Loading AI tools
উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
কোন কালপরিধিতে পণ্য ও সেবার মূল্য টাকার অঙ্কে বেড়ে গেলে অর্থনীতির ভাষায় তাকে মুদ্রাস্ফীতি বলা হয়।[1] সাধারণত পণ্য/সেবার দাম বেড়ে গেলে স্থানীয় মুদ্রা দিয়ে ঐ পণ্য/সেবা ক্রয়ে বেশি পরিমাণ মুদ্রার প্রয়োজন হয় কিংবা একই পরিমাণ মুদ্রা দিয়ে কোনো পণ্য/সেবা কিনতে গেলে আগের চেয়ে পরিমাণে কম পাওয়া যায়। সুতরাং মুদ্রাস্ফীতির ফলে মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমে যায় অথবা আমরা এক কথায় বলতে পারি অধিক মুদ্রার প্রচলনকে মুদ্রাস্ফীতি বলে। একই ভাবে অর্থনীতিতে পণ্যের আসল বিনিময়মূল্য কমে যায়।[2][3] সাধারণত মুদ্রাস্ফীতি সূচকের মাধ্যমে হিসাব করা হয় যাকে মুদ্রাস্ফীতি সূচক বলা হয়।
মূদ্রাস্ফীতি একটি অর্থনীতিতে একাধারে ইতিবাচক ও নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। নেতিবাচক প্রভাবের মধ্যে নগদ অর্থের সুযোগ ব্যয় কমে যায় এবং মানুষ নগদ অর্থের সঞ্চয়ের বদলে তা খরচ করে ফেলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। এর ফলে আর্থিক প্রতিষ্ঠান সঞ্চয়ের অভাবে ভোগে এবং অর্থনীতিতে বিনিয়োগ কমে আসে। এছাড়াও মুদ্রাস্ফীতির ফলে গদবাধা আয়ের মানুষের জীবনযাত্রার মান নিচে নেমে আসে এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সূদের প্রকৃত হার পুনরায় নিরূপণ করতে হয়।[4] অপরদিকে ইতিবাচক প্রভাবগুলো হল পন্যের দাম বেড়ে যাওয়ার বিনিয়োগকারীরা নতুন বিনিয়োগে উৎসাহী হয় যার ফলে অর্থনীতিতে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্ঠি হয় এবং যার মাধ্যমে নতুন উপভোক্তা তৈরী হয়।
কিছু অর্থনীতিবিদের মতে হাইপার ইনফ্লেশন বা অত্যধিক মুদ্রাস্ফীতির অন্যতম কারণ হল বাজারে বেশি পরিমাণে তরল মুদ্রার সরবরাহ তবে অনেকের মতে এই অতিরিক্ত পরিমাণ মুদ্রা সরবরাহ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে অংশ নেয় যার কারণে মুদ্রা সরবরাহ মুদ্রাস্ফীতির একমাত্র কারণ নয়।[5][6]
আধুনিক অর্থনীতিবিদগন সবসময় একটি স্বল্প কিন্তু স্থিতিশীল মুদ্রাস্ফীতির পক্ষে মতামত দেন।[7] কারণ স্বল্পমাত্রার ও স্থিতিশীল মুদ্রাস্ফীতি অর্থনীতির সূচকগুলোকে চলমান রাখে এবং এর বাজারগুলোকে বিভিন্ন অর্থনৈতীক মন্দার মধ্যের সচল ও স্থিতিশীল রাখে। তাই বলা হয় বছরে ২% থেকে ৪%'এর মধ্যে মুদ্রাস্ফীতির হার থাকলে,সেটা দেশের পক্ষে শুভলক্ষণ। পাশাপাশি শুধু যে জিনিসপত্রের দামই বাড়ছে তা ত নয়, মানুষের আয় বা ইনকামও বাড়ছে।
এই অনুচ্ছেদটি সম্প্রসারণ করা প্রয়োজন। |
যখন জিনিসপত্রের দামবৃদ্ধির হার, ক্রেতা বা বিক্রেতার আয়বৃদ্ধির হারের চেয়ে বেশি হয়ে যায়। এই মূল্যবৃদ্ধি নানা কারণে হতে পারে-- কোনো জিনিসের চাহিদা অনেক কিন্তু সেই অনুপাতে তার যোগান নেই অথবা জিনিসটা তৈরি করতে যে কাঁচামালগুলো লাগে তার দাম খুব বেড়ে গেছে। অথবা সরকার ঠিক করেছে বেশি বেশি করে নোট ছাপাবে, যে-রকমটা হয়েছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর জার্মানিতে বা এই শতাব্দীর শুরুতে, জিম্বাবুয়েতে। [8]
মুদ্রাস্ফীতির ফলে সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্য আরো তীব্রতর হয়। উদাহরণস্বরূপ, জিনিসপত্রের দাম বাড়লে উৎপাদকের(ধরা যাক,কারখানার মালিক) উপার্জন বাড়ে, কিন্তু ক্রেতার সঞ্চয়ে ক্রমশ টান পড়তে থাকে। ভূমিহীন কৃষকদের দুরাবস্থার শেষ থাকে না।
মুদ্রাস্ফীতির ফলে চাকুরিজীবী মধ্যবিত্ত, যাদের উপার্জন নির্দিষ্ট তারা বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অন্যদিকে মুদ্রাস্ফীতির ফলে দেনাদাররা অর্থাৎ যে ঋণ নিয়েছে সে লাভবান হয় এবং পাওনাদার বা ঋণদাতারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর কারণ এই সময় দেনাদাররা তাদের সম্পত্তি বা উৎপাদিত দ্রব্য বিক্রি করে আগের চেয়ে বেশি আয় করে,সেই অর্থ দিতে তারা ধার শোধ করতে পারে। অন্যদিকে পাওনাদাররা যে অর্থ ফেরত পায়,তার ক্রয়ক্ষমতা আগের চেয়ে কমে যায়।
যারা স্টক মার্কেটে বিনিয়োগ করে, তারা এই সময়ে লাভবান হয়, কারণ শেয়ারের দাম বাড়ে কিন্তু যারা নির্দিষ্ট সুদের হারে গভর্ণমেন্ট সিকিউরিটি বা ডিবেনচারে বিনিয়োগ করে, তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
ক. বাড়ন্ত চাহিদাজনিত মুদ্রাস্ফীতি (ডিমান্ড পুল ইনফ্লেশন)
যখন কোনো পণ্যের চাহিদা বাড়ছে কিন্তু সেই অনুপাতে তার উৎপাদন অথবা যোগান বাড়েনা বা অপরিবর্তিত থাকে,তখন সেই দ্রব্যের দাম বাড়ে। [9]
করোনা পরিস্থিতিতে দেখা গেছে বিভিন্ন দেশে খাদ্যপণ্যের দাম("ফুড ইনফ্লেশন") বহুগুণ বেড়েছে। এর কারণ লকডাউনের ফলে শ্রমিক,কাঁচামাল ইত্যাদির যোগান বা সাপ্লাই চেইন বিপর্যস্ত।
উৎপাদনশীলতা ধাক্কা খেয়েছে,এদিকে চাহিদা খুব একটা কমেনি।কারণ খাদ্য মানুষের অত্যাবশ্যকীয় প্রয়োজন।
ডিমান্ড পুল ইনফ্লেশনের কারণ
মুদ্রাস্ফীতি মানে অনেক টাকা বাজারে ঘুরছে। সেক্ষেত্রে (ডলারের সাপেক্ষে) টাকার দাম কমবে।
খ. উৎপাদনখরচ বৃদ্ধিজনিত মুদ্রাস্ফীতি (কস্ট পুশ ইনফ্লেশন)
যখন কোনো জিনিস তৈরি করতে যে সামগ্রীগুলো লাগে তার দামের যখন বৃদ্ধি ঘটে,তখন সামগ্রিকভাবে দ্রব্যটির মূল্যবৃদ্ধি ঘটে। [10]
কোনো দ্রব্য উৎপাদন করতে প্রধানত চারটি বস্তু লাগে---Land,Labour,Capital and Entrepreneur. একে আমরা বলি "ফ্যাক্টর অব প্রডাকশন"। এই সব মিলিয়ে যে খরচটা হয়,সেটাকে বলে " ফ্যাক্টর কস্ট"। ফলে এখানে যদি কোনো কিছুর দাম বাড়ে,তাহলে ওই ফ্যাক্টর কস্টও বাড়বে।পাশাপাশি সেই দ্রব্যটি যখন বাজারে আসে তখন তার ওপর সরকার চাপায় অপ্রত্যক্ষ কর।তারপর সেটার বাজারি মূল্য("মার্কেট প্রাইস") ঠিক হয়।এবার যদি সরকার ট্যাক্স বাড়ায় তাহলেও জিনিসের দাম বাড়বে।এছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারে খনিজ তেলের দাম বৃদ্ধি এর অন্যতম কারণ। খনিজ তেলের দাম বাড়া মানেই ট্রান্সপোর্ট বা পরিবহনের দাম বেড়ে যাওয়া।
যখন মূল্যবৃদ্ধি বাড়তে বাড়তে ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে যায়, তখন তাকে বলে "হাইপারইনফ্লেশন"। মাসিক মূল্যবৃদ্ধির হার অন্তত ৫০% হলে তবেই এই সঙ্কটপূর্ণ অবস্থার সৃষ্টি হয়। [11]
হাইপারইনফ্লেশন ঘটার প্রধান কারণই হল সরকার কর্তৃক অনিয়ন্ত্রিতভাবে নোট ছাপানো।যত বেশি নোট ছাপানো হতে থাকে,তত বেশি টাকা লোকের পকেটে আসে,অন্যদিকে উৎপাদন সীমিত।এরফলে চাহিদার পরিমাণ বাড়ে,সাথে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়। সেই বৃদ্ধিকে সামাল দিতে সরকার আবার নোট ছাপালে,মুদ্রাস্ফীতি আরো বেড়ে যায়। ঠিক এরকমটাই হয়েছিল ২০০৭-০৮ সালে জিম্বাবুয়েতে।অনিয়ন্ত্রিত নোট ছাপার ফলে ২০০৮ সালের নভেম্বর মাসে সেই দেশের মুদ্রাস্ফীতির পরিমাণ দাঁড়ায় ৭৯৬০০০০০০০০%! এছাড়া যুদ্ধ,প্রাকৃতিক বিপর্যয় ইত্যাদিও কোনো দেশের উৎপাদনশীলতা এবং জোগানের অবিচ্ছিন্নতাকে বিনষ্ট করে হাইপারইনফ্লেশন ঘটাতে পারে।
স্বাভাবিকভাবেই হাইপারইনফ্লেশনের ফলে স্টক মার্কেটের দাম বেড়ে যায় এবং একই সাথে ব্যাক্তির জমানো পুঁজির মূল্যের অবনমন ঘটা অথবা তার সঞ্চিত অর্থের ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়।
মুদ্রাস্ফীতি মাপার জন্য বিভিন্ন সূচক ব্যবহার করা হয়। এরমধ্যে দুটি প্রধান সূচক হল হোলসেল প্রাইস ইনডেক্স (যখন হোলসেলারের জায়গা থেকে মূল্যবৃদ্ধি মাপা হয়) এবং কনসিউমার প্রাইস ইনডেক্স(যখন কনজিউমার বা ক্রেতার জায়গা থেকে মূল্যবৃদ্ধি মাপা হয়)। [12]
ইন্টারন্যাশনাল মানিটরি ফান্ডের প্রদেয় তথ্য অনুসারে,২৪ টি দেশ মুদ্রাস্ফীতি পরিমাপ করতে হোলসেল প্রাইস ইনডেক্সকে ব্যবহার করে।অন্যদিকে ১৫৭টি দেশ ব্যবহার করে কনসিউমার প্রাইস ইন্ডেক্সকে।বিভিন্ন দেশ মুদ্রাস্ফীতি পরিমাণ করার জন্য কিছু নির্দিষ্ট পরিমাণ দ্রব্যকে নির্বাচিত করে,সময়ের অন্তরে সেই সমস্ত দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধির গড়ই হল ওই দেশের মুদ্রাস্ফীতির পরিমাণ।ভারতের ক্ষেত্রে "হোলসেল প্রাইস ইন্ডেক্স"এ নির্বাচিত দ্রব্যের পরিমাণ ৬৯৭টি,অন্যদিকে "কনসিউমার প্রাইস ইনডেক্সে" নির্বাচিত দ্রব্যের পরিমাণ,গ্রামে ৪৪৮ এবং শহরে ৪৬০টি।
আগে ভারতের মুদ্রাস্ফীতি WPI তেই প্রকাশ করা হয়।কিন্তু ২০১৪ সালের পর থেকে CPI তার জায়গা নিয়েছে।
ইতিবাচক প্রভাবগুলো হল পন্যের দাম বেড়ে যাওয়ার বিনিয়োগকারীরা নতুন বিনিয়োগে উৎসাহী হয় যার ফলে অর্থনীতিতে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্ঠি হয় এবং যার মাধ্যমে নতুন উপভোক্তা তৈরী হয়।
দীর্ঘদিন পর্যন্ত মনে করা হত মুদ্রাস্ফীতি বাড়লে বেকারত্ব কমবে। এর নেপথ্যে ছিলেন উইলিয়াম ফিলিপস। ১৯৫৮ সালে তিনি এক গবেষণা পত্র প্রকাশ করেন যাতে তিনি দেখান যখন মুদ্রাস্ফীতি বেশি, তখন বেকারত্বের পরিমাণ কমছে। এর কারণ ডিমান্ড পুল ইনফ্লেশনে দেখা যেত যত জিনিসের চাহিদা বাড়ছে, সেটা উৎপাদন করার জন্য শ্রমিকের প্রয়োজন হচ্ছে, ফলে নতুন করে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে।কিন্তু পরবর্তীকালে দেখা গেল,সবসময় এই নিয়ম খাটছে না। ডিমান্ড বাড়লে শ্রমিক বেশি লাগবে ঠিক,কিন্তু একই সময়ে সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক যদি তার মানিটারি পলিসিকে কঠোর করে বাজারে টাকার পরিমাণ কমিয়ে দেয় এবং ব্যাঙ্কের সুদের হার বাড়িয়ে দেয় সেক্ষেত্রে নতুন শ্রমিকের নিয়োগ ত দূরের কথা, আগেকার শ্রমিকদেরই বেতন দিতে নাভিশ্বাস যখন একই সাথে প্রচন্ড মূল্যবৃদ্ধি এবং বেকারত্ব দেখা দেয়, তখন সেই অর্থনৈতিক দুরাবস্থাকে বলে "স্ট্যাগফ্লেশন"(Stagflation)। হজ সমীকরণে, সমানুপাতিক বা ব্যাস্তানুপাতিকে প্রকাশ করা যায় না। [13]
যখন একই সাথে প্রচন্ড মূল্যবৃদ্ধি এবং বেকারত্ব দেখা দেয়,তখন সেই অর্থনৈতিক দুরাবস্থাকে বলে "স্ট্যাগফ্লেশন"(Stagflation)।
কোনো দেশের মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য সেই দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং সেই দেশের সরকার একসাথে পরিকল্পনা স্থির করে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দ্বারা গৃহীত পরিকল্পনাকে বলা হয় "মনিটরি পলিসি" (Monetary Policy) এবং সরকারের দ্বারা গৃহীত পদক্ষেপকে বলা হয় "ফিসকাল পলিসি" (Fiscal Policy)।
যখন মুদ্রাস্ফীতি খুব বেড়ে যায়, অর্থাৎ সাধারণত বাজারে প্রচুর টাকার আগমন ঘটে, তখন কোন একটি দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক "ব্যাংক হার" বাড়িয়ে দেয়। ফলশ্রুতিতে অন্যান্য ব্যাংকগুলোও তাদের প্রদেয় বিভিন্ন ঋণের সুদের পরিমাণ বাড়াতে বাধ্য হয়। এদিকে ব্যাংকগুলোকে বেশি টাকা সুদ দিতে হলে সেইসময় ঋণ নেওয়ার প্রতিও মানুষের চাহিদা কমে। এছাড়া আগেকার ঋণ শোধ করতে তাদের অতিরিক্ত অর্থ খরচ হয়। সবমিলিয়ে ক্রেতাদের ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়। আবার যখন মুদ্রাস্ফীতির হার ঋণাত্মক অর্থাৎ বাজারে টাকার যোগান কমে যায়, তখন রিজার্ভ ব্যাংক "ব্যাংক হার" কমিয়ে দেয়। এছাড়া বাজার থেকে সরকার সিকিউরিটি কিনে বিনিময়ে নগদ অর্থ প্রদান করে।[14]
অন্যদিকে সরকারও মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে বিভিন্ন নীতি নির্ধারণ করে। যেমন, অপ্রত্যক্ষ করের জন্য জিনিসের দাম ক্রমাগত বৃদ্ধি পেলে সরকার করের বোঝা লাঘব করতে পারে। আবার সরকার বেতন বৃদ্ধির মাধ্যমে এই সম্যসার সমাধান করতে পারে।
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.