতির কারণে তার জানাজার নামাজকে বাংলাদেশের স্মরণকালের সর্ববৃহৎ জানাজার স্বীকৃতি দেওয়া হয়।[8] তার মৃত্যুতে জাতীয় সংসদে একটি শোকপ্রস্তাবও আনা হয়।
শাহ আহমদ শফী ১৯৩০ সালের ৫ এপ্রিল মোতাবেক ১৩৫১ হিজরিতে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার শিলক ইউনিয়নের পাখিয়ারটিলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।[9][10] তার পিতার নাম বরকত আলী ও মাতার নাম মেহেরুন্নেসা।[11] পাঁচ ভাই ও দুই বোনের মধ্যে আহমদ শফী ছিলেন সবার ছোট। ছয় বছর বয়সে তার মা ও দশ বছর বয়সে তার পিতা মৃত্যুবরণ করেন।[12] পিতামাতার মৃত্যুর পর তিনি ভাইবোন বিশেষত চতুর্থ ভাইয়ের নিকট লালিত-পালিত হন। নিজ পরিবারে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করার পর শিলক ডাউনিং স্কুলে ভর্তির মাধ্যমে তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবনের সূচনা হয়। এরপর তিনি রাঙ্গুনিয়ার সফরভাটার মুআবিনুল ইসলাম ও পটিয়ার আল জামিয়াতুল আরবিয়াতুল ইসলামিয়া জিরিতে লেখাপড়া করেন। ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জিরি মাদ্রাসা বন্ধ হয়ে গেলে তিনি নিজ বাড়িতে ফিরে আসেন। ১৯৪১ সালে তিনি দারুল উলুম হাটহাজারীতে ভর্তি হন।[13] হাটহাজারী মাদ্রাসায় মিশকাত জামাত পর্যন্ত পড়ার পর ১৯৫১ সালে তিনি দারুল উলুম দেওবন্দ গমন করেন এবং সেখানে দাওরায়ে হাদিস সমাপ্ত করেন। পাশাপাশি তিনি হুসাইন আহমদ মাদানির সাথে আধ্যাত্বিক সম্পর্ক গড়ে তোলেন। ১৯৫৫ সালে হুসাইন আহমদ মাদানি তাকে খেলাফত প্রদান করেন।[14] দারুল উলুম দেওবন্দে তার শিক্ষকদের মধ্যে রয়েছেন ইব্রাহিম বালিয়াভি ও ইজাজ আলী আমরুহী।[11] শিক্ষাজীবন সমাপ্ত করে শাহ আবদুল ওয়াহহাবের পরামর্শে তিনি হাটহাজারী মাদ্রাসায় শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবনের সূচনা করেন। ১৯৮৬ সালে তিনি হাটহাজারী মাদ্রাসার মহাপরিচালক মনোনীত হন। ২০০০ সালে তিনি হাটহাজারী মাদ্রাসার শায়খুল হাদিস নিযুক্ত হন। ২০০৫ সালে তিনি বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের সভাপতি মনোনীত হন। ২০১০ সালের ১৯ জানুয়ারি হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ গঠিত হলে তিনি সংগঠনটির আমীর মনোনীত হন। ২০১২ সালে সরকার বাংলাদেশ কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা কমিশন গঠন করে তাকে সভাপতি হিসেবে নিয়োগ প্রদান করে। ২০১৭ সালে তিনি আল হাইআতুল উলয়া লিল জামিআতিল কওমিয়া বাংলাদেশের সভাপতি নির্বাচিত হন।[15] ফিরোজা বেগম ছিলেন তার দাম্পত্যসঙ্গী। পারিবারিক জীবনে তিনি ২ ছেলে ও ৩ মেয়ের জনক।[16]
দারুল উলুম দেওবন্দে লেখাপড়া সমাপ্ত করে দেশে ফিরে তিনি তৎকালীন দারুল উলুম হাটহাজারীর মহাপরিচালক শাহ আব্দুল ওয়াহহাবের সাথে মিলিত হন, যিনি তাকে হাটহাজারী মাদ্রাসার শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ প্রদান করেন।[17] ১৯৮৬ সালে মুহাম্মদ হামেদের মৃত্যুর পর হাজী মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বাধীন মজলিসে শূরা আহমদ শফীকে চতুর্থ মহাপরিচালক হিসেবে নিয়োগ প্রদান করে।[18] তার আমলে ছয়তলা বিশিষ্ট আহমদ মঞ্জিল, চারতলা বিশিষ্ট মাদানি মঞ্জিল, চারতলা বিশিষ্ট নূর মঞ্জিল, চারতলা বিশিষ্ট দারুল আমান, মসজিদে বাইতুল করিমের পুনঃনির্মাণ, মসজিদে বাইতুল আতিকের প্রতিষ্ঠা, চারতলা বিশিষ্ট মেহমানখানা, ছয়তলা বিশিষ্ট শিক্ষাভবন, দুইতলা বিশিষ্ট তিনটি এবং একতলা বিশিষ্ট একটি শপিং কমপ্লেক্স নির্মিত হয়। মাদ্রাসার পশ্চিম পার্শ্বে রেলপথের পরিত্যক্ত ভূমি স্থায়ী লিজ নিয়ে সেখানে ছয় তলা বিশিষ্ট দুটি আবাসিক ভবন নির্মিত হয়। এছাড়া তার উদ্যোগে নিরবচ্ছিন্ন পানি সরবরাহের জন্য পানির ট্যাংক নির্মাণ এবং মাদ্রাসার অন্যান্য ভবনের আধুনিকায়ন ও সম্প্রসারণ কাজ সম্পন্ন হয়। তার উদ্যোগেই বিভিন্ন জায়গায় বেহাত ও জবরদখল হওয়া জমি পুনরায় মাদ্রাসার দখলে আসে।[19] ১৯৯৫ সালে মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার শতবর্ষপূর্তি উপলক্ষে 'শতবার্ষিকী দস্তারবন্দি মহাসম্মেলন' অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে মাদ্রাসার প্রায় ১০ সহস্রাধিক স্নাতকোত্তরকে দস্তারে ফজিলত বা সাম্মানিক পাগড়ি প্রদান করা হয়। উক্ত শতবার্ষিকী মহাসম্মেলন পরবর্তী ২০০২ সালে তার তত্ত্বাবধানে অনুষ্ঠিত হয় 'সপ্তবার্ষিকী দস্তারবন্দি মহাসম্মেলন'।[19] মাদ্রাসার দাওরায়ে হাদিসের ছাত্রদের সংখ্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি হওয়াতে সপ্তবার্ষিকী মহাসম্মেলনের পর থেকে শুরু করে বর্তমানে প্রতি বছর বার্ষিক মাহফিলের সাথে দস্তারবন্দি সম্মেলনও অনুষ্ঠিত হচ্ছে।[19] তার প্রচেষ্টায় মাদ্রাসায় উচ্চতর কেরাত ও তাজবীদ বিভাগ, তাহফীজুল কুরআন বিভাগ, উচ্চতর হাদিস গবেষণা বিভাগ, আরবি সাহিত্য বিভাগ, বাংলা সাহিত্য ও গবেষণা বিভাগ, কম্পিউটার বিভাগ চালু হয়। তার আমলেই মাসিক মুঈনুল ইসলামের নিয়মিত প্রকাশনা শুরু হয় এবং মাজলিসু ফিক্বহিল ইসলামী, সাপ্তাহিক সাহিত্য মজলিস, ফাতওয়ায়ে দারুল উলুম হাটহাজারী ও গুলশানে হাবীব প্রকাশিত হয়।[20] ২০২০ সালের দারুল উলুম হাটহাজারীর ছাত্র আন্দোলনের পর তিনি স্বেচ্ছায় মহাপরিচালকের পদ থেকে অব্যাহতি নেন।[21]
২০০৮ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর নেতৃত্বে জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ প্রণয়ন করা হয়। এতে ধর্ম শিক্ষাকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে মাদ্রাসা ও স্কুলে ধর্ম না পড়িয়ে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের অধীনে মসজিদ, মন্দির, গির্জা, প্যাগোডা প্রভৃতি উপাসনালয়ের মাধ্যমে ধর্মীয় শিক্ষাপ্রদানের কথা বলা হয়। এর মাধ্যমে ধর্ম শিক্ষাকে রাষ্ট্র থেকে আলাদা করার কৌশল অবলম্বন করা হয়। ২০১১ সালে জাতীয় নারী নীতি প্রণয়ন করা হয়, যেখানে ইসলাম বিরোধী বিভিন্ন নীতির অভিযোগ রয়েছে।[22] ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ‘মহান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’-এর নীতিটি বাতিল করা হয়। ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি শুরু হয় শাহবাগ আন্দোলন। এতে লাগাতার ইসলাম অবমাননা, ইসলামের প্রতীকসমূহ নিয়ে ব্যঙ্গবিদ্রূপ করার অভিযোগ উঠে। ১৫ ফেব্রুয়ারি নিহত হয় নাস্তিক ব্লগার রাজিব ওরফে থাবা বাবা। তার মৃত্যুর পর শাহবাগ সংশ্লিষ্টদের ইসলামকে আক্রমণ করা আরও বেড়ে যায়। দৈনিক আমার দেশ ও দৈনিক ইনকিলাব পত্রিকায় থাবা বাবার লেখাগুলো প্রকাশের ফলে প্রতিবাদও শুরু হয়। ১৯ ফেব্রুয়ারি সরকার ও জাতির উদ্দেশ্যে শাহবাগে ইসলাম বিদ্বেষের প্রতিবাদে গর্জে উঠুন শীর্ষক খোলা চিঠি প্রদান করেন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমির শাহ আহমদ শফী। ২২ ফেব্রুয়ারি ঢাকার বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের উত্তর গেইটে হেফাজতে ইসলাম এবং সমমনা ১২টি ইসলামী দলের পক্ষে প্রথম বিক্ষোভ মিছিলটি পুলিশি বাধায় পণ্ড হয়ে যায়।[23]
এরই পরিপ্রেক্ষিতে ৯ মার্চ দারুল উলুম হাটহাজারীতে আলেমদের নিয়ে একটি ওলামা সম্মেলনের আয়োজন করে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। এই সম্মেলন থেকে সরকারকে ১৩ দফা দাবি জানানো হয়।[23] ৫ই এপ্রিলের আগে ১৩ দফা দাবি মানা না হলে ৬ই এপ্রিল ঢাকা অভিমূখে লংমার্চের ঘোষণা দেওয়া হয়।[24] ঢাকা অভিমুখে লংমার্চ কর্মসূচিকে লক্ষ্য করে জনমত গড়ে তুলতে জেলায় জেলায় অনুষ্ঠিত হয় শানে রিসালাত সম্মেলন।[25] লংমার্চ বানচাল করতে ক্ষমতাসীন সরকারের মদদে সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি (ঘাদানিক) ও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটসহ বাম ঘরানার ২৭ সংগঠন ৪ ও ৫ এপ্রিল হরতাল পালন করে। ৬ এপ্রিল যথাসময়ে সারাদেশ থেকে অর্ধকোটি মানুষের অংশগ্রহণে লংমার্চ কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হয়।[26] ১৩ দফা দাবি মানা না হলে লংমার্চে আহমদ শফীর পক্ষে জুনায়েদ বাবুনগরী পরবর্তী পদক্ষেপ ঘোষণা করেন। সরকার দাবি না মানায় ৫ মে ঢাকা অবরোধ কর্মসূচি পালিত হয়।[27] ঢাকা অবরোধ কর্মসূচিতে পুলিশ, র্যাপিড একশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব), আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) এবং বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সমন্বয়ে গঠিত যৌথবাহিনীর আক্রমণে হেফাজতে ইসলামের ৬১ জন নিহত হয়।[28] এ ঘটনার পর শাহবাগ আন্দোলনের পতন ঘটে।[29]
২০১৬ সালে শাহ আহমদ শফীর নেতৃত্বে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ অভিযোগ করে যে স্কুলের পাঠ্যপুস্তকে ইসলামী ভাবধারা বাদ দিয়ে নাস্তিক্যবাদ এবং হিন্দুত্ববাদ পড়ানো হচ্ছে। হেফাজতে ইসলামের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়, ২০১২ সাল থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে দ্বিতীয় শ্রেণি থেকে নবম শ্রেণির বাংলা বইয়ে ‘ইসলামী ভাবধারার' ১৭টি বিষয় বাদ দেওয়া হয়েছে। ২০১৭ সালে যে পাঠ্যপুস্তক প্রকাশ করা হয়, সেখানে হেফাজতের ইসলামের দাবি অনুযায়ী মোট ২৯টি লেখা সংযোজন- বিয়োজন করে পরিবর্তন করা হয়।[15][30] ২০১৭ সালে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের সামনে গ্রিক দেবী থেমিসের ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়। সেটিকে সরিয়ে নেওয়ার দাবিতে শাহ আহমদ শফীর নেতৃত্বে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ আন্দোলন শুরু করে। হেফাজতে ইসলামের আন্দোলনের মুখে পরবর্তীতে ওই ভাস্কর্যটি সুপ্রিম কোর্টের সামনে থেকে অপসারণ করা হয়।[15][30]
শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর প্রথমে ২৫ সদস্য এবং পরে ৬২ সদস্যের আলেমদের প্রতিনিধিদল তার সাথে সাক্ষাৎ করে কওমি মাদ্রাসার শিক্ষা সনদের স্বীকৃতির দাবি জানায়। প্রতিনিধিদলে আজিজুল হক ও শাহ আহমদ শফীও ছিলেন।[31] ২০০৯ সাল থেকেই প্রধানমন্ত্রী আলেমদের সঙ্গে যে আলোচনার সূত্রপাত করেন, সেটি ২০১০ সালে গ্রহণ করা শিক্ষানীতিতেও স্থান পায়। ২০১২ সালে কওমি সনদের স্বীকৃতি বাস্তবায়নে শাহ আহমদ শফীর নেতৃত্বে বাংলাদেশ কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা কমিশন গঠন করে সরকার।[32] নানা প্রতিকূলতার কারণে কমিশনের কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হয়।[33] পরিশেষে ২০১৬ সালের ১০ ডিসেম্বর হাটহাজারী মাদ্রাসায় শাহ আহমদ শফীর সঙ্গে দেশের শীর্ষস্থানীয় আলেমদের এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সে বৈঠকে কওমি মাদ্রাসার স্বকীয়তা পূর্ণমাত্রায় বজায় রেখে দারুল উলুম দেওবন্দের মূলনীতির আলোকে কওমি সনদের স্বীকৃতি গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত হয়।[33] আলেমদের ঐক্যমতের পর ২০১৭ সালের ১১ এপ্রিল শাহ আহমদ শফীর নেতৃত্বে দেশের শীর্ষ আলেমরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করলে প্রধানমন্ত্রী আনুষ্ঠানিকভাবে কওমি সনদের স্বীকৃতির ঘোষণা প্রদান করেন।[33] ১৩ এপ্রিল শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে এসংক্রান্ত গেজেট প্রকাশিত হয়।[34] প্রজ্ঞাপন জারির পর আল হাইআতুল উলয়া লিল জামিআতিল কওমিয়া বাংলাদেশের অধীনে অভিন্ন প্রশ্নে ১৫ মে প্রথমবারের মতো সারা দেশে মোট ২১৮টি কেন্দ্রে দাওরায়ে হাদিস পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়।[35] ২০১৮ সালের ১৩ আগস্ট এই আইনের খসড়ার অনুমোদন দেয় মন্ত্রিসভা। ১০ সেপ্টেম্বর প্রথমবার তা সংসদে তোলা হয়। ১৯ সেপ্টেম্বর বিলের ওপর দেওয়া জনমত যাচাই, বাছাই কমিটিতে পাঠানো এবং সংশোধনী প্রস্তাবগুলোর নিষ্পত্তি শেষে কণ্ঠভোটে বিলটি পাস হয়।[36] ৮ অক্টোবর রাষ্ট্রপতির সম্মতিলাভের পর এটি আইনে পরিণত হয়। আইনটি পাসের জন্য ২০১৮ সালের ৪ নভেম্বর শুকরানা মাহফিল আয়োজনের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সংবর্ধনা প্রদান করা হয়।[37]
পাণ্ডিত্য আর নাস্তিক ইস্যুর কারণে তিনি কওমি ধারার একক নেতায় পরিণত হন।[38] ওমরগণি এমইএস কলেজের অধ্যাপক আ ফ ম খালেদ হোসেনের মতে, অর্ধশতাব্দীর ইতিহাসে কওমি অঙ্গনে এত জনপ্রিয় ও গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি আর হয়নি।"।[39] তার মৃত্যুর পর কওমি আলেমরা দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে এবং কওমি ধারায় নেতৃত্ব শূন্যতা সৃষ্টি হয়।[40] তার লক্ষাধিক শিষ্য ও দুই সহস্রাধিক খলিফা ছিল। এছাড়াও তার নিকট প্রতি বছর সহীহ বুখারীর পাঠ নিতেন এরকম ছাত্রের সংখ্যা আড়াই হাজারের বেশি।[5] তিনি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ ওলামা পরিষদের সভাপতি ছিলেন।[20] সৌদি আরবের হারামাইন শরিফাইনের ইমামদের নিকট তিনি শায়েখ হিসেবে প্রসিদ্ধ ছিলেন। ২০০১ সালের ১৯ আগস্ট হারামাইন শরিফাইনের মহাপরিচালক সালেহ বিন আল হুমাইদ কর্তৃক কাবার গিলাফের একটি অংশ উপহারস্বরূপ পান।[41] ২০০৫ সালে বাংলাদেশের জাতীয় সিরাত কমিটি কর্তৃক তিনি শ্রেষ্ঠ ইসলামি ব্যক্তিত্ব হিসেবে স্বীকৃতি পান।[41] তিনি দীর্ঘকাল বাংলাদেশ আর্ন্তজাতিক ইসলামী সম্মেলন সংস্থা ও বাংলাদেশ শানে রেছালত (সাঃ) সম্মেলন কমিটির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।[5] শিক্ষাক্ষেত্রে কওমি মাদ্রাসার সরকারি স্বীকৃতি লাভে নেতৃত্ব দেওয়ার পাশাপাশি তিনি নারী ও শিশুদের জন্য বিশেষভাবে কাজ করেন। নারীদের জন্য তার প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় চট্টগ্রামে প্রথম বালিকা মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। শিশুদের জন্য প্রতিষ্ঠা করেন নূরানী তালীমুল কুরআন বোর্ড চট্টগ্রাম, যার অধীনে কয়েক হাজার শিশু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মক্তব, স্কুল পরিচালিত হয়। এছাড়াও শতাধিক বালিকা মাদ্রাসা স্থাপনে তার পরোক্ষ ভূমিকা রয়েছে।[42]
তিনি আন্তর্জাতিক মজলিসে তাহাফফুজে খতমে নবুওয়ত বাংলাদেশের সভাপতি ছিলেন। কওমি মাদ্রাসার সরকারি স্বীকৃতি আদায়ের পর তিনি রাষ্ট্রীয়ভাবে আহমদিয়াদের অমুসলিম ঘোষণায় তৎপর হন। এজন্য রূপরেখা প্রস্তুত করে তিনি সরকারের সাথে দর কষাকষি আরম্ভ করেন এবং দেশব্যাপী সফর শুরু করেন। বাংলাদেশের সাবেক ধর্ম প্রতিমন্ত্রী মুহাম্মদ ওয়াক্কাসের মতে, তিনি জীবিত থাকলে এই বিষয়টিও সফলতার দেখা পেত।[43] আন্তর্জাতিক ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রামের বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সভাপতি আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামউদ্দিন নদভী বলেন, ইসলামি আকিদার জন্য, দেওবন্দী সিলসিলার জন্য, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের জন্য, সহীহ তাবলিগের জন্য, কদিয়ানিদের বিরুদ্ধে কথা বলার জন্য- তিনি সবসময় তৎপর ছিলেন।[44] বাংলাদেশ বেতারের উপস্থাপক মীযানুর রহমান রায়হান তাকে শতাব্দীর মহাজাগরণের মহানায়ক হিসেবে উপস্থাপন করেন।[45] দৈনিক যুগান্তরের সহকারী সম্পাদক তোফায়েল গাজালির মতে সমকালিন মুসলিম দুনিয়ার অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে গ্রহণযোগ্যতার বিচারে তিনি অনন্য উচ্চতায় সমাসীন হন।[46] ইসলাম নিয়ে তার জ্ঞান ও কর্মপরিধির মূল্যায়ন করে জামিয়া শরইয়্যাহ মালিবাগের শাইখুল হাদিস আবু সাবের আব্দুল্লাহ বলেন, এদেশে ‘শায়খুল ইসলাম' খেতাবের উপযুক্ত ভূমিকায় আমরা আমাদের কালে শাহ আহমদ শফী ব্যতীত দ্বিতীয় কাউকে দেখিনি, যার সুবিশাল ব্যক্তিত্বের সামনে দেশের সর্বোচ্চ পদাধিকারী ব্যক্তিরাও ছিল ম্লান নিষ্প্রভ।[47] বাংলাদেশ জমিয়তুল উলামার সভাপতি ফরীদ উদ্দিন মাসঊদ শুকরানা মাহফিলে আহমদ শফীকে স্বাধীনতা পদক দেওয়ার দাবি তুলেছিলেন।[48]
শাহ আহমদ শফী ব্যক্তি জীবনে কখনোই দলীয় রাজনীতির সাথে জড়িত হন নি।[43] ২০১৩ সালের ঢাকা অবরোধের পর তিনি ব্যাপকভাবে আলোচনায় আসেন।[49] হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল হক ইসলামাবাদীর মতে, সেসময়ে সরকারের পক্ষ থেকে আহমদ শফীকে ৫টি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব আর ৫০টি আসনের প্রস্তাব দেওয়া হয়।[50] ২০১৩ সালের ২১ নভেম্বর বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসাইন মুহাম্মদ এরশাদও একটি রাজনৈতিক জোট গঠন করতে হাটহাজারী মাদ্রাসায় এসে শাহ আহমদ শফীর সমর্থন চান।[51] হেফাজতকে একটি অরাজনৈতিক সংগঠন উল্লেখ করে তিনি উভয় প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন। জাতীয় রাজনৈতিক মঞ্চে শাহ আহমদ শফীর এই উত্থান সময়কে বাংলাদেশের কবি ও দার্শনিক ফরহাদ মজহার এক অদ্ভুত ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণ চিহ্নিত করেছেন। তার মতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে শাহ আহমদ শফীর নাম বারবারই উঠে আসবে। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, জাতীয় রাজনৈতিক দলের বিপরীতে তার গঠিত অরাজনৈতিক এবং নির্দলীয় হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ জনগণের ইচ্ছা ও আকাঙ্খা বাস্তবায়নের মাধ্যম হয়ে উঠেছিল।[4] শাহ আহমদ শফীর নেতৃত্বে গণমানুষের এই জাগরণকে বাংলাদেশের সাবেক ধর্ম ও পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী মুহাম্মদ ওয়াক্কাস অভূতপূর্ব সর্বপ্লাবী জাগরণ আখ্যায়িত করেন। তার মতে, এটি না হলে বাংলাদেশে কওমি মাদ্রাসা, মসজিদ, টুপি, দাড়ি—সবই অপরাধী সাব্যস্ত হয়ে যেত।[43] ২০১৩ সালের অস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে শাহ আহমদ শফীর আহ্বানের গুরুত্ব বুঝাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উর্দু বিভাগের প্রধান রশীদ আহমদ ধর্মীয় ঐতিহ্যের ইসরাফিলের সিঙ্গা-ফুৎকারের উপমা ব্যবহার করেন। তার মতে, এই আহ্বানের মাধ্যমে নিমেষেই জাতীয় জীবনে নবপ্রাণের সঞ্চার হয়।[52] ১৯২৪ সালে খেলাফতের পতনের পর মুসলিম দেশে শাসক ও আলেম শ্রেণির সম্পর্ক নিয়ে যে একধরনের সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি তৈরি হয় তার সমালোচনা করে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সিনিয়র নায়েবে আমীর সৈয়দ ফয়জুল করিম বলেন, বাংলাদেশেও জ্ঞান চর্চার পরিবেশে বিঘ্ন ঘটাতে এরকম অস্থিরতা তৈরির প্রেক্ষাপট তৈরি হচ্ছিল। তার মতে, আহমদ শফীর প্রচেষ্টায় শাসক-উলামা সম্পর্ককে পুনরায় একটি শান্ত-নিবিড় অবস্থায় ফিরে আসে।[53] দারুল উলুম দেওবন্দের মূলনীতি, কওমি মাদ্রাসার স্বতন্ত্র শিক্ষা ও কার্যব্যবস্থা অক্ষুণ্ণ রেখে কোনো ধরনের শর্তারোপ ব্যতীত শাহ আহমদ শফীর নেতৃত্বে কওমি মাদ্রাসার যে সরকারি স্বীকৃতি লাভ হয়েছে তাকে 'এক অসাধ্য সাধন' হিসেবে আখ্যায়িত করেন কওমি মাদ্রাসার সর্ববৃহৎ শিক্ষাবোর্ড বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের সাবেক মহাসচিব আব্দুল কুদ্দুস। তার মতে, কওমি মাদ্রাসায় সরকারি হস্তক্ষেপ এড়াতে শাহ আহমদ শফী রাষ্ট্রীয় বরাদ্দও প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।[54]
তার রচনাবলির সংখ্যা মোট ২২টি। এর মধ্যে বাংলায় ১৩টি এবং উদুর্তে নয়টি।[55] যথা:[56]
দারুল উলুম হাটহাজারীর ছাত্র আন্দোলনের পর ২০২০ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর শাহ আহমদ শফী মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর পর জানাজার নামাজের সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি হলে, তার ছেলে আনাস মাদানি বলেন, আহমদ শফী সারা জীবন এক জানাজার পক্ষে ছিলেন।[57] ১৯ সেপ্টেম্বর দুপুর ২টা বাজে হাটহাজারী মাদ্রাসায় তার জানাজার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। এতে ইমামতি করেন তার বড় ছেলে মোহাম্মদ ইউসূফ। জানাজা নামাজ শেষে আহমদ শফীর ওসিয়ত অনুসারে তাকে মাদ্রাসার বাইতুল আতিক জামে মসজিদ সংলগ্ন ‘মাকবারাতুল জামিয়া’ নামক কবরস্থানে দাফন করা হয়।[2] তার জানাজার নামাজ ছিল স্মরণকালের সবচেয়ে বড় জানাজা।[58] এতে ৬ শতাধিক র্যাব ও পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের পাশাপাশি ১০ প্লাটুন বিজিবি সদস্য মোতায়েন করা হয়। এছাড়াও ৪ উপজেলায় ৭ জন ম্যাজিস্ট্রেট দায়িত্ব পালন করে।[2] আহমদ শফীকে নিয়ে কটুক্তির অভিযোগে আলাউদ্দিন জিহাদী নামক এক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়।[59]
আহমদ শফীর মৃত্যুর পর "শহীদ শাইখুল ইসলাম আল্লামা শাহ আহমদ শফী (রহ.): হাটহাজারীতে জীবনের শেষ তিন দিন" শিরোনামে ৩৬ পৃষ্ঠার একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়, যাতে তার মৃত্যুকে হত্যাকাণ্ড হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।[60] ১৭ ডিসেম্বর আহমদ শফীর শ্যালক মোহাম্মদ মাঈনুদ্দিন বাদী হয়ে আহমদ শফীর মৃত্যুকে হত্যা আখ্যায়িত করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলায় অভিযোগ করা হয়, আহমদ শফীকে মানসিক নির্যাতন এবং তার অক্সিজেন মাস্ক খুলে দিয়ে হত্যা করা হয়। এ মামলায় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) জুনায়েদ বাবুনগরী, মামুনুল হক সহ ৪৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করে।[61] তবে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ ও দারুল উলুম হাটহাজারীর যৌথ সংবাদ সম্মেলনে আহমদ শফীর মৃত্যুকে স্বাভাবিক উল্লেখ করে হত্যার অভিযোগ অস্বীকার করা হয় এবং এ মামলাকে রাজনৈতিক চক্রান্ত উল্লেখ করা হয়।[62]
১৮ সেপ্টেম্বর আলাদা বার্তায় শোকবাণী প্রদান করেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ।[63] পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্টের সাবেক বিচারপতি তাকি উসমানি বলেন, তার খেদমত ও অবদানগুলো শুধু বাংলাদেশেই নয়, বরং পুরো উপমহাদেশে বিস্তৃত। মিশরের মুসলিম ব্রাদারহুডের আধ্যাত্মিক নেতা ইউসুফ আল কারযাভি শোক প্রকাশ করে বলেন, ইসলাম ও মুসলমানের প্রতি তার অবদানের সর্বোচ্চ প্রতিদান দিন। ভারতের জমিয়ত উলামায়ে হিন্দের নেতা আরশাদ মাদানি বলেন, তিনি ছিলেন মুসলিম উম্মাহর ব্যথায় ব্যথিত একজন আলেম। লিবিয়ার ইতিহাসবিদ আলি সাল্লাবি তার মৃত্যুকে নতুন হিজরি বর্ষের সবেচেয়ে বড় হৃদয় বিদারক ঘটনা হিসেবে উপস্থাপন করেন। কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞানের অধ্যাপক নায়েফ বিন নাহার বলেন, মানুষের হৃদয়ে তার সম্মানজনক অবস্থান ছিল। ব্রিটেনের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক আকরাম নদভী শোকবার্তায় তার কাছ থেকে ইংল্যান্ডে হাদিসের সনদ নেওয়ার কথা স্মরণ করেন। বিশ্ব মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য রাবে হাসানী নদভী বলেন, আহমদ শফীর ইন্তেকাল ইসলামী জ্ঞানের জগতে অপূরণীয় শূণ্যতা তৈরি করেছে। বাংলাদেশি আরবি সাহিত্যিক সুলতান যওক নদভী বলেন, ইসলামের সুমহান ঐতিহ্যের সুরক্ষায় এ মনীষী ছিলেন মুসলিম উম্মাহর একনিষ্ঠ পথপ্রদর্শক ও ওলামায়ে কেরামের ঐক্যের প্রতীক।[64] তাবলীগ জামাতের আমীর সাদ কান্ধলভি বলেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক সামাজিক, ধর্মীয় শিক্ষা ও তাবলিগি কাজের নেতৃত্বে শাহ আহমদ শফী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।[65] ভারতের রাজ্যসভার প্রাক্তন সদস্য মাহমুদ মাদানি তার শোকবার্তায় মাদানি পরিবারের সাথে তার দীর্ঘ পঞ্চাশ বছরেরও অধিক সময়ের কথা স্মরণ করেন। সৌদি আরব ভিত্তিক প্রবাসী রোহিঙ্গা আলেমদের আন্তর্জাতিক সংগঠন রোহিঙ্গা ওলামা কাউন্সিল তাদের বিবৃতিতে রোহিঙ্গা জাতির ক্রান্তিলগ্নে বাংলাদেশে তার অবদানের কথা স্মরণ করে৷ এছাড়াও শোক প্রকাশ করেন শ্রীলংকার প্রধান মুফতি রিজভী।[66]
তার মৃত্যুকে দেশবাসীর জন্য অপূরণীয় ক্ষতি হিসেবে বর্ণনা করে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল।[67] বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ শোকবার্তায় ইসলামি সভ্যতা বিকাশে আহমদ শফীর সারাজীবনের অবদানকে স্মরণ করে।[68] জামায়াতে ইসলামীর বিবৃতিতে তাকে আলেম-উলামা ও তৌহিদী জনতার প্রিয় রাহবার হিসেবে উল্লেখ করা হয়।[69] জাতীয় পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও বিরোধীদলীয় নেত্রী রওশন এরশাদ শোক প্রকাশ করে বলেন, কওমি মাদ্রাসার শিক্ষা ব্যবস্থার আধুনিকায়ন এবং ইসলামের প্রচার ও প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন আহমদ শফী।[70] পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ বলেন, আল্লামা শফী ছিলেন অন্যায় ও অসত্যের বিরুদ্ধে আপসহীন।[71] ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের শোকবার্তায় বলা হয়, দেশের কওমি শিক্ষার কিংবদন্তি ছিলেন বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ ও আলেম শাহ আহমদ শফী।[72] ২০২০ সালের ৮ নভেম্বর আহমদ শফীর মৃত্যুতে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের বিশেষ অধিবেশনে একটি শোক প্রস্তাব পাস করা হয়।[73]
২০২০ সালের ২১ অক্টোবর আহমদ শফীর পরিবার ও আঞ্জুমানে দাওয়াতে ইসলাহের যৌথ উদ্যোগে তার স্মারক প্রকাশের ঘোষণা দেওয়া হয়।[74] তার জীবন নিয়ে ২০২০ সালে সৈয়দ মবনু রচনা করেন সময়ের মহানায়ক। একই বছর প্রকাশিত আহমদ শফীর আরেকটি জীবনীগ্রন্থ মাহমুদ তাশফীন লিখিত কিংবদন্তি শায়েখ আল্লামা আহমদ শফী। ২০২১ সালের মার্চ মাসে জামিয়া আরাবিয়া ইমদাদুল উলুম ফরিদাবাদ থেকে প্রকাশিত মাসিক নেয়ামত সাময়িকীর শায়খুল ইসলাম সংখ্যা বের হয়। আগামী প্রজন্মের কাছে আহমদ শফীর অবদান তুলে ধরতে ২০২০ সালের ১৯ নভেম্বর আল্লামা আহমদ শফী পরিষদ গঠন করা হয়।[75] ২০২০ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর আহমদ শফীর স্মরণে মাদানী একাডেমি অফ নিউইয়র্কের উদ্যোগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একটি স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হয়।[76]
শাহ আহমদ শফীর মৃত্যুর পর হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমীর মনোনীত হন জুনায়েদ বাবুনগরী।[77] বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের নেতৃত্বে আসেন মাহমুদুল হাসান। তিনি মজলিসে আমেলার ১২৫ জন সদস্যের মধ্যে ৬৪ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। আইন অনুসারে, তিনি আল হাইআতুল উলয়া লিল জামিআতিল কওমিয়া বাংলাদেশের চেয়ারম্যানও নির্বাচিত হন।[78]
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.