দারুল উলুম হাটহাজারী
বাংলাদেশের একটি কওমি মাদ্রাসা উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
বাংলাদেশের একটি কওমি মাদ্রাসা উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম সংক্ষেপে হাটহাজারী মাদ্রাসা বাংলাদেশের চট্টগ্রাম জেলার হাটহাজারী উপজেলায় অবস্থিত একটি কওমি মাদ্রাসা। এটি বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ ও সর্বপ্রাচীন কওমি মাদ্রাসা।[1] আব্দুল ওয়াহেদ বাঙ্গালী, হাবিবুল্লাহ কুরাইশি, সুফি আজিজুর রহমান ও আব্দুল হামিদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এবং আশরাফ আলী থানভীর অনুমতিতে ১৯০১ সালে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি বাংলাদেশে দারুল উলুম দেওবন্দের আদলে প্রতিষ্ঠিত প্রথম মাদ্রাসা, যা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আদর্শ ও চিন্তাধারা মোতাবেক পরিচালিত হয়। তাই এটি বাংলাদেশে দ্বিতীয় দারুল উলুম দেওবন্দ নামেও খ্যাত।[4] এটি বাংলাদেশের প্রথম দাওরায়ে হাদিস মাদ্রাসা এবং এখনও বাংলাদেশে হাদিস শিক্ষার প্রধান কেন্দ্র।[5][6] এই মাদ্রাসার অনুকরণে বিপুল সংখ্যক মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় এ মাদ্রাসাকে উম্মুল মাদারিস বা মাদ্রাসার জননীরূপে আখ্যায়িত করা হয়।[7][8] এটি বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের অধিভুক্ত।[9] মাসিক মুঈনুল ইসলাম এই মাদ্রাসার মুখপত্র।
আরবি: الجامعة الأهلية دار العلوم معين الإسلام | |
অন্যান্য নাম | হাটহাজারী মাদ্রাসা |
---|---|
প্রাক্তন নাম | মাদ্রাসা মুঈনুল ইসলাম |
ধরন | কওমি মাদ্রাসা |
স্থাপিত | ১৯০১ |
প্রতিষ্ঠাতাগণ | |
মূল প্রতিষ্ঠান | দারুল উলুম দেওবন্দ |
অধিভুক্তি | বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ |
ধর্মীয় অধিভুক্তি | ইসলাম |
বাজেট | ৩৮ কোটি টাকা (২০২২)[1] |
সদরে মুহতামিম | মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী |
মহাপরিচালক | খলিল আহমদ কাসেমী |
শায়খুল হাদিস | শেখ আহমদ |
প্রধান মুফতি | মুফতি কেফায়াতুল্লাহ |
শিক্ষায়তনিক ব্যক্তিবর্গ | ১০০+ (২০২১)[2] |
শিক্ষার্থী | ৮০০০+ (২০২২)[1] |
দাওরায়ে হাদিস | ২৩১৮ (২০২২)[1] |
প্রাক্তন শিক্ষার্থী | পূর্ণ তালিকা |
অবস্থান | ২২.৫০৪৫৮২° উত্তর ৯১.৮০৭৬৭৫° পূর্ব |
শিক্ষাঙ্গন | শহর (৪.৪৩ একর)[3] |
মুখপত্র | মাসিক মুঈনুল ইসলাম |
ওয়েবসাইট | darululoomhathazari |
প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে দীর্ঘসময় আশরাফ আলী থানভী ও জমিরুদ্দিন আহমদ মাদ্রাসাটির পৃষ্ঠপোষকতা করেন। হাবিবুল্লাহ কুরাইশি এই মাদ্রাসার প্রথম মহাপরিচালক ছিলেন। মাদ্রাসার বর্তমান মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন খলিল আহমদ কাসেমী। ১৯০৮ সালে এই মাদ্রাসার প্রথম শায়খুল হাদিস হিসেবে সাঈদ আহমদ সন্দ্বীপির মাধ্যমে এ মাদ্রাসায় দাওরায়ে হাদিস চালু করা হয়। মাদ্রাসার বর্তমান শায়খুল হাদিস হিসেবে আছেন শেখ আহমদ। ১৯৪৫ সালে মুফতি ফয়জুল্লাহর মাধ্যমে এই মাদ্রাসায় ফতোয়া বিভাগ চালু হয়। ১৯৪১ সালে ব্রিটিশ সরকারের ষড়যন্ত্রমূলক প্রচেষ্টার ফলে মাদ্রাসাটি বন্ধ হয়ে যায়, যা মাদ্রাসার দ্বিতীয় মহাপরিচালক শাহ আবদুল ওয়াহহাবের প্রচেষ্টার ফলে পুনরায় চালু হয়। তাই শাহ আবদুল ওয়াহহাবকে এই মাদ্রাসার দ্বিতীয় স্থপতি হিসেবেও আখ্যায়িত করা হয়। ১৯৯৫ সালে মাদ্রাসাটিতে শতবর্ষপূর্তি উদযাপন করা হয়। ২০১০ সালে এই মাদ্রাসায় হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ গঠিত হয়। মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী মাদ্রাসার সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী পরিষদ মজলিসে শুরার সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
দারুল উলুম হাটহাজারীর প্রাতিষ্ঠানিক ওয়েবসাইটের বিবৃতি মতে, মাদ্রাসাটি প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট ছিল ওই অঞ্চলে তৎকালীন মুসলিম সমাজের ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞতা ও ইসলামি শিক্ষা-সংস্কৃতির প্রতিকূল অবস্থা। মুসলমানদের এ অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে চট্টগ্রাম জেলার কয়েকজন আলেম দারুল উলুম দেওবন্দের অনুকরণে এই মাদ্রাসাটি প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।[3]
আব্দুল ওয়াহেদ বাঙ্গালী উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য দারুল উলুম দেওবন্দ গমন করেন এবং সেখানে দাওরায়ে হাদিস সমাপ্ত করেন। শিক্ষাজীবন শেষে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করে তিনি ধর্মীয় সংস্কার কাজ শুরু করেন।[10] তার সংস্কার কাজের ফলে সুফি আজিজুর রহমান ও আব্দুল হামিদ তার শিষ্যে পরিণত হন।[11] তৎসময়ে হাবিবুল্লাহ কুরাইশিও দারুল উলুম দেওবন্দে উচ্চশিক্ষা অর্জন করেন এবং আশরাফ আলী থানভীর হাতে বায়আত গ্রহণ করে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। খবর পেয়ে আব্দুল ওয়াহেদ বাঙ্গালী ও সুফি আজিজুর রহমান তার সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং সংবাদটি আব্দুল হামিদকেও জানান। ধর্মীয় আদর্শে সমচিন্তক হওয়ায় প্রথম সাক্ষাতের ৬ মাস পর উভয়েই পুনরায় হাবিবুল্লাহ কুরাইশির সাথে মিলিত হন এবং একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব বর্ণনা করেন।[12] মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব উপলব্ধি করে হাবিবুল্লাহ কুরাইশি তার পীর আশরাফ আলী থানভীকে একটি চিঠি লিখেন এবং প্রত্যুত্তরে থানভীর সম্মতিসূচক নির্দেশ পেয়ে তিনি একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করার সিদ্ধান্ত নেন।[13] কুরাইশি ১৮৯৭ সালে বর্তমান চারিয়া মাদ্রাসার রাস্তার পশ্চিমপার্শ্বে পুকুরের পাড়ে ১৫/২০ হাত লম্বা একটি মাদ্রাসা ঘর তৈরি করে পড়াশোনা শুরু করেন।[13] এর পূর্বে আব্দুল হামিদও স্থানীয় ঈদগাহ মাঠের পার্শ্বে একটি ছোট্ট মাদ্রাসা পরিচালনা করতেন। আব্দুল ওয়াহেদ বাঙ্গালী এবং সুফি আজিজুর রহমান উভয়েই হাবিবুল্লাহ কুরাইশি এবং আব্দুল হামিদের সাথে মিলিত হয়ে তাদের মাদ্রাসাদ্বয় একত্রিত করে হাটহাজারী বাজার সংলগ্ন জায়গায় স্থানান্তরের পরামর্শ প্রদান করেন।[14] পরবর্তীতে চারজন একসাথে পরামর্শ করে ১৮৯৯ সালে হাটহাজারী বাজারের পশ্চিমপার্শ্বে ফকিরের বাড়ির পাকা মসজিদের উত্তরে দীঘির দক্ষিণপাড়ে পুরাতন মিঠাহাঁটায়, পূর্ব-পশ্চিম ৫০ হাত লম্বা করে দক্ষিণমুখি দরজা রেখে স্থানীয় কিছু লোকের সাহায্যে একটা মাদ্রাসা ঘর নির্মাণ করেন।[14][3] অতঃপর হাবিবুল্লাহ কুরাইশি তার চারিয়া গ্রামস্থ মাদ্রাসায় সকালবেলা পড়াতেন। দুপুরের দিকে সমস্ত ছাত্রকে সাথে নিয়ে হাটহাজারী বাজারস্থ নতুন মাদ্রাসায় পড়ানো আরম্ভ করেন। অনুরূপ আব্দুল হামিদও তার ঝাড়ুয়া দীঘির পাড়ের মাদ্রাসায় সকালবেলা পড়াতেন এবং দুপুরে হাটহাজারী বাজারের নতুন মাদ্রাসায় ছাত্রদেরকে নিয়ে আসতেন। দুজনেই সুশৃঙ্খলভাবে নিয়মিত পড়াতে লাগলেন। ক্রমশঃ ছাত্রসংখ্যা বৃদ্ধি পেতে লাগল।[15] বাজার সংলগ্ন এলাকায় দিনের বেলায় শোরগোল সহ নানাবিধ অসুবিধার কারণে তারা মাদ্রাসাটি স্থানান্তরের চিন্তাভাবনা শুরু করেন।[15] মাদ্রাসা নির্মাণের জন্য জমির চাহিদার কথা জানতে পেরে গোলবদন জমিদার তার জমি দান করে দেন। তার দানকৃত জায়গায় ১৯০১ সালে স্থায়ীভাবে মাদ্রাসা স্থাপনের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।[3] সিদ্ধান্ত মোতাবেক ওয়াকফ সূত্রে পাওয়া জমিতে উত্তর-দক্ষিণ ৬০ হাত লম্বা এবং ১০ হাত প্রস্থ করতঃ পূর্বমুখী করে বাঁশের বেড়া দ্বারা উপরে ছনের ছাউনিবিশিষ্ট একটি মাদ্রাসা ঘর নির্মাণ করা হয়।[15] মাদ্রাসার ঠিক মাঝখানে একটি শাহী দরজা রাখা হয়, যেন মাদ্রাসা হতে পশ্চিম পার্শ্বের রাস্তার দিকে বের হওয়ার সুযোগ হয়।[16] প্রথম ৭ দিনে ৫০ জন ছাত্র ভর্তি হয়। এদের মধ্যে হাটহাজারী থানার বাইরে রাঙ্গুনিয়ার ১ জন ও বার্মার ১ জন ছাত্র ছিল।[3]
১৯০১ সালে স্থায়ীভাবে মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার পর হাবিবুল্লাহ কুরাইশি ও আব্দুল হামিদ নিয়মিত শিক্ষকতা করতেন এবং আব্দুল ওয়াহেদ বাঙ্গালী ও সুফি আজিজুর রহমান মাঝেমধ্যে মাদ্রাসায় এসে দেখভাল করতেন।[16] এভাবে মাদ্রাসার উন্নতি হতে থাকে। প্রায় দুবছর পর ছাত্রসংখ্যা অতিমাত্রায় বৃদ্ধি হওয়ায় খন্দকিয়া নিবাসী আবুল হাসানকে শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। তখন নিয়মিত তিনজন শিক্ষকের মধ্যে হাবিবুল্লাহ কুরাইশিকে 'আওয়াল সাহেব', আব্দুল হামিদকে 'দুয়াম সাহেব' এবং আবুল হাসানকে 'ছিয়ুম সাহেব' নামে আখ্যায়িত করা হতো।[16] চারবছর পর আব্দুল ওয়াহেদ বাঙ্গালী তাজবিদের শিক্ষক (কারী) হিসেবে নিয়োজিত হন। তার নিয়োগের পর ছাত্র ও শিক্ষকদের জন্য শৌচাগার, গোসলখানা ইত্যাদির ব্যবস্থা করা হয়, সকল ছাত্রদের উপর তাজবিদের সাথে কুরআন শিক্ষা করা বাধ্যতামুলক করে দেওয়া হয় এবং প্রতি সোমবার মাদ্রাসায় সাপ্তাহিক ওয়াজ মাহফিলের ব্যবস্থা করা হয়। হাতীনা দীঘির পশ্চিমপার্শ্বে একটি মসজিদ ছিল। আর সে মসজিদের মিম্বর ছিল মধ্যখানে। সে মিম্বরটি ভেঙ্গে ভেতরে কিছু প্রশস্ত করে এবং সামনে একটি বারান্দা বানিয়ে মাদ্রাসার ছাত্র ও শিক্ষকদের পাঞ্জেগানা নামায ও জুমার জন্য ঠিক করা হয়।[17]
তিন জন শিক্ষক ও একজন কারীর দ্বারা মাদ্রাসাটি চলতে থাকে। পরবর্তীতে ছাত্রসংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় মাদ্রাসায় ধারাবাহিক শিক্ষাস্তরগুলো চালু করা অপরিহার্য হয়ে পড়ে। ফলশ্রুতিতে সুফি আজিজুর রহমান, আফাজুদ্দিন এবং বাংলা বিষয়ের জন্য গুরান মাস্টারকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।[17] মাদ্রাসার পৃষ্ঠপোষকতার জন্য আশরাফ আলী থানভীকে অনুরোধ করা হলে তিনি উক্ত পদ গ্রহণ করেন এবং রশিদ আহমদ গাঙ্গুহির খলিফা জমিরুদ্দিন আহমদকেও উক্ত পদে নিয়োগ প্রদানের সুপারিশ করেন। থানভীর পাশাপাশি স্থানীয় হিসেবে জমিরুদ্দিন আহমদ এই মাদ্রাসার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। হাবিবুল্লাহ কুরাইশি জমিরুদ্দিন আহমদকে মাদ্রাসাটির আত্মা হিসেবে অবহিত করেন।[18] ধারাবাহিকভাবে মাদ্রাসার শিক্ষাক্রম উন্নতির পর কওমি মাদ্রাসা শিক্ষার সর্বোচ্চ স্তর দাওরায়ে হাদিস চালুর জন্য জমিরুদ্দিন আহমদের পরামর্শে ১৯০৮ সালে সাঈদ আহমদ সন্দ্বীপিকে মুহাদ্দিস পদে নিয়োগ প্রদান করা হয়।[19][20] তিনি প্রায় ৩৬ বছর মাদ্রাসার সদরুল মুদাররিস ও শায়খুল হাদিস ছিলেন। সাঈদ আহমদ সন্দ্বীপি মাহমুদ হাসান দেওবন্দির শিষ্য ছিলেন।[20] মাদ্রাসার কার্যপরিধি বৃদ্ধির পর প্রশাসনিক কার্যাবলী সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য থানভীর পরামর্শে হাবিবুল্লাহ কুরাইশিকে মাদ্রাসার প্রথম মহাপরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।[21] মাদ্রাসার কর্মপরিধি আরও বিস্তৃত হলে জমিরুদ্দিন আহমদের পরামর্শে ১৯৩০ সালে শাহ আবদুল ওয়াহহাব মাদ্রাসার সহকারী পরিচালক মনোনীত হন। ১৯৪১ সালে হাবিবুল্লাহ কুরাইশির মৃত্যুর পর শাহ আবদুল ওয়াহহাব মহাপরিচালক হিসেবে নিয়োগ পান। তিনি প্রায় ৪০ বছর এ দায়িত্বে ছিলেন, তার সময়কাল শাহ যুগ নামে পরিচিত।[22] তার সময়ে মাদ্রাসার অভূতপূর্ব উন্নতি ঘটে এবং মাদ্রাসাটি জাতীয় স্তরে উন্নীত হয়। প্রতিষ্ঠাকালীন সময় থেকে মাদ্রাসার নাম ছিল মাদ্রাসা মুঈনুল ইসলাম। তিনি নামটি সংস্কার করে আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম অর্থাৎ বর্তমান নামটি রাখেন।[23] তার প্রচেষ্টায় দাওরায়ে হাদিস পরবর্তী বিশেষায়িত পড়াশোনার জন্য ১৯৪৫ সালে ফতোয়া বিভাগ, ১৯৪৮ সালে আরবি বিভাগ, ১৯৫৫ সালে কিতাবত বিভাগ এবং ১৯৬৬ সালে কারিগরি প্রশিক্ষণ বিভাগ চালু হয়।[24] তার পৃষ্ঠপোষকতায় ১৯৫২ সাল থেকে মাদ্রাসার মুখপত্র মাসিক মুঈনুল ইসলাম নামে প্রকাশিত হতে থাকে।[25] ১৯৪১ সালে ব্রিটিশ সরকার ষড়যন্ত্রমূলকভাবে মাদ্রাসাটি বন্ধ করে দেয়। শাহ আবদুল ওয়াহহাব স্ব-উদ্যেগে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে মামলায় লড়ে যান, বছরখানেক পর মামলায় ব্রিটিশ সরকারের পরাজয় ঘটে এবং পুনরায় হাটহাজারী মাদ্রাসার পথচলা শুরু হয়। একারণে শাহ আবদুল ওয়াহহাবকে হাটহাজারী মাদ্রাসার দ্বিতীয় স্থপতিও বলা হয়।[26] তার প্রচেষ্টায় ১৯৪২ সালে ইব্রাহিম বালিয়াভি মাদ্রাসার সদরুল মুদাররিস হিসেবে যোগদান করেন।[27] ১৯৮২ সালে শাহ আবদুল ওয়াহহাবের মৃত্যুর পর মুহাম্মদ হামেদ তৃতীয় মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।[28] এসময় মাদ্রাসার মজলিসে শূরার সভাপতি ছিলেন হাজী মুহাম্মদ ইউনুস। ১৯৮৭ সালে মুহাম্মদ হামেদের মৃত্যুর পর হাজী মুহাম্মদ ইউনুস শাহ আহমদ শফীকে চতুর্থ মহাপরিচালক হিসেবে নিয়োগ প্রদান করেন।[29]
শাহ আহমদ শফীর আমলে চারতলা বিশিষ্ট নূর মঞ্জিল, চারতলা বিশিষ্ট মাদানি মঞ্জিল, ছয়তলা বিশিষ্ট আহমদ মঞ্জিল, চারতলা বিশিষ্ট দারুল আমান, মসজিদে বাইতুল আতিকের প্রতিষ্ঠা, মসজিদে বাইতুল করিমের পুনঃনির্মাণ, ছয়তলা বিশিষ্ট শিক্ষাভবন, চারতলা বিশিষ্ট মেহমানখানা, দুইতলা বিশিষ্ট তিনটি এবং একতলা বিশিষ্ট একটি শপিং কমপ্লেক্স নির্মিত হয়। জামিয়ার পশ্চিম পার্শ্বে রেলপথের পরিত্যক্ত ভূমি স্থায়ী লিজ নিয়ে সেখানে ছয় তলা বিশিষ্ট দুটি আবাসিক ভবন নির্মিত হয়। এছাড়া তার উদ্যোগে নিরবচ্ছিন্ন পানি সরবরাহের জন্য পানির ট্যাংক নির্মাণ এবং মাদ্রাসার অন্যান্য ভবনের আধুনিকায়ন ও সম্প্রসারণ কাজ সম্পন্ন হয়। তার উদ্যোগেই বিভিন্ন জায়গায় বেহাত ও জবরদখল হওয়া জমি পুনরায় মাদ্রাসার দখলে আসে।[30] ১৯৯৫ সালে মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার শতবর্ষপূর্তি উপলক্ষে 'শতবার্ষিকী দস্তারবন্দি মহাসম্মেলন' অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে মাদ্রাসার প্রায় ১০ সহস্রাধিক স্নাতকোত্তরকে দস্তারে ফজিলত বা সাম্মানিক পাগড়ি প্রদান করা হয়। উক্ত শতবার্ষিকী মহাসম্মেলন পরবর্তী ২০০২ সালে তার তত্ত্বাবধানে অনুষ্ঠিত হয় 'সপ্তবার্ষিকী দস্তারবন্দি মহাসম্মেলন'।[30] মাদ্রাসার দাওরায়ে হাদিসের ছাত্রদের সংখ্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি হওয়াতে সপ্তবার্ষিকী মহাসম্মেলনের পর থেকে শুরু করে বর্তমানে প্রতি বছর বার্ষিক মাহফিলের সাথে দস্তারবন্দি সম্মেলনও অনুষ্ঠিত হচ্ছে।[30] ২০১০ সালে শাহ আহমদ শফী হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ গঠন করেন এবং মাদ্রাসাটি হেফাজতের কেন্দ্রীয় কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হয়।[31][32] ২০১৩ সালে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের ব্যাপক আন্দোলনের মাধ্যমে মাদ্রাসাটিও ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে। পাণ্ডিত্য আর নাস্তিক ইস্যু শাহ আহমদ শফীকে কওমি ধারার একক নেতায় পরিণত করে।[33] ফলশ্রুতিতে তার প্রচেষ্টায় সরকার ২০১৮ সালে কওমি মাদ্রাসাসমূহের দাওরায়ে হাদিসের সনদকে মাস্টার্স ডিগ্রির সমমান প্রদান আইন, ২০১৮ পাস করে কওমি মাদ্রাসার সনদকে সরকারি স্বীকৃতি প্রদান করে।[34]
২০২০ সালে ৫ দফা দাবি নিয়ে এই মাদ্রাসায় ছাত্র আন্দোলন সংগঠিত হয়। ছাত্রদের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে ২০২০ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর রাতে শাহ আহমদ শফী স্বেচ্ছায় মহাপরিচালকের পদ থেকে অব্যাহতি নেন। অব্যাহতি নেওয়ার পরদিনই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।[35] তাকে মাদ্রাসা সংলগ্ন কবরস্থানে দাফন করা হয়। ১৯ সেপ্টেম্বর মাদ্রাসাটি পরিচালনার জন্য তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠিত হয় এবং জুনায়েদ বাবুনগরীকে মাদ্রাসার শিক্ষা পরিচালক ও প্রধান শায়খুল হাদিস হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।[36] ২০২১ সালের ১৯ আগস্ট জুনায়েদ বাবুনগরী মৃত্যুবরণ করেন। ২০২১ সালের ৮ সেপ্টেম্বর মজলিসে শূরার বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়, বৈঠকে আব্দুস সালাম চাটগামী পঞ্চম মহাপরিচালক এবং শেখ আহমদ শায়খুল হাদিস মনোনীত হন। মজলিসে শূরার বৈঠক চলাবস্থায় আব্দুস সালাম চাটগামী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন, ফলশ্রুতিতে ইয়াহইয়া আলমপুরীকে ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।[37] ২০২২ সালের ৯ জুন মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মজলিসে শূরার বৈঠকে ইয়াহইয়া আলমপুরীকে ষষ্ঠ মহাপরিচালক হিসেবে মনোনীত করা হয়।[38] ইয়াহইয়া আলমপুরী ২০২৩ সালের ২ জুন মৃত্যুবরণ করেন। ৩ জুন অনুষ্ঠিত মজলিসে শূরার বৈঠকে সপ্তম মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পান খলিল আহমদ কাসেমী।[39] বর্তমানে খলিল আহমদ কাসেমী মাদ্রাসার মহাপরিচালক, শোয়াইব জমিরি সহকারী পরিচালক, শেখ আহমদ শায়খুল হাদিস, মুফতি জসিম উদ্দিন সহযোগী পরিচালক, কবির আহমদ শিক্ষা পরিচালক এবং মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী সদরে মুহতামিম ও মাদ্রাসার সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী পরিষদ মজলিসে শুরার সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।[40][39]
২০১০ সালে এই মাদ্রাসা থেকে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের জন্ম হয়, যা ২০১৩ সালে সরকার বিরোধী কর্মসূচির মাধ্যমে ব্যাপকভাবে আলোচনায় আসে। সংগঠনটির আমির ছিলেন মাদ্রাসার মহাপরিচালক শাহ আহমদ শফী ও মহাসচিব ছিলেন মাদ্রাসার সহকারী পরিচালক জুনায়েদ বাবুনগরী। মাদ্রাসাটিতে আহমদ শফীর পরে জুনায়েদ বাবুনগরীর অবস্থান ছিল। ২০১৩ সালে আন্দোলনের পর থেকে উভয় নেতার মধ্যে চিন্তাগত পরিবর্তন আসে। আহমদ শফী আস্তে আস্তে সরকার বিরোধী অবস্থান থেকে সরে আসেন এবং জুনায়েদ বাবুনগরী তার অবস্থানে অটল থাকেন।[41] আহমদ শফীর এই পরিবর্তনের পিছনে তার ছেলে আনাস মাদানীকে দায়ী করা হয়। যিনি পিতার প্রভাব খাটিয়ে নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িত হন। আনাস মাদানী ও তার সমর্থকরা মাদ্রাসার পরিচালনা কমিটির বৈঠক করে মাদ্রাসার সহকারি পরিচালকের পদ থেকে জুনায়েদ বাবুনগরীকে সরিয়ে দেওয়ার পর দুই গ্রুপের মধ্যে দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে চলে আসে।[42] যার পরিপ্রেক্ষিতে আনাস মাদানীকে অপসারণ, আহমদ শফীকে মহাপরিচালকের পদ থেকে সরিয়ে উপদেষ্টা বানানো সহ ৫ দফা দাবি নিয়ে ২০২০ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর ছাত্ররা আন্দোলন শুরু করে।
এই মাদ্রাসার আয়তন ৪.৪৩ একর বা ১৭,৯২৭ বর্গমিটার। মাদ্রাসার শিক্ষাব্যবস্থা সম্পূর্ণ অবৈতনিক। শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের জন্য প্রচলিত দলীয় রাজনীতি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।[3] পুরনো শিক্ষাক্রমকে অক্ষুন্ন রেখে যুগোপযোগী আধুনিক সিলেবাসে কুরআন, হাদিস, ফিকহ, তাসীর মানতিক, ফালসফা, দর্শন, ইতিহাস, বালাগাত, সাহিত্য, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান শিক্ষাদানের পাশাপাশি উচ্চতর গবেষণার জন্য এক/দুই বছর মেয়াদী তাখাসসুস ফিত তাফসীর, তাখাসসুস ফিল হাদিস, তাখাসসুস ফিল ফিকহ, তাখাসসুস ফিল কিরাত, তাখাসসুস ফিল আদব, তাখাসসুস ফিদ দাওয়াহ ওয়াল ইরশাদ, দারুত তাসনীফ, বাংলাভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, হিফজ বিভাগ, নূরানী ও হস্তলিপি বিভাগ চালু রয়েছে।[1] মাদ্রাসার একদল আলেম ওয়াজ-মাহফিল, বক্তৃতা-বিবৃতি এবং মিটিং-প্রতিবাদের মাধ্যমে ইসলাম ও মুসলমানদের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন।[3] দেশের বিশিষ্ট ইসলামি পণ্ডিত এবং স্থানীয় ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের নিয়ে মাদ্রাসার নীতি নির্ধারণী সংস্থা মজলিসে শুরা গঠিত হয়।[9] মাদ্রাসাটি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের মধ্যে রয়েছে, এমন একটি দল তৈরি করা যারা তাদের তীক্ষ্ণ লেখনী এবং চিত্তাকর্ষক বাগ্মীতার দ্বারা ইসলামি পুনর্জাগরণে অবদান রাখবে। তবে এই ইসলামি নবজাগরণ বুদ্ধিবৃত্তিক সৃজনশীলতা নয় বরং ঐতিহ্যবাহী ইসলামি প্রতিষ্ঠান ও অনুশীলনের পুনরুজ্জীবন এবং সত্যিকার বিশ্বাসী ও অনুশীলনকারী মুসলমানদের একটি সমাজ তৈরি করা। তাবলিগ জামাতের সঙ্গে মাদ্রাসাটির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। মাদ্রাসার শিক্ষকরা তাদের ছাত্রদের অনুমতির পাশাপাশি তাবলিগ জামাতের কার্যক্রমে অংশগ্রহণের জন্য উৎসাহিত করে।[9]
দারুল উলুম হাটহাজারীর প্রচার ও প্রকাশনা বিভাগ থেকে প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য প্রকাশনা:
দারুল উলুম হাটহাজারীর ছাত্রসংখ্যা প্রায় ৮০০০ জন। দাওরায়ে হাদিস বা স্নাতকোত্তর শ্রেণীতে অধ্যয়নরত রয়েছে ২৩১৮ জন।[1] ২০২২ সালে প্রায় ২৫০০ জন দাওরায়ে হাদিস সমাপ্তকারী শিক্ষার্থীকে সাম্মানিক পাগড়ি প্রদান করা হয়।[47] দারুল উলুম হাটহাজারীর উল্লেখযোগ্য প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের মধ্যে রয়েছে: শাহ আবদুল ওয়াহহাব, শাহ আহমদ হাসান, ছিদ্দিক আহমদ, হাজী মুহাম্মদ ইউনুস, শাহ আহমদ শফী, হারুন বাবুনগরী, মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী, জুনায়েদ বাবুনগরী, মুফতি ফয়জুল্লাহ, জমির উদ্দিন নানুপুরী, মুফতি আবদুর রহমান, আশরাফ আলী বিশ্বনাথী, নুরুল ইসলাম জিহাদী, মিজানুর রহমান সাঈদ, জিয়া উদ্দিন, ইয়াহইয়া আলমপুরী, জাফরুল্লাহ খান ও সাজিদুর রহমান প্রমুখ।
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.