মাতারবাড়ি বন্দর হলো বঙ্গোপসাগরের তীরস্থিত একটি নির্মাণাধীন সমুদ্র-বন্দর, যেটি বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বিভাগের অন্তর্গত কক্সবাজার জেলার মাতারবাড়ি এলাকার অবস্থিত।[2] বন্দরটির নির্মাণ কাজ ২০১০-এর দশকের শেষের দিকে মাতারবাড়ি তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য একটি ক্যাপটিক জেটি নির্মাণের মধ্যমে শুরু হয়েছিল, এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশ সরকার পূর্ণাঙ্গ বাণিজ্যিক বন্দর গড়ার প্রকল্প গ্রহণ করেছিল। বন্দর নির্মাণের পর, এটি হবে বাংলাদেশের প্রথম গভীর সমুদ্র-বন্দর। অনুমান করা হচ্ছে, প্রথম ধাপে বন্দর ও পণ্য পরিবহনের জন্য সড়ক নির্মাণসহ খরচ ৳১৭ হাজার ৭৭৭ কোটি থেকে ৳২০ হাজার কোটি হবে।[3]

দ্রুত তথ্য মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর, অবস্থান ...
মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর
Thumb
অবস্থান
দেশবাংলাদেশ
অবস্থানমাতারবাড়ি, মহেশখালী উপজেলা, কক্সবাজার
স্থানাঙ্ক২১.৬৯১৪° উত্তর ৯১.৮৫৯০° পূর্ব / 21.6914; 91.8590
বিস্তারিত
চালু২০২৬ (2026)[1]
মালিকবাংলাদেশ সরকার
পোতাশ্রয়ের ধরনগভীর সমুদ্র বন্দর[1]
পরিসংখ্যান
ন্যাভিগেশন চ্যানেলের দৈর্ঘ্য১৪.৩ কিলোমিটার (৮.৯ মা)[1]
ন্যাভিগেশন চ্যানেলের বিস্তৃত৩৫০ মিটার (১,১৫০ ফু)
চ্যানেলে জলের গভীরতা১৬ মিটার (৫২ ফু)[1]
বন্ধ

বন্দরটি একটি কৃত্রিম পোতাশ্রয় নিয়ে গঠিত, এবং এর নৌ-চ্যানেল সমুদ্র প্রাচীর দ্বারা পরিবেষ্টিত। পোতাশ্রয়স্থিত কন্টেইনার বার্থ ও বহুমুখী পণ্য বার্থে মধ্যমে পণ্য-সম্ভার পরিচালনা করা হবে। এটির ১৬ মিটার গভীরতা থাকবে এবং এটি প্যানাম্যাক্স ও ক্যাপসাইজ জাহাজগুলিকে মিটমাট করতে সক্ষম হবে। বন্দরের ড্রাফ্ট প্রায় ১৫ মিটার থেকে জোয়ারের সহায়তায় সর্বোচ্চ ১৮ মিটার, যা ১০০,০০০ ডেডওয়েট টন বা ৮ হাজারের বেশি কন্টেইনারবাহী জাহাজগুলিকে প্রবেশের অনুমতি দেবে।[4] বর্তমানে, ৯-মিটারের চেয়ে কম খসড়া গভীরতার জাহাজ দেশের দুটি সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রাম এবং মোংলাতে প্রবেশ করতে পারে। মাতারবাড়ি বন্দর স্থাপনের কাজে প্রায় ১৪.৩ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি নৌ-চ্যানেল তৈরি করছে জাইকা।[1] প্রধান ন্যাভিগেশনাল চ্যানেল ৩৫০ মিটার প্রশস্ত। সে সাথে বন্দরের অর্থায়নে নির্মাণ করা হবে ১০০ মিটার দীর্ঘ জেটি।

ইতিহাস

ওই বছর জাপানের প্যাসিফিক কনসালট্যান্ট ইন্টারন্যাশনাল নয়টি সম্ভাব্য এলাকা পরিদর্শন করে সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের সুপারিশ করে সমীক্ষা প্রতিবেদন জমা দেয়।[5] ফলে, বাংলাদেশে প্রথম সমুদ্রবন্দর স্থাপনের জন্য স্থান হিসাবে কক্সবাজারের সোনাদিয়া দ্বীপের প্রস্তাব রাখা হয়েছিল। বাংলাদেশ সরকার ২০১২ সালে সোনাদিয়া দ্বীপে গভীর সমুদ্রবন্দরের প্রকল্প অনুমোদন করে, এবং প্রথম পর্যায়ের কাজ শেষ করার সময় হিসাবে ২০১৬ সালকে ধরা হয়। প্রকল্পে অর্থায়ন করার আলোচনা চীনের সঙ্গে করা হয়েছিল, অবশ্য ২০১৪ সালের জুন মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফরে সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে নির্ধারিত সমঝোতা স্মারক সাক্ষর না হওয়ায় ভেস্তে যায় এই প্রকল্প।[5]

জাপানি দাতা সংস্থা জাইকার অর্থায়নে মাতারবাড়ীর কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরির উপকরণ আনার জন্য তিনটি জেটি তৈরি করার সময় সমুদ্র বন্দর তৈরির সম্ভাব্যতা যাচাই করা শুরু হয়। জাইকা ২০১৬ সালে তথ্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যে একটি সমীক্ষা করে, যেখান থেকে জানা যায় যে তিনটি জেটির সঙ্গে যে চ্যানেলটি আছে সেটিকে ব্যবহার করে বাণিজ্যিকভাবে বন্দর তৈরির সম্ভাবনা রয়েছে। এই জরিপের পর নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় ঐ অঞ্চলে সমুদ্র বন্দর তৈরির সম্ভাব্যতা পরীক্ষা করে এবং বাণিজ্যিক ব্যবহারের জন্য সমুদ্র বন্দর তৈরি করা সম্ভব বলে জানায়।[6] পরবর্তীতে পটুয়াখালীর পায়রা বন্দর নির্মাণের পাশাপাশি মাতারবাড়ীতে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল বাংলাদেশ সরকার।[5]

জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি ২০২০ খ্রিস্টাব্দের ১০ই মার্চ বন্দর নির্মাণের অনুমোদন দিয়েছিল। বন্দর ও সংযোগ সড়কসহ এই প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয় ১৭ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকা, যার মধ্যে ১২ হাজার ৮৯৩ কোটি টাকা ঋণ হিসাবে জাপান থেকে সংগ্রহ করা হয়, এবং বাংলাদেশ সরকার ২ হাজার ৬৭১ কোটি টাকা ও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ২ হাজার ২১৩ কোটি টাকার জোগান দিয়েছিল। অনুমোদনের পর, টার্মিনালের নকশা প্রণয়নের কাজ ২০২০ সালের জুলাই মাসে শুরু হয়। নকশা চূড়ান্ত হওয়ার পর দরপত্র প্রণয়ন করে বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়, এবং দরপত্রে পেন্টাওশেন কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেডের নেতৃত্বে যৌথভাবে দুটি প্রতিষ্ঠান একটি দরপত্র জমা দিয়েছিল।[6]

মাতারবাড়ীতে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায় ১৪ কিলোমিটার লম্বা চ্যানেল বা জাহাজ চলাচলের নৌপথ খনন করেছিল কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড বা সিপিজিসিবিএল। মূল পরিকল্পনা অনুযায়ী, চ্যানেলটি ৩ কিমি দীর্ঘ, ২৫০ মিটার চওড়া ও ১৫ মিটার গভীর হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু ২০১৮ সালের ২৯শে নভেম্বর নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় এবং বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুযায়ী মাতারবাড়ি বন্দর নির্মাণের জন্য চ্যানেলের গভীরতা, দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ বাড়িয়ে যথাক্রমে ১৬ মিটার, ১৪.৩ কিমি ও ৩৫০ মিটার করা হয়েছিল। চ্যানেলটি ২০২৩ খ্রিস্টাব্দের ২০ই সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১১ই নভেম্বর এই চ্যানেল উদ্বোধন ও টার্মিনালের নির্মাণকাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।[5]

মাতারবাড়ি বন্দরে কয়লা জেটিতে ২০২৩ খ্রিস্টাব্দের ২৫শে এপ্রিল ২৩০ মিটার দীর্ঘ ও ১৪ মিটার ড্রাফ্‌ট সম্পন্ন অউসু মারো নামের একটি জাহাজ প্রথম কয়লা নিয়ে নোঙর করে। জাহাজটি মাতারবাড়ি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ৮০ হাজার মেট্রিক টন কয়লা নিয়ে এসেছিল। এটি ছিল বাংলাদেশের কোন বন্দরের জেটিতে নোঙর করা সবচেয়ে বড় পণ্যবাহী জাহাজ।

অনুমান করা হচ্ছে, ২০২৬ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে গভীর সমুদ্র-বন্দরটির বহুমুখী টার্মিনাল কন্টেইনার জাহাজের জন্য প্রস্তুত হবে।[1][7]

বন্দরের বিবরণ

পোতাশ্রয় ও নৌ-চ্যানেল

মাতারবাড়ি বন্দরের পোতাশ্রয়টি একটি কৃত্রিম পোতাশ্রয়, যা নৌ-চ্যানেলের পাশাপাশি সমুদ্র প্রাচীর দ্বারা সুরক্ষিত। পোতাশ্রয়ের জন্য নির্ধারিত জলের গভীরতা ১৬ মিটার; পোতাশ্রয়ের মধ্যস্থিত মানউভার বেসিনও ১৬ মিটার গভীরতা সম্পন্ন।

আরও তথ্য গভীরতা, পরিমাপ (মিটার) ...
নৌ-চ্যানেলে জলের গভীরতা
গভীরতা পরিমাপ (মিটার)
শর্ত মান
প্রাকৃতিক গভীরতা ৫–১৬ মিটার (১৬–৫২ ফু)
খননকৃত১৬ মিটার (৫২ ফু)
জোয়ারের সময় গভীরতা সর্বোচ্চ১৮ মিটার (৫৯ ফু)
বন্ধ

বন্দর চ্যানেলটি ১৬ মিটার গভীরতার জলভাগকে পোতাশ্রয়ের সংযুক্ত জুক্ত করে। বন্দরের পোতাশ্রয়ে জাহাজ চলাচলের জন্য ১৪.৩ কিমি (৮.৯ মা) দীর্ঘ অ্যাপ্রোচ চ্যানেল ব্যবহার করা হয়। চ্যানেলটির গভীরতা ১৬ মিটার এবং ন্যূনতম ৩৫০ মিটার প্রস্থ, যা ১৫ মিটারের ড্রাফট সহ জাহাজগুলিকে জোয়ার-ভাটার সহায়তা ছাড়াই পোতাশ্রয়ে পৌঁছাতে ও প্রস্থান করতে দেয়। পোতাশ্রয় ও চ্যানেলে ৪.৮৮ মি (১৬.০ ফু) জোয়ার পরিলক্ষিত হয়, এবং জোয়ারের সহায়তায় ১৮ মি (৫৯ ফু) ড্রাফট সম্পন্ন জাহাজ জেটিতে নোঙর করতে সক্ষম।[8][9]

টার্মিনাল

বন্দরে নির্মাণের প্রাথমিক পরিকল্পনায় প্রথম ধাপে রয়েছে দুটি টার্মিনাল—সাধারণ পণ্যবাহী বহুমুখী টার্মিনাল ও কনটেইনার টার্মিনাল— নিয়ে গঠিত একটি জাহাজঘাটা এবং টাগ বোটগুলি জন্য একটি ইনার-বে। জাহাজঘাটার ডেক বা মেঝের উচ্চতায় জলপৃষ্ঠ থেকে ৯ মিটার, এবং মোট দৈর্ঘ্য ৭৬০ মিটার। টার্মিনাল দুটিতে বড় জাহাজ (মাদার ভ্যাসেল) ভিড়তে পারবে, যা বাংলাদেশের কোনো বন্দর জেটিতে ভিড়তে পারে না।[1]

নির্মাণের প্রথম পর্যায়ে কন্টেইনার টার্মিনালটি ২০ হেক্টর জমিতে নির্মিত হবে এবং ৪৬০ মিটার দীর্ঘ জাহাজঘাট বা বার্থ থাকবে। এটি ৮,০০০ টিইইউ জাহাজ ধারণ করতে সক্ষম হবে এবং এর বার্ষিক ক্ষমতা ৬,০০,০০০ থেকে ১.১ মিলিয়ন টিইইউ হবে। পরে, কনটেইনার টার্মিনাল প্রসারিত করা হবে, ৭০ হেক্টর জমিতে, এই পর্যায়ে ১,৮৫০-মিটার বার্থ থাকবে, এবং এর বার্ষিক ক্ষমতা হবে ২.৮ মিলিয়ন-টন।[1]

বহুমুখী টার্মিনালটি ১২ জমিতে নির্মিত হবে এবং এর বার্থটি ৩০০ মিটার দীর্ঘ হবে। এই টার্মিনালের বার্ষিক পণ্য পরিবহন ক্ষমতা হল ৬ লাখ টন শস্য এবং ১,২০০ টন ইস্পাত দ্রব্য।

আরও দেখুন

তথ্যসূত্র

বহিঃসংযোগ

Wikiwand in your browser!

Seamless Wikipedia browsing. On steroids.

Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.

Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.