ডাকওয়ার্থ-লুইস-স্টার্ন পদ্ধতি (ডিএলএস) (ইংরেজি: Duckworth–Lewis–Stern method) ক্রিকেটপ্রেমীদের কাছে অত্যন্ত পরিচিত এবং জনপ্রিয় ক্রিকেটীয় পরিভাষা ও পদ্ধতি। সাধারণতঃ বৃষ্টিবিঘ্নিত কিংবা দিনের আলোকস্বল্পতাজনিত কারণে একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট বা টুয়েন্টি২০ খেলায় ফলাফল আনয়ণকল্পে স্বচ্ছ এবং সঠিক পদ্ধতি হিসেবে রানকে ঘিরে পরবর্তীতে ব্যাটিং করা দলকে পুনরায় জয়ের জন্য লক্ষ্যমাত্রা প্রদান করা হয়। স্বাভাবিকভাবে খেলার পরিসমাপ্তি না হলে বা ফলাফল নির্ধারণে ব্যর্থ হলে এ পদ্ধতি অনুসরণপূর্বক প্রয়োগ করা হয়। ডিএলএস মেথড বা ডার্কওয়ার্থ-লুইস পদ্ধতি ধারণাটির প্রবর্তক হচ্ছেন দুই ইংরেজ পরিসংখ্যানবিদ - ফ্রাঙ্ক ডাকওয়ার্থ এবং টনি লুইস।[1]

Thumb
উইকেট এবং ওভারের সাথে রানের প্রচ্ছন্ন সম্পর্ক

ইতিহাস ও উৎপত্তি রহস্য

১৯৯৭ সালে দুই ব্রিটিশ নাগরিক - পরিসংখ্যানবিদ ফ্রাঙ্ক ডাকওয়ার্থ এবং গণিতজ্ঞ টনি লুইস ডি/এল মেথড বা ডাকওয়ার্থ-লুইস পদ্ধতির প্রধান প্রবক্তা। এটির প্রথম ব্যবহার ঘটে ১৯৯৬-৯৭ মৌসুমে জিম্বাবুয়ে বনাম ইংল্যান্ডের মধ্যকার একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট সিরিজে। ঐ খেলায় জিম্বাবুয়ে ৭ রানে জয়ী (ডি/এল মেথড) হয়।[2] অতঃপর ক্রিকেট খেলার নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা হিসেবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিল (আইসিসি) ১৯৯৯ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে এ পদ্ধতিটি গ্রহণ করে। ডাকওয়ার্থ ও লুইসের অবসর গ্রহণের পর অস্ট্রেলীয় অধ্যাপক স্টিভেন স্টার্ন এ পদ্ধতির আরও সংস্কার করেন। ফলশ্রুতিতে, নভেম্বর, ২০১৪ সাল থেকে এর নবনামকরণ ডাকওয়ার্থ-লুইস-স্টার্ন পদ্ধতি রাখা হয়।[3][4] প্রধান মানদণ্ড হিসেবে বৃষ্টিবিঘ্নতাজনিত কারণে ও একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলায় ফলাফলের লক্ষ্যমাত্রা ধার্য্যকরণের হিসাব-নিকাশে এ পদ্ধতির গুরুত্বকে বিশেষভাবে বিবেচনায় আনে আইসিসি।

স্মরণযোগ্য যে, পূর্বে অনুসৃত ওভারের সেরা রানের পদ্ধতি প্রয়োগের ফলে ১৯৯২ সালের বিশ্বকাপ ক্রিকেটে দক্ষিণ আফ্রিকাকে এক পর্যায়ে ১ বলে ২১ রান করার জন্য লক্ষ্যমাত্রা দেয়া হয়। অথচ, ১ বলের মাধ্যমে সর্বোচ্চ ৬ রান তোলা যায়। বৃষ্টিবিঘ্নিত খেলায় এ বিতর্কের অবসান ঘটেছে ডাকওয়ার্থ-লুইস পদ্ধতি আবিষ্কারের ফলে। নির্দিষ্ট সময়ে খেলা শেষ করার পূর্ব মুহুর্তে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রয়োজন ছিল ১৩ বলে ২২ রানের। কিন্তু সংক্ষিপ্ত বৃষ্টি পর্বের ফলে পুনরায় তাদেরকে ২১ রান করতে বলা হয় মাত্র ১ বলে যা ছিল বিশ্বকাপের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বিতর্কের বিষয়।[5] যদি ডি/এল মেথড প্রয়োগ করা হতো তাহলে ঐ খেলায় দক্ষিণ আফ্রিকাকে চার রান করলে টাই কিংবা পাঁচ রান করলে জয়লাভের জন্য নির্দেশনা দেয়া যেত।[6]

পদ্ধতির ব্যবহার

একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট

১ম ইনিংস বাঁধাগ্রস্ত হলে

  • ২০০৮ সালে ভারত বনাম ইংল্যান্ডের মধ্যকার অনুষ্ঠিত ৪র্থ একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলায় ১ম ইনিংসে বৃষ্টির জন্য দু'দফা খেলা বন্ধ থাকে। ফলে, খেলায় ২২ ওভারে ভারত ব্যাটিং করে ১৬৬/৪ করে। পরে ডি/এল মেথডে ইংল্যান্ডকে জয়ের জন্য লক্ষ্যমাত্রা দেয়া হয় ২২ ওভারে ১৯৮ রান।
  • জানুয়ারী, ২০১১ সালে ভারত বনাম দক্ষিণ আফ্রিকার মধ্যকার ৫ম একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলায় ১ম ইনিংসে বৃষ্টি দু'বার হানা দেয়। ফলে ম্যাচটিকে ৪৬ ওভারে নিয়ে আসা হয় এবং দক্ষিণ আফ্রিকা ক্রিকেট দল ৯ উইকেটের বিনিময়ে ২৫০ রান করে। পরে ডাকওয়ার্থ-লুইস পদ্ধতি অনুসরণ করে ভারতীয় ক্রিকেট দলকে লক্ষ্যমাত্রা দেয়া হয় ২৬৮ রান করার জন্য। ওভার কমানোর ফলে দক্ষিণ আফ্রিকার ইনিংসে এ পদ্ধতি বেশ কাজ দেয়। কেননা, প্রথমে বাধাগ্রস্ত না হলে দক্ষিণ আফ্রিকার স্কোর আরও বেশি হতে পারতো। ফলাফল হিসেবে ভারতীয় অল-রাউন্ডার ইউসুফ পাঠানের ঝড়োগতিতে ৭০ বলে ৮টি চার ও ৮টি ছয়ে গড়া ১০৫ রান করা সত্ত্বেও ভারতীয় দল ২৩৪ রানে অল-আউট হয় এবং উক্ত খেলায় দক্ষিণ আফ্রিকা ৩৩ রানের জয়ের পাশাপাশি ৩-২ ব্যবধানে সিরিজ জয়লাভ করে।

উপরের দু'টো উদাহরণের সাহায্যে দেখানো হয়েছে - কীভাবে ডাকওয়ার্থ-লুইস পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়। ১ম ম্যাচে ইংল্যান্ড ক্রিকেট দল জানতো যে তাদেরকে ২২ ওভার ব্যাটিং করতে হবে। ভারতীয় দল সমানসংখ্যক ওভার খেলা সত্ত্বেও ইংল্যান্ড দলকে বেশি রান করতে হবে। ২য় ইনিংসে ইংল্যান্ড ৮ উইকেটের বিনিময়ে ১৭৮ রান করলেও ভারত ১৯ রানে জয়ী (ডি/এল মেথড) উল্লেখ করা ছিল।[7] কিছু কিছু ক্ষেত্রে এ পদ্ধতি সঠিক পদ্ধতি হিসেবে প্রতীয়মান হয় না।

২য় ইনিংস বাঁধাগ্রস্ত হলে

ডাকওয়ার্থ-লুইস পদ্ধতিতে একটি সাধারণ উদাহরণ হিসেবে ২০০৬ সালে ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যকার ১ম একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলাটি উল্লেখযোগ্য। ভারত প্রথমে ব্যাটিং করতে নেমে ৪৯ ওভারে ৩২৮ রান করে অল-আউট হয়। পরে ২য় ইনিংসে ৪৭তম ওভার পর্যন্ত ব্যাটিং করে পাকিস্তান ৭ উইকেটের বিনিময়ে ৩১১ রান তুলে কিন্তু আলোকস্বল্পতার কারণে খেলা শেষ হয়ে যায়।

এ উদাহরণে দেখা যায় যে, পাকিস্তান ৩২৯ রানের জয়ের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে অগ্রসর হয় এবং ৩ উইকেট, বেশকিছু বল এবং ১৮ রানের দরকার ছিল। গড়পড়তা রানরেট বিবেচনায় আনলে উভয় দলই জয়ের দাবীদার ছিল। কিন্তু ডি/এল মেথডে দেখা যায় যে, ৪৭ ওভার শেষে ৩০৪ রান করলেই জয় পেয়ে যেত। ফলাফল হিসেবে পাকিস্তান ৭ রানে জয়ী (ডি/এল মেথড) উল্লেখ করা হয়।[8]

টুয়েন্টি-২০ ক্রিকেট

  • ২০১০ সালে অনুষ্ঠিত আইসিসি বিশ্বকাপ টি-২০ খেলার গ্রুপ পর্যায়ে শ্রীলঙ্কা এবং জিম্বাবুয়ের খেলায় ডি/এল মেথড পদ্ধতি প্রয়োগ ঘটে। প্রথমে ব্যাটিংয়ে নেমে শ্রীলঙ্কা নির্ধারিত ২০ ওভারে ১৩৭/৭ করে। ১৩৮ রানের জয়ের লক্ষ্য নিয়ে ব্যাট করতে নেমে বৃষ্টিবিঘ্নিত খেলায় জিম্বাবুয়ে ৫ ওভারে ২৯/১ করে। ফলে, ডি/এল মেথডের মাধ্যমে শ্রীলঙ্কা ১৪ রানে জয়ী হয়।[9]
  • একই দিনে অন্য গ্রুপের খেলায় ইংল্যান্ড এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজের খেলার ফলাফলও ডি/এল মেথডের মাধ্যমে নির্ধারিত হয়। ইংল্যান্ড নির্ধারিত ২০ ওভারে ৫ উইকেটের বিনিময়ে ১৯১ রানের বিরাট স্কোর গড়ে। বিশাল রানকে তাড়া করতে নেমে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ২.২ ওভারে বিনা উইকেটে ৩০ রান করা অবস্থায় বৃষ্টিতে খেলা বন্ধ হয়ে যায়। ফলে এ পদ্ধতির মাধ্যমে জয়ের জন্য ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ৬ ওভারে ৬০ রানের লক্ষ্যমাত্রা দেয়া হয়, যা ক্যারিবীয় দলটি এক বল বাকী থাকতেই জয়ের নোঙরে প্রবেশ করে।[10] খেলায় পরাজিত হয়ে হতাশ ইংরেজ অধিনায়ক পল কলিংউড ডাকওয়ার্থ-লুইস পদ্ধতির সঠিক ব্যবহার এবং টি-২০ প্রতিযোগীতায় এর উপযোগিতা ও প্রয়োগ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনাসহ প্রশ্ন তোলেন।[11]

সূত্রের ধারণা

ডাকওয়ার্থ-লুইস পদ্ধতির প্রধান উপাদান হচ্ছে রিসোর্স বা সম্পদ। প্রত্যেক দল দুইভাবে সম্পদ বৃদ্ধি করতে পারে। তন্মধ্যে যতটুকু সম্ভব রান বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে -

  • একটি দলের নির্দিষ্টসংখ্যক ওভারকে যথাযথভাবে কাজে লাগানো এবং
  • দলে কয়টি উইকেট বর্তমান রয়েছে।

ইনিংসের যে-কোন সময় দলের রান করার সক্ষমতা নির্ভর করে এ দু'টি বিষয়ের উপর। পূর্বেকার খেলাগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে যে, ওভার এবং উইকেটের সাথে একনিষ্ঠ সম্পর্কের উপর নির্ভর করে দলের মোট রান সংখ্যা নির্ধারিত হয়। এই একনিষ্ঠ সম্পর্ক বা ঐক্যসূত্রের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে ডাকওয়ার্থ-লুইসের কার্যাবলী।[12]

ব্যবহার নির্দেশিকা ও প্রয়োগ

ডাকওয়ার্থ-লুইস পদ্ধতি খুবই স্বাভাবিকভাবে প্রয়োগ করা হয়। এজন্যে পূর্ব থেকেই প্রস্তুতকৃত একটি টেবিল বা ছক এবং কিছু সাধারণ গাণিতিক হিসাব-নিকাশের প্রয়োজন রয়েছে। স্বল্প বৃষ্টিবিঘ্নিত খেলায় ফলাফল নির্ণয়কল্পেই এ পদ্ধতির সফলতা প্রধান বিবেচ্য বিষয় ও নির্ভরশীল। সেজন্যে -

  • ৫০ ওভারের একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলায় ডাকওয়ার্থ-লুইস পদ্ধতি প্রয়োগ করতে হলে প্রত্যেক দলকে কমপক্ষে ২০ ওভার বলের মুখোমুখি হতে হবে।
  • আধুনিক ক্রিকেটের নব সংযোজন টুয়েন্টি২০ ক্রিকেট খেলায় এ পদ্ধতি অনুসৃত হতে হলে উভয় দলকে কমপক্ষে ৫ ওভার বা ৩০ বল খেলতে হবে।

অধিনায়কের ভূমিকা

একদিনের আন্তর্জাতিক খেলায় বৃষ্টিবিঘ্নিত পরিবেশ সৃষ্টি হলে কিংবা অপর্যাপ্ত আলোকের ফলে খেলায় প্রভাব পড়লে এ পদ্ধতির মাধ্যমে দ্বিতীয় ইনিংসে দলের জয়ের জন্য নতুন লক্ষ্যমাত্রা ধার্য্য করা হয়; বিধায় ফিল্ডিংয়ে দায়িত্বরত অধিনায়ক ডাকওয়ার্থ লুইস পদ্ধতির সূক্ষ্ম হিসাব-নিকাশ নির্ধারণকল্পে এক টুকরো কাগজ সহঃ অধিনায়ক কিংবা অন্য কোন খেলোয়াড়ের কাছে গুঁজে দেন যাতে করে তার ওপর অতিরিক্ত চাপ না পরে।

সর্বশেষ সংস্করণ

প্রকাশিত ছক বা টেবিলের মাধ্যমে ডি/এল মেথড বা ডাকওয়ার্থ-লুইস পদ্ধতির সর্বশেষ সংস্করণ ২০০৪ সালে বের হয়। এটি পরিষ্কারভাবে পূর্বতন নিয়ম-কানুনের তুলনায় একদিবসীয় ক্রিকেটে বেশি রান গড়তে পদ্ধতির উপযোগীতা, গ্রহণযোগ্যতায় রান ও রিসোর্সের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে আলোকপাত করেছে। এ পদ্ধতির সর্বশেষ সংস্করণ বৃষ্টিবিঘ্নিত অন্যান্য ঘরোয়া বা অভ্যন্তরীণ খেলাগুলোতেও প্রয়োগ করা হয়।[13]

ডাকওয়ার্থ-লুইস মেথড: সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে

ক্রিকেট গানের এলবাম নিয়ে ডাকওয়ার্থ-লুইস মেথড ব্যান্ড গান রেকর্ড করে। এ ব্যান্ডের প্রতিষ্ঠা হয় নিল হ্যাননের ব্যান্ড দ্য ডিভাইন কমেডি এবং থমাস ওয়ালশের পাগওয়াস ব্যান্ডের যৌথ প্রয়াসে।[14][15]

তথ্যসূত্র

আরো পড়ুন

বহিঃসংযোগ

Wikiwand in your browser!

Seamless Wikipedia browsing. On steroids.

Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.

Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.