একটি লাইট নোভেল (ライトノベル, রায়টো নোবেরু) হলো প্রধানত হাই স্কুল এবং মিডল স্কুলের শিক্ষার্থীদের জন্যে কেন্দ্র করে লেখা জাপানিজ উপন্যাসের বিশেষ ধরন।[1][2] "লাইট নভেল" কথাটি এমন একটি জাপানীজ শব্দ বা পদ যা ইংরেজী ভাষা থেকে নেওয়া হয়েছে। লাইট নভেলগুলিকে অনেকসময় রানোবে (ラノベ)-ও বলা হয়ে থাকে,[3] অথবা ইংরেজিতে "এলএন"। একটি লাইট নভেলে গড় ৫০,০০০ শব্দ থাকে, প্রায় একটি ওয়েস্টার্ন নভেলের মতো।[4] এগুলিকে মূলত "বুনকোবোন" আকারে (A6,10.5 cm × 14.8 cm) ছাপানো হয় এবং প্রায়ই এদের প্রকাশনার বেশ জটিল সময়সূচি থেকে থাকে।

Thumb
ম্যাকাওতে একটি লাইট নভেল বইয়ের দোকান

লাইট নভেলের প্রচ্ছদ সাধারনত মাঙ্গা অঙ্কনরীতি অনুযায়ী আঁকা হয় এবং এগুলি প্রায়শই মাঙ্গা আর অ্যানিমে-তে অভিযোজিত হয়। বেশিরভাগ লাইট নভেলগুলিই পুস্তকারে প্রকাশিত হয়, কিন্তু কিছু কিছু লাইট নভেল, বই হিসেবে ছাপানোর আগে মাঙ্গার মতো প্রথমে অ্যানথোলজি পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ হয়ে থাকে।।

বিবরন

লাইট নভেলগুলি জাপানের সাময়িক পত্রিকা মাধ্যম থেকে উদ্দীপিত হয়। পাঠকদের সন্তুষ্ট রাখতে বেশিরভাগ জাপানিজ সাময়িক পত্রিকাগুলি প্রত্যেকটি গল্পের শুরুতে চিত্রন অন্তুর্ভুক্তি শুরু করে এবং তারই সাথে পাশাপাশি বিভিন্ন অ্যানিমে, সিনেমা আর ভিডিও গেম-এর সম্বন্ধে নিবন্ধ প্রকাশ করে। এইসমস্ত কিছু নতুন প্রজন্মকে খুশি করতে সফল হয় ও লাইট নভেলগুলি জনপ্রিয় স্টাইলে চিত্রনের সংস্পর্শে আসে। বিখ্যাত সিরিয়ালগুলিও এদিকে উপন্যাস হিসেবে প্রকাশিত হতে থাকে।

প্রায়শই লাইট নভেলগুলি অ্যানিমে, মাঙ্গা আর লাইভ-অ্যাকশন সিনেমার রূপে অভিযোজিত হওয়ার জন্যে নির্বাচিত হয়ে থাকে। তবে এদের মধ্যে কিছু আবার সাহিত্য পত্রিকায় সিরিয়ালাইজড করা হয়।

লাইট নভেলের আরেকরকম পরিচয় আছে "অধিক সংখ্যায় সৃষ্ট ও নিষ্পত্তিযোগ্য" হিসেবে। এর চরমরকম একটি উদাহরণ হলো কাজুমা কামাচি, যিনি দু'বছর ধরে নিরলসভাবে প্রত্যেক মাসে একটি করে উপন্যাস লিখে এসেছেন এবং তার ক্ষেত্রে ব্যবসায় খাটিয়ে থাকা অর্থের হারটা বেশ অধিক ছিল।[5] এভাবেই, প্রকাশনা সংস্থাগুলি বার্ষিক প্রতিযোগিতা আয়োজনের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত নতুন প্রতিভার খোজ করতে থাকে। প্রতিযোগিতার পুরস্কার হিসেবে বিজেতাকে অর্থ এবং তার লেখনী প্রকাশ করতে দেওয়া হয়। দেনগেকি নভেল প্রাইজ হচ্ছে এই সমস্ত প্রতিযোগিতাগুলির মধ্যে বৃহত্তম, যেখানে ২০১৩ সালে ৬,৫০০ এরও বেশি লেখা জমা পড়েছিল।[6] প্রত্যেক লেখনীগুলিকে "লাইট নভেল" হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় এবং কম পয়সার নরম মলাটের বই হিসেবে প্রকাশিত করা হয়। উদাহরণস্বরূপ জাপানে "হারুহি সুজুমিয়া" উপন্যাসটির দাম হলো ¥৫৪০ (৫% ট্যাক্স সমেত), লাইট নভেল আর সাধারন সাহিত্যে ব্যবহৃত মলাটের সমান। ২০০৭ সালে জাপান সরকারের ওয়েবসাইট অনুযায়ী জানা যায় যে লাইট নভেলের বাজারে বার্ষিক ৩০ মিলিয়ন কপি প্রকাশ করা হয়েছিল।[3] কাদোকাওয়া গ্রুপ হোল্ডিং-এর কাদোকাওয়া স্নেকার বুকস আর ডেনগেকি বুকস, বর্তমান বাজারে ৭০% থেকে ৮০% পর্যন্ত শেয়ারে রয়েছে। ২০০৯ সালে লাইট নভেলগুলি বিক্রয়ের মাধ্যমে ¥৩০.১ বিলিয়নের ভাগ বসাতে সক্ষম হয়।[7]

বর্তমানে জাপানিজ লাইট উপন্যাসগুলির বহু লাইসেন্সপ্রাপ্ত ইংরেজী অনুবাদের পাওয়া যায়। এগুলি বাজারে তানকোবোন মাঙ্গার মতো অনেকরকম মলাটে প্রকাশিত হয়ে থাকলেও, ২০০৭ সালের এপ্রিল মাসে সেভেন সিজ এন্টারটেইনমেন্ট-এর হাত ধরেই প্রথমবার লাইট নভেলগুলির ইংরেজি ভাষায় অনুবাদের শুরু। [8] ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ করে এমন কয়েকটি বিশিষ্ট প্রকাশকের নাম হলো- টোকিওপপ, ভিজ মিডিয়া, ডিএমপি, ডার্ক হর্স, ইয়েন প্রেস এবং ডেল রে মাঙ্গা। ভিজ মিডিয়ার প্রতিষ্ঠাতা, সেইজি হোরিবুচি দূরকল্পনা করেছেন, যেদিন থেকে লাইট নভেলগুলি আমেরিকার পাঠকদের কাছে স্বীকৃতি লাভ করবে, সেদিন থেকেই জাপানের মতো যুক্তরাষ্ট্রের বাজারেও লাইট নভেলগুলি ভারী জনপ্রিয় হয়ে উঠবে।[9]

বেশিরভাগ লাইট নভেলগুলিই জাপানি লেখকদের দ্বারা প্রকাশিত হয়ে থাকে, কিন্তু এর কিছু ব্যতিক্রমও লক্ষ করা যায়। যেমন ইউ কামিয়া হলেন একজন জাপানি-ব্রাজিলিয়ান লেখক, যিনি জাপানের বাসিন্দা হয়ে তার উপন্যাসগুলি প্রধান জাপানি প্রকাশনা লেবেলের মাধ্যমে প্রকাশিত করেন।।

ইতিহাস

জাপানে জনপ্রিয় সাহিত্যগুলির বেশ বৃহৎরকমের প্রথা উপস্থিত রয়েছে। সস্তা হলেও লাইট নভেল অন্তর্ভুক্ত পাল্প নভেলগুলি জাপানে কয়েক দশক আগেও বর্তমান ছিল। ১৭৯৫ সালের সোনোরামা বুনকো-র সৃষ্টিকে অনেকে এই সাহিত্যরীতির সূচনা বলে মনে করেছেন। কল্পবিজ্ঞান ও ভৌতিক কাহিনী লেখক হিদেউকি কিকুচি এবং বাকু ইউমেমাকুরা তাদের কেরিয়ার এই লাইট নভেলগুলির মাধ্যমেই শুরু করেছিলেন। অ্যানিমে নিউজ নেটওয়ার্কে কর্মরত কিম মোরিসির প্রতিবেদন অনুসারে কল্পবিজ্ঞান ও কল্পলেখা (ফ্যান্টাসি) ফোরামের প্রস্তুতকারী কেইতা কামিকিতা প্রথম এই "লাইট নভেল" শব্দটি ১৯৯০ সালে ব্যবহার করেন। ১৯৮০ সালে সৃষ্ট কল্পবিজ্ঞান ও কল্পলেখার উপন্যাসগুলি যেহেতু ভারী মাত্রায় পাঠকদের আকর্ষণ করতে শুরু করে, কামিকিতা উপলদ্ধি করেন যে এই উপন্যাসগুলি শুধুমাত্র কোনো নির্দিষ্ট শ্রেণীর মানুষদের জন্যে প্রিয় হয়ে ওঠেনি, তাই তিনি "নবীন প্রাপ্তবয়স্ক" মাধ্যম হিসেবে এই লাইট নভেলগুলির বিচার করেননি।[5]

নব্বই' এর দশকে বহু লোকেরা সেসময়কার বিখ্যাত "স্লেয়ারস" সিরিজটি দেখেছিলেন, যেটি ফ্যান্টাসি-আরপিজিগুলিকে হাস্যরসের সাথে একীভূত করেছিল। কয়েক বছর পর মিডিয়াওয়ার্কস দেনগেকি বুনকো নামে একটি সাহিত্য সঞ্চার করে যা পরবর্তীকালে আজকের সময়ে বহু লাইট নভেলের জন্ম দিয়েছে। তাদের প্রথম সফল হিট "বুগিপপ সিরিজ" খুব দ্রুত অ্যানিমে পর্দায় ফুটে উঠেছিল এবং প্রচুর সাহিত্যপ্রেমী দর্শক তা দেখেও ছিলো।

শুরুর দিকে দেনগুকি বুনকো লেখকরা ধীরে ধীরে সবার নজরে আসছিল কিন্তু ২০০৬ সালে লাইট নভেলগুলি হঠাৎ বিশালকার জনপ্রিয়তা লাভ করলো। "হারুহি সুজুমিয়া" সিরিজের সফল মুক্তির পর বহু প্রকাশক ও পাঠক লাইট নভেলে আকর্ষিত হলো এবং তাদের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পায়।

২০০০ সালের শেষে জাপানিজ টু-ডি কালচারে লাইট নভেলগুলি অনবদ্য ভূমিকা পালন করে। এমন একটি উল্লেখযোগ্য সিরিজ হলো "আ সার্টিন ম্যাজিকাল ইনডেক্স", প্রত্যেক খন্ড প্রকাশনার সাথে এটি হাজার হাজার কপি বিক্রি করতে থাকে। বিভিন্ন লাইট নভেলের বিক্রয় সংখ্যা ক্রমাগত প্রতি বছর বৃদ্ধি হতে থাকে এবং এদের প্রচ্ছদ অঙ্কনের জন্যে সাধারনত পিক্সিভ থেকে বিশিষ্ট শিল্পীদের ডাকা হয়। সর্বাধিক সফল হওয়া উপন্যাসগুলি মাঙ্গা, অ্যানিমে আর লাইভ-অ্যাকশন সিনেমায় অভিযোজিত হয়ে যায়।

২০০০ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে বহু প্রকাশকরা ওয়েব ফিকশন লেখকদের সাথে তাদের ব্লগ বা ওয়েবসাইট থেকে যোগাযোগের মাধ্যমে লেখা প্রকাশনা করতে থাকে। এভাবে প্রকাশিত লেখাগুলি প্রায়শই এমনভাবে সংশোধিত হয় যে মূল গল্পটিই পরিবর্তন হয়ে যায়। ফলে অনলাইনে পড়া পাঠকরা সংশোধিত নতুন প্রকাশিত গল্পটিও পড়তে ইচ্ছুক হতে পারে।[5] বিনামূল্যে উপন্যাস প্রকাশনার ওয়েবসাইট শোসেতসুকা নি নারো হলো এমনরকম সম্পাদনার জন্যে বিখ্যাত। জনপ্রিয় ওয়েব নভেল যেমন "সোর্ড আর্ট অনলাইন", "দ্যাট টাইম আই গোট রিইনকারনেটেড অ্যাস আ স্লাইম", "ওভারলর্ড", "রি:জিরো", "কোনোসুবা" - এভাবেই প্রকাশনার মাধ্যমে গোটা বিশ্বে খ্যাতি লাভ করেছে।

সাম্প্রতিককালে, পশ্চিমের দেশগুলিতে লাইট নভেল প্রকাশনার জন্যে 'ইয়েন প্রেস' এগিয়ে এসেছে, যা হাচেত্তে আর জাপানিজ প্রকাশক কাদোকাওয়ার যৌথ উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত।[10] অন্যান্য প্রকাশক যেমন সেভেন সিজ্, ভিজ মিডিয়া, ভার্টিক্যাল আইএনসি., ওয়ান পিস বুকস, জে-নভেল ক্লাব, ক্রস ইনফিনিট ওয়ার্ল্ডস, সল প্রেস এখনো পর্যন্ত একাধিক লাইট নভেল ইংরেজি ভাষায় প্রকাশনা করার চেষ্টা করে চলেছে।[10] এছাড়াও, লাইট নভেল লেখকরা বিদেশে আয়োজিত অ্যানিমে সম্মেলনে অতিথি হিসেবে উপস্থিত হওয়াও শুরু করেছেন। গত বছরেই 'অ্যানিমে এক্সপো' বছরের সবচাইতে বড়ো অ্যানিমে সম্মেলনের আয়োজন করেছিল, যেখানে "গবলিন স্লেয়ার"-এর লেখক কুমো কাগিউ ও "ইস ইট রঙ্গ টু পিক আপ গার্লস ইন আ ডানগিয়ন?"-এর লেখক ফুজিনো ওমরিকে ডাকা হয়েছিল।[10]

লাইট নভেল সাহিত্যে একটি জনপ্রিয় ধারা হলো "ইসেকাই" (異世界) বা "ভিন্ন জগৎ"-এর কাহিনী। এইরকম গল্পে সাধারনত এমন একটি আধুনিক দুনিয়ার সাধারন মানুষকে কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে রাখা হয়, যে অজান্তেই হঠাৎ একটি ভিন্ন জগতে স্থানান্তরিত হয়ে যায়।[10] "সোর্ড আর্ট অনলাইন" ওয়েব নভেলটি ২০০২ সালে প্রথমবার প্রকাশিত হয়েছিল। এটিই মূলত সেসময় 'ইসেকাই' ধারার বিস্তার ঘটিয়েছিল।[11] এই ওয়েব নভেলটি পরে অনেক বিখ্যাত হয়ে যায়। এটিকে অ্যানিমে, মাঙ্গা, সিনেমা আর স্পিনঅফ সিরিজে অভিযোজিত করা হয়। এই উপন্যাসের বিস্তৃতি লাভের জন্যে "কোনোসুবা" ও "রি:জিরো"-র মতো উপন্যাসের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেতে থাকে।[11] "সোর্ড আর্ট অনলাইন"-এর সাফল্য এবং 'ইসেকাই' সাহিত্যধারার খ্যাতি, জাপানের ফিকশন বিষয়ক ওয়েবসাইটগুলিতে নবীন লেখকদের সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটায় ও তাছাড়াও পশ্চিমে লাইট নভেলের বিস্তৃতির প্রসার হয়।[11]

আরও দেখুন

তথ্যসূত্র

Wikiwand in your browser!

Seamless Wikipedia browsing. On steroids.

Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.

Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.