Loading AI tools
কাজী আনোয়ার হোসেনের সৃষ্ট একটি গুপ্তচরবৃত্তীয় কাহিনী-চরিত্র উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
মাসুদ রানা[1] বাংলাদেশের জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক [কাজী আনোয়ার হোসেন] সৃষ্ট একটি কাহিনী-চরিত্র। ১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দে ধ্বংস পাহাড় প্রচ্ছদনামের প্রথম গ্রন্থটি থেকে শুরু করে সেবা প্রকাশনী থেকে মাসুদ রানা সিরিজে এই চরিত্রকে নিয়ে চার শতাধিক গুপ্তচরবৃত্তীয় কাহিনীর বই প্রকাশিত হয়েছে।[2] সিরিজের প্রথম দুইটি বই মৌলিক হলেও পরবর্তীতে ইংরেজি ও অন্যান্য ভাষার বইয়ের ভাবানুবাদ বা ছায়া অবলম্বনে রচিত হওয়া বইয়ের আধিক্য দেখা যায়। তবে আরও কিছু মৌলিক বই বের হয়েছিল। মাসুদ রানার চরিত্রটিকে মূলত ইয়ান ফ্লেমিংয়ের সৃষ্ট জেমস বন্ড চরিত্রটির বাঙালি সংস্করণ হিসেবে সৃষ্টি করেছিলেন লেখক। কিন্তু বর্তমানে সিরিজটি বাংলা বই এর জগতে স্বকীয় একটি স্থান ধরে রেখে পথ চলছে।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]
এই নিবন্ধটি এমনভাবে লেখা হয়েছে যে মনে হচ্ছে এটি একটি ব্যক্তিগত ভাবনা বা মতামত সম্বলিত রচনা এবং হয়তো নিবন্ধটির পরিচ্ছন্নকরণ প্রয়োজন। (জানুয়ারি ২০২০) |
লেখক | কাজী আনোয়ার হোসেন |
---|---|
দেশ | বাংলাদেশ |
ভাষা | বাংলা |
ধারাবাহিক | মাসুদ রানা |
ধরন | রোমাঞ্চ রহস্য |
প্রকাশক | সেবা প্রকাশনী |
প্রকাশনার তারিখ | ১৯৬৬ – বর্তমান |
ওয়েবসাইট | https://sebaprokashoni.com/ |
“বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের এক দুর্দান্ত, দুঃসাহসী স্পাই গোপন মিশন নিয়ে ঘুরে বেড়ায় দেশ-দেশান্তরে। বিচিত্র তার জীবন। অদ্ভুত রহস্যময় তার গতিবিধি।
কোমলে কঠোরে মেশানো নিষ্ঠুর সুন্দর এক অন্তর। পদে পদে তার বিপদ-শিহরন-ভয় আর মৃত্যুর হাতছানি।”
মাসুদ রানা সেনাবাহিনীর প্রাক্তন মেজর, এবং কাল্পনিক সংস্থা বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স এর সদস্য, এবং তার সাংকেতিক নাম MR-9। এছাড়া রানা এজেন্সি নামক একটি গোয়েন্দা সংস্থাও রানা পরিচালনা করে থাকে। উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পূর্বে তথা ১৯৭১-এর আগের বইগুলোতে সংস্থাটির উল্লেখ থাকতো পি.সি.আই বা "পাকিস্তান কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স" হিসেবে।
মাসুদ রানার সহায়ক চরিত্রে প্রথমেই মেজর জেনারেল রাহাত খানের নাম উল্লেখযোগ্য। তিনি বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স (বিসিআই) এর প্রধান। তারই তত্বাবধানে রানা নিজের কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। এছাড়া তার কাজে সহায়তা করে থাকে সোহেল, সলিল, সোহানা, রূপা, গিলটি মিয়া প্রমুখ চরিত্রও। সাগর-সঙ্গম বইটি লিখতে গিয়ে কোনো এক বই থেকে কাছাকাছি একটা চরিত্র পেয়ে সেটাকেই কাহিনীর উপযোগী করে বসাতে গিয়ে লেখক নিজের অজান্তেই তৈরি করে ফেলেছেন গিলটি মিয়া চরিত্রটিকে। চরিত্রটির বাচনভঙ্গি তিনি তার মায়ের থেকে পেয়েছেন, যিনি হুগলির মানুষ হলেও কলকাতা শহরে বড় হয়েছিলেন। তারই মুখের ভাষা একটু অদলবদল করে নিয়ে বসিয়ে দিয়েছেন গিলটি মিয়ার মুখে। সিরিজের 'সোহেল' চরিত্রটি খানিকটা জেমস বন্ডের বন্ধু ফিলিক্স লেইটারের আদলে গড়া। 'সোহানা' হলো লেখকের কল্পনার বাঙালি মেয়ে।[4]
এছাড়া মাসুদ রানার চিরশত্রুদের তালিকায় উল্লেখযোগ্য হলো বিজ্ঞানী কবীর চৌধুরী, উ সেন প্রমুখ। 'কবীর চৌধুরী' এসেছে সেবা প্রকাশনীর কুয়াশা সিরিজের চরিত্র থেকে।[4]
মাসুদ রানার অধিকাংশ কাহিনীই বিভিন্ন বিদেশী লেখকের বই থেকে ধার করা। এলিস্ট্যার ম্যাকলীন (Alistair MacLean), রবার্ট লুডলাম (Robert Ludlum), জেমস হেডলি চেজ (James Headley Chase), উইলবার স্মিথ (Wilber Smith), ক্লাইভ কাসলার (clive cussler), ফ্রেডরিক ফরসাইথ(frederick forsyth)-সহ বহু বিদেশী, বিশেষ করে ইংরেজি সাহিত্যিকের লেখা কাহিনী থেকে ধার করে মাসুদ রানার কাহিনী লেখা হয়।[2]
কখনও কোনো বই বিদেশী কোনো একক বই থেকেই অনুবাদ করা হয়, আবার কখনও একাধিক বই মিলিয়ে লেখা হয়। যেমন: সিরিজের তৃতীয় বই স্বর্ণমৃগ লেখা হয়েছিলো ইয়ান ফ্লেমিঙের ৩টি কাহিনীর সহায়তা নিয়ে -লিভ অ্যান্ড লেট ডাই, গোল্ড ফিঙ্গার ও অন হার ম্যাজেস্টি'য সিক্রেট সার্ভিস। একাধিক বই থেকে লেখার ক্ষেত্রে প্রথমে যেখানে যেমনটা দরকার একটা কাঠামো তৈরি করে নিয়ে মাসুদ রানার উপযোগী অংশটুকু বইগুলো থেকে নেয়া হয়। তবে একক বই থেকে অংশ নেয়ার ক্ষেত্রে এমন অনেক কাহিনীও পাওয়া যায় যেগুলো সাধারণত তেমন একটা পরিবর্তনের দরকার হয় না।[7]
১৯৬০ - এর দশকে কাজী আনোয়ার হোসেনের কুয়াশা সিরিজ চলছিলো সেবা প্রকাশনী থেকে। তখন জনৈক মাহবুব আমিনের সমালোচনায় তিনি থ্রিলার সিরিজ সম্বন্ধে বৈশ্বিক একটা ধারণা লাভ করেন। মাহবুব আমিনই আনোয়ার হোসেনকে ডক্টর নো বইটি উপহার দিলে আনোয়ার হোসেন নতুন করে চিন্তা করার সুযোগ পান এবং মাহবুব আমিনের প্রেরণায় ছাপতে শুরু করেন মাসুদ রানা সিরিজের প্রথম বই ধ্বংস-পাহাড়। সেই বইটি লেখা হয়েছিলো লেখকের সেগুনবাগিচার বাসার দোতলায় বসে। বইটি লিখতে ৮-৯ মাসের মতো লেগেছিলো। লেখক, প্রথমে খসড়া একটা প্লট সাজিয়েছিলেন: 'কুয়াশা' সিরিজের আদলে, এক প্রতিভাবান বিজ্ঞানী কাপ্তাই শহরের কাছে একটা পাহাড়ের ভেতর অ্যান্টি-গ্র্যাভিটি নিয়ে গোপন গবেষণা করছিলো। কাপ্তাই বাঁধ তৈরির ফলে বিশাল লেকের নিচে তলিয়ে যাচ্ছে পাহাড়টা। তাই সে সিদ্ধান্ত নিলো পাকিস্তানের কোনো শত্রু দেশের সরবরাহ করা শক্তিশালী ডিনামাইট ফাটিয়ে উড়িয়ে দেবে বাঁধটা। আর সেটা ঠেকাবে বাংলাদেশের (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের) কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স এজেন্ট মাসুদ রানা। এই প্লটকে বাস্তবসম্মত করতে লেখক স্বয়ং ঘুরে বেড়াতে শুরু করলেন চট্টগ্রাম, রাঙামাটি, কাপ্তাই, কক্সবাজার প্রভৃতি স্থানে। একাজেই ব্যয় দীর্ঘ একটা সময়। সমস্যা দেখা দিলো তৎকালীন বাংলাদেশে এরকম ঢঙে লেখার চল ছিল না বাংলা ভাষায়, থ্রিলার ধারণ করার উপযোগী ভাষাও শিখতে লাগলেন ঠেকে ঠেকে, প্রয়োজনেই তৈরি করে নিতে হয়েছিলো লেখকের নিজস্ব একটা ধরন। শেখ আবদুল হাকিম তাই নিজের লেখায় ঠিক সন্তুষ্ট হতে পারছিলেন না, বারবার কাটাকাটি করে পাণ্ডুলিপির চেহারাটাই বিগড়ে দিলেন। তৃতীয়বার পরিষ্কার করে আবার লিখলেন গোটা কাহিনীটাই। শেষ পর্যন্ত নিজের অসন্তুষ্টি নিয়েই ছাপার জন্য প্রেসে দিয়েছিলেন, এমনকি প্রুফ রিড করার সময়ও প্রচুর সম্পাদনা করেছিলেন লেখক। এমনকি প্রকাশিত অবস্থায় হাতে পাওয়া বইটিতেও লেখক নিজে সন্তুষ্ট ছিলেন না। যদিও পাঠক ঠিকই সাদরে গ্রহণ করে নেয় মাসুদ রানাকে।[8]
রানা'র চেহারার ক্ষেত্রে লেখক চেয়েছিলেন পাঠকই নিজেকে রানা'র জায়গায় বসিয়ে ভাবুক, তাই তিনি রানা'র চেহারার কোনো স্পষ্ট বর্ণনা দেননি। প্রথম দিককার বইগুলোতে ভারতীয় গোয়েন্দা কাহিনীর প্রভাব লেখক যে সম্পূর্ণভাবে এড়িয়ে যেতে পেরেছিলেন, তা নয়। তবে কয়েকটি বই লেখার পাশাপাশি অ্যালিস্টেয়ার ম্যাকলিন, জেমস হেডলি চেজ, ডেসমন্ড ব্যাগলি, হ্যামন্ড ইনস, ফ্রেডেরিক ফোরসাইথ, পিটার বেঞ্চলি, কেন ফোলেট, ক্লাইভ কাসলার, এডওয়ার্ড এস আরনস, কলিন ফর্বস, জেরার্ড ডি ভিলিয়ার্স, জ্যাক হিগিন্স, এ জে কুইনেল, জিওফ্রি জেনকিনস, উইলবার স্মিথ প্রমুখ বড় বড় থ্রিলার লেখকের বই পড়তে পড়তে রানার চরিত্র ক্রমেই আলাদা রূপ পেতে শুরু করে।[8]
মাসুদ রানা'র নামকরণ করা হয় দুজন বাস্তব মানুষের নামের অংশ মিলিয়ে। কাজী আনোয়ার হোসেন তার স্ত্রী, আধুনিক সংগীতশিল্পী ফরিদা ইয়াসমিনের সাথে পরামর্শ করে নামটি নির্বাচন করেন। এপ্রসঙ্গে স্বয়ং কাজী আনোয়ার হোসেন বলেন:[8]
“ | আমাদের দুজনেরই বন্ধু স্বনামধন্য গীতিকার মাসুদ করিমের 'মাসুদ' আর আমার ছেলেবেলার হিরো (নায়ক) ইতিহাসে পড়া মেবারের রাজপুত রাজা রানা প্রতাপ সিংহ থেকে 'রানা' নিয়ে নাম হলো মাসুদ রানা। | ” |
কখনও কখনও এমনও হয় যে, মাসুদ রানা সিরিজ বন্ধ হবার উপক্রম হয়। প্রথমবার এমনটা হয়েছিলো বাংলাদেশের স্বাধীন হবার আগে, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকার রানার স্বর্ণমৃগ বইটি নিষিদ্ধ (ban) করেছিলো, লেখক কাজী আনোয়ার হোসেন এতে চ্যালেঞ্জ করায় গোটা সিরিজই বন্ধ করে দেওয়ার জোগাড় করেছিলেন ক্ষুব্ধ এক সরকারি কর্মকর্তা। দ্বিতীয়বার, মুক্তিযুদ্ধের পর বিভিন্ন জন টেলিফোনে হুমকি দিতে শুরু করেছিলো, কেননা স্বাধীনতার আগে ভারত কেবল একটা দেশ থাকলেও যুদ্ধের সময়কার অন্যতম মিত্র দেশ ভারত, স্বাধীনতার পরে নিকটবর্তী বন্ধু দেশ হিসেবে পরিচিতি পায়। এতে সিরিজের প্রথম দিককার বইগুলোতে ভারতকে শত্রুপক্ষ করে সাজানো কাহিনীগুলো সাধারণ্যের রোষানলে পড়ে। তখন সেবা'র কর্ণধার বাধ্য হয়ে প্রথম দিককার কয়েকটি বই থেকে ভারতবিরোধী অংশগুলো বর্জন করে নেন, এমনকি ২টি বই পুণর্লিখনও করা হয়েছিলো। তৃতীয়বার, প্লট সংকটের কারণে আটকে গিয়েছিলো সিরিজটি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর (১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে) কোনো দেশ আর বাংলাদেশের শত্রু রইল না, অথচ শত্রুদেশ ছাড়া গুপ্তচর-কাহিনী হয় না। সেটা সামাল দেয়ার জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন বড় বড় শহরে রানা ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি খুলে গুপ্তচরবৃত্তির পাশাপাশি সিরিজটিতে গোয়েন্দা, অ্যাডভেঞ্চার, ট্রেজার-হান্ট, এমনকি বিজ্ঞানকল্প ও পিশাচ কাহিনী টেনে আনা হয়েছিলো। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর পশ্চিমা লেখকরা যখন শত্রু হারিয়ে দিশেহারা, উপায়ান্তর না দেখে রানা সিরিজও খাঁটি গুপ্তচরবৃত্তি থেকে সরে এসে হয়ে পড়ে দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন নীতির আদলে চলতে শুরু করে।[7]
মাসুদ রানা সিরিজের ক্রিমিনাল বইটি বের হওয়ার পর দেখা গেলো যে, ঐ একই কাহিনী নিয়ে আগেই বন্দী গগল নামে একটি বই বেরিয়েছিলো। এধরনের ভুল এই সিরিজে একবারই হয়েছিলো।[7]
মাসুদ রানা চরিত্রটি নিয়ে বাংলাদেশে চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয় মাসুদ রানা সিরিজের ‘বিস্মরণ’ অবলম্বনে, ১৯৭৩ সালে। আর ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৭৪ সালে। পরিচালনায় ছিলেন মাসুদ পারভেজ তথা পরবর্তীকালের জনপ্রিয় অভিনেতা সোহেল রানা। তার পরিচালিত প্রথম ছবি এটি।[9] বিশ বছরের বেশি সময় পর পরবর্তীকালে লেজার ভিশনের ব্যানারে এই চলচ্চিত্রটি ডিভিডি আকারে বাজারে আসে।[10] বাংলাদেশের টিভি নাটকের ইতিহাসে প্রথম প্যাকেজ নাটক প্রাচীর পেরিয়ে এর কাহিনী রচনা করা হয় শেখ আবদুল হাকিম রচিত মাসুদ রানা সিরিজের পিশাচ দ্বীপ নামক বই থেকে। কাহিনীর নাট্যরূপ প্রদান করেন আতিকুল হক চৌধুরী। ১৯৯৪ সালে প্রচারিত এই নাটকটিতে মাসুদ রানার ভূমিকায় অভিনয় করেন জনপ্রিয় মডেল তারকা নোবেল আর তার বিপরীতে সোহানার ভূমিকায় অভিনয় করেন বিপাশা হায়াত। খলনায়কের ভূমিকায় ছিলেন কে. এস. ফিরোজ।[11]
মাসুদ রানা সিরিজটি সাধারণ বাঙালি পাঠকের ঘরে যে একেবারে সাদরে গ্রহণ করা হয়েছে, তা কিন্তু নয়। ষাট দশকের শুরুতে মাসুদ রানা সিরিজের বইয়ে উল্লেখিত নর-নারীর বিবাহ-বহির্ভূত যৌনতাশ্রয়ী সম্পর্কের বিবরণ পাঠকসমাজকে কিছুটা হলেও থমকে দিয়েছিলো। প্রথম দিকে এমনটাই হয়েছিলো যে, 'প্রজাপতি' মার্কাওয়ালা বইগুলো পড়াই নিষিদ্ধ হয়ে পড়েছিলো বাঙালি সমাজে।[2] যারা এসকল পেপারব্যাক বই পড়তো, তাদেরকেও খারাপ নজরে দেখা হতো। বর্তমানে ইন্টারনেটের দৌলতে মাসুদ রানা সিরিজ ভারতের বাঙালীদের ভেতরেও জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
মাসুদ রানা'র প্রতি নানাভাবে সমালোচনা শুরু হলে সেবা প্রকাশনী প্রথমবারের মতো বইয়ের শেষে "আলোচনা" বিভাগ চালু করে। যাতে লেখকের বক্তব্য থেকে সমালোচনাগুলোর জবাব দেয়া সম্ভব হয়। সমালোচনার বিষয়বস্তুর মধ্যে যেমন ছিলো কাহিনী ধার করে লেখার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, তেমনি ছিলো কোনো চরিত্রের মৃত্যুজনিত অতি ঠুনকো বিষয়, কেননা বইয়ের কোনো প্রিয় চরিত্রের মৃত্যুর জন্য সরাসরি দায়ী করা হতো লেখককে। চরিত্রের মৃত্যুজনিত বিষয়টিতে সবচেয়ে বেশি সমালোচনা হয়েছিলো খোদ রানা'র মৃত্যুতে। অগ্নিপুরুষ বইটিতে মাসুদ রানা, নেপল্সের কারাদারেলি হাসপাতালে মারা যায় এবং তাকে কবর দিয়ে দেশে ফেরেন অন্য চরিত্র, মেজর জেনারেল রাহাত খান। অবশ্য পরে লেখক তা কাটিয়ে ওঠেন সামান্য একটি সুযোগ পেয়ে গিয়ে; কারণ ঐ কাহিনীর শেষাংশে রাতের আঁধারে রানার মতো দেখতে এক লোককে পুলিশের লঞ্চ থেকে গোজো দ্বীপে নামতে দেখে পাঠক হয়তো রানা মারা যায়নি মনে করে আশান্বিত হোন।[7]
'মাসুদ রানা' সিরিজের লেখক হিসাবে কাজী আনোয়ার হোসেনের নাম প্রকাশিত হলেও, শেখ আবদুল হাকিম এবং ইফতেখার আমিন নামে দুইজন লেখক নিজেদের এর মূল লেখক হিসেবে দাবি করেছেন এবং স্বত্ব ও রয়্যালটি দাবি করে তারা কপিরাইট রেজিস্টার অফিসে অভিযোগ করেছেন। শেখ আবদুল হাকিম কপিরাইট অফিসে অভিযোগ করেছেন, এ পর্যন্ত কুয়াশা সিরিজ ও মাসুদ রানা সিরিজের ২৬০টি বই তিনি লিখেছেন। অপরদিকে ইফতেখার আমিন দাবি করেছেন মাসুদ রানা সিরিজে তার লেখা বইয়ের সংখ্যা ৫৮টি।[12]
২০১৯ সালের ২৯ জুলাই শেখ আব্দুল হাকিম ‘মাসুদ রানা’ সিরিজের ২৬০টি এবং ‘কুয়াশা’ সিরিজের ৫০টি বইয়ের লেখক হিসেবে স্বত্ব বা মালিকানা দাবি করে সেবা প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী কাজী আনোয়ার হোসেনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ কপিরাইট আইনের ৭১ ও ৮৯ ধারা লঙ্ঘনের অভিযোগ বাংলাদেশ কপিরাইট অফিসে দাখিল করেন।
এক বছরেরও বেশি সময় ধরে আইনি লড়াই শেষে ২০২০ সালের ১৪ জুন বাংলাদেশ কপিরাইট অফিস শেখ আবদুল হাকিমের পক্ষে রায় দিয়েছেন। ফলে দাবি করা মাসুদ রানা সিরিজের ২৬০টি এবং কুয়াশা সিরিজের ৫০টি বইয়ের লেখক হিসেবে স্বত্ব পেতে যাচ্ছেন শেখ আবদুল হাকিম।
বাংলাদেশ কপিরাইট অফিসের রায়ে বলা হয়েছে, সুষ্ঠু সমাধান ও ন্যায় বিচারের স্বার্থে কপিরাইট বোর্ড বা বিজ্ঞ আদালত থেকে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগ পর্যন্ত আবেদনকারীর দাবি করা ও তালিকাভুক্ত বইগুলোর প্রকাশ বা বাণিজ্যিক কার্যক্রম থেকে বিরত থাকার জন্য প্রতিপক্ষকে নির্দেশনা দেওয়া হলো। এছাড়া প্রতিপক্ষকে আবেদনকারীর কপিরাইট রেজিস্ট্রেশন করা প্রকাশিত বইগুলোর সংস্করণ ও বিক্রিত কপির সংখ্যা এবং বিক্রয় মূল্যের হিসাব বিবরণী এ আদেশ জারির তারিখের পরবর্তী ৩০ দিনের মধ্যে বাংলাদেশ কপিরাইট অফিসে দাখিল করার নির্দেশ দেওয়া হলো।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ কপিরাইট অফিসের রেজিস্ট্রার জাফর রাজা চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, ‘শেখ আবদুল হাকিমের দাবি করা ২৬০টি মাসুদ রানার বইয়ের মধ্যে একটি এবং কুয়াশার ৫০টি বইয়ের মধ্যে ছয়টিতে লেখক হিসেবে তার নামে কপিরাইট করা আছে। বাকিগুলোর কপিরাইট করা নেই। তবে সেগুলো তার লেখা এটি তিনি প্রমাণ করেছেন। তবে কপিরাইট অন্তর্ভুক্তির কারণে তাকে প্রতিটি বইয়ের জন্য আলাদা করে আবেদন করতে হবে। এরপর প্রতিটি বইয়ের লেখক হিসেবে তার নাম যাওয়ার পাশাপাশি, কপিরাইটও তার হয়ে যাবে।’
তিনি বলেন, ‘কাজী আনোয়ার হোসেন চাইলে অবশ্যই আমাদের এ রায়ের বিরুদ্ধে আবেদন করতে পারবেন। তা অবশ্যই ৯০ দিনের মধ্যে। এখানে তিনি হেরে গেলে, হাইকোর্টে আপিল করতে পারবেন।’
কপিরাইট অফিস সূত্রে জানা যায়, ২০১৯ সালের ২৯ জুলাই শেখ আবদুল হাকিম অভিযোগ করার পর অভিযোগকারী ও প্রতিপক্ষের আইনজীবীর উপস্থিতিতে ওই বছরের ১১ ও ৩০ সেপ্টেম্বর এবং ৪ নভেম্বর শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। শুনানিতে উভয়পক্ষ সপক্ষে নিজ নিজ বক্তব্য উপস্থাপন করেন। দাখিল করা অভিযোগের বিষয়ে প্রতিপক্ষ লিখিত বক্তব্য দাখিল করেন। প্রতিপক্ষের লিখিত বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে বাদী পুনরায় সপক্ষে লিখিত যুক্তিতর্ক দাখিল করেন। পরবর্তীতে অভিযোগকারীর দাখিল করা যুক্তির বিষয়ে প্রতিপক্ষ পুনরায় লিখিত যুক্তিতর্ক পেশ করেন।
বিষয়টি বেশ জটিল এবং দেশের প্রকাশনা শিল্পের ক্ষেত্রে লেখক ও প্রকাশকের পারস্পরিক সম্পর্কের গুরুত্ব বিবেচনা করে, এর সন্তোষজনক ও সুষ্ঠু সমাধানের উদ্দেশ্যে উক্ত অভিযোগের বিষয়ে এদেশের বিখ্যাত ও প্রথিতযশা কয়েকজন লেখক ও প্রকাশক এবং সেবা প্রকাশনীর সাবেক ব্যবস্থাপকের লিখিত মতামত চাওয়া হয়। তাদের মধ্যে ছিলেন লেখক বুলবুল চৌধুরী ও শওকত হোসেন, প্রখ্যাত শিল্পী হাসেম খান এবং সেবা প্রকাশনীর ব্যবস্থাপক ইসরাইল হোসেন খান। তাদের লিখিত মতামতের ওপর ভিত্তি করেই রোববার রায় দেওয়া হয়েছে। [13]
কপিরাইট অফিসের এই আদেশের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট করেন কাজী আনোয়ার হোসেন। শুনানি শেষে ২০২০ সালের ১০ সেপ্টেম্বর হাইকোর্ট ১৪ জুনের ওই সিদ্ধান্ত স্থগিত করে রুল জারি করেন। পরবর্তীতে কাজী আনোয়ার হোসেনের করা রিট ২০২১ সালের ১৩ ডিসেম্বর আদালত খারিজ করে দেন। এর ফলে ‘মাসুদ রানা’ সিরিজের ২৬০টি বই এবং ‘কুয়াশা’ সিরিজের ৫০টি বইয়ের স্বত্ব পান প্রয়াত লেখক শেখ আবদুল হাকিম।[14] কাজী আনোয়ার হোসেনের পক্ষের আইনজীবী হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার কথা জানান।[15]
সেবা প্রকাশনী কর্তৃক মাসুদ রানা সিরিজে এই পর্যন্ত মোট ৪৬৭টি বই প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু, প্রকৃতপক্ষে বইগুলিতে মোট ৩২০টি গল্প আছে (অনেক বইয়ের দুটি, এমনকি তিনটি ভলিউম থাকায় এমনটি হয়েছে)
১৯৭৪ সালে মাসুদ রানার কাহিনী নিয়ে প্রথম চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। যার পরিচালক ছিলেন মাসুদ পারভেজ।
মাসুদ রানা সিরিজ নিয়ে জাজ মাল্টিমিডিয়া একটি চলচ্চিত্র নির্মান করছে। একটি আপাতবাস্তব টেলিভিশন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মাসুদ রানার চরিত্র খুঁজে বের করা হবে। চলচ্চিত্রটির বাজেট ধরা হয়েছে ৫০ কোটি টাকা। যা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে বেশি বাজেটের চলচ্চিত্র। চলচ্চিত্রটির ৫০ শতাংশ হবে হলিউডে, ৪০ শতাংশ হবে বাংলাদেশের পাহাড়ী অঞ্চলে। আর বাকি ১০ শতাংশ থাইল্যান্ড বা এমন এলাকাগুলোতে। চলচ্চিত্রটির সিনেমাটোগ্রাফার এবং পরিচালক প্রায় সবাই হলিউডের। অমিতাভ রেজা চৌধুরীও চলচ্চিত্রটির সাথে যুক্ত থাকবেন।[16]
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.