Loading AI tools
উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
ফ্রিগেট হলো এক ধরনের যুদ্ধজাহাজ। কয়েক শতাব্দী ধরে কাজের ধরন এবং আকারভেদে বিভিন্ন প্রকার ফ্রিগেট তৈরি হয়ে এসেছে।
সপ্তদশ শতাব্দীতে, দ্রুতগামী ও নিপুণভাবে পরিচালনসক্ষম যুদ্ধজাহাজ কে ফ্রিগেট বলা হতো। ফ্রিগেট হত এমন এক ধরনের যুদ্ধজাহাজ যা প্রধান গোলন্দাজ ব্যাটারীর কামানগুলো একটি বা দুটি ডেকে বহন করে (তুলনামূলক ছোট কামানগুলোগুলো সাধারনত জাহাজের ফরডেক এবং কোয়ার্টার ডেক-এ বহন করা হতো)। সাধারণত ফ্রিগেট শব্দটি ছোট যুদ্ধজাহাজ যা যুদ্ধসারিতে দাড়ানোর মত নয়; বোঝাতে ব্যবহৃত হত, যদিও সম্মুখযুদ্ধে ব্যবহৃত দ্রুতগামী জাহাজ গুলোকে প্রায়ই ফ্রিগেট বলে উল্লেখ করা হতো।
অষ্টাদশ শতাব্দীতে ফ্রিগেট গুলো ছিলো পূর্ণ-পালতোলা জাহাজ, যার তিনটি মাস্তুলের উপরই চতুর্ভুজ আকৃতির পাল তোলা থাকত। এগুলো তৈরি করা হয় গতি এবং নিয়ন্ত্রণের জন্য, অস্ত্রসজ্জা ছিল যুদ্ধসারির জাহাজ থেকে হালকা এবং টহল ও নৌবহর প্রহরার কাজে ব্যবহৃত হত ব্যবহৃত হতো। ব্রিটিশ নৌসেনাবিভাগ এর সংজ্ঞানুযায়ী, ফ্রিগেট গুলো ছিলো কমপক্ষে ২৮ টি কামান বহন করা জাহাজ, যা তার প্রধান অস্ত্রসমুহ একটি একক ডেকে বহন করে, যেখানে যুদ্ধসারির জাহাজগুলো দুই বা ততোধিক ডেকে তাদের গোলন্দাজ ব্যাটারি গুলো বহন করত।
উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে (১৮৫৮ এর শুরুর দিকে, ফ্রান্স ও ব্রিটিশ নৌবাহিনীর নমুনা নির্মাণের সাথে সাথে) বর্মযুক্ত ফ্রিগেট, যা এক ধরনের লৌহবর্মভূষিত যুদ্ধজাহাজ, কিছু সময়ের জন্য সবচেয়ে শক্তিশালী যুদ্ধজাহাজ ছিলো। ফ্রিগেট শব্দটি ব্যবহার করা হতো কারণ এই জাহাজগুলোর প্রধান অস্ত্রসমূহ একটি একক ডেক এ সাজানো থাকত।
আধুনিক নৌবাহিনীতে, অন্যান্য যুদ্ধজাহাজ এবং বাণিজ্যিক জাহাজ গুলোকে নিরাপত্তা প্রদানে ফ্রিগেট ব্যবহৃত হয়। বিশেষত উভচর অভিযানমূলক বাহিনী, পুনঃসরবরাহ দল ও বাণিজ্যিক জাহাজবহরের জন্য ডুবজাহাজ-বিধ্বংসী জাহাজ হিসেবে ফ্রিগেট ব্যবহৃত হয়। কিছু ক্ষেত্রে ফ্রিগেট নামে অভিহিত জাহাজ কর্ভেট, ডেস্ট্রয়ার, ক্রুইজার এবং এমনকি ব্যাটেলশিপ এর সাথেও অধিক সাদৃশ্যযুক্ত। কিছু ইউরোপিয়ান নৌবাহিনী, যেমন ফরাসি, জার্মান এবং স্প্যানিশ নৌবাহিনী ফ্রিগেট শব্দটিকে ডেস্ট্রয়ার এবং ফ্রিগেট উভয় শ্রেণির জাহাজের ক্ষেত্রে ব্যবহার করে থাকে। ফ্রিগেট ক্যাপ্টেন পদটি এই ধরনের জাহাজের নাম থেকে উদ্ভূত।
পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষভাগে "ফ্রিগেট" (ইতালিয়ান: ফ্রিগাতা, স্প্যানিশ/কাতালিয়ান/পর্তুগীজ/সিসিলিয়ান: ফ্র্যাগাতা, ডাচ: ফ্রিগাত, ফ্রেঞ্চ: ফ্রিগেত) শব্দটি ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে উৎপত্তি হয়েছিলো যা দ্বারা বৈঠা, পাল, হালকা যুদ্ধোপকরণ সহ গতি ও ম্যানুভার ক্ষমতার জন্য নির্মিত এক ধরনের যুদ্ধজাহাজকে বোঝানো হতো।[1] এই শব্দের ব্যুৎপত্তি অনিশ্চিত তবে শব্দটি ল্যাটিন শব্দ অ্যাফ্র্যাক্টাস এর অবক্ষয় থেকে উৎপত্তি হয়ে থাকতে পারে যার অর্থ কোনো নিম্ন ডেক এক ধরনের খোলা জাহাজ। অ্যাফ্র্যাক্টাস, প্রাচীন গ্রীক শব্দগুচ্ছ ἄφρακτος ναῦς (অ্যাফ্র্যাক্টাস নাউস) এর থেকে উদ্ভূত হয়েছে যার অর্থ অরক্ষিত জাহাজ।
১৮৫৩ সালে, ১৫৬৮-১৬৪৮ সালের এর ডাচ স্বাধীনতা যুদ্ধ এর সময়, হাবসবার্গ স্পেন প্রোটেস্ট্যান্ট বিদ্রোহীদের কাছ থেকে দক্ষিণ নেদারল্যান্ডস কে উদ্ধার করেছিলো। এর ফলে, এই অধিকৃত বন্দরগুলো ডাচ এবং তাদের মিত্রদের নৌপরিবহনের উপর আক্রমণ করার জন্য প্রাইভেটিয়ার্স (ব্রিটিশ বেসরকারি নৌসেনা) এবং "ডানকার্কাস" (স্পেনীয় বেসরকারি নৌসেনা) দের ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এই উদ্দেশ্যে ডানকার্কাসরা ছোট, ম্যানুভার ক্ষমতাসম্পন্ন পালতোলা জাহাজ ব্যবহার করে যা হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। ডানকার্কাসদের এই সাফল্য তাদের প্রতিযোগী অন্যান্য নৌবাহিনীর জাহাজের নকশাকে প্রভাবিত করে। কিন্তু যেহেতু অধিকাংশ নিয়মিত নৌবাহিনীর ডানকার্কাসদের ফ্রিগেট থেকে দীর্ঘস্থায়ী অপারেশনে সক্ষম জাহাজের প্রয়োজন ছিলো, তাই ফ্রিগেট শব্দটির ব্যবহার যেকোন তুলনামূলক দ্রুত এবং দক্ষ জাহাজ গুলোর ক্ষেত্রে কমে যায়। ফরাসি ভাষায়, "ফ্রিগেট" শব্দটি একটি ক্রিয়াপদ ফ্রিগেটার-এর' জন্ম দেয়, যার অর্থ দীর্ঘ এবং নিম্ন নির্মাণ করা, এবং একটি বিশেষণেরও, যার অর্থ আরও বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা। এমনকি বিশাল ইংরেজ জাহাজ সোভেরেইন অফ দি সি কে ১৬৫১ সালে তার উপরের ডেক গুলো হ্রাস করার পর তৎকালীন সময়ে একে "একটি দূর্বল ফ্রিগেট" হিসেবে বর্ণনা করা হতো।[2]
ওলন্দাজ প্রজাতন্ত্র-এর নৌবাহিনী প্রথম নৌবাহিনী হিসেবে বৃহৎ, গভীর সমুদ্রগামী ফ্রিগেট নির্মাণ করে। স্পেনের বিপক্ষে যুদ্ধে ওলন্দাজ নৌবাহিনীর তিনটি প্রধান দায়িত্ব ছিল- সমুদ্রে ওলন্দাজ বাণিজ্যিক নৌবহরকে রক্ষা করা, স্পেন-অধিকৃত ফ্লান্ডার্স এর বন্দরগুলিতে নৌ-অবরোধ এবং স্পেনীয় নৌবহরের সাথে যুদ্ধ করা ও উপকূলে সৈন্য অবতরণ ব্যহত করা। প্রথম দুটি দায়িত্ব পালনের জন্য প্রয়োজন ছিল গতি, নেদারল্যান্ডের আশেপাশের অগভীর পানিতে চলাচলের সক্ষমতা এবং অবরোধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট পরিমাণ রসদ বহনের সক্ষমতা। তৃতীয় দায়িত্বের জন্য প্রয়োজন ভারী অস্ত্রসজ্জা যা স্পেনীয় বহরের বিপক্ষে যথেষ্ট হবে। প্রথম বৃহৎ যুদ্ধ-উপযোগী ফ্রিগেট তৈরী হয় ১৬০০ সালের দিকে হল্যান্ড-এর হর্ন-এ।[3] আশি বছরব্যাপী যুদ্ধের শেষদিকে ওলন্দাজরা ভারী জাহাজ, যা ইংরেজ ও স্পেনীয়রা তখনও ব্যবহার করছিল, এর বদলে পুরোপুরিভাবে হালকা ফ্রিগেট ব্যবহার শুরু করে যা মোটামুটিভাবে ৪০টি কামান বহন করত এবং ৩০০ টনের মত ওজনের হত।
ওলন্দাজ ফ্রিগেটগুলোর কার্যকারিতা সবচেয়ে স্পষ্ট হয়ে ওঠে ১৬৩৯ সালের ডন্স এর যুদ্ধে, যা অন্যান্য নৌবাহিনীকে, বিশেষ করে ইংরেজদের, একই রকম নকশা গ্রহণ করতে উদ্বুদ্ধ করে।
১৬৫০ এর দশকে ইংরেজ কমনওয়েলথ এর নৌবহর গড়ে উঠত "ফ্রিগেট" হিসেবে অভিহিত জাহাজ দিয়ে, যার মধ্যে সবচেয়ে বড় ছিল দুই ডেকযুক্ত তৃতীয় রেটের জাহাজ "গ্রেট ফ্রিগেট"। ৬০টি কামান বহন করা এই জাহাজগুলো ছিল সেসময়ের "বৃহৎ জাহাজ" হিসেবে অভিহিত জাহাজ গুলোর সমকক্ষ। তবে সেসময়ের অন্য ফ্রিগেটগুলোর অধিকাংশই ক্রুজার হিসেবে ব্যবহৃত হত। ফ্রিগেট শব্দটি বোঝাত দীর্ঘ-কাঠামো নকশা, যা সরাসরি গতীর সাথে সম্পর্কিত ছিল যা পরবর্তীতে নৌযুদ্ধের ব্রডসাইড কৌশল গড়ে ওঠায় সহায়তা করে।
এই সময় নকশা আরও বিবর্তিত হয়, বৈঠার ব্যবহার ফিরে আসে, যার ফলে ১৬৭৬ সালের এইচএমএস চার্লস গ্যালি এর মত বৈঠাযুক্ত ফ্রিগেট তৈরী হয়। এটি ছিল ৩২টি কামান যুক্ত পঞ্চম রেটের জাহাজ কিন্তু একই সাথে এতে উপর ডেকের নিচে ৪০টি বৈঠার স্থান ছিল যা অনুকূল বায়ুর অনুপস্থিতিতে জাহাজটিকে চালাতে সাহায্য করত।
ডেনমার্কে "ফ্রিগাট" বলতে সর্বনিম্ন ১৬টি কামানবাহী যুদ্ধজাহাজকে বোঝাত, যেমন এইচএমএস ফ্যালকন, যা ব্রিটিশ শ্রেণিবিভাগে স্লুপ হিসেবে গণ্য করা হত।
১৮ শতকের মাঝামাঝি সময়ে, ব্রিটিশ রাজকীয় নৌবাহিনীর রেটিং পদ্ধতি অনুযায়ী, ফ্রিগেট শব্দটিকে একক ডেকযুক্ত পঞ্চম রেটের জাহাজের জন্য সীমাবদ্ধ করে দেয়া হয়, যদিও ২৮টি কামান বিশিষ্ট ফ্রিগেটকে ষষ্ঠ রেট হিসেবে গণ্য করা হত।[1]
ঐতিহ্যবাহী পালতোলা ফ্রিগেট, যা বর্তমানে নেপলীয় যুদ্ধ এর জন্য বিখ্যাত, তাদের মূল খুজে পাওয়া যায় অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয়-চতুর্ভাগে ফরাসিদের অগ্রগতিতে। ১৭৪০ সালে ফরাসিদের জাহাজ মিদীকে এই ধরনের প্রথম জাহাজ হিসেবে মনে করা হয়। এই জাহাজগুলো চতুর্ভুজাকার পাল ব্যবহার করত এবং তাদের সব কামান একটি একক ঊর্ধ্ব-ডেকে বসানো থাকত। নিম্ন-ডেক, যা গান-ডেক নামে পরিচিত ছিল, কোন অস্ত্র বহন করত না। এই জাহাজগুলোর নিম্ন-ডেক পানির পৃষ্ঠের নিচে থাকত এবং এটা জাহাজের নাবিকদের আবাসস্থল হিসেবে ব্যবহৃত হত। পূর্বের আদর্শ ক্রুজারগুলোতে নিম্ন-ডেক থাকত আংশিক সশস্ত্র যা জাহাজের হাফ-ব্যাটারি বা ডেমি-ব্যাটারি হিসেবে পরিচিত ছিল। নিম্ন-ডেকের উচ্চতা কমানোর ফলে জাহাজের ঊর্ধ্বাংশের উচ্চতাও হ্রাস পায় যা ফ্রিগেটের চলাচলের দক্ষতাকে বাড়িয়ে তোলে। এই ফ্রিগেটগুলোতে সব কামান ঊর্ধ্ব-ডেকে বহন করার ফলে এগুলো সবসময়ই পানির পৃষ্ঠের চেয়ে উপরে অবস্থান করত, ফলে ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সাগরে দুই ডেকেই অস্ত্র বহন করা জাহাজগুলো নিম্ন-ডেকের কামান গুলো ব্যবহার করতে না পারলেও ফ্রিগেটগুলো তাদের পূর্ণশক্তিই ব্যবহার করতে পারত। [4][5]
১৭৭৭ থেকে ১৭৯০ সালের মধ্যে মোট ৫৯টি ফরাসি পালতোলা ফ্রিগেট তৈরি হয়। আদর্শ নকশায় এইসব ফ্রিগেটের দৈর্ঘ্য হত ১৩৫ ফু (৪১ মি) এবং গভীরতা হত ১৩ ফু (৪.০ মি)। এই জাহাজগুলো ১৪ নট (২৬ কিমি/ঘ; ১৬ মা/ঘ) পর্যন্ত গতীতে চলতে পারত যা তাদের পূর্বসুরীদের থেকে তাৎপর্যপূর্নভাবে দ্রুতগামী।[4]
১৭৪০ থেকে ১৭৪৮ সালব্যাপী অস্ট্রিয়ার উত্তরাধিকার যুদ্ধ-তে ব্রিটিশ রাজকীয় নৌবাহিনী এই নতুন ফ্রিগেটের অনেকগুলোকেই আটক করতে সক্ষম হয়। তারা এইসব জাহাজ, বিশেষ করে এগুলোর উপকূলে নিয়ন্ত্রণ সক্ষমতা দেখে প্রভাবিত হয়। শীঘ্রই তারা ফরাসি বেসরকারি নৌজাহাজ তাইগ্রি এর অনুকরণে জাহাজ তৈরি শুরু করে এবং নিজেদের প্রয়োজনের সাথে খাপ খাইয়ে পরিবর্তন আনতে থাকে যা পরবর্তীতে প্রধান নৌশক্তি হিসেবে ফ্রিগেটের আদর্শমান নির্ধারন করে দেয়। ব্রিটিশ ফ্রিগেটগুলোতে ২৮টি কামান বহন করত যার মধ্যে ২৪টি ৯-পাউন্ড কামান থাকত ঊর্ধ্ব-ডেকে এবং বাকি চারটি ছোট কামান থাকত কোয়ার্টার-ডেকে। পরবর্তীতে এর উন্নত সংস্করণে ফ্রিগেট পঞ্চম রেটের জাহাজ হিসেবে পরিণত হয় যাতে থাকত মোট ৩২ বা ৩৬টি কামান যার মধ্যে ঊর্ধ্ব-ডেকে থাকত ২৬টি ১২-পাউন্ড কামান এবং বাকি ৬ বা ৮টি ছোট কামান থাকত কোয়ার্টার-ডেক ও ফোক্যাসলে।[6]
১৭৭৮ সালে ব্রিটিশ নৌবিভাগ বড় ও ভারী ফ্রিগেটের প্রচলন ঘটায় যাতে প্রধান অস্ত্র হিসেবে থাকত ২৬ বা ২৮টি ১৮-পাউন্ড কামান ( পাশাপাশি কিছু ছোট কামান থাকত কোয়ার্টার-ডেক ও ফোক্যাসলে)। এই ঘটনা সে সময়ের নৌশক্তির অবস্থাকে প্রতিফলিত করে। ফ্রান্স এবং স্পেন উভয়ে শত্রু হিসেবে দেখা দেওয়ায় ব্রিটিশ নৌবহরের স্বাভাবিক সংখ্যাত্মক আধিপত্য না থাকার ফলে ক্রুজারের মত বৃহৎ ও শক্তিধারী জাহাজ নির্মাণের চাপ বেড়ে যায়। এর জবাবে, ফরাসিরা ১৭৮১ সালে তাদের প্রথম ১৮-পাউন্ড কামানযুক্ত ফ্রিগেট নির্মাণ শুরু করে। ধীরে ধীরে ফরাসি বিপ্লব ও নেপোলীয় যুদ্ধের সময় ১৮-পাউন্ড কামানযুক্ত ফ্রিগেট আদর্শমান হয়ে ওঠে। ব্রিটিশরা ৩৮টি কামানযুক্ত বড় ও ৩৬টি কামানযুক্ত ছোট ফ্রিগেট তৈরি করে। পাশাপাশি তাদের নৌবহরে ৩২টি কামানযুক্ত ফ্রিগেটও দেখা যায়, যাকে "সস্তা ফ্রিগেট" বলা যেতে পারে। ৩২-কামানযুক্ত ফ্রিগেটের সুবিধা ছিল যে এগুলোকে ছোট ও কম-বিশেষায়িত জাহাজ নির্মাতারাও নির্মাণ করতে পারত।[7][8]
ফ্রিগেটগুলো প্রধান গোলন্দাজ ব্যাটারির পাশাপাশি কোয়ার্টার-ডেক ও ফোক্যাসলে ছোট কামানও বহন করত। প্রযুক্তিগতভাবে ২৮টির কম কামানবাহী রেটযুক্ত জাহাজকে ফ্রিগেট হিসেবে ধরা হত না, তাদের বলা হত "পোস্ট শিপ"। তবে সাধারণ কথোপকথনে বেশিরভাগ পোস্ট শিপকে ফ্রিগেটই বলা হত, এমনকি ছোট দুইডেকযুক্ত জাহাজ যেগুলো যুদ্ধসারির উপযোগী ছিল না তাদের ক্ষেত্রেও ফ্রিগেট শব্দটির অপব্যবহার দেখা যায়। ১৭৭৮ সালে স্কটল্যান্ডের ক্যারন আয়রন কোম্পানি নৌ-কামান উদ্ভাবন করে যা ফ্রিগেটসহ অন্যান্য ছোট জাহাজের অস্ত্রব্যবস্থায় যুগান্তকারী পরিবর্তন নিয়ে আসে। ক্যারোনেড ছিল বড়-ক্যালিবার, ছোট-ব্যারেলযুক্ত হালকা নৌ-কামান যা খুব দ্রুত রিলোড করতে পারত এবং প্রচলিত কামানের চেয়ে কম লোক দিয়েই পরিচালনা করা যেত। ওজনে হালকা হও্যার কারনে এই কামানগুলোকে ফ্রিগেটের কোয়ার্টার-ডেক এবং ফোক্যাসলে স্থাপন করা যেত। এই কামান জাহাজগুলোর ধাতব ওজন সাপেক্ষে গোলাবর্ষণ সক্ষমতা অনেক বৃদ্ধি করে। ক্যারোনেডের অসুবিধা ছিল এদের গোলাবর্ষণের পাল্লা ছিল তুলনামূলক কম এবং এরা নির্ভুল ছিল। ব্রিটিশরা এই নতুন অস্ত্রের সুবিধাগুলো অনুধাবন করে শীঘ্রই তাদের জাহাজে এটা যুক্ত করে। যুক্তরাষ্ট্র নৌবাহিনীও আবির্ভাবের পরপরই এই কামানের প্রতিলিপি তৈরী করে। পরবর্তী দশকগুলোতে ফরাসী এবং অন্যান্য নৌবাহিনীও এই অস্ত্রের নিজস্ব ব্যবহার শুরু করে। সাধারণত ভারী ফ্রিগেটে প্রধান অস্ত্র হিসেবে থাকত ১৮-পাউন্ডের প্রথাগত কামান, সাথে ৩২-পাউন্ড ক্যারোনেড বসানো থাকত ঊর্ধ্ব-ডেকে।[9]
২৪ পাউন্ড কামান দ্বারা সজ্জিত প্রথম অতি-ভারী ফ্রিগেট তৈরি হয় ১৭৮২ সালে নৌস্থপতি এফ এইচ চ্যাপম্যান দ্বারা সুইডিশ নৌবাহিনীর জন্য। যুদ্ধসারির জাহাজের অপ্রতুলতা থাকায়, সুইডিশরা বেলোনা-শ্রেণির এই ফ্রিগেটগুলোকে জরুরি প্রয়োজনে যুদ্ধসারিতে দাড়াতে সক্ষম করে তৈরি করতে চেয়েছিল। ১৭৯০ এর দশকে ফরাসিরাও স্বল্প সংখ্যক ২৪-পাউন্ড কামান যুক্ত ফ্রিগেট তৈরি করেছিল, যেমন- ফোর্তে এবং ইজিপশিয়েঁ। তারা কিছু পুরাতন যুদ্ধসারির জাহাজকে কেটেও অতি-ভারী ফ্রিগেট তৈরি করেছিল (দিয়াদেম অন্যতম), এই জাহাজগুলো র্যাজী (rasée) নামে পরিচিত ছিল। তবে এটি জানা যায় না, ফরাসিরা আসলে শক্তিশালি ক্রুজার তৈরি করার চেষ্টা করছিল নাকি নিছক তাদের পুরাতন জাহাজের স্থিরতা-সংক্রান্ত সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছিল। ব্রিটিশরা এইসব শক্তিশালী ফ্রিগেটের সম্ভাবনা দেখে সতর্ক হয়, ফলস্বরূপ তারা তাদের তিনটি ৬৪-কামানযুক্ত ব্যাটেলশিপকে র্যাজী-তে রূপান্তর করে, যার মধ্যে ইনডিফ্যাটিগেবল ছিল অন্যতম, যেটি ফ্রিগেট হিসেবে খুবই সফল ক্যারিয়ার পার করে। এই সময় ব্রিটিশরা ২৪-পাউন্ড কামানযুক্ত বৃহৎ ফ্রিগেটও তৈরি করে যাদের মধ্যে সবচেয়ে সফল ছিল এইচএমএস এন্ডিমিয়ন।[10][11]
১৭৯৭ সালে যুক্তরাষ্ট্র নৌবাহিনীর প্রথম ছয়টি বড় জাহাজের তিনটিই ছিল ৪৪টি কামানযুক্ত ফ্রিগেট, যা অভিযানের সময় দুইটি ডেকে ৫৬ থেকে ৬০টি ২৪-পাউন্ড কামান এবং ৩২-পাউন্ড বা ৪২-পাউন্ড ক্যারোনেড বহন করত। এই জাহাজগুলো ছিল অতি-শক্তিশালি, অত্যন্ত বৃহৎ এবং এরা এতটাই অস্ত্র সুসজ্জিত ছিল যে এদেরকে যুদ্ধসারির জাহাজের সমকক্ষ মনে করা হত। ১৮১২ সালের যুদ্ধ-এ দফায় দফায় পরাজয়ের পর রাজকীয় নৌবাহিনী তাদের ফ্রিগেটগুলোকে ২ঃ১ প্রাধান্য না থাকলে এই বৃহৎ আমেরিকান জাহাজগুলোর মুখোমুখি না হওয়ার নির্দেশ দেয়। ইউএসএস কন্সটিটিউশন, যা যুক্তরাষ্ট্র নৌবাহিনী কর্তৃক যাদুঘর হিসেবে সংরক্ষিত, হচ্ছে সবচেয়ে পুরানো কমিশন করা জাহাজ এবং পালতোলা যুগের ফ্রিগেটের উদাহরণ। কন্সটিটিউশন এবং তার সহকর্মী জাহাজ প্রেসিডেন্ট ও ইউনাইটেড স্টেটস নির্মিত হয় ১৯৭৪ সালের নৌ-আইন অনুযায়ী উপকূলীয় জলদস্যুদের দমনের উদ্দেশ্যে। বিখ্যাত আমেরিকান নৌ-স্থপতি জশুয়া হাম্ফ্রিস প্রস্তাব দেন যে এই শুধু জাহাজগুলো লাইভ ওক, এক রকমের গাছ যা শুধু আমেরিকাতেই জন্মায়, দিয়েই তৈরি করা উচিত। এই তিনটি বৃহৎ ফ্রিগেট তৈরি হয়েছিল কিছু স্বতন্ত্র নির্মাণ বৈশিষ্ট ব্যবহার করে যা হগিং (জাহাজের কাঠামোর দুইপাশ নিচে নামলে মধ্যভাগ উপরে ওঠা) কমায় এবং পানিতে চলাচলের দক্ষতা বৃদ্ধি করে। উভয় পাশে আটটি করে সমতলের সাথে ৪৫-ডিগ্রি কোণে তির্যকভাবে কড়িকাঠ বসানো হত, এগুলো ছিল ২ ফুট (৬১ সেমি) প্রশস্ত এবং ১ ফুট (৩০ সেমি) পুরু যা জাহাজের কাঠামো বজায় রাখতে সাহায্য করত পাশাপাশি নমনীয়তা কমানো এবং আঘাতের প্রভাব হ্রাস করতেও সহায়তা করত।[12]
ব্রিটিশরা আমেরিকার এই বৃহৎ জাহাজগুলোর কাছে বার বার পরাজিত হওয়ার পর তিনভাবে জবাব দেওয়ার চেষ্টা করে। তারা ৪০টি প্রথাগত ২৪-পাউন্ড কামানবাহী এক শ্রেণির ফ্রিগেত নির্মাণ করে। তারা তাদের ৭৪টি কামানবাহী ব্যাটেলশীপ গুলোকে কেটে র্যাজীতে রূপান্তরিত করে, ফলস্বরূপ ৩২-পাউন্ড কামান প্রধান অস্ত্র হিসেবে বহন করা ফ্রিগেট তৈরি হয়, সাথে সম্পূরক হিসেবে ছিল ৪২-পাউন্ড ক্যারোনেড। এই জাহাজগুলোর অস্ত্রব্যবস্থা আমেরিকান জাহাজের শক্তিকে অনেকদুর ছাপিয়ে যায়। সর্বশেষ, তারা ১৫০০ টনের স্পার-ডেক যুক্ত জাহাজ লেন্ডার ও নিউক্যাসল তৈরি করে, এরা আকার ও অস্ত্রসজ্জায় আমেরিকান ৪৪-কামানযুক্ত ফ্রিগেটের সাথে সাথে প্রায় খাপে খাপে মিলে যায়।[13]
ফ্রিগেট হচ্ছে পালতোলা যুগের সবচেয়ে কঠোর পরিশ্রম করা জাহাজ। যুদ্ধসারির জাহজের চেয়ে ছোট হলেও স্লুপ ও গানবোটের জন্য ফ্রিগেট ছিল ভয়ঙ্কর প্রতিপক্ষ। ফ্রিগেট ছয়মাসের রসদ বহন করতে পারত, তাদের পাল্লা ছিল দীর্ঘ, অন্যদিকে ফ্রিগেটের চেয়ে বড় জাহাজগুলো বেশি মূল্যবান হওয়ায় একক অভিযানে পাঠানো হত না।
ফ্রিগেট নৌবহরের অনুসন্ধানের কাজ করত, বাণিজ্যবহরে হামলা পরিচালনা করত, টহল অভিযানে যেত এবং সংবাদ ও বিশিষ্টজনদের আনা-নেওয়ার কাজ করত। সাধারণত ফ্রিগেট ক্ষুদ্র দলে বা এককভাবে যুদ্ধ করত। তারা যুদ্ধসারির জাহাজের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলত, এমনকি যুদ্ধ চলাকালেও যুদ্ধসারির জাহাজ থেকে প্রতিপক্ষের ফ্রিগেটে হামলা চালানো অভদ্রতা হিসেবে বিবেচিত হত যদি ফ্রিগেটটি আগে হামলা না করে থাকে।[14] ফ্রিগেট নৌযুদ্ধে জড়িত থাকত প্রধানত পুনরাবৃত্তিকারক ফ্রিগেট হিসেবে। যুদ্ধের ধোয়া ও বিশৃঙ্খলায় ফ্ল্যাগশিপে থাকা নৌবহরের কমান্ডারের সংকেত অনেক সময় বহরের অন্য জাহাজ লক্ষ্য করতে পারত না।[15] এইজন্য ফ্রিগেট যুদ্ধসারির বায়ু প্রবাহের অনুকূল ও প্রতিকূল দিকে অবস্থান করত এবং ফ্ল্যাগশিপের সাথে একটি পরিষ্কার দৃষ্টিরেখায় অবস্থা করত। ফ্ল্যাগশিপ থেকে পাওয়া সংকেত ফ্রিগেট কর্তৃক পুনরাবৃত্তি করা হত, যেহেতু ফ্রিগেটগুলো যুদ্ধসারির বাইরে ধোয়া ও বিশৃঙ্খলামুক্ত পরিবেশে অবস্থান করত, তাদের পক্ষে এসব সংকেত দেখার সুযোগ বেশি ছিল।[15] মাস্তুল ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হওয়ার ফলে ফ্ল্যাগশিপ প্রথাগত সংকেত দিতে ব্যর্থ হত, পুনরাবৃত্তিকারক ফ্রিগেট সেগুলো অনুবাদ করে সঠিক সংকেত বাকি নৌবহরের কাছে পৌছে দিত।[15]
রাজকীয় নৌবাহিনীর কর্মকর্তাগণের জন্য ফ্রিগেট ছিল একটি আকাঙ্ক্ষনীয় পোস্টিং। ফ্রিগেট প্রায়ই যুদ্ধে লিপ্ত হত, যার অর্থ ছিল গৌরব, পদোন্নতি ও আর্থিক পুরস্কারের অধিক সুযোগ।
শান্তিকালীন সময়ে যেখানে বড় জাহাজগুলো রিজার্ভ হিসেবে থাকত, ফ্রিগেট তখনও সক্রিয় থাকত, যার উদ্দেশ্য ছিল খরচ বাচানো এবং ফ্রিগেটের ক্যাপ্টেন ও অন্য কর্মকর্তাদের অভিজ্ঞতা বৃদ্ধি যা যুদ্ধের সময় কাজে লাগত। অন্য জাহাজে আরোহণ ও উপকূলে অভিযান চালানোর জন্য ফ্রিগেটে মেরিন সৈন্য বহন করা হত। ১৮৩২ সালে যুক্তরাষত্র নৌবাহিনীর প্রথম সুমাত্রা অভিযানে ইউএসএস পটোম্যাক নামক ফ্রিগেট ২৮২ জন নাবিক ও মেরিনের একটি দল বহন করে।
উনিশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত ফ্রিগেট নৌবাহিনীর একটি গুরত্বপূর্ন অংশ হিসেবে ছিল। প্রথমদিকের আয়রনক্ল্যাড গুলোকে কামানের সংখ্যার কারণে ফ্রিগেট হিসেবে শ্রেণিবিভাগ করা হত। পরবর্তীতে লোহা এবং বাষ্প সাধারণ মানে পরিণত হলে ফ্রিগেট শব্দটির ব্যবহার পরিবর্তিত হয়ে যায় এবং নৌবহরে ফ্রিগেটের ভূমিকা প্রোটেক্টেড ক্রুজার ও পরে লাইট ক্রুজার কর্তৃক গৃহীত হয়।
উনিশ শতকে বাষ্পীয় শক্তির ব্যবহার শুরু হওয়ার পরেও ফ্রিগেট গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন অব্যাহত রাখে। ১৮৩০ এর দশকে অনেক নৌবাহিনী ভারী কামানবাহী বৃহৎ প্যাডেল স্টিমার নিয়ে পরিক্ষা চালায়, যাদের প্যাডেল ফ্রিগেট নামে ডাকা হত।
১৮৪০ এর দশকের মাঝামাঝি থেকে ঐতিহ্যবাহী পালতোলা ফ্রিগেটের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ ফ্রিগেট তৈরি হতে থাকে যাতে বাষ্পীয় ইঞ্জিন ও স্ক্রু প্রোপেলার ব্যবহৃত হত। প্রথমদিকে কাঠ ও পরে লোহা দিয়ে তৈরি এই স্ক্রু ফ্রিগেটগুলো উনিশ শতকের শেষার্ধ পর্যন্ত তাদের ঐতিহ্যবাহী ভূমিকা পালন করতে থাকে।
১৮৫৯ সাল থেকে বিদ্যমান নকশার ফ্রিগেট ও যুদ্ধসারির জাহাজগুলোতে বর্ম যোগ করা হতে থাকে। এই আয়রনক্ল্যাড যুদ্ধজাহাজগুলোতে বর্মের অতিরিক্ত ওজনের কারণে শুধু একটি ডেক থাকতে পারত ফলে প্রায়োগিকভাবে এরা ফ্রিগেট ছিল যদিও এগুলো বিদ্যমান যুদ্ধসারির জাহাজের চেয়েও অধিক শক্তিশালি ছিল এবং একই কৌশলগত ভূমিকা পালন করত। আর্মার্ড ফ্রিগেট শব্দগুচ্ছ অনেকদিন ব্যবহৃত হত যা পাল-সজ্জিত একদিকে কামান বসানো আয়রনক্ল্যাড বোঝাত।
১৮৭৫ সালের পরে ফ্রিগেটের ব্যবহার বন্ধ হতে থাকে। বর্মযুক্ত কাঠামোর জাহাজকে ব্যাটলশিপ বা আর্মার্ড ক্রুইজার বলা হত। যেসব জাহাজে বর্মযুক্ত ডেক ও বর্মহীন কাঠামো থাকত, তাদের বলা হত প্রোটেক্টেড ক্রুইজার। ফ্রিগেট ও স্লুপ-এর মত বর্মহীন জাহাজকে বলা হত আনপ্রোটেক্টেড ক্রুইজার।
আধুনিক ফ্রিগেটের সাথে প্রাচীন ফ্রিগেটের শুধু নামেই মিল পাওয়া যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-এর সময় রাজকীয় নৌবাহিনী কর্তৃক কর্ভেট-এর চেয়ে বড় কিন্তু ডেস্ট্রয়ার-এর চেয়ে ছোট ডুবোজাহাজ বিধ্বংসী প্রহরী জাহাজকে বোঝাতে ফ্রিগেট শব্দটির পুনর্ব্যবহার শুরু হয়। আমেরিকার ডেস্ট্রয়ার এসকর্ট-এর আকারে ও সক্ষমতায় সমান হলেও ফ্রিগেট নির্মাণ ও পরিচালনা ব্যয় কম ছিল।[16] পূর্বে রাজকীয় নৌবাহিনীর ডুবোজাহাজ বিধ্বংসী প্রহরী জাহাজকে স্লুপ হিসেবে শ্রেণিবিভাগ করা হত, ১৯৩৯-১৯৪৫ সালের ব্ল্যাক সোয়ান-শ্রেণী স্লুপ গুলো নতুন ধরনের ফ্রিগেটের মতই বড় ছিল, এবং অধিক অস্ত্রসজ্জিত ছিল। এরকম ২২টি স্লুপ এবং ২৪টি ছোট ক্যাসল-শ্রেণী কর্ভেটকে যুদ্ধের পর ফ্রিগেট হিসেবে পূনঃশ্রেণীকরণ করা হয়েছিল।
ফ্লাওয়ার-শ্রেণীর কর্ভেটের কিছু দূর্বলতা, যেমন- অল্প অস্ত্রসজ্জা, জাহাজের কাঠামো গভীর সাগরে যাওয়ার উপযোগী না হওয়া, একক শ্যাফট যা জাহাজের গতি ও ম্যানুভার ক্ষমতা কমিয়ে দেয়, স্বল্প পাল্লা, কাটিয়ে ওঠার জন্য ফ্রিগেটের প্রবর্তন ঘটে। কর্ভেটের মত একই বাণিজ্যিক নির্মান বিধিমালা অনুযায়ীই ফ্রিগেটের নকশা করা হত ফলে যেসব ইয়ার্ডে যুদ্ধজাহাজ তৈরি হত না সেগুলোতে ফ্রিগেট তৈরি করা হত। ১৯৪১ সালে নির্মিত রিভার শ্রেণীর প্রথম ফ্রিগেট ছিল আসলে একটি বৃহৎ কাঠামোতে দুই সেট কর্ভেটের যন্ত্রাংশ, যাতে অস্ত্র হিসেবে ছিল তৎকালীন আধুনিক ডুবোজাহাজ বিধ্বংসী অস্ত্র হেজহগ।
ফ্রিগেটের আক্রমণাত্মক অস্ত্র ও গতি থাকত ডেস্ট্রয়ারের চেয়ে কম তবে ডুবোজাহাজ বিধ্বংসী যুদ্ধে এগুলোর প্রয়োজনীয়তা ছিল না। ডুবন্ত অবস্থায় ডুবোজাহাজ ছিল ধীর এবং ২০ নট (২৩ মা/ঘ; ৩৭ কিমি/ঘ) এর বেশি গতিতে এসব ফ্রিগেটে থাকা অ্যাসডিক (ASDIC) সোনার ঠিকমত কাজ করত না। বরং ফ্রিগেট ছিল এক ধরনের সরল এবং সস্তা জাহাজ যা প্রচুর পরিমাণে নির্মান করা যেত এবং ডুবোজাহাজ বিধ্বংসী যুদ্ধের আধুনিকতম আবিষ্কার এতে যুক্ত করা যেত। যেহেতু ফ্রিগেট তৈরি হয়েছিল প্রহরী হিসেবে দায়িত্ব পালনের জন্য, যুদ্ধে মোতায়েনের জন্য নয়, এর গতি ও পাল্লা ছিল সীমিত।
তৎকালীন জার্মান ফ্লোটেনবেগ্লাইটার (নৌবহর প্রহরী), যা এফ-বোট না,এও পরিচিত ছিল, আসলে এক ধরনের ফ্রিগেট ছিল।[17] এগুলো নির্মিত হয়েছিল যুদ্ধ-পূর্ববর্তী ওবারকমান্ডো ডার মেরিন ধারণার উপর ভিত্তি করে যা মাইনসুইপার, মাইন লেয়ার, বাণিজ্যবহর প্রহরী এবং ডুবোজাহাজ বিধ্বংসী নৌযান হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পারত। ভার্সাই চুক্তির ফলে এদের ওজন দাপ্তরিকভাবে ৬০০ টনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকত, যদিও বাস্তবে এদের ওজন ১০০ টন পর্যন্তও বেশি থাকত। এফ-বোটে দুইটি গাদা এবং দুইটি ১০৫ মিমি কামান বহন করা যেত। সরু বিম, তীক্ষ্ণ অগ্রভাগ এবং অবিশ্বস্ত উচ্চচাপ বাষ্পীয় টারবাইন ব্যবহারের ফলে এদের নকশা ছিল ত্রুটিপূর্ন। এফ বোট পরবর্তীতে টাইপ ৩৫ টর্পেডো বোট এবং এলবিং-শ্রেণী টর্পেডো বোট দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়। ফ্লোটেনবেগ্লাইটার উচ্চতর প্রশিক্ষণ জাহাজ হিসেবে সক্রিয় থাকে।
১৯৪৪ সালে ব্রিটিশ নৌবাহিনীর বে শ্রেণী হচ্ছে প্রথম নৌযান যা ফ্রিগেট হিসেবে শ্রেণিবিভক্ত হয়েও নৌবহরের অংশ হিসেবে ব্যবহৃত হয়, যদিও এতে গতি ছিল সীমিত। এইসব আকাশ প্রতিরক্ষা ফ্রিগেট যা অসম্পূর্ণ লোচ-শ্রেণী ফ্রিগেট এর কাঠামোতে তৈরি হয়, যুক্তরাষ্ট্র নৌবাহিনীর ডেস্ট্রয়ার এসকর্টের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ ছিল, যদিও ডেস্ট্রয়ার এসকর্টের অধিক গতি ও আক্রমণাত্মক অস্ত্রসম্ভার তাদের যুদ্ধে মোতায়েনের জন্য অধিক সাযুজ্যপূর্ণ করে তুলেছিল। আমেরিকার যুদ্ধে যোগদানের পূর্বে গভীর সমুদ্রে প্রহরী জাহাজ হিসেবে ডেস্ট্রয়ার এসকর্টের নকশা করা হয়েছিল। আমেরিকার তৈরি ডেস্ট্রয়ার এসকর্ট, যা ব্রিটিশ রাজকীয় নৌবাহিনীতে যুক্ত হয়েছিল, সেগুলো ক্যাপ্টেন ক্লাস ফ্রিগেট হিসেবে পরিচিত ছিল। যুক্তরাষ্ট্র নৌবাহিনীর দুইটি কানাডায় তৈরি অ্যাশভাইল-শ্রেণী এবং ৯৬টি ব্রিটিশ-প্রভাবিত, যুক্তরাষ্ট্রে নির্মিত ট্যাকোমা-শ্রেণীর ফ্রিগেটগুলোকে আসলে প্যাট্রল গানবোট (পিজি) বলা হত যা পরবর্তীতে, ১৯৪৩ সালের ১৫ এপ্রিল, প্যাট্রল ফ্রিগেট (পিএফ) হিসেবে পূণঃশ্রেণিবিভাগ করা হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ভূমি থেকে আকশে নিক্ষেপযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র প্রবর্তন ফ্রিগেটের মত ছোট যুদ্ধজাহাজকে বিমান বিধ্বংসী যুদ্ধে কার্যকর করে তোলে। যুক্তরাষ্ট্র নৌবাহিনীতে এই জাহাজকে বলা হত ওশান এসকর্ট (মহাসাগর প্রহরী) এবং ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত "ডিই" বা "ডিইজি" হিসেবে চিহ্নিত করা হত, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন "ডেস্ট্রয়ার এসকর্ট" এর সাথে মিল রেখে। রাজকীয় কানাডিয়ান নৌবাহিনী এবং ব্রিটিশ রাজকীয় নৌবাহিনী ফ্রিগেট শব্দটির ব্যবহার অব্যাহত রাখে। ফরাসিরা ক্ষেপণাস্ত্র-সজ্জিত, ক্রুজারের সমান পর্যন্ত আকৃতির জাহাজকে (সাফ্রেন, টুরভিল ও হরাইজন শ্রেণী) ফ্রিগাত হিসেব অভিহিত করতে থাকে, আর ছোট জাহাজকে বলত আভিসো। সোভিয়েত নৌবাহিনী ব্যবহার করত প্রহরী জাহাজ (сторожевой корабль) নাম।
১৯৫০ থেকে ১৯৭০ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র নৌবাহিনী ফ্রিগেট শ্রেণির জাহাজ যুক্ত করতে থাকে, যা ছিল আসলে ডেস্ট্রয়ারের কাঠামোর উপর নির্মিত বিমান বিধ্বংসী ক্রুজার। এসব জাহাজে রিম-২ টেরিয়ার ক্ষেপণাস্ত্রের একটি বা দুটি যুগ্ম উৎক্ষেপক থাকত যা পরে ১৯৮০ সালের দিকে রিম-৬৭ স্ট্যান্ডার্ড ইআর ক্ষেপণাস্ত্র দ্বারা আপগ্রেড করা হয়। এসব জাহাজের মূল দায়িত্ব ছিল বিমানবাহী রণতরীকে জাহাজ-বিধ্বংসী ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র থেকে রক্ষা করা, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন ক্রুজারের সম্পূরক ও পরে প্রতিস্থাপক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ক্ষেপণাস্ত্রবাহী ফ্রিগেটে ডুবোজাহাজ বিধ্বংসী সক্ষমতাও ছিল যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন ক্রুজারে অনুপস্থিত ছিল। এদের মধ্যে কিছু জাহাজ যেমন- বেইনব্রিজ ও ট্রাক্সটান এবং ক্যালিফোর্নিয়া ও ভার্জিনিয়া শ্রেণী পারমাণবিক শক্তিচালিত ছিল।[18] এই ফ্রিগেটগুলো আকৃতিতে ডেস্ট্রয়ার ও ক্রুইজারের মাঝামাঝি ছিল। এটা ছিল অনেকটা পালতলা যুগের মত যখন ফ্রিগেট ছিল মধ্যম আকৃতির যুদ্ধজাহাজ কিন্তু তা সমকালীন অন্য নৌবাহিনীর রীতিনীতির সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ ছিল যারা ফ্রিগেট বলতে বোঝাত ডেস্ট্রয়ারের চেয়ে ছোট জাহাজ। ১৯৭৫ সালের জাহাজ পূণঃশ্রেণিকরণ-এর সময় আমেরিকান ফ্রিগেট গুলো ডেস্ট্রয়ার বা ক্রুইজার হিসেবে শ্রেণিভুক্ত হয় আর ওশান এসকর্ট গুলোকে ফ্রিগেট বা ক্ষেত্রবিশেষে ফাস্ট ফ্রিগেট হিসেবে শ্রেণিবিভাগ করা হয়। ১৯৭০ এর দশকে যুক্তরাষ্ট্র অলিভার হ্যাজার্ড পেরি-শ্রেণির ৫১টি ক্ষেপণাস্ত্রবাহী ফ্রিগেট নির্মান করে যার শেষটি ২০১৫ সালে অবসরে যায়, তবে অন্য নৌবাহিনীতে এখনও কিছু জাহাজ সক্রিয় আছে।[19]
১৯৪৫ পরবর্তী অন্যতম সফল নকশা ছিল লেন্ডার শ্রেণী যা বেশ কয়েকটি নৌবাহিনী কর্তৃক ব্যবহৃত হয়েছিল। ১৯৫৯ সালে নির্মান শুরু হওয়া এই জাহাজের নকশা করা হয়েছিল হুইটবি-শ্রেণির ডুবোজাহাজ বিধ্বংসী ফ্রিগেট এর ভিত্তি করে তবে এতে বিমান-বিধ্বংসী অস্ত্রেও সজ্জিত ছিল। এগুলো যুক্তরাজ্য কর্তৃক ১৯৯০ এর দশকে ব্যবহৃত হয়েছিল যা একপর্যায়ে অন্য নৌবাহিনীর কাছে বিক্রি করে দেয়া হয়। "লেন্ডার" বা এর উন্নত নকশা অন্য নৌবাহিনী কর্তৃকও ব্যবহৃত হয়েছিল।
প্রায় সব আধুনিক ফ্রিগেটেই আক্রমণাত্মক ও রক্ষণাত্মক অস্ত্রে সজ্জিত থাকে এবং এগুলোকে ক্ষেপণাস্ত্রবাহী ফ্রিগেট (এফএফজি, FFG) হিসেবে গণ্য করা হয়। ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্রের আধুনিকায়নের ফলে আধুনিক ক্ষেপণাস্ত্রবাহী ফ্রিগেট যেকোন নৌবাহিনীর মূল অংশ হিসেবে আবির্ভুত হয়েছে এবং নৌবহর প্রতিরক্ষা জাহাজ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে যার ফলে বিশেষায়িত বিমান বিধ্বংসী ফ্রিগেটের প্রয়োজন থাকছে না।
রাজকীয় নৌবাহিনীর সালিসবুরি শ্রেণির ফ্রিগেট এয়ার ডিরেকশন ফ্রিগেট যা বিমান অনুসরণে ব্যবহৃত হত। এজন্য এসব জাহাজ লিওপার্ড শ্রেণির ফ্রিগেট-এর তুলনায় কম অস্ত্র বহন করত যদিও তারা একই কাঠামোর উপর নির্মিত ছিল।
মেকো ২০০, আনযাক ও হালিফ্যাক্স শ্রেণী গুলো নির্মিত হয়েছিল এমন সব প্রয়োজনে মোতায়েনের জন্য যা সাধারণ ফ্রিগেট পূরণ করতে পারত না আবার ডেস্ট্রয়ার মোতায়েনের ও প্রয়োজন হত না।
অন্যদিকে কিছু ফ্রিগেট তৈরি হয়েছিল ডুবোজাহাজ বিধ্বংসী যুদ্ধ-এর জন্য বিশেষায়িত হিসেবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে ডুবোজাহাজের গতি বৃদ্ধির ফলে গতির দিক দিয়ে ফ্রিগেটের শ্রেষ্ঠত্ব কমতে থাকে। ফ্রিগেটের আর ধীরগতি ও বাণিজ্যিক জাহাজের যন্ত্রপাতি দিয়ে পরিচালনার সুযোগ থাকল না। ফলে পরবর্তীতে তৈরি হুইটবি শ্রেণীর ফ্রিগেট ছিল দ্রুততর।
এ ধরনের জাহাজে থাকত আধুনিক সোনার যন্ত্রপাতি, যেমন- ভেরিয়েবল ডেপথ সোনার, টোয়েড অ্যারে সোনার এবং বিশেষায়িত অস্ত্র, যেমন- টর্পেডো, সামনের দিকে নিক্ষেপিত অস্ত্র লিম্বো এবং ক্ষেপণাস্ত্র-বাহিত টর্পেডো। আক্রমণাত্মক ও রক্ষণাত্মক অস্ত্র হিসেবে থাকত যথাক্রমে জাহাজবিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র এক্সোসেট ও ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র এআইএম-৭ স্প্যারো। রাজকীয় নৌবাহিনীর টাইপ ২২ ফ্রিগেট বিশেষায়িত ডুবোজাহাজ বিধ্বংসী ফ্রিগেটের উদাহরণ।
বিশেষভাবে ডুবোজাহাজ বিধ্বংসী যুদ্ধের জন্য, বেশিরভাগ আধুনিক ফ্রিগেটের পিছনে হেলিকপ্টার পরিচালনার জন্য একটি হেলিকপ্টার ডেক ও হ্যাঙ্গার থাকে। এর ফলে ফ্রিগেটকে অজানা সমুদ্রতলের হুমকির মুখোমুখি হতে হয় না এবং দ্রুতগতির হেলিকপ্টারের সাহায্যে পারমাণবিক ডুবোজাহাজকে আক্রমণ সহজ হয় যারা ক্ষেত্রবিশেষে ফ্রিগেটের চেয়েও দ্রুতগামী হয়। এই কাজের জন্য হেলিকপ্টারে সম্ভব্য হুমকি শনাক্ত করতে সোনোবয়, তার-বসানো ডুবন্ত সোনার এবং চৌম্বকীয় অসংগতি নির্ণায়ক-এর মত সেন্সর এবং আক্রমনের জন্য টর্পেডো ও ডেপথ চার্জ সজ্জিত থাকে।
হেলিকপ্টারে অবস্থিত রাডারের সাহায্যে দিগন্তরেখার ওপারে থাকা লক্ষ্যকে কে নিরীক্ষণ ও জাহাজবিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র দ্বারা সজ্জিত থাকলে লক্ষ্যকে আক্রমণও করা সম্ভব। অনুসন্ধান ও উদ্ধার অভিযানের জন্য হেলিকপ্টার অমূল্য এবং জাহাজ থেকে তীরে সৈন্য, চিঠি ও অন্যান্য রসদ পরিবহনের কাজে ছোট নৌকা ও পুনঃসরবরাহ জাহাজকে হেলিকপ্টার অনেকাংশে প্রতিস্থাপিত করেছে। হেলিকপ্টারের সাহায্যে এ ধরনের কাজ হয় দ্রুত, কম বিপজ্জনকভাবে এবং এজন্য ফ্রিগেটকে গতি কমানো বা গতিপথ পরিবর্তনের প্রয়োজন হয় না।
কিছু কিছু ফ্রিগেট আকাশ প্রতিরক্ষার জন্য বিশেষায়িত হিসেবে নির্মিত হয়েছে, যুদ্ধ বিমান ও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তির বড় ধরনের আধুনিকায়নের ফলে। এর একটি উদাহরণ হচ্ছে রাজকীয় ডাচ নৌবাহিনীর দা জেইফা প্রোফিন্সিয়া-শ্রেণীর আকাশ প্রতিরক্ষা ও নেতৃত্বদানকারী ফ্রিগেট। এই জাহাজগুলো এসএম-২ ব্লক ৩এ দূর পাল্লার বিমান-বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র, এক বা দুইটি গোলকিপার স্বপ্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, ইএসএসএম মধ্যম পাল্লার বিমান-বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র, একটি স্মার্ট-এল রাডার এবং একটি থ্যালেস একটিভ ফেজড অ্যারে রাডার দ্বারা সজ্জিত, যার সবকিছুই আকাশ প্রতিরক্ষার কাজে ব্যবহৃত হয়। এ ধরনের জাহাজের আরেকটি উদাহরণ হচ্ছে ডেনীয় নৌবাহিনীর ইভার হিতফেল্ট শ্রেণীর ফ্রিগেট।[21]
ফরাসি লা ফায়েত শ্রেণীর নকশার মাধ্যমে আধুনিক ফ্রিগেট নির্মানে স্টেলথ প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হয়।[22] ফ্রিগেটের আকৃতি এমনভাবে নকশা করা হয় যাতে এর রাডার প্রস্থচ্ছেদ সর্বনিম্ন থাকে এবং বাতাসে ভেদনক্ষমতাও বেশি থাকে, এসব ফ্রিগেট ম্যানুভার সক্ষমতায় পালতোলা জাহাজের সমপর্যায়ের। এ ধরনের জাহাজের মধ্যে রয়েছে ইতালীয় ও ফরাসি হরাইজন শ্রেণী যাতে ক্ষেপণাস্ত্র বিধ্বংসী অস্ত্র হিসেবে রয়েছে অ্যাস্টার ১৫ ও অ্যাস্টার ৩০ ক্ষেপণাস্ত্র, জার্মান বাডেন-উতেমবার্গ ও সাক্সেন শ্রেণী, তার্কিশ মার্ক ৪১ উল্লম্ব উৎক্ষেপণ ব্যবস্থা সংবলিত টিএফ২০০০ শ্রেণী এবং ভারতীয় ব্রহ্মস ক্ষেপণাস্ত্রবাহী শিভালিক, তলোয়ার ও নীলগিরি শ্রেণীর ফ্রিগেট।
আধুনিক ফরাসি নৌবাহিনী সক্রিয় থাকা সকল ডেস্ট্রয়ার ও ফ্রিগেটকে প্রথম শ্রেণির ফ্রিগেট ও দ্বিতীয় শ্রেণির ফ্রিগেট হিসেবে শ্রেণিবিভাগ করে থাকে। তবে পরিচিতি সংখ্যার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ফ্রিগেটের জন্য এফ-সিরিজ ও ডেস্ট্রয়ারের জন্য ডি-সিরিজ সংখ্যা ব্যবহার করে থাকে। এটা অনেকক্ষেত্রে ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি করে যেহেতু ফ্রান্সে ফ্রিগেট হিসেবে স্বীকৃত জাহাজের সদৃশ জাহাজ অন্যান্য নৌবাহিনীতে ডেস্ট্রয়ার হিসেবে উল্লেখ করা হয়। ফলস্বরূপ, সাম্প্রতিক ফরাসি ফ্রিগেটের শ্রেণি, যেমন হরাইজন শ্রেণী, ফ্রিগেট রেটিংযুক্ত বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ জাহাজের শ্রেণি।
জার্মান নৌবাহিনীতে ফ্রিগেটকে ডেস্ট্রয়ারের প্রতিস্থাপনের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে, আকৃতি ও ভূমিকার দিক দিয়ে নতুন জার্মান ফ্রিগেটগুলো পুরাতন ডেস্ট্রয়ারের শ্রেণিকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে। জার্মান বাডেন-উতেমবার্গ শ্রেণীর ফ্রিগেট বর্তমানে বিশ্বের বৃহত্তম ফ্রিগেট যার বহন ক্ষমতা ৭২০০ টনেরও বেশি। স্পেনীয় নৌবাহিনীর আলভারো দে বাজান শ্রেণীর ফ্রিগেট হচ্ছে অত্যাধুনিক এইজিস কম্ব্যাট সিস্টেম ব্যবহারকারী প্রথম ফ্রিগেট।
কর্ভেট-এর সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ কিছু নতুন জাহাজের শ্রেণি তৈরি হচ্ছে যাদের সমপর্যায়ের যুদ্ধজাহাজের বদলে ছোট আকৃতির নৌযানের বিরুদ্ধে দ্রুত মোতায়েনে সক্ষম হিসেবে নির্মাণ করা হয়েছে, যেমন যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি লিটোরাল কম্ব্যাট শিপ (এলসিএস)। ২০১৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র নৌবাহিনীর অলিভার হ্যাজার্ড পেরির ফ্রিগেট অবসরের পর সৃষ্ট শূণ্যস্থান পূরণের জন্য এই এলসিএস তৈরি করা হয়। যদিও এলসিএস গুলো ফ্রিগেটের চেয়ে ছোট, তারা প্রায় একই ধরনের অস্ত্র বহন করে আবার এদের পরিচালনার জন্য অর্ধেকেরও কম নাবিকের প্রয়োজন এবং ৪০ নট (৭৪ কিমি/ঘ; ৪৬ মা/ঘ) পর্যন্ত গতিতে চলতে সক্ষম। এলসিএস এর একটি বড় সুবিধা হচ্ছে এগুলো বিভিন্ন মিশন মডিউল-এর সমন্বয়ে নির্মিত যার ফলে এগুলো বৈচিত্রময় ভূমিকা পালনে সক্ষম। বিভিন্ন মডিউলের সমন্বয়ে তৈরি হওয়ায়, জাহাজকে সমুদ্রে রেখেই নির্দিষ্ট মডিউলটি তীরে এনে আপগ্রেড করে পরে জাহাজে বসানো সম্ভব, ফলে জাহাজকে সর্বাধিক সময় মোতায়েন রাখা যায়।
২০১৫ সালে পুরাতন ফ্রিগেটের অবসরের পর যুক্তরাষ্ট্রের এই নতুন পরিকল্পনার ফলে ১৯৪৩ সালের পর প্রথমবারের মত যুক্তরাষ্ট্র নৌবাহিনীতে কোন ফ্রিগেট ছিল না (যদিও ফ্রিগেট হিসেবে চিহ্নিত ইউএসএস কনস্টিটিউশন সক্রিয় ছিল তবে তা নৌবাহিনীর দৈনন্দিন কার্যক্রমে ব্যবহৃত হয় না)।[23]
২০১৯ সাল থেকে নির্মিত এলসিএস গুলোকে ফ্রিগেট হিসেবে আখ্যায়িত করা হচ্ছে এবং পূর্বে নির্মিত জাহাজগুলোকেও পরিবর্তনের পর ফ্রিগেট হিসেবে শ্রেণিবিভাগ করার পরিকল্পনা রয়েছে।[24]
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.