Loading AI tools
চীনা ভাষাসমূহের লিখিত রূপের আলোচনা উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
চীনা লিখন পদ্ধতি (চীনা: 中文; ফিনিন: zhōngwén) বলতে যেসমস্ত চীনা অক্ষর (汉字/漢字; ফিনিন: Hànzì, আক্ষরিক অর্থে "হান অক্ষরসমূহ ") চীনা ভাষা লিখতে বা ছাপাতে ব্যবহার করা হয়, তাদের সমষ্টিকে বোঝায়। চীনা অক্ষরগুলি কোনও বর্ণমালা বা কোনও সংক্ষিপ্ত অক্ষরমালা গঠন করে না, বরং এগুলিকে মোটামুটিভাবে শব্দলিপি জাতীয় কিছু বলা যায়। অর্থাৎ একটি লিখিত চীনা অক্ষর সাধারণত কথ্য চীনা ভাষার একটি ধ্বনিদলের প্রতিনিধিত্ব করে, এবং এই ধ্বনিদলটি নিজেই একটি শব্দ হতে পারে বা বহুধ্বনিদলীয় একটি শব্দের অংশ হতে পারে। চীনা অক্ষরগুলি নিজেরাও আবার প্রায়শই একাধিক অংশ নিয়ে গঠিত, যে অংশগুলি কোন ভৌত বস্তু বা বিমূর্ত ধারণাকে নির্দেশ করতে পারে, [1] বা কোন উচ্চারণ নির্দেশ করতে পারে।[2] চীনা লিখন পদ্ধতিতে সাক্ষরতা অর্জন করতে তাই বিশাল সংখ্যক অক্ষর মুখস্থ ও আত্মস্থ করতে হয়; একজন শিক্ষিত চীনাভাষী ব্যক্তি সাধারণত ৪০০০ অক্ষরের জ্ঞান রাখেন।[3][4] চীনা অক্ষরের সংখ্যার বিশালত্বের কারণে পাশ্চাত্যের বর্ণমালার মাধ্যমে চীনা ভাষাকে লেখার উপায় বের করা হয়েছে।[5] বর্তমানে প্রচলিত বিভিন্ন চীনা অক্ষরগুলি প্রাচীন চীনের শাং রাজবংশের রাজত্বের শেষ পর্যায়ে, আনুমানিক ১২০০ থেকে ১০৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে প্রথম প্রচলিত হয়।[6][7][8] কিন্তু এই অক্ষরগুলির সৃষ্টির প্রক্রিয়া তারও প্রায় কয়েক শতাব্দী আগেই শুরু হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়।[9] এরপর বেশ কিছু শতক ধরে বিবর্তন ও বৈচিত্র্যায়নের পরে শেষ পর্যন্ত প্রাচীন চীনের ছিন রাজবংশের রাজত্বের সময় (২২১ থেকে ২০৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) চীনা অক্ষরগুলিকে প্রমিত রূপ দান করা হয়।[10] এর পরে হাজার হাজার বছর ধরে এই অক্ষরগুলির আরও বিবর্তন ঘটেছে এবং এগুলি চীনা চারুলিপির সুবিকশিত বিভিন্ন শৈলীর অংশে পরিণত হয়েছে।[11] চীনা ভাষার উপভাষা বা ভিন্ন ভিন্ন কথ্য রূপগুলি একে অপরের থেকে দূরে সরে যেতে থাকলে এক ধরনের দ্বিবিধ ভাষারীতির উদ্ভব হয়, যেখানে পরস্পর অবোধগম্য ভিন্ন ভিন্ন কথ্য চীনা উপভাষার বক্তারা একে অপরের সাথে ধ্রুপদী চীনা ভাষার লিখিত রূপ ব্যবহার করে যোগাযোগ স্থাপন করতেন।[12] ২০শ শতকের শুরুর দিকে ধ্রুপদী চীনা ভাষার পরিবর্তে লিখিত চলিত চীনা ভাষা ব্যবহার করা শুরু হয়। এই লিখিত ভাষাটি প্রমিত বা আদর্শ চীনা ভাষার (তথা ম্যান্ডারিন চীনা ভাষার) প্রতিনিধিত্ব করত। যদিও চীনা ভাষার অন্যান্য রূপ বা উপভাষাগুলি এখন আর লেখা হয় না, তার পরেও ক্যান্টনীয় চীনা ভাষা, সাংহাই চীনা ভাষা এবং হোক্কিয়েন চীনা ভাষার ঐতিহ্যবাহী লেখ্য রূপ বিদ্যমান। কিছু চীনা অক্ষর অন্যান্য প্রতিবেশী পূর্ব এশীয় ভাষার লিখন পদ্ধতিতে গ্রহণ করা হয়েছে। বর্তমানে কেবল জাপানি ভাষা ও কোরীয় ভাষাতেই এগুলি ব্যবহৃত হয়। ভিয়েতনামী ভাষাতে চীনা অক্ষরগুলি ত্যাগ করে রোমান বর্ণমালা ব্যবহার করে হচ্ছে।[13][14]
চীনা লিখন পদ্ধতি কোনও বর্ণমালা বা ক্ষুদ্র অক্ষরমালার উপর ভিত্তি করে সৃষ্ট হয়নি।[1] এর পরিবর্তে চীনা অক্ষরগুলি হল একধরনের চিত্রাক্ষর যাদের উপাদানগুলি ভৌত বস্তু বা বিমূর্ত ধারণার প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। কদাচিৎ একটি অক্ষর একটিমাত্র উপাদান দিয়ে গঠিত ও সরল প্রকৃতির হয়; কিন্তু সাধারণত বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দুইটি বা তিনটি উপাদান বিভিন্ন নীতি অনুযায়ী সংযুক্ত হয়ে অপেক্ষাকৃত জটিল আকৃতির অক্ষর তৈরি করে। চীনা অক্ষর গঠন প্রক্রিয়ার সবচেয়ে পরিচিত ব্যাখ্যাটি হল ‘’শুও-ওয়েন চিয়েৎসি’’, যা সু শেন আনুমানিক ১২০ খ্রিস্টাব্দে রচনা করেন। তবে যেহেতু সু শেন চীনা অক্ষরগুলিত আদিতম রূপগুলির ব্যাপারে অবগত ছিলেন না, সেহেতু তাঁর বিশ্লেষণ সবসময় পুরোপুরি নির্ভরযোগ্য নয়। [15] তা সত্ত্বেও এর পরে কোন রচনা বা গ্রন্থই ‘’শুও-ওয়েন চিয়েৎসি’’-র মত এত ব্যাপ্তির সাথে রচিত হয়নি; গ্রন্থটি তাই বর্তমান যুগেও ব্যুৎপত্তিমূলক গবেষণায় প্রসঙ্গোচিত ভূমিকা পালন করছে।[16]
শুও-ওয়েন চিয়েৎসি অনুযায়ী চীনা অক্ষরগুলি ছয়টি মূলনীতির উপর ভিত্তি করে উদ্ভাবিত হয়।[17] এই মূলনীতিগুলি যদিও শুও-ওয়েন চিয়েৎসি-র মাধ্যমে জনসাধারণ্যে প্রচলিত হয়, তবে এগুলি আরও আগেই বিকাশ লাভ করেছিল। এ পর্যন্ত জানা সবচেয়ে প্রাচীন যে রচনায় এগুলির কথা বলা হয়েছে, সেটি হল চৌয়ের কৃত্যসমূহ (আনুমানিক ১৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে রচিত) [18]) প্রথম দুইটি মূলনীতি সরল অক্ষর উৎপাদন করে, যাদেরকে ওয়েন (文 wén) নামে ডাকা হয়:[17]
অবশিষ্ট চারটি মূলনীতি অপেক্ষাকৃত জটিলাকৃতির অক্ষর উৎপন্ন করে, যাদেরকে ঐতিহাসিকভাবে সি৪ (সঠিকভাবে “ৎসি”৪) 字 zì নামে ডাকা হয়। অবশ্য বর্তমানে সি বলতে সরল-জটিল নির্বিশেষে যেকোন অক্ষরকে বোঝাতেই ব্যবহার করা হয়। এই চারটি মূলনীতির দুইটি সরলতর অংশ বা উপাদান থেকে অক্ষর নির্মাণ করে:[17]
বেশির ভাগ লোকই মনে করেন যে চীনা লিখন পদ্ধতি মূলত চিত্রলিপিমূলক বা ভাবলিপিমূলক, যা আসলে সঠিক নয়। প্রকৃতপক্ষে (শুও-ওয়েন চিয়েৎসি-তে উল্লিখিত) প্রায় ৯৫% চীনা অক্ষরই হয় যৌক্তিক অক্ষর-সমবায় বা (অধিকাংশ ক্ষেত্রে) ধ্বনিমূলক অক্ষর-সমবায়।[2] কিছু ধ্বনিমূলক অক্ষর-সমবায় আদিতে সরল চিত্রলিপিমূলক অক্ষর ছিল, এগুলিতে পরবর্তীতে অর্থবহ অক্ষরমূল যোগ করে সমৃদ্ধ করা হয়। যেমন চু৪ 炷 zhù "মোমবাতি" (বা "সলতে") অক্ষরটি আদিতে একটি সরল চিত্রলিপিমূলক অক্ষর 主 ছিল যার বর্তমান উচ্চারণ চু (অর্থ "আমন্ত্রণকারী")। এটির আগে হুও৩ 火 huǒ "আগুন" অক্ষরমূলটি যোগ করা হয় যা নির্দেশ করে যে চু৪ 炷 zhù অক্ষরটির অর্থ আগুন-সম্পর্কিত কোনও কিছু।[19] অবশিষ্ট দুইটি মূলনীতি নতুন কোন অক্ষর উৎপাদন করে না, বরং বিদ্যমান অক্ষরের জন্য নতুন অর্থ প্রদান করে:[17]
চীনা অক্ষরগুলিকে এমনভাবে লেখা হয় যেন প্রতিটি একটি নির্দিষ্ট আকারের বর্গাকৃতির ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ থাকে। এমনকি একাধিক সরল অক্ষরের সমন্বয়ে গঠিত জটিল অক্ষরগুলিকে একই আকারের ক্ষেত্রে লিখতে হয়; এক্ষেত্রে জটিল অক্ষরের উপাদান অক্ষরগুলিকে সংকুচিত করতে হয় যাতে সমগ্র জটিল অক্ষরটি বর্গক্ষেত্রের মধ্যে আঁটতে পারে।[20]
কোনও অক্ষরের উপাদানগুলিকে একেকটি অনেকগুলি “আঁচড়” নিয়ে গঠিত। চীনা অক্ষরের আঁচড়গুলি মূলত আট ধরনের হয়: আনুভূমিক (一), উল্লম্বl (丨), বামদিকে পড়ন্ত (丿), ডানদিকে পড়ন্ত (丶), উঠন্ত (冫যৌগিক আঁচড়ের নিচের অংশটি), বিন্দু (、), আংটা (亅), এবং বক্রাকৃতি (乛, 乚, 乙, ইত্যাদি)।[21]
একটি চীনা অক্ষর লেখার ক্ষেত্রে তুলি বা কলমের আঁচড়ের ক্রমবিন্যাসের আটটি মৌলিক নিয়ম আছে:
উপরের নিয়মগুলি প্রতিটি ক্ষেত্রে কঠোরভাবে অনুসরণ করা হয় না এবং কদাচিৎ এগুলিকে ভঙ্গ করা হয়।[22]
প্রতিটি চীনা অক্ষর মোটামুটি একটি বর্গাকৃতির পরিসীমার ভেতরে লেখা হয়ে থাকে এবং এগুলি সাধারণত একে অপরের সাথে সংযুক্ত থাকে না। সেকারণে এগুলি রচনার দিকের ব্যাপারে কোনও পছন্দ-অপছন্দের ব্যাপার নেই। তবে ঐতিহ্যগতভাবে চীনা পাঠ্যবস্তু উল্লম্ব স্তম্ভাকৃতির বিন্যাসে লেখা হত, যেগুলিকে উপর থেকে নিচে, এরপরে ডান থেকে বামে পড়তে হত। প্রথম অক্ষর স্তম্ভটি পাতার একেবারে ডান দিকে থাকত, এবং শেষ অক্ষরস্তম্ভটি পাতার একেবারে বাম দিকে থাকত। ধ্রুপদী চীনা ভাষায় পাঠ্যবস্তুগুলিতে খুবই কম বিরামচিহ্ন ব্যবহার করা হত। দুই বাক্যের মধ্যকার বিরতি প্রতিবেশ এবং ছন্দ থেকে বের করে নিতে হত।[23] আজও বিশেষ অর্থবহনের জন্য কিংবা লেখার জায়গার আকৃতির কারণে (যেমন উল্লম্ব নামফলকে বা বইয়ের বাঁধাইয়ের পার্শ্বটিতে) উল্লম্ব চীনা লিখনসজ্জা ব্যবহার করা হয় আধুনিক যুগে এসে লিখনসজ্জার পশ্চিমা ধরনটি জনপ্রিয়তা লাভ করেছে, যাতে বাম থেকে ডানে আনুভূমিকভাবে চীনা অক্ষরগুলি লেখা হয়। লাতিন লিপিতে লেখা পাঠ্যবস্তুর মত আনুভূমিক সারিতে সজ্জিত অক্ষরগুলি বাম থেকে ডানে এবং সারিগুলি পাতার উপর থেকে নিচের দিকে পড়া হয়। এই সজ্জাটি বিশেষ করে গণপ্রজাতন্ত্রী চীনে (চীনের মূল ভূখণ্ড) ব্যবহৃত হয়, কেননা সেখানকার সরকার ১৯৫৫ সালে বাম থেকে ডান দিকে লেখা বাধ্যতামূলক করে। [24] প্রজাতন্ত্রী চীনের (তাইওয়ান) সরকার ২০০৪ সালে এসে সরকারী নথিপত্রের জন্য একই নিয়ম প্রবর্তন করে।[25] স্তম্ভাকার বা সারি আকার, উভয়ভাবে সজ্জিত লেখাতেই বিরামচিহ্নের ব্যবহার অনেক বেড়েছে। বিরামচিহ্নগুলি স্পষ্টতই পশ্চিমা লেখাতে ব্যবহৃত বিরামচিহ্নগুলি দ্বারা প্রভাবিত, তবে কিছু কিছু বিরামচিহ্ন চীনা ভাষার (তথা এশীয় ভাষাগুলির) একান্ত নিজস্ব। যেমন দ্বৈত বা একক উদ্ধৃতিচিহ্ন (『 』 ও 「 」); বৃত্তাকার ফুটকি (。), যা পশ্চিমা বাক্যসমাপ্তি নির্দেশক বিন্দুর মত ব্যবহৃত হয়; এবং একটি বিশেষ ধরনের কমা বা ছেদচিহ্ন যার নাম তালিকাবাচক ছেদচিহ্ন (、), যেটি কোনও তালিকার দফা বা প্রস্থগুলিকে পৃথক করে লিখতে ব্যবহৃত হয়, কিন্তু কোনও বাক্যের বাক্যাংশের পৃথকীকরণের ক্ষেত্রে নয়। রাস্তার সংকেতবাহী ফলক বা দোকানপাটের নামফলকে লিখিত চীনা ভাষাগুলি বাম থেকে ডানে (আধুনিক), ডান থেকে বামে (ঐতিহ্যবাহী) এমনকি উপর থেকে নিচের দিকেও লেখা হতে পারে। ফলে পাঠকের জন্য এগুলি পড়া বেশ কঠিন, কেননা একই রাস্তা বা এলাকাতে তিন রকমের সাজানোর নিয়মই ব্যবহৃত হতে দেখা যায়।[26]
চীনা লিখন পদ্ধতিটি আদি যুগ থেকে বর্তমান যুগ পর্যন্ত অবিচ্ছিন্নভাবে ব্যবহার হয়ে আসা সবচেয়ে পুরনো লিখন পদ্ধতিগুলির একটি।[27] এটা সাধারণভাবে গৃহীত যে এপর্যন্ত প্রাপ্ত সবচেয়ে প্রাচীন চীনা লেখার নমুনাটি শাং রাজবংশের রাজা উ তিংয়ের শাসনামলে (১২৫০ থেকে ১১৯২ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) রচিত হয়। এগুলি ছিল কচ্ছপের খোল বা ষাঁড়ের স্কন্ধাস্থির উপর দৈববাণীমূলক খোদাই করা লেখা, যেগুলিকে সহজ ভাষায় দৈববাণী অস্থি নামে ডাকা হয়। অক্ষরগুলিকে প্রশ্নের আকারে অস্থির উপরে খোদাই করা হত। এরপর অস্থিগুলিকে আগুনে উত্তপ্ত করা হত। আগুনের উত্তাপে অস্থিতে যে চিড় ধরত, সেগুলির ব্যাখ্যা করার মাধ্যমে প্রশ্নটির উত্তর বের করা হত। এই আদি চীনা অক্ষরগুলির নাম দেওয়া হয়েছে চিয়া৩কু৩ওয়েন২ 甲骨文 jiǎgǔwén "খোলস-অস্থি লিপি " বা দৈববাণী অস্থিলিপি।[9] ২০০৩ সালে চীনের হনান প্রদেশের চিয়াহু নামক প্রত্নতাত্ত্বিক এলাকাতে কচ্ছপের খোলের উপরে খোদাই করা ১১টি বিচ্ছিন্ন প্রতীকের সন্ধান পাওয়া যায়, যেগুলির কতগুলির সাথে কিছু আধুনিক চীনা অক্ষরের উল্লেখযোগ্য মিল রয়েছে, যেমন মু৪ 目 mù "চোখ"। যেহেতু জিয়াহু এলাকাটি ৬৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে বিদ্যমান ছিল বলে ধারণা করা হয়, সেহেতু এই প্রতীকগুলি বর্তমানে যাচাইকৃত প্রাচীনতম চীনা অক্ষরের নিদর্শনের চেয়ে ৫ হাজার বছরের বেশি পুরনো। কোনও কোনও বিশেষজ্ঞ মনে করেন এগুলি চীনা লিখন পদ্ধতির অগ্রদূত, আবার অন্য বিশেষজ্ঞরা মনে করেন এই দুইয়ের মধ্যে সময়ের দূরত্ব এত বেশি যে এরকম সম্পর্ক ঘোষণা করা সম্ভব নয়।[28]
শাং রাজবংশের শাসনামলের শেষভাগে চীনা লিখন পদ্ধতি বিবর্তিত হয়ে চীনা অনুষ্ঠানকৃত্যমূলক ব্রোঞ্জনির্মিত বস্তুগুলির গায়ে খোদাই করা রূপটি ধারণ করে; এগুলি পশ্চিমা চৌ রাজবংশের শাসনামলে (আনুমানিক ১০৬৬ থেকে ৭৭০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) নির্মিত হয়। এরপরে এটি চীনের ইতিহাসের বসন্ত ও শরৎ পর্বে (৭৭০-৪৭৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) চিন১ওয়েন২ 金文 jīnwén "ধাতব লিপি" নামের এক ধরনের লিখন পদ্ধতিতে বিবর্তিত হয়। চিনওয়েন অক্ষরগুলি দৈববাণী অস্থিলিপিগুলির চেয়ে কম কোণাকৃতির ছিল। পরবর্তীতে চীনের ইতিহাসের যুদ্ধরত রাজ্যসমূহ পর্বে (৪৭৫-২২১ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) লিপিটি আরও বেশি নিয়মানুবর্তী হয়ে ওঠে এবং একটি নির্দিষ্ট রূপে স্থির হয়, যার নাম লিউ৪কুও২ ওয়েন২ৎসি৪ 六國文字/六国文字 liùguó wénzì "ছয় রাজ্যের লিপি "; এই লিপিতে রচিত লেখাগুলিকে সু শেন তার শুও-ওয়েন চিয়েৎসি গ্রন্থে গবেষণার উৎস-উপাদান হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। পরবর্তীতে এই অক্ষরগুলির সৌষ্ঠব ও শৈলীর উন্নতি সাধন করে আরেকটি লিপির উদ্ভব হয়, যার নাম সীলমোহর লিপি। এই লিপিটিই সবচেয়ে পুরাতন লিপি যার অক্ষরগুলি বর্তমান যুগে এসেও ব্যবহৃত হয়। এই অক্ষরগুলি মূলত স্বাক্ষরের সীলমোহরে বা চীনা নথিপত্র ও শিল্পকর্মগুলিতে আসল স্বাক্ষরের স্থলে বিশেষ একধরনের সীলমোহরে ব্যবহৃত হয়। ছিন রাজবংশের সম্রাট লি সি তার শাসনামলে একীভূত চীনা সাম্রাজ্যের সর্বত্র জুড়ে প্রামাণ্য বা আদর্শ লিপি হিসেবে সীলমোহর লিপিটির প্রচলন নিশ্চিত করেছিলেন।[10]
সীলমোহর লিপিটিও পরে বিবর্তিত হয় এবং বিভিন্ন লিখনশৈলীর জন্ম দেয়, যেগুলি আজও বেঁচে আছে। প্রথম যে লিখনশৈলীটির উদ্ভব ঘটে, সেটি হল করণিক লিখনশৈলী।[9][11] ছিন রাজবংশের শাসনামলে দৈনন্দিন ব্যবহারের উপযোগী একটি লিখিত রূপ সৃষ্টি করতে গিয়ে এই লিখনশৈলীটির উদ্ভব ঘটে। সাধারণভাবে করণিক লিপির অক্ষরগুলি দেখতে সীলমোহর লিপির তুলনায় একটু “চ্যাপ্টা” হয়, অন্যদিকে সীলমোহর লিপির অক্ষরগুলি লম্বায় বেশি কিন্তু কম চওড়া হয়ে থাকে। সীলমোহর লিপির সাথে তুলনা করলে করণিক লিপির অক্ষরগুলি চোখে পড়ার মত আয়তাকার। এর পরবর্তী ধাপে চলন্ত লিপি বা অর্ধ-টানা-লেখা লিপিতে অক্ষরগুলি মোটামুটি আলাদা করে লেখা হলেও একেকটি অক্ষরের ভেতরের উপাদানগুলি একটানে জড়িয়ে লেখা শুরু হয়। অর্ধ-টানা-লেখা লিপিটি শেষ পর্যন্ত পূর্ণ টানা লিপিতে বিবর্তিত হয়, যার আরেক নাম তৃণ লিপি; এই লিপিতে অক্ষরগুলিকে তাদের আদি ঐতিহ্যবাহী রূপের সাথে মেলানোই দুষ্কর। তৃণলিপি দেখতে মনে হতে পারে কোন নিয়ম কানুন ছাড়াই এর অক্ষরগুলিকে লেখা হয়েছে। এটা সত্যি যে এই লিপির লেখকদের যথেষ্ট স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তারা অনেক সময় অক্ষরগুলির সংক্ষিপ্ত রূপ ব্যবহার করতেন, যা রীতিতে পরিণত হয়।
সবচেয়ে বেশি স্বীকৃত চীনা লিপিটি হল নিয়মিত লিপি। এই লিপিতে প্রতিটি অক্ষরের প্রতিটি আঁচড় পরিষ্কারভাবে একটির পর একটি টানা হয়। যদিও চলন্ত লিপি ও তৃণ লিপিকে দেখে মনে হয় এগুলি নিয়মিত লিপি থেকে এগুলির উদ্ভব হয়েছে, আসলে নিয়মিত লিপিটিই সবার শেষে বিকাশলাভ করে।
নিয়মিত লিপিটি চীনা লেখ্য ভাষার মূল আদর্শ হিসেবে গণ্য করা হয়। বেশির ভাগ মুদ্রিত চীনা লেখাতে অক্ষরের রূপগুলি এই লিপিটিকে ভিত্তি করেই তৈরি করা হয়েছে। এর পাশাপাশি নিয়মিত লিপিতে আঁচড়ের ক্রমের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা মেনে চলা হয়, এবং এই নির্দেশনা কঠোরভাবে অনুসরণ করে সঠিকভাবে অক্ষরগুলি লিখতে হয়। [29] (অন্যান্য পূর্বতন লিপিগুলিতে আঁচড়ের ক্রম থাকলেও সেগুলি এত কঠোরভাবে মানা হত না)। উদাহরণস্বরূপ 木 mù “মু৪” "কাঠ" অক্ষরটি লেখার সময় প্রথমে বাম থেকে ডানে আনুভূমিক আঁচড়টি টানতে হবে; এরপরে উপর থেকে নিচে উল্লম্ব আঁচড়টি টানতে হবে; পরবর্তীতে বাম দিকের তীর্যক বা কোণাকুনি আঁচড়টি উপর থেকে নিচে টানতে হবে; এবং সবশেষে ডানদিকের তীর্যক আঁচড়টি উপর থেকে নিচে টানতে হবে।[30]
২০শ শতকে এসে চীনা লিখন পদ্ধতি দুইটি আদর্শ রূপে বিভক্ত হয়ে যায়, সরলীকৃত চীনা লিখন পদ্ধতি এবং ঐতিহ্যবাহী চীনা লিখন পদ্ধতি। সরলীকৃত চীনা অক্ষরগুলি মূল চীন ভূখণ্ডে সৃষ্টি করা হয়; এগুলির লক্ষ্য ছিল অক্ষরগুলি লেখার গতি বৃদ্ধি করা (কিছু কিছু অক্ষর লিখতে কয়েক ডজন আঁচড়ের প্রয়োজন হত) এবং এগুলি মুখস্থ করা সহজতর করা। গণপ্রজাতন্ত্রী চীন সরকার দাবি করেন যে উভয় লক্ষ্যই পূরণ হয়েছে, তবে কিছু বহিঃস্থ পর্যবেক্ষক এর সাথে দ্বিমত পোষণ করেন। সরলীকৃত চীনা অক্ষরের ব্যবহার চীনা জনগণের সাক্ষরতা বৃদ্ধিতে কতটুকু ভূমিকা রেখেছে, এ নিয়ে নিয়মমাফিক গবেষণা খুবই কম হয়েছে। মূল চীন ভূখণ্ডে সরলীকৃত অক্ষরগুলির প্রমিতকরণের আগে এগুলিকে নিয়ে যে কয়েকটি গবেষণা সম্পাদিত হয়েছিল, সেগুলি মূলত ছিল পরিসংখ্যানিক ধরনের; এগুলিতে বিভিন্ন পাঠ্য বা লিখিত বিষয়বস্তুর নমুনাতে গড়ে কতগুলি আঁচড় কম প্রয়োজন হয়, তা নিয়ে গবেষণা করা হয়।[31] সরলীকৃত চীনা অক্ষরগুলি সামঞ্জস্যের অভাবের জন্য সমালোচিত হয়েছে। যেমন ঐতিহ্যবাহী চীনা অক্ষর 讓 রাং৪ "অনুমতি দেওয়া"-কে সরল করে 让 লেখা হয়েছে, যেখানে ধ্বনিমূলক উপাদানটি লেখার প্রক্রিয়া ১৭টি আঁচড়ের স্থলে মাত্র ৩টি আঁচড়ে নামিয়ে আনা হয়েছে। একই সাথে বাম দিকের “কথা” অর্থমূলটিকেও সরল করা হয়েছে। কিন্তু অন্যান্য অক্ষর যেমন রাং৩ 壤 rǎng "মাটি" এবং নাং৪ 齉 nàng "নাকিসুরে বলা"-তে ঐ উপাদানটিকে সরল করা হয়নি কেননা এই অক্ষরগুলি তেমন বেশি ব্যবহার করা হয় না।[32] অন্য দিকে, কিছু সরলীকৃত অক্ষর বহুদিন ধরেই হাতের লেখাতে সরল করে লেখা হত, যেমন ওয়ান৪ 万 wàn "দশ হাজার", যার ঐতিহ্যবাহী রূপটি হল 萬.[33]
সরলীকৃত চীনা অক্ষরগুলি মূল চীন ভূখণ্ডে, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়াতে আদর্শ ধরা হয়। ঐতিহ্যবাহী চীনা অক্ষরগুলিকে হংকং, মাকাও, তাইওয়ান ও প্রবাসী চীনা সম্প্রদায়গুলিতে (হংকং ও মালয়েশিয়া ব্যতীত) এখনও সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে।[34]
চীনা লিখন পদ্ধতির ইতিহাসের প্রারম্ভে কথ্য চীনা ভাষা ছিল একক ধ্বনিদলভিত্তিক। অর্থাৎ সে সময় বিভিন্ন ধারণা (বস্তু, কাজ, সম্পর্ক, ইত্যাদি) একটি মাত্র ধ্বনিদল দিয়ে তৈরি শব্দ দিয়ে বলা হত। স্বভাবতই প্রতিটি লিখিত চীনা অক্ষরও একটি মাত্র ধ্বনিদলভিত্তিক একেকটি শব্দকে নির্দেশ করত।[36] কিন্তু সময়ের সাথে কথ্য চীনা ভাষার শব্দগুলি বহুধ্বনিদলভিত্তিক হয়ে পড়ে।[37] তবে যেহেতু আধুনিক বহুধ্বনিদলভিত্তিক শব্দগুলি সাধারণত পুরাতন একক ধ্বনিদলভিত্তিক শব্দ সংযোজন করেই গঠিত হয়, সে কারণে চীনা অক্ষরগুলিকে এখন একক চীনা ধ্বনিদল নির্দেশ করতে ব্যবহার করা হয়।[38] দুই হাজার বছর ধরে চীনা লিখন পদ্ধতির শব্দভাণ্ডার ও বাক্যগঠনপ্রণালীর মান রূপটি ছিল কনফুসিয়াসের আমলে (আনুমানিক ৫০০ খ্রিষ্টাব্দের সময়) কথিত চীনা ভাষাভিত্তিক। এই ভাষাটিকে ধ্রুপদী চীনা ভাষা বা 文言文 ওয়েন২ইয়ান২ওয়েন২” “wényánwén নামে ডাকা হয়। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ধীরে ধীরে ধ্রুপদী চীনা ভাষার সাথে চীনা ভাষার অন্যান্য উপভাষার বেশ কিছু ব্যাকরণিক ও অক্ষর বৈশিষ্ট্য মিশ্রিত হয়ে যায়। এই পরিবর্তনগুলি ছিল খুবই ধীরগতির। কিন্তু ২০শ শতকে এসে ধ্রুপদী চীনা ভাষার সাথে সমসাময়িক যেকোন চীনা উপভাষার পার্থক্য এত বিরাট হয়ে দাঁড়ায় যে এটিকে পৃথকভাবে অধ্যয়ন করতে হত।[39][40] একবার শিখে ফেললে ধ্রুপদী চীনা ভাষা ব্যবহার করে চীনের মানুষেরা একে অপরের সাথে লিখিত যোগাযোগ স্থাপন করতে পারত। এ ব্যাপারটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল, কেননা খ্রিস্টীয় ১ম সহস্রাব্দের শেষ দিকেই চীনা উপভাষাগুলি একে অপরের কাছে অবোধগম্য হয়ে পড়েছিল।[41] একজন ম্যান্ডারিন চীনা উপভাষী বক্তা যাকে “ই” yī বলে, একজন ক্যান্টনীয় চীনা উপভাষী তাকে “ইয়াত” yāt, সাংহাইনীয় উপভাষী সেটিকে “ইছ” iq বলবে, এবং হোক্কীয় ভাষার একে “চিত” chit বলা হবে, কিন্তু চার উপভাষার লোকই এর লিখিত সংস্করণ <টেমপ্লেট:Wiktzh> অক্ষরটিকে চিনতে পারবে, যার অর্থ "এক"।[12] চীনা ভাষা ও উপভাষাগুলি শুধু উচ্চারণেই নয়, শব্দভাণ্ডার ও ব্যাকরণের দিক থেকেও ভিন্ন হয়ে থাকে।[42] ১৯১৯ সালে ৪ঠা মে আন্দোলনের পরোক্ষ পরিণতি হিসেবে যখন আধুনিক চীনা লিখন পদ্ধতি প্রমিত লিখিত ভাষা হিসেবে ধ্রুপদী চীনা ভাষাকে প্রতিস্থাপিত করে, তখন সেটি কারিগরিভাবে নির্দিষ্ট কোন অঞ্চলের চীনা ভাষার সাথে যুক্ত ছিল না। তবে শব্দভাণ্ডার ও ব্যাকরণের দিক থেকে এটি মূলত ম্যান্ডারিন চীনা ভাষাটিকেই সবচেয়ে বেশি প্রতিনিধিত্ব করে। ম্যান্ডারিন চীনা ভাষাটি ভৌগোলিক বিস্তৃতি ও বক্তাসংখ্যা অনুযায়ী চীনের বৃহত্তম উপভাষা-পরিবার এবং অন্যান্য ভাষাগুলি এর ধারে কাছে নেই।[43] এই আধুনিক চীনা লিখন পদ্ধতিকে স্বদেশী চীনা ভাষা বা 白話/白话 “পাই২হুয়া৪”báihuà (আক্ষরিক অর্থ, "সহজ ভাষা ") নামে ডাকা হয়।[44] যদিও স্বদেশী চীনা ভাষাটি আধিপত্য বিস্তারকারী ম্যান্ডারিন চীনা ভাষার সাথে বেশি সম্পর্কিত, তা সত্ত্বেও এটি বিভিন্ন চীনা উপভাষার বক্তাদের মধ্যে লিখিত যোগাযোগের একটি সীমাবদ্ধ মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। বেশির ভাগ অ-ম্যান্ডারিন উপভাষাতেই স্বদেশী চীনা ভাষার অনেক বাক্য বা পদগুচ্ছই ব্যাকরণসম্মত বা অর্থবহ নয়। এ দিক থেকে আধুনিক চীনা লিখন পদ্ধতির সাথে অন্যান্য লিংগুয়া ফ্রাংকার ভূমিকা পালনকারী ভাষা, যেমন লাতিনের তুলনা করা যায়: যারা চীনা লিখন পদ্ধতিতে প্রশিক্ষণ লাভ করে, তাদের জন্য এটি একটি সাধারণ যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। কিন্তু যারা এটিতে প্রশিক্ষিত নয়, অক্ষরগুলির চিত্রলৈখিক প্রকৃতির কারণে পারস্পরিক বোধগম্যতার ক্ষেত্রে কোন সাহায্যই করে না (খুবই সরল অক্ষর যেমন "এক" ব্যতীত)।[45] এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে চীনা অক্ষরগুলিকে একত্রে একটি অতিবৃহৎ কিন্তু অদক্ষ ধ্বনিমূলক লিপি হিসেবে গণ্য করা যায়।[46] তবে গিলাদ জাকারমান প্রমিত চীনা ভাষাতে ধ্বনিগত-আর্থিক মিলকরণ নিয়ে গবেষণা করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে চীনা লিখন পদ্ধতিটি বহুবৃত্তিক (অর্থাৎ এক সাথে একাধিক উদ্দেশ্য পালনে সক্ষম)। এটি একই সাথে আর্থিক ও ধ্বনিগত উপাদান উপস্থাপন করতে পারে।[47] চীনা উপভাষাগুলির মধ্যে শব্দভাণ্ডারের বৈচিত্র্যের কারণে অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবে বিভিন্ন “উচ্চারণনির্দেশক অতিরিক্ত চিহ্ন” ব্যবহার করা হয়; এছাড়া অনেক অনাধুনিক প্রমিত অক্ষরও ব্যবহার করা হয়। [48] ম্যান্ডারিন নয়, এমন আঞ্চলিক ভাষাগুলির মধ্যে একমাত্র ক্যান্টনীয় ভাষাটিরই একটি প্রমিত লিখিত রূপ আছে, যা হংকং এবং বিদেশী চীনা সম্প্রদায়গুলিতে প্রচলিত। এটিতে প্রচুর অক্ষর ব্যবহার করা হয়, যেগুলি সরকারি তালিকাতে নেই কিন্তু এগুলি ক্যান্টনীয় ভাষার অংশ। [49] লিখিত ক্যান্টনীয় ভাষা ইন্টারনেট কথোপকথন কক্ষগুলিতে ও ত্বরিত বার্তা ব্যবস্থাগুলিতে বেশ জনপ্রিয়। তবে প্রাতিষ্ঠানিক লিখিত যোগাযোগের জন্য ক্যান্টনীয় বক্তারাও ম্যান্ডারিন-ঘেঁষা স্বদেশী চীনা ভাষাটি ব্যবহার করেন।[50] একইভাবে, তবে খানিকটা ক্ষুদ্রতর মাত্রায় হোক্কিয়েন ভাষাটিও তাইওয়ানে ও অন্যত্র ব্যবহৃত হয়। তবে ক্যান্টনীয় ভাষার মত এর লিখিত রূপটির তেমন প্রমিতকরণ ঘটেনি। সম্প্রতি তাইওয়ান চীন প্রজাতন্ত্রের শিক্ষা মন্ত্রণালয় হোক্কিয়েন চীনা উপভাষার জন্য একটি প্রমিত বা আদর্শ অক্ষর তালিকা প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা ভবিষ্যতে তাইওয়ানের বিদ্যালয়গুলিতে পড়ানো হবে এবং সাধারণ জনগণের মাঝেও যার ব্যবহারকে উৎসাহিত করা হবে।[51]
চীনা অক্ষরগুলি সম্ভবত খ্রিস্টীয় ১ম সহস্রাব্দের প্রথমার্ধে জাপানি ভাষাতে অনুপ্রবেশ করে। সম্ভবত কোরিয়া হয়ে আগত চীন থেকে আমদানিকৃত পণ্যের মাধ্যমে এই ঘটনাটি ঘটেছিল। [13] ঐ সময়ে জাপানি ভাষাতে কোন স্থানীয় লিখন পদ্ধতি ছিল না। চীনা অক্ষর দিয়েই জাপানি কথ্য ভাষার শব্দগুলিকে প্রকাশ করা হত; এক্ষেত্রে চীনা অক্ষরগুলির অর্থ জাপানি কথ্য শব্দের অর্থের সাথে মিলে গেলেও জাপানি উচ্চারণগুলি সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিল। তবে এর উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রমও ছিল; মানইয়োগানা বলে একটি লিখন ব্যবস্থা ছিল যাতে চীনা অক্ষরের একটি ক্ষুদ্র দলকে উচ্চারণ নির্দেশ করতে ব্যবহার করা হত। এই মানইয়োগানা থেকেই পরবর্তীতে ধ্বনিভিত্তিক অক্ষরমালা হিরাগানা ও কাতাকানার উদ্ভব ঘটে।[52] চীনা অক্ষরগুলিকে ম্যান্ডারিন চীনা ভাষায় হান৪ৎসি৪ hànzì নামে ডাকা হয়। চীনের হান রাজবংশের নামে এই নামকরণ করা হয়েছে। অন্যদিকে জাপানে এই নামটিকে উচ্চারণ করা হয় “কানজি”। আধুনিক জাপানি লিখন ব্যবস্থাতে কানজি অক্ষরগুলি সিংহভাগ বিশেষ্য, ক্রিয়ামূল ও বিশেষণমূল নির্দেশ করতে ব্যবহার করা হয়। এগুলির পাশাপাশি হিরাগানা অক্ষরগুলিকে ব্যাকরণিক উপাদান ও কানজিতে চিত্রিত নয় এমন কিছু শব্দ লিখতে ব্যবহার করা হয়; আর কাতাকানা অক্ষরগুলিকে বিদেশী ভাষা থেকে আগত কৃতঋণ শব্দ, উদ্ভিদ ও প্রাণীসমূহের নাম এবং কিছু বৈজ্ঞানিক বা কারিগরি পারিভাষিক শব্দ লিখতে ব্যবহার করা হয়। জাপানি সরকার সাধারণ জীবনে ব্যবহার্য কানজি অক্ষরগুলির একটি প্রমিত তালিকার প্রবর্তন করেছে যার নাম জোইয়ো কানজি; এই তালিকাতে ২,১৩৬টি অক্ষর রয়েছে; তুলনামূলকভাবে একজন সাক্ষর চীনা এর প্রায় দুইগুণ বেশি (প্রায় ৪০০০) অক্ষরের জ্ঞান রাখেন।[14]
জাপানি ভাষার তুলনায় কোরীয় ও ভিয়েতনামি ভাষাতে চীনা অক্ষরগুলির ভূমিকা অনেক কম। অতীতে একসময় কোরীয় ভাষাতেও জাপানি ভাষার মত অনেক চীনা অক্ষরের প্রবর্তন করা হয়েছিল, যাদের নাম ছিল হানজা।[14] ১৯৭০-এর দশকের পর থেকে সামরিক সরকার ও পরবর্তী সরকারসমূহও জনগণের সাক্ষরতা বৃদ্ধির একটি সমাধান হিসেবে লেখ্য কোরীয় ভাষার প্রায় পুরোটাই শুধুমাত্র হানগুল বর্ণমালা ব্যবহার করে লেখার নীতি গ্রহণ করে। হানগুল বর্ণগুলি একটি বর্গাকৃতির ক্ষেত্রে একে অপরের সাথে সংযুক্ত করে লেখা হয়, এবং এরকম প্রতিটি বর্গক্ষেত্র একেকটি ধ্বনিদল নির্দেশ করে।[53] তবে দক্ষিণ কোরিয়াতে এখনও রাস্তাঘাট ও দোকানপাটের ফলকে শৈলী বা নকশার কাজে, সংবাদপত্রের শিরোনামে স্থান সংকুলানের জন্য, বইপত্রে ও সরকারী নথিপত্রে কোন শব্দের সংক্ষিপ্ত রূপ হিসেবে চীনা অক্ষর ব্যবহার করা হয়।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]
একইভাবে ভিয়েতনামি “চুনম” লিপিতে (chữ nôm) ব্যবহৃত চীনা বা চীনা-শৈলীর অক্ষরগুলি প্রায় পুরোপুরি উঠে গিয়েছে এবং তাদের স্থানে লাতিন বর্ণমালা ভিত্তিক আধুনিক ভিয়েতনামি লিপি ব্যবহৃত হচ্ছে।[54]
এছাড়া হান জাতির মুখের ম্যান্ডারিন চীনা ভাষার পাশাপাশি চীনের অন্যান্য জাতির মুখের চীনা (উপ)ভাষাগুলিতে চীনা অক্ষর ব্যবহার করা হয়। হান জাতির পরে চীনের সবচেয়ে বড় জাতি হল চুয়াং জাতি, তারা ১৩০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে তাদের লেখ্য ভাষাতে চীনা অক্ষর ব্যবহার করে আসছে। ১৯৫৭ সালে চুয়াং ভাষার জন্য একটি পৃথক বর্ণমালার প্রবর্তন করা হয়; তাছাড়া চুয়াং ভাষার নিজস্ব কোন প্রাতিষ্ঠানিক চীনা অক্ষরের প্রমিত সেটও নেই। তা সত্ত্বেও চুয়াং জাতির সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকই চীনা অক্ষরভিত্তিক চুয়াং চিত্রলিপি পড়তে পারেন; নব্য চুয়াং বর্ণমালা বুঝতে পারেন, এমন লোকেরা সংখ্যালঘু।[55]
চীনা লিখন পদ্ধতির ইতিহাসে লিখনকার্যের জন্য বিভিন্ন ধরনের মাধ্যম ব্যবহার করা হয়েছে, যেমন:
হান রাজবংশের শাসনামল থেকে এগুলি দিয়ে ঝুলন্ত পাকানো কাগজ বা হাতে গোটানো কাগজ তৈরি করা হয়।
যেহেতু আধুনিক চীনা শব্দগুলির সিংহভাগই একের অধিক অক্ষর নিয়ে গঠিত, তাই চীনা ভাষার সাক্ষরতার অন্তত দুইটি মাপকাঠি সম্ভব: কোনও ব্যক্তির জানা অক্ষরের সংখ্যা, এবং জানা শব্দের সংখ্যা। চীনা ভাষার ভাষাবিদ জন ডিফ্রান্সিস তার রচিত ‘’অ্যাডভান্সড চাইনিজ রিডার’’ নামক গ্রন্থের ভূমিকায় লেখেন যে একজন চীনা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক সনদধারী ছাত্র গড়ে ৪০০০ থেকে ৫০০০ চীনা অক্ষর এবং ৪০ হাজার থেকে ৬০ হাজার চীনা শব্দ চিনতে সক্ষম।[3] জেরি নরম্যানের তার চাইনিজ গ্রন্থে গড় চীনার জানা অক্ষরের সংখ্যা আরও কমিয়ে ধরেছেন, ৩০০০ থেকে ৪০০০-এর মধ্যে।[4] চীনা অক্ষরগুলির জটপাকানো বিকাশের কারণে এই গণনাগুলি আরও দুষ্কর। অনেক ক্ষেত্রেই একই চীনা অক্ষর বিভিন্ন রূপে লেখা হত। ছিন রাজবংশের সময় সীলমোহর লিপির প্রমিতকরণের মাধ্যমে এই প্রক্রিয়াটিকে বেশ খানিকটা থামানো গেলেও শীঘ্রই আবার শুরু হয়ে যায়। আদিতে শুও-ওয়েন চিয়েৎসি-তে ১০,৫১৬টি অক্ষরের একটি তালিকা ছিল, যাদের মধ্যে ৯,৩৫৩টি ছিল অনন্য (এদের কিছু কিছু তখনই আর ব্যবহৃত হত না) এবং ১,১৬৩টি ছিল চিত্রলৈখিক রূপভেদ। এর মাত্র এক হাজার বছর পরে, ১০৩৯ খ্রিস্টাব্দে উত্তরীয় সুং রাজবংশের শাসনামলে যখন চীনা অক্ষরগুলির ‘’চিইউন’’ নামের আরেকটি তালিকা প্রস্তুত করা হয়, সেই তালিকাটিতে ৫৩,৫২৫ টি অক্ষরকে স্থান দেওয়া হয়। এগুলির সিংহভাগই ছিল একই অক্ষরের চিত্রলৈখিক রূপভেদ।[56]
চীনা লিখন পদ্ধতি কোন বর্ণমালা বা অক্ষরমালার উপর ভিত্তি করে গঠিত নয়, তাই চীনা ভাষার অভিধান, এমনকি চীনা অক্ষর ব্যবহারকারী অন্যান্য অভিধানেও বর্ণানুক্রমে অক্ষরগুলি সাজানো সম্ভব নয়। দক্ষতার সাথে অভিধানের শব্দ খুঁজে বের করার চাহিদা থেকে অক্ষরগুলিকে বিন্যস্ত করার বিভিন্ন পদ্ধতি বের করা হয়েছে।[57] একটি ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতি হল অক্ষরমূল পদ্ধতি। সাধারণত যৌক্তিক অক্ষর-সমবায় কিংবা ধ্বনিগত অক্ষর-সমবায় প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সৃষ্ট জটিল অক্ষরগুলিকে একেকটি অক্ষরমূলের অধীনে খুঁজতে হয়, যদিও এই অনুসন্ধানের উপায়টি পুরোপুরি নিখুঁত নয়। সম্রাট কাংসি-র শাসনামলে অনুমানিক ১৭০০ খ্রিষ্টাব্দে ২১৪টি অক্ষরমূলের একটি অনুমোদিত তালিকা প্রণয়ন করা হয়; এগুলিকে তাই কখনও কখনও কাংসি অক্ষরমূলসমূহ নামে ডাকা হয়। অক্ষরমূলগুলিকে প্রথমে এগুলিকে লেখার জন্য প্রয়োজনীয় আঁচড়ের সংখ্যা অনুযায়ী বিন্যস্ত করা হয়। একই আঁচড়সংখ্যার একাধিক অক্ষরমূলকে অন্য একটি মানদণ্ড অনুযায়ী বিন্যস্ত করা হয়।[58] প্রতিটি চীনা অক্ষরকে (কখনও কখনও যাদৃচ্ছিকভাবে বা ভুল করেও) এই ২১৪টি অক্ষরমূলের যেকোনও একটির অধীনে রাখা হয়।[57] অনেক ক্ষেত্রে অক্ষরমূলগুলি নিজেই একটি অক্ষর হতে পারে; সেক্ষেত্রে সেটি তার নিজস্ব শিরোনামের অধীনের প্রথম ভুক্তি হিসেবে বসে। কোনও প্রদত্ত অক্ষরমূলের অধীনে অবস্থিত অন্য সমস্ত অক্ষরগুলিকে এদের লিখতে প্রয়োজনীয় মোট আঁচড়সংখ্যার ক্রমানুযায়ী বিন্যস্ত করা হয়। সাধারণত এর পরেও একই অক্ষরমূলের অধীনে বহু অক্ষর থাকে যেগুলিকে সমসংখ্যক আঁচড় দিয়ে লেখা হয়। এই পর্যায়ে এসে অক্ষরগুলিকে আর দ্বিতীয় কোন মাপকাঠিতে বিন্যস্ত করা হয় না। অভিধান ব্যবহারকারীকে এরকম সমসংখ্যক আঁচড়বিশিষ্ট সমস্ত অক্ষরগুলিকে একটি একটি করে পড়ে তার উদ্দীষ্ট অক্ষরটিকে খুঁজে নিতে হয়। আঁচড়সংখ্যা অনেক সময় ব্যবহারকারীর সুবিধার জন্য পাতার উপরের প্রান্তে লেখা থাকে।[59] যেহেতু অক্ষরমূল পদ্ধতিটি কেবল লিখিত অক্ষরের উপরেই প্রযুক্ত হয়, তাই কোন অক্ষর খুঁজে বের করার আগে এর উচ্চারণ জানার কোনও প্রয়োজন পড়ে না। একবার ভুক্তিটিকে খুঁজে পাওয়ার পরে সাধারণত পাশেই সেটির উচ্চারণ পাওয়া যায়। তবে কোনও অক্ষরের একাধিক অক্ষর-উপাদানের কোনটি যে এর জন্য নির্দিষ্টকৃত অক্ষরমূল, তা সবসময় সহজ নয়। এ কারণে চীনা অভিধানগুলির শুরুতে প্রায়ই খুঁজে-পেতে-দুষ্কর অক্ষরগুলির একটি তালিকা থাকে; তালিকাতে এগুলি মোট আঁচড়সংখ্যা অনুযায়ী নির্ঘণ্টের মত সাজানো করা থাকে। কোনও কোনও অভিধানে মোট শব্দের প্রায় এক-সপ্তমাংশ এই প্রারম্ভিক তালিকাতে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে।[57]
অক্ষরগুলিকে সাজানোর অন্য পন্থাও আছে, যেগুলিতে প্রায়শই অক্ষরমূল পদ্ধতির দুর্বলতাগুলি দূর করার চেষ্টা করা হয়, কিন্তু এগুলি তেমন প্রচলিত নয়। যেমন কিছু কিছু অভিধানে, যেগুলিতে মূলত কাংসি অক্ষরমূল অনুযায়ী অক্ষরগুলি সাজানো থাকে, সেগুলিতে সাধারণত একটি সহায়ক সূচী বা নির্ঘণ্ট থাকে, যেখানে অক্ষরগুলিকে উচ্চারণ অনুযায়ী সাজানো থাকে; উচ্চারণগুলি সাধারণত হানইউ ফিনিন বা চুইন ফুহাও পদ্ধতিতে লেখা হয়।[60] এই নির্ঘণ্টটিতে উদ্দীষ্ট অক্ষরটিকে অভিধানের যে পৃষ্ঠাতে পাওয়া যাবে, সেই পৃষ্ঠার ক্রমিকসংখ্যা দেওয়া থাকে। অন্য কিছু পন্থাতে কেবল অক্ষরগুলির কাঠামো ব্যবহার করা হয়। এদের মধ্যে চতুষ্কোণ পদ্ধতিটি উল্লেখযোগ্য। এই পদ্ধতিতে অক্ষরের চারটি কোণের কাছাকাছি অবস্থিত আঁচড় অনুযায়ী অক্ষরগুলিকে বিন্যস্ত করা হয়।[61] এরকম আরেকটি পদ্ধতি হল সাংচিয়ে পদ্ধতি, যেখানে প্রতিটি অক্ষরকে ২৪টি মৌলিক উপাদানে ভাগ করে নেওয়া হয়।[62] চতুষ্কোণ পদ্ধতি বা সাংচিয়ে পদ্ধতিতে সঠিক অক্ষরমূল চিহ্নিত করার প্রয়োজন পড়ে না। তবে যেহেতু অনেক আঁচড়ের বিকল্প রূপভেদ আছে, তাই এই রূপভেদগুলি মুখস্থ না করলে এই পদ্ধতিগুলি সফলতার সাথে ব্যবহার করা যায় না। কম্পিটারে ব্যবহারযোগ্য রূপে রূপান্তরিত (অর্থাৎ কম্পিউটারায়িত) চীনা অভিধানগুলি বর্তমানে সুলভ এবং এগুলিতে উপরে বর্ণিত যেকোন সূচী পদ্ধতি ব্যবহার করে স্বল্প সময়ে পছন্দের অক্ষর খুঁজে বের করা সম্ভব।
চীনা অক্ষরগুলি থেকে তাদের সঠিক উচ্চারণ নির্ভরযোগ্যভাবে বের করা সম্ভব নয়, এবং এ ব্যাপারটা চীনা ভাষার সমস্ত উপভাষার জন্য প্রযোজ্য। এজন্য চীনা ভাষার নিরক্ষর বিদেশীদের বোঝার সুবিধার্থে চীনা অক্ষরগুলি লাতিন বর্ণমালার বর্ণগুলি দিয়ে বা পারসিক-আরবি বর্ণমালার বর্ণগুলি (সিয়াও-আরচিং) দিয়ে প্রতিবর্ণীকরণ করার প্রচেষ্টা নেওয়া হয়। তবে প্রতিবর্ণীকরণ কেবলমাত্র বিদেশীদের উচ্চারণ-সহায়িকা হিসেবেই গণ্য করা হয়নি। একসময় এটিকে চীনা অক্ষরগুলির সম্ভাব্য বিকল্প হিসেবেও গণ্য করা হয়েছিল। ৪ঠা মে-র আন্দোলনের সময় এই বিষয়টিকে জোরালোভাবে উত্থাপন করা হয়েছিল এবং ১৯৪৯ সালে চীনে সাম্যবাদীদের বিজয়ের পর এর সমর্থন বৃদ্ধি পায়। এর পরপরই চীনা সরকার দুইটি সমান্তরাল প্রকল্প হাতে নেয়। একটি প্রকল্প ছিল চীনা জনগণের দুই-তৃতীয়াংশের মাতৃভাষা ম্যান্ডারিন চীনা উপভাষার জন্য একটি বর্ণমালা প্রস্তুতকরণ। [42] অন্যটি ছিল ঐতিহ্যবাহী কিন্তু জটিলরূপী চীনা অক্ষরগুলির সরলীকরণ; এর ফলশ্রুতিতেই পরবর্তীতে সরলীকৃত চীনা অক্ষরগুলির উদ্ভব হয়। প্রথমদিকে সরলীকৃত চীনা অক্ষরগুলিকে ঐতিহ্যবাহী অক্ষর ও ধ্বনিভিত্তিক বর্ণমালার মাঝামাঝি একটি যোগসূত্র হিসেবে কল্পনা করা হয়, যাতে পরবর্তীতে চীনা অক্ষরগুলিকে সম্পূর্ণরূপে একটি ধ্বনিমূলক বর্ণমালা দিয়ে প্রতিস্থাপন করা সহজতর হয়।[5] কিন্তু ১৯৫৮ সালে সরলীকৃত চীনা অক্ষরগুলিকে সরকারীভাবে অগ্রাধিকার প্রদান করা হয়। হানইউ ফিনিন নামের ধ্বনিমূলক লিপিটি প্রস্তুত করা হলেও (চীনা অক্ষরগুলিকে প্রতিস্থাপন করে) সর্বক্ষেত্রে এর একক ব্যবহারের ব্যাপারটি অনির্দিষ্টকালের জন্য পিছিয়ে দেওয়া হয়। ফিনিন কেবল ম্যান্ডারিনের উচ্চারণ ভিত্তি করে প্রস্তুত করা হয়েছিল বলে এবং অন্যান্য চীনা উপভাষার জন্য এটি সর্বোতভাবে উপযুক্ত ছিল না বলে হয়ত এর ব্যবহার পিছিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। [63] একই কারণে অদূর ভবিষ্যতেও চীনা ভাষাকে লেখায় উপস্থাপন করার একমাত্র পদ্ধতি হিসেবে ফিনিনের ব্যবহৃত হবার সম্ভাবনা খুব কম। [64]
ফিনিন ব্যবস্থাটি লাতিন বর্ণমালা এবং অল্প কিছু অতিরিক্ত উচ্চারণনির্দেশক চিহ্ন ব্যবহার করে ম্যান্ডারিন চীনা ভাষার প্রমিত উচ্চারণ নির্দেশ করে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ফিনিন ব্যবস্থাতে রোমান্স ভাষা এবং আন্তর্জাতিক ধ্বনিমূলক বর্ণমালাতে যেভাবে লাতিন স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণগুলি ব্যবহৃত হয়েছে, সেভাবেই ব্যবহার করে। কিন্তু এর ব্যতিক্রমও আছে, যা স্বাভাবিক লাতিন বর্ণমালার ব্যবহারকারীদের বুঝতে কষ্ট হতে পারে। যেমন সাধারণভাবে 'b' ও 'p' বর্ণদ্বয় আন্তর্জাতিক ধ্বনিমূলক বর্ণমালাতে ও বেশ কিছু রোমান্স ভাষাতে (যেমন ফরাসি ভাষা) ঘোষ ও অঘোষ ধ্বনি নির্দেশ করলেও (তুলনীয়: বাংলা ঘোষবর্ণ “ব” বনাম অঘোষবর্ণ “প”) ফিনিন ব্যবস্থায় 'b' ও 'p' যথাক্রমে স্বল্পপ্রাণ ও মহাপ্রাণ ধ্বনি নির্দেশ করে (তুলনীয়: বাংলা “প” বনাম “ফ”); এর কারণ ম্যান্ডারিন চীনা ভাষাতে ঘোষ ব্যঞ্জনধ্বনি খুবই কম।[42] একই কারণে ফিনিন 'j' বর্ণটি ইংরেজি j বর্ণের মত বা বাংলা বর্গীয় “জ”-এর মত ঘোষধ্বনি নয়, বরং বাংলা অঘোষধ্বনি “চ” বা ইংরেজি বর্ণসমষ্টি “ch”-এর মত অঘোষধ্বনিকে নির্দেশ করে। অর্থাৎ ফিনিন ব্যবস্থায় লেখা Beijing নামটির সঠিক বাংলা প্রতিবর্ণীকরণ “বেইজিং” নয়, বরং “পেইচিং”।
এছাড়া, বেশ কিছু ব্যঞ্জনধ্বনির জন্য ফিনিন ব্যবস্থায় এমন সব লাতিন বর্ণ ব্যবহার করা হয় যে বর্ণগুলি লাতিন বর্ণমালা ব্যবহারকারী অন্যান্য ভাষাতে সেই ধ্বনিগুলির জন্য ব্যবহৃত হয় না। যেমন ফিনিন 'q' এবং 'x' বর্ণগুলি যে ধ্বনিগুলিকে নির্দেশ করে সেগুলিকে যথাক্রমে ইংরেজি 'ch' (বাংলা “চ”) এবং ইংরেজি 'sh' (বাংলা দন্ত্য “স”)-র মত শোনায়। ফিনিন ম্যান্ডারিন চীনা ভাষার একমাত্র প্রতিবর্ণীকরণ ব্যবস্থা নয়। এর বাইরে চুইন ফুহাও, ওয়েড-জাইলস এবং গুওইউ লুওমাৎসি নামের আরও কিছু ব্যবস্থা আছে। তবে চীনাভাষী বিশ্বে, বিশেষ করে মূল চীন ভূখণ্ডে বর্তমানে ফিনিন-ই আধিপত্য বিস্তারকারী ব্যবস্থা।[65]
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.