Loading AI tools
আরবি গল্প এবং লোককাহিনীর সংগ্রহ উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
আরব্য রজনী (আরবি: كتاب ألف ليلة وليلة কিতাব আলফে লায়লা ওয়া-লায়লা) মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশীয় গল্প এবং লোককথার একটি সংকলন যা ইসলামের স্বর্ণযুগে আরবিতে সংগৃহিত হয়েছিল। এর মূল নাম এক হাজার এবং এক রাত, তবে সহস্র এবং এক আরব্য রজনী বা এরবিয়ান নাইটস নামেও এটি পরিচিত।
পশ্চিম, মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়া এবং উত্তর আফ্রিকা হতে লেখক, অনুবাদক ও গবেষকগণ বহু বছর ধরে আরব্য রজনীর গল্পগুলো সংগ্রহ করেছেন। মূলত প্রাচীন ও মধ্যযুগের আরব, পারস্য, ভারত, মিশর ও মেসপেটমিয়ার লোককাহিনী ও সাহিত্য এ গল্পগুলোর উৎস। এর মাঝে অনেক গল্পই খলিফাদের যুগের। বাকিগুলো পাহলভীয় সাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত যার মাঝে কিছু ভারতীয় উপাদান বিদ্যমান।
আরব্য রজনীর সকল সংস্করণেই সম্রাট শাহরিয়ারকে তার স্ত্রী শেহেরেযাদ কাহিনীগুলো শোনায়। কোন সংস্করণে কয়েকশ’ আবার কিছু সংস্করণে এক হাজার একটি বা তার চেয়ে বেশি কাহিনী সঙ্কলন করা হয়েছে। কাহিনীগুলো গদ্যরীতিতে বর্ণনা করা হয়েছে, তবে কদাচিৎ পদ্যও ব্যবহার করা হয়েছে গানে এবং ধাঁধায় এবং অতিরিক্ত আবেগ প্রকাশে। কতিপয় দীর্ঘ কবিতা থাকলেও বাকিগুলো সবই ছড়া বা চতুষ্পদী শ্লোক।
আরব্য রজনীর মূল আরবী সংস্করণে আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ, আলী বাবা এবং চল্লিশ চোর আর সিন্দাবাদের সমুদ্রযাত্রা গল্পগুলো ছিল না। মধ্যপ্রাচ্যের এসব লোককাহিনী আরব্য রজনীর মাঝে অন্তর্ভুক্ত করেন আঁতোয়ান গ্যালেন্ড ও অন্যান্য ইয়োরোপীয় অনুবাদকগণ।[1]
আরব্য রজনীর মূল কাহিনী কাঠামো গড়ে উঠেছে পারস্যের রাজা এবং তার নববধূকে ঘিরে। তার ভাইয়ের বধূর অবিশ্বস্ততা তাকে ভীষণভাবে নাড়া দেয়। পরবর্তীতে তার নিজের স্ত্রীর প্রতারণায় তিনি পুরোই হতভম্ব হয়ে পড়েন এবং এই অভিজ্ঞতা তাকে নারীবিদ্বেষী করে তোলে। তিনি তার স্ত্রীকে মৃত্যুদণ্ড দেন এবং একের পর এক কুমারী বিয়ে করে তাদের পরের দিন সকালেই মৃত্যুদণ্ড দেয়া শুরু করেন যাতে তারা প্রতারণার সুযোগই না পায়। রাজার উজির ছিলেন কুমারী সন্ধানের দায়িত্বে। রাজ্যে আর কোন কুমারী খুঁজে না পেয়ে অবশেষে উজির নিজের কন্যার সাথে রাজার বিয়ে দেন। বিয়ের রাতে শাহ্রাযাদ রাজাকে একটা গল্প বলা শুরু করে কিন্তু শেষ করে না। রাজা গল্পের শেষ জানতে এতই আগ্রহী থাকে যে মৃত্যুদণ্ড বিলম্বিত করার সিদ্ধান্ত নেয়। শাহ্রাজাদ একটা গল্প শেষ হওয়ার সাথে সাথেই আরেকটা গল্প শুরু করে। পরের গল্পটাও রাতের মাঝে শেষ হয় না। এভাবেই তার মৃত্যুদণ্ড বিলম্বিত হতে থাকে ১০০১ রাত পর্যন্ত।
আরব্য রজনীতে বিভিন্ন ধরনের গল্প সন্নিবেশিত হয়েছে। এতে একই সাথে রয়েছে ইতিহাস দ্বারা অণুপ্রাণিত গল্প, প্রেম কাহিনী, বিয়োগাত্মক কাহিনী, রম্যরচনা, কবিতা এবং প্রহসন। গল্পগুলোকে বিভিন্ন কাল্পনিক চরিত্র ও ঐতিহাসিক চরিত্র দিয়ে সাজানো হয়েছে। আরব্য রজনীর প্রধান চরিত্র আব্বাসীয় খলিফা হারুন আল রসিদ। এছাড়াও এতে তার উজির জাফর আল বারমাকি এবং বিখ্যাত কবি আবু নুয়াসের উল্লেখ রয়েছে যদিও যে সময়কালের প্রেক্ষাপটে কাহিনী সাজানো, এঁদের সময়কাল তারও ২০০ বছর পর। বিভিন্ন গল্পে দেখা যায় কথক অন্য কথকের মাধ্যমে কাহিনী বর্ণনা করেছে। এর বিভিন্ন সংস্করণে কাহিনীর ইতি টানা হয়েছে বিভিন্নভাবে কিন্তু সব সংস্করণেই কাহিনীর শেষে রাজা তার স্ত্রীর মৃত্যুদণ্ডাদেশ বাতিল করেন।
আরব্য রজনীর ইতিহাস বেশ জটিল। আধুনিক গবেষকেরা গল্পগুলো সংগ্রহের ইতিহাস নিয়ে অনেক গবেষণা করেছেন। রবার্ট আরউইন তাদের গবেষণালব্ধ তথ্যগুলোকে সংক্ষেপে লিখেছেন, “ ১৮৮০ এবং ১৮৯০ এর দিকে যটেনবার্গ ও অন্যান্যরা আরব্য রজনীর উপর অনেক কাজ করেন যার ভিত্তিতে একটি সম্মিলিত ধারণার সৃষ্টি হয়। বেশিরভাগ গবেষক এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে আরব্য রজনীর গল্পগুলো অনেকের দ্বারা সংগৃহীত এবং এর পূর্বেকার গল্পগুলো ভারত ও পারস্য থেকে এসেছে। অষ্টম শতকের দিকে এই গল্পগুলো আরবিতে অনুবাদ করে ‘আলিফ লায়লা’ শিরোনামে সংকলিত করা হয়। পরবর্তীতে নবম ও দশম শতকের দিকে ইরাকে মূল গল্পগুলোর সাথে আরবদের গল্প সংযুক্ত হয় যার মাঝে খলিফা হারুনুর রশিদকে নিয়েও কিছু গল্প ছিল। দশম শতকের পরে আরও কিছু আলাদা গল্প এর মাঝে সংযুক্ত হয়। ত্রয়োদশ শতকের পরে সিরিয়া ও মিশরে আরও গল্প যুক্ত হয় যার বেশিরভাগ ছিল যৌনতা ও জাদু সম্পর্কিত।
গবেষকেরা আরব্য রজনীর অনেক গল্পের মূল ধারণার উপাদান সংস্কৃত সাহিত্যে খুঁজে পেয়েছেন। আরব্য রজনীতে ভারতীয় লোকসাহিত্য কিছু জীবজন্তুর গল্পের মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয়েছে যাতে সংস্কৃত উপকথার প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। পঞ্চতন্ত্র ও বেতাল পঞ্চবিংশতি এর মাঝে উল্লেখযোগ্য। জাতক কাহিনিমালা ৫৪৭ টি বৌদ্ধ নীতিকাহিনীর সংকলন । “ষাঁড় ও গাধার গল্প” এবং এর সাথে সম্পর্কিত “এক বণিক ও তাঁর স্ত্রীর গল্প” দু’টোরই উল্লেখ রয়েছে জাতক এবং আরব্য রজনীতে। সম্ভবত পঞ্চতন্ত্রের প্রভাব এসেছে সংস্কৃত তন্ত্রপক্ষ থেকে।[2]
গবেষকেরা আরব্য রজনীর প্রকাশনা সংক্রান্ত ইতিহাস লিপিবদ্ধ করেছেন এভাবে:
هزار ره صفت هفت خوان و رويين دژ فرو شنيدم و خواندم من از
আরব্য রজনী ও এর গল্পগুলোতে নাটকীয়তা, রোমাঞ্চ ও অন্যান্য অনুভূতি সৃষ্টির জন্যে বহু সাহিত্যিক কৌশল ব্যবহৃত হয়েছে। এগুলোর কোনো কোনোটি আরবি, ফার্সী বা ভারতীয় সাহিত্য উদ্ভূত, বাকিগুলো আরব্য রজনীর মৌলিক উদ্ভাবন।
২৫ মার্চ, ১৭০৯ তারিখে প্যারিসের একটা বাড়িতে সন্ধ্যায় এক যুবকের একটা গল্পের চরিত্র ছিল দৈত্য, জিন আর আলাউদ্দিন। সেই গল্প শুনে সঙ্গের খাতায় লিপিবদ্ধ নিলেন প্রাচ্যবিদ আঁতোয়া গ্যাল্যাঁ। তা থেকেই পরে জন্ম নিল ‘আলাউদ্দিনের আশ্চর্য প্রদীপ’ গল্পের লিখিত রূপ।
এর আগেই গ্যাল্যাঁর অনুবাদে প্রাচ্যের বিখ্যাত বই ‘আরব্য রজনী’র কয়েক খণ্ড প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু গ্যাল্যাঁ আর গল্প পাননি কারণ তাঁর সঙ্গে থাকা পুঁথিতে আর গল্প নেই।
সমস্যার সুরাহা হল লুকাচের বাড়িতে, ওই যুবকের গল্প শুনে। যুবকটির নাম হানা দিয়াব। আলেপ্পোর এক বস্ত্র-ব্যবসায়ী পরিবারের ছেলে দিয়াব ১৭০৮ সালে প্যারিসে আসেন, লুকাচের সঙ্গেই। যুবকের গল্প বলার কায়দা চমৎকার। মার্চের সেই সন্ধ্যায় আলাদিনের গল্প ছাড়াও আরও কয়েকটা গল্প দিয়াবের মুখে শোনেন গ্যাল্যাঁ আর লুকাচ। একটা গল্প এক গরিব কাঠুরিয়া, তাঁর ধনী ভাই, এক দল চোর আর এক দাসীকে নিয়ে। ‘আরব্য রজনী’ বইয়ে গল্পটা ‘আলিবাবা ও চল্লিশ চোর’ নামে বিখ্যাত। গ্যাল্যাঁ সে দিন এই গল্পটারও নোট নিয়েছিলেন। কিন্তু আসল সত্য এই, আলাদিন বা আলিবাবা ও চল্লিশ চোর— এই দু’টি জনপ্রিয় গল্পের উল্লেখ কোনও আরবি পুঁথিতে নেই। কারণ গল্পগুলো দিয়াবের গল্প । গবেষকদের ভাষায়, ‘অরফ্যান টেলস’।
এ ভাবেই দিয়াবের মুখে শোনা গল্পের ভিত্তিতে ইউরোপীয় ভাষায় ‘আরব্য রজনী’র প্রথম সার্থক অনুবাদক হলেন আঁতোয়া গ্যাল্যাঁ। ১৭০৪-১৭১৭ সালের মধ্যে মোট বারো খণ্ডে অনুবাদের কাজটি সম্পূর্ণ করেন তিনি। গ্যাল্যাঁর সঙ্গে মোট বারো বার আড্ডায় দিয়াব ষোলোটি গল্প বলেন। তার মধ্যে দশটি গল্পকে গ্যাল্যাঁ স্থান দিলেন তাঁর অনূদিত ‘আরব্য রজনী’র দশম থেকে দ্বাদশ খণ্ডে। তাঁর অনুবাদে ‘আরব্য রজনী’র জলহাওয়ায় কোথাও কোথাও উঁকি দেয় তখনকার ফ্রান্সও। দিয়াবের কাছে শোনা ‘রাজকুমার আহমেদ ও পেরি-বানু’র গল্পে যে বিলাসবহুল প্রাসাদ আর বিপুল ঐশ্বর্যের বর্ণনা, তা মনে করায় ফরাসি শাসক লুই দ্য গ্রেট-এর আমলের বিখ্যাত ভার্সাই প্রাসাদকে। [3]
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.