Loading AI tools
শশাঙ্কের রাজধানী। উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
কর্ণসুবর্ণ (কানসোনা) ছিল বাংলার প্রথম স্বাধীন শাসক শশাঙ্কের (৬০৬-৬৩৭ খ্রি) রাজধানী। সপ্তম শতকের চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন-সাং-এর ভ্রমণ বৃত্তান্ত 'জিউ জি'-তে 'কিলোনসুফলন' হিসেবে এর উল্লেখ পাওয়া যায়। তার বিবরণ অনুযায়ী, তিনি তান-মো-লি-তি (তাম্রলিপ্তি, আয়তন ১৭০০ 'লি') থেকে কিলোনসুফলন (কর্ণসুবর্ণ, আয়তন ৪৪৫০ 'লি') পৌঁছান।[1]
এই রাজধানীর নিকটেই ছিল লো-টো-মো-চিহ্ (রক্তমৃত্তিকা) মঠটি। ১৯৬০-এর দশকে প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানে প্রাপ্ত রাজবাড়িডাঙ্গার (পশ্চিম বাংলার মুর্শিদাবাদ জেলার সদর সাবডিভিশনের চিরুটি স্টেশনের নিকটবর্তী যদুপুর গ্রাম) মঠের সাথে লো-তো-মি-ছি (রক্তমৃত্তিকা)-র শনাক্তকরণের জোরালো ভিত্তির বলে এখন যথার্থভাবেই বলা যায় যে, খননকৃত প্রত্নস্থলের নিকটে ছিল কর্ণসুবর্ণ। রাক্ষসীডাঙ্গার ধ্বংসস্তূপ খননে আনুমানিক সপ্তম শতকের বৌদ্ধ বিহারের ভিত্তিচিহ্ন পাওয়া গেছে, স্থানীয়ভাবে এটি রাজা কর্ণ-এর প্রাসাদ নামে পরিচিত। তবে নদীপ্রবাহ বা ভাঙ্গনের ফলে অনেক চিহ্ন মুছে গেছে[2]। উৎকীর্ণ লিপিসহ পোড়ামাটির ফলকের (ধর্মচক্র-প্রতীক) আবিষ্কার ও এতে রক্তমৃত্তিকা মহাবিহার নামের উল্লেখ এর শনাক্তকরণের সকল দ্বিধাদ্বন্দ্বকে দূর করে দিয়েছে। লোকমুখে বলা হয়,পৌরাণিক রাজা মহাভারতে বর্ণিত অঙ্গরাজ কর্ণের রাজত্বের রাজধানী ছিলো এই কর্ণসুবর্ণ।
হিউয়েন-সাং আমাদেরকে কর্ণসুবর্ণের একটি স্পষ্ট বর্ণনা দিয়েছেন। এর সাহায্যে আমরা এর অবস্থান ও মানুষ সম্বন্ধে জানতে পারি। তার মতে, দেশটি ছিল বেশ জনবহুল ও এখানকার মানুষ ছিল বেশ ধনী। এলাকাটি ছিল নিচু ও স্যাঁতসেতে। নিয়মিত চাষাবাস হতো, ফুল ও ফলের প্রাচুর্যতা ছিল এবং এখানকার আবহাওয়া ছিল নাতিশীতোষ্ণ। এখানকার জনগণ উন্নত চরিত্রের অধিকারী ছিলেন এবং তারা ছিলেন শিক্ষার পৃষ্ঠপোষক। তার এ বর্ণনায় দেশটির সমৃদ্ধির পরিচয় পাওয়া যায়।
কর্ণসুবর্ণের লিপিতাত্ত্বিক প্রমাণ মেলে কামরূপের শাসক ভাস্করবর্মণ-এর নিধনপুর দানপত্র থেকে। এ দানপত্রটি কর্ণসুবর্ণের বিজয় ছাউনি (জয়-সরদ-অনবর্থ-স্কন্ধবারাত কর্ণসুবর্ণ-বাসকাত) থেকে প্রদান করা হয়েছিল। এতে প্রতীয়মান হয় যে, স্বল্প সময়ের জন্য গৌড়ের রাজা শশাঙ্কের রাজধানী কর্ণসুবর্ণ কামরূপের শাসক ভাস্করবমর্ণ-এর হাতে চলে গিয়েছিল। সপ্তম শতাব্দীর মাঝামাঝিতে কর্ণসুবর্ণ পুনরায় সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য জয়নাগের প্রশাসনিক কেন্দ্রও ছিল। জয়নাগের বপ্য ঘোষবৎ দানপত্র থেকে এ তথ্য পাওয়া যায় [স্বস্তি কর্ণ(স)উবর্ণকাস্থিতস্য মহারাজাধিরাজহ (জ) পরম ভগবত শ্রী-জয়নাগ(দে)বশ্য]।
হিউয়েন সাং-এর লেখা থেকে আমরা কর্ণসুবর্ণের জনগণের ধর্মীয় জীবন সম্পর্কে ধারণা পাই। বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীর মানুষ এখানে বসবাস করত। এখানে বৌদ্ধ ধর্ম যে সমৃদ্ধ অবস্থায় ছিল তার যথেষ্ট প্রমাণ হলো যে, কর্ণসুবর্ণের নিকটই অবস্থিত ছিল বিশাল ও বিখ্যাত মহাবিহারটি। হিউয়েন সাং-এর বিবরণ থেকেই জানা যায় যে, সম্মতীয় স্কুলের বৌদ্ধগণ প্রধানত কর্ণসুবর্ণের দশটি মঠেই বাস করত। বৌদ্ধ মঠ ছাড়াও এখানে পঞ্চাশটি দেব মন্দিরও ছিল। হিউয়েন-সাং-এর মতে কর্ণসুবর্ণের পরিধি ছিল ১০০ মাইল তার ভ্রমণকালে এই স্থান জনাকীর্ণ ছিল।[3]
খননকৃত রাজবাড়িডাঙ্গার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন কর্ণসুবর্ণকে একটি নগর কেন্দ্র হিসেবে ইঙ্গিত করে। তবে বেশ কিছু গ্রামীণ বসতি যেমন পাঁচথুপি গোকর্ণ, মহলন্দি, শক্তিপুর প্রভৃতির অস্তিত্ব রাজধানী শহরের চারপাশে বিদ্যমান ছিল। এরা সম্ভবত নগরবাসীর প্রয়োজনীয় বস্তুর চাহিদা পূরণ করত। সম্ভবত এ অঞ্চলের সাথে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার বাণিজ্যিক যোগাযোগ ছিল। মালয় উপদ্বীপের ওয়েলেসলী অঞ্চল থেকে প্রাপ্ত পঞ্চম শতাব্দীর একটি উৎকীর্ণ লিপিতে রক্তমৃত্তিকা থেকে আগত জনৈক মহানাবিক বুদ্ধগুপ্তের উল্লেখ পাওয়া যায়। অন্য আর একটি তথ্য অনুযায়ী রক্তমৃত্তিকা থেকে মালয় উপদ্বীপে আগত একটি বড় জাহাজের ক্যাপ্টেনের উপস্থিতি বাংলার সাথে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার সামুদ্রিক বাণিজ্যের ইঙ্গিত দেয়। আর চিরুটি অঞ্চলের ভাগীরথী সংলগ্নতা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাড়ায় এ কারণে যে সামুদ্রিক বাণিজ্যে এটি একটি চ্যানেল হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারত।
তাই কর্ণসুবর্ণ একটি সমৃদ্ধশালী রাজনৈতিক-প্রশাসনিক, সামরিক ও ধর্মীয় নগর কেন্দ্র হিসেবে বিখ্যাত ছিল। তবে এর খ্যাতি ছিল ক্ষণস্থায়ী। এটি প্রসিদ্ধি লাভ করে সপ্তম শতাব্দীর প্রথম পর্যায়ে শশাঙ্কের উত্থাণের মাধ্যমে এবং ঐ শতাব্দী শেষেই আবার বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যায়। পাল ও সেনদের কোন দলিলেই এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজধানী শহরের কোন উল্লেখ খুঁজে পাওয়া যায় না।[4]
বারহারওয়া–আজিমগঞ্জ–কাটোয়ার লুপ লাইনে অবস্থিত কর্ণসুবর্ণ রেলওয়ে স্টেশন। কলকাতা ও হাওড়া থেকে উত্তরবঙ্গগামী প্যাসেঞ্জার ও এক্সপ্রেস ট্রেন এই স্টেশনের ওপর যায়।[5] বাসযোগে জেলা সদর শহর ও জেলার অন্যান্য শহরের সাথে কর্ণসুবর্ণ যুক্ত।
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.