ভারত বিভাজন
ব্রিটিশ-ভারত থেকে ভারত ও পাকিস্তান নামক দুটি স্বাধীন দেশের জন্ম উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
ব্রিটিশ-ভারত থেকে ভারত ও পাকিস্তান নামক দুটি স্বাধীন দেশের জন্ম উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ভারতকে দুই ভাগে বিভক্ত করা হয়।[lower-alpha 3] দুটি স্বাধীন ভারত ও পাকিস্তান নামে দেশ তৈরি করা হয়েছিল।[6] ভারত অধিরাজ্য বর্তমান সময়ে ভারতীয় প্রজাতন্ত্র; পাকিস্তান অধিরাজ্য বর্তমান সময়ে ইসলামি প্রজাতন্ত্রী পাকিস্তান ও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ হিসাবে পরিচিত। বিভাজনের ঘটনাটি জেলা-ভিত্তিক অমুসলিম বা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে বাংলা ও পাঞ্জাব প্রদেশের বিভাজনের সাথে জড়িত ছিল। ভারত বিভাজনের সঙ্গে সঙ্গে ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনী, রাজকীয় ভারতীয় নৌবাহিনী, ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস, রেল ও কেন্দ্রীয় কোষাগারও বিভক্ত করে দেওয়া হয়। এই বিভাজনটি ভারতীয় স্বাধীনতা আইন ১৯৪৭-এ বর্ণিত হয়েছিল এবং এর ফলে ভারতে ব্রিটিশ রাজ বা ক্রাউন শাসনের অবসান ঘটে। দুটি স্ব-শাসিত দেশ ভারত ও পাকিস্তান আইনত ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট মধ্যরাতে অস্তিত্ব লাভ করে।
তারিখ | ১৫ আগস্ট ১৯৪৭ |
---|---|
অবস্থান | দক্ষিণ এশিয়া |
ফলাফল | ব্রিটিশ ভারতীয় সাম্রাজ্যের ভারত ও পাকিস্তান অংশে বিভাজন এবং শরণার্থী সংকট |
নিহত | ২ লক্ষ থেকে ২০ লক্ষ,[1][lower-alpha 1] ১০০ লক্ষ থেকে ২০০ লক্ষ বাস্তুচ্যুত[2][3][4][5][lower-alpha 2] |
এই বিভাজনটি ধর্মীয় ভিত্তিতে ১ কোটি থেকে ২ কোটি মানুষকে বাস্তুচ্যুত করে এবং সদ্য প্রতিষ্ঠিত অধিরাজ্য দুটিতে অতিমাত্রায় শরণার্থী সংকট তৈরি করে।[2][3][4][5] বিভাজনের অব্যবহিত পূর্বে ও পরে প্রাণহানির ঘটনা সহ বড় আকারে সহিংসতা হয়, বিতর্ক সাপেক্ষে মনে করা হয়, সহিংসতায় ১ লাখ থেকে ২০ লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছিলেন।[1][lower-alpha 4] দেশ বিভাজনে সহিংসতার প্রকৃতি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বৈরিতা ও সন্দেহের পরিবেশ তৈরি করেছিল, যা আজ অবধি তাদের সম্পর্কের উপর প্রভাব ফেলে।
ভারতের বিভাজন শব্দটি ১৯৭১ সালে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের বিচ্ছিন্নতা বা ব্রিটিশ ভারতের প্রশাসন থেকে বার্মা (বর্তমানে মিয়ানমার) ও সিলনের (বর্তমানে শ্রীলঙ্কা) বিচ্ছিন্নতার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করে না।[lower-alpha 5] এই শব্দটি দুটি নতুন আধিরাজ্যের মধ্যেকার দেশীয় রাজ্যসমূহের রাজনৈতিক সংহতকরণকেও, বা দেশীয় রাজ্য হিসাবে হায়দ্রাবাদ, জুনাগড় এবং জম্মু ও কাশ্মীরের সংযুক্তি বা বিভাজনের বিরোধের বিষয়টিকেও অন্তর্ভুক্ত করে না, যদিও কিছু ধর্মীয় ধারায় দেশীয় রাজ্যে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছিল। এটি ১৯৪৭–১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দের সময়কালে ফরাসি ভারতের ছিটমহল ভারতে অন্তর্ভুক্ত করা বা ১৯৬১ সালে গোয়া ও পর্তুগিজ ভারতের অন্যান্য জেলাসমূহকে ভারতের দ্বারা অধিগ্রহণ করার বিষয়টকেও অন্তর্ভুক্ত করে না। এই অঞ্চলে ১৯৪৭ সালের অন্যান্য সমসাময়িক রাজনৈতিক সত্ত্বা, সিকিম রাজ্য, ভুটান রাজ্য, নেপাল রাজ্য ও মালদ্বীপ বিভাজনের দ্বারা প্রভাবিত হয়নি।[lower-alpha 6]
দেশীয় রাজ্যসমূহে প্রায়শই শাসকদের সম্পৃক্ততা বা আত্মতুষ্টির সাথে সহিংসতা অত্যন্ত সংঘবদ্ধ ছিল। এটা বিশ্বাস করা হয় যে শিখ রাজ্যে (জিন্দ ও কাপুরথালা ব্যতীত) মহারাজারা মুসলমানদের জাতিগত নির্মূলকরণে আত্মতৃপ্ত ছিলেন, যখন পাতিয়ালা, ফরিদকোট ও ভরতপুরের মহারাজারা তাদের আদেশ দেওয়ার ক্ষেত্রে জড়িত ছিলেন। কথিত আছে যে, ভরতপুরের শাসক তাঁর জনগণের জাতিগত নির্মূলকরণ প্রত্যক্ষ করেছিলেন, বিশেষত দীঘের মতো স্থানসমূহে।[10]
১৯০৫ সালে তাঁর দ্বিতীয় কার্যকালে তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড কার্জন ব্রিটিশ ভারতের বৃহত্তম প্রশাসনিক বিভাগ বেঙ্গল প্রেসিডেন্সিকে রাজনৈতিক ভাবে দ্বিখণ্ডিত করেন। এই বিভাজনের ফলে গঠিত হয় মুসলমান-প্রধান পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশ (অধুনা বাংলাদেশ রাষ্ট্র, ভারতের উত্তরপূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের জলপাইগুড়ি বিভাগ) এবং হিন্দু-প্রধান বঙ্গপ্রদেশ (অধুনা পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের প্রেসিডেন্সি ও বর্ধমান বিভাগ, বিহার, ঝাড়খণ্ড ও ওড়িশা রাজ্য)।[11]
কারো কারো মতে কার্জনের বঙ্গভঙ্গ প্রশাসনিক দিক থেকে খুবই ফলপ্রসূ হয়েছিল। লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্কের সময় থেকে এই ধরনের প্রশাসনিক সংস্কারের কথা অনেক বার ভাবা হলেও তা বাস্তবায়িত করা হয়নি। যদিও ভারতীয় জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে এই ঘটনার ফলে যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়, তেমনটি আগে ঘটেনি।[11] বাঙালি হিন্দু উচ্চবিত্ত গোষ্ঠী বঙ্গভঙ্গের তীব্র বিরোধিতা করেন। এঁদের অনেকেরই পূর্ববঙ্গে জমিদারি ছিল এবং সেই জমিদারির প্রজারা ছিলেন মুসলমান কৃষক। বাঙালি হিন্দু মধ্যবিত্ত বা ভদ্রলোক সমাজও নবগঠিত বঙ্গপ্রদেশে বিহারি ও ওড়িয়াদের দিয়ে বাঙালিদের সংখ্যালঘু করে দেওয়ার জন্য বঙ্গভঙ্গের তীব্র প্রতিবাদ জানান। তাঁরা মনে করেন, তাঁদের রাজনৈতিক সক্রিয়তার জন্যই কার্জন বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।[11] কার্জনের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে স্বদেশি আন্দোলন শুরু হয়। এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন দুই-বারের কংগ্রেস সভাপতি সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটিশ দ্রব্য বয়কট। ইচ্ছাকৃতভাবে না হলেও কখনও কখনও আন্দোলনকারীরা রাজনৈতিক সহিংসতার আশ্রয় নিতেন। যার ফলে সাধারণ নাগরিকরা আক্রান্ত হতেন।[12] সহিংস আন্দোলন কার্যকরী হয়নি। কারণ, সেগুলি ব্রিটিশরা প্রতিহত করেছিল এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে সেগুলি ব্যর্থ হয়েছিল।[13] উভয় ধরনের আন্দোলনের প্রধান শ্লোগান ছিল ‘বন্দেমাতরম্’। এটি ছিল বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত একটি গানের শিরোনাম। গানটি একাধারে বঙ্গজননী, ভারতমাতা ও হিন্দু দেবী কালীর উদ্দেশ্যে রচিত হয়েছিল।[14] কলকাতার ইংরেজি-শিক্ষিত ছাত্ররা যখন কলকাতা থেকে তাদের গ্রাম বা মফঃস্বলে যান, তখন আন্দোলন বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে।[15] ‘বন্দেমাতরম্’ শ্লোগানটির ধর্মীয় উন্মাদনা ও বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিবাদ যুগান্তর ইত্যাদি দলের অধীনে যুবকদের একত্রিত করে। এঁরা সরকারি ভবনে বোমা বিস্ফোরণ, সশস্ত্র ডাকাতি,[13] ও ব্রিটিশ আধিকারিকদের হত্যা করতে শুরু করে।[14] কলকাতা যেহেতু সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল, তাই এই রাজনৈতিক আন্দোলন ও ‘বন্দেমাতরম্’ শ্লোগানটি জাতীয় স্তরে পরিচিত ও স্বীকৃত হয়।[14]
বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে হিন্দুদের সর্বব্যাপী প্রতিবাদ আন্দোলন এবং তার ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের মধ্যে সংস্কারের ভয়ে ভারতের মুসলমান উচ্চবিত্ত সম্প্রদায় ১৯০৬ সালে নতুন ভাইসরয় লর্ড মিন্টোর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে মুসলমানেদের জন্য পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থার দাবি জানায়। প্রাক্তন শাসক এবং ব্রিটিশদের সঙ্গে তাদের সহায়তার নথি তুলে ধরে মুসলমান উচ্চবিত্তেরা আইনসভায় তাঁদের আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের দাবি জানান। এরপরই ১৯০৬ সালের ডিসেম্বরে ঢাকায় অল-ইন্ডিয়া মুসলিম লিগ স্থাপিত হয়। লর্ড কার্জন সেই সময় তাঁর সামরিক প্রধান লর্ড কিচেনারের সঙ্গে মতবিরোধের জেরে ইস্তফা দিয়ে ইংল্যান্ডে ফিরে গিয়েছিলেন। কিন্তু লিগ তাঁর বঙ্গভঙ্গের পরিকল্পনার সমর্থক ছিল। ১৮৭১ সালে ব্রিটিশ ভারতের জনগণনায় প্রথম ভারতের মুসলমান-অধ্যুষিত অঞ্চলগুলির কথা জানা গিয়েছিল। এরপর তিন দশক ধরে মুসলমান উচ্চবিত্ত সম্প্রদায়ের অবস্থান নির্ধারিত হয়েছিল। সেই অবস্থানই ছিল মুসলিম লিগের অবস্থান।[16] (কার্জন পূর্ববঙ্গের মুসলমানেদের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপন করতে চেয়েছিলেন। ১৮৭১ সালের জনগণনার পর থেকে পূর্ববঙ্গের মুসলমানেদের অবস্থান ব্রিটিশদের কাছে আশঙ্কাজনক হয়ে উঠেছিল। তাছাড়া সিপাহি বিদ্রোহ ও দ্বিতীয় আফগান যুদ্ধের সময় ব্রিটিশ-মুসলমান বিরোধ তাঁর বিশেষ চিন্তার কারণ হয়েছিল।[16]) ১৮৭১ সালের জনগণনার পর থেকে উত্তর ভারতের মুসলমান নেতৃবর্গ নবগঠিত হিন্দু রাজনৈতিক ও সামাজিক গোষ্ঠীগুলির গণপ্রতিরোধের সম্মুখীন হয়েছিল।[16] যেমন, আর্যসমাজ শুধুমাত্র গোরক্ষাকারী গোষ্ঠীগুলিকে সমর্থনই করেনি,[17] বরং মুসলমানেদের হিন্দুধর্মে পুনরায় ধর্মান্তরিত হওয়ার জন্য আহ্বান জানিয়েছিল।[16] ১৯শ শতাব্দীর শেষভাগে যুক্তপ্রদেশে (অধুনা উত্তরপ্রদেশ) রাজনৈতিক প্রতিনিধি সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে হিন্দুরা অধিক ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠে। সেই সময় হিন্দি-উর্দু বিতর্ক রাজনৈতিক মোড় নেয় এবং ১৮৯৩ সালে গোহত্যা-বিরোধী দাঙ্গা বাধে। এর ফলে মুসলমানেরা আতঙ্কিত হয়ে ওঠে।[18] ১৯০৫ সালে লোকমান্য বাল গঙ্গাধর তিলক ও লালা লাজপত রাই কংগ্রেসে নেতা হয়ে ওঠার চেষ্টা করেন এবং কংগ্রেসও কালীর প্রতীকতত্ত্বকে আন্দোলনের সামনে নিয়ে আসে। এর ফলে মুসলমানেদের ভয় বৃদ্ধি পায়।[16] উল্লেখ্য, ‘বন্দেমাতরম্’ শ্লোগানটি বঙ্কিমচন্দ্রের যে আনন্দমঠ উপন্যাস থেকে গৃহীত হয়েছিল, সেই উপন্যাসের উপজীব্য ছিল পূর্বতন মুসলমান শাসনে শাসক কর্তৃক হিন্দুদের অবদমন ও হিন্দুদের বিদ্রোহ।[19] মুসলমান উচ্চবিত্ত সমাজের প্রতিনিধি ঢাকার নবাব খাজা সলিমুল্লাহ শাহবাগে নিজের বাড়িতে মুসলিম লিগের প্রথম অধিবেশন ডেকেছিলেন। তিনি জানতেন, নবগঠিত প্রদেশে মুসলমানেরা সংখ্যাগুরু এবং এতে মুসলমানেদের রাজনৈতিক ক্ষমতালাভের সুবিধাই হবে।[19]
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ব্রিটেন এবং ভারতের মধ্যে সাম্রাজ্যপূর্ণ সম্পর্কের সন্ধিক্ষণ হিসাবে প্রমাণিত হয়। ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীর ১৪ লক্ষ ভারতীয় ও ব্রিটিশ সৈন্য যুদ্ধে অংশ নেয় এবং তাদের অংশগ্রহণের ব্যাপক সাংস্কৃতিক পরিণতি ঘটে: ভারতীয় সৈন্যরা ব্রিটিশ সেনাদের সাথে লড়াই করা এবং মারা যাওয়ার পাশাপাশি কানাডা এবং অস্ট্রেলিয়ার মতো সৈনিকদের খবর নিউজপ্রিন্টে এবং রেডিওর নতুন মাধ্যম বিশ্বের দূরবর্তী কোণে ভ্রমণ তাদের নাম পৌছে।[20] এর ফলে ভারতের আন্তর্জাতিক প্রোফাইল বৃদ্ধি পাবে এবং ১৯২০ এর দশকে বাড়তে থাকবে।[20] ১৯২০ সালে অ্যান্টওয়ার্পে গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকে "লেস ইন্ডেস আংলাইসেস" (ব্রিটিশ ইন্ডিয়া) নামে ১৯২০ সালে লীগ অফ নেশনস-এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হওয়া এবং অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি ভারতের নেতৃত্ব দেওয়ার কথা ছিল।[21] ভারতে ফিরে, বিশেষ করে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের নেতাদের মধ্যে, এটি ভারতীয়দের জন্য বৃহত্তর স্ব-সরকারের আহ্বানের দিকে পরিচালিত করবে।[20]
কংগ্রেসের ১৯১৬ সালের লখনৌ অধিবেশনও ছিল কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগের অপ্রত্যাশিত পারস্পরিক প্রচেষ্টার স্থান, যার জন্য জার্মানি এবং তুরস্কের মধ্যে যুদ্ধকালীন অংশীদারিত্ব সরবরাহ করেছিল। যেহেতু তুর্কি সুলতান বা খলিফাও বিক্ষিপ্তভাবে মক্কা, মদিনা এবং জেরুজালেমের ইসলামিক পবিত্র স্থানগুলির অভিভাবকত্ব দাবি করেছিলেন, এবং যেহেতু ব্রিটিশ এবং তাদের মিত্রদের তুরস্কের সাথে দ্বন্দ্বে রয়েছে, তাই কিছু ভারতীয় মুসলমানের মধ্যে ব্রিটিশদের "ধর্মীয় নিরপেক্ষতা" সম্পর্কে সন্দেহ বাড়তে শুরু করে, ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদের ফলে ইতোমধ্যে যে সন্দেহ প্রকাশ পেয়েছিল যা মুসলমানদের কাছে খারাপ গ্রহণ হয়েছিল।[22] লখনৌ চুক্তিতে, লীগ বৃহত্তর স্ব-সরকারের প্রস্তাবে কংগ্রেসে যোগ দেয় যা তিলক এবং তার সমর্থকরা প্রচার করেছিল; বিনিময়ে, কংগ্রেস প্রাদেশিক আইনসভার পাশাপাশি ইম্পেরিয়াল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলে মুসলমানদের জন্য পৃথক নির্বাচকমণ্ডলী গ্রহণ করে। ১৯১৬ সালে মুসলিম লীগের সদস্য সংখ্যা ছিল ৫০০ থেকে ৮০০ জন এবং পরবর্তী বছরগুলোতে ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে এর ব্যাপক অনুসারী ছিল না; লীগে এই চুক্তির সর্বসম্মত সমর্থন ছিল না, মূলত ইউনাইটেড প্রভিন্স (ইউপি) থেকে একদল "ইয়ং পার্টি" মুসলমান আলোচনা করেছিল, সবচেয়ে উল্লেখযোগ্যভাবে, ভাই মোহাম্মদ এবং শওকত আলী, যারা প্যান-ইসলামিক উদ্দেশ্যকে গ্রহণ করেছিল।[22] যাইহোক, এটি বোম্বে থেকে একটি তরুণ আইনজীবী, মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ, যিনি পরে লীগ এবং ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলন উভয় নেতৃত্বের ভূমিকা উত্থান ছিল সমর্থন ছিল। পরবর্তী বছরগুলিতে, যখন এই চুক্তির সম্পূর্ণ প্রভাব সামনে আসে, তখন এটিকে পাঞ্জাব ও বাংলার মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠদের চেয়ে ইউপি এবং বিহারের মতো প্রদেশের মুসলিম সংখ্যালঘু অভিজাতদের বেশি উপকৃত হিসাবে দেখা হয়। সেই সময়" লখনউ চুক্তি" জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক ছিল এবং ব্রিটিশরা তা দেখেছিল।[22]
ব্রিটিশ ভারত বিভাজনের ফলে পূর্বের ব্রিটিশ প্রদেশ পাঞ্জাবকে ভারত অধিরাজ্য ও পাকিস্তান আধিরাজ্যের মধ্যে বিভক্ত করা হয়। এই প্রদেশের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পশ্চিমাংশ পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশে পরিণত হয়; হিন্দু ও শিখ সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ব অংশ ভারতের পূর্ব পাঞ্জাব রাজ্যে পরিণত হয় (পরে রাজ্যে রাজ্যে হিসাবে পাঞ্জাব, হরিয়ানা ও হিমাচল প্রদেশে বিভক্ত করা হয়)। বহু হিন্দু ও শিখ পশ্চিমে বাস করত এবং বহু মুসলমান পূর্বে বাস করত, এই সমস্ত সংখ্যালঘুদের ভয় এতই বেড়েছিল যে দেশভাগে বহু মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছিল এবং আন্তঃসাম্প্রদায়িক সহিংসতা ঘটে। কেউ কেউ পাঞ্জাবের সহিংসতাকে প্রতিশোধাত্মক গণহত্যা হিসাবে বর্ণনা করেন।[23] অনুমান করা হয়, যে দেশভাগের সময় পাঞ্জাব জুড়ে মোট প্রায় ১.২ কোটি মানুষের অভিবাসন ঘটে;[lower-alpha 7] প্রায় ৬৫ লক্ষ মুসলমান পূর্ব পাঞ্জাব থেকে পশ্চিম পাঞ্জাবে এবং ৪৭ লক্ষ হিন্দু ও শিখ পশ্চিম পাঞ্জাব থেকে পূর্ব পাঞ্জাবে স্থানান্তরিত হন।
নতুন গঠিত সরকাররের কাছে এই ধরনের বিস্ময়কর মাত্রার দ্বি-মুখী অভিবাসন প্রত্যাশিত ছিল না ও এর সমাধানের জন্য সম্পূর্ণরূপে সজ্জিত ছিল না এবং নতুন ভারত-পাকিস্তান সীমান্তের উভয় প্রান্তে ব্যাপক সহিংসতা ও বধ্যভূমি সংগঠিত হয়। মৃত্যুর সংখ্যা আনুমানিক তারতম্য, সর্বনিম্ন ২,০০,০০০ এবং সর্বোচ্চ ২০,০০,০০০। সমস্ত অঞ্চলের মধ্যে সহিংসতার সবচেয়ে খারাপ ঘটনাটি পাঞ্জাবের মধ্যে সংঘটিত হয়েছিল বলে মনে করা হয়।[24][25][26][27] কার্যত কোনও মুসলিম পূর্ব পাঞ্জাবে বেঁচে ছিলেন না (মালেরকোটলা ব্যতীত) এবং কার্যত কোনও হিন্দু বা শিখ পশ্চিম পাঞ্জাবে বেঁচে ছিলেন না।[28]
লরেন্স জেমস পর্যবেক্ষণ করেছেন যে "পশ্চিম পাঞ্জাবের গভর্নর স্যার ফ্রান্সিস মুডি অনুমান করেছিলেন, যে তাঁর প্রদেশ করতে গিয়ে ৫,০০,০০০ জন মুসলমান মৃত্যুবরণ করেছিলেন, যদিও করাচির ব্রিটিশ হাইকমিশনার পুরো সংখ্যাটি ৮,০০,০০০ করে রেখেছিলেন। ‘২,০০,০০ জন মানুষের মৃত্যু’র বিষয়টি মাউন্টব্যাটেন ও তার পক্ষাবলম্বীদের অমূলক কথা": [জেমস ১৯৯৮: ৬৩৬]।[29]
এই সময়কালে, অনেকে অভিযোগ করেছিলেন যে তারা সিংহ মুসলিম হত্যার পক্ষে সমর্থন দিচ্ছেন। লাহোরে একটি মঞ্চ থেকে প্রায় ৫০০ জন শিখের সাথে তারা সিংহ ১৯৪৭ সালের ৩ই মার্চ "পাকিস্তানের মৃত্যু" ঘোষণা করেন।[30] রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ইশতিয়াক আহমেদের মতে:[31][32][33][34]
৩ শে মার্চ, উগ্রপন্থী শিখ নেতা মাস্টার তারা সিংহ পাঞ্জাব বিধানসভার বাইরে তাঁর কিরপণ (তরোয়াল) প্রদর্শন করেছিলেন এবং উত্তর পাঞ্জাবের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলাসমূহে শুধুমাত্র শিখদের বিরুদ্ধে নয় বরং হিন্দুদের বিরুদ্ধেও মুসলমানদের দ্বারা সহিংস প্রতিক্রিয়া জাগানো পাকিস্তানের ধারণার ধ্বংসের আহ্বান জানিয়েছিলেন। তবুও, বছরের শেষদিকে পশ্চিম পাঞ্জাবে হিন্দু ও শিখের চেয়ে পূর্ব পাঞ্জাবে অধিক সংখ্যক মুসলমানের মৃত্যু হয়েছিল।
নেহেরু গান্ধীকে ২২ আগস্ট লিখেছিলেন যে, পশ্চিম পাঞ্জাবের হিন্দু ও শিখের চেয়ে পূর্ব পাঞ্জাবে দ্বিগুণ মুসলমানের মৃত্যু ঘটেছে।[35]
বাংলা প্রদেশটি দুটি পৃথক সত্তা - ভারত অধিরাজ্যে যুক্ত হওয়া পশ্চিমবঙ্গ ও পাকিস্তানের আধিরাজ্যে যুক্ত হওয়া পূর্ববঙ্গে বিভক্ত ছিল। পূর্ববঙ্গের নামকরণ ১৯৫৫ সালে পূর্ব পাকিস্তান করা হয় এবং এটি পরে একাত্তর সালে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যেম স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রে পরিণত হয়।
র্যাডক্লিফ দ্বারা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলা মুর্শিদাবাদ ও মালদহ ভারতে, হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ খুলনা ও বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ, তবে খুব কম জনবহুল জেলা পার্বত্য চট্টগ্রামকে পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল।[36]
পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত হওয়া পূর্ববাংলার জেলাসমূহে বসবাসরত হাজার হাজার হিন্দুরা নিজেদের আক্রমণের শিকার হতে দেখে ও এই ধর্মীয় নিপীড়ন পূর্ববাংলার হাজার হাজার হিন্দুকে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য করেছিল। কলকাতায় হিন্দু শরণার্থীদের বিশাল আগমন এই শহরের জনসংখ্যাকে প্রভাবিত করেছিল। বহু মুসলমান পূর্ব পাকিস্তানের উদ্দেশ্যে শহর ছেড়ে চলে গিয়েছিল এবং শরণার্থী পরিবারসমূহ তাদের কিছু বাড়িঘর ও সম্পত্তি দখল করেছিল।
বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ পার্বত্য চট্টগ্রামকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যদিও ব্রিটিশ সংসদ বা 'ভারতীয় স্বাধীনতা আইন ১৯৪৭' সীমান্ত কমিশনকে ভারত থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামকে পৃথক করার আদেশ প্রদান করেনি। পার্বত্য চট্টগ্রামে ১৯৪৭ সালে সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধ ও হিন্দুদের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ৯৮.৫% ছিল।[37] ১৯৪৭ সালের ভারতীয় স্বাধীনতা আইন অনুসারে, ভারতীয় বাংলা প্রদেশকে ধর্মীয় ভিত্তিতে পশ্চিমবঙ্গ ও পূর্ববঙ্গে বিভক্ত করা হয়েছিল।[38] পার্বত্য চট্টগ্রাম ১৯০০ সাল থেকে একটি বঞ্চিত অঞ্চল এবং এটি বাংলার অন্তর্গত ছিল না। এটি বাংলার অংশ না হওয়ায় কলকাতার বঙ্গীয় আইনসভায় পার্বত্য চট্টগ্রামের কোনও প্রতিনিধি ছিল না।
চাকমা ও অন্যান্য আদিবাসী বৌদ্ধরা ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজধানী রাঙ্গামাটিতে ভারতীয় পতাকা উত্তোলন করে স্বাধীনতা দিবস উদ্যাপন করেছিলেন। রেডিওতে ১৯৪৭ সালের ১৭ আগস্ট পাকিস্তান ও ভারতের সীমানা ঘোষিত হওয়ার পরে তারা জেনে বিস্মিত হয়েছিলেন, যে পার্বত্য চট্টগ্রাম পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আদিবাসীরা স্নেহা কুমার চাকমার নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দলকে ভারতীয় নেতৃত্বের থেকে সহায়তার জন্য দিল্লিতে প্রেরণ করা হয়েছিল। স্নেহা কুমার চাকমা টেলিফোনে উপ-প্রধানমন্ত্রী বল্লভভাই প্যাটেলের সাথে যোগাযোগ করেন। বল্লভভাই প্যাটেল সাহায্য করতে রাজি ছিলেন, কিন্তু স্নেহা কুমার চাকমাকে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর সাথে চুক্তি করার জন্য জোর দিয়েছিলেন। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য সামরিক দ্বন্দ্ব ব্রিটিশদের ভারতে ফিরিয়ে আনতে পারে, এই ভয়ে জওহরলাল নেহরু সাহায্য করতে অস্বীকার করেছিলেন।[39]
স্বাধীনতার এক সপ্তাহ পরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বালুচ রেজিমেন্ট পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রবেশ করে এবং বন্দুকের পয়েন্টে ভারতীয় পতাকা ২১শে আগস্ট নামিয়ে দেয়।[40] পূর্ব পাকিস্তান আদিবাসী বৌদ্ধ জনগণকে ভারতপন্থী হিসাবে দেখেছিল এবং চাকরি, শিক্ষা, ব্যবসা বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সুযোগে তাদের সাথে পরিকল্পিতভাবে বৈষম্যমূলক আচরণ করেছিল। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পরে আদিবাসীদের পরিস্থিতি পরিবর্তন হয়। এই অঞ্চলের প্রাকৃতিক পরিবেশে আকৃষ্ট হয়ে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে অনেকে এসে বসতি স্থাপন করে। পার্বত্য চট্টগ্রামে পাড়ি জমানোর জন্য সরকার থেকে উৎসাহিত করা হয়েছিল। বাংলাদেশ সরকার মুসলিম জনবসতিদের রক্ষার জন্য এবং পাহাড়ী বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দমনে কয়েক হাজার সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য পাঠিয়েছিল। তার আগে পাহাড়ী বিচ্ছিন্নতাবাদীরা পাহাড়ী এলাকাগুলোতে অসংখ্য চাঁদাবাজি ও জঙ্গি কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছিল। [তথ্যসূত্র প্রয়োজন]
পাঞ্জাব ও বাংলার মতো গুজরাতে তেমন কোনও গণ-সহিংসতা ঘটেনি।[41] তবে গুজরাতে বড় আকারের শরণার্থী স্থানান্তর হয়। অনুমানিক ৩,৪০,০০০ জন মুসলমান পাকিস্তানে পাড়ি জমান, যার মধ্যে ৭৫% মূলত ব্যবসায়িক স্বার্থের কারণে করাচিতে চলে গিয়েছিলেন।[41] আগত শরণার্থীদের সংখ্যা বেশ বড় ছিল, ১০ লাখেরও বেশি মানুষ গুজরাতে চলে এসেছিল। এই হিন্দু শরণার্থীরা মূলত সিন্ধি ও গুজরাতি ছিলেন।[42]