আবু হানিফা আল-নোমান ইবনে সাবিত ইবনে যুতা ইবনে মারযুবান (৬৯৯ — ৭৬৭ সাল/৮০ — ১৪৮ হিজরি,[5] আরবি: نعمان بن ثابت بن زوطا بن مرزبان), উপনাম ইমাম আবু হানিফা নামেই সমধিক পরিচিত, ছিলেন ফিকহশাস্ত্রের একজন প্রখ্যাত বিশেষজ্ঞ এবং হিজরি প্রথম শতাব্দীর একজন গুরুত্বপূর্ণ ইসলামি ব্যক্তিত্ব। ইমাম আবু হানিফার বিষয়ে চতুর্থ খলিফা দোয়া করেছিলেন। ইসলামি ফিকহের সর্বাধিক প্রসিদ্ধ ও পরিচিত চারটি "সুন্নি মাযহাবের" একটি “হানাফি মাজহাব”-এর প্রধান ব্যক্তিত্ব ছিলেন তিনি। তিনি তার জ্ঞান এবং সম্মানের কারণে সুন্নি ইসলামে আল-ইমাম আল-আজম (সর্বশ্রেষ্ঠ ইমাম) নামে পরিচিত। এই উপাধি ইমাম আবু হানিফা ব্যতীত ইসলামের ইতিহাসে আর কাউকে দেয়া হয়নি।[3][6]

দ্রুত তথ্য ইমামে আজম ইমাম আবু হানিফা, উপাধি ...
ইমামে আজম
ইমাম আবু হানিফা
চিত্রণ
উপাধিইমাম আজম, আমিরুল মুমিনিন ফিল ফিকহ, ইমামুল আইম্মা, ইমামুল মুজতাহিদিন
জন্মনোমান বিন সাবিত
৫ সেপ্টেম্বর, ৬৯৯ খ্রিস্টাব্দ/৪ শাবান, ৮০ হিজরি
কুফা, উমাইয়া খিলাফত
মৃত্যু১৪ জুন ৭৬৭(767-06-14) (বয়স ৬৭)/১৫০ হিজরি
বাগদাদ আব্বাসীয় খিলাফত
মৃত্যুর কারণকারাগারে নির্যাতন। (কারো মতে বিষপ্রয়োগ)[1]
জাতীয়তাকুফি
জাতিভুক্তপারসিক ফার্সি[2][3][4]
যুগহিজরি প্রথম শতাব্দী
পেশাহানাফি ফিকহের ইমাম
মাজহাবস্বতন্ত্র মুজতাহিদ
মূল আগ্রহফিকহ
উল্লেখযোগ্য ধারণাকিয়াস, ইজতিহাদ
লক্ষণীয় কাজহানাফি মাজহাব প্রতিষ্ঠা, ফিকহশাস্ত্রের উন্নয়ন
যাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন
যাদেরকে প্রভাবিত করেছেন
বন্ধ
ইরাকের বাগদাদে অবস্থিত আবু হানীফা মসজিদ

জীবনী

জন্ম, নাম ও বংশধর

উমাইয়া খলিফা আবদুল মালিক ইবনে মারওয়ানের রাজত্বকালে ইমাম আবু হানিফা ইরাকের কুফা নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন।[7][8] তার ছয় বছর বয়সে আবদুল মালিক মৃত্যুবরণ করেন। ষোলো বছর বয়সে তিনি পিতার সাথে হজে গিয়েছিলেন। তার পিতা সাবিত বিন যুতী; কাবুল, আফগানিস্তানের একজন ব্যবসায়ী ছিলেন। তার পিতার বয়স যখন ৪০ বছর তখন আবু হানিফা জন্মগ্রহণ করেন। বংশধরের দিক থেকে তাকে অ-আরবীয় বলে ধরা হয়ে থাকে কারণ তার দাদার নামের শেষে যুতী। প্রখ্যাত মুসলিম ইতিহাসবিদ খতিবে বাগদাদি আবু হানিফার নাতি ইসমাইল বিন হাম্মাদের বক্তব্য থেকে আবু হানিফার বংশ ব্যাখ্যা দেন। অন্য আরেক ইতিহাসবিদ হাম্মাদ আবু হানিফাকে পারসিক বংশোদ্ভূত বলে দাবি করেন।[3][4] আবু হানিফার বংশ নিয়ে অনেক ব্যাখ্যা পাওয়া যায় তবে সবচেয়ে বেশি পরিচিত ও নির্ভরযোগ্য মত হলো তিনি কাবুলের পারসিক বংশোদ্ভূত।[3][4]

Thumb
ইমাম আবু হানিফা মসজিদ

শিক্ষা

প্রথমত তিনি কুফা শহরেই অধ্যয়ন শুরু করেন ইলমে কালাম নামক দর্শন ও আধুনিক ভাষাবিজ্ঞান শাস্ত্রে। কিন্তু, এর বিভিন্ন শাখায় বুৎপত্তি অর্জনের পর তা ছেড়ে দিয়ে ২০ বছর বয়সে তিনি ফিকহ্ ও হাদীস শাস্ত্রের গভীর অধ্যয়নে মনোনিবেশ করেন। তিনি হাম্মাদ ইব্‌ন যাইদকে তাঁর প্রধান শিক্ষক হিসেবে বেছে নেন। হাম্মাদ ছিলেন ঐ সময়ে হাদীসের শ্রেষ্ঠ বিশেষজ্ঞদের অন্যতম। তাঁর তত্ত্বাবধানে ইমাম আবু হানীফাহ আঠারো বছর শিক্ষা লাভ করেন। এ সময়ে তিনি নিজেই শিক্ষাদানের যোগ্যতা অর্জন করেন। তবে হিজরি ১২৪ সালে (৭৪২ খ্রীঃ) হাম্মাদের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি তাঁর ছাত্র হিসেবেই থেকে যান। তারপর চল্লিশ বছর বয়সে আবু হানীফা তাঁর শিক্ষকের স্থান লাভ করেন এবং কুফার শ্রেষ্ঠতম বিশেষজ্ঞে পরিণত হন।

প্রাথমিক জীবন বা ব্যবসায়িক জীবন

ইমাম আবু হানিফার প্রাথমিক জীবন কেমন ছিল এ বিষয়ে ঐতিহাসিকগণ বেশি কিছু উদ্ধৃত করেননি। তিনি ছিলেন একজন প্রসিদ্ধ কাপড় ব্যবসায়ী। ইমাম আবু সতাঁর তত্ত্বাবধানে ইমাম আবু হানিফা আঠারো বছর শিক্ষা লাভ করেন। এ সময়ে তিনি নিজেই শিক্ষাদানের যোগ্যতা অর্জন করেন। তবে হিজরি ১২৪ সালে (৭৪২ সাল) হাম্মাদের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি তাঁর ছাত্র হিসেবেই থেকে যান। তারপর চল্লিশ বছর বয়সে আবু হানিফা তাঁর শিক্ষকের স্থান লাভ করেন এবং কুফার শ্রেষ্ঠতম বিশেষজ্ঞে পরিণত হন। বিস্তৃত অঞ্চলব্যপী বিপুল পরিমাণ মূল্যবান রেশমী কাপড়ের আমদানি ও রফতানি হতো। পৈতৃক এই ব্যবসার সুবাদেই তিনি প্রচুর বিত্তের মালিক ছিলেন। তৎকালীন বিশিষ্ট ওলামাগণের মধ্যে সম্ভবত তিনিই ছিলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা বা বিত্তবানদের হাদিয়া-তোহফা প্রাপ্তির পরোয়া না করে নিজ উপার্জনের দ্বারা জীবিকা নির্বাহ, এলেমের সেবা এবং তার নিকট সমবেত গরিব শিক্ষার্থীদের যাবতীয় ব্যয়ভার নির্বাহ করার ব্যবস্থা করতেন। ১৬ বছর বয়সে তিনি পিতৃহারা হন। পিতা ছিলেন একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। তার মৃত্যুর পর এই ব্যবসার দায়িত্ব নিতে হয় যুবক ইমাম আবু হানিফাকে।[9]

তার অসামান্য দক্ষতা ও নিষ্ঠায় ব্যবসা প্রসারিত করার পাশাপাশি কাপড় তৈরির এক কারখানা স্থাপন করেন। যা কিছু দিনের মধ্যেই অনন্য হয়ে ওঠে। ব্যবসায় তার সততার পরিচয় পেয়ে দিগ্বিদিক থেকে লোকেরা তার দোকানে ভিড় জমাতেন। এভাবে তিনি জন মানুষের কাছে ব্যাপকভাবে পরিচিত লাভ করলেন। ইমাম শাবি (রহ.) তাকে ইলমের ব্যাপারে উৎসাহিত করার আগ পর্যন্ত তিনি এ ব্যবসাকেই নিজের ক্যারিয়ার হিসেবে নিয়েছিলেন।[10]

ব্যবসা জীবন থেকে শিক্ষা জীবনে পদার্পণ

কিশোর বয়স থেকেই ইমাম সাহেব পিতার ব্যবসার কাজে যোগ দিয়েছিলেন। ব্যবসায়িক কাজেই তাকে বিভিন্ন বাজার ও বাণিজ্যকেন্দ্রে যাতায়াত করতে হতো। ঘটনাচক্রে একদিন ইমাম শাবীর রহ.-এর সাথে তার সাক্ষাত হয়ে যায়। প্রথম দর্শনেই ইমাম শাবী আবু হানীফার নিষ্পাপ চেহারার মধ্যে প্রতিভার স্ফুরণ লক্ষ্য করেছিলেন।

তিনি জিজ্ঞেস করলেন, হে বৎস! তুমি কি কর? এ পথে তোমাকে সব সময় যাতায়াত করতে দেখি? ইমাম সাহেব জবাব দিলেন, আমি ব্যবসা করি। ব্যবসার দায়িত্ব পালনার্থেই ব্যবাসায়ীদের দোকানে দোকানে আমাকে যাওয়া-আসা করতে হয়। ইমাম শাবী রহ. পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন, এটা তো তোমার লেখাপড়ার বয়স। কোন আলেমের শিক্ষায়তনেও কি তোমার যাতায়াত আছে? আবু হানীফা সরলভাবেই জবাব দিলেন, সেরূপ সুযোগ আমার খুব কমই হয়। কিছুক্ষণ আলাপ-আলোচনার মাধ্যমেই ইমাম শাবী আবু হানীফাকে জ্ঞানার্জনে মনোযোগী হওয়ার প্রতি আগ্রহী করে তুললেন। ইমাম আবু হানীফা বলেন, ইমাম শাবীর রহ.-এর সেই আন্তরিকতাপূর্ণ উপদেশবাণী গুলো আমার অন্তরে গভীরভাবে রেখাপাত করল এবং এরপর থেকেই আমি বিপনীকেন্দ্রগুলোতে আসা-যাওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন শিক্ষা কেন্দ্রেও যাতায়াত শুরু করলাম। এ সময় আবু হানীফা রহ.-এর বয়স ছিল উনিশ বা বিশ বছর।[9]

হাদিসশাস্ত্রের শিক্ষা গ্রহণ

ফিকাহ অধ্যায়নের পর তিনি হাদিস শিক্ষার জন্য তদানিন্তন হাদিস বেত্তাদের খিদমতে হাজির হন এবং শিক্ষা লাভ করেন। তখনও কোন প্রণিধান যোগ্য হাদিস গ্রন্থ সংকলিত হয়নি। কোন একজন মুহাদ্দিস সকল হাদিসের হাফিজ ছিলেন না। প্রথমে তিনি কুফায় অবস্থানরত মুহাদ্দিসদের থেকে হাদিস শেখেন। এরপর তিন বসরা যান। সেখানে হজরত কাতাদাহ রহ.-এর খিদমতে হাজির হন এবং হাদিসের দরস হাসিল করেন। তারপর ইমাম আবু হানীফা রহ. হজরত শুবা রহ.-এর দরসে যোগ দেন। তাকে হাদিস শাস্ত্রে ‘আমিরুল মুমিনিন’ বলা হয়। কুফা ও বসরার পর ইমাম আবু হানীফা হারামাইন শরিফাইন এর দিকে দৃষ্টিপাত করেন। প্রথমে তিনি মক্কা গেলেন এবং সেখানে তিনি হাদিসবিদ হজরত আতা ইবনে আবু রিবাহ রহ. -এর দরবারে যান এবং দরসে শামিল হয়ে শিক্ষা অর্জন করেন। ১১৫ হিজরিতে আতা রহ. মৃত্যুবরণ করলে তিনি মক্কায় চলে আসেন এবং হজরত ইকরামা রহ.-এর কাছ থেকেও হাদিসের সনদ লাভ করেন।[9]

হাফেজ মুহাম্মদ ইউসুফ সালেহি শাফেয়ি (রহ.) বলেন,

ইমাম আবু হানীফা (রহ.) হাদিসের বড় বড় হাফেজ ও শীর্ষদের অন্তর্ভুক্ত। তিনি যদি হাদিসের প্রতি খুব বেশি মনোযোগী না হতেন ও ব্যুৎপত্তিসম্পন্ন না হতেন, তাহলে ফিকহের মাসআলা-মাসাইল বের করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হতো না।

--- তাবাকাতুল হুফফাজ, আল হাদিস ওয়াল মুহাদ্দিসুন, পৃষ্ঠা-২৮৪

মুহাদ্দিস ইয়াহিয়া ইবনে মুঈনকে যখনই ইমাম আবু হানীফা (রহ.) সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হতো, তখনই তিনি বলতেন :'

তিনি নির্ভরযোগ্য, বিশ্বস্ত, ভুলভ্রান্তিমুক্ত। হাদিসের ব্যাপারে কেউ তাঁকে দুর্বল বা অগ্রহণযোগ্য বলেছেন বলে আমি শুনিনি।

--- উমদাতুল কারি, দ্বিতীয় খণ্ড পৃষ্ঠা : ১২

হাফেজ আবু নঈম ইসফাহানি (রহ.) বলেন :

আমি ইমাম আবু হানীফার কাছে একটি ঘরে উপস্থিত হলাম, যা কিতাবে পরিপূর্ণ ছিল। জিজ্ঞেস করলাম, এগুলো কিসের কিতাব? প্রত্যুত্তরে বলেন, হাদিসের।

--- উকুদুল জাওয়াহিরিল হানীফা প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা : ২৩

সাহাবিদের দর্শন

উম্মতের সর্বসম্মতিক্রমে ইমাম আবু হানিফা একজন তাবেয়ি ছিলেন। আল্লামা ইবনে হাজার মক্কি বলেন, ইমাম আবু হানিফা নিম্নে উল্লেখিত সাহাবিদের সাক্ষাৎ লাভ করেন:

  • আনাস ইবনে মালিক (ওফাত: ৯৩ হিজরি),
  • আব্দুল্লাহ ইবনে আবি আওফা (ওফাত: ৮৭ হিজরি),
  • সহল ইবনে সা'আদ (ওফাত: ৮৮ হিজরি),
  • আবু তোফায়েল (ওফাত: ১১০ হিজরি),
  • আবদুল্লাহ ইবনে জুবায়দি (ওফাত: ৯৯ হিজরি),
  • জাবের ইবনে আবদুল্লাহ (ওফাত: ৯৪ হিজরি) এবং
  • ওয়াসেলা ইবনুল আসকা (ওফাত: ৮৫ হিজরি)।[11]

ফিকহ শাস্ত্রের আবিষ্কারক

ইমাম আবু হানীফা ফিকহ শাস্ত্রের আবিষ্কারক ছিলেন।[11] ফিকহ ও ইসলামী আইন সংকলন ও সম্পাদনার জন্য তিনি ৪০ জন ফকিহ নিয়ে এক আইনজ্ঞ কাউন্সিল প্রতিষ্ঠা করেন। ঐযুগে যেসব মাসয়ালা-মাসায়িল সংকলন হয়েছিল, তার সংখ্যা ১২ লাখ ৭০ হাজারের ঊর্ধ্বে। ফিকহ শাস্ত্রে তার অবদানের ব্যাপারে ইমাম শাফেয়ি বলেন, ফিকহ শাস্ত্রের সব মানুষ ছিলেন আবু হানীফার পরিবারভুক্ত।[12]

ইমাম মালেক বলেন, আবু হানীফা এমন এক ব্যক্তি, তিনি যদি ইচ্ছা করতেন, এই স্তম্ভটিকে সোনা প্রমাণিত করবেন, তবে নিঃসন্দেহে তিনি তা করতে সক্ষম।[13] তাই ইমাম আবু হানীফার নামযুক্ত মাসয়ালাগুলো ও মাযহাব দ্রুত সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে।

হাদিস শাস্ত্রে অবদান

ইমাম আবু হানিফা হাদিস শাস্ত্রে অতুলনীয় জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। তিনি চার হাজার শাইখ থেকে হাদিস সংগ্রহ করেছেন।[14]

ইমাম বুখারির অন্যতম ওস্তাদ মক্কি বিন ইবরাহিম, যার সনদে ইমাম বুখারি বেশির ভাগ 'সুলাসিয়াত' হাদিস বর্ণনা করেছেন। এই মক্কি বিন ইবরাহিম, ইমাম হানিফা-এর ছাত্র। তিনি ইমাম আবু হানিফা সম্পর্কে বলেন, আবু হানিফা তার সময়কালের শ্রেষ্ঠ আলেম ছিলেন।[15] আবিদ ইবনি সালিহ বলেন, ইমাম আবু হানিফা হাদিসের নাসিখ ও মানসুখ নির্ণয়ের ব্যাপারে খুব সতর্ক ছিলেন।' ইমাম আবু হানিফা তার শহরে যেসব হাদিস পৌঁছেছে তার মধ্যে মুহাম্মাদের (সাঃ) তিরোধানের সময়কার সর্বশেষ আমল কী ছিল সেসব তার মুখস্থ ছিল।

ইয়াহিয়া ইবনে নাসর বলেন, একদিন আমি ইমাম আবু হানিফা-এর ঘরে প্রবেশ করি। সেখানে তার কিতাব ভরপুর ছিল। আমি জিজ্ঞাসা করলাম এগুলো কী? তিনি বললেন, এগুলো সব হাদিসের কিতাব, যার মধ্যে আমি সামান্য কিছু বর্ণনা করেছি, সেগুলো ফলপ্রদ।[16]

কাজির পদ প্রত্যাখান

৭৬৩ সালে আব্বাসীয় বংশের আল-মনসুর আবু হানিফাকে রাজ্যের প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগের প্রস্তাব দেন কিন্তু স্বাধীনভাবে থাকার জন্য তিনি প্রস্তাব প্রত্যাখান করেন। তার পরিবর্তে তার ছাত্র আবু ইউসুফকে প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব দেওয়া হয়। প্রস্তাব প্রত্যাখানের ব্যাপারে আবু ইউসুফ আল মনসুরকে ব্যাখা দেন তিনি নিজেকে এই পদের জন্য উপযুক্ত মনে করছেন না। আল-মনসুরের এই পদ প্রস্তাব দেওয়ার পেছেনে তার নিজস্ব কারণ ছিল, আবু হানীফা প্রস্তাব প্রত্যাখান করার পর মনসুর তাকে মিথ্যাবাদী হিসেবে অভিযুক্ত করেন। এই অভিযোগের ব্যাখ্যায় আবু হানীফা বলেন, “আমি যদি মিথ্যাবাদী হই তাহলে প্রস্তাব প্রত্যাখান করার ব্যাপারে আমার মতামত সঠিক, কারণ কীভাবে আপনি প্রধান বিচারপতির পদে একজন মিথ্যাবাদীকে বসাবেন।” এই ব্যাখ্যার উত্তরে আল-মনসুর আবু হানিফাকে গ্রেফতার করেন ও তাকে নির্যাতন করে কারাগারে বন্দি করে রাখা হয়। এমনকি বিচারকরা সিদ্ধান্ত নিতেন কে তার সাথে দেখা করতে পারবে।

মৃত্যু

৭৬৭ সালে আবু হানিফা কারাগারে মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর কারণ পরিষ্কার নয়। কেউ কেউ বলেন আবু হানিফা আল-মনসুরের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহের চেষ্টা করেন এ জন্য তাকে জেলখানার ভেতর মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়।[17] এটা বলা হয়ে থাকে যে, আবু হানীফার জানাযায় অনেক লোক সমাগম হয়েছিল। ইতিহাসবিদ খাতিবে বাগদাদি-এর পক্ষ থেকে বলা হয় তার জন্য লোকজন মৃত্যুর ২০ দিন পর্যন্ত প্রার্থনা করেছিল। পরবর্তীতে, অনেক বছর পর বাগদাদের পাশে আধামিয়াতে আবু হানিফ মসজিদ নামে একটি মসজিদ প্রতিষ্ঠা করা হয় আবু হানিফার নামে।

ইমাম আবূ হানিফার ওফাতের খবর পেয়ে ইমাম শুবা বলেন :

তাঁর সাথে কূফার ফিকহও চলে গেল, আল্লাহ আমাদেরকে ও তাঁকে রহমত করুন। - ইবন আব্দুল বার্র, আল-ইনতিকা ১/১২৬-১২৭

১৫০৮ সালে সাফাভি সম্রাজ্যের শাহ ইসমাইল আবু হানিফা ও আব্দুল কাদের জিলানির মাজার এবং অন্যান্য সুন্নি নিদর্শন ধ্বংস করে দেন।[18] ১৫৩৩ সালে উসমানীয়রা পুনরায় ইরাক দখল করে ও মাজারসহ অন্যান্য সুন্নি নিদর্শন পুনর্নির্মাণ করে।[19]

সম্মাননা

ইমাম শাফিঈ -র মতে: যে ব্যক্তি ফেকাহর জ্ঞান অর্জন করতে চায়, সে যেন ইমাম আবু হানীফা এবং তার ছাত্রদের সান্নিধ্য লাভ করে। কারণ ফেকাহর ব্যাপারে সকলেই আবু হানীফা-র মুখাপেক্ষী।[20] ইমাম আবু ইউসুফ বলেন, '[21] ইমাম আবু হানীফা কেবলমাত্র কারাগারে বসেই ১২ লক্ষ ৯০ হাজারের অধিক মাসয়ালা লিপিবদ্ধ করেছেন'।

তার বিষয়ে ইমাম হাসান ইবন সালিহ বলেন :

নুমান ইবন সাবিত বিজ্ঞ আলিম ছিলেন, ইলমের বিশুদ্ধতা নির্ণয়ে সচেতন ছিলেন। কোনো বিষয়ে রাসূলুল্লাহ সা. থেকে থেকে কোনো হাদীস সহীহ বলে প্রমাণিত হলে তিনি তা পরিত্যাগ করে অন্য দিকে যেতেন না। - ইবন আব্দুল বার্র, আল-ইনতিকা, পৃ. ১২৮

ইমাম ইবনুল মোবারক বলেন :

আমাদের নিজেদের বিষয়ে আল্লাহকে মিথ্যা বলব না! ফিকহের বিষয়ে আমাদের ইমাম আবূ হানীফা এবং হাদীসের বিষয়ে আমাদের ইমাম সুফইয়ান সাওরী। আর যখন দুজন কোনো বিষয়ে একমত হন তখন আমরা তাঁদের বিপরীতে আর কাউকে পরোয়া করি না।’’... ‘‘আল্লাহ যদি আমাকে আবূ হানীফা এবং সুফইয়ান সাওরী দ্বারা উদ্ধার না করতেন তাহলে আমি সাধারণ মানুষই থাকতাম।’’ ‘‘আবূ হানীফা মানুষদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ফকীহ।’’ - সাইমারী, আখবারু আবী হানীফা, পৃ. ১৪০; খতীব বাগদাদী, তারীখ বাগদাদ ১৩/৩৩৭; যাহাবী, সিয়ারু আ’লামিন নুবালা ৬/৩৯৮।

গ্রন্থাবলী

পরিচিত ২০টি প্রসিদ্ধ গ্রন্থের নাম উল্লেখ করা হলো:

  • ১. আল-ফিকাহুল আকবর।[20]
  • ২. আল-ফিকাহুল আবসাত।
  • ৩. কিতাব আল আলিম অয়াল মুতাআল্লিম।
  • ৪. আল-অসিয়া।
  • ৫. আর-রিসালা।
  • ৬. মুসনাদে আবি হানীফা
  • ৭. অসিয়া ইলা ইবনিহি হাম্মাদ।
  • ৮. অসিয়া ইলা তিল মিজিহি ইউসুফ ইবনে খালিদ।
  • ৯. অসিয়া ইলা তিল মিজিহি আল কাজী আবি ইউসুফ।
  • ১০. রিসালা ইলা উসমান আল বাত্তি।
  • ১১. আল কাসিদা আল কাফিয়া (আননুমানিয়া)।
  • ১২. মুজাদালা লি আহাদিদ দাহ রিন।
  • ১৩. মারিফাতুল মাজাহিব।
  • ১৪. আল জাওয়াবিত আস সালাসা।
  • ১৫. রিসালা ফিল ফারাইয।
  • ১৬. দুআউ আবি হানীফা।
  • ১৭. মুখাতাবাতু আবি হানীফা মাআ জাফর ইবনে মুহাম্মদ।
  • ১৮. বাআজ ফতোয়া আবি হানীফা।
  • ১৯. কিতাবের মাক সুদ ফিস সারফ।
  • ২০. কিতাবু মাখারিজ ফিল হিয়াল।

আরও দেখুন

তথ্যসূত্র

বহিঃসংযোগ

Wikiwand in your browser!

Seamless Wikipedia browsing. On steroids.

Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.

Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.