Loading AI tools
উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
রাজমালা ত্রিপুরা ও তার রাজবংশের ইতিহাস। বিভিন্ন সময়ে চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, নোয়াখালী ও শ্রীহট্ট ত্রিপুরার রাজার অধিকারে থাকায় রাজমালায় এইসব জায়গার ইতিহাসও বিধৃত। রাজা প্রথম ধর্মমাণিক্যের রাজত্বকালে ১৪৩১ খ্রিষ্টাব্দে বাংলা পদ্যে রাজমালা প্রথম রচিত হয়, পরে বিভিন্ন সময়ে নতুন তথ্য যোগে এটির হালনাগাদ হয়েছে। এই হিসাবে এই গ্রন্থটি চৈতন্য চরিতামৃত এবং কৃত্তিবাসী রামায়ণের থেকে প্রাচীন।
মূল রাজমালা ছয়টি লহর বা খণ্ডে রচিত। প্রথম খন্ড রচিত হয় রাজা ধর্মমাণিক্যের উদ্যোগে, পঞ্চদশ শতাব্দীতে। ত্রিপুরার রাজপুরোহিত (চন্তাই) দুর্লভেন্দ্রনারায়ণের কাছে মৌখিক পরম্পরায় ত্রিপুরী ভাষায় প্রচলিত আখ্যান শুনে বাণেশ্বর ও শুক্রেশ্বর নামে দুই ব্রাহ্মণ পণ্ডিত এটি বাংলা পদ্যে রচনা করেন। কালীপ্রসন্ন সেন বিদ্যাভূষণ সম্পাদিত রাজমালা অনুযায়ী নিচের ক্রমে এটি রচিত হয়:—
প্রথম লহর
দ্বিতীয় লহর
তৃতীয় লহর
চতুর্থ লহর
পঞ্চম লহর
ষষ্ঠ লহর
রাজা রাধাকিশোর মাণিক্যের দরবার থেকে চন্দ্রোদয় বিদ্যাবিনোদের সম্পাদনায় রাজমালা ৬ খণ্ডে সম্পূর্ণ মুদ্রিত হয়। তারপর বীরেন্দ্রকিশোর মাণিক্যের রাজত্বের শেষভাগে নতুন ঐতিহাসিক তথ্য যোগে কালীপ্রসন্ন সেন বিদ্যাভূষণ রাজমালা আরেকবার সম্পাদনা করেন। চার লহর সম্পাদনা করে তিনি মারা যাওয়ায় বাকী দুই খণ্ডের আধুনিকীকরণ হয় নি। এটি প্রকাশিত হয় বীরবিক্রম কিশোরের সময়, ১৯২৬-৩১ সালে।
কৈলাসচন্দ্র সিংহের (১৮৫১-১৯১৪) রাজমালা বা ত্রিপুরার ইতিহাস প্রকাশিত হয় ১৮৯৬ সালে। নাম রাজমালা হলেও এটি রাজকীয় রাজমালা থেকে আলাদা। কৈলাসচন্দ্র বিশ বছর ভারতীয় পুরাতাত্ত্বিক সর্বেক্ষণে কর্মরত ছিলেন। তার ঠাকুর্দা ও বাবা ত্রিপুরা রাজসরকারে যথাক্রমে মোক্তার ও সেরেস্তাদার ছিলেন।[1] ফলে বংশপরম্পরায় প্রাপ্ত ত্রিপুরা-সম্পর্কিত জ্ঞান এবং ব্যাপক পুরাতাত্ত্বিক গবেষণার অভিজ্ঞতার সংমিশ্রণে, বহু আকরগ্রন্থের পর্যালোচনাক্রমে (যথা আলেকজান্ডার ম্যাকেঞ্জির History of the Relations of the Government with the Hill Tribes of the North East Frontier of Bengal, টমাস হারবার্ট লেউইনের Hill Tracts of Chittagong, হান্টারের Statistical Accounts of Bengal, ষষ্ঠ খন্ড, এবং সদ্যপ্রকাশিত জনগণনা ও অন্যান্য সরকারি দস্তাবেজ), কৈলাসচন্দ্র তার গ্রন্থ রচনা করেন, যা ইতিহাস গবেষণায় পরবর্তীকালের বিভিন্ন ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ডক্টরাল থিসিসের পূর্বসূরী। এত পার্থক্য সত্ত্বেও রাজমালা নাম রাখার কারণ? গ্রন্থের ভূমিকায় কৈলাসচন্দ্র জানিয়েছিলেন যে তৎকালীন ত্রিপুরারাজ (বীরচন্দ্র মাণিক্য) রাজরত্নাকর নামে একটি সংস্কৃত ইতিহাস প্রকাশের উদ্যোগ নেওয়ায় এবং এই নতুন বই ত্রিপুরার ইতিহাসকে বিকৃত করতে পারে আশঙ্কা করে প্রাচীন রাজমালার ঐতিহ্য রক্ষার জন্য তিনিও এই নাম রাখেন।
তবে কৈলাসচন্দ্রের গবেষণালব্ধ তথ্যগুলি তখনকার রাজন্যভিত্তিক পরিপ্রেক্ষিতে পরিবেশিত, যার সঙ্গে এখনকার প্রজাতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির অনেক সময়ই ব্যাপক ফারাক দেখা যায়। উদাহরণস্বরূপ, ভূপেন্দ্র চক্রবর্তীর রাজমালায় তার বইয়ের উপর আধারিত সমসের গাজি অধ্যায় এবং আধুনিক সূত্র-ভিত্তিক উইকিপিডিয়ার শমসের গাজী নিবন্ধটি তুলনা করলেই এ ব্যাপারটি বোঝা যাবে।
স্কুলপড়ুয়াদের জন্য সহজ গদ্যে রাজমালা রচনা করেন ভূপেন্দ্রচন্দ্র চক্রবর্তী, বহু অলঙ্করণে সমৃদ্ধ এই রাজমালা ১৯৪১ সালে আগরতলা থেকে প্রকাশিত হয়। অলঙ্করণে ছিলেন লেখকের ভাই ও শান্তিনিকেতনের কলাভবনের বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী রমেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী (পরবর্তীকালে কলকাতার সরকারী আর্ট কলেজের অধ্যক্ষ[2]) ও তার কলাভবন-সতীর্থ ধীরেন্দ্রকৃষ্ণ দেববর্মণ। লেখকের মৃত্যুর পর ১৯৪৭ সালে ত্রিপুরার প্রবীণ সাহিত্যিক সত্যরঞ্জন বসু কর্তৃক পরিবর্ধিত হয়ে এর দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়। এই সংস্করণ বাংলা উইকিসংকলনে স্ক্যানের সাহায্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
এই বইতে মূল রাজমালার পরিধি ছাড়িয়ে কাহিনীকে ত্রিপুরার শেষ রাজা কিরীটবিক্রমকিশোর পর্যন্ত সম্প্রসারিত করা হয়েছে। এই গ্রন্থ কালীপ্রসন্ন বিদ্যাভূষণ সম্পাদিত রাজমালার পাঠ অনুযায়ী মহারাজ কল্যাণমাণিক্য অবধি রচিত হয়েছে, তারপরের অংশ গোবিন্দমাণিক্য থেকে কৃষ্ণকিশোরমাণিক্য পর্যন্ত চন্দ্রোদয় বিদ্যাবিনোদ সম্পাদিত রাজমালা অবলম্বনে রচিত। ঈশান চন্দ্রের রাজত্বের সম্পূর্ণ ও বীরচন্দ্রের আংশিক ঐতিহাসিক উপাদান কৈলাস সিংহের রাজমালা থেকে নেওয়া। বীরচন্দ্রের অর্ধ ও রাধাকিশোরের সম্পূর্ণ আলেখ্য কর্ণেল মহিমচন্দ্র ঠাকুরের দেশীয় রাজ্য অনুসারে রচিত।
রেভারেন্ড জেমস লঙ ১৮৫০ সালে এশিয়াটিক সোসাইটির জার্নালে প্রকাশিত Rajamala or An Analysis of the Chronicles of the Kings of Tripura নিবন্ধে রাজমালার সংক্ষিপ্তসার সহ বইটির উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন এবং লেখেন,
We may consider this as the most ancient work in Bengali that has come down to us, as the Chaitanya Chatitamrita was written not before 1557 and Krittibas subsequently translated the Ramayan....... The Rajmala of the Tipperah family which bears all the marks of antiquity is kept with the greatest care. I have every reason to believe it to be a genuine record of the Tipperah family.[3]
এই বক্তব্যের কারণে গ্রন্থটির ব্যাপক প্রচার হয়, এতটাই যে, প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক উইলিয়াম উইলসন হান্টার প্রণীত A Statistical Account of Bengal, Vol VI (Tipperah) (১৮৭৬)-এর ইতিহাস অংশ লঙ-রচিত রাজমালার সংক্ষিপ্তসারের ভিত্তিতে লেখা হয়েছিল।[4]
পরবর্তী গবেষকরা কলকাতা, ঢাকা ও আগরতলার বিভিন্ন প্রকাশনায় রাজমালার ঐতিহাসিকত্বের চুলচেরা বিশ্লেষণ করেছেন। দীনেশচন্দ্র ভট্টাচার্য রচিত স্বাধীন ত্রিপুরার রাজমালা (প্রবাসী, ফাল্গুন ১৩৫৪) এবং বাংলা সাহিত্যের কতিপয় ঐতিহাসিক কাব্য: রাজমালা, কৃষ্ণমালা, গাজিনামা ও চম্পকবিজয় (শাশ্বত ত্রিপুরা: ত্রিপুরা হিতসাধিনী সভার শতবার্ষিকী স্মারক সঙ্কলন, ১৮৭২-১৯৭২, কলকাতা) এবং সুধীরকৃষ্ণ দেববর্মার রাজমালা প্রসঙ্গ (আগরতলা, ১৯৫৮) এ ব্যাপারে উল্লেখযোগ্য। একদল ঐতিহাসিকের মতে পুরো বইটাই অষ্টাদশ শতাব্দী ও ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমাংশের মধ্যে রচিত। এঁদের মধ্যে আছেন প্রসিদ্ধ পুরাতত্ত্ববিদ্ দীনেশচন্দ্র সরকার (Some Epigraphical Records of the Medieval Period from Eastern India, দিল্লী, ১৯৭৯), জ্যোতিষচন্দ্র দত্ত (An Introduction to the History of Tripura: From Monarchy to Democracy, কলকাতা, ১৯৮৪) এবং জগদীশ গণচৌধুরী (Place Names, স্ব-সম্পাদিত An Anthology of Tripura, নতুন দিল্লী, ১৯৮৫)। আরেক দল ঐতিহাসিক রাজমালায় দেওয়া তথ্যের ঐতিহাসিকতা মেনে নিয়ে তার ভিত্তিতে ইতিহাস রচনায় ব্রতী হয়েছেন। যথা দীনেশচন্দ্র সেন (বৃহৎ বঙ্গ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৩৫) এবং তার পূর্বসূরী ত্রিপুরা রাজসরকারের আধিকারিক (ত্রিপুরার সমতল অংশ চাকলা রোশ্নাবাদের প্রশাসক ও পরে মহারাজ রাধাকিশোরের একান্ত সচিব[5]) ই. এফ. স্যান্ডিস (History of Tripura Compiled from Authentic Sources, কলকাতা, ১৯১৫) ও উত্তরসূরী নলিনীরঞ্জন রায়চৌধুরী (Tripura Through the Ages: A Short History of Tripura from Earliest Times to 1947, নতুন দিল্লী, ১৯৮৩)।[1]
ভূপেন্দ্র চক্রবর্তীর রাজমালা অনুসারে এখানে বইটির বিষয়বস্তু দেওয়া হল। রাজমালা যেহেতু পঞ্চদশ শতাব্দীতে রচনা শুরু হয়, তাই এর কয়েক পুরুষ আগে থেকে বইটির ঐতিহাসিক বৈধতা ধরা যেতে পারে। তাই রাজমালার ঐতিহাসিকতা সাধারণভাবে ধরা হয় ত্রয়োদশ শতাব্দীতে রাজা রত্নমাণিক্য থেকে, যিনি গৌড়ের সুলতানের কাছ থেকে মাণিক্য উপাধি পেয়ে মাণিক্য রাজবংশের সূচনা করেন।
রাজমালার কথারম্ভ চন্দ্রবংশীয় রাজা যযাতি থেকে। যযাতি শুক্রাচার্যের শাপে অকালে জরাগ্রস্ত হন। কিন্তু সেই জরা কাউকে দেওয়ার অধিকারও তার থাকে। তিনি তার পুত্রদের অনুরোধ করেন জরা নিয়ে তাকে যৌবন দিতে। কনিষ্ঠ পুত্র পুরু ছাড়া কেউ রাজি হয় না। তাই যযাতি পুরুকেই তার রাজ্য দিয়ে যান, এই পুরুর বংশেই পাণ্ডব-কৌরবদের জন্ম। যযাতির অন্য ছেলেরা ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে গিয়ে রাজ্য স্থাপন করেন। এক ছেলে দ্রুহ্যু আসেন পূর্বদিকে কিরাতদের (= মঙ্গোলয়েড) দেশে, সেখানে তিনি ত্রিবেগ নামে রাজ্য স্থাপন করেন। এই বংশের রাজা ত্রিপুর নিজের নামে রাজ্যের নাম রাখেন। ইনি খুব অত্যাচারী হওয়ায় প্রজাদের আরাধনায় শিব ত্রিশূলাঘাতে এঁকে বধ করেন। ত্রিপুরপুত্র ত্রিলোচন যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞে হাজির ছিলেন। অন্যান্য রাজ্যের সঙ্গে সংঘাতে মাঝে মাঝে এ রাজ্যের স্থান পরিবর্তন হয়, শেষ পর্যন্ত ষষ্ঠ শতাব্দীতে রাজা প্রতীত রাজত্ব স্থাপন করেন প্রবঙ্গে, যা এখন ত্রিপুরা। এর স্মরণেই ত্রিপুরাব্দ। (বর্তমান ঐতিহাসিক ধারণায় বঙ্গাব্দের মত ত্রিপুরাব্দও আকবরের ফসলী অব্দ থেকে এসেছে।[6]) প্রতীতের অধস্তন চতুর্থ পুরুষ হামতরফা রাঙ্গামাটি (বর্তমান ত্রিপুরার দক্ষিণাংশ, নোয়াখালী ও চট্টগ্রামের পশ্চিমাংশ) জয় করেন। সেখানে তখন মঘ রাজত্ব, মঘ প্রজাদের খুশি করতে রাজা নিজের নামের শেষে ফা (পিতা) উপাধি যোগ করেন।
ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষে ত্রিপুরার রাজা রত্ন ফা গৌড়ের সুলতানকে একটি অতি মূল্যবান মাণিক দিয়ে মাণিক্য উপাধি পান। এই রাজাই প্রথম ত্রিপুরায় মুদ্রা প্রবর্তন করেন।[7] মূল রাজমালায় বর্ণিত অন্যান্য উল্লেখযোগ্য রাজা নিম্নরূপ:—
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.