Loading AI tools
উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
অপারেসন মেঘদূত ভারতীয় সেনাবাহিনী দ্বারা সিয়াচেন হিমবাহ অধিকারের সামরিক অভিযানের গোপন নাম। এই অভিযান ১৯৮৪ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ই এপ্রিল সিয়াচেন হিমবাহ ও তার সংলগ্ন এলাকায় পৃথিবীর সর্বোচ্চ যুদ্ধক্ষেত্রে এই অভিযান সংগথিত হয়। এই অভিযানের ফলে সিয়াচেন হিমবাহ ও সালতোরো পর্বতশ্রেণী এলাকা ভারতের অধিকারে আসে ও সিয়াচেন দ্বন্দ্ব্ব নামক দীর্ঘমেয়াদি সামরিক দ্বন্দ্ব্বের সূত্রপাত হয়।
১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দে ভারত, পাকিস্তান ও সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ সামরিক পর্যবেক্ষক দল যুদ্ধবিরতি রেখা চুক্তিতে সই করে। ১৯৫৬ থেকে ১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দে ভারতীয় ভূবৈজ্ঞানিক সর্বেক্ষণ সিয়াচেন হিমবাহ সম্পর্কিত তথ্য প্রকাশ করে।[5] ১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দে পাকিস্তান এরিক শিপটনের নেতৃত্বে বাইলাফন্ড গিরিবর্ত্ম হয়ে সিয়াচেন হিমবাহ অভিযানে সম্মতি প্রদান করে।[6] পাঁচ বছর পরে একটি জাপানী-পাকিস্তানি মিশ্র অভিযাত্রী দল সালতোরো কাংরি শৃঙ্গ অভিযান করেন।[7] ১৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দে পাকিস্তান চীনকে শাক্সগাম উপত্যকা প্রদান করার পর পাকিস্তান কে২ পর্বতশৃঙ্গে পশ্চিমী অভিযানে সম্মতি প্রদান করে। [5]
১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ, পাকিস্তান ও অন্যন্যরা যুদ্ধবিরতি রেখা চুক্তি অনুযায়ী মানচিত্র প্রদর্শন করে। [5] কিন্তু ১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দে দ্য ইউনাইটেড স্টেটস ডিফেন্স ম্যাপিং এজেন্সী কোন রকম তথ্যসূত্র ছাড়াই তাদের কৌশলগত অগ্রণী মানচিত্রে এনজে ৯৮৪২ থেকে কারাকোরাম গিরিবর্ত্মের (৫,৫৩৪ মিটার) পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলকে চীনের অংশ হিসেবে বর্ণনা করা হয়। [8]
সিয়াচেন হিমবাহ অঞ্চলের সীমান্ত সম্বন্ধে সিমলা চুক্তিতে অস্পষ্ট ভাবে উল্লেখ করা হয় যে সীমান্ত এনজে ৯৮৪২ থেকে উত্তরদিকে হিমবাহের দিকে এটি বিস্তৃত থাকবে। এনজে ৯৮৪২ এর স্থানাঙ্কের পার্শ্ববর্তী এলাকায় অসম্পূর্ণ ভাবে সংজ্ঞায়িত মানচিত্রের ওপর মালিকানার দাবীর কারণে এই দ্বন্দ্ব্ব শুরু হয়।[9]
১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে স্বাক্ষরিত সিমলা চুক্তির সীমান্ত সংক্রান্ত অস্পষ্টতা এবং দ্য ইউনাইটেড স্টেটস ডিফেন্স ম্যাপিং এজেন্সীর মানচিত্রে সিয়াচেন অঞ্চল পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত বলে দেখানোয় ১৯৭০ এর দশক থেকে ১৯৮০ এর দশক পর্যন্ত এই অঞ্চলের উঁচু শৃঙ্গগুলিতে অভিযানের জন্য পর্বতারোহী অভিযাত্রী দল পাকিস্তান সরকারের কাছে অনুমতি চাইতে থাকে এবং পাকিস্তান তাদের অনুমতিপত্রও প্রদান করে। ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দে জাপানী পর্বতারোহী কাতায়ামা বাইলাফন্ড গিরিবর্ত্ম হয়ে টেরাম কাংরি-১ (৭,৪৬৫ মি অথবা ২৪,৪৯১ ফু) ও টেরাম কাংরি-২ (৭,৪০৬ মি অথবা ২৪,২৯৮ ফু) পর্বতশৃঙ্গদ্বয় জয়ের অভিযানে পাকিস্তানের থেকে অনুমতি লাভ করে। [10] ১৯৭৮ খ্রিষ্টাব্দে জারোস্লাভ পন্সারের নেতৃত্বে এক জার্মান অভিযাত্রী দল বাইলাফন্ড গিরিবর্ত্ম হয়ে সিয়াচেন হিমবাহে প্রবেশ করে এবং সিয়াচেন হিমবাহ ও টেরাম শেরের সংযোগস্থলে অভিযানের মূল ঘাঁটি তৈরী করে। এই সব ঘটনা পাকিস্তানকে এই সকল অঞ্চলের দাবী জানাতে উৎসাহ দেয়। [11]
ভারত সরকার ও সেনাবাহিনী সব কিছু লক্ষ করে মানচিত্রটির ব্যাপারে প্রতিবাদ করে। মার্কিন মানচিত্র ও পাকিস্তানের অনুমতিপত্রের গুরুত্ব অনুভব করে ১৯৭৮ খ্রিষ্টাব্দে ভারতীয় সেনাবাহিনীর হাই অল্টিচিউড ওয়ারফেয়ার স্কুলের কমান্ডিং অফিসার কর্ণেল নরেন্দ্র কুমার সিয়াচেন অঞ্চলে টেরাম কাংরি-২ পর্বতশৃঙ্গে সেনা পর্বতারোহণ অভিযান করেন। [12]
১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দে রাউলপিন্ডির সামরিক ঘাঁটিতে ভারতীয় সেনাবাহিনীর পর্বতারোহণ অভিযানগুলিকে বিশ্লেষণ করে পাকিস্তানের জেনারেলরা মনে করেন যে এই অভিযানগুলির মাধ্যমে ভারত সিয়াচেন হিমবাহ ও তার সংলগ্ন সামরিক ভাবে গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলিকে অধিকার করে নেবে এবং এই কারণে ভারতের পূর্বে সিয়াচেন হিমবাহ দখল করার সিদ্ধান্ত নেন। [13] কিন্তু ভারত পাকিস্তানের সামরিক অভিযানের নিশ্চিত আগাম খবর পেলে পাকিস্তানকে ঐ সমস্ত সামরিক ভাবে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল অধিকার করার থেকে আটকাতে পাকিস্তানের পূর্বে সিয়াচেন অঞ্চলে সামরিক অভিযানের খসড়া প্রস্তুত করে। [14]
ভারতীয় গুপ্তচর বিভাগ থেকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ১৩ই এপ্রিল, ১৯৮৪ খ্রিষ্টাব্দে সিয়াচেন হিমবাহ অধিকার করবে বলে খবর এলে ভারতীয় সেনাবাহিনী ১৩ই এপ্রিল, ১৯৮৪ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে সিয়াচেন হিমবাহ অধিকার করবে বলে অভিযানের প্রস্তুতি নেয়। এই অভিযানের নাম দেওয়া হয় অপারেশন মেঘদূত এবং এর নেতৃত্ব দেওয়া হয় লেফটানেন্ট জেনারেল প্রেম নাথ হুনের ওপর। ভারতীয় বিমানবাহিনী আন্তোনভ এএন-১২, আন্তোনভ এএন-৩২ ও ইল্যুশিন আইএল-৭৬ বিমানের মাধ্যমে হিমবাহের নিকটবর্তী বিমানবন্দরগুলিতে সৈন্য ও সরঞ্জাম সরবরাহ শুরু করে। সেখান থেকে সৈন্যদের এম আই-৮ ও এম আই-১৭ হেলিকপ্টারের মাধ্যমে হিমবাহ সংলগ্ন শৃঙ্গগুলির পূর্বদিকে অবতরণ করানো হয়।
ভারতীয় সেনাবাহিনী কুমায়ুন রেজিমেন্টের একটি ব্যাটেলিয়ন ও লাদাখ স্কাউটসকে সিয়াচেন হিমবাহ অঞ্চলে পাঠায়। ১৯৮২ খ্রিষ্টাব্দে সংগঠিত দ্বিতীয় ভারতীয় অ্যান্টার্কটিকা অভিযানে অংশগ্রহণ করায় এই সৈন্যরা হিমবাহের প্রতিকূল পরিবেশে সহজেই মানিয়ে নিতে পারে। লেফটানেন্ট কর্ণেল ডি কে খান্নার নেতৃত্বে এই দুই বাহিনী বরফে ঢাকা জোজি গিরিবর্ত্মের মধ্যে দিয়ে হিমবাহের দিকে যাত্রা করে। [15]
মেজর আর এস সাঁধুর নেতৃত্বে বাহিনীর একটি বিভাগ প্রথমেই হিমবাহের উঁচু স্থানগুলি দখল করে। এর পরে ক্যাপ্টেন সঞ্জয় কুলকার্ণির নেতৃত্বে অপর একটি দল বাইলাফন্ড গিরিবর্ত্ম অধিকার করে। বাহিনীর বাকি অগ্রগানী অংশ ক্যাপ্টেন পি ভি যাদবের নেতৃত্বে সালতোরো পর্বতশ্রেণীর উঁচু শীর্ষদেশে চারদিন ধরে আরোহণ করে। [15] ১৩ই এপ্রিলের মধ্যে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ৩০০ সৈন্য বাইলাফন্ড, সিয়া ও গ্যোং নামক সিয়াচেন হিমবাহের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ গিরিবর্ত্ম ও সালতোরো পর্বতশ্রেণীর সমস্ত শীর্ষদেশ দখল করে নেয়। [13] ১৭ই এপ্রিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ঐ অঞ্চলে প্রবেশ করে শুধুমাত্র সালতোরো পর্বতশ্রেণীর পশ্চিম ঢাল ও সালতোরো উপত্যকা দখল করতে পারে।[13]
১৯৮৪ খ্রিষ্টাব্দের পরে পাকিস্তান ভারতকে ঐ অঞ্চল থেকে হঠিয়ে দেওয়ার জন্য বহুবার ব্যর্থ অভিযান করে। এর মধ্যে ১৯৮৭ খ্রিষ্টাব্দের আক্রমণ ছিল সব চেয়ে উল্লেখযোগ্য। এই আক্রমণের নেতৃত্ব দেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল পারভেজ মুশাররফ। তিনি স্পেশাল সার্ভিসেস গ্রুপের একটি সদ্য তৈরী কমান্ডো দলের ৮০০০ সৈন্যের এক বিশেষ গ্যারিসনকে বাইলাফন্ড গিরিবর্ত্ম দখলের জন্য পাঠান। কিন্তু তীব্র যুদ্ধের পর পাকিস্তানি সেনা পিছু হটতে বাধ্য হয়। সেই বছর পাকিস্তান কায়েদ নামক তাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি হাতছাড়া করে। অপারেশন রাজীব নামক এই যুদ্ধে ভারতের সর্বোচ্চ সাহসিকতার পুরস্কার পরমবীর চক্র লাভ করেন নায়েব সুবেদার বানা সিং। তিনি দিনের বেলায় ১,৫০০ ফু (৪৬০ মি) খাড়া বরফের দেওয়ালে চড়ে ২২,১৪৩ ফুট (৬,৭৪৯ মি) উঁচুতে অবস্থিত কায়েদ নামে একটি পাকিস্তানি ঘাঁটি দখল করেন। [16][17][18][19] তার অতুলনীয় শৌর্যের প্রতি সম্মান দেখিয়ে শৃঙ্গটির নামকরন করা হয় বানা টপ৷
এই অভিযানে ভারতের দখলে ৯০০ বর্গমাইল (২,৩০০ কিমি২) [20] থেকে ১,০০০ বর্গমাইল (২,৬০০ কিমি২) এলাকা চলে আসে। [21] ফলে ভারত ৭০ কিলোমিটার (৪৩ মা) দীর্ঘ সিয়াচেন হিমবাহ ও তার সমস্ত প্রশাখা হিমবাহ এবং সিয়াচেন হিমবাহের পশ্চিমদিকে অবস্থিত সালতোরো পর্বতশ্রেণীর সিয়া, বাইলাফন্ড, ও গ্যোং এই তিনটি প্রধান গিরিবর্ত্ম নিজেদের দখলে আনে। অপরদিকে পাকিস্তান সালতোরো পর্বতশ্রেণীর পশ্চিমদিকে অবস্থিত হিমবাহ উপত্যকাগুলিকে অধিকার করে। [1][22][23][24][25][26] পাকিস্তান গ্যোং গিরিবর্ত্ম থেকে পাঁচ কিলোমিটার দক্ষিণ পশ্চিমে অবস্থিত হিমবাহ উপত্যকা দখলে রাখে। কিন্তু সালতোরো পর্বতশ্রেণী আরোহণ করে তারা যেমন ভারতের দখলীকৃত এলাকায় আসতে পারেননি, ভারতও তাদের কৌশলগত সুবিধাজনক উচ্চ অবস্থান ছেড়ে যেতে পারেনি। এই দুই সেনাবাহিনীর সামরিক অবস্থানের মধ্যের সীমানারেখাকে প্রকৃত ভূমি অবস্থান রেখা বলা হয়।[27][28]
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.