Loading AI tools
যে সমাজব্যবস্থায় পুরুষেরা আধিপত্য বিস্তার করে উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
সমাজবিদ্যায় পিতৃতন্ত্র হচ্ছে একটি সামাজিক ব্যবস্থা যেখানে পুরুষেরা প্রাথমিক ক্ষমতা ধারণ করে এবং রাজনৈতিক নেতৃত্ব, নৈতিক কর্তৃত্ব, সামাজিক সুবিধা ও সম্পত্তির নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে প্রাধান্য স্থাপন করে, পরিবারের ক্ষেত্রে পিতা ও পিতৃতুল্যগণ নারী ও শিশুর উপর কর্তৃত্ব লাভ করে। কিছু পিতৃতান্ত্রিক সমাজ একই সাথে পিতৃগোত্রজ হয়, যার অর্থ হচ্ছে এইসব সমাজে সম্পত্তি ও পদবী পুরুষের মাধ্যমে এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে বাহিত হয়।
ঐতিহাসিকভাবে বিভিন্ন সংস্কৃতির বিস্তৃত পরিসরে সামাজিক, আইনগত, রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানে পিতৃতন্ত্রের অস্তিত্ব দেখা গেছে।[1] এমনকি, যদিও বা সংবিধান ও আইনসমূহে সমাজের পিতৃগোত্রজ হবার বিষয়টি লেখা থাকে না, প্রথানুসারে বেশিরভাগ সমসাময়িক সমাজই পিতৃগোত্রজ হয়ে থাকে।[2]
পিতৃতন্ত্র শব্দটি ইংরেজি "Patriarchy" (পেট্রিয়ার্কি) এর পারিভাষিক শব্দ। এই শব্দটির আক্ষরিক অর্থ হচ্ছে "পিতার শাসন"।[3][4] শব্দটি এসেছে গ্রীক πατριάρχης (পেট্রিয়ার্কেস) থেকে, যার অর্থ হচ্ছে "জাতির পিতা" বা "জাতির প্রধান বা পেট্রিয়ার্ক"।[5][6] এই শব্দটিও আবার গ্রীক πατριά (পেট্রিয়া) এবং ἄρχω (আরকো) থেকে এসেছে। গ্রীক পেট্রিয়া অর্থ হচ্ছে বংশ[7], যা আবার এসেছে গীক πατήρ (প্যাটার) থেকে, যার অর্থ পিতা। আর গ্রীক আরকো শব্দটির অর্থ হল "আমি শাসন করি"।[8]
ঐতিহাসিকভাবে, পেট্রিয়ার্কি শব্দটির দ্বারা পরিবারে পুরুষ প্রধানের স্বৈরাচারী শাসনকে বোঝানো হত। কিন্তু আধুনিক সময়ে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই শব্দটির দ্বারা বরং একটি সামাজিক ব্যবস্থাকে বোঝায় যেখানে ক্ষমতা প্রাথমিকভাবে প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের দ্বারাই ধৃত হয়।[9][10][11] এর একটি উদাহরণ হচ্ছে সিলভিয়া ওয়ালবির দেয়া পিতৃতন্ত্রের সংজ্ঞাটি। সিলভিয়া সংজ্ঞা দেন, "পিতৃতন্ত্র হচ্ছে একটি আন্তসম্পর্কযুক্ত সামাজিক কাঠামো-ব্যবস্থা যেখানে নারীদেরকে শোষণ করার জন্য পুরুষদেরকে সুযোগ দেয়া হয়।"[12] এপ্রিল এ. গর্ডনের মতে,[12] ওয়ালবির সংজ্ঞায় বিভিন্ন পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থার অধীনে নারীদের ভূমিকা এবং অগ্রাধিকারের ক্রমের বিভিন্নতা ও পরিবর্তনের বিষয়টিও অনুমোদিত হয়। এই সংজ্ঞাটিতে পিতৃতন্ত্রের কবলে থেকে পুরুষের দ্বারা নারীর প্রাতিষ্ঠানিক অধীনস্ততা এবং শোষণকেও স্বীকার করা হয়। পিতৃতন্ত্র অনেক রকমের আকার ধারণ করতে পারে। তাত্ত্বিকভাবে এও সম্ভব যে, পিতৃতন্ত্রের কারণে মাতৃত্বের গুরুত্ব হ্রাস পেল, আর তা এক দিক দিয়ে নারীকে দিন মজুর ও অন্যান্য ভূমিকার দিকে ঠেলে দিয়ে তাদের উপকার করল।
একই রকম ব্যুৎপত্তির শব্দ সামাজিক বিজ্ঞান ও মানবিক বিভাগের আরও বিভিন্ন ক্ষেত্রে সমাজ, সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার বিভিন্ন পিতৃতান্ত্রিক দৃষ্টিকোণকে ব্যাখ্যা করতে ব্যবহার করা হয়। পেট্রিওলজিকাল নামক বিশেষণটি এসেছে পেট্রিওলজি নামক বিশেষ্য থেকে, যা আবার এসেছে দুটো গ্রীক শব্দ πατέρας (প্যাটারাস বা পিতা) এবং λογος (লোগস বা পাঠ) থেকে। অর্থাৎ এই পেট্রিওলজি অর্থ হচ্ছে "পিতৃবিদ্যা"। এই পেট্রিওলজি শব্দটির উৎপত্তি হয়েছিল ধর্মতত্ত্বের পাঠে। সেখানে "গড দ্য ফাদার" বা ঈশ্বরপিতার কার্যসমূহ এবং ব্যক্তি বিষয়ক পাঠের বিশেষ ধর্মতাত্ত্বিক আলোচনাকে এই নামে অভিহিত করা হয়। বর্তমান সময়ে, সামাজিক বিজ্ঞান ও মানবিক বিভাগের বিষয়সমূহে এই শব্দটিকে ধার করে আনা হয়েছে, আর এই শব্দটির অর্থ এখন আরও বিস্তৃত হয়েছে। এখন এই শব্দটিকে সাংস্কৃতিক ও সামাজিক জীবনের বিশেষ পুরুষ-শাসিত ও পুরুষ-কেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গিকে ব্যাখ্যা করতে ব্যবহার করা হয়।
নৃতাত্ত্বিক সাক্ষ্য-প্রমাণগুলো থেকে দেখা যায় প্রাগৈতিহাসিক শিকারি-সংরক্ষণকারী সমাজগুলোতে তুলনামূলকভাবে বেশি লৈঙ্গিক সমতা ছিল, এবং প্লেইস্টোসিন যুগের শেষের অনেক পর কৃষি ও পশুর গৃহায়ণ (domestication) এর মত প্রযুক্তিগত ও সামাজিক উন্নয়নের আগ পর্যন্ত পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা তৈরি হয় নি।[13][14][15] রবার্ট এম. স্ট্রোজিয়ার এর মতে, ঐতিহাসিক গবেষণা থেকে এখনও পর্যন্ত পিতৃতন্ত্রের নির্দিষ্ট সূচনা ঘটনা পাওয়া সম্ভব হয় নি।[16] কোন স্কলার ছয় হাজার বছর পূর্বের (খ্রিষ্টপূর্ব ৪০০০ অব্দ) সময়কে পিতৃতন্ত্রের সূচনা বলে দাবী করেন, যখন পিতৃতন্ত্রের সূচনা হিসেবে পিতার ধারণা তৈরি হয়।[17][18]
মার্ক্সবাদী তত্ত্ব অনুসারে ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস এবং কার্ল মার্কস একে ভিন্নভাবে দেখেছেন। তাদের মতে পিতৃতন্ত্র এসেছে একটি প্রাথমিক শ্রম বিভাগ থেকে যেখানে নারীরা গৃহ এর তত্ত্বাবধানে ছিল এবং কৃষির মাধ্যমে খাদ্য উৎপাদন এর তত্ত্বাবধান করত। পুঁজিবাদের বিকাশের পর উৎপাদন এর জগৎ মুদ্রায়িত (monetized) হয় (মুদ্রার সাহায্যে মূল্য নির্ধারণ করাকে মুদায়ণ বলে), এবং গৃহের জগৎ কখনই মুদ্রায়িত হয় নি এবং তা অবমূল্যায়িত হয়। আর এর দ্বারা নারী ও পুরুষ সম্পর্কিত ধারণা এবং পুরুষ ও নারীর ক্ষমতা পরিবর্তিত হয়ে যায়।[19]
প্রাচীন নিকট প্রাচ্যে খ্রিষ্টপূর্ব ৩১০০ অব্দে নারীর প্রজননমূলক ক্ষমতার উপর নিষেধাজ্ঞা এবং ইতিহাসকে প্রতিনিধিত্ব করা ও তৈরি করার কাজ থেকে নারীকে আলাদা রাখার ব্যাপারটি দেখা গেছে, যা থেকে সেই সময়ে পুরুষ কর্তৃক নারীর কর্তৃত্ব ছিল তা জানা যায়।[16] কোন কোন গবেষকের মতে, হিব্রুদের আবির্ভাবের সাথে সাথে "ঈশ্বর-মানব চুক্তিসমূহ থেকেও নারীকে পৃথক করা হয়"।[16][20] পুরাতত্ত্ববিদ মারিজা গিমবুটাস বলেন, প্রাচীন ইউরোপ এর এজিয়ান অঞ্চলের প্রাথমিক কৃষি সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীকে ইউক্রেনিয়ান স্তেপস থেকে আসা কুরগান (কুরগান-বিল্ডার) আক্রমণকারীদের দল বারবার আক্রমণ করলে বলকান ও দক্ষিণ ইতালিতে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে পুরুষ ক্রমোচ্চ শ্রেণী (male hierarchy) তৈরিক হয়, যার থেকে পাশ্চাত্য সমাজে পিতৃতন্ত্রের উত্থান ঘটে।[21] স্টিভেন টেইলর বলেন, পিতৃতান্ত্রিক কর্তৃত্বের উত্থান সামাজিক স্তরভূক্ত ক্রমোচ্চ শ্রেণীবিভাগজনিত রাষ্ট্রশাসনব্যবস্থা, প্রতিষ্ঠানায়িত হিংস্রতা এবং জলবায়ু-সংক্রান্ত পীড়নের সময়কালের সাথে সম্পর্কিত পৃথকীকৃত ব্যক্তিস্বতন্ত্র-অহং এর সাথে জড়িত।[22]
একজন বিশিষ্ট গ্রীক জেনারেল মেনো, একই নামের প্লেটোনিক সংলাপে, প্রাচীন গ্রীসের নারী ও পুরুষের স্ব-স্ব ধর্ম সম্পর্কিত বিরাজমান ভাবপ্রবণতার সার তুলে ধরেছিলেন। তিনি বলেন:
প্রথমত, আপনি যদি একজন পুরুষের ধর্ম সম্পর্কে বলেন, সহজেই বলা যায় যে এগুলোই পুরুষের ধর্ম - তিনি শহরের বিষয়াদিকে ব্যবস্থাপনের জন্য প্রতিযোগিতায় জড়ান, আর এমনভাবে এগুলোকে তিনি ব্যবস্থাপন করেন যাতে এতে তার বন্ধুদের উপকার হয় এবং শত্রুদের ক্ষতি হয়, আর তিনি নিজে যাতে ক্ষতির সম্মুখীন না হন সেজন্য তিনি সচেতন হন। অন্যদিকে আপনি যদি একজন নারীর ধর্ম সম্পর্কে বলেন - তাহলে খুব সহজেই বলা যায় যে তিনি ভালভাবে গৃহের ব্যবস্থাপনা করেন, গৃহের সম্পত্তির দেখাশোনা করেন, এবং স্বামীকে মান্য করেন।[23]
এরিস্টোটলের রচনাগুলোতে নারীকে নৈতিকভাবে, বুদ্ধিগতভাবে এবং শারীরিকভাবে পুরুষের চেয়ে অধম হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে; সেখানে নারীকে পুরুষের সম্পত্তি হিসেবে বলা হয়েছে; বলা হয়েছে যে সমাজে নারীর ভূমিকা প্রজন এবং গৃহে পুরুষদেরকে সেবা করা; এবং দেখানো হয়েছে যে নারীর উপর পুরুষ কর্তৃত্বকে প্রাকৃতিক ও ধর্ম।[24][25][26]
জেরদা লারনার তার দ্য ক্রিয়েশন অব পেট্রিয়ার্কি বইতেবলেন এরিস্টোটল বিশ্বাস করতেন যে নারীদের রক্ত পুরুষের রক্তের চেয়ে শীতল, যা নারীদেরকে পুরুষে রূপান্তরিত হতে দেয় নি, যেখানে তিনি পুরুষকে নির্ভুল ও উচ্চতর লিঙ্গ বলে মনে করতেন। মেরিয়েন ক্লাইন হরোউইজ বলেন, এরিস্টোটল বিশ্বাস করতেন "আত্মার অবদানে সৃষ্টির আকৃতি ও নকশা তৈরি হয়"। এর অর্থ হচ্ছে এই বিশ্বে যেকোন রকম খুঁতই থাকুক না কেন তা নারীর দ্বারা হয়েছে, কারণ কখনই নিখুঁত থেকে খুঁতকে পাওয়া সম্ভব না (যেখানে নিখুঁত বলতে পুরুষকে বোঝানো হচ্ছে)। এরিস্টোটলের তত্ত্বে একটি ক্রমোচ্চ শ্রেণীবিভাগজনিত শাসনগত গঠনপ্রণালী ছিল। লারনার দাবী করেন যে এরিস্টোটলের এই পিতৃতান্ত্রিক বিশ্বাসব্যবস্থা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বাহিত হয়েছে, এবং পুরুষেরা এই বিশ্বাস ধারণ করতে প্রভাবিত হয়েছে যে তারা নারীদের চাইতে উচ্চতর। এই সংকেতগুলোই বেঞ্চমার্ক হিসেবে কাজ করে যেগুলো দেখে শিশুরা তাদের বৃদ্ধির সময় শিক্ষা গ্রহণ করে থাকে, এবং এভাবেই পিতৃতন্ত্রের চক্র অবিরত চলতে থাকে।[27]
মিশরে এবিষয়ক কোন দার্শনিক নথি নেই, তবে হেরোডোটাস মিশরের নারী এবং এথেন্সের নারীদের ভূমিকা সম্পর্কিত একটি তুলনামূলক আলোচনা করেন। তিনি পর্যবেক্ষণ করেন যে মিশরীয় নারীরা বাজারে উপস্থিত হন এবং বাণিজ্যে নিযুক্ত হন। প্রাচীন মিশরে একজন মধ্যবিত্ত নারী স্থানীয় বিচারকার্যে অংশগ্রহণ করতে পারতেন, স্থাবর সম্পত্তি লেনদেনে যুক্ত হতে পারতেন, এবং উত্তরাধিকারসূত্রে সম্পত্তি গ্রহণ করতে ও সম্পত্তি দান করতে পারতেন। নারীরা একইসাথে ঋণগ্রহণ এবং আইনি নথিসমূহে সাক্ষর দিতে পারতেন।[28]
তবে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের মিশর জয়ের ফলে মিশর গ্রীক প্রভাবে প্রভাবিত হয়, যেখানে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট এরিস্টোটলের কাছ থেকে শিক্ষা নিয়েছিলেন।[29]
মধ্যযুগীয় ইউরোপে যেহেতু সম্রাজ্ঞীগণ (যেমন থিওডোরা) এবং পরিবারের নারী-কর্ত্রীগণ (যেমন কনস্টান্টাইনের মাতা হেলেনা) সুবিধা, রাজনৈতিক ক্ষমতা এবং সামাজিক মর্যাদা ভোগ করতেন তাই বলা যায় সেইসময় পিতৃতন্ত্র পরম ছিল না।[30][অনির্ভরযোগ্য উৎস?] ধর্মীয় অঙ্গনে রোমান ক্যাথলিক এবং অর্থোডক্স চার্চ কেবল পুরুষদের জন্য পৌরহিত্য সীমাবদ্ধ করেন, যদিও চার্চকে মাতৃরূপে দেখা হত।[31]
মার্টিন লুথারের সময় থেকে, প্রোটেস্ট্যান্ট মতবাদ প্রতিনিয়ত এক্সোডাস ২০ঃ১২ এর নির্দেশনাকে সকল ঊর্ধ্বতনের প্রতি কর্তব্যকে ন্যায়সিদ্ধ করার জন্য ব্যবহার করা হত। এক্সোডাসের সেই নির্দেশনায় "নিজের পিতাকে সম্মান করো" কথাটার উল্লেখ ছিল। এখানে "পিতা" শব্দটিকে কেবলমাত্র জন্মদাতা পিতার ক্ষেত্রেই ব্যবহার করা হত না, বরং এই "পিতা" শব্দটি দ্বারা সকল পুরুষ গুরুজন এবং রাজাকে বোঝানো হয়, তেমনটিই দাবী করা হত।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]
যদিও অনেক ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকের তাত্ত্বিক সমাজে নারীর অবস্থান বিষয়ে এরিস্টোটলের চিন্তাধারার সাথেই সম্মত ছিলেন, তবুও কেউই ১৬৮০ সালের পূর্বে পিতৃতান্ত্রিক পরিবারের ভিত্তিতে রাজনৈতিক অধীনতা প্রমাণের চেষ্টা করেন নি। স্যার রবার্ট ফিলমারের সাথে পিতৃতান্ত্রিক রাজনৈতিক তত্ত্ব গভীরভাবে সম্পর্কিত। ১৬৫৩ সালের কিছু পূর্বে, ফিল্মার পেট্রিয়ার্কা নামে একটি গ্রন্থ লেখেন। অবশ্য এই গ্রন্থটি তার মৃত্যুর পূর্বে প্রকাশিত হয় নি। এই গ্রন্থে তিনি রাজার সর্গীয় অধিকারের পক্ষে কথা বলেন যা আদমের কাছ থেকেই বংশপরম্পরায় সেই রাজা লাভ করেন বলে মনে করেন। এখানে আদম হচ্ছে জুডিও-ক্রিশ্চিয়ান মতাদর্শ অনুযায়ী প্রথম মানব।[32] যাই হোক, অষ্টাদশ শতকের শেষার্ধে পিতৃতন্ত্র নিয়ে যাজক সম্প্রদায়ের অনুভূতি সেই সময়ের বুদ্ধিদীপ্ত কর্তৃত্ব দ্বারা বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়। দিদেরো এর এনসাইক্লোপিডিয়াতে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত পিতৃতান্ত্রিক কর্তৃত্বকে অস্বীকার করা হয়। সেখানে বলা হয়, "... যুক্তি আমাদেরকে দেখায় যে পিতার যেরকম অধিকার ও কর্তৃত্ব রয়েছে, ঠিক তেমনি সমান অধিকার ও কর্তৃত্ব মাতারও রয়েছে; যেহেতু পিতা ও মাতা উভয়ই সন্তানের ভূমিষ্ট হবার পেছনে দায়ী, কাজেই সন্তানের উপর অর্পিত অধীনস্ততার উৎপত্তি পিতা ও মাতা উভয়ের থেকেই। এভাবেই ঈশ্বরের ইতিবাচক আইন কোন পিতা ও পাতার মধ্যে কোন ধরনের বৈষম্য সৃষ্টি না করেই সন্তানের জন্য প্রযুক্ত হয়; পিতা ও মাতা উভয়েই সন্তানের প্রতি একই রকমের কর্তৃত্ব ও অধিকার ধারণ করেন..."[33]
উনিশ শতকে, অনেক নারীই সাধারণের দ্বারা স্বীকৃত খ্রিষ্টীয় ধর্মগ্রন্থের পিতৃতান্ত্রিক ব্যাখ্যাসমূহকে প্রশ্নবিদ্ধ করেন। এদের মধ্যে প্রবীনতমদের মধ্যে একজন হচ্ছেন সারাহ গ্রিমকে, যিনি খ্রিষ্টীয় ধর্মগ্রন্থসমূহের লিঙ্গসমূহের ভূমিকার সাথে সম্পর্কিত লেখাগুলোকে একজন পুরুষ কতটা পক্ষপাতিত্বহীন হয়ে অনুবাদ ও ব্যাখ্যা করতে পারেন সেই বিষয়ে সন্দেহবাদিতা ব্যক্ত করেন। তিনি ধর্মগ্রন্থের নারী সম্পর্কিত লেখাগুলোর জন্য বিকল্প অনুবাদ ও ব্যাখ্যার প্রস্তাব করেন, এবং ধর্মগ্রন্থের অনেকগুলো স্তবককে তিনি ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে সমালোচনা করেন। তিনি যুক্তি দেখান যে, উক্ত স্তবকগুলো কেবল একটি নির্দিষ্ট পরিস্থিতির ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য ছিল, সেগুলোকে সার্বজনীন এবং সার্বক্ষণিক আদেশ হিসেবে গণ্য করা যাবে না।[34] এলিজাবেথ কেডি স্ট্যানন তার নারীবাদী চিন্তাধারাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য সারাহ গ্রিমকের বাইবেলগত সূত্রসমূহের সমালোচনাসমূহকে ব্যবহার করেন। তিনি দ্যা উইমেনস বাইবেল নামক একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেন যেখানে ওল্ড টেস্টামেন্ট এবং নিউ টেস্টামেন্ট এর নারীবাদী ভাষ্য উল্লিখিত ছিল। এই প্রবণতাটি নারীবাদী তত্ত্বে বর্ধিত হয় যা পিতৃতান্ত্রিক জুডিও-ক্রিশ্চিয়ান মতাদর্শকে সমালোচনা করে।[35]
পিতৃতন্ত্র কেবল আলাদা আলাদা ব্যক্তির লিঙ্গবাদই নয়, বরং এটি প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ন্ত্রণের সাথেও সম্পর্কিত। যেখানে পুরুষেরা বাড়ির বাইরে গিয়ে বিভিন্ন বিষয়ে যোগ্যতাগত পূর্ণতা লাভ করতে সক্ষম হচ্ছে, সেখানে নারীকে কেন স্টেরিওটাইপগতভাবে একটি গৃহপালিত চরিত্র হিসেবেই চিন্তা করা হচ্ছে - এই বিষয়ে প্রচুর গবেষণা করা হয়। বৈষম্য ও নির্যাতনের পিতৃতান্ত্রিক কাঠামো ঐতিহাসিকভাবে নারীকে রাজনৈতিক অংশগ্রহণের সুবিধা থেকে বঞ্চিত করে পুরুষ সুবিধা প্রতিষ্ঠিত করেছে। নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে যদি নারীর সুযোগকে এর মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গভাবে নির্মূল নাও করা যায়, অন্তত এটাকে এর মাধ্যমে হ্রাস করা হয়েছে, আর এর ফলস্বরূপ নারীর জীবন হয়েছে সীমাবদ্ধ। এই বৈষম্যপূর্ণ অবস্থার তুলনা করা যায় একটি সামাজিক সোপানের সাথে, যার ফলে পুরুষেরা বাড়ির বাইরে বের হবার সুযোগ এবং নারীর উপর কর্তৃত্ব করার সুযোগ লাভ করে। যদিও সকল সমাজেই নেতা এবং নেতৃত্ব থাকা আবশ্যক, তবুও এই সমাজগুলোতে পিতৃতন্ত্রের কারণে নারী সম্পূর্ণভাবে হয়েছে প্ররোচনা, নির্যাতন এবং অধীনস্ততার শিকার। গতানুগতিকভাবে পিতৃতন্ত্র পরিবারের পিতাকে তার স্ত্রী এবং সন্তানদের উপর পূর্ণাঙ্গ অধিকার দান করেছে। আর সেই সাথে দান করেছে এদেরকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করার অধিকার, এবং কোন কোন ক্ষেত্রে হত্যা এবং নিলাম করার অধিকার। কিছু নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে সুবিধা এবং কর্তৃত্বের পিতৃতান্ত্রিক সংযুক্তি এবং নারীকে সামগ্রী হিসেবে মূল্যায়ন "ধর্ষণ সংস্কৃতিতে" পরিণত হতে পারে, যেখানে নারীর উপর ধর্ষণ এবং ততোধিক অত্যাচারকে সামাজিক নিয়ম বা অনুশাসনেরই সাধারণ অংশ হিসেবে স্বীকৃত হয়। যেমন উনিশ ও বিশ শতকে ক্রোয়েশিয়া, কসোভো এবং বসনিয়ায় সার্বগণ সেই অঞ্চলের অধিবাসীদেরকে শাস্তি দিতে, হুমকি দেবার জন্য অধিবাসী নারীদেরকে ধর্ষণ করাকে সমরকৌশল হিসবে ব্যবহার করতেন, এবং এটি তেমন গুরুত্ব সহকারে বিবেচ্য হত না। যখন থেকে সরকার বিভিন্ন নাগরিক স্বাধীনতা এবং দায়িত্বের বিধান জাতি করে, অখন থেকে লৈঙ্গিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকার বিষয়টি সকলের সামনে আসে এবং সরকারের প্রতি এই বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ বৃদ্ধি পায়।[36]
নারীবাদী তত্ত্ব অনুসারে পিতৃতন্ত্র একটি অন্যায্য সামাজিক ব্যবস্থা যা নারী ও পুরুষ উভয়ের উপরেই লৈঙ্গিক ভূমিকা চাপিয়ে দেয়, এবং উভয়ের উপরেই শোষণের কারণ হয়ে থাকে।[37] এতে প্রায়শইই সামাজিক, রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক কার্যপদ্ধতি অন্তর্ভুক্ত হয় যেগুলোতে নারীর উপর পুরুষ আধিপত্য দেখা যায়। নারীবাদী তত্ত্ব অনুযায়ী পিতৃতন্ত্রকে সাধারণত একটি সামাজিক নির্মাণ হিসেবে দেখা হয়, যাকে এর বৈশিষ্ট্য ও প্রকাশের উন্মুক্তকরণ এবং সমালোচনাধর্মী বিশ্লেষণের মাধ্যমেই পরাভূত করা সম্ভব হবে।[38]
সমাজের লৈঙ্গিক বিচ্ছেদ নারী ও পুরুষের কার্যক্রম ও আকাঙ্ক্ষার উপর প্রাতিষ্ঠানিক বাঁধা তৈরি করে। বিবাহ, চাকরিতে লৈঙ্গিক বৈষম্য এবং সামাজিক ও পারিবারিক ক্রম এর মাধ্যমে পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোকে ভালভাবেই টিকিয়ে রাখা হয়। কেউ কেউ বলেন, সম্পূর্ণ পিতৃতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকেই উঠিয়ে দেয়া উচিত, বিশেষ করে পরিবারকে উঠিয়ে দেয়া উচিত, যাকে তারা নারীদের উপর শোষণের প্রাথমিক স্তর হিসেবে দেখেন। পরিবার কেবল পরিবর্তন এবং মান্য করার জন্য নিজের শাখা প্রশাখা বিস্তৃত করে বৃহত্তর সভ্যতার প্রতিনিধি হিসেবেই কাজ করে না, সেই সাথে পিতৃতান্ত্রিক রাষ্ট্রের শাসনের একটি অংশ হিসেবেও পরিবার কাজ করে, যেখানে পরিবারের প্রধানের দ্বারা রাষ্ট্রটির সকল অধিবাসীকে শাসন করা হয়।[39]
অনেক নারীবাদী (বিশেষ করে পণ্ডিত এবং আন্দোলনকারী) পিতৃতন্ত্রের বিনাশের জন্য সাংস্কৃতিক পুনর্গঠনের ডাক দিয়েছেন। সাংস্কৃতিক পুনর্গঠন সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের সাথে সম্পর্কিত। এর সাথে সমাজের সাংস্কৃতিক ধারণার পুনর্গঠনও জড়িত।[40] "পিতৃতন্ত্র" এর বিশ্বজনিন ব্যবহারের পূর্বে নারীবাদীরা মোটামুটি এই অবস্থাটিকে নির্দেশ করতে "পুরুষ উগ্র জাতীয়তাবাদ" ("male chauvinism") এবং "লিঙ্গবাদ" ("sexism") শব্দ দুটিকে ব্যবহার করতেন।[41] লেখিকা বেল হুক বলেন নতুন শব্দ নিজেই এর আদর্শগত ব্যবস্থাকে চিহ্নিত করে (যেখানে পুরুষকে জন্মগতভাবেই নারীর চেয়ে উচ্চতর ধরা হয়) যা নারী ও পুরুষ উভয়ই বিশ্বাস করতে পারেন বা একে প্রয়োগ করতে পারেন, যেখানে পূর্বের শব্দগুলোর দ্বারা কেবল পুরুষকেই নারীর শোষক হিসেবে দেখানো হত। বেশিরভাগ নারীবাদীদের বিশ্বাসকে বোঝার জন্য এই উক্তিটি গুরুত্বপূর্ণ। যারা ভিন্ন বিশ্বাসকে ধারণ করেন বা প্রচার করেন তারা পিতৃতন্ত্রের শোষণের সাথে আরও কিছু যুক্ত করেন বা এর আওতাভুক্ত পরিধিকে আরও বিস্তৃত করেন।[41]
পিতৃতন্ত্রের পক্ষের সমর্থকরা যৌনতার পৃথকীকরণের জন্য সাধারণ গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হরমোন কে সূচিত করেছে।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] হরমোনকে "যৌন দুনিয়ার অন্যতম চাবিকাঠি" ধরা হয় কারণ এটি সমস্ত প্রাণীর মধ্যে বিদ্যমান এবং ভ্রুণ থাকাকালীন সময়ে তা শিশুর যৌনতা নির্ধারণে এবং বয়োঃসন্ধিকালীন সময়ে শিশুর মানসিক বিকাশ এর মত দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে প্রধান ভূমিকা পালন করে।[42] স্বভাব এবং মস্তিষ্কের বিকাশে যে হরমোন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে তার নাম টেস্টোস্টেরন ও ইস্ট্রোজেন হরমোন; যা যথাক্রমে পুরুষ এবং নারী হরমোন না হয় পরিচিত। পুরুষ হরমোন শিশুদের পুরুষালী আচরণ ও নারী হরমোন শিশুদের নারীচিত ও আচরণ সৃষ্টি করে।
সমাজবিজ্ঞানীদের মধ্যে প্রধানত পিতৃতন্ত্রের জন্য জৈবিক কারণ দায়ী এ ব্যাখ্যাটিকে প্রত্যাখান কর্যে দেখা যায়।[43] তারা মনে করেন সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়াই লৈঙ্গিক ভূমিকা নির্ধারণে অন্যতম নিয়ামক।[44] মানসম্পন্ন সমাজবিজ্ঞানের তত্ত্ব মতে পিতৃতন্ত্র হচ্ছে সামাজিক গঠনেরই ফলাফল; যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে স্থানান্তরিত হচ্ছে।[45] এই ধরনের গঠন ব্যবস্থা বুনিয়াদি সংস্কৃতি এবং নিম্ন শ্রেণির অর্থনীতিতে দেখা যায়।[46] এমনকি আধুনিক সমাজ যেখানে লিঙ্গ বার্তা পরিবার থেকে সন্তান পেয়ে থাকে, সেখানেও গণমাধ্যম এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠান গুলো মনে করে পুরুষের দ্বারা পরিবারের নিয়ন্ত্রণ হওয়া উচিত।[44]
জীববিজ্ঞানী রিচার্ড লিওনটিন মনে করেন, পিতৃতন্ত্র যতটা না জৈবিক কারণে নির্ধারিত তার চেয়ে অনেক বেশি সামাজিক এবং রাজনৈতিক কারণে সংগঠিত হয়ে থাকে। ক্রিশ্চিয়ানো হফ সনমারের মত লিঙ্গ নারীবাদ বিরোধীরা মনে করেন পিতৃতন্ত্রের জন্য শুধুমাত্র জৈবিক কারণই দায়ী।[47]টেমপ্লেট:Undue weight inline
মোসাও (চায়নার ইউনুন প্রদেশের ক্ষুদ্র সমাজ) সমাজ মার্তৃতান্ত্রিক সমাজ, যেখানে নারীই সমাজের নিয়ন্ত্রা।[43] আদিবাসীয় সমাজে মার্তৃতান্ত্রিকতা দেখা যায়।[48] কিছু শিকারী দলে নারী-পুরুষে সমানাধিকার দেখা যায়।[15] কিক্কোডলার মত কিছু নৃতাত্ত্বিক মনে করেন পির্তৃতন্ত্র সাংস্কৃতিকভাবে বিশ্বজনীন।[49] বারবার স্মাট মনে করেন, মানুষে পির্তৃতন্ত্র বিবর্তিত হয়েছে পুরুষের প্রজনন গত আকর্ষণ এবং নারীর প্রজনন গত আকর্ষণের কারণে। তিনি ছয়টি কারণকে তালিকাভুক্ত করেছেন:
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.