বিজ্ঞানের দর্শন
অনুমান, ভিত্তি এবং বিজ্ঞানের প্রভাব সম্পর্কে দার্শনিক অধ্যয়ন / From Wikipedia, the free encyclopedia
বিজ্ঞানের দর্শন বলতে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান এবং বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ার উপাদানগুলোকে দর্শনের দৃষ্টিভঙ্গিতে অধ্যয়ন করা বোঝায়। বিজ্ঞানের অনুশীলন এবং লক্ষ্যগুলোর অধিবিদ্যা, জ্ঞানতত্ত্ব এবং নীতিবিদ্যা সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষণ জ্ঞানের এই শাখায় প্রাধান্য পায়।[1] উদাহরণ স্বরূপ, বিজ্ঞান ও সত্যের সম্বন্ধ অধ্যয়ন করাকালীন — কীভাবে বিজ্ঞান মিথ্যা প্রমাণিত করার যোগ্য ভবিষ্যদ্বানী প্রদান করে এবং বিজ্ঞানের এই কার্য কীভাবে বিজ্ঞানকে অধিক নির্ভরশীল করে তোলে। সাধারণভাবে বিজ্ঞান নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি অনেক দার্শনিক আবার বিজ্ঞানের নির্দিষ্ট শাখাগুলোকেও দর্শনের দৃষ্টিতে বিশ্লেষণ করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন যে কারণে পদার্থবিজ্ঞানের দর্শন, জীববিজ্ঞানের দর্শন ইত্যাদি ক্ষেত্রগুলোর জন্ম হয়েছে।
বিজ্ঞানের দার্শনিক আলোচনা বিষয়ে স্বয়ং বিজ্ঞানীদের অবস্থান বেশ দ্বিধাবিভক্ত। একদিকে অনেক বিজ্ঞানী যেমন বিজ্ঞানের দর্শনে অবদান রেখেছেন, অন্যদিকে অনেকে আবার এর সমালোচনা করেছেন এবং বিজ্ঞানের জন্য এর কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। যেমন বিখ্যাত মার্কিন পদার্থবিজ্ঞানী রিচার্ড ফাইনম্যান বলেছিলেন, "পাখিদের জন্য পক্ষীবিদ্যার উপযোগীতা যতটুকু বিজ্ঞানের জন্য বিজ্ঞানের দর্শনের উপযোগীতা তার থেকে বেশি নয়"। কিছু দার্শনিক আবার তার এই উক্তির সমালোচনা করেছেন। যেমন অধিবিদ্যা ও জ্ঞানতত্ত্ব নিয়ে গবেষণায় রত মার্কিন দার্শনিক জোনাথন শাফার ফাইনম্যানের বক্তব্য প্রসঙ্গে বলেছেন, পক্ষীবিদ্যা পাখিদের জন্য সত্যিই খুব উপকারী হতো যদি পাখিদের সেই বিদ্যা আয়ত্ত করার ক্ষমতা থাকতো।[2]
বিজ্ঞানের দর্শনের মুখ্য প্রশ্নসমূহের বিষয় 'বিজ্ঞান কি এবং কি নয়', 'বৈজ্ঞানিক প্রণালীসমূহের নির্ভরশীলতা', 'বিজ্ঞানের শেষ লক্ষ্য' ইত্যাদি। বিজ্ঞানের দর্শনের বহু মুখ্য প্রশ্নের উত্তরের ক্ষেত্রে দার্শনিকগণ একমত নন। 'বিজ্ঞান অনিরীক্ষণীয় বিষয়ের সত্য অনাবৃত করতে পারবে কি না?', 'বৈজ্ঞানিক যুক্তির ন্যায্যতা বা প্রতিপন্ন করতে পরা যায় কি যায় না?' ইত্যাদি প্রশ্ন তার অন্তর্গত। বিজ্ঞান বিষয়ক তেমন সাধারণ প্রশ্নসমূহ ছাড়াও দর্শনের এই ভাগে বিজ্ঞানের কোনো এক ধারায় (যেমন জীববিজ্ঞান, ভৌত বিজ্ঞান ইত্যাদি) প্রযোজ্য প্রশ্নেরও উত্তর সন্ধান করে। কোনো কোনো দার্শনিক আধুনিক বিজ্ঞানের ফলাফলের সহায়তায় স্বয়ং দর্শনের বিষয়ই মীমাংসা করে থাকেন।
যদিও বিজ্ঞান বিষয়ক দার্শনিক চিন্তা অন্ততঃ অ্যারিস্টটলের সময় থেকেই চলে আসছে, বিজ্ঞানের দর্শনের এক পৃথক শৃঙ্খলা রূপে বিকাশ বিংশ শতাব্দীর মধ্য ভাগ থেকেই আরম্ভ হয়েছে। এমনটা হয়েছিল যৌক্তিক দৃষ্টবাদের প্রাক্কালে। যৌক্তিক দৃষ্টিবাদের লক্ষ্য প্রতিটি দার্শনিক বিবৃতির অর্থপূর্ণতার মাপ-কাঠি নির্ণয় করা এবং বস্তুবাদী রূপে সেই বিবৃতিসমূহকে পরিমাপ করা। টমাস কুনের ঐতিহাসিক গ্রন্থ 'দ্য ষ্ট্রাক্সার অব সায়েণ্টিফিক রেভোলিউসন্স' (১৯৬২) বৈজ্ঞানিক উন্নতি যে অবিচলিত, এবং জ্ঞানের সঞ্চয়িত অধিগ্রহণ নিশ্চিত প্রণালীর ওপর আধারিত, সেই ধারণাকে প্রত্যাহ্বান করে। তিনি তার পরবর্তী তর্ক করেন যে, যেকোনো উন্নতি এক বিশেষ ঐতিহাসিক সময়ের দৃষ্টান্তের (প্রশ্ন, ধারণা, চর্চার) সাথে আপেক্ষিক।
পরবর্তী সময়ে, ডাব্লিউ ভি কুয়াইন এবং অন্যান্যদের জন্য বিজ্ঞানের সুসংগত অভিগমন, যে শাস্ত্র মান্য হয় যদি এই পর্যবেক্ষণকে এক সুসংগত সমগ্রের অংশ হিসাবে দেখানো যায় — এই অভিগমন প্রধান হয়ে পড়ে। স্টিফেন জে গুডের মতো কোনো কোনো চিন্তাবিদ বিজ্ঞানকে স্বয়ংসিদ্ধ ধারণার সমষ্টিতে স্থলিত করতে শুরু করেন, যেমন: প্রকৃতির সামঞ্জস্য। পল ফেয়েরাব্যান্ডকে ধরে দার্শনিকদের এক কণ্ঠ্য সংখ্যালঘু দল তর্ক করে যে, 'বৈজ্ঞানিক প্রণালী'র মতো আসলে কোনো বস্তুই নেই, তারা বিজ্ঞানের সকল অভিগমনকে মান্যতা প্রদান করতে থাকেন, অলৌকিকতাসমূহকেও। বিজ্ঞানের বিষয়ে চিন্তা করার অন্য এক অভিগমন হল সমাজবৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে জ্ঞান কীভাবে সৃষ্টি হয় তা অধ্যয়ন করা। এমন অভিগমনকে ডেভিড ব্লুর, বেরী বার্নসের মতো দার্শনিক সমর্থন করেন। শেষে, ১৯-২০ শতাব্দীর ইউরোপীয় দর্শন বিজ্ঞানকে মানব অভিজ্ঞতার কঠোর বিশ্লেষণ হিসাবে চায়।
বিজ্ঞানের বিশেষ ভাগ সম্বন্ধীয় দার্শনিক প্রশ্নসমূহ আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ থেকে উদিত সময়ের প্রকৃতি বিষয়ক, রাজনীতিতে অর্থনীতির প্রভাব ইত্যাদি। একটি মুখ্য বিষয় হল, কোনো এক বৈজ্ঞানিক শৃঙ্খলাকে অন্য এক শৃঙ্খলয় অনুবাদ করতে পারা যায় কি যায় না। যেমন, রসায়ন বিজ্ঞানকে ভৌত বিজ্ঞানে অনুবাদ করতে পারি কি না? সমাজবিজ্ঞানকে ব্যক্তিগত মনোবিজ্ঞানর স্তরে অনুবাদ করতে পারি কি না? বিজ্ঞানের দর্শনের সাধারণ প্রশ্নসমূহেরও বিজ্ঞানের কোনো এক ধারায় বিশেষ গুরুত্ব থাকতে পারে। যেমন বৈজ্ঞানিক যুক্তির বৈধতার পরিসংখ্যানবিদ্যার প্রতিষ্ঠাপনে বিশেষ গুরুত্ব আছে। কি বিজ্ঞান হয় এবং কি বিজ্ঞান নয়, সেকথা চিকিৎসা বিজ্ঞানের দর্শনে জীবন-মরণের প্রশ্ন। তদুপরি, জীববিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান ইত্যাদির দর্শনসমূহ মানব প্রকৃতির বৈজ্ঞানিক অধ্যয়নে বস্তুবাদী রূপ লাভ করতে পারবে, না মূল্যবোধ এবং সামাজিক সম্বন্ধ প্রভাবিত হয়ে থাকবে, তেমন বিষয়েও অধ্যয়ন করে।