টাই টেস্ট (ইংরেজি: Tied Test) ক্রিকেট খেলার ফলাফলবিশেষ। টেস্ট ক্রিকেটের দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাটিংকারী দল রান সমান রাখা অবস্থায় অল-আউট হলে এ ফলাফল নির্ধারিত হয়। এ ধরনের ফলাফল অত্যন্ত দুষ্কর ও দূর্লভ ঘটনারূপে বিবেচ্য। ১৮৭৭ সাল থেকে শুরু হবার পর দুই সহস্রাধিক টেস্টের মধ্যে মাত্র দুইটি খেলা টাই হয়েছে।
প্রথমটি ১৯৬০ সালে অস্ট্রেলিয়া-ওয়েস্ট ইন্ডিজের মধ্যে হয়।[1] দ্বিতীয়টি ১৯৮৬ সালে ভারত-অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে হয়। উভয়ক্ষেত্রেই খেলা শেষ হবার পর উভয় দলের মোট রান সংখ্যা সমান হয়েছিল। শেষে ব্যাটিংকারী দল তাদের চূড়ান্ত ইনিংসটিতে ১০ জন ব্যাটসম্যানকে হারায় ও বিপরীত দৃষ্টিতে বোলিংকারী দল ১০ উইকেট তুলে নেয়। অন্য কথায় ইনিংস ঘোষণা কিংবা ১০ উইকেট পতনের মাধ্যমে চারটি পূর্ণাঙ্গ ইনিংস সম্পন্ন হবার পর উভয় দলের রান সংখ্যা একই ছিল।
ক্রিকেটে ড্র থেকে টাইয়ের পার্থক্য রয়েছে। এ পর্যায়ে কোন দলই জয় পায়নি। ব্যতিক্রম হিসেবে রয়েছে আনুষ্ঠানিকভাবে পরিত্যক্ত ঘোষণা।
উভয় টাই টেস্টেই অস্ট্রেলিয়া দলের অংশগ্রহণ ছিল। উভয় খেলাই খেলার শেষদিনের শেষ ওভার পর্যন্ত খেলা হয়। এর অর্থ দাঁড়ায় যে, সকল চারটি সম্ভাব্য টেস্ট খেলার ফলাফল স্বল্প কয়েক মিনিট বাকী থাকতে শেষ হয়। ব্যাটিংকারী দল জয় পায়নি, ফিল্ডিংকারী দল জয় পায়নি, ড্র হয়নি বা টাই হয়েছে। একমাত্র ব্যক্তি হিসেবে বব সিম্পসন উভয় টেস্টের সাথেই সম্পৃক্ত ছিলেন। প্রথমটিতে খেলোয়াড় হিসেবে ও পরেরটিতে অস্ট্রেলিয়া দলের কোচ হিসেবে অংশগ্রহণ ছিল তার।
প্রথম টাই টেস্ট, ১৯৬০
৯–১৪ ডিসেম্বর, ১৯৬০ স্কোরকার্ড |
ব |
||
- ওয়েস্ট ইন্ডিজ টসে জয়ী হয়ে ব্যাটিংয়ের সিদ্ধান্ত নেয়
- প্রতি ওভারে ৮ বল
প্রথম টাই টেস্টটি সফররত ওয়েস্ট ইন্ডিজ বনাম স্বাগতিক অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে সংঘটিত হয়েছিল।[1][2] ঐ খেলাটি অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড রাজ্যের ব্রিসবেনের গাব্বায় ৯ থেকে ১৪ ডিসেম্বর, ১৯৬০ তারিখে অনুষ্ঠিত হয়।[3][4][5]
ওয়েস্ট ইন্ডিজের ১ম ইনিংস
ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল শুরুতেই ৬৫ রানে ৩ উইকেট খোঁয়ায়। এ অবস্থায় গারফিল্ড সোবার্স ১৭৪ মিনিট ক্রিজে অবস্থান করে কার্যকরী ১৩২ রানের মূল্যবান ইনিংস খেলেন। অ্যালান ডেভিডসনের ৫/১৩৫ বোলিং পরিসংখ্যানের ফলে ওয়েস্ট দল ৪৫৩ রানে অল-আউট হয়।
অস্ট্রেলিয়ার ১ম ইনিংস
নর্ম ও’নীল ৪০১ মিনিট ক্রিজে অবস্থান করে ১৮১ রানের দায়িত্বশীল ইনিংস উপহার দেন। ৫০৫ রানে স্বাগতিকরা অল-আউট হয় ও ৫২ রানে এগিয়ে যায়। ওয়েস্ট ইন্ডিজের পক্ষে ওয়েস হল ১৪০ রানের বিনিময়ে ৪ উইকেট দখল করেন।
ওয়েস্ট ইন্ডিজের ২য় ইনিংস
ফ্রাঙ্ক ওরেলের ৬৫ রানের সুবাদে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল ২৮৪ রান তুলতে সমর্থ হয়। অ্যালান ডেভিডসন ৬/৮৭ পান। এ পর্যায়ে অস্ট্রেলিয়ার জয়ের লক্ষ্যমাত্রা দাঁড়ায় ২৮৪।
অস্ট্রেলিয়ার ২য় ইনিংস
অ্যালান ডেভিডসন ও অস্ট্রেলীয় দলনেতা রিচি বেনো ৭ম উইকেট জুটিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ১৩৪ রানের নতুন রেকর্ড গড়েন।[6]
শেষের ওভার
ঘড়িতে তখন বেলা ৫:৫৬। ওয়েস হল বোলিং করছেন। অস্ট্রেলিয়ার সংগ্রহ তখন ২২৭/৭। ঐ সময়ে অস্ট্রেলিয়ায় অনুষ্ঠিত টেস্ট খেলাগুলোয় ৮-বলে এক ওভাররূপে পরিগণিত হতো। শেষ আট বলে অস্ট্রেলিয়ার প্রয়োজন মাত্র ছয় রান ও হাতে রয়েছে তিন উইকেট।
- ১ম বল: ওয়ালি গ্রাউটের উরুতে বল আঘাত হানে। বেনো তাকে এক রান নেবার জন্য ইশারা দেন। সাত বলে জয়ের জন্য প্রয়োজন মাত্র পাঁচ রান।
- ২য় বল: হুক শট মারতে গিয়ে রিচি বেনো উইকেট-রক্ষক জেরি আলেকজান্ডারের গ্লাভসে কট বিহাইন্ড হন। দলের সংগ্রহ দাঁড়ায় ২২৮/৮। ছয় বলে জয়ের জন্য প্রয়োজন মাত্র পাঁচ রান।
- ৩য় বল: নতুন ব্যাটস্যান ইয়ান মেকিফ মিড-অফ অঞ্চলে কাট মারেন। কোন রান হয়নি। পাঁচ বলে জয়ের জন্য প্রয়োজন মাত্র পাঁচ রান।
- ৪র্থ বল: বলটি মেকিফের ব্যাট স্পর্শ ছাড়াই লেগ-সাইডে চলে যায়। গ্রাউট বাই রান নেয়ার জন্য আহ্বান করেন। আলেকজান্ডার বলটি বোলার প্রান্তে ছুঁড়ে রান আউটের চেষ্টা করেন। লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় ও মেকিফ ভূমি স্পর্শ করেন। চার বলে জয়ের জন্য প্রয়োজন মাত্র চার রান।
- ৫ম বল: গ্রাউট বাউন্সার মোকাবেলা করে বলকে স্কয়ার লেগ অঞ্চলে মারেন। রোহন কানহাই ক্যাচ তালুবন্দী করার প্রাক্কালে হলও ক্যাচ নেয়ার চেষ্টা করেন। ফিল্ডিংয়ের ভারসাম্যহীনতার কারণে ক্যাচ নেয়া হয়নি কারোরই। মেকিফ ও গ্রাউট স্থান বদল করে এক রান তুলে নেন। তিন বলে জয়ের জন্য প্রয়োজন মাত্র তিন রান।
- ৬ষ্ঠ বল: মেকিফ দূর্দান্তভাবে বলকে মিড-উইকেটে বাউন্ডারীর দিকে পাঠালে সীমানার কাছ থেকে কনরাড হান্ট ধরেন। জয়সূচক তৃতীয় রান সংগ্রহকালে কনরাড হান্ট বলটি জেরি আলেকজান্ডারের গ্লাভসে দিলে তিনি বেইল ফেলে দিয়ে গ্রাউটকে বিদায় করেন। অস্ট্রেলিয়ার সংগ্রহ দাঁড়ায় ২৩২/৯। জয়ের জন্য অস্ট্রেলিয়ার দুই বলে এক রান প্রয়োজন ও হাতে ছিল এক উইকেট।
- ৭ম বল: নতুন ব্যাটসম্যান লিন্ডসে ক্লাইন মাঠে আসেন। বলকে স্কয়ার লেগ অঞ্চলে ঠেলে দিয়ে এক রান নেয়ার জন্য দৌঁড় দেন। ১২ মিটার দূরে থাকা জো সলোমন বলটিকে হাতে নিয়ে স্ট্যাম্প বরাবর নিক্ষেপ করেন। বলটি স্ট্যাম্পে আঘাত করে ও কয়েক ইঞ্চি দূরে থাকা মেকিফকে রান আউটে বিদায় নিতে হয়।
অস্ট্রেলিয়া দল ২৩২ রানে অল-আউট হয়। এরফলে টেস্ট ক্রিকেট প্রবর্তনের ৮৪ বছর পর প্রথম টাই খেলা হিসেবে শেষ হয়।
দ্বিতীয় টাই টেস্ট, ১৯৮৬
১৮–২২ সেপ্টেম্বর, ১৯৮৬ স্কোরকার্ড |
ব |
||
- অস্ট্রেলিয়া টসে জয়ী হয়ে ব্যাটিংয়ের সিদ্ধান্ত নেয়।
- প্রতি ওভারে ৬ বল
দ্বিতীয় টাই টেস্টটি ১৯৮৬-৮৭ মৌসুমে সফরকারী অস্ট্রেলিয়া ও স্বাগতিক ভারতের মধ্যে তিন টেস্টে গড়া সিরিজের প্রথম টেস্ট ছিল।[7] ১৮ থেকে ২২ সেপ্টেম্বর, ১৯৮৬ তারিখে মাদ্রাজের চিপকে এম. এ. চিদাম্বরম স্টেডিয়ামে এ টেস্টটি সম্পন্ন হয়।[8][9][10][11] পরিবেশ অত্যন্ত কোলাহলপূর্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়া বিরাজ করে।[12] প্রচণ্ড উত্তাপের কারণে ইনিংস শেষ করার পরপরই তাকে হাসপাতালে প্রেরণ করতে হয়েছিল। অস্ট্রেলীয় কোচ বব সিম্পসন ইনিংসটিকে অস্ট্রেলিয়ার পক্ষে তার দেখা সেরা ইনিংসরূপে অভিহিত করেন। ডেভিড বুন ১২২ ও অস্ট্রেলীয় অধিনায়ক অ্যালান বর্ডার ১০৬ রানের ইনিংস খেলেছিলেন।[13]
ভারতের ১ম ইনিংস
তৃতীয় দিন শেষে ২৭০ রানে ভারত দল ৭ উইকেট হারায়। ৩৯৭ রানে অল-আউট হলে মাত্র ২৩ রানের ব্যবধানে এগিয়ে যাওয়ায় ফলো-অন এড়াতে সক্ষম হয়। তখনও দলটি ১৭৭ রানে পিছিয়ে ছিল। ভারতীয় অধিনায়ক কপিল দেব ১১৯ রানের দায়িত্বশীল ইনিংস উপহার দেন। গ্রেগ ম্যাথিউস ৫/১০৩ বোলিং পরিসংখ্যান দাঁড় করান। টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসের প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে সুনীল গাভাস্কার ১০০তম টেস্টে অংশ নেন।
অস্ট্রেলিয়ার ১ম ইনিংস
তৃতীয় দিন সকালে অস্ট্রেলিয়া দল ৫৭৪/৭ তুলে ইনিংস ঘোষণা করে। ডিন জোন্স ভারতের মাটিতে অস্ট্রেলিয়ার টেস্ট দলের পক্ষে তৎকালীন সর্বোচ্চ ২১০ রানের ইনিংস খেলেন। এ রান তুলতে তিনি ৩৩০ বল মোকাবেলায় ২৭ চার ও ২ ছক্কা হাঁকান।
অস্ট্রেলিয়ার ২য় ইনিংস
পূর্বদিনের রানের সাথে যুক্ত করে চতুর্থ দিন শেষে ১৭০/৫ তুলে ইনিংস ঘোষণা করে অস্ট্রেলিয়া দল। ফলে, ভারতের জয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হয় ৩৪৮ রানের।
ভারতের ২য় ইনিংস
শুরুটা বেশ ভালোই ছিল ভারতীয় দলের। এক পর্যায়ে তারা ২০৪/২ তুলে। সুনীল গাভাস্কার ৯০ রান তুলে তৃতীয় খেলোয়াড় হিসেবে আউট হন। চন্দ্রকান্ত পণ্ডিত আউট হলে দলের সংগ্রহ দাঁড়ায় ২৯১/৫। নিয়মিত বিরতিতে নিচেরসারির ব্যাটসম্যানদের চলে যাওয়ায় শেষ ওভারের পূর্বে ভারতের রান সংখ্যা ৩৪৪/৯।
শেষের ওভার
গ্রেগ ম্যাথিউস রবি শাস্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বোলিং করছেন। বোলার প্রান্তে অবস্থান করছিলেন ভারতের সর্বশেষ ব্যাটসম্যান মনিন্দর সিং। ভারতের জয়ের জন্যে ৬ বলের ওভারে চার রানের দরকার ছিল ও হাতে ছিল মাত্র এক উইকেট।
- ১ম বল: শাস্ত্রী কোন রান নেননি। পাঁচ বলে চার রানের দরকার।
- ২য় বল: শাস্ত্রী দুই রান নিলে পুনরায় ব্যাট ধরার সুযোগ পান। চার বলে দরকার দুই রান।
- ৩য় বল: স্কয়ার লেগ অঞ্চলে ঠেলে দিয়ে শাস্ত্রী এক রান নেন। দলের সংগ্রহ টাইয়ে পরিণত হয়। জয়ের জন্য এক রানের প্রয়োজন। এ অবস্থায় ব্যাট হাতে ভারতের ১১শ ব্যাটসম্যান অবস্থান করছেন।
- ৪র্থ বল: সিং কোন রান নেননি। দুই বলে এক রানের প্রয়োজন।
- ৫ম বল: বল সিংয়ের পিছনের পায়ে আঘাত হানে। বিশাল আবেদনে সাড়া দিয়ে আম্পায়ার বিক্রমরাজু তাকে আউট ঘোষণা দেন।
ভারত ৩৪৭ রানে অল-আউট হয়। ম্যাথিউস ৫/১৪৬ পান ও খেলায় ২৪৯ রান খরচায় ১০ উইকেট দখল করেন। রে ব্রাইট ৫/৯৪ বোলিং পরিসংখ্যান গড়েন। এভাবেই টেস্ট ক্রিকেটের দ্বিতীয় টাই হয়। ডিন জোন্স ও কপিল দেবকে যৌথভাবে ম্যান অব দ্য ম্যাচের পুরস্কার প্রদান করা হয়েছিল।
রান সংখ্যা সমান হওয়ায় ড্র
দুইটি টাই টেস্টের পাশাপাশি আরও দুইটি টেস্টের ফলাফলে রান সংখ্যা সমান ছিল। কিন্তু, চতুর্থ ইনিংসে সময়সীমা অতিক্রান্ত হওয়ায় ড্র হয়ে যায়। তবে, ব্যাটিংকারী দলের তখনও উইকেট হাতে ছিল। এ খেলাগুলো টাই নয়, ড্র হিসেবে পরিচিতি পায়।
- প্রথমটি ১৯৯৬ সালে জিম্বাবুয়ে বনাম ইংল্যান্ডের মধ্যে বুলাওয়ের কুইন্স স্পোর্টস ক্লাবে সিরিজের ১ম টেস্টে সংঘটিত হয়েছিল। ২০৫ রানের জয়ের লক্ষ্যমাত্রায় ধাবিত হয় ইংল্যান্ড দল। কিন্তু, ২০৪/৬ করতে বাধ্য হয়। শেষ বলে জয়ের জন্যে তাদের তিন রানের দরকার ছিল। নিক নাইট দুই রান নেয়ার পর তৃতীয়টি নিতে গিয়ে রান আউটের শিকারে পরিণত হন।[14]
- দ্বিতীয়টি ২০১১-১২ মৌসুমে ভারত বনাম ওয়েস্ট ইন্ডিজের মধ্যকার সিরিজের তৃতীয় টেস্টে সংঘটিত হয়। মুম্বইয়ের ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে ভারত দলের জয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ২৪৩ রান। তবে তারা ২৪২/৯ করতে সমর্থ হয়। চূড়ান্ত বলে দুই রানের প্রয়োজন থাকা অবস্থায় রবিচন্দ্রন অশ্বিন প্রথম রান করে দ্বিতীয় রানে অগ্রসর হলে রান আউটে পরিণত হন। ফলে খেলাটি ড্র হয়।[15]
তথ্যসূত্র
Wikiwand in your browser!
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.