Loading AI tools
গৌড় সম্রাট উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
মহাশৈব শশাঙ্ক ছিলেন প্রাচীন বাংলার গৌড় সাম্রাজ্যের সার্বভৌম রাজা। গৌড় সাম্রাজ্যের সার্বভৌম নৃপতি ও বাংলা অঞ্চলে একীভূত রাষ্ট্রের প্রথম স্বাধীন রাজা। তিনি বাংলার বিভিন্ন ক্ষুদ্র রাজ্যকে একত্র করে গৌড় জনপদ গড়ে তোলেন।[1] খ্রিস্টীয় ৭ম শতাব্দীতে তিনি রাজত্ব বলে ধারণা করা হয়। ঐতিহাসিকদের মতে তিনি ৫৯৩ থেকে ৬৩৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে রাজত্ব করেন। তাঁর সিংহাসনে আরোহনের দিন থেকেই গণনা শুরু হয় বাঙ্গলা বর্ষপঞ্জি বা বঙ্গাব্দ । তাঁর রাজধানীর নাম ছিল কর্ণসুবর্ণ বা কানসোনা।
গৌড় রাজ্য | |
---|---|
৬০৬–৬৪০ | |
বৃষভধ্বজ
পতাকা
| |
শশাঙ্কের মৃত্যুর সময় দক্ষিণ এশিয়ার প্রধান রাজ্যগুলোর মানচিত্রে পীতাভ-সবুজ বর্ণে গৌড় রাজ্যের ভৌগোলিক ব্যপ্তি, আনুমানিক ৬২৫ খ্রি. | |
রাজধানী | কর্ণসুবর্ণ |
প্রচলিত ভাষা | বাংলা |
ধর্ম | হিন্দু(মহাপাশুপতশৈব) |
জাতীয়তাসূচক বিশেষণ | বাঙালি |
সরকার | রাজতন্ত্র |
রাজা | |
• ৬০৬ - ৬৩৮ | শশাঙ্ক |
• ৬৩৮ - ৬৪০ | মানব |
ঐতিহাসিক যুগ | হর্ষাব্দ |
• প্রতিষ্ঠা | ৬০৬ |
• বিলুপ্ত | ৬৪০ |
বর্তমানে যার অংশ | টেমপ্লেট:(পূর্ব ও পশ্চিম বাংলার অংশবিশেষ মিলে পূর্ব ও পশ্চিমবাংলার অংশবিশেষ মিলে) |
বাংলার ইতিহাসে তিনি বিশিষ্ট স্থান দখল করে আছেন। শশাঙ্ক প্রথম বাঙালি সম্রাট ও প্রথম স্বাধীন বাঙালি নৃপতি। তিনি মোটামুটি ভাবে ৫৯০ থেকে ৬২৫ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে রাজত্ব করেন বলে ধারণা করা হয়।[2] তাঁর ৮ম ও ১০ম রাজ্যাংকে প্রকাশিত দুটি লিপি পাওয়া গেছে মেদিনীপুর থেকে এবং তারিখবিহীন অপর একটি লিপি খড়গপুরের নিকট এগ্রা হতে আবিষ্কৃত হয়েছে। এছাড়া শশাঙ্কের অধীনস্থ গঞ্জামের (উড়িষ্যা) রাজা মাধববর্মার তাম্রশাসন (৬১৯ খ্রিষ্টাব্দের), হর্ষবর্ধনের বাঁশখেরা ও মধুবন তাম্রশাসন এবং কামরূপের রাজা ভাস্কর বর্মনের নিধানপুর তাম্রশাসন থেকে তাঁর সম্পর্কে জানা যায়। শশাঙ্কের উৎকীর্ণ স্বর্ণ ও রৌপ্যমুদ্রাও পাওয়া গেছে। গুপ্তদের পতন ও শশাঙ্কের উত্থানের মধ্যবর্তী সময়ে বাংলায় বেশ কিছু স্বাধীন শাসকের উদ্ভব ঘটে। এঁদের অস্তিত্ব সম্পর্কে জানা যায় অল্প কিছু লিপি এবং স্বর্ণ মুদ্রার ভিত্তিতে। রোহতাসগড়ে প্রাপ্ত সিলের ছাঁচে লিখিত ‘শ্রী মহাসামন্ত শশাঙ্ক’, বাণভট্টের সমসাময়িক সাহিত্য উপকরণ, চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন-সাং এর বিবরণ এবং বৌদ্ধ গ্রন্থ আর্যমঞ্জুশ্রীমূলকল্প শশাঙ্কের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ উৎস।
সিংহাসনে আরোহণ করে তিনি বঙ্গাব্দ চালু করেন। বাংলা ক্যালেন্ডার তৈরির কৃতিত্ব শশাঙ্কের।[3] বঙ্গাব্দ (বাংলা সন) শব্দটি আকবর যুগের থেকে বহু শতাব্দী পুরনো দুটি শিব মন্দিরেও পাওয়া যায়, যা থেকে জানা যায় যে আকবরের সময়ের অনেক আগে থেকেই বাংলা ক্যালেন্ডার বিদ্যমান ছিলো।[4][5]
শশাঙ্ক বা শশাঙ্কদেব নামটি সংস্কৃত থেকে এসেছে, যা চাঁদের আরেকটি নাম। শশাঙ্কদেব নামটি তাই চন্দ্র দেবতাকে প্রকাশ করে। হিন্দু দেবতা শিবও 'শশাঙ্ক শেখর' নামে পরিচিত কারণ তিনি তার মাথায় চাঁদ ধারণ করে থাকেন।
চীনা সন্ন্যাসী জুয়ানজাং-এর লেখায় তাকে শে-শাং-কিয়া বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তাকে শশাঙ্ক নরেন্দ্রগুপ্তও বলা হয়, যা প্রাথমিকভাবে দাবি করে যে তিনি পরবর্তী গুপ্তদের বংশধর ছিলেন।[6] মগধের সিনহার রাজবংশীয় ইতিহাসে, 'শশাঙ্ক' এবং 'সোম' নামগুলো পরস্পর পরিবর্তনযোগ্যভাবে ব্যবহৃত হয়েছে।
শশাঙ্কের প্রাথমিক জীবন সম্পর্কে অতি অল্প তথ্য জানা যায়। কথিত আছে তিনি একজন শৈব ব্রাহ্মণ ছিলেন।[7] নগেন্দ্রনাথ বসু যুক্তি দেখিয়েছেন যে, শশাঙ্ক ছিলেন রাজা কর্ণদেবের পুত্র/বংশ, যিনি কর্ণসুবর্ণ শহর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।[8]
৪৬৭ খ্রিস্টাব্দে স্কন্দগুপ্তের মৃত্যুর পর গুপ্ত সাম্রাজ্য বেশ কয়েকজন দুর্বল রাজা সিংহাসন আরোহণ করেন। অন্য দিকে, প্রায় ৪৮০ খ্রিস্টাব্দে আলচন হুন সেনারা পতনশীল গুপ্ত সাম্রাজ্যকে একাধিক দিক থেকে আক্রমণ করতে শুরু করে। বিশাল সাম্রাজ্যের প্রতিরক্ষা ব্যয় রাজকীয় কোষাগারের উপর চাপ সৃষ্টি করে। যদিও প্রাথমিকভাবে হুনদের বিতাড়িত করা হয়, তবে হুনদের দীর্ঘস্থায়ী আক্রমণগুলো গুপ্ত রাজাদের পতনকে ত্বরান্বিত করেছিল। উল্লেখ্য যে ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ববিদ শঙ্কর শর্মা যুক্তি দিয়েছেন যে, ষষ্ঠ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে একটি বিশাল বন্যার ফলে গুপ্ত সাম্রাজ্যের অবসান ঘটে।[9]
ষষ্ঠ শতাব্দীর শেষের দিকে, সাম্রাজ্যটি পরবর্তী গুপ্ত রাজবংশের একজন দুর্বল শাসক, মহাসেনগুপ্ত (আরসি ৫৬২-৬০১ খ্রিষ্টাব্দ) দ্বারা শাসিত হয়েছিল।[10] গুপ্ত রাজাদের পতনের ফলে সাম্রাজ্যে বিশৃঙ্খলার দেখা দেয়। যশোধর্মনের মতো অসংখ্য স্থানীয় সামন্ত রাজা ও শাসক আবির্ভূত হন এবং প্রাক্তন সাম্রাজ্যের অনেক অংশ নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু করেন। শশাঙ্ক এই স্থানীয় শাসকদের মধ্যে একজন হিসেবে আবির্ভূত হন, যার লক্ষ্য ছিল গৌড় এবং এর আশেপাশের অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ করা।
শশাঙ্কের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় মগধ রাজ্যের রোহতাস নামক ছোট্ট শহর রোহতাসগড়ে ৭ম শতকের পাহাড়ি দুর্গে। সীলমোহরে খোদাই করে লেখা আছে, "মহাসামন্ত শশাঙ্কদেব।"
কতিপয় ইতিহাসবিদ ধারণা করেন, শশাঙ্ক, পরবর্তী গুপ্ত সাম্রাজ্যের রাজা মহাসেনগুপ্তের অধীনে মহাসামন্ত হিসেবে রাজ্য শাসন করেন।[11] কর্ণসুবর্ণের গৌড় রাজা ছিলেন সম্ভবত মৌখরী বংশের প্রতিনিধি। কর্ণসুবর্ণের অপর একজন রাজা জয়নাগ শশাঙ্কের সমসাময়িক বলে প্রতীয়মান হয়। বস্তুত কর্ণসুবর্ণ ছিল শশাঙ্কের রাজধানী এবং এ বিখ্যাত নগরী অবস্থিত ছিল বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলায় রাজবাড়িডাঙ্গার (রক্তমৃত্তিকা মহাবিহারের প্রত্নস্থল অথবা আধুনিক রাঙ্গামাটি) সন্নিকটে চিরুটি রেল স্টেশনের কাছে।
লিপিমালা এবং সাহিত্যিক সূত্রে শশাঙ্ক গৌড়ের শাসক হিসেবে বর্ণিত হয়েছেন। সংকীর্ণ অর্থে পদ্মা ও ভাগীরথী নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলই গৌড়। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে এক বিস্তৃত এলাকা এর অন্তর্ভুক্ত হয়। শক্তিসঙ্গম তন্ত্র গ্রন্থের ৭ম পটল ‘সটপঞ্চষদ্দেশবিভাগ’-এ বলা হয়েছে যে, গৌড়ের সীমানা বঙ্গদেশ হতে ভুবনেশ (উড়িষ্যার ভুবনেশ্বর) পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল। এটি অসম্ভব নয় যে, লেখক শশাঙ্কের রাজ্যসীমা, যা উড়িষ্যার একটি অংশকেও অন্তর্ভুক্ত করেছিল, চিন্তা করেই গৌড় দেশের বিস্তৃতির বর্ণনা দিয়েছেন।
প্রত্যন্ত অঞ্চলে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতির সঙ্গে গুপ্ত সাম্রাজ্যের ধ্বংস ও পতন আকস্মিক যুগপৎ সংঘটন। অনেক অপরিচিত এলাকা, যেগুলো সম্ভবত গোত্র প্রধানগণ শাসন করতেন এবং যেখানে জনবসতি ছিল হালকা, ঐতিহাসিক খ্যাতি অর্জন করে। এ এলাকাগুলোর মধ্যে ছিল পশ্চিমবঙ্গ, উত্তর উড়িষ্যা এবং মধ্যপ্রদেশ সংলগ্ন এলাকার (ছোটনাগপুর মালভূমির অংশ দ্বারা গঠিত) লালমাটি অঞ্চল, যেখানে চাষাবাদ ও বসবাস করা বেশ কষ্টসাধ্য।
এ পরিপ্রেক্ষিতে শশাঙ্ক ভারতের বিভিন্ন অংশে তাঁর রাজনৈতিক প্রভাব সম্প্রসারণের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তাঁর প্রথম কাজ ছিল মৌখরীদের দৃঢ় নিয়ন্ত্রণ থেকে মগধ মুক্ত করা। শশাঙ্ক তাঁর মিত্র মালবের রাজা দেবগুপ্তকে সঙ্গে নিয়ে পুষ্যভূতি রাজা প্রভাকরবর্ধনের জামাতা মৌখরী রাজা গ্রহবর্মার বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হন। গ্রহবর্মা, দেবগুপ্তের হাতে নিহত হন। এরপর প্রভাকরবর্ধনের জ্যেষ্ঠ পুত্র বৌদ্ধ ধর্মমতাবলম্বী থানেশ্বর রাজ রাজ্যবর্ধন দেবগুপ্তের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন এবং দেবগুপ্তকে পরাজিত ও নিহত করেন। কিন্তু দেবগুপ্তের মিত্র শশাঙ্কের সঙ্গে এক সংঘর্ষে রাজ্যবর্ধন নিহত হন।
শশাঙ্ক প্রথমে গৌড়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন এবং মগধে দৃষ্টি দেন। সেই সময়ে মগধ মৌখরি শাসনের অধীনে ছিল এবং শশাঙ্ক আবার এটিকে মুক্ত করার প্রতিজ্ঞা করেছিলেন।
সেন (১৯৭৭) দেখিয়েছেন যে, শশাঙ্ক ছাড়া আর কেউ মগধের মৌখরি শাসকদের পরাজিত করতে পারেনি।[13] এরপর, তিনি ওড়িশা, মধ্য প্রদেশের কিছু অংশ এবং বিহারে তার রাজ্য সম্প্রসারণের দিকে মনোনিবেশ করেন।
যদিও শশাঙ্ক গৌড়ের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে পরিচিত, কিন্তু তার রাজ্য বঙ্গ ও গৌড়ের চেয়েও অনেক বড় ছিলো। তাঁর রাজ্য বঙ্গ থেকে ভুবনেশ্বর পর্যন্ত প্রসারিত হয়েছিল এবং পূর্বদিকে কামরূপ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল ।
অধিকাংশ পণ্ডিত গৌড়ের রাজা শশাঙ্কের সঙ্গে রাজ্যবর্ধনের সাক্ষাতের বিষয়টি সত্য বলে ধরে নিলেও শশাঙ্ক রাজ্যবর্ধনের মৃত্যুর অভিযোগ এড়িয়ে যান। বাণভট্টের মতে, রাজ্যবর্ধন খুব সহজেই মালবের সৈন্যবাহিনীকে সম্পূর্ণভাবে পরাজিত করেন এবং তিনি ‘গৌড়ের রাজার মিথ্যা উপচারে আশ্বস্ত হয়ে নিরস্ত্র ও একাকী অবস্থায় শত্রু শিবিরে নিহত হন’। চৈনিক তীর্থযাত্রী হিউয়েন-সাং একই ধরনের বর্ণনা দেন। শশাঙ্কের শত্রুর মৃত্যুর প্রকৃত পরিস্থিতি সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্যের অভাব রয়েছে। তাই রাজ্যবর্ধনের প্রতি শশাঙ্কের আচরণ বিশ্লেষণ করা অসম্ভব। নিজের পৃষ্ঠপোষকের ভাইয়ের মৃত্যুতে গভীরভাবে শোকাহত বাণভট্ট এবং বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি বিশেষ অনুরাগী ও হর্ষবর্ধনের প্রতি ব্যক্তিগতভাবে কৃতজ্ঞ হিউয়েন-সাং উভয়েই তাদের মনোভাবের জন্য সুপরিচিত। সম্ভবত এ কারণেই রাজ্যবর্ধনের মৃত্যু সম্পর্কিত বিবরণ দানে আবেগ প্রশমিত করতে তাঁরা ব্যর্থ হয়েছেন।
কোন কোন পণ্ডিত মনে করেন রাজ্যবর্ধন খুব সম্ভব শশাঙ্কের সঙ্গে শান্তি আলোচনায় প্রস্তুত ছিলেন এবং এ কারণেই তিনি শত্রু শিবিরে আগমন করেন। হর্ষরচিতের চতুর্দশ শতাব্দীর ব্যাখ্যাকার শঙ্কর উল্লেখ করেন যে, গৌড়ের রাজা শশাঙ্ক রাজ্যবর্ধনকে আমন্ত্রণ জানান রাজ্যবর্ধনের সঙ্গে নিজ কন্যার বিবাহ সংক্রান্ত আলোচনার জন্য। বিষয়টি কতটুকু সত্য তা নিশ্চিত করে বলা বেশ কঠিন, কেননা শঙ্করের প্রদত্ত এ তথ্যের উৎস সম্পর্কে কিছু বলা হয় নি। হর্ষবর্ধনের লিপি উৎস বাঁশখেরা তাম্রশাসনে উৎকীর্ণ রাজ্যবর্ধনের মৃত্যু সম্পর্কিত তথ্য পর্যাপ্ত নয়। কিন্তু বাণভট্ট ও হিউয়েন সাং-এর বিবরণের মাধ্যমে সৃষ্ট পরিস্থিতি উপশমিত হয় যখন বাঁশখেরা তাম্রশাসনে এ তথ্য পাওয়া যায় যে, হর্ষবর্ধনের ভাই রাজ্যবর্ধন ‘সত্যানুরোধে’ শত্রুর বাসভবনে প্রাণ ত্যাগ করেন। অবশ্য এখানেও শত্রুর নাম প্রকাশ করা হয় নি। এ থেকে মনে হয় যে, অসমাপ্ত শান্তি আলোচনার জের ধরেই রাজ্যবর্ধনের মৃত্যু ঘটে। কিন্তু এ দুর্ঘটনার জন্য শশাঙ্কের ব্যক্তিগত দায়িত্ব নিশ্চিতভাবে নির্ধারণ করা যায় না।
এ ঘটনার পর রাজ্যবর্ধনের কনিষ্ঠ ভ্রাতা থানেশ্বরের সিংহাসনে আরোহণকারী হর্ষবর্ধন বিপুল সৈন্যবাহিনী নিয়ে শশাঙ্ককে শাস্তি দিতে অগ্রসর হন এবং শশাঙ্কের পূর্ব সীমান্তের প্রতিবেশী কামরূপ রাজ ভাস্করবর্মনের (বাণভট্ট উল্লিখিত কুমার) সঙ্গে মৈত্রী জোট গড়ে তোলেন। বাণভট্ট সূত্রে জানা যায়, হর্ষবর্ধন ভাণ্ডির ওপর সেনাবাহিনীর দায়িত্ব অর্পণ করে নিজে বিন্ধ্য পর্বতের জঙ্গলে তাঁর বোন রাজ্যশ্রীকে উদ্ধার কাজে ব্যস্ত ছিলেন। বোনকে উদ্ধারের পর তিনি নিজ সৈন্যদলের সঙ্গে মিলিত হন। এরপর হর্ষবর্ধন বোন রাজ্যশ্রীর অনুমতি নিয়ে কান্যকুঞ্জর (কণৌজ) সিংহাসনে আরোহণ করেন। ভাণ্ডির সৈন্যবাহিনীর অগ্রগতি সম্পর্কে আর কিছু জানা যায় না। কিন্তু এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে, শশাঙ্ক শৌর্য-বীর্যের সঙ্গেই তাঁর রাজ্য শাসন অব্যাহত রাখেন। শশাঙ্ক উত্তর উড়িষ্যা এবং বাংলা ব-দ্বীপাঞ্চলের দক্ষিণাংশও তাঁর সাম্রাজ্যভুক্ত করেন। হর্ষবর্ধন তাঁর শাসনের শেষ দিকে ৬৪০-৪৩ খ্রিস্টাব্দে দক্ষিণ-পূর্ব বিহার ও উড়িষ্যায় প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করেন এবং একই সময়ে ভাস্করবর্মন রাজধানী নগর কর্ণসুবর্ণ অধিকার করেন বলেও মনে হয়। এ সকল ঘটনা সম্ভবত শশাঙ্কের মৃত্যুর পরই ঘটেছিল, কেননা ততদিনে গৌড়ের শক্তির পতন হয়েছে এবং শশাঙ্ক সম্পর্কেও তেমন কিছু শোনা যাচ্ছিল না। কিন্তু বৌদ্ধ গ্রন্থ আর্যমঞ্জুশ্রীমূলকল্প-এ পুণ্ড্রবর্ধনের যুদ্ধে হর্ষের হাতে শশাঙ্কের পরাজয়ের কাহিনী এবং শশাঙ্কের ১৭ বছরের রাজত্বকাল সম্পর্কে যা বলা হয়েছে, তা সমসাময়িক অপর কোন উৎস দ্বারা সমর্থিত নয়। বরং অতি সম্প্রতি দক্ষিণ মেদিনীপুর হতে আবিষ্পৃত শশাঙ্কের শিলালিপিতে দণ্ডভুক্তি জনপদের অস্তিত্বের উল্লেখ রয়েছে, যা মেদিনীপুর ও উড়িষ্যার অংশবিশেষ নিয়ে গঠিত ছিল।
হর্ষবর্ধন প্রথমদিকে শৈব ধর্মের অনুসারী ছিলেন, কিন্তু ধীরে ধীরে তিনি বৌদ্ধ ধর্মের একজন মহান পৃষ্ঠপোষকে পরিণত হন। বৌদ্ধ ধর্মের একজন একান্ত অনুরাগী হিসেবে তিনি মহাযান মতবাদ প্রচারে কণৌজে এক বিশাল সংগীতি আহ্বান করেন। হর্ষবর্ধন ব্রাহ্মণদের বিদ্রোহ অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে দমন করেছিলেন বলে কথিত আছে। কণৌজের পর তিনি প্রয়াগেও অনুরূপ বিশাল বৌদ্ধ সংগীতির আয়োজন করেন। কণৌজ ও প্রয়াগের বৌদ্ধ সমাবেশে হিউয়েন-সাং এবং সীমান্তবর্তী সকল রাজ্যের রাজা, মন্ত্রী, অভিজাত প্রমুখ অংশ নেন। বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি বিরূপ মনোভাবাপন্ন শশাঙ্ককে শায়েস্তা করার জন্যই বোধিস্বত্বের নির্দেশে হর্ষের জন্ম হয়েছে বলে হিউয়েন-সাং বিশেষভাবে উল্লেখ করেন। তিনি শশাঙ্কের কয়েকটি বৌদ্ধ ধর্মবিরোধী কাজকর্মের উদাহরণও তুলে ধরেন।
কিন্তু নালন্দায় অবস্থিত বিশ্ববিদ্যালয় ( নালন্দা মহাবিহার ) উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি, যেখানে হিউয়েন-সাং নিজেও বেশ কিছুদিন লেখাপড়া করেছিলেন, এবং শশাঙ্কের রাজধানী শহর কর্ণসুবর্ণের উপকণ্ঠে রক্তমৃত্তিকা মহাবিহারসহ বেশ কিছু সংখ্যক বৌদ্ধ মঠের অস্তিত্ব থেকে হিউয়েন-সাং প্রদত্ত তথ্য সঠিক নয় বলে মনে হয়। অন্যদিকে হর্ষবর্ধনের পৃষ্ঠপোষকতা লাভকারী চৈনিক তীর্থযাত্রী হিউয়েন-সাং তাঁর পৃষ্ঠপোষকের শত্রু শশাঙ্ক সম্পর্কে বলতে গিয়ে হর্ষের প্রতি গভীর পক্ষপাতিত্ব করেছেন বলে মনে হয়। গৌড়াধিপের (শশাঙ্কের নাম উল্লিখিত হয় নি; শশাঙ্ক অর্থ ‘শিব’, আর সম্ভবত বাণভট্ট নিজেও শৈব মতাবলম্বী ছিলেন) বিরুদ্ধে হর্ষবর্ধনের সভাকবি বাণভট্ট কটূক্তিপূর্ণ ভাষা যেমন ‘গৌড়ভুজঙ্গ’ বা ‘গৌড়াধম’ ইত্যাদি ব্যবহার করে শশাঙ্কের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করেন। এটি সত্য যে, শশাঙ্ক ছিলেন ব্রাহ্মণ্য ধর্মের একজন শক্তিশালী পৃষ্ঠপোষক এবং শৈব ধর্মের প্রতি একান্ত অনুরাগী। ধনী বণিক শ্রেণী এবং তাঁর জাতশত্রু হর্ষবর্ধনের পৃষ্ঠপোষকতা লাভকারী বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি তাঁর কোন সহানুভূতি ছিল না। অসম্ভব নয় যে, তৎকালীন বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের অনুভূতি এতে আহত হয়েছিল।
অপরপক্ষে বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি হর্ষবর্ধনের অনুরাগ এবং ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রতি বিদ্বিষ্ট মনোভাব (এ প্রসঙ্গে কণৌজ সমাবেশের সময় বিপুল সংখ্যক ব্রাহ্মণকে নৃশংসভাবে দমন করার ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে) হিন্দুধর্মের অনুসারিগণকে হতাশ করে এবং তারা বিপুল সংখ্যায় পূর্ব ভারতের দিকে অভিবাসন করে। হিউয়েন-সাং কামরূপে বেশ কিছু শিক্ষিত ব্রাহ্মণের চলে যাওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন। বেশ কিছু ব্রাহ্মণ কামরূপে বসবাসের জন্য ভাস্করবর্মনের কাছ থেকে ভূমিদান লাভ করেন। কুলজি গ্রন্থে কণৌজের বেশ কিছু ব্রাহ্মণের বাংলায় অভিবাসনের উল্লেখ রয়েছে। সরযূ (উত্তর প্রদেশ) তীরবর্তী অঞ্চল থেকে বাংলার দিকে গ্রহবিপ্রগণের অভিবাসনের গল্প, সম্ভবত শশাঙ্কের আমন্ত্রণে, এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে। প্রাথমিক পর্যায়ে বাংলা ও কামরূপে সাদরে গৃহীত হলেও এই বিপুল অভিবাসন শেষ পর্যন্ত এ দুদেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার ওপর বিরূপ প্রভাব বিস্তার করে। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী পাল রাজাদের শাসনকালে বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে মেলামেশা, আচার-আচরণ ও রীতি-নীতির ক্ষেত্রে সামাজিক বাধা তেমন একটা ছিল না; কিন্তু ব্রাহ্মণ্যবাদের গোড়া সমর্থক সেন রাজাদের সময় প্রবলভাবে এসকল বাধা বিদ্যমান ছিল। এর ফলে বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের মধ্যে দূরত্ব বৃদ্ধি পায়। সমাজে নিম্ন অস্কৃশ্য ও অন্ত্যজ শ্রেণীর উত্থান ক্রমশ প্রকট হয়ে ওঠে। শশাঙ্ক বেশ ভাল রাজা ছিলেন।তিনি প্রজাদের জলকষ্ট দূর করার জন্য শরশঙ্ক নামে একটি দীঘি খনন করেন।
শশাঙ্কের মৃত্যুর পর তার সন্তান মানব আট মাস ধরে গৌড় রাজ্য শাসন করেন। অবশ্য গৌড় শীঘ্রই হর্ষবর্ধন ও কামরূপের ভাস্করবর্মনের অধীনস্থ হয়। এমনকি ভাস্করবর্মন সফলভাবে কর্ণসুবর্ণও দখল করেন।
রাজা শশাঙ্কের জারি করা তিনটি তাম্রলিপি আবিষ্কৃত হয়েছে। এর মধ্যে দুটি তার ৮ম এবং ১০ম রাজত্বের বছরে জারি করা হয়েছিল এবং মেদিনীপুর থেকে আবিষ্কৃত হয়েছিল। অন্যটি, ইগ্রা তাম্রশাসন নামে পরিচিত, খড়গপুরের কাছে আবিষ্কৃত হয়েছিল ইতিহাসবিদরা বলছেন যে বাংলার রাজকুমারদের দরবারে কবিতার বিকাশের সাথে সাথে গৌড় রচনার অনন্য শৈলীর বিকাশ ঘটে।[15][16]
বর্তমান মেদিনীপুরে অবস্থিত , শরশঙ্কা হলো একটি বিশাল দীঘি (মানবসৃষ্ট হ্রদ) যার পরিমাপ ১৪০ একরের বেশি। [17] যা মোট ৮০টি ফুটবল মাঠের প্রায় সমান। এর নান্দনিকতা হিন্দু বাস্তুশাস্ত্র স্কুল অফ আর্কিটেকচার, ডিজাইন এবং নান্দনিকতার স্পষ্ট প্রভাব দেখায়।
বাঙালি লোককথা ও কিংবদন্তি অনুসারে, রাজা শশাঙ্কের নির্দেশে দিঘিটি খনন করা হয়েছিল।[18] একটি মৌখিক ঐতিহ্যে: একবার শশাঙ্ক তার মায়ের সাথে পবিত্র তীর্থযাত্রায় যাচ্ছিলেন এবং তার কাফেলা দাতনের যমুপাতি গ্রামে শিবির স্থাপন করেছিল। সেখানে তার মা স্থানীয় আতিথেয়তায় মুগ্ধ হয়েছিলেন; তিনি তাদের জিজ্ঞাসা করলেন কেন তাদের ফলন এত কম। গ্রামবাসীরা জবাব দিল যে তারা জলের তীব্র ঘাটতিতে ভুগছে। তাই শশাঙ্কের মা তার ছেলেকে গ্রামবাসীদের জন্য কিছু করার জন্য অনুরোধ করেছিলেন, যাতে তাদের পাতলা মৌসুমে এখনও পানি থাকে। তার মায়ের ইচ্ছাকে সেকি অমান্য করতে পারে, শশাঙ্ক তার খাপ থেকে একটি তীর বের করে ঘোষণা করেছিল যে, যতদূর পর্যন্ত তার তীর পৌঁছাবে ততদূর পর্যন্ত তিনি একটি জলাধার খনন করবেন। এবং এইভাবে, তিন বছরের ব্যবধানে এবং স্থানীয় অভিজাতদের সহায়তায়, শরশঙ্কা দীঘি খনন কাজ সম্পন্ন হয়।[19]
১৯১৪ সালে প্রকাশিত, শশাঙ্ক বিখ্যাত ভারতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা একটি ঐতিহাসিক উপন্যাস , যিনি মহেঞ্জোদারোতে তাঁর আবিষ্কারের জন্য সবচেয়ে বেশি পরিচিত । তিনি শশাঙ্ককে বাংলার গৌরবময় অতীত এবং ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক আকাঙ্খার একটি শক্তিশালী প্রতীক হিসেবে দেখতে পান।[20]
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.